ষাটের দশকের শেষের দিকের কথা। আমি বিশ^বিদ্যালয়ের সম্মান শ্রেণীর শিক্ষার্থী। অল্পস্বল্প লেখালেখি করি। তার থেকে বেশি পড়ার চেষ্টা করি। তখন ঢাকার সাহিত্যজগত আজকের তুলনায় অনেক ছোট আকারের ছিল। বর্তমানের মতো এত লেখক-কবি যেমন ছিল না, অন্যদিকে প্রকাশনার ক্ষেত্রও ছিল সঙ্কুচিত। কোলকাতা থেকে প্রকাশিত উপন্যাস-মাসিক সাহিত্য পত্রিকা সে সময় ঢকায় সহজলভ্য ছিল। আজকের মতো প্রতি বছর শহীদ দিবসে, বিশেষত বিশ^বিদ্যালয় পর্যায়ের রাজনীতি সচেতন শিক্ষার্থী এবং রাজনৈতিক দলের নেতা-কর্মীরা ২১ ফেব্রুয়ারির প্রভাতফেরি বের করতেন। প্রভাতফেরির গন্তব্যস্থল ছিল কেন্দ্রীয় শহীদ মিনার। সেখানে ছাত্রসমাবেশে দেশের রাজনীতি বিষয়ে ছাত্রনেতৃত্ব বক্তব্য তুলে ধরতেন। বাংলা একাডেমি চত্বরে কবিতা পাঠের আসর বসতো যেখানে প্রবীণদের সাথে নবীন কবিরাও কবিতা পড়তেন। এই দুই স্থানে শহীদ দিবস উপলক্ষে প্রকাশিত স্মরণিকা আকারের সাহিত্যপুস্তিকা বিক্রি হোত। তবে দৈনিক পত্রিকাগুলোর সাপ্তাহিক সাহিত্য পাতা বের হতো। যার কোন কোনটা অত্যন্ত মানসম্মত লেখায় সমৃদ্ধ থাকতো।
ঢাকায় সে সময় নিয়মিত ভাবে প্রকাশিত কোন সাহিত্য পত্রিকা ছিল না। গ্রন্থ আকারে গল্প বা কবিতার প্রকাশনাও কম ছিল। তাই আমাদের পক্ষে পাঠের পরিসীমা সীমিত ছিল। হঠাৎ একদিন একটা লেখার শিরোনাম ও লেখকের নামে চোখ আটকে গেল। মনে করতে পারছি না যে দৈনিক পত্রিকার সাহিত্যপাতা নাকি কোন সাময়িকপত্রে লেখাটা প্রকাশিত হয়েছিল। লেখার শিরোনাম জোশ মলিহাবাদী-এ জাতীয় কিছু ছিল। তবে লেখকের নাম আজো ভুলিনিÑ বশীর আল হেলাল। জোশ মলিহাবাদী নামের একজন উর্দু কবির বিষয়ে তখন পর্যন্ত কিছুই জানতাম না। লেখাটায় কী নিয়ে আলোচনা ছিল তা আজ ভুলে গেলেও কবির নামের ভিন্নতা এবং প্রবন্ধ লেখকের নামের শেষাংশে অপ্রচলিত শব্দ আমাকে লেখাটা পড়তে প্রভাবিত করেছিল। আমাদের লেখকদের নামগুলো বাঙালী মুসলমানদের মধ্যে প্রচলিত পদবিসম্পন্ন ছিল যেগুলো শেষে উদ্দীন, রহমান, আলী, এসব শব্দযুক্ত হতো। কিন্তু আল হেলাল শব্দযুক্ত নাম সেই প্রথম দেখলাম। সেই প্রবন্ধটা পড়ার পর লেখকের আর কোন লেখা কিছু পড়েছিলাম বলে মনে পড়ে না।
বশীর আল হেলালের সঙ্গে আমার তখন যোগাযোগ হয়নি। স্বাধীনতার অনেক পরে তার সঙ্গে পরিচয় হয়েছিল। মনে হয় নতুন শতাব্দীর প্রথম দিকে মধ্যপ্রাচ্যে অস্থিতিশীল রাজনৈতিক ঘটনাবলীর প্রেক্ষাপটে। সে সময় ইরাকের কুয়েত দখল থেকে সৃষ্ট পরিস্থিতিতে ইরাকের জন্য প্রণীত মার্কিন আগ্রাসীনীতির কারণে বাংলাদেশের বাম রাজনৈতিক মহলে যথেষ্ট মার্কিনবিরোধী মনোভাব তৈরি হয়েছিল। তখনকার তরুণ রাজনৈতিক কর্মী এবং বর্তমানে গণসংহতি আন্দোলনের প্রধান সমন্বয়ক জোনায়েদ সাকি ও তার সহকর্মীদের উদ্যোগে যুদ্ধবিরোধী একটি কমিটি তৈরি করা হয় তখন। এর আহবায়ক করা হয় অধ্যাপক সিরাজুল ইসলাম চৌধূরীকে। বশীর আল হেলালের সাথে আমাকে এর যুগ্ম আহবায়ক করা হয়।
