করোনাকাল
বিচ্ছিন্ন অনুভব
মাহফুজা হিলালী

প্রবন্ধ
অধ্যাপক আনিসুজ্জামান
শামসুজ্জামান খান

গল্প
ডায়মন্ড লেডি ও পাথর মানব
হামিদ কায়সার

গদ্য
নিদ্রা হরণ করেছিল যে বই
মিনার মনসুর

নিবন্ধ
পঞ্চকবির আসর
সায়কা শর্মিন

বিশ্বসাহিত্য
আইজাক আসিমভের সায়েন্স ফিকশন
অনুবাদ: সোহরাব সুমন

বিশেষ রচনা
প্রথম মহাকাব্যনায়ক গিলগামেশ
কামাল রাহমান

শ্রদ্ধাঞ্জলি
মুজিব জন্মশতবর্ষ
মারুফ রায়হান
 
সাক্ষাৎকার
কথাশিল্পী শওকত আলী

জীবনকথা
রাকীব হাসান

ভ্রমণ
ইম্ফলের দিনরাত্রি
হামিদ কায়সার

ইশতিয়াক আলম
শার্লক হোমস মিউজিয়াম

নিউইর্কের দিনলিপি
আহমাদ মাযহার

শিল্পকলা
রঙের সংগীত, মোমোর মাতিস
ইফতেখারুল ইসলাম

বইমেলার কড়চা
কামরুল হাসান

নাজিম হিকমাতের কবিতা
ভাবানুবাদ: খন্দকার ওমর আনোয়ার

উপন্যাস
আলথুসার
মাসরুর আরেফিন

এবং
কবিতা: করেনাদিনের চরণ

১৭ বর্ষ ০৩ সংখ্যা
অক্টোবর ২০২৪

লেখক-সংবাদ :





