হামিদ ফারাজ, কেন্দ্রীয় মহিলা হাসপাতাল প্রধান। ফোন উঠিয়েই তিনি শুনতে পান, ‘সা’উদ আল-ধাহাব এর স্ত্রী হাসপাতালে আসছেন।’ খবরটা শোনার পরপরই ফারাজ চলমান শিফটের দায়িত্বে থাকা শীর্ষস্থানীয় ডাক্তারকে নিজ কক্ষে ডেকে পাঠান। এবং সে এসে ভেতরে ঢোকার পর, তার সামনে শান্ত থাকার ভান করে বলেন, ‘আজ খুব গুরুত্বপূর্ণ কেউ একজন এখানে আসছেন। বিশ্বস্ত সূত্রে জেনেছি, তিনি খুব ভালো বা মূল্যবান কেউ হবেন।’ তার বলার ভঙ্গি ছিল বেশ গম্ভীর ধরনের। কপালের ভাজ আর জমাট চাহনি তারই প্রতিফলন। হঠাৎ ধূমপানও একথাই প্রকাশ করে। কেননা ইদানীং এই বাজে অভ্যেসটা তিনি ত্যাগ করেছেন। আর এরই মধ্যে ফলাও করে স্থানীয় সব খবরের কাগজকে জানিয়ে দিয়েছেন যে তিনি ধূমপান বিরোধী কমেটিতে যোগ দিয়েছেন। যদিও, এই মুহূর্তে এরকম কোনো কথাই তার মনে নেই।
‘বিশ্বস্ত সূত্রে জেনেছি,’ এর মানে কী? কথাটার ব্যাখ্যা শোনার জন্য ডাক্তার তার সামনে চুপচাপ বসে রইলেন। গোলমেলে একটা ভাবধরে বসে থাকাতে আর সাংঘাতিক চাপের মধ্যে আত্মসংবরণ করতে পারঙ্গম, ফারাজ সাহেব বললেন, ‘ডাক্তার নাওয়াল, আপনি খুব ভালো করেই জানেন এই পরিদর্শন আমাদের এই হাসপাতালের জন্য কতটা ঐতিহাসিক আর গুরুত্বপূর্ণ!’
কথাটা কেবল ওই মুহূর্তের ঘোলাটে ভাবটুকুকে আরো ঝাপসা করে তুলল। ডাক্তার নাওয়াল জিজ্ঞেস করলেন, ‘কে আসছেন পরিদর্শনে, জনাব হামিদ?’
‘সা’উদ আল-ধাহাব এর স্ত্রী!’
‘কিন্তু এই হাসপাতালে তিনি কেন আসছেন?’
‘অন্য মহিলাদের মতোই সন্তান জন্মদিতে।’
এবার ডাক্তার নাওয়ালের কাছে সবকিছু একদম দিনের মতো ফর্সা মনে হল, ‘ঠিক আছে, তাকে আসতে দিন। আমরা আমাদের যার যার দায়িত্ব পালন করবো। স্বাভাবিকভাবে যেমনটা করে থাকি।’
ফারাজ সাহেব বললেন, ‘কেবল এতেই হবে না!’
‘ব্যক্তিগত একটা কামরা ভালোকরে গুছিয়ে রাখবো।’
‘তাতেও হবে না।’
‘ঠিক আছে, তিনি ঢোকার সময় সদর দরজায় দাঁড়িয়ে থেকে সবাই মিলে তাকে ফুলেল শুভেচ্ছা জানাবো।’ এর সঙ্গে আরো জোর গলায় সেই ডাক্তার মহিলা যোগ করলেন, ‘যা তিনি আগে কখনও দেখননি।’
তার দিকে তাকিয়ে এবার তিনি জবাবে বললেন, ‘আর তারপরে কী করবেন? এতসব করেও পার পাওয়া যাবে না।’
তাহলে এবার আপনিই বলেদিন এরপর আর কী কী করতে হবে আমাদের?’