তখন আমাদের পরিচয় হলো। দেখলাম যে সাধারণ বাঙালী চেহারার সঙ্গে তার চেহারা মেলে না। দীর্ঘকায় ছিপছিপে এক ব্যক্তি। উজ্জ্বল গাত্রবর্ণ যা সচরাচর বাঙালীদের মধ্যে দেখা যায় না। তার শরীরে যে আরব রক্তের মিশ্রণ ছিল পরে তার জীবন সম্পর্কে কিছু তথ্য পেয়ে জানতে পারলাম। তার পূর্বপূরুষরা দশ প্রজন্ম আগে ইরাক থেকে এসে মুর্শিদাবাদে বসতি স্থাপন করেছিলেন। মূলত ধর্মপ্রচারের উদ্দেশ্যে তারা এসেছিলেন। তবে পরবর্তীকালে তারা জ্ঞানচর্চা শুরু করেন যদিও তা উর্দু, আরবী ও ফার্সি ভাষা শিক্ষার মধ্যে সীমাবদ্ধ ছিল। তার পিতা এই তিন ভাষায় পারদর্শী ছিলেন এবং ফার্সি ভাষায় সাহিত্যচর্চা করতেন। অন্যদিকে বাংলায় কথা বলতে পারলেও এই ভাষার বর্ণ পরিচয় তার ছিল না। অথচ তার দুই ছেলে, অগ্রজ নেয়ামাল বাসিরের মতো বশীর আল হেলাল বাংলা ভাষায় সাহিত্য চর্চা করে গেছেন। প্রথমে দুই ভায়ের নামের শেষে যথাক্রমে বাসির ও বাশীর থাকায় তাদের লেখার পাঠকদের মধ্যে কে কোনজন নিয়ে সংশয় হোত বলে পরে নেয়ামাল বাশীর নাম পালটে বশীর আল হেলাল করে নিয়েছিলেন।
নেয়ামাল বাসিরের সঙ্গেও আমার ভিন্ন কারণে পরিচয় হয়েছিল। পূর্বপূরুষদের দিক থেকে তাদের মাতৃভাষা উর্দু হওয়াই স্বাভাবিক। অথচ এরা দুই ভাই বাংলা ভাষায় লিখেছেন। এটা প্রমাণ করে যে তাদের পূর্বপুরুষ বিদেশ থেকে এলেও কালক্রমে এরা এদেশের অংশ হয়ে গিয়েছিলেন। ভারত বিভক্তির পর বাশীর পূর্ববঙ্গে চলে এসে স্কুল পর্যায়ে পড়ালেখা করে পরে জন্মভূমি পশ্চিমবঙ্গে ফিরে গিয়েছিলেন। সেখানে কলেজ ও বিশ^বিদ্যালয় পর্যায়ে লেখাপড়ার সময় তিনি বাম রাজনীতির সঙ্গে জড়িয়ে পড়েন। তবে ১৯৬৮ সালে ঢাকায় চলে এসে এখানেই তার স্থায়ী আবাস গড়ে তোলেন।
বশীর ভায়ের সঙ্গে আমার নিয়মিতভাবে যে যোগাযোগ ছিল তা নয়। দুই জনের কর্মস্থল ভিন্ন হওয়ায় বোধ হয় এর একটা কারণ হতে পারে। তা ছাড়া তার লেখার বিচিত্র ভুবন ছিল- অন্যদিকে আমার বিষয় আন্তর্জাতিক সম্পর্ক এবং বেশির ভাগ অ্যাকাডেমিক লেখালেখির জগতে আমার বিচরণ থাকায় তার সঙ্গে যোগাযোগ হয়ে উঠতো না।
তবে তার সঙ্গে আবার আমার যোগাযোগ গড়ে উঠেছিল। প্রবীণ রাজনীতিক খালেকুজ্জামান নেতৃতাধীন বাসদ-এর উদ্যোগে দেশের শিক্ষাব্যবস্থায় বিরাজমান সমস্যা নিয়ে আন্দোলন করার উদ্দেশ্যে এক সময় শিক্ষা আন্দোলন মঞ্চ নামের এক প্ল্যাটফরম গড়ে তোলা হয়েছিল। ঢাকা বিশ^াবিদ্যালয়ের পদার্থবিদ্যার প্রয়াত অধ্যাপক অজয় রায়ের নেতৃত্বে সংগঠনটা কাজ শুরু করেছিল। তার সঙ্গে বশীর ভাই, রাবির অধ্যাপক শহীদুল ইসলাম, ঢাবির