আলোচনাটি আসলে পঞ্চাশ বছরেই সীমাবদ্ধ থাকবেনা, গত এক দেড়শো বছরের উপখ্যান মাঝে মাঝে উঁকি দেবে, হাজার বছরের উপাখ্যানও দিতে পারে। পঞ্চাশ বছর, মানে যার যাত্রা বিন্দু ১৯৭১, একটি রাষ্ট্রের জন্ম। যদিও কোলকাতা কেন্দ্রিক বিভিন্ন প্রকাশনায় মুদ্রিত হয়েছে ‘একটি জাতীর জন্ম’। জাতি ও দেশ বা রাষ্ট্র আসলে আলাদা আলোচনা, একটি দেশে বা রাষ্ট্রে বহু জাতি থাকে, আর জাতির জন্ম হয়েছে আসলে বহু আগে। এই যে প্রাচীন পূর্ব বাংলা, যার অধিবাসীরা ‘বাঙ্গাল’ নামে কোলকাতায় বিবিধ কটাক্ষের মুখোমুখি হতো সেই বাঙ্গাল জাতের জন্ম কি ১৯৭১ এ, না অবশ্যই নয়। এমনকি কোলকাতা কেন্দ্রিক বাংলার অভিজাত সমাজ ঘটি ও বাঙ্গাল মিলিয়ে যে বাঙালি জাতি সত্তাকে পূণঃনির্মান করতে চাইলেন, সেটার বয়সও বহু শতাব্দী। চর্যার হিসেবেই হাজার বছরের বেশি। ইউরোপে Nation বলতে রাষ্ট্র বোঝায়,
indigenous বলতে জাতি বোঝায়। আমরা Nation অর্থে বাংলাদেশি, indigenous অর্থে এই ভূগোলের সংখ্যা গুরু হচ্ছে বাঙালি। যেহেতু ১৯৪৭ এ ঘটি ও বাঙ্গালের এক বিশাল অদল বদল হয়েছে তাই সংখ্যাগুরু বাঙ্গাল বলছি না, বাঙালিই বলি। কিন্তু চোরাস্রােতে কি ঘটি বাঙ্গালের জোয়ার ভাটা নেই? আছে বলেই ‘বাঙালি মসুলমান’ তত্ত্বালোচনার প্রয়াস আছে। এই আলোচনাকে আমি বাঙালি জাতিসত্তাকে পুনঃনির্মাণের অংশ হিসেবেই নিচ্ছি। মৌর্য ও পাল বাংলার পর সেন বাংলায় কেন, কিভাবে বাংলায় বর্তমানে হিন্দু বলে পরিচিতরা বৌদ্ধ থেকে হিন্দু হলো তা অলোচনা করছিনা তবে সে সময়ে আদিবাসিরা ও বুদ্ধরা ধর্মান্তরিতদের ‘মালু’ বলতো সেটি খুবই প্রনিধান যোগ্য। আধুনিক বাংলায় এসেও ‘মালু’ অপমানসূচকতা হারায়নি মুসলিম কিংবা হিন্দু সংখ্যাগরিষ্ঠতায়। কিন্তু কৌতূহলের বিষয় হচ্ছে ‘মালু’ বা মালায়লামি ভাষায় আজো কথা বলে এমন মানুষ এ দেশে আছে। তাদের সেন রাজারা নিয়ে এসেছিলেন ভৃত্য হিসেবেই, তাদের নিরাপত্তা ও শুচিতার প্রশ্নে, ও হ্যা সেনেরা ছিলেন হিন্দু। বাংলায় না হয় ‘মালু’ শব্দটি পাচ্ছি কিন্তু, তৎকালিন হিন্দুদের ভারতবাসী কি নামে ডাকতো, তা আমার জানা নেই। আরব থেকে আগত মুসলিম শাসকেরা নগরের সকল ভারতীয়কেই প্রথমে হিন্দু বলেই চিহ্নিত