বাথরুমের দরজা আটকে বেসিনের দিকে চোখ ফেরাতেই অতসীর চোখে পড়ে এলোমেলোভাবে রাখা একগাদা টয়লেট্রিজ। এমনিতেই ব্যাচেলর বাসায় আলাদা একটা গন্ধ থাকে, এই বাসায়ও আছে। আর বাথরুমে সকল শ্যাম্পু বডিওয়াশ হয় এডিডাস, নয় নিভিয়া মেন আর তা না হলে জিলেটের।দুই একটা অপরিচিত নাম চোখে পড়লো, উচ্চারণ জানে না সে। মাথাও ঘামায় না এসব নিয়ে। পলাশের ব্র্যান্ডপ্রীতির সামান্য আভাস সে আগেই পেয়েছে। থ্রি ইডিয়টস ছবির নায়িকার ফিয়াসের কথা মনে পড়ে তার- নায়ক তাকে মজা করে ডাকে ‘প্রাইস ট্যাগ’, যে কোন জিনিসের দাম উল্লেখ করে কথা বলে সে। বিয়ের যে শেরাওয়ানি নষ্ট হয়েছে বলে‘মেরি দেড় লাখ কি শেরওয়ানি’ বলে চিৎকার শুরু করে, সেটা দেখলে মনে হয় মধ্যবিত্ত বাড়ির পর্দা কিংবা সোফার কাভার বানাবার ফেব্রিক দিয়ে তৈরি। অতটা প্রাইস ট্যাগ মার্কা না হলেও পলাশকে মনে হয়েছে জিনিসপত্র নিয়ে খানিক ফুটানি আছে ওর। কিংবা ওর মতন সামাজিক অবস্থানে যারা থাকে তাদের জন্য হয়তো এটাই স্বাভাবিক। দেখা যাক কনডম কোন ব্র্যান্ডের কিনেছে।
অতসী আজকে পলাশের বাসায় যে উদ্দেশ্যে এসেছে তা দুজনের কাছেই মোটামুটি পরিষ্কার, কোন ভুল বোঝাবুঝির অবকাশ নেই। কিছুদিন টেক্সটে যোগাযোগ হবার পর তারা দেখা করেছে ময়মনসিংহের একটি ক্যাফেতে। সেখানে অতসী আগে খুব বেশিবার যায়নি। আড়াইশো টাকা দিয়ে কফি আর সাড়ে তিনশো টাকার পাসতা খাবার সামর্থ তার এই মুহুর্তে নেই। পলাশকে অবশ্য সেকথা বুঝতে দেয়নি সে। কী খাবে জিজ্ঞেস করাতে সে জানিয়েছে তার খুব একটা খিদে নেই, জুস হলেই চলবে। পলাশ তখন মুচকি হেসে বলেছে,“কফিডেটে এসে জুস? কেমন একটা হয়ে গেল না?” ওর ঠোঁটে লেগে থাকা হাসিটা দেখে তখন ওকে বেশ আকর্ষনীয়ই লাগছিলো। ও এসেছিলোও বেশ সেজেগুজে। ছোট মফস্বল শহরের ছেলেরা এত পারফিউম মাখে না। আর ময়মনসিংহের ছেলেরা তো অধিকাংশই ঠিকমত প্যান্ট আর জুতা পরতেই জানে না। অনেকেরই প্যান্টের ঝুল থাকে বড়, গোড়ালির কাছে সেই ঝুল বেঁকে স্যান্ডেলের তলায় চলে যায়। শুধুমাত্র জিনসের তলা স্যান্ডেলের তলায় ফেলে ময়লা করে হাঁটা দেখে যথেষ্ট সুদর্শন এক ছেলেকে রিজেক্ট করেছিল সে কলেজে পড়বার সময়। ফ্লার্টের জন্য লাগসই লাইন মাথায় না আসাতে অতসী তখন বলেছে “আমি সন্ধ্যার পর কফি খাইনা, স্লিপিং ডিজঅর্ডার হয়”। আড়াইশো টাকার ড্রাগনের জুস খেতে খেতে তার মনে হয়েছে, আহা এই টাকায় অন্তত এক কেজি ড্রাগন ফল কেনা যেতো। এই গরিবি চিন্তা সে নিজের পেটেই রেখেছে, মুখে বলেনি।