এবার তিনি শান্তভাবে ফোনের রিসিভার তুলেন। তারপর এক এক করে হাসপাতালের সবগুলো বিভাগকে, খুব সংক্ষিপ্ত আর স্পস্ট আদেশ জানিয়ে দেন। এবার তিনি খুবই ব্যস্ত ভঙ্গিতে আরেকটা সিগারেট ধরান। যদিও প্রথম সিগারেটটা টেবিলের ওপর রাখা তার অপর হাতের আঙুলের ফাঁকে এখনও জ্বলছে। এবার ডাক্তার নাওয়েল তাকে মনে করিয়ে দেন, বিগত তিন বছর যাবত তিনি ধূমপান বিরোধী কমেটির প্রধান হিসেবে দায়িত্ব পালন করে আসছেন। একথা শুনে বিচলিত ফারাজ সাহেব সজোরে রিসিভার রেখেদেন। তারপর উঠে দাঁড়ান এবং পায়চারি করতে করতে দৃঢ় কণ্ঠে আদেশের সুরে বলেন, ‘খবরদার! অপারেটিং রুম ছেড়ে অন্য কোথাও যাবেন না।’
অনতি বিলম্বে মহিলা হাসপাতালে জরুরি অবস্থা ঘোষণা করা হলো। হাসপাতালটিকে তখন যুদ্ধকালীন সামরিক ব্যারাক বলে মনে হচ্ছিল। নার্সরা বিছানার চাদর, বালিশের কভার আর কাঁথা-কম্বল, খাবার দাবার এবং বিপাকে পড়া রোগীদের নিয়ে এদিক সেদিক ছোটাছুটি শুরু করে দিল। এতে করে করিডোরে একে অন্যের গায়ে ধাক্কা লাগছিল। অস্থির এক শোরগোল বাতাসে ভেসে বেড়াতে থাকে। চারদিকে জুতার হিলের ঠক্-ঠক্ প্রতিধ্বনি। আরো অনেক নার্স তাদের সঙ্গে কাজে যোগদিতে এলে, বিস্ময় প্রকাশ করে জানতে চায়, ‘আরে এসব কী হচ্ছে এখানে?’
সবাই সদাশান্ত, কারো মুখে রা-শব্দটি পর্যন্ত নেই। তাই এর কোনো সহজ উত্তর পাওয়া তাদের পক্ষে খুবই কঠিন। ফারাজ সাহেব সেই ঝড়ের মাঝে দাঁড়িয়ে আছেন। অবিকল ডুবন্ত কোনো জাহাজের ক্যাপ্টেনের মতন— ক্রুদের আদেশ নির্দেশ দিয়ে যিনি সশরীরে তার কর্মীদের কাজকারবার তদারকি করছেন।
পুবের বাগানের দিককার ব্যক্তিগত কামরাতে গত দু’দিন যাবত অন্য রোগী অবস্থান করছে। ব্যপারটা আবিষ্কার করার পর তিনি আতঙ্কিত বোধ করেন। হতাশায় তিনি চেঁচিয়ে উঠলেন, ‘এই অবস্থা দেখলে তাৎক্ষণাৎ তিনি এই কামরা ছাড়বেন!’
নার্সদের প্রধান জবাবে বলে, ‘কিন্তু অন্য সবগুলো কামরাতেও তো রোগী আছে।’
‘জাহান্নামে যাক সব! জাহান্নমে যাক! ঘরগুলো এখনই খালি করে দিতে হবে!’
‘কিন্তু সার্জারি কক্ষ এখনও ঝকঝকে তকতকে। ওটা তো খালিই পড়ে আছে...’
‘তাহলে ওগুলোর কোনো একটা ওয়ার্ডে তাকে তোলার ব্যবস্থা করো।’
‘এখনই সেই ব্যবস্থা করছি, স্যার। এতেই চলবে?’