আমার প্রথম বই
শাহাদুজ্জামান
সে এক সময় ছিলো যখন থাকতাম মেডিকেলের অস্থি মাংসের জগতে কিন্তু মন পড়ে থাকতো আইডিয়ার পৃথিবীতে।  এনাটমি, ফিজিওলজির বইয়ের নিচে থাকতো দস্তয়েভস্কি, মার্কেজ, কুন্ডেরা । দু পাতা প্যাথলজির বই পড়লে পাঁচ পাতা পড়তাম জীবনানন্দ। মেডিকেল চত্বরে গোলাগুলি, সামরিক শাসন, হরতাল। এরই ভেতর অন্ধকারে গান, ‘ও আলোর পথযাত্রী, এ যে রাত্রি, এখানে থেমো না।’ রুদ্ধশ্বাসে ভিসিআরের বোতাম টিপে সত্যজিৎ, মৃণাল, ঋত্বিক, গদার, ত্রুফো করতে করতে ভোর। চট্টগ্রামের  ষোল শহর স্টেশনে মাঝরাতে স্তব্ধ দাঁড়িয়ে থাকা লাল মালগাড়ির বগিকে প্রশ্ন, ‘এই জীবন লইয়া কি করিব, এ জীবন লইয়া কি করিতে হয়?’ কখন, কিভাবে হাত গলিয়ে বেরিয়ে পড়ে অক্ষর। লিখতে শুরু করি। লিখলে ভার কমে। অনুবাদ করি, নানা তাত্ত্বিক বিষয়ে। প্রবন্ধ লিখি সমাজ, রাজনীতির পাকচক্র নিয়ে।  গ্রন্থকেন্দ্রিক, নাগরিক এক জীবন কাটাই তখন।  নিজেরা ছোট কাগজ করি। অনুবাদ, প্রবন্ধ সেখানেই ছাপাই।
তারপর একদিন নানা চড়াই উৎড়াই পেরিয়ে মেডিকেলের সার্টিফিকেট নিয়ে মানুষিক সৈনিক সেজে মুখোমুখি দাঁড়াই জীবনের। কাজের সূত্রে ঢুকে যাই বাংলাদেশের পেটের ভেতর। উন্নয়ন সংস্থার গ্রামীণ স্বাস্থ্য প্রকল্পের ডাক্তার হিসেবে ঘুরে বেড়াই দেশের গ্রাম থেকে গ্রামান্তরে। মূলত নগরেই বেড়ে ওঠা মানুষ আমি গ্রামকে দেখেছি দূর থেকে। গ্রামে গিয়ে মানুষের মুখের নতুন ভাঁজ দেখি, যা দেখিনি আগে। তত্ত্ব আর অক্ষরের ভেতর দিয়ে জীবনকে দেখছিলাম এতদিন। গ্রামে গিয়ে প্রকৃতির বিস্ময় আর জীবনের জঙ্গমতা দেখতে দেখতে খসে পড়তে থাকে তত্ত্বের গেড়ো। বুদবুদের মতো জন্ম নিতে থাকে গল্প। ভেতরের গল্প, বাইরের গল্প।  গল্প লিখতে শুরু করি। গল্প যে গ্রাম নিয়ে তা ঠিক নয়, হয়তো শহর নিয়েই, শহরের মানুষ নিয়েই।  কিন্তু  ইতিমধ্যে শহরের উল্টোপিঠ দেখে নিয়েছি,  ফলে  শহরকে দেখি  নতুন করে । গল্পের কলকব্জা ভালো মতো বুঝতে সাহস করে ইতিমধ্যে সাক্ষাৎকার নিয়ে ফেলেছি বাংলা সাহিত্যের দুই প্রধান গল্পকার হাসান আজিজুল হক আর আখতারুজ্জামান ইলিয়াসের।  আলোচিত হয়েছে সে সাক্ষাৎকার। অনুবাদ বা সাক্ষাৎকারে অন্য লেখকের আড়ালে থাকা যায়। সে আড়াল নিরাপদের। কিন্তু গল্পে সেই আড়ালের সুবিধা নেই। পর্দা খুলে নিজেই হাজির হতে হয় মঞ্চে। যা লিখছি তা আমারই কথা, আমারই ভাষা।  কেমন অনিরাপদ লাগে।  নিজের লেখা গল্প নিয়ে কুণ্ঠিত থাকি। তবু গল্প লিখি, মনে হয় আমার বলবার কিছু কথা তৈরী হয়েছে ইতিমধ্যে, আমার ভাষায় তা বলতে চাই। কাকে বলতে চাই? হয়তো নিজেকেই।  কিম্বা হয়তো অন্যকেও।
আমার আবাল্য বন্ধু মুকুলের জীবনের এক গল্প নিয়েই লিখি এক গল্প। তাকেই পড়তে দেই। গল্পের নাম দেই ‘জোৎস্নালোকের সংবাদ’। উচ্ছ্বসিত হয় সে। উৎসাহ দেয় ছাপাবার। কোন সম্পাদককে চিনি না তখন। খামে ভরে পোস্টে পাঠিয়ে দিই ‘সাহিত্যপত্র’র সম্পাদক সিরাজুল ইসলাম চৌধুরীকে। কৈশোর থেকে সিরাজুল ইসলাম চৌধুরীর লেখা পত্রিকার কলাম  ‘সময় বহিয়া যায়’ মনোযোগ দিয়ে পড়ি। খোঁজ পাই তিনি ‘সাহিত্যপত্র’ নামে পত্রিকা সম্পাদনা করছেন। সম্ভবত প্রথম একটি সংখ্যা প্রকশিত হয়েছিল তখন। আমার গল্পটির  ভেতর রাজনীতি আর প্রেমের এক যুগলবন্দী ছিলো। সিরাজুল ইসলাম চৌধুরীর রাজনীতিমনস্ক সাহিত্য আলোচনা পড়ে সম্ভবত মনে হয়েছিলো তিনি হয়তো গল্পটিকে তার পত্রিকার উপযুক্ত ভাববেন। আমাকে বিস্মিত করে  ফিরতি ডাকে সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী জানান আমার গল্পটা নির্বাচিত হয়েছে এবং তা ছাপা হবে পরবর্তী সংখ্যায়। ছাপা হয় এবং এ বাবদ একশ টাকার একটি চেকও পেয়ে যাই। লেখা থেকে আমার প্রথম উপার্জন। একটি গল্প লিখে সেটি পত্রিকায় ছাপিয়ে ফেলা, যে পত্রিকার সম্পাদক সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী এবং সে লেখা থেকে একটা উপার্জনও করে ফেলায় গোপনে গল্প নিয়ে একটা আস্থা জমে নিঃসন্দেহে।  আমি গল্প লেখা অব্যাহত রাখি।
