করোনাকাল
বিচ্ছিন্ন অনুভব
মাহফুজা হিলালী

প্রবন্ধ
অধ্যাপক আনিসুজ্জামান
শামসুজ্জামান খান

গল্প
ডায়মন্ড লেডি ও পাথর মানব
হামিদ কায়সার

গদ্য
নিদ্রা হরণ করেছিল যে বই
মিনার মনসুর

নিবন্ধ
পঞ্চকবির আসর
সায়কা শর্মিন

বিশ্বসাহিত্য
আইজাক আসিমভের সায়েন্স ফিকশন
অনুবাদ: সোহরাব সুমন

বিশেষ রচনা
প্রথম মহাকাব্যনায়ক গিলগামেশ
কামাল রাহমান

শ্রদ্ধাঞ্জলি
মুজিব জন্মশতবর্ষ
মারুফ রায়হান
 
সাক্ষাৎকার
কথাশিল্পী শওকত আলী

জীবনকথা
রাকীব হাসান

ভ্রমণ
ইম্ফলের দিনরাত্রি
হামিদ কায়সার

ইশতিয়াক আলম
শার্লক হোমস মিউজিয়াম

নিউইর্কের দিনলিপি
আহমাদ মাযহার

শিল্পকলা
রঙের সংগীত, মোমোর মাতিস
ইফতেখারুল ইসলাম

বইমেলার কড়চা
কামরুল হাসান

নাজিম হিকমাতের কবিতা
ভাবানুবাদ: খন্দকার ওমর আনোয়ার

উপন্যাস
আলথুসার
মাসরুর আরেফিন

এবং
কবিতা: করেনাদিনের চরণ

১৭ বর্ষ ০১ সংখ্যা
আগস্ট ২০২৪

লেখক-সংবাদ :





