‘একটা দমবন্ধ ঘরে বহু বছর পরে রোদ্দুর ঠিকরে পড়ল যেন। আবার কেমন জানি কান্নাও পেল। আশ্চর্য! ..চোখের আড়াল হওয়া স্বজনের লেখা চিরন্তন পরম সম্পদ - একজীবনের জন্য অমূল্য প্রাপ্তি।’ আমার কাছে লেখা আমার মা প্রয়াত কথাসাহিত্যিক মকবুলা মনজুরের দুটো চিঠি পড়ে কবি মারুফ রায়হানের এই মন্তব্য আমাকে গভীরভাবে আমাকে ছুঁয়ে গেল, আনন্দ ও বেদনায় মেশানো সে অনুভূতি।
১৯৯৮ থেকে ২০১১-র মধ্যবর্তী নানা সময়ে অস্ট্রেলিয়া প্রবাসী আমাকে মা প্রচুর চিঠি লিখেছিলেন। কখনো ঢাকা, কখনো থাইল্যান্ড অথবা নিউজিল্যান্ড থেকে। মা ভালোবাসতেন চিঠি পেতে আর ভালোবাসতেন চিঠি লিখতে। প্রবাসে আমার কাছে মা’র প্রতিটি চিঠি খোলার মুহূর্ত ছিলো সদ্য খোলা ঝিনুকের ভেতর থেকে একটি আশ্চর্য নিটোল মুক্তো বের করে নেয়ার মতো আনন্দময়।
দেশের মাটির জন্য মা'র ছিল অন্ধের মতো টান। কিন্তু সংসারের দাবি মেটাতে গিয়ে মাকে বিদেশে মাইগ্রেট করতে হয়েছিল একাধিকবার। দেশত্যাগের বেদনা তাঁর কাছে ছিল অসহনীয়। অথচ সে কথা বাইরের কাউকে জানান নি কখনো। সেই অব্যক্ত যন্ত্রণা তাঁর চিঠিতে শব্দবদ্ধ হয়ে ধাক্কা দিয়ে যায় বুকের ভেতরে-
‘এই যে সুন্দর প্রকৃতি, প্রজাপতির মতো ফুটফুটে নাতনি লনে তার দাদার সাথে ছুটে বেড়াচ্ছে এই সবকিছু ছাপিয়েও আমার গরীব আর বিশৃংখল, দুর্নীতি আর বিােভে ভরা স্বদেশ কেন এমন করে ডাকে আমাকে। সবাই বলে, তুমি কেন মনে করতে পারো না যে এখানে বেড়াতে এসেছো, আরো কত জায়গায় বেড়াবে। কিন্তু পাখির ডানায় ওড়ার আনন্দ কেন জানো? তার এক সময় নীড়ে ফিরে যাবার আশ্বাস আছে বলে।’
‘...কিন্তু ওই যে আমার দুঃখ-দারিদ্র্যে জর্জরিত, নিরাপত্তাহীন, রোগে ভারাক্রান্ত জন্মভূমি সে আমাকে এক মুহূর্তও ভুলে থাকতে দেয় না। ওখানে আমি নেই, কিন্তু ছিলাম। চল্লিশ বছর ধরে দুঃখে আনন্দে মেশানো একটা সংসার আমি গড়ে তুলেছিলাম। একবার ভেঙ্গে যেতে যেতে আবার নতুন করে সাজিয়েছিলাম এখান থেকে ফিরে গিয়ে। সেই সংসার আমার কোথায় হারিয়ে গেলো! এখন তো দেশের মাটিতে ফিরে গেলেও কদিনের অতিথি হিসেবে অন্যের বাড়িতে থাকবো। আর ঢাকায় আমার সেই সাহিত্য জগৎ, পত্রপত্রিকা অফিস, রেডিও টিভি কোথাও রইল না আমার পদচারণা। আমি ওখানে গেলেও যাব আগন্তুকের মত। আর এখানে! এইসব চিন্তা আমাকে সর্বণ তাড়িয়ে ফেরে। ...ওই যে আমি ছিলাম - সেই আমি আর রইলাম না এই কষ্ট আমি কী করে বোঝাই মাগো!’
