হাত দুটোকে অলসভাবে ছেড়ে দেয় মুনাব্বর। এতক্ষণ দম বন্ধ করে
দাঁড়িয়েছিল; এবার আর পারছে না। ভেঙ্গে পড়তে চাইছে ওর শরীর। খাটে বসে
পড়ে সে। দেওয়ালে হেলান দিয়ে হা করে নিঃশ্বাস নেয়। পায়ের নীচে ঘাম ঝরে
ভিজে গেছে ফোর। গামছাটাকে দুহাতে জড়িয়ে ও ভাবতে থাকে, এখন ? এখন
সে কি করবে ?
ছেলেমেয়ে দুটিকে এভাবে মুক্তি দিয়ে দিল। ওর আত্মহত্যার পর এরা দুটিতে
আত্মীয়স্বজনের দ্বারে দ্বারে পথে পথে ঘুরে বেড়াবে একথা ভাবতেও
মুনাব্বরের শরীরের রক্ত উথালপাথাল করে ওঠত। কল্পনাতেও সে এ দৃশ্য
সহ্য করতে পারত না। কিন্তু কি করবে সে ! কোনভাবেই একটি মানসম্মত
কাজ জুটাতে পারল না। সেই যে করোনার দমকে ব্যবসা মন্দা বলে তার চাকরি
চলে গেল এরপর পাঁচটি বছর প্রায় বেকার বসে আছে। আবাসন নির্মাণ
কোম্পানীগুলোতে ধর্ণা দিতে দিতে বুঝে গেছিল, ওর বয়েস পঞ্চাশ পেরিয়ে
গেছে। অভিজ্ঞতাও অনেক। তাই বেশি বেতন দিয়ে কোন কোম্পানি ওকে
চাকরি দিতে চাইছে না। চাকরি আক্রার এই বাজারে একজনের বেতনে দুজন
তরুণ ইঞ্জিনীয়ার রাখতে পারলে তারা কেন বয়স্ক মুনাব্বরকে নেবে !
মুনাব্বর জেনেছে, বেসরকারি ব্যাংকগুলোতে এরম নিয়ম আছে। স্বেচ্ছায়
চাকরি ছাড়ার ব্যবস্থা করে দিয়েছে। কিন্তু ব্যাংকারদের কথা আলাদা।
তাদের পেন্সন, গ্রাচ্যুইটি, ভাতাফাতা মিলে অনেক রকম আর্থিক সহায়তা
থাকে। এইসব ভুঁইফোড় হঠাত নাম করে ফেলা আবাসন নির্মাণ
কোম্পানীগুলোতে এসব কিছুই নেই। এরা তো এলোগেলো মায়াবনবিহারিণী
কোম্পানী। কয়েকজন বন্ধু মিলে কিম্বা ভাইবোন আত্মীয়রা নিজেদের পুঁজি
খাটিয়ে স্বল্প সময়ে ধনী হয়ে যাওয়ার জন্য কোম্পানী খুলে বসে। কয়েক
বছর পর এরা হাওয়ায় মিলিয়ে যায়।
এরমধ্যে ওর যা কিছু সঞ্চয় ছিল সেগুলোও গেছে। বছর কয়েক আগে জমি
কেনার জন্য রতন নামের একজনকে কয়েক লক্ষ জমানো টাকা দিয়েছিল।
জমি ত জমি। সেই টাকা মেরে দিয়েছে রতন। বহু ধরাধরির পর সালিশির
মাধ্যমে মাসে পাঁচ হাজার করে টাকা দিত রতন। পাঁচ মাস ধরে সেই টাকাও
বন্ধ করে দিয়েছে। কিছুতেই রতনের নাগাল পাওয়া যাচ্ছে না। সালিশির
লোকজনও কে কোথায় ছড়িয়ে ছিটিয়ে গেছে। দিনরাত ছাত্র পড়িয়ে স্ত্রী
সংসারটাকে ধরে রেখেছে। তবে কূল কিনারাহীন সংসার সমুদ্রে প্রতিদিন পাল
ছেঁড়ার শব্দ শুনতে পাচ্ছে মুনাব্বর। কিছু ত করা দরকার। কিন্তু কি করবে সে
!