এই প্রথম বারের মতো ফারাজ সাহেবকে কিছুটা নিরুদ্বেগ দেখাল। ‘এটা হলো শুধু শুরুর ছবি।’
এবং এরপর তিনি দীর্ঘ করিডোর ধরে বিদ্যুৎ গতিতে নার্স, টেকনিশিয়ান আর ডাক্তারদের ভিড় ঠেলে অপারেশন কক্ষের দিকে ছুটলেন। বছর খানের আগে নিজ অন্ত্রে তিন তিনটি অপারেশনের ব্যথা ভুলে, নতুন উদ্যমে তিনি শক্তিমান কর্মচঞ্চল একজন ব্যক্তিতে রূপান্তরিত হলেন। মাত্র কয়েক সেকেন্ডের মধ্যে তিনি সার্জারি কক্ষে হাজির হলেন। সেখানে এক তরুণী ডাক্তার তাকে অভ্যর্থনা জানাল। ‘সব কিছু ঝকঝকে তকতকে, সাজানো গোছানো।’
‘তুমি এর পুরোটা সময় ডাক্তার নাওয়েলকে সাহায্য করবে।’
‘আপনার বলার আগে থেকেই এই কাজটা আমি শুরু করে দিয়েছি, স্যার।’
‘আর ডেলিভারির পর প্রতি ঘণ্টায় তুমি ওঁনার স্বাস্থ্যের দিকে খেয়াল রাখবে।’
‘তাহলে তো, চার নম্বর বিভাগের দায়িত্ব থেকে আমাকে অব্যাহতি নিতে হবে।’
‘তোমাকে কী করতে হবে সেটা আমি দেখছি। তুমি এখানকার হেড নার্স, রোজকে গিয়ে বলো, যাতে ধাপে ধাপে আমাকে বাচ্চাটার রিপোর্টগুলো দেখিয়ে নেয়।’
‘ঠিক আছে, স্যার— আর কিছু কি করতে হবে?’
‘সেটা পরে জানতে পারবে।’
কথাটা বলেই ফারাজ সাহেব একটা হুইল চেয়ার ঠেলতে ঠেলতে সদর দরজার দিকে এগিয়ে গেলেন। আগ্রহী দর্শক, কয়েক জন নার্স আর ডাক্তার নাওয়েল তার পিছু নিলেন। গেটের কাছে নীল রঙের একটা মার্সিডিজ বেঞ্জ আসতেই সবাই বাইরের দিকে ফিরে দু’টি সারিতে দাঁড়িয়ে পড়ল। নার্সরা ওষুধপত্র, চাদর আর ধূপ-ধূনা হাতে নিলো। মি. হামিদ ফরাজ এগিয়ে গিয়ে নিজেই ওই গাড়ির দরজা খুললেন। তার পেছনেই হুইল চেয়ারটা লাগোয়াভাবে রাখা ছিল। গাড়ি থেকে মধ্য বয়েসি একজন মহিলা নেমে এলেন। তার জড়সড় অবস্থা দেখে স্পস্ট বোঝা যাচ্ছিল গর্ভাবস্থার একেবারে চূড়ান্ত পর্যায়ে রয়েছেন তিনি। অতি সাবধানে তাকে হুইল চেয়ারে বসান হলো। এর পরপরই সবাই একে একে হাত থেকে হাতে শোভাযাত্রা আকারে তা ঠেলে নিয়ে চলল। এতে আল-ধাহাবের বউ আবার পড়ে যায় কি-না, তাতে মেঝেতেই শিশুটার জন্ম হয় কি-না, এই ভেবে ফারাজ সাহেব খুবই ভীত হয়ে পড়লেন। আর তাতে করে তাকে দেখে তখন মনে হচ্ছিল, তার নিজেরই বুঝি বাচ্চা জন্ম দেবার ব্যথা উঠেছে। এরকম কিছু একটা ঘটলে এই হাসপাতালের সবার কপালে কী-যে দুর্ভাগ্য নেমে আসবে! ফারাজ সাহেব হুইল চেয়ারটাকে এত দ্রুত গতিতে ছুটতে দেখে হতবিহ্বল হয়ে পড়লেন। তাই তিনি চেঁচাতে শুরু করে দিলেন, ‘সাবধানে! খুউব সাবধানে! আরো স্বচ্ছন্দে, তবে তাড়া করে এগোও!’
