করোনাকাল
বিচ্ছিন্ন অনুভব
মাহফুজা হিলালী

প্রবন্ধ
অধ্যাপক আনিসুজ্জামান
শামসুজ্জামান খান

গল্প
ডায়মন্ড লেডি ও পাথর মানব
হামিদ কায়সার

গদ্য
নিদ্রা হরণ করেছিল যে বই
মিনার মনসুর

নিবন্ধ
পঞ্চকবির আসর
সায়কা শর্মিন

বিশ্বসাহিত্য
আইজাক আসিমভের সায়েন্স ফিকশন
অনুবাদ: সোহরাব সুমন

বিশেষ রচনা
প্রথম মহাকাব্যনায়ক গিলগামেশ
কামাল রাহমান

শ্রদ্ধাঞ্জলি
মুজিব জন্মশতবর্ষ
মারুফ রায়হান
 
সাক্ষাৎকার
কথাশিল্পী শওকত আলী

জীবনকথা
রাকীব হাসান

ভ্রমণ
ইম্ফলের দিনরাত্রি
হামিদ কায়সার

ইশতিয়াক আলম
শার্লক হোমস মিউজিয়াম

নিউইর্কের দিনলিপি
আহমাদ মাযহার

শিল্পকলা
রঙের সংগীত, মোমোর মাতিস
ইফতেখারুল ইসলাম

বইমেলার কড়চা
কামরুল হাসান

নাজিম হিকমাতের কবিতা
ভাবানুবাদ: খন্দকার ওমর আনোয়ার

উপন্যাস
আলথুসার
মাসরুর আরেফিন

এবং
কবিতা: করেনাদিনের চরণ

১৭ বর্ষ ০৩ সংখ্যা
অক্টোবর ২০২৪

লেখক-সংবাদ :