তিন তিনটে মাস অনেক ভেবেছে। অনেক বার। অনেক ভাবে। স্ত্রী দিশার সাথে
আগে কথা হত। এখন আর সেভাবে হয়না। দিশা বুঝে গেছে, মুনাব্বর শেষ।
একবার শুধু বলেছিল, এতসব না ভেবে তুমি যে একজন ইঞ্জিনিয়ার এটা ভুলে
যাও। দেখো, কোথাও যদি হিসাব লেখারও কাজ পাও, নিয়ে নাও।
মুনাব্বর দিশার কথাটিকে মানতে পারেনি। হোক সে ডিপ্লোমা ইঞ্জিনিয়ার।
ইঞ্জিনিয়ার ত ! আগারগাঁওএর বিশাল ব্যস্ত উড়ালপুলে দাঁড়িয়ে বিপুল
কর্মব্যস্ত জন¯্রােতের দিকে তাকিয়ে সেদিন মুনাব্বরের মনে হয়েছিল, সে
কি একদম ফিনিস হয়ে গেছে ? একেবারেই মূল্যহীন ছোবড়া ইঞ্জিনীয়ার সে
? উড়ালপুলে বসা অস্থায়ী সব্জীওয়ালার সাথে সেদিন প্রায় চল্লিশ মিনিট
তর্কবিতর্ক করে আধাকেজি পটল আর এক কেজি পেঁপে কিনে ফাউ কয়েকটি
কাঁচামরিচ আদায় করে মুনাব্বর ভেবেছিল, নাহ্, সে ত এখনও পারে। তার দম
আছে। একদম ফিট সে। এবার ফিউচার আবাসনের এমডিকে সিওর বুঝাতে
পারবে, এই কোম্পানির জন্য সে কতখানি উপযুক্ত এবং গুরুত্বপূর্ণ।
অথচ তিন দিন অপেক্ষা করেও এমডি স্যারের দেখা পায়নি। এমডি স্যার ওর
সাথে দেখাই করল না !
ভোরে বেশী করে রুটি, সব্জী সাথে দুপুরের জন্য ডিম বা মাছের ঝোল বানিয়ে
কাজ এগিয়ে রাখে দিশা। দুটি জোয়ান ছেলেমেয়ে আর মুনাব্বর খাওয়ার পরেও
হটপটে কয়েকটি রুটি বাড়তি থাকে। বাসায় থাকলে এগোরোটার দিকে
মুনাব্বর অনেক সময় ধরে অনেকক্ষণ খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে সেই রুটিগুলো দেখে
তারপর চা দিয়ে খেয়ে নেয়। চা সে নিজেই বানিয়ে খায়। দিশাকেও যতœ করে
দিয়ে যায়। মায়া লাগে দিশার। মাঝে মাঝে দুধ সেমাই করে রাখে। পরোটা দিয়ে
ঠান্ডা দুধ সেমাই খেতে খুব পছন্দ করে মুনাব্বর। এগারোটা সাড়ে
এগারোটায় শিক্ষার্থীরা চলে গেলে দুপুর তিনটা পর্যন্ত ফ্রি থাকে দিশা।
আগে সকাল সকাল বেরিয়ে যেত মুনাব্বর। আজকাল ঘরেই থাকে বেশিটা
সময়। এটা সেটা ঘরোয়া কাজ করে। দু রুমের ছোট্ট ঘরে তেমন কাজই বা কি !