আদ্দিস আবাবায় ফুড ট্র্যাভেল
মঈনুস সুলতান
আদ্দিস আবাবা নগরীর কুইন তাইতুস পানসিওন নামে যে সস্তা হোটেলে আমি গেল রাত কাটিয়েছি, ওখান থেকে জার্মান ক্যাফে বেকারির দূরত্ব তেমন বিরাট কিছু না। ইথিওপিয়ার এ রাজধানী শহর আফ্রিকার আরো পাঁচটা আর্বাণ সেট-আপের তুলনায় নিরাপদ, তাই ভোরবেলা ফুটপাতে চাপকল ঘিরে নাবালকদের জল ছোড়াছুড়ির লীলাখেলা দেখতে দেখতে পয়দলে মেলা দেই ক্যাফের দিকে। এতে যেমন আমার ট্যাক্সি ভাড়াটার সাশ্রয় হয়, তে¤িœ সড়কের লাগোয়া রোয়াকে যারা আশ্রয় নিয়েছেন, তাদের দিনযাপনের একটি খন্ড খতিয়ানও নিতে পারি। জিম্বাবুয়ের হারারে শহর থেকে রওয়ানা দিয়ে পূর্ব আফ্রিকার গোটা তিনেক এয়ারপোর্টে বেহদ যাত্রাবিরতির পর- আমি ঘানার আক্রা নগরীতে পুরা একটি রাত কাটাতে বাধ্য হই। যাত্রা বিভ্রাটে খানা-খাদ্য কিছু জোটেনি। তারপর বিকালের দিকে ফ্লাইট পাকড়ে রাত নয়টা নাগাদ এসে পৌঁচেছি আদ্দিস আবাবায়।
ঔপনিবেশিক আমলে আফ্রিকার একমাত্র স্বাধীন দেশ ইথিওপিয়া সম্পর্কে আমার অনেক দিনের আগ্রহ । এদেশের প্রয়াত স¤্রাট হাইলে সেলাসি বিগ্রহ বিশেষ- হিপি সম্প্রদায়ের রাসতাফেরিয়ান তারিকার জটাজুটধারী লোকজনদের কাছে। তামাম দুনিয়া থেকে রাসতাফেরিয়ানরা হামেশা এখানে আসেন তাঁর প্রাসাদ চাক্ষুস করতে, এক জামানার এ লিভিং গডের সামাধিতেও তারা বেহুঁশ হয়ে ধর্ণা দেন। এ ধরনের হুযুগ আমাকে আকর্ষণ করছে গেল এক যুগ অব্দি। সামাজিকভাবে বেতাল কিসিমের রাসতাফেরিয়ানদের সম্পর্কে আমি ওয়াকিবহাল হতে চাই। কিন্তু এদিকে ঘুরতে আসার জন্য কিছুতেই কড়িপাতির সংকুলান হচ্ছিলো না। তবে জুয়ার দান মিলে যাওয়ার মতো একটি দাতা সংস্থায় কাকতালীয়ভাবে দরখাস্ত পাঠাতেই আফ্রিকান ইউনিওনের সম্মেলনে পর্যবেক্ষক হিসাবে হাজির থাকার মওকা মিলে যায়।
আমি ফুটপাতের খানাখন্দ হুঁশিয়ারির সাথে অতিক্রম করতে করতে রোয়াকে কাঁথা-কম্বল বিছিয়ে- শিথানে ছাগলের চামড়ায় তৈরী ঝোলাতে যথাসর্বস্ব সম্বল নিয়ে শুয়ে থাকা গৃহহীন মানুষজন অবলোকন করি। কম্বলের ওপর থালাতে চাপাতির মতো দেখতে বড়সড় গোলাকার ইনজিরা রুটিকে ঘিরে বসেছে মাসুম বাচ্চাকাচ্চাসহ ছেলেবুড়োর পুরো আট জনের একটি পরিবার। গৃহকর্তা মুখে রুটি তুলতে তুলতে আমার দিকে তাকিয়ে ফোকলা দাঁতে হাসেন। দাতা সংস্থার বদৌলতে আমার পকেট আজ কড়িপাতিতে সরগরম। জিম্বাবুয়েতে খাদ্যাভাব ও মুদ্রাস্ফীতিতে আমার জিন্দেগি-বন্দেগী ফর্দাফাই হচ্ছে বছর দেড়েক হলো। তাই আজ আদ্দিস আবাবাতে ভ্রমণের শুরুয়াত করছি- ফুড ট্র্যাভেলের মারফত।
এ খাদ্য-সফরে গাইডের তদারকিতে একাধিক রেস্তোরাঁয় ঘুরপাক করার বন্দোবস্ত আছে। খানা-খাদ্য বাবদে ভালোমন্দ বিস্তর জুটবে- এ ব্যাপারে আমি স্থির নিশ্চিত। তারপরও কেবল মাত্র একখানা ইনজিরা রুটি ঘিরে প্রতঃরাশরত পুরো পরিবারটির ইমেজ মাথা থেকে সরাতে পারি না। কেন জানি আমার ফুড ট্র্যাভেলের সৌভাগ্যে অকস্মাত নিজেকে চালিয়াত মনে হয়। আমি হেঁটে যেতে যেতে রোয়াকের বিরাট একান্নবর্তি পরিবারটির দিকে ফিরে তাকাই। ছেলেবুড়ো ও শিশুরা সকলে খেতে খেতে হাসি মুখে হাত নাড়ে। তাদের খাদ্য সরবরাহে স্পষ্টত অপ্রতুলতা আছে, কিন্তু চোখমুখের অভিব্যক্তিতে নেই কোন দীনতা বা দারিদ্র্যের চিহ্ন।
এ ব্যাপারটা করোটির কোটরে বন্ধক রেখে আমি এসে দাঁড়াই জার্মান ক্যাফে-বেকারির সামনে। সিঁড়ির কাছে গোটা কতক উদ্ভিদ রুকুসুখু আরবান প্রতিবেশে ছড়াচ্ছে সাবুজিক সিগ্ধতা। ক্যাফেটির সাইনবোর্ডের ঠিক পেছনে ফিরিঙ্গি এক জেনানার এ্যাপিল-তপ্ত তসবির। অলীক এ নারী যেন রিপুর তন্ত্রীতে সর্বনাশ ছড়িয়ে তাকিয়ে আছে, সড়কের ওপারে খুঁটির বন্ধন থেকে শিথিল হয়ে ঝুলে পড়া বৈদ্যুতিক তারের দিকে। ওখানে ডানা ঝাপটিয়ে ভারসাম্য রক্ষা করে কাছাকাছি বসেছে সবুজ পালকে ভাইব্রেন্ট ব্লু রঙের বিচ্ছুরণ ছড়ানো লেজ-ঝোলা দুটি খেচর।
এ ক্যাফের বারান্দায় বসে ফুড ট্র্যাভেলের গাইডের জন্য অপেক্ষা করার কথা। তিনি এখনো এসে হাজির হননি। ভেতরের কামরা থেকে এ্যসপ্রেসোর কড়া ঝাঁঝের সাথে ভেসে আসছে সদ্য বেক করা রুটির সৌরভ। আমি কাউন্টারে গিয়ে সফ্ট চিজে ছেঁচা অলিভের প্রলেপ দেয়া রুটির সাথে এক পেয়ালা মাকিয়াতোর অর্ডার করি। দেয়ালে ঝুলানো সাউন্ড বক্স থেকে ছড়িয়ে পড়ছে এডভার্ড গ্রেগ নামে এক জার্মান ধ্রুপদী কলাকারের কম্পোজ করা মিউজিক। মাকিয়াতোর সুরভিত পেয়ালা হাতে নিতে নিতে মর্নিং মুড নামক কম্পোজিশনের সুরেতালে জানপ্রাণ তর হয়ে ওঠে।
ফুটপাত থেকে বেশ উঁচুতে বারান্দাটির অবস্থান হাওয়াতে বসার পরিবেশে এসেছে বেলকনির ব্যঞ্জনা। আমার পাশের টেবিলে এ্যসপ্রেসোর পেয়ালা হাতে বসে সুদর্শন এক শ্বেতাঙ্গ পুরুষ। তার শরীর রোদে পুড়ে, স্বর্ণাভ চুলদাড়িতে সাব-সাহারান আফ্রিকার ধুলোবালি মেখে, এ সাহেব-সন্তানের চোখেমুখে এসেছে রাফ এন্ড টাফ ট্র্যাভেলারের রুকুসুখু অভিব্যক্তি। ইনি এ্যসপ্রেসোতে চুমুক দিতে দিতে দারুণ অস্থির দৃষ্টিপাতে চারদিকে তাকাচ্ছেন। তার ছটফটে আচরণে তিনি যে আধময়লা টিসার্টের তলায় চড়চড়ি পোকার কামড়ে আক্রান্ত হয়েছেন- এ ধারণা করা অস্বাভাবিক না। তো আমি ঘাড় বাড়িয়ে জানতে চাই, ফুড ট্র্যাভেলের গাইডের জন্য অপেক্ষা করছেন কি না? তিনি খেঁকিয়ে ওঠে বলেন, ইয়েস, এন্ড আই অ্যাম শিওর.. ওই ব্যাটা সময় মতো আসবে না। এ ধরনের অসহিষ্ণুতা স্পষ্টত আনসিজনড্ টুরিস্টের আলামত বিবেচনা করে আমি সান্ত¡না দিয়ে বলি, ম্যান, দিস ইজ আফ্রিকা, একটু দেরি হচ্ছে, তবে এসে যাবে।
তিনি কপাল কুঁচকে দিস ইজ আফ্রিকা বাক্যটির প্রতিধ্বনি করে কষাবিশা মুখে জানান, মাই নেম ইজ বনোয়াঁ, ফ্রেঞ্চ সিটিজেন। তিন সপ্তাহ আগে কেপ টাউন থেকে বাসে রওয়ানা দিয়ে, তামাম ইস্ট আফ্রিকা চষে, কাল মধ্যরাতে আদ্দিস আবাবাতে এসে পৌঁচেছি। আই অ্যাম আফটার অ্যা ফাইন লুকিং গার্ল, সে এখনো এসে পৌঁছায়নি, কথা দিয়ে সময় মতো হাজির না হওয়ার বিষয়টা..কী বলবো..ইউ নো, আই হেইট দিস। তার জগত সংসারের ওপর বিলা হওয়ার কারণ বুঝতে পারি, মেয়েদের লীলা সব সময় বোঝাও যায় না। নারীটি আরো কিছুক্ষণের মধ্যে এসে না পৌঁছালে এনার মেজাজ যে সপ্তমে পৌঁছাবে- এ ব্যাপারে নিশ্চিত হয়ে বলি, বনোয়াঁ, তুমি কী খানাপিনা পছন্দ করো? ফের খেঁকিয়ে ওঠে তিনি জবাব দেন, লুক আই অ্যাম অ্যা ট্রাভেলিং ফুডি। যে শহরে যাই, যেখানে দুদিনের জন্য থানা গাড়ি, চেষ্টা করি লোকাল ফুড একটু চেখে দেখতে, দ্যাটস্ অল।
সিঁড়ি বেয়ে উঠে আসেন আরেক জোড়া পর্যটক। এদের মাঝে স্যুটপরা কৃষ্ণাঙ্গ পুরুষটি গলায় পেঁচিয়ে পরেছেন ফিলিস্তিনি কেতার চেককাটা কুফিয়া গিলাফ। আমি তাকে সালাম দিতেই, মাস্ক-আতরের সৌরভ ছড়িয়ে আমার কব্জি চেপে ধরে, জোরেসোরে তা ঝাঁকিয়ে বসে পড়েন পাশের চেয়ারে। তার নারী-সঙ্গিনীও কৃষ্ণকায় গোলগাল পৃথুলা এক আফ্রিকান-আমেরিকান। এ তরুণীর হিজাবে গাব্দা গোব্দা সাইজের তরমুজের প্রিন্ট। গলার হার থেকে ঝুলছে সজারুর জোড়া কাঁটা, তার মধ্যিখানের লকেটে ঝুলছে শীর্ণকায় এক নারীমূর্তি। আমাদের বাতচিত দ্রুত জমে ওঠে।
আফ্রিকান-আমেরিকান পুরুষটির নাম- রিকারর্ডো গফুরুল ওয়াহাব। ইনি রিয়াদ বিশ্ববিদ্যালয়ে ইসলামের ইতিহাস পড়ান। তার সঙ্গিনীর পোষাকি নাম উম্মুল মদিনা, বাড়িতে সবাই তাকে ডারোথি ডাকে। মিসরের রানি নেফারতিতি তার রোল মডেল। পুরাকালের ফারাও কুইনের স্মৃতিময় আহ্বানে সাড়া দিয়ে মদিনা কায়রোতেই হালফিল বাসা বেঁধেছেন। আমার কৌতূহলের জবাবে জানান, লকেটে তিনি রানি নেফারতিতির মূর্তি ধারণ করে আছেন। তার সাজগোজ থেকে আমিও তেজারতির একটি ইনোভেটিভ আইডিয়া পেয়ে যাই। ভাবি, ঘষেটি বেগম কিংবা আলেয়ার তসবির খুঁজে পেলে- তার মিনিয়েচার রূপ কাঠে খোদাই করে লকেট হিসাবে বাজারজাত করা যায়।
অধ্যাপক ওয়াহাব ঘাড় কাত করে ফিসফিসিয়ে জানতে চান- আমি মুসলিম কি না? ইতিবাচক জবাব পাওয়ামাত্র মৃদু হেসে পোর্টফোলিও ব্যাগ দেখিয়ে বলেন, ব্রাদার, নামাজ-কালাম পড়ার জরুরত পড়লে আমাকে ইশারা দেবে। আমার কাছে এক্সট্রা জায়নামাজ আছে। তায়ুমুমের জন্যও আছে পবিত্র খাকের একটি ডেলা। তার মন্তব্য শেষ হওয়ার আগেই ডারোথি জানতে চান,তোমাদের দেশে চানরাতে মেহদি দিয়ে মেয়েরা হাতে-পায়ে অল্পনা আঁকে কী? আমি এ বাবদে দীর্ঘ জবাব দিতে যাই, কিন্তু মনে হয় ওয়াহাব আমার কথা শুনছেন না, বরং তিনি যেন কিছু একটা বলতে চাচ্ছেন। তো বাকোয়াস থামিয়ে জানতে চাই,হোয়াটস্ আপ প্রফেসর? তিনি ফিসফিস করে বলেন, মাস খানেক আগে আলেকজান্দ্রিয়াতে বেড়াতে গেলে তাদের দুজনের মোলাকাত হয়। ওখানেই যুগল ভ্রমণের পরিকল্পনা করে আদ্দিস আবাবাতে ফুড ট্র্যাভেলে এসেছেন। শুনে আমি মাশাল্লা বলে উল্লাস প্রকাশ করি।
বারান্দার ছাদে আটকানো একটি সাউন্ড বক্স হঠাৎ করে এক্টিভেটেড হয় মিউজিকের সুরছন্দে। মর্নিং মুড নামক ধ্রুপদী কম্পোজিশনটি হ্রদের পানি ছুঁয়ে যাওয়া শুভ্র মরালের মতো হৃদয় স্পর্শ করতে করতে উড়ে যাচ্ছে আরবান আকাশের দিকে। মার্জারীর মৃদু পায়ে বারান্দায় ওঠে আসে ব্রাজিলের মেয়ে কানসিয়েনা। গেল রাতে সে ঘানার আক্রা শহর থেকে একই ফ্লাইটে উড়ে এসেছে আদ্দিস আবাবায়। আমরা উড়োজাহাজে পাশাপাশি বসেছিলাম, এয়ারপোর্ট থেকে হোটেলে যাওয়ার পথে একত্রে একটি ট্যাক্সিও শেয়ার করেছি। কানসিয়েনা আদ্দিস আবাবাতে বসবাস করছে মাস সাতেক হলো। সে ফরাশি একটি ফ্যাশন হাউসে ইনটার্ন হিসাবে কাজ করছে। আদ্দিস আবাবায় তার অ্যাসাইনমেন্ট হচ্ছে, মেয়েদের পোশাক-আশাকের সানাতনী নক্সার নমুনা সংগ্রহ, এগুলোর এডাপ্টটেশনের সম্ভাবনার ওপর বিশ্লেষনমূলক প্রতিবেদন তৈরী করে ফ্রান্সের ফ্যাশন হাউসে পাঠানো ইত্যাদি।