ওই মার্সিডিজ গাড়ির ড্রাইভার, রশিদ ‘আসকার নিজেও, এতটা উত্তেজিত ছিলো না। গেটে এসে, এতসব দেখে লোকটা একেবারে হতভম্ব হয়ে যায়। আর তারপর লোকজনের মিছিলের সঙ্গে তাল রেখে দ্রুত ছুটতে গিয়ে কখন যে নিজের স্যান্ডেল জোড়া বগলে চালান করে দিয়েছে তা সে একেবারে টেরই পায়নি। এসব দেখে প্রচ- এক ধাঁধার মধ্যে পড়ল সে। তার মনে হলো কোনো এক অজানা কারণে, হাসপাতালের এই লোকগুলো তার বউকে নির্ঘাত কিডন্যাপ করতে চলেছে।
শোভাযাত্রাটা থামলো বেশ বড় একটা ডেলিভারি রুমের সামনে এসে। তবে এত লোক ওটাতে আঁটবেনা। আর সবার ওর ভেতরে প্রবেশের অনুমতিও নেই। নার্সরা তাই দরজার বাইরে ছোট ছোট দলে ভাগ হয়ে দাঁড়িয়ে রইল। ফারাজ সাহেব তাদের ইশারায় ডাকলেন।
এবার তিনি রশিদ ‘আসকারের দিকে তাকালেন। সে-ও তাৎক্ষণাৎ প্রশ্ন ছুড়ে দেবার জন্য উন্মুখ হয়ে ছিলো। যদিও তার স্ত্রীকে নিয়ে শুরু হওয়া শোভাযাত্রাটা সঠিক একটা জায়গাতে এসে শেষ হওয়াতে তার মনে খুবই শান্তি বিরাজ করছিল। কিছু একটা বলতে যাবে কিন্তু মুখটা তার হা হয়েই রইল। কেননা তাকে সেই অবস্থায় থামিয়ে দিয়ে ফারাজ সাহেব বলে উঠলেন, ‘সবকিছু ঠিকঠাক আছে। আর ঠিকঠাক মতোই সবকিছু হবে বলে আশা করছি।’
‘আসকার তোতলাতে তোতলাতে বলল, ‘এ ব্যাপারে আমি একেবারে পুরোপুরি নিশ্চিত।’
ফারাজ সাহেব এর সঙ্গে যোগ করলেন, ‘আমি শুধু এটুকুই চাইছি যে আমাদের যত্ন আপনাদের কাছে গ্রহণযোগ্যতা পাবে।’
‘আমরা যে এই মুহূর্তে আপনাদের ধন্যবাদ দিতেও অক্ষম।’
এবার হামিদ ফারাজ সাহেবের মুখে অনেকক্ষণ পর এক চিলতে হাসি ফুটল। তিনি উচ্ছ্বসিত বোধ করলেন: মেঝেতে থাকা পা জোড়া হালকা মনে হলো। এমন সময় হঠাৎ-ই ডেলিভারি রুমের দরজা খুলে গেল এবং একজন নার্স লম্বা একটা বিছানা ঠেলতে ঠেলতে বিজয়ীর হাসি হেসে সগর্বে দ্রুত বেরিয়ে এলো।
ফরাজ সাহেবকে উদ্দেশ্য করে প্রথমেই সে ঘোষণা করল, ‘ছেলে হয়েছে! ছেলে!’
ফারাজ সাহেব যেদিকটায় ‘আসকার দাঁড়িয়ে ছিলো সেই দিকে ফিরে বলতে লাগলেন, ‘অভিনন্দন! অভিনন্দন আপনাকে! আপনার ছেলে হয়েছে!’
