একটি নদীর নামে ফিকশন। তাও গদ্যের ঠকোমকোযুক্ত নাম। উপন্যাসের লেখক সম্মন্ধে যিনি ধারণা রাখেন না তার কাছে একটি গ্রন্থের নাম কী অর্থ বহন করে? নদী সংক্রান্ত কোনো গবেষণাকর্ম কি এটি? নাকি সাধারণ ইতিহাস, যাতে মিলবে নদীতীরবর্তী জনপদের নৃতাত্ত্বিক উপাদান? পাঠককে দোষ দেয়া যাবে না। এমনটাই পাঠকের সনাতন চিন্তাপ্রবাহ। একই লেখকের দার্শনিকের নামে নাম দ্বিতীয় উপন্যাস সম্পর্কে প্রাথমিক মনোভঙ্গিও ছিল অনুরূপ।
কিন্তু লেখকের আগের লেখালেখি সম্পর্কে সামান্যটুকুও পরিচয় না থাকা পাঠক মলাট উল্টে প্রথম পাতার প্রথম কয়েকটি লাইন পড়তে শুরু করলে ভেতরে ভেতরে বিলক্ষণ বুঝবেন, এ ধরনের গদ্যশৈলী তার কাছে নতুন, কিন্তু মনোযোগ সরতে দিচ্ছে না, গল্পও কেমন একটা রহস্য ধরে আছে। এটি তাহলে ইতিহাস বা পাঠ্যপুস্তক নয়, একটি নভেলই। প্রথম স্তবকটি উদ্ধৃত করা যাক।
‘সন্ধ্যা দ্রুত পায়ে এই শহরের প্রান্তসীমার গ্রাম-গ্রাম এলাকাটাতে নামছে আর তেরো বছরের বাচ্চা ছেলে জাহেদের ততই বেশি করে মনে হচ্ছে যে আজ রাতের নৌকায় বাবার সঙ্গে আড়িয়াল খাঁ নদীতে যাবার ব্যাপারে এ বাড়ির লোকগুলোকে রাজি করানোর সময়টুকু তার কমে আসছে, কমেই আসছে। ‘রাতের নৌকা’, শব্দ দুটো নিয়ে ভাবল সে। তার মনে হলো ব্যাপারটার মধ্যে কেমন এক শান্ত ও কম্পনশূন্য কী যেন আছে, আজ সারাদিন ধরে গড়িয়ে চলে রাতে পৌঁছানো দিনের মধ্যেও তা আছে কেমন অচাঞ্চল্য, স্থিরতা। অন্যদিকে সন্ধ্যা? সন্ধ্যার মধ্যে সবসময়েই এক থরথরানি, এক ডানা ঝাপটানি, এক দ্রুততা। দ্যাখো না পাখিগুলো কেমন তখন ছটফট ছুটে যায় ঘন-গাঢ় জঙ্গলের দিকে?...’
এইটুকু পড়েই পাঠক দেখতে পাচ্ছেন সন্ধ্যা নিয়ে যে-কথাগুলো বলা হলো তা কবিতার মতোই ঘোর তৈরি করছে এবং চিন্তাজগতকে আন্দোলিত করছে। তেরো, মানে জীবনের এক আশ্চর্য সংবেদনময় বয়সটিতে পৌঁছনো এক বালক নাকি কিশোরের দেখা পৃথিবী: অবশ্যই সীমাবদ্ধ ভূখ-ের, চেনা জানা এবং আগন্তুক কিছু মানুষকে ঘিরে ঘটনাপ্রবাহের শ্বাসরুদ্ধকর, উৎকণ্ঠাময় ঘনঘটার ভেতরে তড়পড়ানো এক অভাবিত সময়ের!