ইদানীং রান্না শিখেছে। টুকটাক রান্নাও করে রাখে। রাতে ছাত্র পড়িয়ে দিশা
যখন হাতমুখ ধুয়ে খেতে বসে মুনাব্বর জুলজুল চোখে চেয়ে থাকে। মনে মনে
খুশি হয় দিশা। মন ভালো থাকলে হয়ত বলে, রান্না ভালো হয়েছে। কোনদিন
হয়ত বলে, তুমি ত একবার পলাশবাড়ী ঘুরে আসতে পার ! বড়আপা সিদল আর
কি কি যেন দিতে চেয়েছে। ঘরে বানানো জিনিস কতদিন খাইনা। সবাই মিলে যে
যাব---- ছুটিছাটাও ত নাই ---
মুনাব্বর জানে ছুটিছাটার চাইতে সবাই মিলে যাওয়া আসা থাকা খাওয়ার
বিশাল খরচ ওরা মেটাতে পারবে না। অনেকবার ভেবেছে, ও একাই ঘুরে আসবে
পলাশবাড়ি; কিন্তু ওর আর যাওয়া হয়ে ওঠে না। কতবার কল্পনা করেছে,
এবার বাড়ি গেলে বড়আপার সাথে মাঠের কচুশাক তুলে আনবে। গাঠিকচু খেতে
ওর খুব ভালো লাগে। আর গুঠুং গুঠুং করে প্যালকা রান্নার সেই শব্দ ! মেঘ
গুড়গুড় শেষে ধারা বৃষ্টিতে বাড়ির পাশের পুকুর থেকে কানকো বেয়ে উঠে
আসা কই মাছ খুঁজে আনা ছিল ওদের দুভাইবোনের প্রিয় কাজ। বড়আপা
শিউলিপাতার বড়া বানিয়ে রাখত ওর জন্য। কখনও কাঁচা সর্ষে তেল দিয়ে
সরিষাফুলের ভর্ত্তা। খুব বেশি টাকাপয়সা ছিল না ওদের। কিন্তু থাকার
জায়গা ছিল। ম্নান টিনের ঘরে কয়েকটা বড় বড় রুম ছিল। হাত পা ছড়িয়ে
সস্তা চৌকিতে আরাম করে ঘুমানো যেত। ছিল শীত গ্রীষ্মের অস্থায়ী
রান্নাঘর। এখন বড়আপাও খুব অভাবে আছে। ছেলেরা বেশিদূর লেখাপড়া
করতে পারেনি। যে যার মতো সরে গেছে সংসার নিয়ে। বড়আপা ঘর আগলে
বসে থাকে। করমচা পেড়ে শুকিয়ে রাখে, পাটপাতা, আলু, কচুডগা, কাঁচা
ধুনেপাতা, রামধুনে পাতা রোদ্দুরে শুকিয়ে পাঠিয়ে দেয় দুই ছেলের সংসারে।
একটু ত সাহায্য হয়। নিজে কি খায় কে জানে ! মুনাব্বর ভাবে, ওর পড়াশুনার
খরচ দিতে হবে বলে আব্বা তাড়াতাড়ি বড়আপার বিয়ে দিয়ে দিয়েছিল। একই
পাড়া। ঘর চেনা আত্মীয়স্বজনও চেনাজানা। খুব খারাপ ছিল না কেউ। হেকমত
ভাই ছিলেন রংরসিয়া মানুষ। বাড়িতে মাঝে মাঝে গানের আসর হত।
রঙ্গরসের গম্ভীরা গেয়ে বাড়ির নারীপুরুষ শিশুদের মাতিয়ে রাখত জামাই
শ্বশুর। সেই সব দিনগুলোতে জামাইয়ের সাথে আব্বাও কেমন রঙ্গিন মানুষ
হয়ে যেত। মায়াবতী এই বড়আপার জন্য সে কিছু করতে পারছে না।
একতলা বাড়ির জানালা দিয়ে পাশের বাড়ির গেটে সবসময় জ্বালিয়ে রাখা
কমজোরি বাল্বের মিনমিনে আলো দেখতে দেখতে মুনাব্বর ভাবে, আহা সে
কেন বড় হতে গেল। কেন এই কঠিন শহরের নির্মম চিপায় এসে এত্ত বড়
শরীরটাকে গুটিয়ে খাটের এক কোণে নয়ত এক চিলতে ফোরে খাটের নীচে পা
ঢুকিয়ে ঘুমাতে হচ্ছে। ছেলেটা তরুণ হয়ে গেছে। হাত পা ছড়িয়ে সে বেচারাও
ঘুমাতে পারে না। মানুষ কেন যে বড় হয়ে যায় ! সে যাবে,। শীঘ্রই বাড়ি যাবে।
প্যান্টের কোমর ঢিলা হয়ে যাচ্ছে। হাড় জেগে উঠছে শরীরের। আজকাল সে
শক্ত করে বেল্ট বাঁধে। অথচ কি আশ্চর্য ! দিশার শরীর মহিষের বাথানের
মতো চওড়া হয়ে ফুলে উঠছে। নিয়মিত ভালো খাবারদাবার নাই কিন্তু মাংস
জমছে দিশার পেটে, পিঠে, চিবুকে, স্তনে। চরম অসূয়ার বশে দিশার শরীরে
কাম তাপহীন হিংসুক হাতের শক্ত চাপ দিয়ে মুনাব্বর ভাবে, দিশা কি লুকিয়ে
লুকিয়ে ভালো কিছু খায় ? হয়ত খায়। ওদেরকে লুকিয়েই খায়। সকাল সাতটায়
যে ছাত্রকে দিশা পড়াতে যায় তারা নাস্তা দেয় বলে শুনেছে। কি দেয় ? ডিম,
মাংস, দুধ, ঘি চুবচুবে পরোটা, কাবাব, বিরিয়ানী, তেহারি, কেক, পেস্ট্রি !