ছেলেদের সঙ্গে সম্পর্ক করার ব্যাপারে অনেককগুলো টিপস দিয়েছিল তাকে তার রুমমেট রুবা।তার মধ্যে একটি হচ্ছে “নেভার বি হাম্বল”।অতসীর ছেলেদের সঙ্গে মেশার অভিজ্ঞতা অনেক থাকলেও ইন্টিমেট রিলেশনে সে কখনো যায়নি। অবকাশ ছিল না তার। মাকে সারাজীবন বিছানায় পড়ে থাকতেই দেখেছে সে। ক্লাস সেভেনে পড়ার সময় থেকে বাসা সামলাতে হতো তাকে। বুয়া কামাই দিলেই তার উপর দায়িত্ব পড়তো রান্না করার। একবার ভাতের মাড় ফেলতে গিয়ে হাত পুড়ে গেল। পরদিন বাবা রাইস কুকার কিনে এনে দিলেন। পুরনো দিনের কথা মনে পড়ে অতসীর চোখ জ্বালা করে,গলার কাছে দলা পাকিয়ে ওঠে শক্ত একটা জিনিস। তাদের কত সুন্দর একটা পরিবার ছিল। সবকিছু কীভাবে ওলট পালট হয়ে গেল। নিজের অজান্তেই সে বেসিনের আশেপাশের সবগুলো জিনিসপত্র গোছাতে শুরু করে। কয়েকটি শিশির মুখ আলগাভাবে রাখা,দুই একটি প্যাকেট পড়ে আছে পাশেই, কিন্তু জিনিসগুলো তাতে ঢোকানো নেই। পলাশকে ইমপ্রেস করার ইচ্ছায় নয়, অগোছালো দেখলে তার নিজের অস্বস্তি লাগে। এলোমেলো টেবিলে সে পড়তে পারে না। রুবাআপুর সঙ্গে তার চমৎকার সম্পর্ক থাকলেও ঘর গোছানো নিয়ে তাদের মনোমালিন্য হয়ে যেতো প্রায়ই।রুবা ছিল অত্যন্ত এলোমেলো স্বভাবের। নিজের কোন জিনিস সে গুছিয়ে রাখতে পারতো না। এমনকি পরীক্ষার আগে এডমিট কার্ড পর্যন্ত খুঁজে পেতো না।
আজকে তেত্রিশ দিন হল পলাশের সঙ্গেতার নিয়মিত যোগাযোগ শুরু হয়েছে। এটা রিলেশনশিপ কিনা তা নিয়ে স্পষ্ট কথাও হয়ে গেছে দিন দশেক আগে, যদিও কাউকেই জানায়নি এখনও। গত এক মাস ধরেই সে প্রতি পদে পদে রুবার উপদেশ মেনে চলেছে।রুবার থিওরি হল, মেয়েদের হতে হবে নরমসরম,ন্যাকা টাইপ। তা না হলে ছেলেরা সেই মেয়েদের অন্তত গার্লফ্রেন্ড হিসেবে চাইবে না। কোন মেয়ে খুব স্ট্রং হলেই তাদের মনে হয় এই মেয়ে তাকে কন্ট্রোল করে, সেই পয়েন্ট থেকে তাদের ইগো হার্ট হতে থাকে। এই মেলইগো নিয়ে ওরা না পারে আরামে থাকতে, না পারে উগরে ফেলতে। তখন তারা চিটিং করে। এরচেয়ে ভাল হচ্ছে এদের ইগোকে স্যাটিস্ফায়েড হতে দেওয়া। “এমন একটা ভাব করবি যেন তুই কিছুই বুঝিস না, কিছুই পারিস না” এমন উদ্ভট হাইপোথিসিস শুনে সে প্রায় হেসে ফেলেছিল।
“নেকু সেজে থাকলে কি ছেলেরা চিট করে না?”
