সাইফুল কী করে ভাববে এমন ঘটনা তার অপেক্ষায় ছিল, অথবা সে-ই অপেক্ষায় ছিল! ঘটনায় সে ছাড়াও রয়েছে দুইজন- গগন আর রঞ্জু। বিসরার খালের মাথাভাঙা ব্রিজের ওপর রুমাল বিছিয়ে তিন তাস খেলতে বসে গগন- ধ্যুৎ, মোটে দুই শলা সিগারেট বলে মুখ ব্যাকা করতে সাইফুল যেন যাদুবলে পাঞ্জাবির পকেট থেকে প্রায়-ভরা প্যাকেট নেভি ফিল্টার বের করে ভাবছিল ঘটনাটা ওদের বলবে কি না। সকাল থেকে দোনোমনায় আছে। কাকে বলা যায়, আদৌ যায় কি না। সিগারেট দেখে রঞ্জু দাঁত বের করে তাসের বা-িল খুলতে লেগে গিয়েছিল, আর গগন আলগোছে একটা সিগারেট ঠোঁটে ঝুলিয়ে দিয়াশলাইয়ে কাঠি ঘষতে যাবে, এমন সময় হঠাৎই সাইফুল মন ঠিক করে ফেলেছিল। এদের না বললে আর কাকে বলবে! পরপরই মুখ খুলে বেশি না, মাত্র কিছু দূর এগিয়েছে, গগন আর রঞ্জু একের পর এক তার নিজের কথাই বলে দিতে থাকলে সে কী করবে- নিজে বলবে, না ওদের মুখ থেকে শুনবে এ দোটানায় কিছু সময় পার করে ভাবল ঘটনাটা, মানে স্বপ্নটা, দেখল সে, ওরা জানল কী করে! স্বপ্ন ফাঁস হওয়ার কথা জিন্দেগিতে শোনেনি। ঘটনার ওখানে শুরু, আর শেষটা শেষ কি না কে বলবে!
ভোরে ঘুম ভাঙতে বরাবরের মতো কিছু সময় বিছানায় গড়াগড়ি দিতে গিয়ে সুখ পাচ্ছিল না। ঘুম কেটে গেলেও ফিনফিনে একটা ঘুমের পর্দা যাই-যাই করেও চোখের পাতায় রয়ে গিয়েছিল। মীনা উঠে গেছে কোন ফাঁকে। পাশে থাকলে জড়াজড়ি করে ভোরবেলার চনমনে চাগাড়টা দমাতে গিয়ে ঘুমের পর্দাকেও হটাতে পারত। কিন্তু মীনার কথা তার মাথায় ছিল না। শরীরে চাগাড়-বাগাড়ও টের পাচ্ছিল না। কী একটা যেন করার কথা বা কোনো কাজে কোথায় যাওয়ার কথা, অথচ মনে করতে পারছে না এ রকম একটা ঘুষঘুষে অশান্তি নিয়ে হাত-মুখ ধুয়ে চা খাবে বলে রান্নাঘরের দিকে যেতে যেতে মনে হয়েছিল বাজারে যাওয়া ছাড়া বন্ধের দিন কাজ বলতে আর কী থাকতে পারে! মীনা চা বানিয়ে হাতে প্লেটহীন কাপ ধরিয়ে দিতে সে আধোঅন্ধকার ঘর ছেড়ে বারান্দায় এসে চায়ে পয়লা চুমুকটা দেবে বলে কাপের কানায় কেবল ঠোঁট ভিড়িয়েছে, তখনই চমকে উঠেছিল। গা-শিরশির চমকে মনে পড়ে গিয়েছিল রাতে কী কা-টা সে করেছে। ঘুমের মধ্যে, স্বপ্নে করলেও কাজটা তারই করা। চায়ে আর চুমুক দেয়া হয়নি। এদিকে মন দিয়ে স্বপ্নের কথা ভাবার আগেই স্বপ্নটাই ভাজের পর ভাজ খুলে তার মাথায় চরতে শুরু করে দিয়েছিল। এ জন্যই ঘুম ভাঙার পর জুত পাচ্ছিল না- মনে হচ্ছিল কী জানি একটা কাজ পড়ে আছে! এদিকে