আমার প্রথম বই
সুশান্ত মজুমদার
নিয়মিত লেখালেখির বছর এগারো পর বের হয় আমার প্রথম গল্পগ্রন্থ ‘ছেঁড়াখোঁড়া জমি।’ বইটি প্রকাশ করেন রূপম প্রকাশনী আন্ওয়ার আহমদ। তিনি ছিলেন কবি ও সম্পাদক। জীবৎকালে তিনি গল্পবিষয়ক পত্রিকা ‘রূপম’ ও কবিতা পত্রিকা ‘কিছুধ্বনি’ সম্পাদনা করতেন। কবিতা লেখা ও পত্রিকা   সম্পাদনার সুবাদে তাঁর সঙ্গে আমার পরিচয়। আমার গল্পগ্রন্থ প্রকাশে তিনি আগ্রহ দেখালে তৎক্ষণাৎ শুরু হয় দারুণ এক অস্থিরতা যেন ভেতর ছুঁয়ে ছুঁয়ে অথির বিজলী যায় ছুটি। আমার গল্প গ্রন্থাকারে প্রকাশে উপযুক্ত কি’না এই সংশয়ে প্রায়শই আমি আক্রান্ত ছিলাম। তখন সাহিত্য-সংস্কৃতির সাপ্তাহিকী ‘সচিত্র সন্ধানী’তে আমার কাজ। কয়েক ছত্র আলোচনা ছাপার উদ্দেশে আন্ওয়ার আহমদ পত্রিকা বের করে নয়াপল্টনে সন্ধানীর কার্যালয়ে আসতেন। যাওয়ার আগে তাঁর শেষ কথা-- গল্পের পা-ুলিপি কত দূর! জবাবে বানোয়াট উত্তর ছিল আমার একমাত্র উদ্ধার-- ‘এই তো প্রায় হয়ে আসছে।’ ওই সময় চাকুরিস্থলের ঠিকানা থাকলেও আমার রাত্রিবাসে কোনো নির্দিষ্ট ছাউনি ছিল না। ঢাকা শহরের আমি একজন বিবাহিত কুমার। বউ থাকে দূর মফস্বলে। অন্নসংস্থানে আমি একা ঢাকায়। আমার প্রকাশিত লেখার কপি যতেœ রাখার মতো কোনো ব্যবস্থা ছিল না। এই কারণে প্রকাশিত অনেকগুলি গল্প আজো আমি সংগ্রহ করতে পারি নি। স্থায়ীভাবে হারিয়েই গেছে।
দিন যায়। আন্ওয়ার আহমদও হঠাৎ হঠাৎ আসেন। মানুষটা মনে মনে যেন প্রতিজ্ঞা করেছেন-- কত প্রতিষ্ঠিত জ্যেষ্ঠ লেখকদের বই ছেপেছি; আর কোথাকার এক ছোকরা। আতঙ্কে আমি বুজে থাকি, নাছোড় মানুষটা এই বুঝি হাজির হ’ন। একদিন গম্ভীর মুখে আন্ওয়ার আহমদ এসে অফিসের বাইরের বারান্দায় ডেকে আমার পকেটে কিছু গুঁজে হন হন পায়ে চলে যান। আমি নড়াচড়া ভুলে যাই। ধীরে স্বাভাবিক হয়ে গুণে দেখি--তিন হাজার টাকা। সম্ভবত বই বের হওয়ার আগেই তিনি লেখক রয়েলটির অংশ দিয়ে গেলেন। সাঁইত্রিশ বছর আগে তিন হাজার টাকা অনেক টাকাই। এবার কী হবে! পা-ুলিপি প্রস্তুত করে প্রকাশককে না দিয়ে কই যাও! প্রায় সম্পন্ন--বার বার বলা মিথ্যার সঙ্গে এবার যোগ হলো টাকার চাপ। সারা শরীরে হিম ভেঙ্গে আসে। এ-সময় জাফর ওয়াজেদ এসেছেন সন্ধানী অফিসে কবিতা দিতে। আমার নিস্তেজ শুকনো মুখ দেখে তিনি অনুমান করলেন আমি কোনো সমস্যাক্রান্ত। আমার দুরবস্থার কথা খুলে বলতেই জাফর ওয়াজেদ হাসলেন--‘সাধা ভাত পায়ে ঠেলছেন কেন ? নো প্রোবলেম। আপনার বেশ কয়েকটা ছাপা গল্পের কপি আমার কালেকশনে আছে। পেয়ে যাবেন।’ বলে কী! আমার বিস্ময়মাখা চেহারা দেখে সত্যতা প্রকাশে জাফর ওয়াজেদ স্বরে খানিকটা জোর দেন--‘কোনো গুলচাল মারছি না। কালই পেয়ে যাবেন।’ কী সৌভাগ্য, পরিত্রাতা জাফর ওয়াজেদ আমার জন্য প্রস্তুত সমাধান দিতেই কী সন্ধানী অফিসে এসেছেন!