উপন্যাসের পাঠকেরা উপন্যাসে প্রথমত জমজমাট কাহিনী চান। মস্তিষ্কে ধারণ করে একজন লেখক টেবিলে বসে গল্প বানান, বা তৈরি করেন; কিন্তু পাঠক বানোয়াট কাহিনী পছন্দ করেন না। শুধুমাত্র পাঠেরই যে একটি আনন্দ থাকে, সেটি সেভাবে আলোচিত হয় না, বিশ্লেষণও করা হয় না। অথচ পাঠকের জন্যেই তৈরি হয় লেখা। পাঠক নতুন উপন্যাস হাতে নিয়ে নতুন গল্প পড়তে চান, নতুনভাবে বলা গল্প পড়তে চান। কেউ তাকে দিব্যি না দিলে, বাধ্য না করলে, তিনি আপন আনন্দ লাভের জন্যেই উপন্যাস পড়েন, তাই পছন্দ না হলে ছেড়ে দেন, আর উপন্যাসমুখো হন না। বই পড়ার নেশায়, বা পাঠের আনন্দে যিনি উপন্যাস পড়েন, তিনি পড়ে প-িত হতে চান না। কিন্তু নতুন কিছু জানা গেলে শিখতে পারলে তিনি মোহিত হন, মনে রাখেন লেখকের নাম। কাহিনীর অভিনবত্ব তাকে পাঠে মনোযোগী রাখে, সন্দেহ নেই; কিন্তু কীভাবে বলা হচ্ছে কাহিনীটা, কিভাবে কাহিনীর বাঁকবদল হচ্ছে, এবং চরিত্রগুলোর আচরণে ধারাবাহিকতা, অকৃত্রিমতা রয়েছে কিনা- এসব অসচেতনভাবে হলেও খেয়াল করেন। এইসব মিলিয়েই পাঠকের কাছে, পঞ্চাশ-একশটা উপন্যাস পড়েছেন এমন পাঠকের কাছে, নতুন আরও একটি উপন্যাস গুরুত্বপূর্ণ কিংবা সাধারণ মানের হয়ে ওঠে।
বোদ্ধা পাঠক এবং সমালোচকদের কথা আলাদা। তারা কিছুটা খুঁত-সন্ধানী হন, লেখককে নিজের প্রতিভাস্তর থেকে নিচের ভাবতে ভালোবাসেন এবং অসন্তুষ্ট থাকার পণ করেই কপট বিরক্তি নিয়ে বই পড়ে যান। এতে শুরুতেই তার আনন্দ লাভের ক্ষেত্রে বৈরী পরিবেশ তৈরি হয়ে যায় বলেই আমার মত। এটিই আমাদের এখানে চলতি প্রবণতা। ভালো বলতে কার্পণ্য করি, মন্দকথনেই আমরা উদার। নতুন লেখকদের জন্যে আমাদের যদি কোনো বিস্ময় তৈরি হয়ও, সেটি চাপা দিয়ে বরং সন্দিগ্ধতা প্রকাশে অটল থাকি। সামান্য দুর্বলতাকে বড় করে তুলি।
মাসরুর আরেফিন এক অর্থে নতুন লেখকই, মানে নতুন কথাসাহিত্যিক। মাত্র চার বছর হলো আমার তাঁর উপন্যাস দেখতে পাচ্ছি। তাঁর লেখা নিয়ে আলোচনার চাইতে তার বিরুদ্ধে চালু করা কিছু বিষয় এবং অন্য আরও কিছু বিষয় নিয়ে বেশি কথাবার্তা হতে দেখি। তাঁর চারখানা বইয়ের একটিও যদি কেউ আগাগোড়া পাঠ করেন, এবং শত্রুতা করবেন এমন ইস্পাতদৃঢ় প্রতিজ্ঞা না করে সেটি নিয়ে কথা বলতে বসেন, তবে নতুন পাঠকরা এই লেখকের লেখার প্রতি আকৃষ্ট হবেন- এমনটাই আমার পর্যবেক্ষণ। সে যাই হোক, তাঁকে নিয়ে নেতিবাচক আলোচনা ঢের হলেও এসবই শেষ পর্যন্ত দেশব্যাপী সাধারণ্যে তার একটি পরিচিতি এনে দিয়েছে। আর ঘটনাচক্রে কেউ যদি একবার তার যে কোনো একটি উপন্যাস পড়েই ফেলেন, তাহলে সেসব নেতিবাচক প্রচারণা ভোজবাজির মতোই হাওয়া হয়ে যায়।