করেছিলো, সময়ের কালক্রমে তারা জেনেছে এখানে মুসলিম আছে, বৌদ্ধও আছে, আছে পারস্য ও আরব খেকে অভিবাসন নেয়া পার্সী ও ইহুদিও। তবে এদেশের মুসলিমদের নিয়ে খুব একটা আগ্রহ মুসলিম শাসকদের ছিলোনা, জাতে উঠতে বা শাসকের নিকটবর্তী হতে মুসলিমেরা তাদের পূর্ব পুরুষেরা ইরান, তুরান, আরব থেকে এসেছে বলে বহুগল্প তৈরী করেছিলো। সেটাই জন্ম দিয়েছে আরেক সংকটের। সেই সংকটেই মুসলমানেরা ভারতীয় নয় বলে মাঝে মাঝেই বিবিধ দাঙ্গা বেধে যায়। ধর্ম ও জাতপাতের তালিকাগুলি লিপিবদ্ধ করেছে ইংরেজ শাসকেরা। তবে সেটা আজো পুরোপুরি করে ওঠা হয়নি, বৈজ্ঞানিক বা নৃবিজ্ঞানের আলোকে হয়নি বিধায়, মসুলমানেরা ভারতীয় কিনা এ নিয়ে যেমন বিতর্ক আছে, তেমনি দলিতেরা হিন্দু কিনা তা নিয়েও দাঙ্গা হাঙ্গামা আছে।
৫০ বছরের রাজনৈতিক বাস্তবতা
নাজিব তারেক
আধুনিক শিল্পী রচনা করেন অজানা বাজারের জন্য
-শার্ল বোদলেয়ার
ছবি বিক্রি হয় কান দিয়ে।
- সাচি, শিল্পবাজার বিশেষজ্ঞ
খ
বাংলাদেশের চিত্রকলা আলোচনার পূর্বে ধর্ম ও রাজনীতি নিয়ে কেন এই সাতকাহন? লেখার শুরুতেই একজন শিল্পবাজার বিশেষজ্ঞের উক্তি উদ্ধৃত করেছি। উদ্ধৃত করেছি আধুনিক ইউরোপের অন্যতম কবির উক্তি। বাংলাদেশের চিত্রকলা আলোচনায় বাংলার সাতকাহনটি তাই জরুরি। এই ভূমিতে ইউরোপ থেকে আমদানী কৃত ‘আধুনিক চিত্রকলা’ নিয়ে আমাদের যে আলোচনা তার হাল হকিকত বুঝতে এটা সাহায্য করবে। আর একটু পরিষ্কার করে বলি, এ আলোচনা চিত্রকরেরা কি আঁকছেন তা নিয়ে যত, তার চেয়ে অধিক রসিক ও ক্রেতারা কোনচিত্রকলাকে নিয়ে আহ্লাদিত হচ্ছেন তা নিয়ে। এই রসিক, ক্রেতারা যাকে নিয়ে আহ্লাদিত তিনিই শিল্পী, যাকে নিয়ে তারা আহ্লাদিত নন, সে হয়তো হারিয়ে গিয়েছে পদ্মা মেঘনার জলে।
কবির সুবিধা হচ্ছে শ্রুতি ও স্মৃতিতে সে গণতে ছড়িয়ে যায় টিকে যায়, এলিট তথা শাসক শ্রেণী তাকে উপেক্ষা করলেও, কিন্তু চিত্রকরের সে উপায় নেই। এলিট তাকে গ্রহণ না করলে সে হারাবে গঙ্গার জলে। কালিঘাটের পটও হারাতো, যদিনা শাসক বৃটিশেরা তা সংগ্রহ করতো, আমাদের মগজ শাসন করে ফরাসীরা, তারা যদি না দেখাতো, তাহলে কবেই চাইনিজ ডিজিটাল প্রিন্টের হাতে মার খেয়ে মরে যেতো রিক্সা-চিত্রকলা!