তার কাছ থেকেই আমি ফুড ট্র্যাভেলের আইডিয়া পাই। সে তার মোবাইল ব্যবহার করে আজকের নানা কিসিমের রেস্তোরাঁয় গাইডেড ট্যুরের বন্দোবস্ত করে দিয়েছে। কানসিয়েনা আমার দিকে দৃষ্টিপাত না করে সোজা হেঁটে গেলে আমি একটু আহতবোধ করি। জিন্সের সাথে আফ্রো-বাটিকের অফ শোল্ডার একটি টপ পরেছে সে। আমাদের দিকে পিছন ফিরে পাশের টেবিলের সামনে দাঁড়িয়ে সে বিমোহিত হয়ে শুনে মনিং মুডের সুর-মূর্ছনা। টেবিলে বসে থাকা তেতোবিরক্ত শ্বেতাঙ্গ পর্যটক বনোয়াঁ মনে হয় সফরের ক্লান্তিতে চোখ মুদে ঝিমাচ্ছেন। কানসিয়েনা কোমরে হিল্লোল তুলে নৃত্যের মুদ্রায় দুলে উঠলে- পদশব্দে অদৃশ্য ঘাসফড়িংয়ের মতো আমাদের নাসারন্ধ্রের দিকে উড়ে আসে উত্তম ফরাসি পারফিউম। সে অতঃপর ওয়াকিং-শু দিয়ে ফ্লোরে আওয়াজ তুললে, বনোয়াঁ ধ্যান ভেঙ্গে ধড়মড় করে জেগে ওঠেন। কানসিয়েনা আরো কাছে গিয়ে তার কপালে এসে পড়া ধুলি ধুসরিত সোনালি চুলের গুচ্ছ সরিয়ে দিয়ে চুমো খায়। তাদের প্রকাশ্য অন্তরঙ্গতা চলে বেশ কিছুক্ষণ। তারপর হঠাৎ করে আমার দিকে চোখ পড়তেই, ম্যান, ইউ আর অলরেডি হিয়ার, লাভলি টু সি ইউ, বলে উঠে চলে আসে আমাদের টেবিলে।
আমি তার বাড়িয়ে দেয়া হাত স্পর্শ করি। সে পেশাদারি দক্ষতায় আমার টেবিলে বসে থাকা অধ্যাপক ওয়াহাব ও মদিনা ডারোথির সাথে পরিচিত হয়। তারপর লাজুকভাবে বলে, কাম অন এন্ড মিট মাই ফ্রেন্ড বনোয়াঁ, হি ইজ অ্যা রিয়েল ফুড লাভার ইন হার্ট। ইথিওপিয়ার মুখরোচক খাবার খেয়ে সে এক্সাইটেড হলে.. .. আই হোপ হি উইল বি মাই ফিঁয়াসে ওয়ান ডে।
আমি উঠে এসে বনোয়াঁর টেবিলে বসি। কিন্তু তার সাথে বাতচিত তেমন জমে না। তিনি আধোঘুমে ঢুলু ঢুলু চোখে হরিণীর তালাশ পাওয়া চিতাবাঘের মতো কানসিয়েনাকে অবলোকন করছেন। ভোরের আলো পড়ে খাদ মেশানো গিনি সোনার মতো ঝলমল করছে তার খোলা কাঁধ। বনোয়াঁ কায়ক্লেশে পকেট থেকে বের করেন রূপালি ধাতুতে তৈরী ছোট্ট একটি লিক্যুর ফ্লাক্স। তা থেকে কয়েক ফোটা ব্র্যান্ডি আধ-খাওয়া ঠান্ডা এ্যসপ্রেসোর পেয়ালায় মিশিয়ে তা কানসিয়েনার দিকে বাড়িয়ে দিলে, সে ঠোঁটের রঙ বাঁচিয়ে সাবধানে পান করে।
ছাগল তাড়ানোর কান-জোকা লাঠি হাতে অতঃপর ক্যাফের বারান্দায় এসে হাজির হন ফুড ট্র্যাভেলের গাইড কুফি নাগাসি। তিনি এহরামের কাপড়ের মতো ফকফকে সাদা একটি চাদর জড়িয়ে এসেছেন। মুন্ডিত মস্তক এ ইথিওপিয়ান মানুষটির ক্লিনশেভড্ থুতনির দুপাশে চোরকাঁটার মতো দুই সারি দাড়ি। গলায় ঝুলানো কাঠের ক্রুশ উর্দ্ধে তুলে ধরে তিনি যেন স্ক্রিপ্ট দেখে সংলাপ আওড়াচ্ছেন এমন ভঙ্গিতে বলেন,ওয়েলকাম টু আদ্দিস আবাবা, দিস সিটি হ্যাজ ফেসিনেটিং ল্যান্ডমার্কস্, ওয়ান্ডারফুল ফুড এন্ড আন-প্যারালাল কফি কালচার।
তার বচনে বিশেষ একটা ইমপ্রেসড্ না হয়ে বনোয়াঁ সরাসরি জানতে চান, ঘন্টা খানেক দেরি হওয়ার কারণ কী? এতে বিব্রত না হয়ে কুফি নাগাসি- চার্চে প্রার্থনা করতে যাওয়ার অজুহাত দিয়ে বলেন, আমাদের নিয়ে হরেক রকমের রেস্তোরাঁয় যে মাইক্রোবাসটি যাবে তা সারাই করতে সময় লাগছে। বনোয়াঁ এতে স্পষ্টত অসহিষ্ণু হন। তিনি শহরের মানচিত্র মেলে ধরে জানতে চান-যে রেস্তোরাঁয় ব্রেকফার্স্টের এন্তেজাম হয়েছে, তার লকেশন কোথায়? জায়গাটি কানসিয়েনারও পরিচিত। খুব বেশি দূরে না। চাইলে ¯্রফে পয়দলেই পৌঁছে যাওয়া যায়।
বনোয়াঁ কিছু না বলে প্রথমে উঠে দাঁড়ান। তার সাথে বাকিরাও সামিল হলে কুফি নাগাসি উটের গলায় ঝুলানো হয়- এ ধরনের একটি ঘন্টা চাদরের তলা থেকে বের করে টুংটাং আওয়াজে ফুড ট্র্যাভেলের শুরুয়াত ঘোষণা করেন। তিনি বিড়বিড় করে অভিষ্ঠ রেস্তোরাঁটির বৈশিষ্ট্য বর্ণনা করলে- সেদিকে কান না দিয়ে বারান্দার সিঁড়ি বেয়ে হুড়মুড়িয়ে সবাই নেমে আসে ফুটপাতে।
মানচিত্র হাতে বনোয়াঁ ছোট্ট ট্র্যাভেলিং ট্রুপের পদযাত্রায় লিড দিচ্ছেন। গাইড কুফি নাগাসি খানাখন্দ সামনে পড়লে ঘন্টা বাজিয়ে সাবধান করছেন। কিন্তু তাকে কেউ বিশেষ পাত্তা দিচ্ছে না। মনমরা হয়ে মানুষটি আমার পাশে পাশে হাঁটছেন। তো আমি তার সাথে টুকটাক কথাবার্তা বলি। জানতে চাই, মি. নাগাসি, টেল মি সামথিং আবাউট ইথিওপিয়ান পিপুল। তিনি চোরকাঁটার মতো সুঁচালো দাড়ি মুচড়িয়ে ঘোষণা দেন, উই বিলিভ উই আর ভেরী স্পেশাল পিপুল। ফলো আপ হিসাবে জানতে আগ্রহ হয়, নিজেদের স্পেশাল ভাবার কোন বিশেষ কার্যকারণ আছে কী মি. নাগাসি? তিনি রীতিমতো চেতে ওঠে বলেন, আমরা যে খৃষ্ট ধর্মের চর্চা করি, লুক দিস ভার্সন অব ক্রিশ্চানিটি ইজ দ্যা ওল্ডেস্ট ইন দ্যা ওয়ার্ল্ড। দিস ইজ বাই ফার দ্যা ওল্ডেস্ট রিলিজিওন।
একটু ধন্ধে পড়ে যাই। ঈশায়ী ধর্মের প্রাচীনত্বের দাবি ইহুদিরা মেনে নেবে না। গোঁড়া হিন্দুরা এ স্টেটমেন্ট জানতে পারলে নাগাসি মহাশয়ের দিকে শিবসেনা লেলিয়ে দিতে পারে। আমার পাশ দিয়ে হেঁটে যাওয়া ডারোথি মাদিনা নাগাসির বক্তব্য শুনে ফিচেলের মতো ফিক করে হেসে জানতে চান, ফুড ট্র্যাভেলের মাইক্রোবাসটি কী দুনিয়ার সবচেয়ে পুরানো আদি মোটরকার? কুফি নাগাসি এ মন্তব্যের জুত মতো জবাব দেয়ার কোন ফুরসত পান না। বনোয়াঁ নিজের গতি শ্লথ করে, কাছে এসে খানিকটা শাসানোর ভঙ্গিতে বলেন, ডু ইউ হ্যাভ অ্যা সেলফোন নাগাসি? আই ওয়ান্ট ইউ টু ইউজ দিস। আমি চাই আমরা পৌঁছার আগে রেস্তোরাঁয় তুমি রিং করে জানাবে খাবার তৈরী করে রাখতে। ওখানে পৌঁছার পর যেন শুনতে না পাই- বাবুর্চি ছাগল কিনতে বাজারে গেছে।
বনোয়াঁ নাগাসিকে ট্রিট দিচ্ছেন। আমি ওসবে জড়াতে চাই না, তাই পিছিয়ে পড়ি। দেখি, পাশ দিয়ে চিন্তিত মুখে হাঁটছে কানসিয়েনা। তাকে কিছু জিজ্ঞেস করতে হয় না, সে নিজ থেকেই বলে, বনোয়াঁর সঙ্গে আমার জানাশোনা হয় প্যারিসে। সে স্বল্প বাজেটে রাফ ট্র্যাভেল করতে পছন্দ করে, কিন্তু ভ্রমণের স্ট্রেস নিতে পারে না। সব কিছুতে জোর জবরদস্তি করা তার স্বভাব। দিস ইজ ইথিওপিয়া, এখানে সব কিছুর রিদম স্লো, এ বিষয়টা তার মাথায় ঢুকছে না।
আমি কিছু না বলে নীরবে তার পাশ দিয়ে হাঁটি। মেয়েটি রিজনেবোল। ভিন্ন একটি দেশে বসবাস করতে এসে কালাচারেলি এডজাস্ট করছে শোভনভাবে। হাঁটতে হাঁটতে তার সঙ্গের সুরভিত উত্তাপ সম্পর্কে আমি ফের সচেতন হই। দেখি, পাশে একটি কাঁটাগাছের মরা ডালে বসে পরস্পরের পালক খুঁটছে দুটি পাখি। পালকের বনানী-সবুজে নীলের তীব্র একসেন্ট দেয়া লেজ-ঝোলা এ রকমের এক জোড়া পাখি ঘন্টা দেড়েক আগে আমি জার্মান বেকারি-ক্যাফের সামনে বিজুলির তারে বসে থাকতে দেখেছি। কুফি নাগাসি ফের ঘন্টা বাজান। বুঝতে পারি, আমরা এসে পৌঁচেছি আমাদের অকুস্থল- প্রাতঃরাশের নির্ধারিত রেস্তোরাঁয়।
ফুড ট্র্যাভেলের ছোট্ট ট্রুপটি রেস্তোরাঁয় ঢোকা মাত্র ছোটাছুটিতে রীতিমতো তুলতবিল পড়ে যায়। বসার জায়গাতেই চুলার গনগনে আগুনে রান্নাবান্নার জোগাড় চলছে। শিলাপাথরের পাটাপুতায় নারীরা টেফ বলে এক ধরনের দীর্ঘ ঘাসের বীজ পিসে আটার কাই বানাচ্ছেন। আমাদের সামনেই রুটি বেলে প্রকান্ড তাওয়ায় কমসে-কম বিশ ইঞ্চি ডায়োমিটারের ইনজিরা ব্রেড চড়ানো হয়।
বনোয়াঁ গনগনে আঁচে উতলানো কড়াইয়ের পাশে দাঁড়িয়ে রাধুঁনিকে জেরা-জবর করে জানতে চান- কী কী উপাদান দিয়ে এ খাবার কী প্রকারে রান্না হচ্ছে। বাবুর্চি মুখখানা কাচুমাচু করে ফরাসি সাহেবের চড়া মেজাজের সন্তানকে পাকসাকের সাথে রন্ধন প্রণালীর ধারা বর্ণনা দিয়ে চলে। কড়াইতে ওয়াট বলে এক ধরনে ভেজিটেবল স্টু চড়ানো হয়। ঘিয়ের মতো দেখতে যে তেল ব্যবহার করা হয় তার নাম নিতার কিবাহ। পয়লা তাতে লালচে রঙের কাটা পেঁয়াজ ভাজা হয়। তারপর তাতে মেশানো হয় মিটমিটা নামে এক ধরনের সিজনিং মিক্স। বাবুর্চি হাত তালি দিয়ে ইশারা করতেই তার এক সাকরেদ তাতে ছুড়ে এক মুটো খোসা ছড়ানো রসুন ও কুচানো আদা। ফের তালিয়া বাজাতেই তাতে চিমটা দিয়ে ফেলা হয় স্থানীয় ভাবে বেরবেরে বলে পরিচিত লাল মরিচের গুড়া ।
এ ফোঁড়নে রন্ধনের ব্যাপারটা ক্লাইমেক্সে পেঁৗঁছে যায়। সূত্রপাত হয় সমবেতভাবে হাঁচি ও কাশির। প্রফেসর ওয়াহাব কুফিয়া গিলাফটি বাড়িয়ে দেন তার সঙ্গিনীর দিকে। ডারোথি মদিনা সোবহানাল্লা বলে তার নাকে গিলাফ গুঁজেন। এবার ডেগচিতে ছোড়া হচ্ছে বাটি বাটি কিকি বা সবুজ মটরদানা। সাথে মেশানো হয় ইথিওপিয়ায় বিরসিন নামে পরিচিত ডাল।
আমি পুরো প্রক্রিয়ার ডিসপ্লেতে ¯্রফে আগ্রহ হারিয়ে ধপাস করে বসে পড়ি চেয়ারে। কুফি নাগাসি প্রকান্ড একটি স্টিরিও টেবিলে উপর রেখে সিডির বাটনে চাপ দিয়ে জানান, ট্র্যাডিশনালি ইথিওপিয়াতে বিয়ে-শাদির অনুষ্ঠানে রান্নাবান্নার সাথে সাথে চলে উদ্দীপনাময় গান-বাজনা। স্টিরিও থেকে হান্ডি-পাতিল , ঢোল-কাসর ও শিঙ্গা ফোঁকার এ্যয়সা চড়া দাগের জোশাল আওয়াজ বের হয় যে, কানসিয়েনা যিসাশ ক্রাইস্ট বলে ফিশফিশিয়ে আমাকে জানায়, দিস ইজ অ্যা বিট মাচ, আমার কিন্তু বুক ধড়ফড় করছে।