একদিন কায়দা করে জানতে চেয়েছিল। দিশা অতি সাধারণভাবেই বলেছিল,
অই চা রুটি ভাজি ডিম। কোনদিন পাউরুটি চা ডিম। কেন গো ?
মুনাব্বর দিশার কান্ত মুখ দেখে তাড়াতাড়ি কথা ঘুরিয়ে নিয়েছিল। অই
ছাত্রের বাসা থেকে মাঝে মাঝে বিরিয়ানির প্যাকেট দেয় দিশাকে। তাহলে ?
নাস্তায় বিরিয়ানিও দেয়। আলবৎ দেয়। ছাত্রের বাবা একটি মন্ত্রণালয়ের
মাঝারি মাপের কেরানি। দপ্দপিয়ে পয়সা কামাচ্ছে। অফিসের অনুষ্ঠানে এক
প্যাকেট বিরিয়ানির বদলে পাঁচ প্যাকেট সরিয়ে ফেলা হল এদের প্রথম কাজ।
এ ধরণের ট্যাক্টিস মুনাব্বর ভালোই জানে। এগুলো ত দিনের আলোতেই হয়।
আর এদিকে ওরা সারা বছর সস্তার প্রোটিন খায়। ডিম কষা আর তেলাপিয়া
মাছের ঝোল, তেলাপিয়া কষা আর ডিমআলুর ঝোল। মুনাব্বরের চোখে রাগ
জমে ওঠে। আগে দিশা আর বাচ্চাদুটোকে নিয়ে সে কতবার হাজির বিরিয়ানি
খেয়েছে ! একবার ত ফ্যামিলি ট্যুরে সাফারি পার্কেও ঘুরে এসেছে। দুইবার
কক্সবাজার নিয়ে গেছে। দিশার কি মনে পড়ে না সেই সব দিনের কথা !
নামাজ শেষ করে বসে থাকে দিশা। আজ মঙ্গলবার। সাতটার বাচ্চাটাকে
পড়িয়ে আসার সাথে সাথে সাড়ে আটটায় চারজন স্টুডেন্ট চলে আসবে পড়তে।
একঘন্টার বেশি পড়ায় না দিশা। দশটায় আরেকটা ব্যাচ। এরা সবাই এই
পাড়ার ডে শিফটের শিক্ষার্থী। এরমধ্যে তার ছেলে আর মেয়ে ইশকুল কলেজে
বেরিয়ে যাবে। কপালে তসবি ছুঁইয়ে দিশা ভাবে আর বড় জোর তিনটে বছর।
মেয়ে কলেজে উঠলেই সেলসগার্ল হিসেবে কাজ পেয়ে যাবে পাড়ার বুটিকসে।
যদিও বেতন কম। সময় বেশী দিতে হবে। তা হোক; ওর ভেতরেই পড়াশুনা
চালিয়ে যেতে পারবে মেয়ে। পড়বে তো আর্টসে। ছেলেটিও মাথায় মুনাব্বরের
মতো হয়ে গেছে। দেখতে অনেকটাই একরকম লাগে। গেল কাল বিকেলে ইফতার
খেতে খেতে দিশাকে ভরসা দিয়ে বলেছে, আম্মু এইত এইচএসসি হয়ে গেলেই
কাজে ঢুকে যাব। টেনশন করো না।
দিশা এখন আর টেনশন করে না। কেবল ব্যাগের চিপায় থাকা টাকাগুলো গুণে
যায়, এ মাসটা চালাতে পারবে ত ! রতন নামের লোকটা মনে হয় আর টাকা
দেবে না। মুনাব্বরকে দিশেহারা দেখাচ্ছে। আল্লাহ মালিক। দুই রাকাত বেশি
নামাজ পড়ে চোখের জলে ভেসে দীর্ঘ মোনাজাত করে। মোনাজাত শেষ করে
সারাদিনের কাজগুলো ভেবে নেয় সে। আজ সকালের ব্যাচদুটো তাড়াতাড়ি ছেড়ে
দেবে। নতুন একটি কাজ পেয়েছে সে। দুপুর বারোটা থেকে সন্ধ্যা ছয়টা