চিত্রকলার ভূমিকা কবিতা তথা টেক্সটের মতো প্রত্যক্ষ নয়, তাই খুব সহজেই এর প্রভাব ও প্রতিপত্তিকে চিহ্নিত করা যায়না ঠিকই তবে আন্দোলন সংগ্রামকে শক্তিযোগাতে কিংবা নসাৎ করতে চিত্রকলার চেয়ে শক্তিশালী কিছু হয়না। এ কারণেই ক্ষমতাসীনরা তাদের ক্ষমতা কাঠামোকে টিকিয়ে রাখতে, বৃদ্ধি করতে এবং তাদের ভবিষ্যতকে নিরাপদ করার জন্য তাদের স্বার্থমত কবিতাকে যেমন পুরস্কৃত করে তেমনি চিত্রকলাকেও পুরস্কৃত করে। পুরস্কার প্রদান ঘটনাটি সর্বদা প্রাতিষ্ঠানিক রূপে ঘটে তা নয়, ‘তিনি তো স্বীকৃতি পাননি’ও পুরস্কার যাত্রার অংশ।
গ
কোন শিল্পই রাজনীতি নিরপেক্ষ নয়। শিল্পকর্মকে হয়তো করণ কৌশলের দক্ষতা দিয়ে শিল্পী রাজনীতি নিরপেক্ষ করে তুলতে চেষ্টা করেন, কিন্তু শিল্পীর মগজে যে রাজনীতি খেলা করে তা পুরোপুরি মুছে ফেলা যায় যায়না। উল্টো এই রাজনীতি আড়াল করার প্রয়াস (কিংবা রাজনীতি প্রকাশের প্রয়াস) শিল্পীর শিল্পকর্মকে করে তোলে দুর্বল। আধুনিক শিল্প আলোচনায় তাই রাজনৈতিক আলোচনা খুবই গুরুত্বপূর্ণ। প্রকরণ-সৃজন ছাপিয়ে রাজনীতি যখন উচ্চকিত তখন আমরা সেই শিল্পকর্মকে বলি পোস্টার, আবার শিল্পকর্ম যখন রাজনীতিহীন তখন তা ¯্রফে গৃহসজ্জা। রাজনীতিহীন গৃহসজ্জামূলক শিল্পকর্মকে কাব্যিক টেক্সট দিয়ে সাজিয়ে উপস্থাপন করা সহজ। ১৯৭৫ পরবর্তী বাংলাদেশের শিল্প আলোচনায় এই কৌশলটি একাত্তরের বাংলাদেশ বিরোধিতার এক বড় অস্ত্র। ১৯৪৭ পরবর্তী বাঙালি আন্দোলন যা বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের পটভূমি। সেই বাঙালি আন্দোলনের বিরোধী সাহিত্যিকদের বাংলা সাহিত্যে চিহ্নিত করা হলেও শিল্পীদের চিহ্নিত করা হয়নি। সেই সুযোগে বাঙালি ও বাংলাদেশ বিরোধী শিল্পীদেরই পুনরুত্থান লক্ষ্য করা যায় ১৯৭৫ এর পর। এটা অনেকটা বঙ্গবন্ধু-সৈয়দ নজরুল-তাজউদ্দিনের বিপরীতে একে তাকে দাঁড় করানোর মতই ব্যাপার, জয়নুল-কামরুল-সফিউদ্দিন-আনোয়ারুল-এর বিপরীতে কাউকে দাঁড় করানোর মতো। যেহেতু পাকিস্তান সরকার তথা পকিস্তানী এলিটদের আনুকূল্যে এদের কারো কারো ঝুলিতে বিদেশী প্রসংশাপত্র আছে, তাই তাদের তথাকথিত মেধা ও প্রতিভার ফুলঝুরি ফোটানো হয়, এসব প্রশংসাপত্র দেখিয়ে।
ঘ
একটি শিল্পকর্মে মিশে থাকে শিল্পীর প্রকরণ জ্ঞান, শিল্প-ইতিহাস জ্ঞান ও সমকালীন রাজনীতির বিবিধ বিষয় আশয় নিয়ে ব্যক্তির ভাবনা। ইউরোপীয় উপনিবেশের বিপরীতে যে স্বদেশ ভাবনা তা অবনঠাকুর, নন্দলাল বসু, যামিনী রায়, গগনেন্দ্রনাথ ঠাকুর, রবীন্দ্রনাথের চিত্রকর্মের ফর্মকে নির্ধারণ করেছে। একই ভাবে জয়নুল, কামরুল, সফিউদ্দিন, আনোয়ারুল, সুলতান, কিবরিয়া, আমিনুল, বশীর, কাইয়ুম, রশীদ, নভেরা, দেবদাস, হামিদুর এর চিত্রকর্মে পাকিস্তান ভাবনা, পাকিস্তান ভাবনার বিপরীতে বাঙালি ও বাংলাদেশ ভাবনা প্রযুক্ত হয়।