যতই স্বপ্নটা ভাজ খুলছিল, তার মন চাচ্ছিল ভাজগুলো যেন আরও ধীরে, গুটিগুটি শামুকের গতিতে খোলে। একটু পরই তাকে মজার খেলায় পেয়ে বসেছিল, সে চাইলেই ঘুরিয়ে-ফিরিয়ে আস্তে-ধীরে শামুকের গতিতে স্বপ্নটাকে নাড়াচাড়া করতে পারে। একবার হয়ে গেলে ফের গোড়া থেকে আবার চালু করতে পারে- যতবার খুশি। করেওছিল অনেকটা সময় ধরে। ঠান্ডা চা খেতে মন্দ না আগে কখনো খেয়াল করেনি।
এর পর সকালটা সাইফুলের বদলে যেতে লাগল। বাজারের ব্যাগ হাতে মীনাকে বলল মাছ কী আনবে, মানে মীনা কী খেতে চায়? এমনভাবে কদাচিৎ বলে। মীনা মুখ তুলে আড়াই বছর ঘর করা স্বামীর দিকে তাকিয়ে অবাক না হয়ে পারল না। লোকটা ভালোই, বছরদুয়েক হলো বাজারে ছোট হোমিও ফার্মেসি দিয়েছে, রুজি মন্দ না। লোকে ডাক্তার ডাকে, মীনার শুনতে আরাম লাগে, তবে দোষের মধ্যে খেয়াল-খুশিমতো ফার্মেসি বন্ধ রাখে, যেমন আজ। কী মাছ আনবে কথাটার সাথে মিলিয়ে সাইফুলের ঠোঁটে এমন মিটিমিটি হাসি দেখবে সে ভাবেনি। হাসিটা আগেও সে দেখেছে, কিন্তু এই যে ঠোঁটে কনে দেখা আলোর মতো আটকে আছে তো আছেই, এমন তো দেখেনি। সে না বলে পারল না, কী হইছে তুমার? সাইফুল জবাব দিল না, মীনা দেখল ঠোঁটে নরম রোদের মতো হাসিটার নড়াচড়া নাই। একে হাসি বলা যায়, আবার যায়ও না- ঠিক হাসি না, হাসির ছাপ বা ভাপ বললে মানায়। হাসি বলে মীনাই একে চিনতে পারে, যেন খুব ভিতর থেকে মন উতলা করা মিষ্টি স্বাদের মতো এক কণা সুখ ঠোঁটের কোণে এসে জিরিয়ে নিচ্ছে- মীনা ধন্ধে পড়ে তাকিয়ে থাকে।
সেই শুরু। সাইফুল বাজারে গেল। বরাবরের মতো মীনা ফর্দ ধরিয়ে দেয়নি, তবু সাইফুল যতটা সম্ভব মনে করে এটা ওটা কিনল। ঘরে পেঁয়াজ নাই জানত, বেছে বেছে লাল-লাল দেশি পেঁয়াজ কিনল, টমেটো কিনল, মৌসুমের সবে ওঠা ফুলকপি কিনল, আরও যা যা মনে পড়ল ব্যাগে ভরল। মীনার কাছে জানতে চেয়েছিল কী মাছ, মীনা কিছু না বলে তার মুখে তাকিয়ে কী হইছে তুমার বলেছিল, তারপর তাকিয়েই ছিল। কী দেখছিল মীনা? বড় বড় জ্যান্ত কৈ মাছ দেখে তার মনে হলো মীনা কৈ মাছ পছন্দ করে, চাষের কৈ হলেও তার আপত্তি নাই। ফুলকপির সাথে কি কৈ মাছ যায়? তার মন বলল, যায়। এমনও ভাবল আজ যা চাইবে তা-ই যাবে। আশ্চর্য কথাটা ভাবলেও সে আশ্চর্য হলো না। সাইফুল কৈ মাছ কিনল, মাছওয়ালাকে দিয়ে কুটিয়েও নিল। মীনা এতে যারপরনাই অবাক হবে। কোনো দিন তো বাজার থেকে মাছ কুটিয়ে আনে না। বাজারে সাইফুল চেনা-জানা যাদেরই পেল