মাসরুরের চতুর্থ উপন্যাসটি নিয়ে কিছু বলার আগে এ কথাগুলো আমার আঙুলে আপনা থেকেই এলো, কম্পিউটারে লেখার সুবাদে এক সেকেন্ডেই এসব মুছে ফেলা সম্ভব, তবু মুছছি না। থাকুক আমার স্বতঃস্ফূর্ত কথাগুলো। স্বীকার করি, আমি আড়িয়াল খাঁ উপন্যাসটি নিয়ে একটু দ্বিধান্বিতই ছিলাম। সমকাল ঈদসংখ্যায় এর অংশবিশেষ পড়ার পরে আমার ভেতরে যে প্রতিক্রিয়াগুলো তৈরি হয় তার ভেতর দুটি ছিল এমন:
১. মাসরুর এই প্রথম গ্রামীণ ও মফস্বলের পটভূমিতে লিখছেন। তার আগের তিনটি উপন্যাসের প্রেক্ষাপট থেকে এটি সম্পূর্ণত আলাদা। প্রথমটিতে (আগস্ট আবছায়া) দেশের অবিসংবাদিত নেতাকে সপরিবারে হত্যার নৃশংসতম ঘটনাটি ‘মিনিট বাই মিনিট’ বর্ণিত হয়েছে। এখানে ইতিহাসের সঙ্গে কল্পনার একটি অভূতপূর্ব মিশ্রণ আমরা প্রত্যক্ষ করেছি এবং আঙ্গিকগত বিচারেও তাতে লক্ষ্য করা গেছে দারুণ অভিনবত্ব। যদি এ লেখাটিকে আলাদা করে সরিয়ে রাখি, তাহলে বাকি দুটি উপন্যাসে (আলথুসার ও আন্ডারগ্রাউন্ড) আমরা দেশের সমান্তরালে বৈশ্বিক প্রেক্ষাপটও দেখেছি, তাতে এটাও আমরা দেখেছি যে মাসরুরের বিপুল পঠনপাঠনের প্রাসঙ্গিক সারাৎসার খানিকটা করে এসেছে; আরও এসেছে বিশ^সাহিত্য ও দর্শনের কয়েকজন মনীষীর প্রসঙ্গ এবং সৃষ্টিকর্মের উল্লেখ বা ব্যাখ্যা। যা পাঠককে পাঠে আলাদা স্বাদ দিয়েছে, সন্দেহ নেই। কিন্তু আড়িয়াল খাঁ-য় এসবের অনুপস্থিতি ঘটবে বলেই মনে হচ্ছিল। তাই এটি লেখকের জন্যে একটি বাঁকবদল। সেটি তিনি কয়েক মাসের ভেতর ( যদি ঈদ-পরবর্তী একুশের বইমেলায় নতুন উপন্যাসটির প্রকাশ বিষয়ে সিদ্ধান্ত নেন) কিভাবে মানোত্তীর্ণরূপে হ্যান্ডেল করতে পারবেন, সেটি ছিল দুশ্চিন্তার বিষয়।
২. কাহিনীতে ঘটনার ঘনঘটা যতোই থাকুক, তাতে হাস্যরস, উৎকণ্ঠা, চমক এবং গতি বহাল থাকুক, ভাষা যদি সাদামাটা হয়ে যায় তবে চতুর্থ উপন্যাসে এসে তাঁর নিজস্ব পাঠকেরা হোঁচট খাবেন এবং লেখকের অবনমন ঘটবে। ধপ্পাশ করে মাটিতে না পড়লেও এক ধরনের নিম্নমুখিতা চলে আসবে। যা দারুণভাবে এগিয়ে চলা একজন লেখকের জন্য ভালো ফল এনে দেবে না। খসড়া উপন্যাসটিতে কোথাও যেন আমি বাক্যে ও বয়ানে সাহিত্যগুণসম্পন্নতার ঘাটতি দেখছিলাম। প্রধান কয়েকটি চরিত্রের ভেতরেও সহজাত ও স্বয়ংসম্পূর্ণ হওয়ার ক্ষেত্রে অভাব লক্ষ্য করছিলাম।