কোন সম্পাদকের সঙ্গে  পরিচয় নেই বলে একে একে  ডাকে  সেসব গল্প পাঠাতে থাকি বিভিন্ন পত্রিকায়। আনন্দের সাথেই লক্ষ করি সব কটি গল্প একে একে ছাপা হচ্ছে নানা দৈনিক এবং সাহিত্য পত্রিকায়। গল্প ছাপা হয়ে ভোরের কাগজ, সংবাদ, মাটি, শৈলী ইত্যাদি পত্রিকায়। ভোরের কাগজের সাহিত্য সম্পাদক তখন সাজ্জাদ শরিফ, সেখানে ছাপা হয়েছিলো আমার ‘অগল্প’ গল্পটি । সাজ্জাদের সঙ্গে অনেক পরে পরিচয় হলে জানিয়েছিলেন যে এই গল্পটির প্রতি সৈয়দ শামসুল হকের দৃষ্টি আকর্ষণ করিয়েছিলেন তিনি। সৈয়দ শামসুল হক এরপর ‘অগল্প’ গল্পটিকে বিস্তর প্রশংসা করে লিখেছিলেন  দৈনিক সংবাদ পত্রিকায় তার ‘হৃৎকলমের টানে’ কলামে। একজন তরুণ লেখকের জন্য সৈয়দ হকের সেই ইতিবাচক মন্তব্য বড় প্রাপ্তি তখন। সৈয়দ হকের সঙ্গে আলাপ পরিচয় হয়েছে এরও দীর্ঘদিন পরে। একদিন আখতারুজ্জামান ইলিয়াস ডেকে নিয়ে প্রশংসা করেন আমার গল্পের। তার পত্রিকা ‘তৃণমূলের’ জন্য গল্প চান। তার পত্রিকায় ছাপান আমার গল্প ‘হারুনের মঙ্গল হোক’। গল্প লিখছি, পত্রিকায় পাঠাচ্ছি, ছাপা হচ্ছে। সম্মানিত লেখকদের দৃষ্টিতেও পড়ছে সেসব গল্প।  ইতিবাচক মন্তব্য তখন পাচ্ছি পাঠক পাঠিকার কাছ থেকেও।  ফলে গল্পের পালে হাওয়া লাগে।  অন্যান্য লেখার চাইতে ক্রমশ মনোযোগী হই গল্প লেখায়। নব্বই দশকের শুরুর কথা এসব। সেসময় লেখা আমার সব গল্পের প্রথম পাঠক আমার বন্ধু মুকুল এবং আমার স্ত্রী পাপড়ীন নাহার। ওদের পরামর্শে বরাবরই রদবদল করি গল্পে। পেশা, সংসার ইত্যাদির ঘোরাটোপে লেখাটা অব্যাহত রাখার চেষ্টা করে যাই। গল্পের বই প্রকাশের কথা খুব স্পষ্ট করে ভেবেছি বলে মনে পড়ে না। মনের ভেতর বই প্রকাশের ইচ্ছা  ছিলো নিশ্চয়। কিন্তু নিজের যে প্রবণতা লক্ষ করি তাতে দেখতে পাই আমার সব শক্তি, মনোযোগ যায় লেখাটা লিখতে। লেখা হয়ে উঠবার পর তার পরবর্তী যাত্রা নিয়ে পরিশ্রমে আগ্রহ পাই না। লেখাটা খামে ভরে পত্রিকা আফিসে পাঠিয়ে দেয়ার শ্রমটুকুর বাইরে আর কোন উদ্যোগ নেবার শক্তি পাই না। ফলে গল্পের বই প্রকাশের কথা ভেবেছি হয়তো কিন্তু সম্ভাবনা দেখিনি, উদ্যোগও নিইনি।  গল্প পত্রিকায় ছাপা হচ্ছে তাতেই সন্তুষ্ট তখন।
এর মধ্যে বন্ধু মুকুল আমাকে পত্রিকায় প্রকাশিত প্রকাশনা সংস্থা  ‘মাওলা ব্রাদার্স’-এর একটা  বিজ্ঞাপন দেখায় একদিন। মাওলা ব্রাদার্স সেসব তরুণ লেখকদের কাছ থেকে পা-ুলিপি আহবান করেছে যাদের কোন বই প্রকাশিত হয়নি।  যে পা-ুলিপিটি শ্রেষ্ঠ বলে বিবেচিত হবে সেটি তারা বই আকারে প্রকাশ করবে বলে জানায়।  মুকুল প্রতিযোগিতায় পাা-ুলিপি পাঠাতে তাগাদা দেয়, উৎসাহ দেয় পাপড়ীনও।  সাহিত্য নিয়ে প্রতিযোগিতায় মন বিশেষ সায় দেয় না। তবে টের পাই প্রতিযোগিতাটি অভিনব। ঠিক এধরনের বিজ্ঞাপন আগে দেখেছি বলে মনে পড়ে না। প্রতিযোগিতায় জিতে গেলে অনায়াসে একটা বই প্রকাশিত হয়ে যাবে এই সম্ভাবনাটি আমাকে অনুপ্রাণিত করে। নানা মহলে আমার গল্পগুলোর যে পাঠ প্রতিক্রিয়া পেয়েছি  তাতে  এমন একটা প্রতিযোগিতায় যুক্ত হয়ে যাওয়াটা খুব বেখাপ্পা হবে বলে মনে হয় না। পা-ুলিপি জমা দেবার সিদ্ধান্ত নিই। নানা জায়গায় ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা গল্পগুলো যোগাড় করতে থাকি। তখন দেশে কম্পিউটার সুলভ নয়। বড় বড় অফিসে কম্পিউটার ব্যবহার শুরু হয়েছে মাত্র।  আমি তখনও কম্পিউটার ব্যবহার জানি না। লিখি হাতে। কিন্তু আমার হাতের লেখা এক কথায় জঘন্য। বহু যতেœ ধীরে লিখে লেখাটাকে খানিকটা বোধগম্য পর্যায়ে  এনে তবে সেগুলো পাঠিয়ে দিতাম পত্রিকায়। কিন্তু এই হাতের লেখায় লেখা পা-ুলিপি কোন প্রতিযোগিতায় পাঠালে শুধু বাজে হাতের লেখার কারণেই সরাসরি পা-ুলিপিটি বাতিল হয়ে যাবে এ ছিলো আমার দৃঢ় বিশ্বাস। ফলে সিদ্ধান্ত নিই আমার সব গল্প টাইপ রাইটারে টাইপ করে নেব। গল্পের কিছু হাতে লেখা কপি, পত্রিকায় প্রকাশিত গল্পগুলোর পেপার কাটিং জড়ো করি। আমি টাইপ রাইটিংও জানি না। টাইপ করবার জন্য তখন ভরসা নীলক্ষেত। আমার সব লেখা নিয়ে একদিন হাজির হই নীলক্ষেতে। টাইপ রাইটার ভাইরা নানারকম বিজ্ঞপ্তি, চাকরীর আবেদন, মামলা মোাকদ্দমার কাগজপত্র টাইপ করেন। গল্প টাইপ করাবো শুনে তারা খানিকটা বিভ্রান্ত হয়ে পড়েন। একটা ফাইলের ভেতর পেপার কাটিং, হাতে লেখা কাগজ ইত্যাদি জট পাকানো কাগজপত্র দেখে অধিকাংশ টাইপিস্ট একাজ করতে রাজী হন না । কেউ কেউ খুব বেশী দাম হাঁকেন।  
অবশেষে রাজী হলেন একজন। পা-ুলিপি দেখে বললেন একাজ টানা কয়েক দিন করতে হবে।  আমি তার সঙ্গে চুক্তিবদ্ধ হই। প্রতিদিন অফিস সেরে সন্ধ্যার পর ঘণ্টাখানেক আমি তার সাথে পা-ুলিপি নিয়ে বসব। তিনি টাইপ করবেন। আমি তার পাশে থাকব, কোন শব্দ, বাক্য ইত্যাদি নিয়ে প্রশ্ন থাকলে উত্তর দেব। আমার কর্মস্থল তখন ঢাকায়।  