তাই বোধকরি মা’র ছোটগল্প ‘অন্তরাল সংগীত’-এর প্রধান চরিত্র ইতিহাসের অধ্যাপক লায়লা আহমেদের হৃদয় মথিত উচ্চারণ ‘...এদেশের মাটি থেকে আমাকে কেউ নিতে পারবে না’ - আর তীব্র অনিচ্ছা সত্ত্বেও দেশ ছেড়ে চলে যাবার ঠিক আগের দিনটিতেই আকস্মিকভাবে লায়লার মৃত্যু হয়।
আবার যখন এদেশের মাটিতেই মা দেখেছেন সামাজিক মূল্যবোধ ও খেটে খাওয়া মানুষের অবমাননা, সহ্য করেননি। তার বহু উদাহরণের একটি আছে তাঁর চিঠিতে -
‘পয়লা বৈশাখ চলে গেলো। উত্তরা পার্কের সেই প্রচ- দাবদাহের মধ্যে... প্রচুর উৎসব হলো। আর পয়লা বৈশাখের ঠিক দুদিন আগে সাভারে একটা দশতলা গার্মেন্টস ফ্যাক্টরি ধ্বসে গিয়ে কয়েক শ’ শ্রমিক মাটি চাপা পড়ে শেষ হয়ে গেলো। কিন্তু কোনো একটা উৎসব তার জন্য থমকে গেলো না। রমনা বটমূলে ‘ছায়ানট’ থেকে শুরু করে কোথাও এতোটুকু শোক প্রকাশ করা হলো না। শিল্পীরা নাচলো, গাইলো, মিছিলো করলো কী প্রচন্ড উল্লাসে! শুধু আমি ‘সেন্টিমেন্টাল ফুল’ মকবুলা মনজুর বক্তৃতা দিতে গিয়ে শোক প্রকাশ এবং ঈষৎ আত্মধিক্কার দিয়ে মনে হয় অনেকেরই অপ্রিয় হলাম। তবে আমি তার পরোয়া করি না। আমার হাতে কোনো মতা নেই কিন্তু কলম তো আছে!’
কলম তিনি তুলে নিয়েছিলেন। গার্মেন্টস ফ্যাক্টরি দুর্ঘটনার শিকার ভাগ্যহীনা এক নারী শ্রমিকের মর্মান্তিক পরিণতির চিত্র এঁকেছিলেন তার ‘শেফালিরা’ গল্পে। শ্রমিকের অধিকার বিষয়ে বিত্তশালী গার্মেন্টস ফ্যাক্টরি মালিকদের অমানবিক ঔদাসীন্যকে দিয়েছিলেন চরম ধিক্কার। গল্পটির নাট্যরূপও প্রচারিত হয়েছিলো বাংলাদেশ টেলিভিশনে।
সংগ্রামী মানুষের সাথে মা’র একাত্মতা বোধ, দেশের জন্য তাঁর নিঃশর্ত ভালোবাসা এবং সর্বোপরি প্রকৃতির প্রতি তাঁর অসীম মুগ্ধতা এই চিঠিগুলোতে নানা আলোয় উন্মোচিত হয়েছে। সেইসাথে ফুটে উঠেছে তাঁর জীবনের কান্নাহাসির দোলদোলানো দিনরাত্রির নানা ছবি। তাই চিঠিগুলো পড়তে পড়তে মাঝে মাঝেই থমকে যেতে হয়, চমকে উঠতে হয়, আর যে আলোড়ন ভেতরে জাগে, তা যিনি পড়ছেন তার একান্তই নিজস্ব, কারো সাথে যেন ভাগ করে নেয়া যায় না।
মেয়ের প্রতি মায়ের সহৃদয় পরামর্শ, মায়ের জন্য মেয়ের নিঃশর্ত ইমোশনাল সাপোর্ট এবং মা ও মেয়ের পারস্পরিক নির্ভরশীলতার যে সুস্পষ্ট ছবি এই চিঠিগুলোতে আছে, বহু পাঠক সেখানে নিঃসন্দেহে নিজেকে খুঁজে পাবেন। আর হৃদয়তন্ত্রীতে যে টান অনুভূত হবে তা কখনো আনন্দের, কখনো তীব্র বেদনার।
এও নিশ্চিত যে কোনো কোনো পাঠক চিঠিগুলোতে নিজের নামটিও হঠাৎ আবিষ্কার করবেন এবং চমৎকৃত হবেন।
মা’র মৃত্যুর বেশ কয়েক বছর আগে হঠাৎ একদিন বলেছিলেন, আমার চিঠিগুলো কিন্তু রেখো, তোমার মেয়ে বড় হয়ে পড়বে।