বয়স্ক একজন নার্স আনন্দে আত্মহারা হয়ে গেয়ে উঠল। সবার মুখে হাসি। তারপর মিছিল সহকারে সবাই আল-ধাহাবের বউয়ের ব্যক্তিগত কামরা গোছগাছ করবার জন্য ভেতরে প্রবেশ করল। আর বিশেষজ্ঞের মতো সবাই মিলে তড়িৎ ওই ঘরের তেলাপোকাসহ যাবতীয় পোকামাকড় মেরে সাফ করে ফেলল। এমন ঘটনা এই হাসপাতালে আগে কখনও ঘটতে দেখা যায়নি। তাদের অনুসরণ করে মাঝ বয়সী চলনে রাশিদ ‘আসকার কিছু দূর এগিয়ে এসে দাঁড়িয়ে রইল। তার বউকে ঘিরে তখন উচ্চপদস্থ সব ডাক্তার, নার্স, সেকশন হেড আর টেকনিশিয়ান। তাদের কারো হাতে কাগজপত্র, ব্লাড প্রেশার মাপার যন্ত্রপাতি, আর কারো হাতে রিপোর্টের স্তূপ। ‘আসকার ওই দলটাকে বলল, ‘আপনারা এত যত্ন সহকারে কাজ করেন, নিজ চোখে না দেখলে কখনই এটা আমার বিশ্বাস হতো না।’
হামিদ ফারাজ বললেন, ‘আমাদের সীমাবদ্ধতার জন্য দুঃখিত।’ অনেকক্ষণ থেমে তিনি বললেন, ‘গভর্নর সাহেব কখন তাকে দেখতে আসছেন?’
তাৎক্ষণাৎ লোকটা তাদের বিস্ময়কর ওই অভ্যর্থনার কারণ আন্দাজ করতে পারলো। আর তখন এই কথাগুলো, আকাশে ওড়া অচেনা অনাহুত পাখির মতো তার গায়ে এসে আছড়ে পড়ছে বলে মনে হতে লাগল। এই মুহূর্তে তার জন্য যে বিস্ময় অপেক্ষা করছিল তা সে একেবারেই ভুলে গেলো এবং মনে মনে সবকিছুর একটা ব্যাখ্যা দাঁড় করাতে লাগলো। কিন্তু হামিদ ফারাজের কথায় তার সেই ভাবনায় ছেদ পড়ল, ‘গভর্নর সাহেব যদি সাধারণ একজন দর্শনার্থী হিসেবে এখানে আসতে না চান তাহলে আমরা তাঁর জন্য প্রয়োজনে সব ধরনের সতর্কতা মূলক ব্যবস্থা গ্রহণ করবো।’
রাশিদ ‘আসকার হতবিহবল হয়ে ফারাজ সাহেবকে বললেন, ‘কাকে আপনি গভর্নর বলছেন, সদ্য ভূমিষ্ঠ ওই শিশুটাকে?’