সেই টাইপিস্ট ভাইটির সঙ্গে এর পর আমার কৌতূহলোদ্দীপক কয়েকটা দিন কাটে। তার চেহারা মনে করার চেষ্টা করি। পারি না। তবে তার আঙুলগুলো মনে আছে। বেশ সরু এবং দীর্ঘ সে আঙুল। আঙুলগুলো মনে আছে কারণ কয়েকটি দিন আমি নিবিড়ভাবে তার আঙুলের দিকে তাকিয়ে থেকেছি। কদিন ঠিক মনে নেই কিন্তু পর পর কয়েকদিন টানা সেই টাইপিস্ট ভাইটির পাশে বসে থেকেছি। তিনি তার সরু, লম্বা আঙুলগুলো দিয়ে আমার গল্পগুলো টাইপ করেছেন। ঠক ঠক ঠক ঠক ঘটাং শব্দ হচ্ছে। আমি সেই আঙুলের দিকে তাকিয়ে আছি। অনেক শব্দের মতো টাইপ রাইটারের সেই শব্দও আজ বিলুপ্ত। আমি দেখছিলাম তিনি টাইপ করছেন, সাদা কাগজে একটা একটা করে শব্দের জন্ম হচ্ছে। তার টাইপের সঙ্গে সঙ্গে আমি আমার গল্পগুলো আবার পড়ে গেছি। আমি যেন আমার নিজের গল্পগুলোর নতুন জন্ম প্রত্যক্ষ করছিলাম তখন। কখনো কখনো ভুল টাইপ হয়ে যাচ্ছিল, হোয়াইট ফ্লুইড দিয়ে মুছে আবার তার ওপর টাইপ করছিলেন তিনি। অসুস্থ ক্ষতর মতো কাগজে কাগজে ছড়িয়ে পড়ছিলো হোয়াইট ফ্লুইড। টাইপিস্ট শুধু শব্দ বা বাক্য নিয়ে না, এক পর্যায়ে গল্পের বিষয় নিয়েও আগ্রহী হয়ে উঠলেন। মনে আছে তিনি যখন ‘মৌলিক’ গল্পটা টাইপ করছেন তখন থেমে থেমে বেশ হাসছিলেন। জানতে চাই- হাসছেন কেন?  ‘মৌলিক’ গল্পটিতে একটা লঞ্চ চরে আটকে যাবার ঘটনা আছে। আটকে যাওয়া লঞ্চের খাবার সব শেষ হয়ে গেলে প্রথম শ্রেণীর নাক উঁচু অভিজাত এক যাত্রীকে খাবার খেতে বাধ্য হয়ে তৃতীয় শ্রেণীতে নেমে আসতে হয়। অথচ এই লোক খানিক আগেই   তৃতীয় শ্রেণী নিয়ে নানা তুচ্ছতাচ্ছিল্য করছিলেন। হাসির কারণ জানতে চাইলে টাইপিস্ট বলে উঠলেন- ‘এইবার বেটা মজা বুঝুক, পেটে টান পড়লে মাতব্বরী যায় কই?’  গল্পটির সারকথা এত চমৎকারভাবে তার বয়ানে শুনে চমকিত হই। ক্ষুধাকে মৌল প্রবৃত্তি হিসেবে উপস্থাপন করতেই গল্পের নাম দিয়েছিলাম ’মৌলিক’। মনে আছে সেই টাইপিস্ট ভাইটি বলেছিলেন- ‘আপনার এই গল্পটা আমার কিন্তু খুব মনে ধরছে।’ নিজের শ্রেণী অবস্থান থেকে একজন ধনবানের এই পরাজয়ে তিনি একটা গোপন আনন্দ পেয়েছিলেন কি? মৌলিক গল্পটি ছাপা হয়েছিলো মারুফ রায়হান সম্পাদিত ‘মাটি’ পত্রিকায়। এই গল্পটি ভিত্তি করেই পরে নুর ইমরান মিঠু নির্মাণ করেছেন চলচ্চিত্র ‘কমলা রকেটা’, যা জিতে নিয়েছে দেশ-বিদেশের অনেকগুলো পুরস্কার।  
নীলক্ষেত থেকে আমার গল্পের টাইপ করা পা-ুলিপি নিয়ে ফিরি। পা-ুলিপি বাঁধাই করি। কিন্তু তখনও বইটির কোন নাম দিইনি। বাঁধাই করা হলেও কাভার পেইজটি খালি রাখি। বইটির নাম কী দেব এনিয়ে দ্বিধান্বিত ছিলাম বেশ। এক সময় মনে হলো এই দ্বিধাই বস্তুত আমার গল্পগুলোর মৌল প্রবণতা। তখন একটা ক্রান্তির কাল। সেই নব্বই দশকের গোড়ায় সবেমাত্র ঠা-া যুদ্ধের অবসান হয়েছে। পতন হয়েছে সমাজতান্ত্রিক ব্লকের। পৃথিবীতে বাজারী অর্থনীতির জয়জয়কার। দ্রুত বদলে যাচ্ছে বাংলাদেশ। ফ্ল্যাট সংস্কৃতি, প্রাইভেট টিভি চ্যানেল, ফাস্ট ফুড আলোড়নে বদলাচ্ছে ঢাকা। তীব্র হচ্ছে অর্থবিত্তের প্রতিযোগিতা। তারুণ্যে যৌথ সাম্যের যে সমাজের স্বপ্ন ফুটে উঠেছিলো তা তখন ধুলিস্যাৎ। দেখতে পাচ্ছি  রাষ্ট্রের যে প্রবল আলোড়ন তাতে ব্যক্তিমানুষ হতবিহ্বল হয়ে যাচ্ছে। আমার গল্পগুলো সময়ের পাকচক্রে পড়া তেমনি এক একটি দ্বিধান্বিত বিহ্বল মানুষের গল্প। আমার নিজেরও পেশাগত জীবন, ব্যক্তিগত জীবন, সাহিত্যিক জীবন নিয়ে নানা দ্বিধাদ্বন্দ্ব  তখন। এ ভাবনা তখন তাড়িত করছে যে শুধু আশা, বিশ্বাস আর ইতিবাচক স্বপ্ন দেখাই নয়, দ্বিধা, বিহ্বলতাও মানুষের মৌল প্রবণতা। তাকে এড়িয়ে যাওয়া আত্মপ্রবঞ্চনা। সেই সময় আর জীবনের প্রেক্ষিতে ‘বিহ্বলতা‘ আমার খুব ঘনিষ্ঠ একটি শব্দ বলে মনে হলো। বিহ্বলতাকেই আমি মূল মঞ্চে নিয়ে আসতে চাইলাম। বইটার নাম  দিলাম ‘কয়েকটি বিহ্বল গল্প’। সিদ্ধান্ত নিয়েছিলাম পুরো বইটা টাইপ করলেও বইয়ের নামটা থাকবে হাতে লেখা। মুকুলের হাতের লেখা চমৎকার। ওকে অনুরোধ করলাম লিখে দিতে।  বাঁধাই করা বইয়ের কাভারে কলম দিয়ে মুকুল লিখলো ‘কয়েকটি বিহ্বল গল্প’। পা-ুলিপি জমা দেয়ার শেষ দিনে আমি আর মুকুল সেই টাইপ করা বাঁধাই পা-ুলিপি নিয়ে গেলাম বাংলাবাজারের মাওলা ব্রাদার্সের দোকানে। বললাম পা-ুলিপি দিতে এসেছি। একজন কর্মচারী দোকানের এক কোন দেখিয়ে বললেন- ‘ঐখানে রাখেন’। দেখলাম সেখানে স্তূপীকৃত আরো অসংখ্য পা-ুলিপি জমা পড়েছে। পা-ুলিপির সঙ্গে ঠিকানা টেলিফোন নাম্বারও দিতে বলা হলো। ঠিকঠাক জমা দিয়ে আমি আর মুকুল বুড়িগঙ্গার পাড়ে ঘুরলাম কিছুক্ষণ। আমরা দুজনই তখন খানিকটা ম্লান। ঐ বিশাল পা-ুলিপির স্তূপ থেকে ‘কয়েকটি বিহ্বল গল্প‘’ আদৌ আর মুখ তুলতে পারবে কিনা সন্দেহ হলো আমাদের। সেদিন হাজির বিরানী খেলাম কি? মনে পড়ছে না।