মা'র গর্ব ছিল যে বিদেশে জন্ম নিয়েও নাতনি তাঁর ঝরঝরিয়ে বাংলা বলে এবং পড়তে পারে। তারপর হাসিতে সামান্য কৌতুকের আভাস এনে বলেছিলেন, বলা যায় না, হয়তো কোনো একদিন আসবে যখন তুমি মায়ের এই চিঠিগুলো দিয়ে একটা ‘পত্রগুচ্ছ’ই ছাপিয়ে ফেললে।
এই ইচ্ছেটা যে আমার ভেতরে লালিত হচ্ছিল মা সেটা কি করে টের পেয়েছিলেন জানি না। সেই সুপ্ত ইচ্ছেকে বাস্তব রূপ দেওয়ার প্রয়াসেই মা’র অসাধারণ চিঠিগুলো সম্প্রতি আমি গ্রন্থবদ্ধ করার উদ্যোগ নিয়েছি। ইতিহাসবিদ ও বিশিষ্ট সম্পাদক প্রোফেসর শরীফ উদ্দিন আহমেদ অত্যন্ত যত্ন নিয়ে বইটি সম্পাদনা করেছেন। কবি তারিক সুজাতের প্রকাশনা সংস্থা জার্নিম্যান বুকস এই বইটির প্রকাশনার দায়িত্ব নিয়েছে। গ্রন্থটির নামকরণ করা হয়েছে 'পৌষ ফাগুনের পালা - মকবুলা মনজুরের পত্রগুচ্ছ'। প্রাসঙ্গিকতা রার্থে এবং চিঠিগুলোর নানা বিষয় যাতে পাঠক সহজেই বুঝতে পারেন সেজন্য মা'র চিঠিগুলোর মাঝে মাঝে মা'কে লেখা আমার কয়েকটি চিঠিও বইটিতে অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে।
প্রকৃতির সুরে বাঁধা এই পত্রস্তবক থেকে খুলে নেয়া দুয়েকটি পুষ্পের উপহার পাঠকের হাতে তুলে দিলাম। এর বর্ণ ও সুগন্ধ পাঠকের মনকে ছুঁতে পারলেই এই আয়োজন সার্থক হবে।
সুকন্যা বেনকা
মেলবোর্ন, অস্ট্রেলিয়া
জানুয়ারী ২০২২
আত্মজাকে মায়ের চিঠি
১৫ই মে, ২০০৩
চোনবুরি, থাইল্যান্ড
পিউ মা,
এইতো কিছুণ আগে লনে হাঁটছিলাম। শেষ বিকেলের আকাশ সোনালি-লাল মেঘে ভরে গিয়ে চারদিকটা সেই অপরূপ আলোয় স্নান করিয়ে দিচ্ছিল। আমার বুকের ভেতরে ভালোলাগার সাথে তোমার জন্য কী যে কষ্ট! দেখতে দেখতে আকাশের রং বদলে যায়, সন্ধ্যাতারার টিপ জ্বলে ওঠে - কিন্তু সেই দিন তো আর কখনো ফিরে আসে না। আসা সম্ভবও নয়। তবু দিন তো থেমে থাকে না। বিশেষ করে তোমাদের যাদের নতুন জীবন তাদের প্রতিটা দিনই তো সম্ভাবনা আর স্বপ্নের আলোয় স্নান করে শুরু হয়। রবীন্দ্রনাথের কথায়, ‘যে ফুল ঝরে সেই তো ঝরে তবু ফুল তো থাকে ফুটিতে’। তোমাদের পুষ্পিত জীবনের জন্য প্রকৃতির কত আয়োজন, কত আশিস আমাদের।
কেমন আছো মা? তোমার নতুন ইমেইল ঠিকানা পাইনি বলে কোনো যোগাযোগ নেই। খুব চিন্তা হয়। তোমার সাথে সারাণের যোগাযোগে এমন অভ্যাস হয়ে গিয়েছে যে শূন্যতা অনুভব করি। তোমার তো এখন লম্বা ছুটি চলছে। সারাদিন একা একা কী করো মা? মারিয়া নিশ্চয়ই তোমাকে দেখতে আসে? আর তার হবু খেলনা পুতুলটার জন্য হাত ভরে কত কী নিয়ে আসে! আর আ্যন্থনি তো যতণ বাড়িতে থাকে ততণ কোনো চিন্তা নেই - ফাঁক নেই তাই না? কী যে লক্ষ্মী ছেলে!