আজ খাদ্যের সম্ভাবনার সাথে বাদ্যের এমন উচ্চরোল চলছে যে, আশঙ্কা হয়, এর উৎপাতে ওস্তাদ মিয়া তানসেন না আবার সুদূর হিন্দুস্থানে গোর থেকে উঠে বসেন। কিছু একটা বিহিত করতে হয়। আমি বনোয়াঁর দিকে তাকাই। কিছু বলতে হয় না, ইশারাই কাফি প্রমাণিত হয়, তিনি হুংকার দিয়ে বলেন, নাগাসি, শাট দ্যাট স্টিরিও আপ রাইট অ্যাট দিস মোমেন্ট।
ওয়াট নামক স্টু ও আটকিট বলে পরিচিত ভাজা সব্জি দিয়ে ইনজিরা ব্রেড খেতে ভালোই লাগে। তবে ফের গোল বাঁধান বনোয়াঁ। তিনি ছুরি দিয়ে ইনজিরা ব্রেড কাটেন, একটু ঘাঁটাঘাঁটিও করেন, সালুন বা স্টুর কট্টা নাকের কাছে তুলে কাঠবিড়ালের মতো শুঁকাশুঁকিও করেন, তবে কিছু মুখে তুলেন না। কুফি নাগাসি বিব্রত হয়ে চরনাকি নামে এক ধরনের মিষ্টি পেসট্রি প্লেটে করে তার সামনে রাখেন। তাতেও বনোয়াঁর মন ওঠে না।
আমি অস্বস্তিতে কানসিয়েনার দিকে তাকাই। সে মাথা নিচু করে আছে, তার চোখেমুখে খেলছে গির্জার নান বা সন্ন্যাসীনীদের মতো নিরাসক্ত অভিব্যক্তি। বোধ করি মেয়েটি নীরবে ভাবছে, বনোয়াঁর সাথে ঘর বাঁধলে ভবিষ্যতে সংসারে কী ধরনের সিচ্যুয়েশনের সৃষ্টি হতে পারে। খানাপিনার পর কুফি নাগাসি ইথিওপিয়ার ট্র্যাডিশনাল কায়দায় কফি সেরিমনির আয়োজনের প্রস্তাব দেন। কিন্তু বনোয়াঁ ও প্রফেসর ওয়াহাব দুজনেই আপত্তি তুলেন, কিছুক্ষণ আগে না আমরা জার্মান বেকারি থেকে কফি পান করে বেরোলাম। বনোয়াঁ উঠে পড়ে লেটস্ মুভ অন বলে বেরোনোর উদ্যোগ নেন।
রোস্তোরাঁর সামনে মাইক্রোবাসটি দাঁড়িয়ে আছে। ধা ঝকঝকে এ বাহনটির চেসিসে আমরা আমাদের চেহারা-সুরতের পরিষ্কার প্রতিবিম্ব দেখতে পাই। চাইলে এটাকে আরশি হিসাবে এস্তেমাল করে থিয়েটারের মঞ্চে নামার জন্য মেকাপ নেয়া যায়। ঠিক বুঝতে পারি না- এমন ব্র্যান্ড নিউ বাহনের সারাই করার প্রয়োজন পড়লো কেন ? তবে এ নিয়ে সওয়াল না তুলে- গাড়িতে উঠতে উঠতে ভাবি, ভ্রমণে বহু কিছুরই রহস্য ভেদ করা যায় না, তবে হাস্য মুখে বিভ্রান্তি মোকাবেলা করলে আখেরে সফর সুখকর হয়।
মাইক্রোবাসটি চলে আসে মিনিলিক স্কোয়ারে। কুফি নাগাসি ঘন্টা বাজিয়ে মনযোগ আকর্ষণ করে জানান, ১৯৩০ এখানে স¤্রাট হাইলে সেলাসির সিংহাসনে বসার অভিষেক অনুষ্ঠিত হয়েছিল। তার এ তথ্যে কেউ বিশেষ একটা গুরুত্ব দেয় না। তো মাইক্রোবাস বাঁক ফিরে গলিগুজির ভেতর দিয়ে চলে আসে মিরকাটো বা মার্কেটে।
আমরা নেমে পড়তেই দেখি, ঠেলাগাড়িতে করে নিয়ে যাচ্ছে প্রচুর পরিমাণে মোটর পার্টস্ ও টায়ার। রুটির দোকানে খরিদদারদের বিস্তর ভীড়। কিছু টং-দোকানে ডিসপ্লে করা হচ্ছে বর্ণাঢ্য ধূপকাঠি, পুড়ে পুড়ে কিছু স্টিক বাতাসে ছড়াচ্ছে সুগন্ধি। জবাই করা জানোয়ারদের দোকানগুলোর সামনে দিয়ে আগাতে গেলে-গরুর কাটা মুন্ড হাতে হা-রে-রে করে আমাদের দিকে তেড়ে আসে দীর্ঘকায় এক কৃষ্ণাঙ্গ মানুষ। জননী মেরির মূর্তি বুকে চেপে আরেক ব্যক্তি হাত বাড়িয়ে ছুঁতে চায় কানসিয়েনার শরীর। তৃতীয়জন মাটিতে ছেড়ঁখুড়া তুলতুলে কম্বল বিছিয়ে তাতে হাঁটু গেড়ে বসে।
পরিস্থিতি আয়ত্বের বাইরে চলে যাচ্ছে আন্দাজ করে আমি তাদের হাতে তুলে দেই খুচরা কিছু নোট। পাশ থেকে নাগাসি ফিসফিসিয়ে বলেন- বাজারের এ দিকটাতেই কিছু ক্রনিক পাগলের উপস্থিতি আছে। এদের অতিক্রম করে হান্ডি-পাতিলের গলিতে আসা মাত্র বারো চৌদ্দটি আওয়ারা ছাগল চেঁ-বেঁ করে পরিস্থিতি গুলজার করে তুলে।
নাগাসি ঘন্টা বাজিয়ে ঘোষণা দেন, এসব হচ্ছে বাজারের কন্ট্রোল্ড্ কেওস। ঘাবড়াবার কিছু নেই। আমরা সকলে তার পেছন পেছন ঢুকে পড়ি একটি মুদির দোকানে। শুকনা ফল, মরিচ, বাখর ও হরেক কিসিমের ডালের বস্তার পেছনে শানেমানে বসে আছেন দোকানি মহিলা। আমাদের হাতের ইশারায় তিনি পর্দা ঠেলে দোকানের পেছন দিকে যেতে বলেন। জানা যায়, ওখানে ডিসপ্লে করা আছে রহস্যময় মশলাপাতি। নাগাসি কিছু মশলার আফ্রদিসিয়াক্ গুনাগুন সম্পর্কে আমাদের অবগত করেন। খাদ্যে এ সব বস্তুর মিশেলে নাকি সঙ্গম হয়ে ওঠে দারুণভাবে সেটিসফেক্টরি।
বঁনোয়া, প্রফেসর ওয়াহাব ও ডারোথি মদিনা উৎসাহের সাথে পর্দা ঠেলে ভেতরে ঢুকে। মশলাপাতিতে আমার আগ্রহ কমে আসে, তো বেরিয়ে আসি সড়কে। দেখি, সাথে সাথে হাঁটছে কানসিয়েনা। আমি জানতে চাই, হোয়াই বনোয়াঁ ইজ সো ইন্টারেস্টেড ইন স্পাইসিস? সে জবাব দেয়,এক সময় বনোয়াঁ গ্রাফিক ডিজাইনার হিসাবে কাজ করতো। তাতে সফলতা না আসলে বর্তমানে সে রেস্তোরাঁয় শেফ হতে চাচ্ছে। প্যারিস নগরীতে রান্নাবান্নার কাজে কমিয়াবি হাসিল করা খুবই মেহনত সাপেক্ষ। এর চেয়ে অনেক কম পরিশ্রমে চিত্রকর হওয়া যায়। জানতে চাই, বনোয়াঁ কী গুড়া মশলার সওদাপতি করবে? কানসিয়েনা ফিক করে হেসে বলে,দ্যাট ইজ হোয়াট হিজ ইনটেনশন ইজ। আজ রাতে সে আমাকে রান্না করে খাওয়ানোর প্রস্তাব দিয়েছে। বলতে বলতে তার অলিভের আভা ছড়ানো গন্ডদেশ রক্তিম হয়ে ওঠে।
এদিককার পুরো গলি জুড়ে অনেকগুলো কাপড়ের দোকান। তার একটিতে ঢুকে কানসিয়েনা তাঁতের সফ্ট মেটেরিয়েলে তৈরী স্কার্ফগুলো খুঁটিয়ে দেখে। তারপর দোকানিকে কতগুলো স্কার্ফ প্যাক করে দিতে বলে জনান্তিকে মন্তব্য করে, এগুলোর মটিফের ব্যবহার করে ছেলেদের জন্য টিশার্ট ডিজাইন করা যায়। কথা বলতে বলতে আমার দিকে তাকালে- তার চোখমুখে স্পষ্টত এক ধরনের দোলাচল দেখতে পাই। মনে মনে ভাবি, এ দ্বিধা কী বনোয়াঁর সঙ্গে সম্পর্ক গড়ে ওঠার পয়লা দিককার উদ্বেগ?
দোকান থেকে বেরিয়ে আসতে গিয়ে কেন জানি আগেকার জামানায় গীত কাজী সাহেবের একটি গানের কলি স্মৃতিতে ফিরে আসে, তব কাজল আখির ঘন পল্লব তলে..। পরের চরণটি কিছুতেই আর মনে আসে না। প্রচুর মশলাপাতি ও নানা রকমের ধকড়মাকড় কিনে বনোয়াঁ, ওয়াহাব ও ডারোথি মদিনা ফিরে আসে। মাইক্রাবাসে ফিরতে ফিরতে আমি কেবলই সংগীতটির বিস্মৃত কলি নিয়ে ভাবি। এটি কী কমল দাশগুপ্তর সুরে করা? গাড়ির পিছন দিকে একা বসতে বসতে মনে হয়, ভাটি বয়সেও আমার অনুভূতি অক্ষুন্ন আছে, তবে স্মৃতি বোধ করি ঘঁষা কাচের মতো হয়ে ওঠছে ক্রমশ ধূসরিম।
গাড়ি চালু হতেই কুফি নাগাসি জানান, আমাদের পরবর্তী গন্তব্য- নগরীর একটি জমকালো রেস্তোরাঁ। তবে সড়কে ক্রমশ ট্র্যাফিকের কেওস বাড়তে থাকে। এক পর্যায়ে জ্যাম এভোয়েড করতে গিয়ে ড্রাইভার মাইক্রোবাসটি নিয়ে আসে স¤্রাট সেলাসির সাবেক প্রাসাদের দেউড়িতে। আমি রাজভবনটি দেখতে চাই। প্রফেসর ওয়াহাবের দিকে তাকালে তিনি বলেন, গো এহেড। কিন্তু অন্যরা তেমন একটা উৎসাহ দেখায় না।
বনোয়াঁর চোখমুখ দেখে মনে হয়, তিনি ফরাশি স¤্রাট নেপোলিয়ান ছাড়া অন্য কোন রাজা-বাদশাহের নাম কস্মিনকালেও শুনেননি। দেউড়ি অতিক্রম করে আমরা ঢুকে পড়ি রাজপুরির গাছবিরিক্ষে শ্যামল একটি আলিশান মাপের চত্তরে। নাগাসি ঘড়ি দেখে বলেন,আজকে হাফ ডে, বেলা একটায় প্রাসাদে পর্যটকদের ঢোকা বন্ধ হয়ে যাবে। অর্থাৎ হাতে আছে মাত্র পঁচিশ মিনিট। কানসিয়েনা অন্যদের নিয়ে স¤্রাটের বাগিচায় হাঁটাহাঁটি করতে যায়। আমি ও ওয়াহাব ¯্রফে ছুট লাগাই-খানিক ইউরোপীয় ধাচে তৈরী প্রাসাদের চকমিলান ভবনটির দিকে।