যেচে একথা সেকথা জিজ্ঞাসা করল। নসু ম-ল তার নাতির খৎনার দাওয়াত দিল। হাজামকে দিয়ে করাচ্ছে শুনে সাইফুল বলল আজকাল হাসপাতালে পাঁচ মিনিটে হয়ে যায়। নসু ম-ল হাসল, মানে পাত্তা দিল না তার কথাকে, বলল, আসবা কিন্তু ডাক্তার, কাইল বাদজোহর। সাইফুল ঘাড় নাড়ল, মনে মনে ঠিক করল যাবে, মীনাকেও নিয়ে যাবে, অবশ্য মীনা যাবে বলে মনে হয় না।
যা ভেবেছিল তাই। কৈ দেখে মীনা খুশি হলো ঠিকই, তবে কানকো-ছিলা, আঁশ-ছাড়ানো, পেট-ফাড়া মাছ দেখে সে এমনভাবে তাকাল, সাইফুলের মনে হলো সে কী হইছে তুমার বলবে। মীনা অবশ্য বলল না। সে ফুলকপি পেয়ে বলল, আগে ফুলকপি দেখলেই মনে হইত শীত আইসা পড়ছে। আইজকাইল আগাম ফলায়, শীতের সোয়াদ ফুলকপিতে মিলে না। শুনে সাইফুল ভাবল শীতের স্বাদ কী জিনিস, আবার ফুলকপিতে!
মীনাকে এর পর আর সাইফুল অবাক হওয়ার সুযোগ দেয়নি। কেন জানি তার মনে হয়েছে মীনা উল্টোপাল্টা সন্দেহ করবে। সে যতটা সম্ভব মনের অবস্থাকে ঢেকেঢুকে খামোখাই মীনার রান্নার তদারকি করেছে। ফুলকপির সাথে কৈ মাছ যায় কি না এ নিয়ে কথাবার্তা বলার দরকার মনে করেনি। মীনার যা ইচ্ছা তাই হবে। সে যদি তার নানির শেখানো তেল-কৈ রাঁধতে চায় রাঁধুক। তবে রান্নার এক ফাঁকে মীনাকে লম্বা এক ফালি আদা কুচি কুচি করতে দেখে ইচ্ছা হয়েছিল জিজ্ঞাসা করে কৈ রান্নায় আদা দেয়ার বিষয় কি তার নানির কাছে শেখা? কিন্তু মীনা এত যত্ন করে ধারালো ছোট চাকু দিয়ে কুচিগুলো করছিল, তার মনে হচ্ছিল এ সময় কথা বলে মনযোগ নষ্ট করলে আঙুল কেটে রক্তারক্তি করে ফেলতে পারে। মীনার প্রায়ই আঙুল কাটে।
অনেকক্ষণ ঘরে কাটিয়ে সে মাথা ঠান্ডা করে স্বপ্নের ব্যাপারটা নিয়ে ভাবতে এক চক্কর বাইরে থেকে ঘুরে আসবে বলে বেরোল। বাড়ি থেকে বেরিয়ে দক্ষিণে ইশকুল বরাবর হাঁটলে মিউনিসিপালিটির পাকা চওড়া সড়ক। সে উল্টোদিকে কিছু দূর গিয়ে নিরিবিলিতে দাঁড়ানোর বা বসার জায়গা খুঁজল। কিছুটা সামনে এগোালে কালাম কন্ট্রেকটারের পুকুরপাড়ে শান্তিতে বসার জায়গার অভাব নাই। এ সময় ঘাটে মানুষজন থাকার কথা না। সে পুকুরের দিকেই এগোল, অল্প কয়েক কদম যেতেই মরা ছাতিম গাছে মস্ত বড় একটা দাঁড়কাক দেখে থমকে দাঁড়াল। এত বড় দাঁড়কাক আগে দেখেছে বলে মনে পড়ল না। আজকাল দাঁড়কাকের দেখাই-বা কোথায় মেলে! পাতিকাক দু-চারটা যা দেখা যায়, তা-ও হাটে-বাজারে, দাঁড়কাকের কথা মানুষ একরকম ভুলেই গেছে। কিন্তু এটা এই মরা গাছে ডানা ছড়িয়ে