একাত্তরে যারা সরাসরি বাংলাদেশ সরকার, জনগণ ও মুক্তিবাহিনীর বিরুদ্ধে সশস্ত্র কিংবা সাহিত্য, সাংবাদিকতা, শিল্প নিয়ে ঝাঁপিয়ে পড়েছিলো তারা অবশ্যই বাঙালি ও বাংলাদেশ বিরোধী। এদের বাহিরেও আরো এক পক্ষ আছে, যাদের বাঙালি বা বাংলাদেশী বলা যাবে না, তারা হচ্ছে ‘নিরপেক্ষ ভাবে বাংলাদেশ বিরোধী’। ১৯৭২-এ এই বাংলাদেশ বিরোধীরা রাষ্ট্র ক্ষমতার বিবিধ আসন (সচিব, অধ্যাপক, সম্পাদক, কোম্পানী এমডি/সিইও, ইত্যাদি) দখল করে, মেধা ও প্রতিভার ফুলঝুরি দেখিয়ে, এ ক্ষেত্রে বিদেশী প্রশংসাপত্র তাদের হাতে এক দুর্দান্ত অস্ত্র।
রাষ্ট্র ক্ষমতার বিবিধ আসনের এইসব এলিটেরা বাংলাদেশ ভাবনাটিকেই ক্রমাগত ভাবে বিকৃত করে চলেছেন, শিল্প-আলোচনাও এর বাইরে নয়। এরই প্রেক্ষিতে বাংলাদেশের ৫০ বছর আলোচনায় রাজনীতিতে যেমন কারা কারা বাঙালি, বাংলা, বাংলাদেশ বিরোধী চিহ্নিত করা জরুরি, তেমনি সাহিত্য ও শিল্পেও কারা কারা বাঙালি, বাংলা, বাংলাদেশ অনুগত নয় তা খুঁজে বের করা জরুরি। এটা খুঁজে বের করতে খুব বেশি রাজনৈতিক হওয়ারও দরকার নেই। রাজনৈতিক বাকোয়াজি সর্বস্ব সাহিত্য ও শিল্প-সমালোচনার টেক্সটগুলিকে বাদ দিলে এবং প্রকরণ ও শিল্প-ইতিহাসের আলোকে এক একটি রচনাকে বিশ্লেষণ করলেই জঞ্জালমুক্ত হয়ে প্রতিভা ও মেধার মূল্যায়ন সম্ভব।
ঙ
বাংলাদেশি আধুনিক চিত্রকলার যাত্রা শুরু জয়নুল-কামরুল-আমিনুলের হাত ধরে, আনোয়ারুল হক, সফিউদ্দিন আহমেদ সে যাত্রার সঙ্গী হলেন শুরুতেই, পরে যোগ দিলেন খাজা শফিক, কিবরিয়া, হাবীবুর রহমান। আমিনুল ছাত্র হিসেবেই প্রতিষ্ঠা যাত্রার শুরু থেকে ছিলেন, ঢাকা চারুকলার যাত্রা শুরু হলে তার সাথে ছাত্র হিসেবে যোগ দিলেন মুর্তজা বশীর, রশীদ চৌধুরী, বিজন চৌধুরী, হামিদুর রহমান, আব্দুর রাজ্জাক, দেবদাস চক্রবর্তী, নিতুন কুন্ডু, কাইয়ুম চৌধুরী, এমদাদ হোসেন, নভেরা, প্রমুখ। কামরুল স্কুল ছাত্রাবস্থা থেকেই ব্রিটিশ বিরোধী তথা স্বদেশী আন্দোলনের সাথে যুক্ত, আমিনুলও ছিলেন বাম ঘরানার। হামিদুর, নভেরা ছিলেন আমিনুলের ঘনিষ্ঠ। বশীর সহদোরদের প্রভাবে আমিনুলের সাথে পরিচিত ছিলেন। দেবদাস, বিজন চৌধুরী ছিলেন কলকাতা আর্ট স্কুলের ছাত্র, সেখান থেকে তারা ঢাকায় এসেছিলেন সেখানকার ছাত্র আন্দোলনের পটভূমিতে। ১৯৫২ ভাষা আন্দোলনের পরে বিজন কোলকাতা ফিরে যান।
চ
আলোচনার শুরুতে সাতকাহন গেয়েছিলাম ধর্ম ও রাজনীতি নিয়ে। শেষও করছি সেই সাতকাহন দিয়ে। কোলকাতা আর্ট স্কুলকে গণ্য করা হয় এ দেশীয় চিত্রকলার ‘আধুনিকতা’র সুতিকাগার হিসেবে। এই কোলকাতা আর্ট স্কুলের রয়েছে দুটি পর্ব। ১) ইউরোপীয় হয়ে ওঠার যাত্রা ২) ভারতীয়ত্বের (বাঙালিত্বের) সন্ধান।
ইউরোপীয় হয়ে ওঠার যাত্রাটি সাধারণ চেখেই ধরা পড়ে। কিন্তু বাঙালিত্বের যাত্রাটির রয়েছে যেমন ভুল পথ তেমনি প্রতিবিপ্লবও রয়েছে, প্রতিবিপ্লব আবার ইউরোপ যাত্রার সহযোগী। হ্যাঁ ইউরোপকে অস্বীকার করবার উপায় নেই, কিন্তু আমরা ইউরোপকে কি প্রতিমায় গ্রহণ করছি সেটি খুবই গুরুত্বপূর্ণ আলোচনা। গাজীর পট হোক আর সাঁওতাল পট হোক আজ আর গণ-আমাদের চিত্রচাহিদাকে পূরণ করবে না, তাই রিক্সাচিত্র গণ-আমাদের চাহিদা পূরণে এগিয়ে আসে। কিন্তু আমাদের অভিজাত চিত্রকলা বা এলিট শ্রেণীর পছন্দের চিত্রকলা কোন পথে? এ রুচি ইউরোপ যাত্রী।
জয়নুল কি এটাকেই রুচির দুর্ভিক্ষ বলছেন?