পর দিন জাফর ওয়াজেদের কল্যাণে ‘সাপ্তাহিক বিচিত্রা’, ‘সাপ্তাহিক রোববার’, ‘সংবাদ সাময়িকী’তে প্রকাশিত আমার আট-ন’টা গল্পের পিনবদ্ধ কপি পেয়ে যাই। আমার সারা শরীর থেকে যেন জ¦র ছেড়ে গেল। লেখকের প্রথম বই নিয়ে উত্তেজনা থাকা স্বাভাবিক, কিন্তু আমার সমস্যা আমাকে যেন বাজিয়ে দেখতে চেয়েছে--বইয়ের ভার তুমি বহন করতে পারবে কিনা!
‘ছেঁড়াখোঁড়া জমি’র নাম গল্প তিনটি--এক দুই ছাপা হয়েছিল সচিত্র সন্ধানীতে। সন্ধানীর দপ্তরে চাকরির জন্য ছাপা কপি পেতে অসুবিধা হয় নি। তিন নম্বর গল্পটা কোনো এক সাহিত্য পত্রিকায় ছাপা হয়েছিল--নাম মনে নেই। গল্পটির ফটোকপি দিয়েছিলেন চট্টগ্রামের এক লিটল ম্যাগাজিনের যুবক। এমন উপকারীর নাম মনে না থাকার জন্য আমি ক্ষমাপ্রার্থী। আরামবাগের প্যাপিরাস প্রেসে ওই সময় বইয়ের কম্পোজ ও ছাপা ভালো হতো। প্রেসের প্রধান মোতাহার হোসেনের সঙ্গে আমার পরিচয় হয়েছিল কথাসাহিত্যের দুই স্তম্ভ আখতারুজ্জামান ইলিয়াস ও কায়েস আহমেদের মাধ্যমে। তাঁদের দু’জনের গল্পগ্রন্থের কাজ প্যাপিরাস করেছে। মোতাহার আমার ‘ছেঁড়াখোঁড়া জমি’র কাজ করতে উৎসাহী। প্রকাশক আন্ওয়ার আহমেদেরও সমর্থন পাওয়া গেল। শিল্পী সমর মজুমদার প্রচ্ছদ আঁকতে সানন্দে রাজি। তখন তিনি প্রেসের কাছাকাছি বিসিকে কর্মরত। বইয়ের প্রুফ দেখবো আমি।
প্রকাশকের হাতে পা-ুলিপি দেয়ার পর নির্ঘুম রাত কাটে। গল্পের শব্দ বাক্য, বিষয়ের কোথাও কোথাও মনে মনে সংস্কার করি। যতদূর সম্ভব লেখার পতিত অংশের উন্নতি না হলে মনের মধ্যে খোঁচাখুঁচি লেগেই থাকবে। হ্যান্ড কম্পোজে তখন এক ফর্মা করে কম্পোজ হতো। সপ্তাহ শেষে নিউজপ্রিন্টে প্রুফ পেয়ে লেখার উপর বিহবল দৃষ্টিতে চেয়ে থাকি। ছাপার পর লেখা পড়া আমার জন্য দুষ্কর। দূর, বিষয় ঠিকঠাক লেখা হয় নি। শব্দ ব্যবহারও যথাযথ মনে হয় না। বাক্য গঠন কি ঠিক আছে? এতো গোলযোগ নিয়ে আমার লেখা যখন আমারই মধ্যে কলহ করে তখন পাঠক এই বই কিনতে ও পড়তে যাবেন কেন?
শুরু হলো প্রুফের বানান, ভুল কাটাকুটির সঙ্গে নতুন লাইন যোগ, শব্দ বদলে নতুন শব্দের ব্যবহার। ফাঁকা লাগা অংশে পুরো নতুন এক প্যারা লিখে বসিয়ে দিই। নির্দিষ্ট দিন সন্ধানীর অফিসে মোতাহার এসে হাজির। প্রেসের ব্যস্ততা নিরসনে সে সর্বক্ষণ তৎপর থাকে। এক ফর্মা প্রুফ তাঁর হাতে তুলে দিতেই মোতাহার শরীরের শক্তি হারিয়ে চেয়ারের উপর যেন খসে পড়ে। তাঁর গলায় আর্তনাদ--‘করেছেন কি? এতো নতুন করে লিখেছেন? এই প্রুফ আমি প্রেসে নিতে পারবো না।     