কেন? সাইফুল খুটিয়ে দেখল, হ্যাঁ, শরীর-গতরে বিশাল, শুধু কুচকুচে তেলতেলে গায়ের রঙ দেখে বা গলার খকখকানি দিয়েই একে দাঁড়কাক বলে চেনা যাবে। সাইফুল অবশ্য এক নজর তাকিয়ে দাঁড়কাক বলে ধরতে পারল। কাকটার ভঙ্গি মোটেও কাকের মতো না, ঠোঁট দুটোকে মনে হচ্ছিল অতিরিক্ত লম্বা আর বাঁকানো, সেই সাথে সে না ভেবে পারেনি এ কাক সুযোগ পেলে মানুষকেও ঠোকরাতে পারে।
কোথায় স্বপ্নের কথা ভাববে বলে বেরিয়েছিল, কাকটা তার মনযোগ কেড়ে নিতে সে একটু পরে যা আবিস্কার করল তা বেশ আশ্চর্যের। কাকটা এমনি এমনি ডানায় রোদ লাগাতে মরা ছাতিম গাছকে বেছে নেয়নি। সাইফুল দেখল দাঁড়কাকের পা দুটোর নিচে চাপা পড়ে কাতরাচ্ছে একটা মাঝারি বেড়াল ছানা। ছানাটার গা থেকে ফোঁটা ফোঁটা রক্ত ঝরছে, পেট ফেড়ে কাকটা আগেই নাড়ি-ভুঁড়ি বের করে ফেলেছে। তারপরও ছানাটা মরেনি, কাতরাচ্ছে পরিষ্কার বোঝা যাচ্ছে। কাক আবার কবে থেকে শিকারি বনে গেল! পথে-ঘাটে ফেলে দেয়া পচা-বাসি খাবারদাবার, গু-মুত খেয়েই বাঁচে। তার রাগ হলো খুব। সে দুই হাত ওপরে তুলে বার কয়েক জোরে তালি বাজিয়ে বিফল হলো। কাকটা পাত্তা দিল না, বরং মেজাজ দেখাতেই যেন ঝটিতে ঠোকর মেরে আধহাত পরিমান টাটকা নাড়ি মুখে নিয়ে টেনে টেনে গিলতে লাগল। সাইফুল আর পারল না, ছানাটাকে বাঁচানোর উপায় নেই, তবু এ হারামিকে খেতে দেবে না এমন জেদ নিয়ে সে খানিকটা তফাতে মাটিতে পড়ে থাকা বাঁশের কঞ্চি তুলে গাছের দিকে তেড়ে গেল। কাকটা দেখল সাইফুল তার মুখের খাবার কেড়ে নিতে কঞ্চি বাগিয়ে মুখে নানা রকম আওয়াজ করছে। কঞ্চিটা নেহাত ছোট না, সাইফুল ছাতিম গাছের মরা ডালপালায় কষে কঞ্চির বাড়ি দিয়ে চলেছে, এমন সময় একটু আগে যেমন ভেবেছিল এ কাক মানুষকে ঠোকরাতেও পারে, তার চেয়ে বেশিই কাকটা করে দেখাল। সে গাছ ছেড়ে বিশাল ডানা ঝপঝপিয়ে সাইফুলের মাথা-নাক-মুখ বরাবর ঝাপ দিল। এতটা কল্পনা করাও কঠিন- একটা কাক, হোক দাঁড়কাক, হোক গায়ে-গতরে দশাসই। ভয় পেলেও সে হাতের কঞ্চিটাকে বেদম মাথার ওপর বনবন ঘোরাতে লাগল, আর পরিষ্কার মনে আছে একটা মোক্ষম বাড়ি কাকটার গায়ে ঠেকতে সে রেগেমেগে গালাগালি করতে করতে উড়ে চলে গিয়েছিল।
দিনেদুপুরে এমন কা-, সাইফুল খুবই অবাক হলো। আরও অবাক হলো আশপাশ জনমানুষহীন, কেউ নেই। এত দূর সে ভেবেছে, তখনই মনে পড়ল রাতের স্বপ্নে এ কাকটাও ছিল। রাতের স্বপ্ন দিনের রোদে হুবহু ফিরে আসবে এর চেয়ে আচানক কী হতে পারে!
