শিল্পী হায়াম স্যুটিন সম্পর্কে ২০২২ সালের আগেও তেমন কিছু জানতাম না। কেবল স্কুল অব প্যারিস ঘরানার শিল্পীর তালিকায় তাকে নামে চিনতাম।
স্যুটিনের প্রতি কেন আগ্রহ জন্মালো সে প্রশ্নের উত্তরটা খুব সহজ। তিনি ছিলেন জীবনযুদ্ধে পরাজিত একজন গরীব শিল্পী। অনেকটা ভ্যানগখের মতো। জীবনযাপনেও অনেক মিল দুই শিল্পীর। আঁকার ধরনেও মিল যথেষ্ট। ভ্যানগখের মতো স্যুটিনও ভক্ত ছিলেন রেমব্রান্টের। একইসাথে চার্ডিন এবং গুস্তভ ক্যুবার্ত ছিলেন স্যুটিনের প্রিয়। তবে স্যুটিনের প্রতি বাড়তি আগ্রহ তৈরী হবার পেছনের কারণটি ব্যক্তিগত। তা হলো, খাদ্য তালিকায় গরুর মাংসের প্রতি আমার ভালোবাসা।
২০২২ সালে যুক্তরাষ্ট্রে আসার পর জানলাম বাংলাদেশে দিন দিন গরুর মাংসের দাম চড়া হচ্ছে। পরিচিত যারা সপ্তাহে দুই/তিন দিন গরুর মাংস খেতেন তারা খাদ্য তালিকায় ক্রমে কমিয়ে দিচ্ছেন গরুর মাংস। খুব ছোট ঘটনা, কিন্তু আমাকে দারুণ নাড়া দিয়েছিল বিষয়টি। তখনই যুক্তরাষ্ট্রের মিনিয়াপলিস আর্ট গ্যালারিতে প্রথম স্যুটিন দেখি। সেখানে শিল্পীর আঁকা মাংসের ছবির সাথে পরিচয়। দেখলাম এক্সপ্রেশনিজম ধারার চূড়ান্ত উদহারণ ১৯২৬ সালে আঁকা কারকেস অব বিফ নামের বিখ্যাত ছবিটি।
ক্যানভাসের পাশে পরিচিতি সংযুক্তি নোটে শিল্পীর কাজের বিবরণ পড়ে আগ্রহ জন্মায় বিশদভাবে শিল্পীকে জানতে।
তারই ধারাবাহিকতায় প্রথম জানতে পারি ফিলাডেলফিয়ার বিখ্যাত সংগ্রাহক ডা. আলবার্ট বার্নসের কথা, যিনি স্যুটিনকে আবিষ্কার করেছিলেন এবং বিখ্যাত করেছিলেন। সেই সূত্রে স্যুটিনকে বিশদ জানতে ভ্রমণ করেছিলাম ফিলাডেলফিয়ায় বার্নস মিউজিয়ামে। ড. অ্যালবার্ট বার্নস পেশায় চিকিৎসক হলেও তাঁর মূল ব্যবসা ফার্মাসিউটিক্যালস কেন্দ্রিক। জার্মানী থেকে কেমিস্ট্রি বিষয়ে উচ্চশিক্ষা গ্রহণ করে আবিস্কার করেছিলেন ‘আর্গিরল’ নামের সিলভার প্রোটিন ধরনের এক বিশেষ অ্যান্টিসেপটিক। মূলত এই আর্গিরল ওষুধটি ড. বার্নসকে রাতারাতি মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের অন্যতম ধনী ব্যক্তিতে পরিণত করে। ফার্মাসিউটিক্যালস কোম্পানীর মালিক হিসেবে ড. বার্নস উপার্জিত অর্থের এক বিশাল অংশ খরচ করা শুরু করলেন ইউরোপের তৎকালীন আধুনিক শিল্পীদের কাজ সংগ্রহের মাধ্যমে। বলা হয়ে থাকে, ড. বার্নসের সূত্রে আমেরিকার মিউজিয়ামগুলো আগ্রহী হয়েছিলো ইম্প্রেশনিস্ট, পোস্ট ইম্প্রেশনিস্ট, কিউবিস্ট কিংবা স্কুল অব প্যারিস ঘরানার শিল্পীদের বিষয়ে।