হ্যাঁ, রুচি যখন আত্মসন্ধানহীন তখন তা অবশ্যই ‘কুরুচি’। দেশের ধনিক শ্রেণী গণমানুষকে পাঠ করবার কষ্ট করেনি বলেই গণ-রুচিকে যেমন বোঝেনি তেমনি গণরুচিকে এগিয়ে নিয়ে যাওয়ার নেতৃত্ব প্রদানেও ব্যর্থ। এলিটের গণ বিচ্ছিন্নতা এতটাই যে- যে কবির সুবিধা শ্রুতি ও স্মৃতিতে সে গণতে ছড়িয়ে যায় টিকে যায়, সেই কবির গ্রন্থ বিক্রয়ের সংখ্যা তথা পাঠ সংখ্যা জনসংখ্যার তুলনায় ০% শুধু নয় -০%। কিন্তু ১৯৪৭ পূর্ব বাংলা কবিতার অবস্থা এমন ছিলো না। মাইকেল-রবীন্দ্রনাথ ইউরোপ যাত্রাকে যেমন স্বীকার করেছেন তেমনি ভারত আত্মা তথা বাংলাকেও সন্ধান করেছেন, কিন্তু কল্লোলের ইউরোপ যাত্রা বাংলা কবিতাকেই বাংলা থেকে উৎখাত করলো। একই ভাবে রবি বর্মা- হেমেন- অবন-জয়নুল ইউরোপ যাত্রাকে যেমন স্বীকার করেন তেমনি বাংলাকেও সন্ধান করেন।
১৯৪৭-এরপর পূর্ব বাংলা বা পূর্ব-পাকিস্তানে নাগরিক ও লোক শিল্পী সাহিত্যিকদের এক নতুন পরিস্থিতির মুখোমুখি পড়তে হয়। লোক শিল্পী সাহিত্যিকেরা কি করে সেই পরিস্থিতিকে মোকাবেলা করেছেন, করছেন তা গবেষণার বিষয় হলেও ভাট কবিতা কিংবা রিক্সা চিত্রকলায় তার কিছুটা বোঝা যাবে। তবে নগর চিত্রকরদের আমরা তিনটি ভাগে চিহ্নিত করতে পারি:
১) ইউরোপের যাত্রী : এরা সংখ্যায় বেশি হলেও এরা মূলত মধ্য ক্ষমতার, শৈল্পিক মানে বা মেধায়। এমনকি সংগঠন বিচারেও, তবে নাগরিক বাজারে এদের চাহিদা বিপুল।
২) পাকিস্তানবাদী বা সামন্তবাদী : এরা বিভিন্ন উপদলে ছড়িয়ে ছিটিয়ে হলেও এরাই ক্ষমতায়। এদের অংকনরীতিতে বাংলা কিংবা ভারতীয় চিত্রকলার দীর্ঘযাত্রার তেমন ছাপ লক্ষ্য করা যায় না। এরা ইউরোপীয় ক্লাসিক বা রেনেসাঁ চিত্রকলার অনুকরণেই তাদের চিত্র রচনা করেন। বিষয়ে গ্রামবাংলা থাকলেও সেখানে বাংলার গ্রাম অনুপস্থিত। জীবন চর্চাতেও তারা জমিদার বা ধনিক শ্রেণীর আশ্রয়ে বাউন্ডুলে ধরনের। সংখ্যায় এরা কম হলেও এরাই ক্ষমতায়। ১৯৪৭-১৯৭১ এ যেমন, তেমনি ১৯৭৫ থেকেও।