আঙিনায় কোন ঘরদুয়ারের সাথে সম্পর্কহীন একটি সিঁড়ি দেখতে পেয়ে ওয়াহাব দাঁড়িয়ে পড়েন। এখানে এসে এ যাত্রায় পয়লা বারের মতো তিনজন রাসতাফেরিয়ান মানুষের মোলাকাত পাওয়া যায়। এদের প্রত্যেকের মস্তকে শিবঠাকুর সুলভ দীর্ঘ জটাজুট সূর্যমুখি রঙের উলের হ্যাটে ঢাকা। ইতিহাসের অধ্যাপক ওয়াহাব, তার বাচনিকে জানতে পারি, দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের আমলে- ১৯৩৬ থেকে ১৯৪১ সাল আব্দি ইথিওপিয়ায় চলে ইতালিয়ানদের দখলদারি। তরুণ স¤্রাট সেলাসি তখন প্রবাসে যেতে বাধ্য হন। ইতালিয়ানরা এ অঞ্চলে তাদের সামরিক অর্জনের প্রতীক স্বরূপ ফি বছর তৈরী করে একটি করে সিঁড়ি।
  যুদ্ধে জার্মানির সাথে ইতালির পরাজয় হলে স¤্রাট সেলাসি ফিরে আসেন আদ্দিস আবাবায়। তিনি সিঁড়িগুলো ভাঙ্গেননি, তবে তাঁর রাজবংশের শাসনের নিশানা হিসাবে উপরের সিঁড়িটিতে স্থাপন করেন একটি সিংহমূর্তি। আমি এ মনুমেন্টটির ছবি তুলতে যাই, দেখি, রাসতাফেরিয়ানরা চৌকিদারের সাথে দেন-দরবার করছেন, সিঁড়ি বেয়ে উপরে ওঠে সিংহ-প্রণাম করার জন্য। আমি সূর্যপ্রণাম সম্পর্কে অবগত হলেও পাথরের সিংহকে সালাম করার রেওয়াজ সম্পর্কে তেমন কিছু জানি না। ওয়াহাবও এ আচরণের কোন ব্যাখ্যা দিতে পারেন না।
  তো আমাদের হাতে সময় কম। তাই প্রাসাদে ঢুকে পড়ে প্রশস্ত করিডোর ধরে আগাই। দু পাশের দেয়াল হরেক রকমের চিত্র ও ইথিওপিয়ার জনগোষ্ঠির শিকারে ব্যবহৃত নানাবিধ হাতিয়ারে সাজানো। আমরা কাঠে তৈরী ভারী একটি সিঁড়ি বেয়ে উঠে আসি দোতলায়। দরবার হলে ঢোকার মুখে- ছোট্ট একটি পরিসরে ডিসপ্লে করা হচ্ছে স¤্রাটের পোষা সিংহটির ট্যাক্সিডার্মি করা মূর্তি।
  এখানেও আরেকজন রাসাতাফেরিয়ান মানুষের সাক্ষাৎ পাওয়া যায়। তিনি মেঝেতে শুয়ে পড়ে ক্যামেরা বাড়িয়ে ফ্লাশ ঝলকিয়ে ছবি তুলছেন। অবস্থাদৃষ্টে মনে হয়, ইনি সিংহের অন্ডকোষের ফটোগ্রাফ করছেন। প্রত্যঙ্গটি সিংহ প্রজাতির প্রজননে জরুরি ভূমিকা পালন করলেও এর ফটোগ্রাফ দর্শনে দর্শকদের কী ফায়দা হবে ঠিক বোধগম্য হয় না। প্রাসাদ বন্ধ করে দেয়ার বেল বেজে ওঠে। আমি ও ওয়াহাব পড়িমড়ি করে ছুট লাগাই মাইক্রোবাসের দিকে।
  ট্র্যাফিকের ঝুটঝামেলা কমে গেছে। তাই মাইক্রোবাসটি এক টানে আমাদের নিয়ে আসে গ্রানডি ডে পেপে রেস্তোরাঁয়। ইথিওপিয়ান খাবারের এ নামজাদা ঠেকটির বাগিচায় আছে শনে ছাওয়া বৃত্তাকার একটি গার্ডেন হাউস। রেস্তোরাঁর ভেতরের সাজসজ্জা দৃষ্টিনন্দন, পরিবেশও পয়পরিষ্কার। ঢোকার মুখে সুদর্শনা এক ওয়েট্রেস হাসি মুখে খাবার স্যাম্পোলের ট্রে হাতে দাঁড়িয়ে। তার এপ্রোনের পকেটে রাখা কয়েকটি চিমটা। আমি ও ডারোথি মদিনা চিমটা দিয়ে তুলে খানিকটা ভাজা সব্জি মুখে দেই। অন্যরা বিফের টুকরা চেখে ডিশগুলো মুখরোচক বলে মতামত দেয়। তবে কেউই রেস্তোরাঁর ভেতরে বসতে রাজি হয় না। সকলের আগ্রহ গার্ডেন হাউসের খোলামেলায় বসে আহারাদি চাখতে।
  কুফি নাগাসি আমাদের প্রস্তাবে রাজি হন, তবে কপাল কুঁচকে বনোয়াঁর দিকে তীব্র দৃষ্টিপাত করে বলেন, ইফ ইউ গাইজ ডোন্ট ট্রাই, ইউ আর নট গোনা আন্ডারস্ট্যান্ড দ্যা টেস্ট এন্ড ফ্লেভার অব ইথিওপিয়ান ফুড। তার যুক্তিসঙ্গত মন্তব্যে আমি ও ওয়াহাব মাথা হেলিয়ে সায় দিলে তিনি ফের কথা বলেন,গার্ডেন হাউসে বসতে চাও বস, বাট ইউ অল মাস্ট ইট। বুঝতে পারি- এ পর্বে খানাপিনা নিয়ে টালবাহনার কোন অবকাশ নেই।