কিন্তু আড়িয়াল খাঁ ছাপাখানায় যাওয়ার দুদিন আগে আমার কাছে যে পা-ুলিপিটি এলো এবং দ্রুততম সময়ের মধ্যে সেটি পড়ে ওঠার কথা ভাবলাম, তখনই পড়তে পড়তে আমার দুর্ভাবনার মেঘ সরে যেতে লাগলো। যে বুদ্ধিদীপ্ততা ও দার্শনিকতা মাসরুরের আগের তিনটি পা-ুলিপি পাঠের সময়ে আমি পেয়েছি, আড়িয়াল খাঁ-য়েও আমি তেমনটিই পেলাম। যদি আলাদাভাবে কিছু বলতে হয় তাহলে বলবো, চরিত্র সৃষ্টিতে চরিত্রের মুখনিঃসৃত উচ্চারণে এবং তার আচরণের প্রকাশের ক্ষেত্রে লেখক এবার কোনোরকম সেন্সরে যাচ্ছেন না, তিনি আরো তীব্র, ক্ষীপ্র ও প্রত্যক্ষ হয়েছেন; কিন্তু তার ভাষায় শব্দব্যবহারে ও তুলনা-উপমা দেয়ার ক্ষেত্রে সেই চেনা লেখককেই পাওয়া যাচ্ছে। আমার এমনও মনে হচ্ছিলো এর কোনো পৃষ্ঠা থেকে আমি যদি কোনো লাইন বাদ দিতে চাই তাহলে সেটি তার অঙ্গহানিই ঘটাবে। আমি কখনোই ভুলি না যে, কোন এবসার্ড আনপ্রেডিক্টেবল সমাজে আমরা বসবাস করছি। এখানে সামান্য স্খলন বা ত্রুটির জন্য মোল্লারা দেশছাড়া করার পরিবেশ তৈরি করতে পারে। যে সরকারই ক্ষমতাবলয়ে থাকুক না কেন, খুব সূক্ষ্ম বিচারে না গেলেও মোটা দাগে বলা কোনো বাক্যের জন্যে গ্রন্থ নিষিদ্ধও হতে পারে। তাই সম্পাদকের দৃষ্টিকোণ থেকে যখন কোনো পা-ুলিপি পড়ে থাকি, লেখককে সতর্ক করে দেয়া কর্তব্যজ্ঞান করি। আর মাসরুরের সঙ্গে আমার যা সম্পর্ক তাতে গ্রন্থ প্রকাশের পর সম্ভাব্য সঙ্কট/ সমস্যা/ জটিলতা থেকে মুক্ত থাকার জন্য কিছুটা জোরাজুরিও করার অধিকার রাখি।
যাহোক, দশ বছর আগে পড়া একটি উপন্যাস কেন পাঠক মনে রাখে? তার একটি কিংবা দুটি চরিত্রের অতিসাধারণ নয় এমন ব্যতিক্রমী উপস্থিতির কারণে এবং অতিঅবশ্যই লেখনীশৈলী গুণে। যে চরিত্রগুলো বাস্তব জীবনের কোনো বলিষ্ঠ চারিত্রিক বৈশিষ্ট্যসম্পন্ন উজ্জ্বল চরিত্রের প্রতিদ্বন্দ্বী হয়ে উঠতে পারে। আমরা প্রত্যেকেই নিজের নিজের জীবনে একটি করে চরিত্র। উপন্যাসের চরিত্র আমার বা অন্য কারো মতো হবেন, বা না হবেন, সে বিচারের চেয়েও বড় যে উপন্যাসের চরিত্র বা চরিত্রগুলো হয়ে উঠবে তার জীবনের প্রবহমান ক্যানভাসে দাঁড়িয়ে বিশ্বাসযোগ্য এবং অবশ্যই চরিত্রের বৈশিষ্ট্যগুণেই পাঠকের হৃদয়াসনে গ্রহণযোগ্য। আন্না কারেনিনা বা রাসকিলনভ ভিন্ন ভাষার দুটি চিরায়ত উপন্যাসের দুটি প্রধান চরিত্র হলেও আমরা পাঠের পর তাদেরকে আমাদের জীবদ্দশারই বাস্তব কোনো চরিত্র হিসেবেই বিবেচনা করি এবং তাদের জন্য আমাদের মনে গভীর মমতা তৈরি হয়। মাসরুরের আড়িয়াল খাঁ-য়ের কেন্দ্রীয় চরিত্র বালক বা কিশোর জাহেদ তো আছেই সবার ওপরে। কিন্তু দুটি চরিত্র আমরা কখনোই কি ভুলতে পারব? বলছি পারভিন ও মালেক হুজুরের কথা।