নৃবিজ্ঞান বিভাগের প্রয়াত অধ্যাপক আরেফিন, স্থপতি শামসুল আরেফিন ও আমি যুক্ত হয়েছিলাম। আশরাফউদ্দীন আকাশ ছিল এর সদস্যসচিব। মঞ্চ থেকে সে সময় অনেকগুলো জেলা-উপজেলা সফর করে শিক্ষা সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিদের সঙ্গে শিক্ষার সমস্যাগুলো নিয়ে মতবিনিময় করা হয়েছিল। সে সময় বিভিন্ন স্থানে সড়ক পথে যাওয়ার সময় আমরা নিজেদের মধ্যে আলোচনা করতাম কোন সমস্যাগুলো নিয়ে প্রথমে কাজ করা দরকার। বশীর ভাই শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে জড়িত না থাকলেও এ বিষয় নিয়ে যথেষ্ট পরিমান সচেতন ছিলেন বলে মনে হয়েছিল। শান্ত স্বভাবের বশির ভাই নিজ মত প্রকাশে অকুন্ঠ ছিলেন। সভাপতির সঙ্গে রাজনৈতিক বিষয়ে আলোচনায় তার বক্তব্য প্রকাশে অনুত্তেজিত থাকতেন। বাসদের অভ্যন্তরীণ বিবাদের কারণে পরে শিক্ষা আন্দোলন মঞ্চ নিষ্ক্রিয় হয়ে যায়। আমাদের মধ্যে যোগাযোগের মাধ্যমটা বন্ধ হয়ে যাওয়ায় পরে আর বশীর ভাইয়ের সঙ্গে দেখা হতো না।
বদরুদ্দীন উমরের গবেষণা লব্ধ ভাষা আন্দোলনের ইতিহাস নিয়ে একটা লেখার সময় আমি বশীর আল্্ হেলালের ’ভাষা আন্দোলনের ইতিহাস’ গ্রন্থটা সংগ্রহ করেছিলাম। তার এই গ্রন্থ ৮ শ’ পৃষ্ঠার বিশাল কলেবরের গবেষণালব্ধ একটা প্রকাশনা। বাংলা একাডেমী থেকে ১৯৮৫ সালে প্রথম প্রকাশিত হলেও ১৯৯৯ সালে আগামী থেকে বর্ধিত এক সংস্করণ বের হয়েছিল। এর তিনটা খন্ড আছে একই মলাটের ভেতর। প্রথম খন্ডে ’ভাষা-আন্দোলনের ঐতিহাসিক প্রেক্ষাপট’, দ্বিতীয় খন্ড ’ভাষা আন্দোলনের ইতিহাস’ এবং শেষ খন্ড ’বাংলাভাষার সংস্কার-প্রয়াস’ । বশীরও যে একটা অত্যন্ত শ্রমসাধ্য কাজ খুব আন্তরিকভাবে করেছেন তা বোঝা যায়। উমরের মতো তিনিও প্রতিটা খন্ডে বিভিন্ন উপশিরোনামের অধীন আন্দোলনের প্রেক্ষাপট, ইতিহাস এবং বাংলাভাষা সংস্কার নিয়ে বিস্তৃত তথ্য ও ব্যাখ্যা দিয়েছেন। লেখক ভাষাকে কেন্দ্র করে বাঙালীদের সাংস্কৃতিক অবদমনের সঙ্গে অর্থনৈতিক শোষণ ও রাজনৈতিক আধিপত্যবাদকে সম্পর্কিত করে এর প্রেক্ষাপটকে দুটি স্বতন্ত্র অধ্যায়ে ভাগ করেছেন। প্রথম সংস্করণের ভূমিকায় তিনি আন্দোলনের সাংস্কৃতিক প্রেক্ষাপটকে বিস্তৃত করেছেন। তার বইয়ের তৃতীয় খন্ড ’বাংলাভাষার সংস্কার প্রয়াস’ একটা মূল্যবান সংযোজন।
আমাদের দেশে কিছু কিছু মানুষের কাজের প্রচার হয়ে থাকে তার অবদানের তুলনায় বেশি। এ ক্ষেত্রে মিডিয়ার ভূমিকা আছে। কিন্তু যারা নিভৃতে কাজ করে যান তাদের প্রচার তুলনামূলক কম লক্ষ করা যায়। রাষ্ট্রীয় কোন পুরস্কার তাদের জন্য বরাদ্দ হয় না। বশীর আল হেলাল এই দ্বিতীয় গোষ্ঠীভুক্ত। জীবিত অবস্থায় এরা প্রচারের অপেক্ষা না করে কাজ করে যান। বশীর আল হেলালকে তার লেখালেখি বাঁচিয়ে রাখবে।