করোনাকাল
বিচ্ছিন্ন অনুভব
মাহফুজা হিলালী

প্রবন্ধ
অধ্যাপক আনিসুজ্জামান
শামসুজ্জামান খান

গল্প
ডায়মন্ড লেডি ও পাথর মানব
হামিদ কায়সার

গদ্য
নিদ্রা হরণ করেছিল যে বই
মিনার মনসুর

নিবন্ধ
পঞ্চকবির আসর
সায়কা শর্মিন

বিশ্বসাহিত্য
আইজাক আসিমভের সায়েন্স ফিকশন
অনুবাদ: সোহরাব সুমন

বিশেষ রচনা
প্রথম মহাকাব্যনায়ক গিলগামেশ
কামাল রাহমান

শ্রদ্ধাঞ্জলি
মুজিব জন্মশতবর্ষ
মারুফ রায়হান
 
সাক্ষাৎকার
কথাশিল্পী শওকত আলী

জীবনকথা
রাকীব হাসান

ভ্রমণ
ইম্ফলের দিনরাত্রি
হামিদ কায়সার

ইশতিয়াক আলম
শার্লক হোমস মিউজিয়াম

নিউইর্কের দিনলিপি
আহমাদ মাযহার

শিল্পকলা
রঙের সংগীত, মোমোর মাতিস
ইফতেখারুল ইসলাম

বইমেলার কড়চা
কামরুল হাসান

নাজিম হিকমাতের কবিতা
ভাবানুবাদ: খন্দকার ওমর আনোয়ার

উপন্যাস
আলথুসার
মাসরুর আরেফিন

এবং
কবিতা: করেনাদিনের চরণ

১৭ বর্ষ ০৩ সংখ্যা
অক্টোবর ২০২৪

লেখক-সংবাদ :