তো, আমরা রেস্তোরাঁ থেকে বেরিয়ে বাগান-ঘরে বসার জোগাড় করি। তেমন একটা দেরি হয় না। খাবারের স্যাম্পোল চাখতে দেয়া ওয়েট্রেস নিয়ে আসেন আরেকটি ট্রে। প্রত্যেকের সামনে যে বাটিগুলো দেয়া হয়-তাতে পরিবেশিত হয়েছে স্টার্টার হিসাবে কিটফো। নাগাসি খাদ্যটি যে মশলা মাখানো রো বিফের টুকরা তা জানালে, আমার পাশ থেকে ডারোথি মদিনা ইয়াক বলে নেতিবাচক আওয়াজ দেন। তার পুরুষ সাথী ওয়াহাবও মনে হয় বেহালাল মাংসের কারণে বিড়বিড় করে ওয়াসতাগফিরুল্লা পাঠ করেন। আমাদের অনাগ্রহ দেখে ওয়েট্রেস আহত হন না। ইশারা দিতেই তার অন্য এক সেহেলি দ্রুত নিয়ে আসেন ভিন্ন একটি ট্রে। আমাদের পাতে এবার দেয়া হয় গরজনঝোলা সসে মাখানো মুচমুচে করে ভাঁজা তেলাপিয়া মাছের ফ্যালে। বস্তুটি আমরা বেশ আয়েশ করে লেজুসুদ্ধ কুড়মুড়িয়ে চিবাই।
  এবার বিয়ের উপাচারের ডালার মতো রঙচঙে একটি বেতের বারকোশ ক্যারি করে নিতে আসেন তিন জন ওয়েট্রেস। তা থেকে তুলে প্রত্যেকের সামনে রাখা হয় খাবারের স্বতন্ত্র থালি। তাতে ইনজিরা রুটির উপর আলাদা করে রাখা শিরো তেগাবিনা বা মটরশুঁটির মন্ড। পাশে ফিরফির নামে পরিচিত ভাঁজা সব্জি। নাগাসি বাকি ডিশ গুলোর ডিটেইল্ড্ বর্ণনা দিচ্ছেন। খাবারগুলো স্বাদে তোফা, তাই তার বাকোয়াস না শুনে আমরা আহারে মনযোগ দেই।