পায়ের উপর পা তুলে নাচাতে নাচাতে রুবা বলেছিল, “তা হলেও চিটিং করতে পারে,গ্যারান্টি নাই কোন”
“তাইলে ঢং কইরা লাভ কী?’
“নিজের আরাম”, রুবা নির্বিকারে বলেছিল,“গিফট পাবি,অ্যাটেনশন পাবি, ইউ’ল বি ট্রিটেড লাইক আ কুইন” তারপর একটু হেসে বলল,“তার আগে প্রমাণ করতে হবে ইউ ওয়্যার বর্ন আ প্রিন্সেস”।
রুবা তার চেয়ে মাত্র দুই বছরের বড় হলেও পুরুষদের সম্পর্কে তার অভিজ্ঞতা অনেক। তার প্রথম প্রেমিককে নাকি সে শাবানার মতন নিষ্ঠায় সেবাযত্ন করেছে, ফলে তাকে কাজের বেটি হয়েই থাকতে হয়েছে মেলাদিন।সেটা ইন্টারমিডিয়েট পড়বার সময়ের কথা। সেই সম্পর্ক ভাঙবার পর সে নিজের মেধা ব্যক্তিত্ব আর যোগ্যতা নিয়ে বেশ আকর্ষণীয় মেয়ে হিসেবে বিশ্ববিদ্যালয়ের চৌহদ্দিতে পা দিয়েছিল। তখন তার বয়স কম হলেও আত্মসম্মানবোধ বেশ হয়েছে। প্রেমের জন্য ব্যক্তিত্ব বিসর্জন দেওয়া যাবে না এমন একটা জ্ঞান হয়েছে। তার বহু এডমায়ারার থাকলেও কারো সঙ্গেই ঘনিষ্ঠতা মাসখানেকের বেশি টেকেনি। রুবার মতে “আই ওয়াজ টু শার্প ফর দেম”। অতসী জিজ্ঞেস করেছিল, তাকে দেখলেই তো বোঝা যায় সে শার্প। সেই ছেলেগুলি তাহলে আগ্রহী হতই বা কেন? চেহারা বা সৌন্দর্যের জন্য কী?“আরে ধুর, আমি কি আর দেখতে সুন্দরী নাকি? ছেলেদের মধ্যে একটা টেমিং অব দ্য শ্রু টেন্ডেন্সি থাকে। তারা মনে করে এগ্রেসিভ মেয়েদের বশ করতে পারলেই সেটা খুব শিভালরি। নাইলে ভ্যান্দাচোদা মেয়ের কি অভাব নাকি?”
অতসী তখন বুঝতে পারে রুবা আসলে তার ক্যাম্পাসের প্রথম প্রেমিকের কথা বোঝাচ্ছে। বছরখানেক প্রেম করেছে সে বিবিএ ডিপার্টমেন্টের এক সুদর্শন ছেলের সঙ্গে। তার ক্লাসমেট পুতুলের মতন দেখতে আরেকটি মেয়ে সেই ছেলেটিকে খুব পছন্দ করতো, ছেলেটি মোমের মতন ফর্সা মেয়েটির বদলে রুবাকে বেছে নেওয়ার পেছনের লজিক হিসেবে সে টেমিং অব দ্য শ্রু থিওরির প্রবর্তন করেছে। রুবা দেখতে প্রচলিত অর্থে সুন্দরী নয়, দুধে আলতা গায়ের রং নয় তার, বরং বেশ শ্যামলাই বলা চলে, উচ্চতাও মাঝারি, মাত্র পাঁচ ফিট। তবে মেদহীন ফিট শরীরে স্বাস্থ্য আর উদ্যম দুটি স্পষ্ট। দেখলেই বোঝা যায় সে অসুস্থ বা দুর্বল নয়, প্রচুর খাটতে পারে।তার সুস্বাস্থ্যই তাকে আকর্ষণীয় করে তুলেছে। আর তার ফ্যাশন সেন্সও খুব ভালো।