মোট ১৪ টা গল্প ছিলো বইটায়। পরিসরে সবগুলি ছোট। দু থেকে চার পাতার গল্প।  গল্পে আদি মধ্য অন্ত মিলিয়ে একটা সরলরৈখিক কাহিনী বলবার ইচ্ছা আমার বিশেষ ছিলো না কখনোই। আমাকে টানতো আইডিয়া। কোন একটা বিশেষ ভাবনা। সেই ভাবনাকে আকার দিতে একটা কাহিনী বা চরিত্রকে আশ্রয় করেছি সেইসব গল্পে। পরে ভেবে দেখেছি গল্পে এই ন্যারেশন ভাঙ্গার অনুপ্রেরণা আমি পেয়েছি সম্ভবত অন্যান্য শিল্পমাধ্যম থেকে। অনেকটা হয়তো গ্রামে গিয়ে লোকশিল্পের নানা ফর্মের সাক্ষাৎ পেয়েও। আমি রুশ সাহিত্যের মগ্ন পাঠক ছিলাম। টলস্টয়, দস্তয়েভস্কি, চেকভ, গোগল, তুর্গেনিভ কথাসাহিত্যের এইসব দিকপালদের গল্প উপন্যাস পড়ে মনে হতো গল্প বয়ানের যে চূড়ান্ত স্তর তারা স্পর্শ করেছেন সেগুলোকে অতিক্রম করা আর বুঝি সম্ভব না। তাদের সেই পথ মাড়িয়ে তাদের ধারে কাছে যাওয়াও হবে দুরূহ। একটা বিকল্প পথের দিশা পেয়েছিলাম মার্কেজ পড়ে। মনে হয়েছে এ একেবারেই ভিন্ন বয়ান। তিনিও মূলত লিনিয়ার  গল্প বলার অসাধারণ খেলোয়াড়। কিন্তু  গল্প না বলার ভাবনা বরং পেয়েছিলাম অন্য মাধ্যমে। নাটক, চলচ্চিত্র, চিত্রকলার সঙ্গেও ঘনিষ্ঠ যোগাযোগ তখন আমার। ব্রেখটের নাটক এবং তার এলিনিয়েশন ভাবনার ভেতর পেয়েছিলাম গল্প ভেঙ্গে দেয়ার শক্তি, সে শক্তি দেখেছিলাম চলচ্চিত্রকার গদারের ছবিতে। পিকাসোর কিউবিজমও এই ভেঙ্গে দেয়ার গল্প। সাহিত্যে মিলান কুন্ডেরা, বোর্হেস কিম্বা কার্তাজারকে দেখেছি এই ভাঙ্গার খেলা খেলতে। বাংলা কথাসহিত্যে বেশ সাহসের সঙ্গে এই নিরীক্ষা করতেন আশির দশকের লেখক  সুবিমল মিশ্র। গল্প ভাঙ্গার অসাধারণ ক্ষমতা দেখেছি আমাদের গ্রামীণ পালাগানে, হাটের মজমার কথকদের ভেতর। যেহেতু আইডিয়ার দিকে আমার ঝোঁক ছিলো বেশী ফলে অজান্তেই এই গল্প ভাঙ্গার চর্চাটি আমাকে টেনেছে।  দেখেছি গল্পের মোহ মাঝপথে খানিকটা ভেঙ্গে দিলে চিন্তাটা উসকে ওঠে। সেই সুযোগে পাঠক পাঠিকার মনোযোগ খানিকটা নিয়ে যাওয়া যায় গল্পের মূল আইডয়ার দিকে। মার্ক্সবাদী নন্দনতত্ত্ব অনুবাদ দিয়ে শুরু হয়েছিলো আমার সাহিত্য যাত্রা। ফলে ওয়াকিবহাল ছিলাম মার্ক্সবাদী সাহিত্য বিতর্ক বিষয়ে। সোভিয়েত পতনের পর যে কোন গ্রান্ড ন্যারেটিভ নিয়ে সন্দেহ জোরদার হয়েছে।  গল্পের গ্রান্ড ন্যারেটিভ এড়ানোর ভাবনাও তখন তাই চাঙ্গা। তবে এভাবে  গল্প আর না-গল্পের ভারসাম্য রাখা যে সহজ নয় সেটা টের পেয়েছি বরাবর।
 এ বইয়ে আমার ‘অগল্প’ নামের গল্পটি সেই গল্প ভাঙ্গার সরাসরি নমুনা। এতে রয়েছে গল্পের ভেতর গল্প। এটি মুক্তিযুদ্ধের গল্প লিখতে না পারার গল্প। তাই নাম দিয়েছিলাম অগল্প। মুক্তিযুদ্ধ কেন্দ্রিক আমাদের যে স্বপ্নভঙ্গ, সেই থীমটিকেই ধরেছিলাম এই গল্পে। আমার ফর্মটাই যেন ছিলো এর কনটেন্ট। এমন গল্পের ভেতর গল্প রয়েছে অন্য গল্পগুলোতেও। এ বইয়ের প্রথম গল্প ‘এক কাঁঠাল পাতা আর মাটির ঢেলার গল্প’ তে মূলত একটা ছোট গ্রামীণ গল্পকে বলতে গিয়ে আরো অনেক  আধো গল্পের অবতারণা করা হয়েছে।  কাঁঠাল পাতা আর মাটির ঢেলার বন্ধুত্বের এই গল্পটি শুনেছিলাম গ্রামেই, তার সঙ্গে কোন এক পত্রিকায় পড়া নাম ভুলে যাওয়া এক কবিতার অনুপ্রেরণায় লিখেছিলাম এ গল্পটি। এতে গল্প আর কবিতার সীমারেখা যেন ভেঙ্গে গিয়েছিলো। আমার বইয়ের যে মূল থীম ‘বিহ্বলতা’ তার প্রস্তাবনা এই গল্পের কেন্দ্রে। উন্নয়ন সংস্থার গ্রামীণ প্রকল্পে কাজের অভিজ্ঞতার প্রতিফলন আছে ‘হারুনের মঙ্গল হোক’ আর ‘স্যুট টাই আর নক্ষত্রের দোষ’ গল্পে। এও ব্যক্তি মানুষের নাজুকতারই গল্প। রাষ্ট্রের বড় বয়ানের সাথে ব্যক্তিমানুষের খাপ খেতে না পারার বিহ্বলতার গল্প সেগুলো। গেছি সামরিক শাসনের অভিজ্ঞতার ভেতর দিয়ে। ‘মিথ্যা তুমি দশ পিঁপড়া’ এক প্রতিবাদী তরুণের ক্রমশ সামরিক বয়ানে অভ্যস্ত হয়ে ওঠারই গল্প। যদিও সেখানে গল্প নেই কোন, আছে তিনটা চিঠি মাত্র। বাংলাদেশের অর্থনীতিকে চাঙ্গা করছে তখন পোশাক শিল্প। সনাতন জীবন থেকে বেরিয়ে শত শত গ্রামীণ নারী যোগ দিচ্ছে পোশাক শিল্পের শ্রমিক হিসেবে। এই রূপান্তরের গোপন ঝুঁকির কথা ভেবেছি ‘ক্ষত যত ক্ষতি যত’ গল্পে। একজন নারী পোশাক শ্রমিকের ধর্ষিতা হবার গল্প সেটি কিম্বা হয়তো সেই ধর্ষণের রিপোর্ট লেখা ডাক্তারেরও গল্প। আগেই বলেছি ‘জোৎস্নালোকের সংবাদ’ গল্পে আছে প্রেম আর বাম রাজনীতির পতনের বিষণœ মিথস্ক্রিয়া। বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাস্পাসে হত্যা, গোলাগুলি নৈমিত্তিক ব্যাপার হয়ে উঠেছিলো তখন। একটি সন্ত্রাসী কর্মকা- নিয়ে গল্প লিখেছিলাম সন্ত্রাসীদের দৃষ্টিকোণ থেকেই, ‘কারা যেন বলছে’ নামে। তাদেরই বানিয়েছিলাম গল্পের মূল চরিত্র। দৃষ্টিভঙ্গির বহুত্ব নিয়ে গল্প ‘কতিপয় ভাবুক। এটি একই সাথে গল্প এবং গল্পের ইন্টারপ্রিটেশন। সত্য কী, তাকেই প্রশ্নবিদ্ধ করা হয়েছে এখানে। আকিরো কুরোসাওয়ার ‘রশোমন’ ছবিটার প্রভাব আছে এ গল্পে। এটাও মানুষের বিহ্বলতারই গল্প। খানিকটা ভিন্ন থীমের গল্প ‘ডোডো পাখির জন্য নস্টালজিয়া’। আজ এনথ্রোপসিন, জৈববৈচিত্র্য, ক্লাইমেট চেঞ্জ ইত্যাদি নিয়ে বিস্তর কথা হচ্ছে। নব্বই দশকের গোড়ায় এসব আলাপ বিশেষ ছিলো না। কিন্তু আমার গ্রামীণ জীবনের অভিজ্ঞতা আমাকে জানিয়েছে মানুষ আর প্রাণীর গভীর আত্মীয়তার খবর। এই আত্মীয়তার ভাঙ্গনের  আশংকা নিয়ে সেই গল্প। নেহাতই অনুভূতিনির্ভর একটি গল্প লিখেছিলাম ‘কিছু শিরোনামা’ নামে। আর আমাদের জাতকের গল্পের ধরনে কথোপকথনের আঙ্গিকে লিখেছিলাম ‘মারাত্বক নিরুপম আনন্দ’। নাটক আর গল্পের দেয়াল ভেঙ্গে গিয়েছিলো এখানে। এই গল্পের শিরোনামটি নিয়েছিলাম জীবনানন্দের এক গল্প থেকে। আমার গল্পে জীবনানন্দের অনুপ্রবেশ সেই প্রথম , যার পুনরাবৃত্তি ঘটেছে পরবর্তী  আরো অনেক কটি গল্পে এবং তার পূর্ণাঙ্গ পরিণতি ঘটেছে জীবনানন্দকে নিয়ে আমার উপন্যাস ‘একজন কমলালেবু’ লেখার ভেতর দিয়ে। বলতে পারি এই গল্পগুলোর ভেতর দিয়ে আমার পরবর্তী লেখার বিষয় এবং আঙ্গিকের একটা মানচিত্র তৈরী হয়ে উঠেছিলো।  