৩) বাঙালিত্বের সন্ধানী : এরা ইউরোপ যাত্রাকে অস্বীকার করেন না, তবে বাঙালিত্বের সন্ধান তাদের চিত্রকলায় লক্ষ্য করা যায়। এ বাঙালিত্বের সন্ধান কোলকাতার ‘বাঙালি’ পরিচয় এক নয়। নৃতাত্ত্বিক আলোচনাটি মুখ্য হলে একে ‘বাঙ্গাল’ সন্ধান বলা অধিক সঠিক হতে পারতো, আবার ১৯৪৭ এর সীমানার কারণে ‘বাঙালি’ বলাটিই রাজনৈতিক ভাবে সঠিক। যদিও তাতে কোলকাতার ‘বাঙালি’ পরিচয়ের সাথে গুলিয়ে যাওয়ার সংকট আছে, আর সে সুযোগে ‘বাংলাদেশ’ বিরোধীদের এই বাঙালিত্বকে বিব্রত করবার সুযোগও ঘটে। জয়নুলের ঢাকা চারুকলা ১৯৭৫ পর্যন্ত নিশ্চিত ভাবেই এই বাঙালিত্বের সন্ধানকে নেতৃত্ব দিয়েছে, তবে ১৯৯০ এরপর বাংলাদেশের চিত্রকলায় বাঙালিত্বের সন্ধান এতোটাই উপেক্ষিত যে আজকাল জয়নুল, কামরুলের বাঙালিত্বের সন্ধান ছাপিয়ে ইউরোপ যাত্রী ও পাকিস্তানবাদী বা সামন্তবাদীদের অধিক বাঙালি হিসেবে দেখানোর প্রয়াস প্রায় প্রতিষ্ঠিত। যা বাংলাদেশের আত্ম-সন্ধান তথা স্বাধীনতাকেই হুমকির মুখে ফেলছে। গণতান্ত্রিক জাতীয়তাবাদ ব্যতিত কোন জাতি যেমন নিজেকে চিহ্নিত করতে পারে না, তেমনি উত্তরাধুনিক আন্তর্জাতিকতায় ‘ব্রান্ড’ হিসেবে যুক্তও হতে পারে না, বাজারে আর দশটি শস্তা প্রডাক্ট হিসেবে গড়াগড়ি খায় মাত্র।
ছ
কয়েকটি মিথ ও বাংলাদেশের চিত্রকলা
বাংলাদেশে ছবি বিক্রি হয় না।
সামন্ত-বাজারে ছবি আসলে বিক্রি হয় না। সামন্ত প্রভু শিল্পীকে ছবি আঁকবার মুজরা বা কমিশন করেন। আধুনিক গণতন্ত্রে বা আধুনিক বাজারে ছবি যেমন মুজরা দেয়া হয় তেমনি বিক্রিও হয়। বোদলেয়ার এই বিক্রিটিকেই মুখ্য করে দেখতে চাইছেন, যেখানে ক্রেতার সাথে রচয়িতার দেখা নাও হতে পারে। গ্যালারি বা দালাল বা প্রকাশক বা সমালোচক বা কিউরেটর নামক বুর্জোয়া ব্যবস্থা শিল্পী ও ভোক্তার স্বাধীনতাকে নিশ্চিত করেন। বাংলাদেশে (এবং পৃথিবী জুড়েই) কেন এই বাক্য বলা হয়?
ক) বক্তা যদি চিত্রকর হয়ে থাকেন তাহলে তিনি চাইছেন।
১) নতুন কেউ এসে যেন বক্তার বাজার নষ্ট না করে।
২) বাজারে তার কোন অবস্থানই নেই বা বাজারে তিনি গৃহীতই হননি।
৩) তিনি বাজারে কখোনই তার রচনা নিয়ে উপস্থিত হননি, সামন্ত জনের প্রচারণা দ্বারা বিভ্রান্ত হয়ে এবং নিজেই তোতাপাখির মতো অপরের কথা আউড়ে যাচ্ছেন।
খ) বাজার কাঠামো যেন গড়ে না ওঠে, প্রগতির সকল পথ রুদ্ধ করাই তার উদ্দেশ্য।
গ) বক্তা যদি কবি, আমলা, সাংবাদিক তথা কোন ক্ষেত্রের ক্ষমতাবান হয়ে থাকেন তাহলে বুঝতে হবে ঘুষ/ ভিক্ষা/লুট হিসেবে ছবি চাইছেন। সাম্য বা মূল্য নির্ধারণ পূর্বক বিনিময় তার কাম্য নয়।
২) বিদ্যালয় বা প্রতিষ্ঠান শিল্প শেখায় না
কেন এই প্রচারণা?