ভাবছি তোমাদের কাছে যাবার পরের দিনগুলোর কথা। নিশ্চয়ই ফুটফুটে খোকা অথবা খুকু পুতুলটা নিয়ে অনেক মজা করব। গল্প - গল্প - গল্প আর তোমার বাগানের পাখি আর ফলের মেলা। শীত কেমন থাকবে? বেশি হলে তো ‘কাঁথা আম্মু’ হয়ে বসে থাকবো। তবে চুলোর পাড়ে দাঁড়িয়ে রান্নাবান্না করাটাও আরামের হবে বলে মনে হচ্ছে। তখন তো তোমার সারাণই খিদে পাবে। কী কী খাবে? লিস্ট করে রেখো।
তোমার নতুন ইমেইল হলে ছোট খালাকে ইমেইল করতে পারো। ও তোমার জন্য খুবই চিন্তা করে। এর মধ্যে লিনডা ফোন করেছিল। জুলাইতে ওরা লন্ডন যাচ্ছে। ওই সময়ে জয়ার বিয়ে হবে বলে জানাল।
আজ এ পর্যন্তই। তোমাদের দুজনের জন্য আমাদের অনেক আদর ও শুভকামনা।
মা
(ফুটনোট: মারিয়া- বেয়ান, জয়া- নাতনি)
(দুই)
২৪ শে সেপ্টেম্বর, ২০০৭
উত্তরা, ঢাকা
পিউ মা,
সামনে তোমার জন্মদিন। কার্ডের সাথে এই চিঠি। প্রয়োজনীয় কোনো কথা নেই তেমন। তবু ভাল লাগা থেকেই এই লেখা। কখনো ব্যস্ত থাকি, কখনো অলস অবসরে। প্রায়ই ভাবি তোমাকে চিঠি লিখবো। কিন্তু হয়ে ওঠে না। এর মধ্যে আবার ঈদ সংখ্যার লেখালেখি, কাস নেওয়া ইউনিভার্সিটিতে, ঘর সংসারের কাজ সবই আছে। তবু মনে হয় পড়ে রয়েছে অনেক অলস অবসর। হয়তো আছে অবসর - হয়তো নেই। তবু আছে ভাবতেই ভালো লাগে।
এখানে সময় চলেছে আপন গতিতে। রোজার মাসও চলছে। মহা উৎসাহে তোমার বুবু ঈদের শপিং করছে, করছে তোমার খালাও। তোমার বুবু তো এই সেদিন জন্মদিনে আমাকে চমৎকার একটা শাড়ি দিলো। এমনিতেই আমার গাদা গাদা শাড়ি। বারবার বলেছিলাম ঈদে কিন্তু শাড়ি-টাড়ি দিও না। কিন্তু কে কার কথা শোনে! আবার কিনেছে একটা চমৎকারের চেয়েও চমৎকার শাড়ি। আর তোমার আব্বুকে দিয়েছে একটা স্যান্ডউইচ মেকার।
সেদিন তোমার সাথে টেলিফোনে দীর্ঘ সংলাপ হবার পর লেখার মত বাড়তি কিছু নেই। তবু আছে বাংলাদেশের প্রকৃতির খামখেয়ালির কথা। আশ্বিন চলছে। এই রোদ, এই বৃষ্টি। সহসা সাইকোনের পূর্বাভাসও এসে যায়। তবু মনে পড়ে যায় রবীন্দ্রনাথের কথা:
‘রোদ্দুরে লেগেছে চাঁপা ফুলের রং’
আসলেই তাই। আমার লেখার টেবিলের জানালার ওপাশের সেই প্রাণরসে ভরপুর, ফুলের সুবাসে মাতাল নিম গাছটা আনোয়ার সাহেব কেটে ফেলেছেন, বাস্তব কারণে। ক’দিন খুব কষ্ট পেলাম - ওদিকে তাকাতে মন চাইতো না। তারপর একদিন ল্য করলাম একটুখানি দূরেই একটা চাঁপা ফুলের গাছ ফুলের উপহার নিয়ে দাঁড়িয়ে। বৈশাখে ফুল ফোটাতে শুরু করে এখন এই আশ্বিনেও চলেছে ওর ‘কান্তিবিহীন ফুল ফোটানোর খেলা’।