গল্প, কবিতা, নাটক, প্রবন্ধের দেয়াল ভেঙ্গে নিজের লেখাকে একটা সাহিত্যকর্ম হিসেবে দেখার প্রস্তুতি বলা যায় সেখান থেকেই।      
ফেরা যাক মাওলা ব্রাদার্স কথা সাহিত্য পুরস্কারের প্রসঙ্গে। এই আয়োজনে যে পা-ুলিপি জমা দিয়েছি সে কথা জানতো শুধু মুকুল আর পাপড়ীন। জমা দেয়ার পর  একরকম ভুলেই ছিলাম  সেই পা-ুলিপির কথা।   মাঝে মাঝে মনে উঁকি দিত বটে যে কোন এক  প্রতিযোগিতায় একটা পা-ুলিপি জমা দিয়েছিলাম। তারপর হঠাৎ একদিন একটা ফোন পেলাম মাওলা ব্রাদার্সের স্বত্বাধিকারী আহমেদ মাহমুদুল হকের কাছ থেকে। বললেন তার ওয়ারীর বাসায় যেতে। টের পেলাম ডাল মে কুছ কালা হ্যায়।  হাজির হলাম তার ওয়ারীর বাসায়। বেশ ভাবগম্ভীর মানুষ তিনি। আমাকে একটা প্রেস বিজ্ঞপ্তি দেখালেন। বললেন এই খবরটা দেশের সব পত্রিকায় যাবে। দেখলাম লেখা আছে মাওলা ব্রাদার্স পা-ুলিপি প্রতিযোগিতায় শ্রেষ্ঠ পা-ুলিপি হিসেবে নির্বাচিত হয়েছে ‘কয়েকটি বিহ্বল গল্প’। আহমেদ মাহমুদুল  হক আমাকে  জানালেন  দুশোর ওপর পা-ুলিপি জমা পড়েছিলো। সেখান থেকে দশটা পা-ুলিপি বাছাই করে পাঠানো হয়েছিলো বিচারকদের কাছে। জানালেন দেশের পাঁচ জন প্রধান কথাসাহিত্যিক বিচার করেছিলেন পা-ুলিপিগুলো। একজন বিচারক যে ছিলেন আহমদ ছফা সেটা জানা গেল যখন তিনি এই প্রতিযোগিতায় তার বিচারক হবার অভিজ্ঞতা নিয়ে লিখলেন বাংলা বাজার পত্রিকায়। আমার বইটা সহ বাকি বাছাইকৃত পা-ুলিপির বিস্তর প্রশংসা করে তিনি লিখেছিলেন সেখানে। এই পা-ুলিপি প্রসঙ্গে বলেছিলেন কলকাতার সাহিত্যের বাইরে বাংলাদেশের নিজস্ব এক সাহিত্যের উত্থান ঘটছে। এরপর দেশের প্রায় সব দৈনিকে এই পুরস্কারের খবরটি প্রচারিত হলো আমার ছবি সমেত । আমার মা আনন্দে বাজার থেকে সব কটা পত্রিকা যোগাড় করে খবরটির পেপার কাটিং দিয়ে একটা ফাইল বানালেন। মা নেই এখন। সেই ফাইলটি আছে আমার কাছে। দেখছি খবরটি ছাপা হয়েছিলো ২রা জানুয়ারি ১৯৯৬ সালে।   
পা-ুলিপিটি বই আকারে প্রকাশ পেল ১৯৯৬-এর বইমেলায়। মাওলা ব্রাদার্স তাদের স্টলে বইয়ের প্রচ্ছদ এবং আমার ছবি ইত্যাদি দিয়ে প্রকা- ব্যানার বানালো। বইয়ের প্রচ্ছদ করেছিলেন ধ্রুব এষ। প্রচ্ছদের অংশ হিসেবেই জুড়ে দেয়া হয়েছিলো পুরস্কারের তকমা। সেটি বেশ ব্যতিক্রমী ব্যাপারই ছিলো তখন। কথা ছিলো একটি অনুষ্ঠানের মাধ্যমে পুরস্কারটি আমার হাতে তুলে দেয়া হবে। পুরস্কারের একটি অর্থমূল্যও ছিলো পঁচিশ হাজার টাকা। কি কারণে জানি না সেই অনুষ্ঠান আর হয়নি। খানিকটা দেরিতে পুরস্কারের অর্থমূল্যটি অবশ্য আমাকে দেয়া হয়েছিলো। বলাবাহুল্য বইটি সে মেলায় বিশেষ দৃষ্টি আকর্ষণ করেছিলো। প্রচুর পাঠক পাঠিকা আগ্রহের সাথে কিনেছিলেন বইটি। পুরস্কার পেলেই যে একটা বই পাঠকপ্রিয় হবে তার কোন নিশ্চয়তা নেই। তবে প্রকাশের পর থেকেই বিস্তর ইতিবাচক মন্তব্য পেয়েছিলাম বইটি নিয়ে। সে সময়ের প্রায় সবকটি দৈনিক পত্রিকার সাহিত্য পাতা এবং বেশ কটি সাহিত্য পত্রিকায় বইটির ইতিবাচক রিভিউ ছাপা হয়েছিলো প্রকাশের প্রথম সপ্তাহেই। বইমেলায় গিয়ে পেয়েছি বহুজনের ব্যক্তিগত শুভেচ্ছা। সেই কিশোর বয়সে সত্তর দশক থেকে বইমেলায় যাই। নিজেকে পাঠকই ভেবে এসেছি বরাবর। সেভাবে কখনো ভাবিনি যে এই বইমেলায় একদিন আমার বই থাকবে, লোকে কিনবে সে বই। কিন্তু দীর্ঘদিন পর ১৯৯৬ সালের বইমেলা আমার জন্য বিশিষ্ট হয়ে উঠলো। সে মেলার আলাচ্য বই হয়ে উঠলো আমার প্রথম বই ‘কয়েকটি বিহ্বল গল্প’। প্রকাশক আহমেদ মাহমুদুল হক কথাচ্ছলে বলেছিলেন একটা ছোটগল্পের বই পুরষ্কুত হওয়াতে তিনি খানকিটা চিন্তিতই ছিলেন কারণ ছোটগল্পের বিক্রি বাট্টায় তার সন্দেহ ছিলো। জানালেন পুরস্কারের চূড়ান্ত শর্ট লিস্টে একটি উপন্যাসও ছিলো, তিনি ভাবছিলেন উপন্যাসটি পুরস্কৃত হলে তিনি নিশ্চিন্ত থাকতেন কারণ তিনি জানতেন উপন্যাসের বিক্রি বরবরই গল্পের চেয়ে বেশি। তবে তার আশংকা ঠিক হয়নি। ‘কয়েকটি বিহ্বল গল্প’ দিয়ে তার বাণিজ্যও হয়েছে ভালো।