জীবনের প্রমত্ত ঢেউ
শামীম আহমেদ
আমরা আমাদের চারপাশে যত সাফল্যের গল্প দেখি, তার পেছনে যে কত-শত বঞ্চনা-ব্যর্থতার কাহিনী থাকে, তা আমাদের বেশিরভাগেরই অজানা থেকে যায়। যেহেতু অধিকাংশ ক্ষেত্রেই আমরা সাধনা, যন্ত্রণা, শ্রমের কাব্যগুলো সম্পর্কে অবগত নই, সেহেতু কেবল সাফল্যের গল্প আমাদের অনেককে বিচলিত করে।
আমরা অনেক সময় ভাবি আমাদের ভাগ্যটাই খারাপ। তবে এ-ও ঠিক, কারও কারও সাফল্যের জন্য অন্যদের মতো অতটা পরিশ্রম তো করা লাগে না। অনেকের ভাগ্যও ভাল হয়, আবার কেউ কেউ পারিবারিকভাবেই অনেক কিছু পেয়ে সৌভাগ্যবান হন। সেই সব অল্প কিছু মানুষকে দেখলে আমার ভালো লাগে। জীবন খুব অদ্ভুত জিনিস।
জন্ম থেকে পৃথিবীর আমাদের উপহার দেয় শত শত কোটি ভাগ্য-বিড়ম্বিত মানুষ; সেখানে গুটি কয়েকজন যদি ভাগ্যের পালে হাওয়া পেয়ে জীবনে সুখী হয়, তবে হোক না! তবে আমরা যারা অতটা ভাগ্যবান নই, তারা অন্তত অন্যের সৌভাগ্যকে দেখেও তো কিঞ্চিত খুশি হতে পারি! নিজেদের ধনে-মানে-ঐশ্বর্যে যদি আমাদের পুলকিত হবার সেই মাহেন্দ্রক্ষণ না আসে, তবে সেই মুহূর্তের মুকুট যখন অন্যের জীবনকে মহিমান্বিত করে, তখন তার থেকেই আমরা বরং খুশির উপাদান খুঁজে নিতে পারি।
তবে এটিও উল্লেখ করা দরকার, আমরা মানুষের ভাগ্য দেখে উল্লাস করতে পারি বৈকি, কিন্তু অন্যের ভাগ্য লুটে যারা খায়, তাদের জীবনকে যাতে আমরা আবার উদযাপন না করি!
যেহেতু চল্লিশের কোঠায় প্রবেশ করেছি বেশ ক’বছর আগে, এখন যারা তরুণ, কিশোর; যারা আগামীর জয়যাত্রী হবেন নিজের ও দেশের, তাদের কেউ কেউ এই অভাগার কাছ থেকে জীবন নিয়ে পরামর্শ চান। এমনসব ক্ষেত্রে আমি সবসময় তরুণদের জানিয়ে দিই যে আমি কোনো সাফল্যের মাল্যগাথা নই। সে তরুণ আমার ক্লাসে কিংবা বাইরে যেখানেই হোক না কেন, তাদের আমি বিনয়াবনতচিত্তে মনে করিয়ে দিতে চাই যে, আমার জীবন একগুচ্ছ ব্যর্থতার গল্প। তবু যদি তারা গল্প শুনতে চান, আমি তাদের গল্প বলি। সে গল্প ব্যর্থতার এবং ব্যর্থতা থেকে বেরিয়ে আসার গল্প।
আমার কাছে জীবনের সব সফলতার গল্পই হচ্ছে একেকজন মানুষের ব্যর্থতা কাটিয়ে উঠবার গল্প, এক ভুল দ্বিতীয়বার না করার গল্প। একই ভুল বারংবার করেও কেউ কেউ সফল হন বটে; তবে তরুণদের সাথে আমি সেই গল্প করি না। গত সপ্তাহে আমার এক ছাত্র ক্লাস শেষে দোনা-মনা করতে করতে এসে আমাকে জিজ্ঞেস করেই ফেলল, আমি কীভাবে ক্লাসে এত দয়ার্দ্র আচরণ করি! কখনও রাগি না, কখন গলার স্বর উঁচু করি না।
সবসময় শিক্ষার্থীদের সমস্যাকে নিজের সমস্যা মনে করে তার সমাধান খোঁজার চেষ্টা করি। সেই শিক্ষার্থীর বন্ধু আমাকে বলল, তার বন্ধু কয়েক সপ্তাহ ধরেই আমাকে এই প্রশ্নটি করতে চাইছিল, ওরা আটকে রেখেছিল, আজ আর পারল না। আলাপের এক পর্যায়ে ওই শিক্ষার্থী জিজ্ঞেস করল আমার রাশি কুম্ভ কিনা! যেহেতু বেশিরভাগ ক্ষেত্রে অনার্স লেভেলের শিক্ষার্থীদের পড়াই, তাই তাদের কৌতূহল আমাকে খুব বেশি অবাক করে না। কিন্তু এই শিক্ষার্থী ছিল মাস্টার্স লেভেলের, তাই একটু অবাক হলেও তার প্রশ্নের ধরনে হেসে দিলাম।
তাকে জানালাম, আমি কুম্ভ রাশির জাতক নই, আমি কন্যা রাশির জাতক, যদিও রাশিফলে আমার বিশ্বাস নেই। তরুণী মাথা নেড়ে বলল, না কিছুতেই মিলছে না। তুমি এত দয়াবান, এত হেসে কথা বলো, আমাদের এত সমস্যার সমাধান করো, কখনও রেগে যাও না, আমি ভেবেছিলাম তুমি নিশ্চয় কুম্ভ রাশির জাতক। তাকে বললাম, আমি তো সবসময় এমন ছিলাম না।