কথাটা বলেই দৃষ্টি ফিরিয়ে ‘আসকার তার বউয়ের দিকে তাকালো। আর তারপর সে ফারাজ সাহেবকে আরোকিছু প্রশ্ন জিজ্ঞেস করার জন্য মুখ খুলতে যাবে। ঠিক এমন সময়, বারান্দার শেষ প্রান্ত থেকে আসা একটা চিৎকার শুনে সে একেবারে চুপটি মেরে গেলো। ওখান থেকে হাঁপাতে থাকা একটা লোক সজোরে জিহ্বা কাঁপিয়ে ঘোষণা করছে, ‘সাউদ আল-ধাহাবের বউ মাত্রই হাসপাতালে এলেন!’ কথাটা বলেই লোকটা ওই দিকে ছুটতে শুরু করল। হামিদ ফারাজ সাহেব আবারও ছুটতে শুরু করলেন। চরম পরিশ্রান্ত হবার পরও তিনি দৌড়াতে লাগলেন। শুধু তিনিই নন, পুরো হাসপাতালটাই আবার দৌড়াতে শুরু করে দিল। সব দিক থেকে, উচ্চপদস্থেরা সবাই। করিডোর, ঘরদোর, বারান্দা, মেইন গেটের ওপাশের সড়ক, ডেলিভারি রুম, গোসলখানা, এবং ওয়ার্ড জুড়ে আবারও সেই আগের মতোই দৌড়ঝাঁপ শুরু হয়ে গেল। তবে একটা লোকই শুধু স্থির বসে রইল। আর সে হলো রাশিদ ‘আসকার। অর্থলগ্নি কোম্পানির এই মাইনে খাটা ড্রাইভার তার বিশেষ ধরনের দায়িত্বের কারণে চাকুরী জীবনে আজই প্রথম বারের মতো, নিজের এমন একটা জরুরি কাজে মার্সিডিজ বেঞ্জ ব্যবহারের সুযোগ পেয়েছিল। কী এক ঘোর লাগা অবস্থায় সে তার বউকে বলল, ‘জানো বউ, আসলে মার্সিডিজ বেঞ্জ একটা হিরো!’
হাসপাতালের কর্মীর ঝাঁক সদর দরজায় ভিড় করতে গেলে পরে; একাকী সেই মুহূর্ত টুকুতে তারা স্বামী-স্ত্রী একে ওপরকে নিবিড়ভাবে জড়িয়ে রইল, ওরা ফিরে এসে ঘরটা খালি করতে বলার আগ পর্যন্ত।
(সালওয়া জেবশেহ ও নাওমি শিহাব নাঈ’র ইংরেজি অনুবাদ অবলম্বনে)
মুহাম্মাদ ‘আব্দ আল-মালিক (জন্ম ১৯৪৪)
বাহারাইনের ছোটগল্পকার ও ঔপন্যাসিক মুহাম্মাদ ‘আব্দ আল-মালিক। তাঁর লেখাতে গুরুতর নিপীড়িত জনের পক্ষে গভীর সচেতনতা প্রকাশ পেয়েছে। মানুষে মানুষে শোষণ আর নির্যাতনের বিভিন্ন ঘাত-প্রতিঘাত এবং বঞ্চিত মানুষের অসহায়ত্বের সব ধরনের ছবি তাঁর বর্ণনায় ঠাঁই পেয়েছে। এসবের পাশাপাশি তাঁর লেখাতে যথেষ্ট হাস্য রসাত্মক উপাদানেরও খোঁজ মেলে। আর এভাবেই তিনি তাঁর অনন্য বর্ণনার ঢঙে বিভিন্ন সামাজিক পরিস্থিতি আর ঘটনা গল্পসমূহে তুলে ধরেছেন। এ গল্পটিতেও আমরা এরকমই কিছু একটা দেখতে পাবো। অপ্রয়োজনীয় বিরক্তিকর বর্ণনা এবং অনাবশ্যক বিবৃতি খুব দক্ষতার সঙ্গে এড়িয়ে, মনে দাগ কাটতে সক্ষম এমন যথাযথ প্রাণবন্ত আবেগী আঙ্গিক ধরে রেখে তিনি সাহিত্য রচনা করেছেন। তার প্রথম গল্প সংগ্রহ ‘দ্য ডেথ আব কার্ট ওনার’ ১৯৭২ এ প্রকাশিত হয়। তাঁর দ্বিতীয় গল্পগ্রন্থ ‘উই লাভ দ্য সান’ প্রকাশিত হয় ১৯৭৫ এ। তাঁর প্রকাশিত অন্যান্য গ্রন্থের মাঝে ‘দ্য ফ্রান্স’(১৯৮২), ‘দ্য রিভার ফোস’র নাম বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য। ১৯৮০তে তাঁর গবেষণাধর্মী উপন্যাস ‘জিজওয়া’ প্রকাশিত হয়।