প্রসঙ্গক্রমে বলে রাখি, পা-ুলিপি প্রেসে দেবার আগে মাহমুদ ভাই বললেন, সব ঠিক আছে কিন্তু বইয়ের একটা উৎসর্গপত্র  দিতে হবে। বই উৎসর্গ আমার জন্য একটা নতুন অভিজ্ঞতা। ‘কয়েকটি বিহ্বল গল্প’ আমি উৎসর্গ করেছিলাম আমার স্ত্রী পাপড়ীন নাহারকে। দ্বিধা বিহ্বলতার পাকচক্রে যখন পাখির পালকের মতো উড়ছি, যখন  আমার সকল নিয়ে বসে আছি সর্বনাশের আশায় তখন আমার সঙ্গে পরিচয় হয়েছিলো পাপড়ীনের। অগ্রজ বন্ধু চলচ্চিত্রকার শামীম আখতারের আড্ডায় কথা হয়েছিলো প্রথম। আমারই একটা লেখা নিয়ে বিতর্ক হয়েছিলো তার সঙ্গে। তার বুদ্ধিদীপ্ত তর্কে কাবু হয়েছিলাম। আগ্রহী হয়েছিলাম তার ব্যাপারে।  তখন গানের পৃথিবীতে আবির্ভূত হয়েছেন সুমন। আমরা সুমন নিয়ে কথা বলেছি। ‘তোমাকে চাই’ নামের দীর্ঘ গানের কোন লাইনটি সবচেয়ে প্রিয় খুঁজতে গিয়ে আবিষ্কার করেছিলাম আমাদের দুজনেরই পছন্দের লাইন ‘এই বিভ্রান্তিতে তোমাকে চাই।’ তারপর দেখা করেছি তার সঙ্গে তার কলেজে, বাড়িতে। অধিকাংশ সময় আমি বক্তা, পাপড়ীন শ্রোতা। একদিন বলেছিলাম কথা না বললে একজনকে বুঝবো কি করে? পাপড়ীন  উত্তরে বলেছিলো- ‘যে আমার নীরবতা বোঝে না সে আমার ভাষাও বুঝবে না।’ এ সংলাপই চূড়ান্ত করেছিলো আমাদের সম্পর্ককে। পাপড়ীনের এই সংলাপটি ব্যবহার করে আমি বইটি তাকে উৎসর্গ করেছিলাম। ‘কয়েকটি বিহ্বল গল্পের’ উৎসর্গপত্রটি আলাদা করে মনোযোগ আর্কষণ করেছে বহুজনের। পাপড়ীনের এই সংলাপ বহুজনের মুখে শুনেছি পরে। সেসময়ের এক তরুণ আমাকে অবাক করে জানিয়েছিলো এই কথাটিকে প্রিন্ট করে তারা বিশেষ টি শার্টও বাজারে বের করেছিলেন। কয়েকটি বিহ্বল গল্পের এই উৎসর্গপত্র এবং পাপড়ীনের সেই সংলাপ এখনও অনেকে উল্লেখ করেন আমাকে।  
বলা যায় খানিকটা আড়ালে আবডালে, অলিতে গলিতে চলছিলাম, ‘কয়েকটি বিহ্বল গল্প‘ প্রকাশের পর লেখক হিসেব আমাকে সাহিত্যের মূল মাঠে এসে দাঁড়াতে হলো। প্রথম বই  প্রকাশ করা, প্রকাশের পর তাকে লোকের দৃষ্টিগোচর করাতেই নাভিশ্বাস ওঠে অধিকাংশ লেখকের। সে হিসেবে পুরস্কারের ভেতর দিয়ে জীবনের প্রথম বই, সেই সঙ্গে পাঠক, সমালোচকের ইতিবাচক প্রতিক্রিয়া, গণমাধ্যমে প্রচার ইত্যাদি একজন  নবীন লেখকের জন্য নিঃসন্দেহে সৌভাগ্যের। ফলে বলা বাহুল্য আমার সাহিত্য যাত্রায় এ পুরস্কারের একটা ভূমিকা আছে। তবে পুরস্কার লেখকের ব্যাপারে পাঠকের একটা প্রত্যাশারও জন্ম দেয়। পরবর্তী বই লেখার ক্ষেত্রে সেটা একটা চাপ সৃষ্টির সম্ভাবনাও তৈরী করে। কিন্তু আমি ‘কয়েকটি বিহ্বল গল্প’কে মাথায় রেখে পরবর্তী লেখাগুলো লিখেছি বলে মনে পড়ে না। যে বিষয়, যে লেখা যা দাবী করেছে সেটা দেবার চেষ্টা করেছি। নিজেকে ভেঙ্গেছি। আমার লেখা নিয়ে বরাবরই নানা বিতর্ক হতে দেখেছি। এই বই কি উপন্যাস না ইতিহাস, গবেষণা না জীবনী, ডকু ফিকশন না মেটা ফিকশন ইত্যাদি প্রশ্ন উঠেছে। এসব বিতর্ক আমাকে বিশেষ ভাবনায় ফেলেনি। লেখার দাবী অনুযায়ী লিখে গেছি। পাঠক পাঠিকার রুচিকে শুধু অনুসরণ নয়,  আমার লেখার ধারায় তাদের অভ্যস্ত করে তোলাও একটা কাজ মনে হয়েছে।
তবে প্রথম বইটি পাঠক মহলে সমাদৃত হবার কারণে পরবর্তীকালে বই প্রকাশে আমার আর কোন সমস্যা হয়নি। ১৯৯৬-এর পর থেকে মাওলা ব্রাদার্স তো বটেই অন্য অনেক প্রকাশনা থেকেই নিরবচ্ছিন্নভাবে বই প্রকাশ হয়েছে আমার প্রতিবছরই। পুরস্কার দিয়েই সাহিত্য যাত্রা শুরু হওয়াতে সাহিত্য পুরস্কার সংক্রান্ত কোন মায়া তৈরীর অবকাশও আর থাকেনি। মাওলা ব্রাদার্স কথাসাহিত্য পুরস্কার পাওয়ার  প্রায় বিশ বছর পর ২০১৬-তে আমি বাংলা একাডেমী পুরস্কার পাই। দেশে নানা পুরস্কার চালু থাকলেও এর মাঝে আমি আর কোন পুরস্কার পাইনি। তবে আমার লেখা অব্যাহত রাখার সঙ্গে পুরস্কার প্রনোদনার কোন সম্পর্ক তৈরী হয়নি। উল্লেখ করা দরকার যে ১৯৯৬ সালের পর মাওলা ব্র্রাদার্স কথাসাহিত্যের এই পুরস্কারটিই  আর চালু রাখেনি।  কি কারণে তা অবশ্য জানি না।
এই বইটি প্রকাশের পর আমার বাবার প্রতিক্রিয়া ছিলো বিচিত্র। অন্যত্র আমি উল্লেখ করেছি যে   আমার সাহিত্যের আগ্রহ তৈরীর একটা প্রধান সূত্র আমার বাবা। আমার বাবা প্রকৌশলী ছিলেন কিন্তু সাহিত্যে তার আগ্রহ ছিলো বিপুল। প্রচুর পড়তেন। আমাদের বাসায় তার তৈরী একটি লাইব্রেরী ছিলো। বাংলা সাহিত্যের দিকপাল সব লেখকদের লেখা আমি সেখান থেকেই পড়তে শুরু করি। বাবার  খুব  ইচ্ছা ছিলো লেখক হবার। চমৎকার স্বাদু গদ্যে নানা লেখা লিখেছেন তিনি। কিন্তু কোথাও ছাপাবার সুযোগ পাননি। বাবার আগ্রহেই বিয়ের অনেক বছর পর আমার মা বাংলা সাহিত্যে এম এ করেন, পরে হন বাংলা সাহিত্যের শিক্ষক। আমার লেখা ছাপা হলে খুব আগ্রহ নিয়ে পড়তেন বাবা। আমার অনুবাদ, তাত্ত্বিক লেখা নিয়ে খুব একটা প্রতিক্রিয়া না জানালেও আমার গল্পগুলো পছন্দ করতেন খুব। আমার এই প্রথম গল্পের বই ‘কয়েকটি বিহ্বল গল্প’ যেদিন তার হাতে দিলাম বাবা আমাকে জড়িয়ে ধরে খুব কেঁদেছিলেন মনে আছে। বলেছিলেন আমার এই বই প্রকাশের ভেতর দিয়ে তার নিজের লেখক হবার অসমাপ্ত ইচ্ছাই যেন পূরণ হলো ।