কম্পোজিটর ক্ষেপে যাবে।’ আমি তাঁকে অভয় দিই। পরের প্রুফে এতো কাটাকুটি থাকবে না। মোতাহার চুপ--তাঁর মুখে কিছুতেই আর আগের আলো ফিরে আসে না।--‘শোনেন, যতটুকু কম্পোজ হয়েছে কেটেছেন, আপনার বাকি লেখা আমি দিয়ে যাব, আপনি নতুন করে লিখে দিলে কম্পোজ হবে।’ আমি জানি, প্রুফ দেখতে দেখতে সংশোধন, যোগ-বিয়োগ না করলে আর করা হবে না। মোতাহারের কণ্ঠ থেকে দয়া-মায়া, সম্মতির কোনো সুর শোনা গেল না। তাঁর সিদ্ধান্তে সে যেন অনড়।
মোতাহার এক ফর্মা কাটা প্রুফ নিয়ে আরামবাগের উদ্দেশ্যে রওনা দেন। অস্বস্তিপূর্ণ মনে আমিও অফিস ছেড়ে তাঁর পেছন ধরে যাত্রা করি। ফকিরাপুলের চিপা জনবহুল নোংরা রাস্তা পেরিয়ে উঁচু পুরনো বিল্ডিংয়ের ঘাড়ের পাশে বাতাসরুদ্ধ করে দাঁড়িয়ে ক্ষয়াটে ইটের বাড়ি, দক্ষিণের আরো সরু রাস্তার শেষ মাথায় প্যাপিরাস প্রেস। মোতাহার নিশ্চয় প্রুফ কম্পোজিটরের হাতে দিয়েছে, নচেৎ ভেতরে বজ্রকণ্ঠ কেন? দরোজার আড়ালে দাঁড়িয়ে শুনি--আমার চৌদ্দগুষ্ঠি উদ্ধারের গরম বাক্য। ইট-পাটকেল ছুঁড়ে মারার মতো চরম গালিগালাজ প্রেসের চারপাশের  এসে পড়ছে। আমি কলঙ্কে ভিজে যাই। দরকার নেই বইয়ের--এমন রুখোচালে ভেতরে ঢুকে মোতাহারের দিকে হাত বাড়িয়ে দিই--‘দেন, আমার পা-ুলিপি।’ কম্পোজিটর চুপ। মোতাহার আমার মুখে বিব্রত নজর ধরে রাখে। এরা বুঝেছে, তাঁদের ক্রুদ্ধ কণ্ঠের অরুচিকর সব কথা আমি শুনেছি। দু’জন কম্পোজিটর কোনো কাজের বাহানায় দ্রুত বেরিয়ে গেল। বাকি কম্পোজিটর উপদেশ দানে আমার উদ্দেশে ঘুরে দাঁড়ায়--‘কম্পোজের কালে তো আপনার লেখা পড়ছি, জটিল লেখা, রসকষ নেই, এ চলবে না।’ কষ্ট চেপে আমি মুখে একপ্রস্ত ম্লান হাসি ঝুলিয়ে রাখি। মোতাহার আমাকে এবার আশ^স্ত করেন--‘ঠিক আছে কম্পোজ হবে। কাটাকাটি কম করেন। সহসা সে মন খুঁড়ে দু’লাইনের স্মৃতি তুলে আনে--‘আরে, ইলিয়াস সাহেব, কায়েস সাহেব তো জ¦ালিয়ে মেরেছেন। তাঁদের লেখা কারেকশনে সময় গেছে, ওই টাইমে দু’তিনটা বই হয়ে যেত।’ বুঝলাম, অগ্রজ দুই লেখক প্রুফ দেখার সময় একই কান্ড করেছেন। অজান্তে গুরুজনদের অনুসরণ করেছি বুঝে ভেতরের ভার খানিকটা হালকা হয়ে এলো।