“তবে কি জানিস তো, যৌবনে কুক্কুরী ধন্যা। এই বয়সে সেক্সুয়ালি স্টার্ভড জেনারেশনে প্রেম পিরিতি হওয়া কোন ঘটনা না। তোর আমার মতন প্লেনলুকিং মেয়েদের জন্যেও সম্পর্কে জড়ানো ওয়ানটুর ব্যাপার, তুই চাস কিনা তার উপর ডিপেন্ড করে। তোকে জাস্ট সিদ্ধান্ত নিতে হবে প্রেম করবি কি করবি না- দ্যাট’স অল”। রুবার কথায় মনে হওয়া স্বাভাবিক যে প্রেম করাটা দোকানে গিয়ে বার্গার অর্ডার করবার মতন সামান্য একটা নৈমিত্তিক ব্যাপার। কাউকে অন্তত ভালো তো লাগতে হবে, তাই না? একথা শুনে রুবা হেসেই খুন। তারপর হাসি থামিয়ে গেয়ে উঠেছিল “ফুলের বনে যার পাশে যাই তারেই লাগে ভালো, ও রজনীগন্ধা তোমার গন্ধসুধা ঢালো”।
বাবা যতদিন বেঁচে ছিল সে কোন সম্পর্কে জড়ানোর কথা ভাবেইনি। মা মারা যাওয়ার পর সে ক্যাম্পাসে থাকেনি বেশিদিন। এসে শুধু পরীক্ষাগুলো দিয়ে যেতো। বাবা বলতেন, ক্লাসে যা, ক্লাস কর, রেজাল্ট খারাপ হবে, গ্রেড নেমে যাবে। ভাগ্য ভালো গ্রেড নেমে যাবার ভয়ে সে ময়মনসিং ছেড়ে ক্যাম্পাসে গিয়ে থাকেনি। বাবার জীবনের শেষ এক সপ্তাহ সে বাসায়ই ছিল। অলোক তখন এসএসসি পরীক্ষা দিয়েছে মাত্র।প্র্যাকটিকেলগুলো নিয়ে ব্যস্ত।বাবা তাকে সব ব্যাংকের একাউন্ট বুঝিয়ে দিয়েছেন, বাড়ির দলিল আর কোথায় কত লোন আছে সব দেখিয়ে দিয়েছেন। মায়ের চিকিৎসার জন্য লক্ষ লক্ষ টাকা খরচ করতে হয়েছিল। কার কাছে কত টাকা পাওনা আছে সেটাও বাবা জানিয়ে গেছেন। মা চলে যাওয়ার পর তার একবার সামান্য আশংকা হয়েছিল বাবা হয়তো আর বেশিদিন বাঁচবেন না। মা মারা যাওয়ার পর বাবাকে দেখাতো পরাজিত যোদ্ধার মতন। মৃত্যুর কাছে মানুষ যতটা হেরে যায় আর কোন কিছুর সঙ্গেই অত হারে না।
তার চিন্তায় ছেদ ফেলে দরজায় নক পড়ে। পলাশ কি এখনই অধৈর্য হয়ে গেছে? দশ মিনিটেই? সে দরজা খুলে উকি দেয়। কাপড় খুলে ফেলেছে নাকি ছেলেটা? নাহ, অতটা উতলা মনে হয় না। “তোমার কিছু লাগবে কিনা চেক করতে নক দিলাম”। তাকে সম্পূর্ণ কাপড়ে এবং শুকনো অবস্থায় দেখে কি একটু হতাশ হয়েছে? ওর মুখ দেখে অবশ্য সেরকম কিছু মনে হয়না। বেশ ক্যাজুয়াল ভঙ্গিতে দাঁড়িয়ে আছে সে, অভিব্যক্তিতে মাত্রাতিরিক্ত আগ্রহ বা লোভ বোঝা যাচ্ছে না।
“আমার শাওয়ার নিতে একটু বেশি সময় লাগে, প্লিজ ডোন্ট বি এনয়েড” বেশ আদুরে ভঙ্গিতেই বলে সে।
“ইট’স ওকে, টেইক ইয়োর টাইম। তোমার গরম পানি লাগবে? গিজার অন করা আছে কিন্তু”।