বার্নস বিশেষ আগ্রহে সংগ্রহ করেছিলেন আগস্ত রেনোয়া, পল সেজান, পাবলো পিকাসো, হেনরি মাতিস এবং হাইম স্যুটিনের কাজ। ১৯২২ সালের ডিসেম্বর মাসে ড. অ্যালবার্ট বার্নস দ্বিতীয়বারের মতো যখন প্যারিস এলেন, একসাথে স্যুটিনের ৫২টি ক্যানভাস (বর্তমান বাজার মূল্য প্রায় ৫৫ হাজার ডলার) কিনে নিলেন আর্ট ডিলার পল গ্যুলিয়ামের কাছ থেকে। ড. বার্নস প্রথমবার প্যারিস এসেছিলেন ১৯১২ সালে।
এর ঠিক এক বছর আগে ছবি এঁকে ক্যারিয়ার করতে হাইম স্যুটিন প্যারিসের মন্টপারনাসে এলাকায় থাকা শুরু করেছিলেন। তখন একই সাথে নবীন ও উঠতি শিল্পী হিসেবে ছবি আঁকছেন শাগাল, মাতিস, পিকাসো, মদিগলিয়ানি, কিসলিং। কিছুদিন তাঁদের সঙ্গ দিয়েছিলেন মেক্সিকোর প্রখ্যাত শিল্পী দিয়াগো রিভেরা।
বার্নস সেই আমলের হিসেবে অনেক কম মূল্যে স্যুটিনের কাজগুলো কিনে নিয়েছিলেন। তিনি ছিলেন পাকা জহুরী।
সাথে সাথে প্যারিসের শিল্প বাজারে গুজব রটে গেলো ধনী মার্কিন আর্ট কালেক্টর ড. বার্নস নবীন শিল্পী স্যুটিনের কাছ থেকে একশ’র বেশী ক্যানভাস কিনে নিয়েছেন। এই খবর ছড়িয়ে পড়লে দরিদ্র শিল্পী স্যুটিনের খ্যাতি রাতারাতি ছড়িয়ে পড়লো। প্যারিসের কিছু প্রধান পত্রিকা এবং আর্ট জার্নালে ড. বার্নসের এই শিল্প ক্রয় নিয়ে খবর প্রকাশিত হলে অন্যান্য আর্ট ডিলাররা নড়েচড়ে বসেন। স্যুটিনের বন্ধু এবং আর্ট ডিলার লিওপল্ড বোরোস্কি এতে লাভবান হলেন সবচেয়ে বেশী। তবে বার্নস ফাউন্ডেশনের সংগ্রহে স্যুটিনের কাজ দেখতে গিয়ে অবাক বিস্ময়ে দেখি, সেখানে সর্বোচ্চ সংখ্যক ছবি আছে রেঁনোয়া এবং সেজানের। ড. বার্নসের চোখে স্যুটিন ছিলেন ভ্যান গখের চেয়েও গুরুত্বপূর্ণ আধুনিক শিল্পী। তা নিয়েও বিস্তর আলোচনা-সমালোচনা আছে। স্যুটিন নিজেও এ তুলনায় অস্বস্তি প্রকাশ করতেন। কিন্তু এটা সত্যি, ড. বার্নসের কারণে স্যুটিন শিল্পী হিসেবে সফলতা পেয়েছিলেন। ব্যক্তি হিসেবে যথেষ্ট ধনী হয়ে উঠলেও মননে ছিলেন আপাদমস্তক একজন হতদরিদ্র শিল্পী। যার শিল্প এবং দৈহিক ক্ষুধা কোনোদিন নিবৃত্ত হয় নি। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় নাৎসী বাহিনী ফ্রান্স দখল করলে স্যুটিন আত্মগোপনে চলে যান। বিশিষ্ট ইহুদী শিল্পী হিসেবে গেস্টাপো পুলিশ তাঁকে খুঁজছিলো। গোপনে গ্যাস্ট্রিক আলসারের চিকিৎসা নেবার সময় ১৯৪৩ সালে মারা গেলেন স্যুটিন। ড. বার্নস যখন প্রথম হাইম স্যুটিন’কে ফিলাডেলফিয়া আর্ট সার্কেলে পরিচিত করালেন তখন আর্ট বোদ্ধারা কেউ সহজভাবে নেয় নি এ ফরাসী অভিবাসী শিল্পীকে। তুমুল সমালোচনার