জীবন আমাকে যেভাবে একদিকে কঠিন করেছে; অন্যদিকে সহজও করেছে, ন¤্রও করেছে। আজ থেকে দশ বছর আগে আমাকে মানুষ যেভাবে চিনত, এখন তো সেভাবে চিনবে না। জীবনের অর্থই তো তাই। সময়ের সাথে বদলে যাওয়া। খুব ভাল হয় সেই বদলে যাওয়া যদি ভালোর জন্য হয়। ক্লাস শেষ হয়ে গেছিল, সবার ঘরে ফেরার তাড়া; তরুণী যাওয়ার সময় বিড়বিড় করে বলছিল, আমি যদি তোমার মতো দশভাগ ন¤্রভদ্রও হতে পারতাম! আনমনে হাসলাম।
পরের ক্লাসে তাদের বললাম, আমি তোমাদের সাথে যেমন, আমার বাবা-মা, স্ত্রী-সন্তান এবং ঘনিষ্ঠ বন্ধুদের সাথে হয়তো অমন নই। তারা আমার একান্তজন, তাদের সামনে আমি অনেক খোলামেলা। শিক্ষকতা আমার পেশা। আমার পেশায় আমি শঠ নই একথা যেমন সত্য; তেমন এও সত্য আমি তোমাদের বন্ধুও নই।
আমি তোমাদের বন্ধুর মতো বৈকি, কিন্তু বন্ধু তো নই। কর্মক্ষেত্রে অনেকে বন্ধু হয়, আমি হই না। এটা আমার নিজস্ব সিদ্ধান্ত। কাজের ক্ষেত্রে পরিশ্রমী হতে চাই, সৎ হতে চাই, বিনয়ী হতে চাই, বন্ধুবৎসল হতে চাই; কিন্তু বন্ধু হতে চাই না।
প্রসঙ্গক্রমে আরেকটি বিষয়ের অবতারণা করি, বড় হতে গিয়ে দেখলাম পরিচিত অনেক বিজ্ঞ, প্রজ্ঞাবান মানুষ সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে তাদের সাফল্যের খবর উল্লেখ করেন না। কেন করেন না সেটা বুঝেছি আরও বহু পরে। সাফল্যের খবরে কিছু মানুষ প্রথমে বিস্ময় প্রকাশ করে, তারপর খুশির ভান করে মাথায় তোলে।
এরপর চুপি চুপি নিজেদের মধ্যে হতাশা প্রকাশ করে, তারপর কিছুদিন চুপ থেকে আপনার দোষ-ত্রুটি-ব্যর্থতা খুঁজে বের করে, সবাইকে জানায়, তারা আগেই সন্দেহ করেছিল আপনার পক্ষে সফল হওয়া সম্ভব নয়। এরপর শুরুতে আপনাকে যে মাথায় তুলেছিল, সেখান থেকে আছাড় মারে। তাই বিজ্ঞজন, প্রজ্ঞাবানরা এখন আর সামাজিক মাধ্যমে সাফল্যের খবর দেন না। সাফল্য খুব কঠিন জিনিস, ব্যর্থতাও। আমার পিএইচডি করার শুরুর দিকে ক’জন মানুষের অনেক সাহায্য-সহযোগিতা পেয়েছি।
পিএইচডির অর্ধেক পথে এসে, তারা হঠাৎ করেই বলা যায় আমার জীবন থেকে হারিয়ে যায়। হারিয়ে যাওয়া বলতে আক্ষরিক অর্থে বলছি না, কিন্তু তাদের যে অবয়ব আমাকে চলার পথে উৎসাহ দিয়েছে, সেই রূপ পাল্টে যায়। তাদের আচরণে এই ইঙ্গিতও প্রকাশ পায় যে, তাদের সাহায্য ছাড়া পিএইচডি নামক পাহাড় টপকানো আমার পক্ষে সম্ভব না।
চলার পথের এই বেমক্কা ধাক্কা খেয়ে জীবন থেকে প্রায় এক-দেড় বছর পিছিয়ে গিয়েছিলাম বটে, কিন্তু পরবর্তীকালে আবিষ্কার করলাম তাদের সরে যাওয়া, পাল্টে যাওয়া অবয়ব আমার জন্য হিতে বিপরীত হয়েছে। নিজের হারানো আত্মবিশ্বাস ফিরে পেয়েছি। বিদেশ-বিভূঁইয়ের মাটিতে বিশ্বের সেরা বিশ্ববিদ্যালয়ের পিএইচডি একার শ্রম ও সাধ্যেই অর্জন করতে পেরেছি। এই যে জীবনে ঘটে যাওয়া প্রতিবন্ধকতা, তা আদতে আমাদের চলার পথের ছড়ি হয়ে যায়।
সেদিন এমনই এক তরুণের সাথে কথা হচ্ছিল। অনেকদিন ধরেই সে আমার কাছে সময় চাচ্ছিল জীবন নিয়ে, জনস্বাস্থ্য নিয়ে, টিকে থাকা নিয়ে গল্প করার জন্য। অবশেষে তাকে কিছুটা সময় দিতে পারলাম। পুরোটা সময়েই তার মধ্যে মুগ্ধতা এবং সেই মুগ্ধতার উৎস আমার জীবনের ব্যর্থতার গল্প, ব্যর্থতার সাথে ক্রমশ লড়াই করার গল্প।
সেই বিনয়ী তরুণী কথাপ্রসঙ্গে আমাকে বলল, ব্যর্থতা, সফলতা, বিনয়ের সাথে সাথে বয়সও তোমাকে পরিণত করেছে। হেসে তরুণীর সাথে সহমত প্রকাশ করলাম। বয়স তো জীবনের একটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয় বটেই। বয়স সময়ের একটি জরুরী পরিমাপক। সেই নিক্তিতে যদি পাড়ি দেওয়া পথ থেকে শিক্ষা না নেওয়া যায়, তবে জীবন নামক উত্তাল সমুদ্র পাড়ি দেওয়া দুষ্কর বটে। আদতে জন্ম থেকে মৃত্যু তো কেবলই এক উত্তাল সাগর, যার প্রমত্ত ঢেউগুলো একেকটি ব্যর্থতা থেকে শিক্ষা নিয়ে এগিয়ে যাওয়ারই গল্প।