নিরীহ ভাবে এটি প্রতিষ্ঠান বিরোধিতা।
এই সব প্রতিষ্ঠান বিরোধীরাই আবার শিক্ষার মান নিয়ে সোচ্চার, যখন আন্তর্জাতিক তালিকায় বাংলাদেশি কোন প্রতিষ্ঠানের নাম থাকে না। যদি ধরি তালিকায় নাম নেই মানে প্রতিষ্ঠানই নেই তাহলে প্রতিষ্ঠান বিরোধিতার যৌক্তিকতাটি কি?
এটি একটি রাজনৈতিক প্রশ্ন!
প্রতিষ্ঠান বিরোধিতা আপাত প্রচলের বিরুদ্ধচারণ মনে হলেও প্রতিষ্ঠান বিরোধিতার আরো এক চাওয়া আছে। আর সেটা হচ্ছে প্রতিষ্ঠান গড়ে উঠতে বাধা দেয়া। প্রতিষ্ঠানই হচ্ছে গণতন্ত্রের মূল শক্তি, গণ এর মেধা যাচাইয়ের সর্বোত্তম উপায়।
যদি একটি জনগোষ্ঠির নিজস্ব প্রতিষ্ঠান গড়ে না ওঠে তাহলে সে জনগোষ্ঠি সা¤্রাজ্যবাদি শক্তির পদানত থাকবে। সা¤্রাজ্য কেন্দ্রের আজ্ঞাবাহক রূপে কেন্দ্রের উৎপাদিত পণ্য ক্রয় করতে বাধ্য থাকবে এবং পৃথিবীর সকল সম্পদের নিয়ন্তা থাকবে কেন্দ্র তথা উন্নত বিশ^। তৃতীয় বিশে^ তাই ‘বিদ্যালয় বা প্রতিষ্ঠান শিল্প শেখায় না’ বাক্যটির জনপ্রিয়তা নিশ্চিত করা জরুরি হয়ে পড়েছে সা¤্রাজ্যবাদী ও সামন্তদের।
তিনি কোন স্বীকৃতি পাননি বা তাকে স্বীকৃতি দেয়া হয়নি।
সামন্তকালে স্বীকৃতি দাতা ছিলেন সামন্তপ্রভু। আধুনিকে স্বীকৃতি প্রদানের এখতিয়ার প্রতিষ্ঠানের। ১৯৪৭ পরবর্তী পূর্ব বাংলায় ক্ষমতার চূড়ায় পাকিস্তানবাদিরা থাকলেও বাঙালি জাতীয়তাবাদীরা বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান তৈরী করতে থাকেন। ঢাকা চারুকলা ছিলো তেমন একটি প্রতিষ্ঠান। ঢাকা চারুকলায় তাই নিশ্চিত করে বাঙালি জাতীয়তাবাদী ব্যতিত কাউকে স্থান দেয়া হয়নি। ১৯৭১ এর গণহত্যা ও বুদ্ধিজীবী হত্যা দিয়ে ১৯৭২ থেকেই বাঙালি জাতীয়তাবাদ তথা বাংলাদেশ বিরোধীরা ক্ষমতা কাঠামোর বিবিধ স্থানে দখল নিতে থাকে, মেধা ও বিলেতি স্বীকৃতির শংসাপত্র দেখিয়ে। ১৯৭৫এর হত্যা সমূহের মধ্যদিয়ে তারা ক্ষমতার পুরোটাই দখলে নিয়ে নেয়। এ সময়েই চিত্রকলার (ও সাহিত্য সহ বিবিধ বিষয়ের) সেই সব প্রতিভাকে প্রাতিষ্ঠানিক স্বীকৃতি দেয়ার অজুহাত হিসেবে এই বাক্য সমূহের প্রচলন ঘটে, যারা বাঙালি জাতীয়তাবাদী জাত বাংলাদেশে বিশ^াস রাখেন না। দেশের বা রাষ্ট্রের সর্বোচ্চ স্বীকৃতি/পুরস্কার এদের প্রদান করার পরও এই প্রচার অব্যাহত রাখা হয়েছে, ১৯৪৮-১৯৭১ কালের বাঙালি জাতীয়তাবাদকে অস্বীকার করার কৌশল হিসেবে।
শিল্পীরা হবেন প্রতিবাদী, একাত্তরে শিল্পীরা প্রতিবাদ করেছিলো বলেই না বাংলাদেশ স্বাধীন হয়েছে।