পর্যন্ত একজন বিপতœীক বৃদ্ধকে দেখাশুনা করতে হবে। অনেক টাকা দেবে
এরা। বৃদ্ধের ছেলেমেয়েরা উন্নত দেশগুলোতে থাকে। মা মারা যাওয়ার পর
নিজেরা বাবার সেবা করতে পারছে না বলে দুজন সেবা সাহায্যকারী রেখেছে।
এই কাজটি নিলে বিকেলের ছাত্রটিকে ছেড়ে দিতে হবে। রাতের যমজ
ছাত্রদুটিকে নিয়ে সমস্যা নেই। কাজ ফাইন্যাল হলে আজকেই মুনাব্বর আর
ছেলেমেয়েদের সে সুখবরটি জানাবে।
মেয়েটাকে আরেকবার দেখে আসে মুনাব্বর। মনে হচ্ছে, যেন বই পড়তে পড়তে
ঘুমিয়ে পড়েছে। কাছে গেলে হয়ত গলায় এঁটে বসা গামছার দাগ দেখা যাবে। এ
ঘরে ফিরে মাথার নীচে বালিশ দিয়ে ছেলেটাকে লম্বা করে শুইয়ে দেয়। ঘাড়
ভেঙ্গে গেছে বলে ছেলেটার মাথা ঢলঢল করছে। দিশার ফিরতে এখনও দেরি
আছে। মঙ্গলবার কি একটি জরুরী কাজ আছে বলে দুদিন আগে জানিয়েছিল।
এমনিতেই ঘরে ফিরতে ইফতার টাইম পেরিয়ে যায় আজকাল। রোজা রমজানের
দিনে অবুঝ যমজ দুটি ভাই কিছুতেই ছাড়তে চায় না তাদের প্রিয় মিস্কে।
ওদের বাবামাও অনুরোধ করে। দিশা থেকে যায় বলে মাঝেমধ্যে ওদের মাকে
সাহায্য টাহায্যও করে।
ঘরের মেইন দরোজা ভালো করে আটকে দেয় মুনাব্বর। চায়ের সাথে ঘুমের
ওষুধ মিশিয়ে দিয়েছিল বলে মেয়েটা হয়ত কিছুই বুঝতে পারেনি। ছেলেটি
একবার চোখ মেলে তাকিয়েছিল। ঘাড়টা ভেঙ্গে দিয়েছে মুনাব্বর। তার
ব্যর্থতার ভোগান্তি কিছুতেই ভুগতে দেবে না ছেলেমেয়ে দুটিকে। এদের জন্ম
সে দিয়েছে। সে-ই জন্মের মতো শেষ করে দিলো এদের জীবন।
সন্ধ্যা হয়ে আসছে। মুনাব্বর দেখে আখিরা-মাচ্চা নদীতে দৌলত মাঝির খেয়া
নৌকায় বাঁধা হারিক্যানের মতো টিমটিম করে জ্বলছে পাশের বাড়ির আলোটা।
পলাশবাড়ির ঘ্রাণ ভেসে আসছে। পুরনো টিনের ঘর, সুতানটি আমের গাছ,
হেকমতভাইয়ের কবরে গজিয়ে ওঠা তেলাকুচার ঝাড়, পাকা তেলাকুচা খাচ্ছে
ঘুঘু, চড়ুই, ময়না। খেয়াঘাটের আকাশে ছায়া ছায়া হয়ে ভাসছে আব্বা মার
দেহচ্ছবি। ফ্যানের সঙ্গে ওড়নাটাকে বেঁধে শক্ত ফাঁদ তৈরি করে নিয়েছে সে।
একজন ইঞ্জিনিয়ারের মাপজোক ভুল হলে চলবে নাকো। চেয়ারটা টেনে ফাঁদে
গলা দিয়ে প্রাক্টিক্যালি মেপে নিয়েছে। শুধু ঝুলে পড়ার সাথে সাথে ঝাটকা
মেরে চেয়ারটাকে পায়ের নাগালের বাইরে ফেলে দিতে হবে। মরার সময়
খড়কুটো পেলে মানুষ আঁকড়ে ধরে বাঁচতে চায়।
মুনাব্বর বাঁচতে চায় না। এভাবে কি বাঁচা যায় !