নারী পুরুষের সমঅধিকারের বিষয়টি গুরুত্বপূর্ণ। কিন্তু সমাজে পদে পদে রয়েছে বৈষম্য। আমি পিতার সম্পত্তির একভাগ পেলে আমার বোন পাবেন অর্ধেক। আমি যে বাড়িতে বেড়ে উঠছি বিয়ের পরও সে বাড়িতে আমি থাকতে পারবো, এ নিয়ে কোনো কথা নেই, কিন্তু আমার বোনকে চলে যেতে হবে ভিন্ন বাড়ি। এটি প্রথা বা নিয়ম। নানা প্রথা ও নিয়ম একটি মেয়ের মনোজগতে বৈষম্য-ব্যথার অনপনেয় দাগ বসাতে থাকে। সেখানে কোনো মেয়ের মধ্যে সত্যিকারের সমঅধিকারের বোধ, মুক্তচিন্তা ও ব্যক্তিস্বাধীতার উপাদান লক্ষ্য করি তবে আমরা চমকিত হই কিংবা বিব্রতবোধ করি। পারভিন চরিত্রটি তেমনই এক অসাধারণ সৃষ্টি। পুরুষের কটুক্তি, বা টিজ, নারীকে ভোগের সামগ্রী হিসেবে দেখার পুরুষতান্ত্রিক দৃষ্টিভঙ্গিকে তীব্রতম ভাষায় নগ্ন করে দেয়ার এক দ্রোহী চরিত্র হলো পারভিন। আবার জীবন উপভোগ-সম্ভোগের বেলায়ও চিরায়ত বাঙালি নারী নয়, পারভিনের মানুষসুলভ মানসিকতার প্রকাশ বাংলা উপন্যাসে নতুন হাওয়া এনে দেবার মতোই।
লেখক নিজেই উপন্যাসটি বেরুনোর পর পারভিন সম্পর্কে খানিকটা খোলাসা করে লিখেছেন: ‘আড়িয়াল খাঁ‘ আমার চতুর্থ উপন্যাস, আমার একদম অন্য মেজাজের এক লেখা। আর এতে ১৯৮০-র এমন এক বাংলাদেশের, এমন এক ঘন-বুনো-জংলী-সান্দ্র বাংলাদেশের গল্প আছে যে, যারা সেই মানুষ-গাছ-পাখি-পশু-নক্ষত্র-হাওয়া একসঙ্গে মিশে থাকা অবাক হলুদ ও অবাক নীলের সম্মিলনের আশ্চর্য শ্যামল-সবুজ বাংলাকে দেখেননি, যাদের জন্ম হয়েেছ ধরা যাক তার পরে, তারা সেই বিস্ময়-বাংলাকে এ উপন্যাসে দেখবেন আর ভাববেন- হুম, বোঝা গেল, এটা তাহলে ‘পারভিন‘ নামের এক নক্ষত্রম-লীর গল্প, এই পৃথিবীর নয়। যেমন, নায়ক জাহেদের সুন্দরী বড় বোন পারভিনকে জাহেদের এনায়েত স্যার বলছেন, ‘ধরো পারভিন, তোমার নামটাই ধরো। কতো প্রোডাকটিভ একটা নাম সেটা। পারভিনের অর্থ জানো? সাত-বোন তারাম-লী- ৪৪৪ আলোকবর্ষ দূরে আছে পৃথিবীর সবচাইতে কাছের যে-নক্ষত্রম-ল, তার নাম পারভিন। রাতের আকাশে আমাদের পৃথিবী থেকে স্পষ্ট খালি চোখে ওই পারভিনকেই শুধু দেখা যায়। বি-টাইপ নক্ষত্র ওরা, টরাস তারাম-লীর উত্তর-পশ্চিমে থাকে।...বুঝলে কিছু গালে-টোল-ফেলা মেয়ে, বুঝলে কিছু তুমি?’