দুপুরটা গেল। মীনা ফুলকপি দিয়েই কৈ মাছ রেঁধেছিল, ধনেপাতা ছিল না বলে রান্নাটা নাকি তার মনমতো হয়নি। সাইফুল চুপচাপ খেয়ে উঠে বাইরে রোদের দিকে তাকিয়ে ভাবল কাকটা তাকে ছেড়ে দেবে না। আজগুবি কথাটা কেন ভাবল সে বলতে পারবে না, তবে একবার মাথায় বেতাল টোকা পড়তে সে রাতের স্বপ্নে ফিরে যেতে চাইল। চেষ্টা করল সকালবেলা যেমন ভাজের পর ভাজ খুলে দেখেছিল সেভাবে খুঁটিয়ে দেখে। হলো না। গোটা স্বপ্নটা মাথায় থাকলেও সকালে যেমন শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত বারকয়েক ঘুরিয়ে-ফিরিয়ে দেখেছিল, সেভাবে এল না। এল, তবে ছাড়া-ছাড়াভাবে। তার তখন মনে হলো কাউকে বলা দরকার। কিন্তু কাকে বলে? মীনাকে বলা যাবে না, কী ভাবতে কী ভাববে, আর ভয়ও পাবে। একটা রগরগে ভয়ের স্বপ্নকে সাইফুল কেন সকাল থেকে বয়ে বেড়াচ্ছে, এ কথাই মীনাকে চিন্তায় ফেলবে। নিজে সাইফুল এমন একটা ঘটনা ঘটিয়েছে, নৃশংস খুন যাকে বলে - হোক স্বপ্নে - তারপরও ফুরফুরে মনে তার বাজারে যাওয়া, ফুলকপি ও কৈ মাছ নিয়ে ফেরা- মীনা ভেবে ভেবে বেশ বিপদেই পড়বে। আসল কথা, মীনাকে সাইফুল কিছুতেই বোঝাতে পারবে না খুনটা করে-স্বপ্নে হলেও-সে বড় আমোদে সকালটা কাটিয়েছে। অবশ্য দুপুরে স্বপ্ন থেকে উড়ে এসে হারামি কাকটাই যা গ-গোল পাকিয়েছে।
শেষমেশ বিছরার খালের ভাঙা ব্রিজে রঞ্জু ও গগনকে নিয়ে বসতে না বসতে সাইফুল মন ঠিক করে ফেলেছিল। বলতে যখন ইচ্ছা করছে, যাদের সঙ্গে ওঠাবসা তাদেরই বলা উচিত। ছোটবেলা এক সঙ্গে পড়েছে, সাইফুল মেট্রিকের পরে বছরখানেক কলেজে ঘোরাঘুরি করলেও রঞ্জু বা গগনের ইশকুলের গ-ি পেরোনো হয়নি। ফলে ইদানীং তিনজনের কাজ-কর্মে ম্যালা ফারাক। সাইফুল ফার্মেসিতে ফরশা জামা-কাপড় গায়ে মেটিরিয়া মেডিকা ঘেঁটে রাসটক্স থারটি, নেট্রাম সালফ ৬ী বা সাইলিসিয়া ছোট ছোট শিশিতে ভরে রুগিকে খাওয়ার নিয়ম বোঝায়। গগন এক ভুসিমালের গুদামে মালামালের হিসাব রাখে, দরকার পড়লে বস্তা টানাটানিও করে। রঞ্জুর অবস্থা সে তুলনায় বেশ খারাপ, কিছু দিন টেম্পো চালিয়ে একটা খোঁড়া পা নিয়ে এখন এক গ্যারেজে কাজ করে। তাসের আড্ডায় তেল-মোবিলের ছাপমারা জামা-কাপড় পরেই আসে।