তিনি বিরক্ত হয়ে ইথিওপিয়ান ভোঁজে গুরুশা প্রথার উল্লেখ করেন। ভালোবাসার নিদর্শন হিসাবে যুগলদের মধ্যে পাবলিকলি পরস্পরের মুখে খাবার তুলে দেয়ার রেওয়াজ আছে। কানসিয়েনা গুরুশার আইডিয়া পাওয়া মাত্র বনোয়াঁর মুখে ইনজিরায় ফিরফির জড়িয়ে তুলে দেয়। এ মুহূর্তে তাদের দুজনকে কিউট দেখায়।
  ভুরিভোজনের পর আমি ও ওয়াহাব গার্ডেন হাউস থেকে বেরিয়ে গাছতলায় দাঁড়াই। আমি একটি সিগ্রেট ধরালে ওয়াহাব মিসওয়াক দিয়ে দাঁত মাজেন। অতঃপর ¯্রফে কৌতূহলবশত জানতে চাই, আর ইউ মেকিং এনি প্রগ্রেস উইথ মদিনা, প্রফেসর? তিনি হাসিমুখে জানান, ডারোথি মদিনা তার দাওয়াতে সাড়া দিয়ে সৌদি আরবে যেতে রাজি হয়েছে। তো জানতে চাই, আপনারা কি রিয়াদে লিভ টুগেদারের কথা ভাবছেন? তিনি দ্রুত জবাব দেন, ওহ্ হেল নো, তওবা, আমরা এক সাথে উমরাহ করার পরিকল্পনা করছি। তারপর আল্লাহ অলমাইটির ঘরের সামনে দাঁড়িয়ে পরস্পরের কাছে অঙ্গীকারাবদ্ধ হবো। আমি তাকে অভিনন্দন জানাই।