“থ্যাঙ্ক ইউ” বলে ঘাড় হেলায় সে। তারপর দরজা আটকে কাপড় ছাড়ে। কমোডের পেছন থেকে ঝাড়ু বের করে এনে বাথরুমের মেঝে ঝাট দেয়। হারপিক ছিটিয়ে কমোড ব্রাশ করে। অপরিচিত বাসার বাথরুম ধুতে তার কোন ঘেন্না হয় না। জীবনের পথে পথে এত নোংরামি ছড়িয়ে আছে যে মানুষের মলমূত্রকে সেই তুলনায় ঘৃণ্য মনে হয় না তার কাছে। যখনি কষ্টে ক্ষোভে গ্লানিতে তার পৃথিবী ছিন্ন ভিন্ন হয়ে যায় ঠিক তখনই সে কাপড় কাঁচে কিংবা বাথরুম পরিষ্কার করে। যে কোন ধরনের পরিচ্ছন্নতার কাজ মানসিক স্বাস্থ্যের জন্য উপকারী। মেডিটেটিভ আর হিলিং।এই ব্যাপারটা সে আবিষ্কার করেছে বাবার চল্লিশার আগে পাওনাদারদের সঙ্গে দেখা করতে যাবার দিন। পরপর তিন চারজনের সঙ্গে দেখা করেছে সে। কেউই পুরো টাকা ফেরত দেয়নি। দুইজন ইনিয়ে বিনিয়ে বলার চেষ্টা করলো বাবাই আসলে তাঁদের কাছ থেকে ধার নিয়েছেন বিভিন্ন সময়ে, টেনশনে ভুলে গেছেন।
“ভাবির অবস্থা খারাপ ছিল তো, তোমার আব্বার মাথার ঠিক ছিল না” আকাশ থেকে পড়েছে সে শুনে। বাবার মতন মাথা পরিষ্কার মানুষ সে খুব কম দেখেছে। ভয়ানক বিপদেও বাবা শান্ত থাকতেন, উত্তেজিত হতেন না। মা মারা যাওয়ার পর শোকে স্তব্ধ হয়ে গেলেও বাবা কখনও হুঁশজ্ঞান হারাননি।
সেদিন শেষ যার বাসায় গেছিল তিনি বাবার সবচেয়ে কাছের বন্ধু, শফিক চাচা। বাইরের ঘরে তাকে বসিয়ে অনেক কিছু খেতে দিলেন তিনি। চাচি এসে খানিক কান্নাকাটি করলেন। চাচি উঠে চলে যাওয়ার পর চাচা কাঁদতে কাঁদতে তাকে জড়িয়ে ধরলেন। একটু বেশি জোরেই চেপে ধরেছিলেন। কোমরের একপাশে সে টের পায় চাচার ঊরুসন্ধির চাপ। সেদিন এসে রাগে দুখে ঘর দুয়ারে আগুন লাগিয়ে দিতে ইচ্ছা হয়েছিল তার। লাথি মেরে সারা দুনিয়াটাকে ভেঙ্গে চুরমার করে দিতে পারলে যেন শান্তি পাওয়া যেতো।কিন্তু অলোকের সামনে কিছুতেই ভেঙে পড়বে না বলে পণ করেছিল সে।শেষ পর্যন্ত ঘর মুছে আর বাথরুম সাফ করে মন শান্ত করতে পেরেছিল।বাসার দুটি বাথরুমের কমোড বেসিন থেকে শুরু করে প্রতি বর্গ ইঞ্চি টাইলস ঘষে পরিস্কার করতে করতে সে ভুলে গেছিল বাবা মারা যাওয়ার ব্যথা, পিতৃব্যের লোলুপতা, অনিশ্চিত আগামীর ভয়াবহতা।
শফিক চাচা ঠিক পাওনাদার নন। তাঁর মতন ধনাঢ্য ব্যক্তির বাবার কাছ থেকে ধার নেওয়ার কথা না। তাঁর অনেক ব্যবসার একটিতে বাবার ইনিভেস্টমেন্ট ছিল বলে জানিয়েছিলেন বাবা তাকে, মারা যাওয়ার মাত্র কিছুদিন আগেই।
“এসব আমাকে বলতেছ কেন? তোমার উপরে কি ওহি নাজিল হইছে? কালকেই মইরা যাবা?”