মালেক হুজুর চরিত্রটি, আমার মতে, পাঠক-মনে অভিঘাত সৃষ্টির বিবেচনায় পারভিন চরিত্রের সফলতম প্রতিদ্বন্দ্বী হবে। কিশোর জাহেদের ভেতরে অদৃশ্য সত্য অবলোকনের অন্তর্দৃষ্টি ও কবিধর্মী-প্রতিভা আমরা দেখি প্রত্যক্ষরূপে; আর এই মালেক হুজুরের ভেতরও এই দুই বৈশিষ্ট্য রয়েছে, তবে আপাত পরোক্ষরূপে। মালেক হুজুরের রহস্যময় বয়ান পাঠককে একটানে জীবনের অজ্ঞাত মোহনায় নিয়ে যায়। এক জায়গায় তিনি বলছেন: ‘কালাবদর, নয়া ভাঙ্গানি, বিঘাই, কেত্তনখোলা, সব আইস্যা জাহেদ চাইপ্যা ধরছে আড়িয়াল খাঁরে। আমি দোয়া-দুরুদের হিসাব মিলাইয়া দেখছি যে, সেই আড়িয়াল খাঁ-তে তুমি সেই জিনিস পাইবা, যা আমি তোমারে বলি তা তুমি পাইবা- যুদি খালি সাহস করো, যুদি খালি রাইতের বেলায় যাও, আর তোমার লগে যুদি থাহে এই তাবিজ।‘
জাহেদের চরিত্রচিত্রণে লেখকের শক্তিমত্তার বিচিত্র স্ফূরণ প্রত্যক্ষ করা যায়। বালকবয়সের সহজাত স্বতঃস্ফূর্ত অবলোকন ও প্রতিক্রিয়া কতো বিচিত্রগামী হতে পারে, আর তাতে যথাযথ অনুভবের একটি ছায়াপাতও ঘটে থাকে, তার মেধাময় প্রকাশ দেখবো আমরা আড়িয়াল খাঁয়। বালকের মনোজগৎ খুঁড়ে দেখেছেন লেখক একজন মনোবিদের মতোই। বলতে প্রলুব্ধ হচ্ছি বহুকাল পর বাংলা কথাসাহিত্যে এমন একটি বালক-চরিত্র পাওয়া গেল যা আগেকার সমস্ত বালক-চরিত্র থেকে আশ্চর্যজনকভাবে আলাদা, তার ভাবনাভুবন ও চিন্তার ধরন অভিনব, সত্যোচ্চারণে যার শব্দের সঙ্গে মিশে থাকে শপাং শপাং চাবুক।
এ উপন্যাসে যৌনতার প্রকাশ (স্বাভাবিক-প্রাকৃতিক, উদগ্র কামনা-বাসনা এবং পাশবিক সমকামিতা) নিয়ে নিশ্চয়ই বহু কথা হবে। কেননা এই প্রসঙ্গটিকে এড়িয়ে আড়িয়াল খাঁয়ের আলোচনা অসম্ভব। তাই দুটি বাক্যে বলা যাক, শরীর উন্মোচন ও যৌনতা উপভোগ একান্ত দুজনার বিষয়, যদিও তাতে দেখবার দৃষ্টিভঙ্গিতে থাকতে পারে পৃথকত্ব। যৌনচাহিদা মোচনের জন্য দুর্বলের ওপর সবলের বলপ্রয়োগ কতোখানি বীভৎস হতে পারে, যে সেই গ্লানি ও ক্ষোভ থেকে মুক্তির জন্য নিষ্পিষ্টজনের কতোটা ভয়ঙ্কর হয়ে ওঠা সম্ভব, তার রোমহর্ষক বিবরণ এতে আছে। জীবন্তভাবেই আছে। কিন্তু এর কোনোটিকেই পাঠকের কাছে অসম্ভব কিংবা অবাস্তব মনে হবে না। তবু তা যেন অসম্ভবপ্রায় ফিকশন-ফিকশন সত্য। শিল্পময়তার এই জাদুতুল্য উপস্থাপন পাঠকের হৃদয়ে স্থায়ী দাগ এঁকে দেয়ার মতোই।
মাসরুর আরেফিন বাংলাদেশের জন্য বড় আন্তর্জাতিক পুরস্কার বয়ে আনবেন, এমন একটা কথা মনে-মনে বলে আসছি দু’বছর হলো, প্রকাশ্যে সম্ভবত এই প্রথম বলছি। মাসরুর পঞ্চাশ পেরুলেন দুব’ছর হলো। স্বাধীন বাংলাদেশও সদ্য পঞ্চাশ পেরুলো। হয়তো আজ থেকে আরও পঞ্চাশ বছর পরে কোনো এক ভিনদেশি কিংবা বাঙালি গবেষক আড়িয়াল খাঁ-র জাহেদের মধ্যে স্বয়ং মাসরুর আরেফিনের কৈশোরকেই আবিস্কার করে উঠবেন, কে জানে!