তখনই গার্ডেন হাউস থেকে ঘন্টি বাজিয়ে নাগাসি সবাইকে ডাকেন। আমরা সকলে জড়ো হলে তিনি চোখমুখ সিরিয়াস করে জানান, সবাইকে এখনই উঠতে হয়, পরপর আরো দুটি রোস্তোরাঁয় খাবারের অয়োজন করা হয়েছে। আমি বিরক্ত হই, নাগাসি আমাদের রাক্ষস খোক্কস ভাবলেন নাকি? আরো দুটি রেস্তোরাঁয় খাবারের কথা শুনে বাকিরাও নির্বাক হয়ে গেছেন। তিনি ওসবের তোয়াক্কা না করেন ফের ঘোষণা করেন, দুটি রেস্তোরাঁয় খাবার চাখা হলে পর তিনি একটি ট্র্যাডিশনাল ক্যাফেতে নিয়ে যাবেন- ওখানে ইথিওপিয়ান কেতায় চলছে কফি সিরিমনির আয়োজন।
  খাবার-দাবারের বিপুল সম্ভাবনায় বনোয়াঁও বিমূঢ় হয়ে পড়েন। তিনি নার্ভাসভাবে নাগাসিকে প্রশ্ন করেন,ইজ দ্যাট নেসেসারি। খানাপিনায় আপাততঃ ক্ষান্ত দিলে হয় না? মাথা হেলিয়ে অত্যন্ত নারাজ ভঙ্গিতে নাগাসি জানান, দিস ইজ ফুড ট্র্যাভেল, ইটিং ইজ দ্যা মেইন পারপাস অব দিস ট্রিপ। রেস্তোরাঁগুলোতে খাবারের জন্য এডভান্স করা হয়ে গেছে। তারা টেলিফোন করে জানতে চাচ্ছে আমরা কখন পৌঁছাবো। আমি নাগাসির মুখের দিকে তাকাই। তার চোখেমুখে এমন এক সংকল্প খেলা করছে যে- মনে হয়, এ যাত্রায় কোন পর্যটক খানাপিনা ফাঁকি দিতে চাইলে তিনি তা বরদাস্ত করবেন না।
  তো আমি মিনমিনিয়ে জানতে চাই, আর কোন অপশন নেই, অন্য কোথাও বেড়াতে গেলে হয় না? নাগাসি আশ্বাস দেয়ার ভঙ্গিতে হাত তুলে বলেন, সন্ধ্যার পর মিষ্টান্ন ও হানি ওয়াইনের ব্যবস্থা আমি অলরেডি করে রেখেছি। তবে আপনারা অন্য কিছু খেতে চাইলে কাইন্ডলি আমাকে জানাবেন, অ্যারেঞ্জিং এনাদার রেস্টুরেন্ট এন্ড অ্যা লিটিল মোর ফুড ইজ নট গোয়িং টু বি অ্যা প্রবলেম। আমরা তার বিবৃতিতে খানিক অতঙ্কিত হয়ে পরস্পরের মুখের দিকে তাকাই।