একথা শুনে বাবা বলেছিলেন,“অলোক ছোট এখনও। তুই এসব বুইঝা রাখ। ভবিষ্যৎ বলা যায় না কিছুই” খুবই নিরাসক্ত প্র্যাকটিকেল স্বরে বলেছিলেন বাবা। বেশ সুস্থ তিনি তখনও। অতিরিক্ত ধূমপান করা ছাড়া কোন বদভ্যাস কোনকালে ছিল না তাঁর। হার্টের অসুখ ছিল না । বিনামেঘে বজ্রপাতের মতন হার্ট এটাক করে বাবা মরে যাওয়ার পর খুব অভিমান হয়েছিল তার। যেন ইচ্ছা করেই সব ছেড়েছুড়ে চলে গেছে বাবা। তাহলে পাওনাদারদের থেকে টাকাগুলো আদায় করে যেতে পারলো না কেন? নিজের বউ অসুস্থ, জলের মতন টাকা খরচ হচ্ছে চিকিৎসায়। এর মধ্যে তাঁর কী দরকার ছিল চাচাত ভাই আর মামাশ্বশুরকে টাকা ধার দেওয়ার? বাথরুম ধুয়ে সেদিন সে ঠাণ্ডা পানি দিয়ে গোসল করেছিল অনেকক্ষণ ধরে। ঠাণ্ডা লেগে জ্বর চলে এসেছিল।তাঁদের বাসায় গিজার নেই।
এখন পলাশের ঢাকার বাসার বাথরুমে গরম পানির ধারার নিচে দাঁড়িয়ে সে সিদ্ধান্ত নেয় সকল গ্লানি আর ক্ষোভ ধুয়ে ফেলবে। ঠিক যেভাবে বাথরুমের টাইলস আর বেসিন ঝকঝকে করে তুলতে পারে সে, ঠিক সেভাবেই জীবনকে ঝরঝরে আর ফ্রেশ করে ফেলতে হবে। ময়লা নোংরা কোন কিছুই জমিয়ে রাখা যাবে না। সারা শরীরে পুরুষালি গন্ধের বডিওয়াশ মেখে গোসল করতে থাকে অতসী। আপাদমস্তক পরিচ্ছন্ন হয়ে গেলে বেঁচে থাকার আগ্রহ বেড়ে যায়, একথা হয়তো সকলের জন্যই সত্যি।
সে সিদ্ধান্ত নিয়েছে যে পলাশের সঙ্গে এই সম্পর্ক টিকিয়ে রাখতে হবে। শুধু টেকানোই না, এটাকে টেনে বিয়ে পর্যন্ত নিয়ে যেতে হবে। ধনাঢ্য বাবার ছেলের বউ হয়ে সে ওই বাড়িতেই আবার ঢুকবে যেখান থেকে প্রতারিত আর লাঞ্ছিত হয়ে ফিরে আসতে হয়েছিল। সেদিন ফেরার সময় গাড়ি থেকে নামতে থাকা পলাশ থমকে দাঁড়িয়েছিল তাকে দেখে। সহানুভূতি জানানোর সময় সব মানুষের চোখের দৃষ্টি কিছুটা তরল হয়ে যায়। পলাশের চোখেও তেমন কোমলতা ছিল। সে তখন কান্না চেপে স্বাভাবিক চেহারা করে বের হচ্ছে শফিকচাচার বাপের আমলের পুরাতন বাড়ি থেকে। চাচা পেছন থেকে ডেকে বললেন পলাশ তাকে বাড়িতে নামিয়ে দেবে। সে ঠিক করেছে এই গাড়িটাতে করেই সে ও বাড়িতে আবার ঢুকবে। প্রথম রুমডেটের দিন এত দূর চিন্তা করাটা হয়তো বাড়াবাড়ি। কিন্তু বুঝে স্টেপ নিলে অসম্ভব না কিছুই। আর রুবার টিপসগুলো তো আছেই।
রুবা প্রায়ই বলতো “লাইফ ইজ আ বিচ”। অতসীর এখন আর কুক্কুরী হতে আপত্তি নেই।
সচিত্রকরণ: মাহমুদুর রহমান দীপন