শিল্প স্বয়ং একটি প্রতিবাদ। প্রচলকে অতিক্রান্ত হওয়ার যে যাত্রা তাই শিল্প। যে ইউরোপীয় সা¤্রাজ্য বা প্রচলতার বিপরীতে যে বাংলা ও বাংলাদেশ সন্ধান তা প্রতিটি বাংলাদেশি শিল্পীর সাধারণ চর্চার অংশ, আবার হাজার বছরের বাংলার যে পশ্চাদমুখিতা, অচলায়তন তার বিপরীতে অবস্থানই শিল্পীর শিল্পত্ব। শিল্পীর তাই আলাদা করে রাজনৈতিক প্রতিবাদেও অংশ হওয়ার প্রয়োজন পড়ে না। ইতিহাসের সন্ধিক্ষণ ও প্রবাহ আলাদা বিষয়। সন্ধিক্ষণে যে ভাঙ্গবার প্রয়োজন পড়ে তাতে শিল্পী ও গণ উভয়েই স্বতঃস্ফূর্ত ভাবেই প্রতিবাদেও রাজপথে দাঁড়িয়ে পড়ে, কিন্তু যখন সময় গঠনের তখন শিল্পীর দায় নেতৃত্বের, পথ দেখানোর, প্রতিবাদের নয়। আর সে দায় পালন করতে শিল্পীরা বিপ্লবী ভূমি যা তাদেরই শ্রমে ঘামে তৈরী তা ত্যাগ করে বিদেশ বিভূইয়ে আশ্রয়ও নিয়েছেন, প্রাত্যহিক রাজনৈতিক প্রতিবাদের অংশ সে নয়। পশ্চিমী নন্দন আলোচনার খুবই গুরুত্বপূর্ণ স্বীকারোক্তি তাই Abstract art, propaganda against communism
জ
দীর্ঘ খ্রীস্টান যাত্রার পর ইউরোপ ‘রেনেসাঁ’ ইউরোপীয় আত্মপরিচয় সন্ধানের উপায় হয়েছিলো। সেখানের মৃত-ইউরোপীয় ধর্মের ফসিলসমূহ যা ইউরোপীয় মিথ নামে আমরা চিনি, তাদের পথ দেখিয়েছিলো। ইউরোপীয় চিত্রকরেরা সেইসব মিথের ‘প্রত্যক্ষণ’ নির্মাণে রচনা করলেন অসংখ্য চিত্র, তা করতে গিয়েই তারা আবিস্কার করে চললেন চিত্ররচনার বিবিধ কলা ও কৌশল। শিক্ষা ব্যবস্থার মধ্যদিয়ে আমরা তা জানি, জানছি, আরো জানবো। আমাদের তা জানতেও হবে, ইউরোপকে অস্বীকারের কোন পথ বা উপায় নেই, বরঞ্চ তাকে জয় করতে চাইলে তাকে জানতেই হবে। ইউরোপ আমাদের পরাজিত করতে গিয়ে আমাদেরকে নিশ্চিহ্ন করতে চেয়েছে, আবার সেই ইউরোপই কালীঘাটের পট সহ বহুু নিদর্শন রক্ষাও করেছে, হয়তো আমাদের বুঝতে ও শাসন করতেই তারা সেটা করেছে, তবে রক্ষা করেছে। আমাদের নিজেদের প্রতি দায়িত্ববোধেই আমাদের জানতে হবে আমাদেরকে। নিজেকে জানার মধ্যদিয়েই আমরা আমাদের পুনরুত্থান বা রেনেসাঁ করতে পারবো, নচেৎ নয়। আধুনিকতায় বা আন্তর্জাতিকতায় পৌঁছতে গেলে আমাদের পুনরুত্থান বা রেনেসাঁর কোন বিকল্প নেই। সা¤্রাজ্যবাদ আমাদের চোখে উত্তরাধুনিকতার ধুলো ছুড়ে মেরেছে। তা তারা মারুক, আমাদের পরিচয় ও পথ আমাদেরই নির্মাণ করতে হবে। সেটা করতে গেলে ‘মালু’ শব্দটির মত বহু শব্দের উৎস সন্ধান করতে হবে ধর্মান্ধতা মুক্ত হয়ে, যেমন তেমনি সরস্বতী, গণেশ কিংবা আল্লাহুকে ফর্ম হিসেবে বা চিত্র-চরিত্র হিসেবেও দেখবার সক্ষমতা অর্জন করতে হবে।
তা কি পারবো?