বইয়ের কাজ শেষ হতে হতে একুশের বইমেলা চলে গেল। প্রকাশকের মুখ দেখে পরিষ্কার বুঝি--আমার উপর দারুণ চটে আছে সে। তাঁর ধারণা হয়েছে, লেখকের নামে আস্ত একটা ডেঁপো যুবক আমি। নিজের লেখার যতেœর অছিলায় সময় নষ্টের বাজে বাহাদুরি করছি। জানি, বইয়ের এগারোটি গল্প আমাকে বানাতে হয় নি। চারপাশ থেকে তুলে আনা চরিত্র, নাম-ধাম, পটভূমি এদিক-ওদিক করেছি মাত্র। বিশেষ করে বামপন্থী রাজনীতির দুর্বলতা, তাদের ব্যর্থতার একাধিক গল্পের বিষয় নিয়ে মনে চাঞ্চল্য ছিল। ভ্রান্ত উগ্রপন্থার ইনারকিলিং গল্পের কারণে দলীয় ক্যাডারদের থেকে বিরাগভাজনের সম্ভাবনা ছিল। আমি চাই নি,আমার গল্পে পঠন-পাঠনে পাওয়া বহুল প্রচলিত গদ্য ও আঙ্গিকের ব্যবহার। মুক্তিযুদ্ধ-পরবর্তী সত্তর দশকে তীব্র আলোড়িত হয় দেশ-জাতি। বদলে যেতে থাকে মানুষের মন-মেজাজ-রুচি-অভ্যাস। নতুন বাস্তবতা গল্পে ধরতে হলে চাই বিষয়ানুযায়ী ভাষা ও লিপিকৌশলের ব্যবহার। এ-কারণে আমার গল্প পাঠে পাঠকের আয়ত্তে থাকা পুরনো পাঠ-অভিজ্ঞতা হয়তো হোঁচট খাবে। চিন্তায় এমন ধারণা তখনো আমি লালন করি মাত্র। কাউকে বলি না, লিখেও নিজস্ব বিবেচনা প্রকাশ করি না। অন্তর্নিহিত ভাবনা গল্পে শিল্পিতভাবে প্রকাশ করাই হচ্ছে লেখকের ক্ষমতা। এমন শক্তি কি অর্জিত হয়েছে ? আমি তো সাহিত্যের নবীন শিক্ষাথী
গ্রন্থের প্রথম গল্প ‘এক জোড়া মোজা’য় আমি লিখতে চেয়েছি এস্টাবলিশমেন্ট-বিরোধী বিষয়। আমি যখন জীবন-জীবিকার প্রয়োজনে ঢাকাবাসী তখন অনির্দিষ্ট ছিল আমার বাস, তিন বেলা আহারের নিশ্চয়তা ছিল না। কখনো কবি জাহিদ হায়দারের বাসায়, কখনো কবি সোহরাব হাসানের ভাড়া বাসায়, কখনো কবি আবদুল হাই শিকদারদের টিনের ছাউনিতে আমার সাময়িক রাত্রিবাস। জামা-প্যান্ট সব-সময় পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন রাখার উপায় ছিল না। পরে সূর্য সেন হলে বহিরাগত হয়েও বিভিন্ন রুমে রাত কাটাই। আমার চেহারা, বেশভুষা বহুজনের কাছে ছিল বিরক্তিকর। এমনও দিন গেছে, সাপ্তাহিক ‘বিচিত্রা’য় গল্প জমা দেয়ার জন্য বিভাগীয় সম্পাদক আলমগীর রহমানের জন্য অপেক্ষা করছি, তখন বিচিত্রাসংশ্লিষ্ট এক প্রদায়ক রুক্ষ নজর দিয়ে আমাকে চেয়ারছাড়া করেছেন। আমি জানি, এস্টাবলিশমেন্ট উপরে যতই চকচকে ঝলমলে করুক তার ভেতরে রয়েছে লোভ-লালসা, পচন-ক্ষয়-নিরাময়শূন্য অসুখ। আমি বড়কর্তার পায়ের মোজার গন্ধের মধ্য দিয়ে প্রকাশ করতে চেয়েছি প্রতিষ্ঠান, সাহেব-সুবের নোংরা জীবন। ‘এক জোড়া মোজা’ আমার অন্যতম একটি প্রিয় গল্প।
‘অনিবার্য’ গল্পটি ষাটের দশকে খুলনা থেকে বাগেরহাটের ফেরার কালে দেখা ন্যারোগেজ রেল নিয়ে। অসুস্থা মা-কে প্রায়ই খুলনার ডাক্তার দেখিয়ে সন্ধ্যার মুখে ফেরার পথে রূপসার পর প্রথম ছোট যে স্টেশন কর্ণপুর, এর অন্ধকারাচ্ছন্ন পরিবেশ স্কুল পড়–য়া ওই বয়সে আমাকে দারুণ প্রভাবিত করেছিল। স্মরণে জীবিত থাকা দৃশ্যাবলি নিয়ে তাই লিখতে পেরেছিলাম, ‘দিনমানের রোদ পোড়া পোড়া ঝলসানো গাছ-গাছালি অস্পষ্ট, ধোঁয়া-ধোঁয়া, স্থির, শুকনো, কর্কশ রেখার পি-। দু’পাশের ঘাসজমিতেও একটানা রমরমা কালোর স্রােত। চাঁদের উল্টো পিঠের গা ছমছমে রহস্য ছড়ানো।