কী যে সব লিখে চলেছি! মনে হয় এসব আমার মনের এলোমেলো আনন্দ থেকে অথবা অর্থহীন ভালোলাগার কান্নার মত লেখা। কেন লিখি? না লিখেও তো পারি না।
কেমন আছো তোমরা? শানীলার কথা বলার অপরূপ সুরটা সর্বণই যেন কানে বাজে। ওর আঁকা ছবিটা সামনের আলমারির পাল্লার সাথে লাগিয়ে রেখেছি। অপলকে ‘চেয়ে চেয়ে দেখি সারাদিন’।
আজ এখানেই। তোমাদের তিনজনের জন্য অঢেল শুভেচ্ছা ও আদর।
মা
(ফুটনোট: আনোয়ার সাহেব- পারিবারিক বন্ধু ও প্রতিবেশি, শানীলা- নাতনি)
কন্যার লেখা পত্র
৫ই অগাস্ট, ২০০২
মেলবোর্ন
মা,
তোমাকে কিছুতেই লেখা হয়ে উঠছিলো না। কার্যকারণ ইত্যাদি তো সব জানোই। তোমার ‘ছায়াপথে দেখা’ খুব ভালো লেগেছে পড়তে। তুমি বলেছিলে ‘ঐতিহ্য’ নামে একটা প্রকাশনী থেকে অল্প বয়সী একটা ছেলে তোমার বই প্রকাশ করতে চেয়েছে। এই-ই তাহলে সেই বই! বইয়ে যে সময়কার ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের কথা তুমি লিখেছ আমি সেই সময়ে ওখানে না পড়ে থাকলেও, পরে আমাদের সময়ে তো প্রায় সেই রকমই ছিলো সবকিছু, তাই না? পড়তে পড়তে আমি যেন ছবির মতো দেখতে পাচ্ছিলাম রোকেয়া হলের গেট দিয়ে শেবা বেরোচ্ছে আর তপন দাঁড়ানো সেই জারুল গাছটার নিচে। ওখানে তো আমি গেছি কতবার! ঝাউতলী, শেবাদের বাড়ি আর বাড়ির সবাইকে নিয়ে পরিবেশের যে চিত্র তুমি তুলে ধরেছো তা যে কি অদ্ভুত-জীবন্ত!
শেবার মা’র চরিত্রটা দারুণ বাস্তবধর্মী - নিঃসন্দেহে মিলিয়ে নেয়া যায় আমাদের পরিচিত মহলের একাধিক চরিত্রের সাথে। নাসিরের চরিত্রটা তুমি চমৎকার এঁকেছ মা! লরেনের সাথে নাসিরের সম্পর্ক গড়ে উঠবার ভেতর দিয়ে নাসিরকে পরিচিত জগতের একজন স্বাভাবিক মানুষ বলে মনে হয়। কাছের মানুষ বলে মনে হয়। তাই বোধহয় নাসির নিজের সাথে শেবার জীবনযাপনের তুলনা করে উপলব্ধি করে যে - শেবা তো একজনই হয়। আর তাই হয়তো শেবার কোনো বন্ধু নেই! উপন্যাসের শেষ অংশে শেবার অসুস্থ অবস্থায় সেই ঝাউতলীর বাড়িতে যাওয়া, সেই ঝড় আর বৃষ্টির বর্ণনা পড়তে পড়তে যেন দম আটকে আসে - আর শেষ পৃষ্ঠায় - ‘আমাকে খোঁজো না তুমি বহুদিন... এক নত্রের নিচে তবু -’ আহ্ জীবনানন্দ! আর সেই ‘অবিনাশী শব্দাবলী’ তোমার অপূর্ব লেখনীর ভেতর দিয়ে পুনঃপ্রকাশিত হয়ে পাঠকের হৃদয়ে কি ভীষণ রক্তরণ ঘটায়!
কি অসম্ভব সৌভাগ্য আমার - যে মানুষ এমন ভাবে ভাবতে পারে - লিখতে পারে - সে আমার মা! আমার খুব ইচ্ছে করে তোমার কাছে কাছে থাকি!
ভালো থেকো মাগো।
তোমার বুড়িমা
(দুই)
১৭ই জুলাই ২০০৭
মেলবোর্ন
মা,
তোমার চিঠি আর ছবিগুলো পাবার পর থেকে মনে মনে তোমাকে অনেক লম্বা লম্বা চিঠি লিখে চলেছি; অথচ সত্যি সত্যি কাগজ কলম নিয়ে বসবার সময় কেবল হলো এই এখন। খুব মজার সময় কাটিয়েছি আমরা আজকে তিনজন। আমাদের বাড়ি থেকে মাত্র পঞ্চাশ কিলোমিটার দূরেই ম্যাসেডন পাহাড় (যেখানে তুমি গিয়েছো) এবং সংলগ্ন উডএন্ড শহরে সকালবেলা থেকে তুষার পড়তে শুরু করেছে। অ্যান্থনির ছিলো ‘ডে অফ’, কিন্তু আমার অফিস। অ্যান্থনি বললো, ‘আজকে তো কোনো ক্রমেই অফিস যাওয়া চলবে না! এ’রকম বাড়ির এত কাছে তুষারপাত দেখবার সুযোগ আমাদের হয়েছিলো প্রায় সাত বছর আগে। তুমি তাড়াতাড়ি অফিসে ফোন করে দাও যে যাচ্ছ না। আমরা আজকে খুব মজা করব’। শানীলা যে কি খুশি! কি খুশি! ওর এই প্রথম সত্যি সত্যি তুষার দেখা। অ্যান্থনি গাড়ি চালাচ্ছে খুব সাবধানে - আস্তে আস্তে - বরফে দারুণ পিছল রাস্তা। আর সাদা সাদা খইয়ের মতো তুষার-স্ফুলিঙ্গ নাচছে গাড়ির কাচ ঘিরে-ঘিরে। পথের দুধারে ঘাসের ওপর তুষারের চাদর। গাছের মাথায় মাথায়, পাইন আর ফার্ন গাছের প্রসারিত শাখায় পেঁজা তুলোর মতো ধবধবে তুষার।
তুষার পড়া বন্ধ হবার পর গাড়ি থেকে নেমে চললাম হাঁটতে। শানীলা তুষার দিয়ে বল বানালো - ছুড়োছুড়ি খেললো আর আমরাও। সবাই গরম জ্যাকেট আর মাথায় উলের বীনি পরা। মা আমি কোন জ্যাকেটটা পরেছিলাম তুমি কি আন্দাজ করতে পারবে? সেই যে তোমরা আমাকে কত কা- করে কিনে পাঠিয়েছিলে মেলবোর্নে ১৯৯৮ সালে একটা দারুণ শীত-মানা, হাড়-রঙা জ্যাকেট, হ্যাঁ সেইটা! জ্যাকেটটা আমাকে উষ্ণ রাখছিলো ঠিক যেমন রাখত প্রায় নয় বছর আগে ছাত্রী অবস্থায় সেই কনকনে শীতের সন্ধ্যায় আমি যখন হেঁটে হেঁটে বাড়ি বাড়ি চ্যারিটির র্যাফেল টিকিট বিক্রি করতাম - ঠান্ডায় ঠোঁট মনে হয় অবশ হয়ে আসতো, কথা বলতে কষ্ট হতো - কিন্তু জ্যাকেটটা আমাকে জড়িয়ে থাকতো ঠিক তোমাদের স্নেহের মতোই উষ্ণতায়! মা, তোমার কি মনে আছে আমি মেলবোর্নে আসার আগে তুমি তোমার সবচেয়ে ভালো এবং গরম একটা কালো কার্ডিগান আমাকে দিয়েছিলে, বলেছিলে মেলবোর্নে কত শীত - এইটাই তুমি নিয়ে যাও। সেই কার্ডিগানটা কত দিন - রাত - মাস- বছর- আমার ভালো গরম ভারী কোট কেনার মতো আর্থিক অবস্থা হওয়ার আগ পর্যন্ত আমার পাতলা কোটের নিচে সবসময় থাকত। এখন যদিও কার্ডিগানটা আর পরি না, পুরনো হয়েছে - কিন্তু আমি সেটা যত্ন করে তুলে রেখেছি। সেদিন আলমারির কাপড় গোছাবার সময় আস্তে হাত রাখছিলাম কার্ডিগানটার ওপর - আর বলছিলাম - আম্মু - আম্মু - কি মায়া - কি মায়া! ইস্ চোখে পানি চলে আসে।
তোমরা অনেক ভাল থেকো!
শীগগিরই আবার লিখবো তোমাকে।
তোমার বুড়িমা