খুব সাধাসিধা, সহজ এবং খানিকটা খেয়ালী মানুষ ছিলেন আমার বাবা। আমার বই প্রকাশে তিনি  এতই উদ্বেলিত হয়ে উঠলেন যে বেশ বিচিত্র কিছু কা- করতে লাগলেন।  আমার লেখক কপি যা পেয়েছিলাম সেগুলো বিভিন্নজনকে বিতরণ করে হাতে বিশেষ ছিলো না। বাবা একদিন নিজেই বইটার অনেকগুলো কপি কিনে আনলেন। বললেন তিনি ঠিক করেছেন তার পরিচিত, আত্মীয় বন্ধু সবাইকে তিনি হাতে হাতে বইটা উপহার দেবেন। বাবা তখন রিটায়ার করেছেন। বাইরে যাবার সময় বাবা বেশ নকশা করা নানারকম টুপি পরতেন, হাতে থাকতো একটা বাহারী ছড়ি। বাবাকে প্রায়ই দেখতে লাগলাম বেশ সেজেগুজে, এক হাতে ছড়ি অন্যহাতে ‘কয়েকটি বিহ্বল গল্পের’ কপি নিয়ে বের হচ্ছেন। তার চেনা পরিচতি মানুষের বাড়িতে বাড়িতে গিয়ে বইটা দিয়ে আসতেন তিনি। এভাবে জনে জনে বই বিলানো নিয়ে হাসাহাসি করতাম আমি। কিন্তু তার কোন বিকার নেই। আমরা তখন শ্যামলী থাকি। একদিন ঠিক করলেন আমাদেরই প্রতিবেশী কবি শামসুর রাহমানকে আমার বইটা দিয়ে আসবেন। আমি ব্যাপারটাতে বেশ আপত্তি তুললাম। বাবার বা আমার কারো সাথেই শামসুর রাহমানের কোন পরিচয় ছিলো না। এভাবে অপরিচিত একজনকে যেচে বই দেয়াটা আমার মোটেও পছন্দ হয়নি। তবু বাবা নিষেধ শুনলেন না। বাহারী টুপি মাথায়, ছড়ি হাতে যথারীতি হাজির হলেন শামসুর রাহমানের বাসায়।  বাবা আমাকে পরে  আগ্রহের সাথে জানালেন যে তিনি বইটা শামসুর রাহমানের  দিয়ে বলেছেন ‘এই যে আমার বড় ছেলে শাহাদুজ্জামানের গল্পের বই, পুরস্কার পেয়েছে।’ রাহমান সাহেব বাবাকে আপ্যায়ন করেছেন, আগ্রহের সাথে বইটা উল্টেপাল্টে দেখেছেন। একজন গর্বিত পিতার শিশুসুলভ আনন্দে শরিক হতে পেরে হয়তো মজাই পেয়েছিলেন শামসুর রাহমান। কিন্তু এরপর বাবা শুরু করলেন আরেক কা-। বাবা ‘কয়েকটি বিহ্বল গল্পের’ গল্পগুলি ইংরাজীতে অনুবাদ করতে শুরু করলেন। বলে রাখা দরকার আমার বাবা আহসানিয়া ইঞ্জিনিয়ারিং কলেজের মেধাবী ছাত্র ছিলেন। ১৯৫৫ সালে তাদের ব্যাচে প্রথম হয়েছিলেন তিনি। ভালো ইংরাজী জানতেন। ষাট দশকে প্যারিস, ইংল্যান্ডে গিয়ে ইঞ্জিনিয়ারিং ট্রেনিং নিয়ে এসেছেন। আমার বাবার ধারণা হলো যে তার ছেলের এই গল্পগুলো আন্তর্জাতিক পাঠকের কাছে পৌঁছানো দরকার। কে জানে গোপনে হয়তো ভাবছিলেন অনুবাদ করে ছেলের বই তিনি পাঠিয়ে দেবেন নোবেল কমিটির কাছে! বাস্তবিকই রাত জেগে একটার পর একটা গল্প অনুবাদ করতে লাগলেন। বাবার এই কা-ে কৌতুক বোধ করলেও বিশেষ বাধা দিইনি কারণ চাকরী থেকে অবসর নিয়ে অফুরন্ত সময় তার হাতে। ব্যস্ত থাকবার মতো একটা কাজ অন্তত পেয়েছেন। যে মমতায় তিনি কাজটা করছিলেন তাতে তাকে শারীরিকভাবেও চাঙ্গা হয়ে উঠতে দেখেছি। তার অনুবাদগুলোর মানও মন্দ নয়। উল্লেখ্য আমার বাবার করা অগল্প অনুবাদটি নিয়াজ জামান যুক্ত করেছিলেন তার সম্পাদিত ৭১-এর গল্পের অনুবাদ  বই ‘ওয়ার  এ্যান্ড বিয়োন্ড’ গ্রন্থে। কয়েকটি বিহ্বল গল্পের অনেকগুলো গল্প পরে অনুবাদ করেছেন সোনিয়া নিশাত আমিন, যা বই আকারে প্রকাশিত হয়েছে ইউপিএল থেকে ‘ইব্রাহিম বক্স এ্যান্ড আদার স্টোরিজ’ নামে। তবে আমার কাছে অমূল্য হয়ে আছে বাবার স্পর্শ লাগা সেই অনুবাদ। বাবা নেই। বাবাকে ভাবতে গেলে তাকে দেখতে পাই মাথায় বাহারী টুপি, এক হাতে ছড়ি আরেক হাতে ‘কয়েকটি বিহ্বল গল্পে’র কপি নিয়ে বেরুচ্ছেন বাসা থেকে কোন প্রিয়জনকে উপহার দিতে।  
    আমার সাহিত্যযাত্রার প্রথম বই ‘কয়েকটি বিহ্বল গল্প’ আমার জীবনে একটা বিশেষ জায়গা দখল করে আছে। এই বিশেষ বইটির একটা বিশেষ পাঠক পাঠিকা গোষ্ঠীও তৈরী হয়েছে। এরপর ত্রিশেরও অধিক বই প্রকাশিত হয়েছে আমার কিন্তু দেখেছি অনেক পাঠক পাঠিকার কাছে আমি এখনও মূলত ‘কয়েকটি বিহ্বল গল্পেরই’ লেখক। গুগল রিডস আমাকে জানায় বইটি প্রকাশের দুই যুগ পেরিয়ে গেলেও এখনও পাঠিকা পাঠিকারা বইটা নিয়ে লিখছেন, মন্তব্য, তর্ক করছেন। আমি নিজেও মাঝে মাঝে সেই গল্পগুলোর কাছে ফিরে যাই। সেই গল্পের লেখককে খুব ভালো চিনতে পারি। কিন্তু এও টের পাই যে মানুষ হিসেবে আমি বদলেছি, আমার কাল বদলেছে। ঠিক ঐ গল্পগুলোর মতো গল্প লেখা আমার পক্ষে হয়তো এখন সম্ভব নয়। তবে এটাও বুঝি যে আমার পরবর্তী গল্পগুলো সেইসব গল্পেরই সম্প্রসারণ। এই দেশকে নিয়ে, এদেশের মানুষকে নিয়ে, আমাদের জীবনকে নিয়ে আমার বলার কথা শেষ হয়নি এখনও। ফলে নানা নতুন বিষয়ে, নতুন আঙ্গিকে গল্প লিখছি, বই প্রকাশ করছি। কিন্তু বিহ্বলতা কাটেনি এখনও। এখনও চারিদিকে তাকাই ভয়ে, আগ্রহে, কৌতূহলে। এখনও বিহ্বল গল্পই লিখি।