ঢাকার শান্তিনগরের এক সরু গলি রাস্তায় আমি যখন পুরনো টিনের ঘরে থাকি, সচিত্র সন্ধানীতে চাকরি করি, যাতায়াতকালে বিভিন্ন ফল গাছের আড়ালে মিতালি কুটির নামে পুরনো একটা ইটের বাড়ি দেখা যেত। এক বৃষ্টির দিনে দেখি, এক অশক্ত বৃদ্ধ মানুষ তাঁর বোচকা নিয়ে চুপচাপ বাড়িটার সামনের এক ফালি ফাঁকা বারান্দায় বসে ঝিমুচ্ছেন। ভেতর থেকে ভেসে আসছে রান্নার দারুণ গন্ধ। তখুনি আমার মাথার মধ্যে ক্রমশ জমতে থাকে ‘সরল সত্য’ গল্পটি।
মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে বইয়ে আছে ‘একাকার’ ও ‘শরিক’ নামে দু’টি গল্প। ‘একাকার’ গল্পে আমাদের শহরের পাশে ভৈরব নদীর পাড়ের বাগেরহাট শহরে একাত্তরে পাকিস্তান আর্মির অ্যকশন, ধ্বংস, হত্যাকা- নিয়ে লেখা। বিধবা শুচিবাইগ্রস্ত হিন্দু নারী নদী পার হয়ে আশ্রয় নিয়েছে এক মুসলিম বাড়িতে। বাড়ির সাহসী সচেতন যুবক সনাতনধর্মী এই বৃদ্ধার বাড়ি রক্ষা করতে গিয়ে পাকিস্তান আর্মির গুলিতে শহিদ হয়েছেন। এই যে ধর্মীয় পরিচয়ের উর্ধ্বে বাঙালির একাকার হয়ে যাওয়া জীবন দান--এমন সত্য ঘটনা নিয়ে আমার ‘একাকার’ গল্পটি। কিন্তু ‘শরিক’ গল্পে মুক্তিযুদ্ধ থাকলেও এবং আমার এলাকার ঘটনা হলেও পরে আমি ভেবেছি গল্পটি শিল্পের সংযম ভেঙ্গে ফেলেছে, লেখায় পরিমিতিবোধের অভাব রয়েছে। শিল্পের শর্ত পূরণে আমি তখনো হয়তো পুরো মাত্রায় সচেতন হই নি।
বইয়ের বাকি পাঁচটি গল্প ‘টুথপেস্ট’, ‘ছেঁড়াখোঁড়া জমি-১’, ‘ছেঁড়াখোঁড়া জমি-২’, ‘ছেঁড়াখোঁড়া জমি-৩’, ‘প্রতিপক্ষ’ আমার একটি উপন্যাসের চিন্তাধারার খন্ড খন্ড আখ্যান। তখন উপন্যাস লেখার মতো একটানা মনোযোগ, পরিশ্রম আমার মধ্যে পুরোপুরি ক্রিয়াশীল ছিল না। উপন্যাসের বিষয় ভেঙ্গে যেতে থাকে এবং তা বিভিন্ন নামে গল্প হয়ে যায়। ছাত্রজীবনে আমি প্রগতিশীল রাজনীতির সক্রিয় কর্মী ছিলাম। ষাটের দশকের বাম রাজনীতি আমাকে রোমাঞ্চিত করেছিল। তত্ত্বীয় বিষয়ে গভীরে যাওয়ার মতো বিদ্যা-বুদ্ধিতে তখনো দখল ছিল না। আবেগ ও গোপন রাজনীতি ধাঁধা প্রবলভাবে টেনেছে। একদিন শুনি আমাদের ছোট্ট শহরের সচ্ছল পরিবারের কলেজ পড়–য়া এক যুবক হঠ্যাৎ নিখোঁজ। ক’দিন পর নিজের থেকে সে ফিরে আসে। বামরাজনীতি নিয়ে তাৎক্ষণিক প্রভাবিত হয়ে গ্রামাঞ্চলে সে কাটিয়েছে। তাঁর শ্রেণী চরিত্র আদৌ অনুমোদন করেনি রাজনীতি। একসময় বাম রাজনীতির মতাদর্শগত মতপার্থক্য এমন সংঘাতময় পর্যায়ে পৌছে যে এতোদিনের ঘনিষ্ঠ কমরেড একে অন্যকে শ্রেণীশত্রু আখ্যা দিয়ে পরস্পরকে মেরে ফেলার সিদ্ধন্ত নেয়। অভ্যন্তরীণ কোন্দল সমাজবিপ্লবের জন্য ক্ষতিকারক। সাংগঠনিকভাবে বামরাজনীতি এলাকাভিত্তিক টুকরো হয়ে অন্য নামে আত্মপ্রকাশ করতে থাকে। এই অপরাজনীতির ইনারকিলিং নিয়ে আমি রচনা করি একাধিক গল্প। সব গল্পের সময় রাত এবং পটভূমি শহরতলি ও গ্রামাঞ্চল। ‘বাংলাদেশের সমকালীন ছোটগল্পে’ ‘ছেঁড়াখোঁড়া জমি-২’ প্রকাশিত হওয়ার পর শক্তিমান কথাসাহিত্যিক আখতারুজ্জামান ইলিয়াস আমাকে উৎসাহিত করেছিলেন। ‘ছেঁড়াখোঁড়া জমি-৩’ গল্পে এক জোতদার পুত্র আমজাদ ভূমিহীন কৃষকদের আন্দোলন, মাঠের ফসল দখল কর--বীরত্বের এই শ্লোগানের আকর্ষণে বাড়ি ছেড়ে দলে ভিড়ে যায়। জোতদাররাও সংগ্রামী কৃষকদের বিরুদ্ধে পাল্টা ব্যবস্থা গ্রহণ করে। এক সময়ে কৃষক আন্দোলন মার খেলে আমজাদ স্বীয় বাড়িতে ফিরে আসে। তাঁর প্রত্যাবর্তনের খবর পেয়ে শহীদ কৃষকের স্ত্রী রাহেলা বাচ্চা কোলে এসে হাজির--‘ এই ছাওয়ালডার বাজানরে মনসুর জোতদার খুন করলি পর আপনারা কইছিলেন বদলা নেবেন। সেই বদলায় কি করতিছেন ? তার জন্যি আসা। বদলা না নিতি অব্দি দুই-এক নলা ভাত যা মুখি পুরি তা হারাম মনে কয়।’
প্রকৃতপক্ষে, গল্প লেখার জন্য আমাকে কাহিনী বানাতে হয় নি। চারপাশের মানুষ, বিরাজমান বাস্তবতা, পায়ের নিচের জমিন, এমনকি জীবন্ত প্রকৃতি আমাকে প্রতিনিয়ত উপকথা বা চালচিত্রের জোগান দিয়েছে।
শেষাবধি সামনে পহেলা বৈশাখ রেখে আমার ‘ছেঁড়াখোঁড়া জমি’ গল্পের বই প্রেসের লাঞ্ছনা থেকে রেহাই পেয়ে পাঠকের মুখ দেখে। ছত্রিশ বছর আগে বাংলা ১৩৯৪, ইংরেজি এপ্রিল ১৯৮৮-তে বড় ভাইকে উৎসর্গিত বইটি বাংলা একাডেমি চত্বরে আয়োজিত বৈশাখী মেলায় ‘রূপম প্রকাশনী’র স্টলে শোভা পায়। মনে আছে, মেলায় ছোট আয়তনের বইয়ের স্টল ছিল তিনটি; প্রাঙ্গণে আর সব কাপড়-চাদর-মাদুর পেতে বসা কাঠ-বাঁশ-হাড়ি-পাতিল, পুতুল, খেলনা, মুড়ি-মুড়কির দোকান। সাংসারিক কাজে ব্যবহার্য জিনিসপত্র কিনতে মহিলাদের উপস্থিতিই বেশি। ঢাক-ঢোল, বাঁশির আওয়াজ ও রঙিন বাচ্চাদের দৌড়া দৌড়ির মধ্যে বইয়ের দোকান এবং আমার বইটি ষোলআনা উপেক্ষিত।
তখন দুপুর। মেঘের আনাগোনায় আকাশ ক্রমশ আলো হারাচ্ছে। আশপাশের গাছের ডালে বাতাসের মৃদু হামলা শুরু। প্রকাশক থেকে এক কপি বই নিয়ে আমি ঊর্ধ্বশ^াসে রওনা দিই। শান্তিনগরের সরু এক গলির ঘোরপ্যাঁচের মাথায় জংধরা টিনের ছাউনির লম্বাটে রুমে আমার বাস। কালবৈশাখী ভীষণ প্রতাপে প্রকৃতি দখল করে। কারেন্ট চলে গেছে। আটপৌরে রুমের অন্ধকারে প্রবল বর্ষণের আওয়াজের মধ্যে বইটি বুকে চেপে আমি বসে থাকি।