পাশাপাশি ড. বার্নসকেও একহাত নিয়েছিলো শিল্পী সমাজ। ‘আর্ট নিউজ’ পত্রিকায় স্যুটিন সম্পর্কে শিল্প সমালোচক এডওয়ার্ড লংস্ট্রেথ লিখেছিলেন, গ্লোরিফায়েি দ্য আগলি। এতে ড. বার্নস অত্যন্ত ক্ষুব্ধ হয়েছিলেন। যতদিন বেঁচে ছিলেন তাঁর বিশাল সংগ্রহের রেনোয়া, সেজান, ভ্যান গখ, মাতিস, মদিগলিয়ানি, পিকাসো এবং স্যুটিন সহ অন্যান্য আধুনিক শিল্পীদের কাজগুলো বাইরের কাউকে দেখতে দেন নি। ড. বার্নস বিশ্বাস করতেন, সমকালীন বোদ্ধাদের কারো আধুনিক শিল্পকলা বোঝার ক্ষমতা নেই। এমনকি নোবেল জয়ী টি এস এলিয়ট’কেও তিনি তাঁর সংগ্রহশালায় ঢোকার অনুমতি দেন নি। কেবলমাত্র চারুকলার ছাত্রদের সুযোগ ছিল অনুমতি নিয়ে ড. বার্নসের সুবিশাল সংগ্রহ দেখার।
বলা বাহুল্য, যখন প্রচ- অর্থকষ্টে স্যুটিন ছবি এঁকে জীবন কাটাচ্ছিলেন সেই সময় ১৯২২ সালে ড. বার্নস প্যারিস এসেছিলেন ইম্প্রেশনিস্টদের ছবি কিনতে। হঠাৎ তাঁর চোখে পড়ে স্যুটিনের একটি কাজ। এরপর শিল্পীর ৫২টি ক্যানভাস একসাথে কিনে রাতারাতি তাঁর ভাগ্য বদলে দেন এবং শিল্পী হিসেবে প্রতিষ্ঠা পেতে সাহায্য করেন। বার্নস মিউজিয়াম ছাড়াও স্যুটিনের উল্লেখযোগ্য কাজ দেখেছি মিনিয়াপোলিস, ডেট্রয়েট মিউজিয়াম, কিভল্যান্ড আর্ট মিউজিয়াম এবং নিউ ইয়র্কের মেট্রোপলিটন মিউজিয়াম অব আর্ট গ্যালারীতে। শিল্পী স্যুটিন বেলারুশ থেকে ভাগ্যের সন্ধানে এবং শিল্পী হিসেবে প্রতিষ্ঠিত হতে প্যারিসে পা রেখেছিলেন ১৯১৩ সালে। দারিদ্র্যের কারণে ইচ্ছে থাকলেও মাংস খেতে পারতেন না। কসাইখানায় গিয়ে ঝুলে থাকা গরুর মাংস দেখে দেখে আঁকতেন। মরা মুরগীর ছবিও এঁকে সেই ছবি বিক্রির চেষ্টা করতেন। কেউ খুব একটা কিনতে আগ্রহ দেখাতো না। গরীবী বিষয়ের ছবি বলে কথা! তখন অবশ্য পিকাসো-মাতিসের ছবির কদর বেশী। অনেক পরে মার্কিন আর্ট ডিলার ড. বার্নসের সুবাদে স্যুটিন রাতারাতি পরিচিত হয়ে ওঠেন। ছবি বিক্রি শুরু হলো, অর্থাভাব কাটতে থাকলো। কিন্তু ততদিনে পেপটিক আলসার বাঁধিয়ে ফেলেছেন। ইচ্ছে করলেও মাংস-কাবাব খেতে পারেন না। পেট ব্যথা করে। অগত্যা আবার শুরু করলেন জবাই করা আস্ত গরুর মাংসের ছবি আঁকা।
নগদ অর্থে সদ্য জবাই করা গরুর মাংস কিনে আনলেন। স্টুডিওতে ঝুলিয়ে সামনে বসে আঁকলেন। যেহেতু খেতে পারছিলেন না, স্টুডিওতেই পচতে থাকলো মাংস। দুর্গন্ধ ছড়ালো। প্রতিবেশীরা আপত্তি জানালেও তাঁর ভ্রূক্ষেপ নেই। স্যুটিন এতেই খুশী। পেট না ভরলেও মন ভরছে। ছবি আঁকার জন্য এর চেয়ে ভালো অনুপ্রেরণা আর কী হতে পারে?