তিনজনের মধ্যে, সাইফুল ভেবে দেখেছে, গগন গায়ে-গতরে যেমন লম্বা-চওড়া, মাথায় বুদ্ধিশুদ্ধিও রাখে ভালো। মাঝে মাঝে এমন বুঝদার কথাবার্তা বলে, তখন কে বলবে ক্লাস সেভেনে দুইবার ফেল মেরে ছেঁড়া-ফাড়া বই-খাতা বেচে হাওয়াই মিঠাই খেয়েছে। রঞ্জু বেঁটে-খাটো, এক্সিডেন্টে ডান পা খুঁতো হওয়ার পর ইদানীং আরও বেঁটে-বাটুল লাগে, তবে মাথা তারও মন্দ না। সাইফুলকে সে ডাকে ডাকতর। নিজে সাইফুল পোশাক-আশাকে এদের থেকে আলাদা হয়ে গেলেও দোস্তিটা ঠিকই টিকিয়ে রেখেছে। সেজন্যই বিকাল-বিকাল তিনজন জুত হয়ে বসতেই সাইফুলের মন ঠিক করতে অসুবিধা হয়নি। শুনে ওরা কে কী ভাববে পরে দেখা যাবে। আর তাই গগন সিগারেট ঠোঁটে ঝুলিয়ে কাঠি ঘষতে যাবে, তখনই তার মন ঠিক করে ফেলা মোটেও আশ্চর্যের কিছু ছিল না। যদিও সিদ্ধান্তটা সে হঠাৎই নিয়েছে, তবু তার মনে হয়নি কাজটা বেঠিক হয়েছে।
কী বলে শুরু করেছিল সাইফুলের মনে নাই। হতে পারে বলেছিল, শোন, তোরারে একটা খোয়াবের কথা কই। কাইল রাইতে না আমি একটা খুন করছি।
তুই করছস খুন?
গগনের প্রশ্নে সাইফুল মাথা নাড়তে মুখের সিগারেটে ধীরে-সুস্থে আগুন দিয়ে ধোঁয়া ছাড়তে ছাড়তে গগন বলল, কারে বরজখরে?
থতমত খেয়ে সাইফুল ওর দিকে তাকাতে গগন জানতে চাইল, ঠিক না?
রঞ্জু তাসের বান্ডিল খুলে ময়লা হলেও বুকখোলা মেয়েদের ছবিওয়ালা তাসগুলো যত্ন করে রুমালের ওপর বিছিয়ে চোখ তুলে দুইজনকে দেখল। একটা সিগারেট তুলে মুখে না দিয়ে নাড়াচাড়া করতে করতে বলল, ক কী দেখলি।
না, স্বপ্নে তো মানুষ আগা-মাথা নাই কত কিছুই দেখে। আমি এমনভাবে দেখলাম মনে হইল বরজখরে খুন করতে ম্যালা দিন সুযোগ খুজতেছিলাম। পাইতেছিলাম না। পাইলাম তো পাইলাম এমন সুযোগ, রামদার এক কোপে গর্দান আলগা কইরা দিলাম।
রামদা পাইলি কই? রামদার পিঠ কি ব্যাকা থাকে? এরে কুকরি কয়, নেপালে পাওয়া যায়। এবার রয়েসয়ে বলল গগন।
যা কই শুনবি তো।
তুই তো ভুল কইতেছস।
মানে?
মানে আবার কী? তোর হাতে রামদা না, কুকরি আছিলো। আর কুকরি দিয়া এক কোপে গর্দান আলগা করা যায় না।
সাইফুল চমকাল। এরা কী শুরু করছে! ঘটনাটা তার নিজের, তাকে বলতে দিচ্ছে না। রামদা না, তার হাতে নাকি ছিল নেপালি কুকরি! হঠাৎ তার মনে হলো রামদা অন্তত হাত দুয়েক লম্বা হয়, বেশিও হতে পারে, কিন্তু তার হাতে যে জিনিস ছিল সেটা বড়জোর হাতখানেকের। আর, হ্যাঁ, মাথাটা রামদার মতো চিকন আর টানটান ছিল না। কুকরিই তবে? এরা জানল কী করে!
চমকানোর ধাক্কা সামলে সাইফুল দুইজনের দিকে তীক্ষè চোখে তাকিয়ে কী বুঝল কে জানে। সে বলতে শুরু করল, র্ধ, তোরা যেমন কইতেছস, কুকরিই। কুকরির নামই শুনছি, দেখি নাই।
আমিও দেখি নাই।- গগন।
আমিও না। - রঞ্জু।
মহামুশকিল, এরা তো তাকে বলতেই দিচ্ছে না। সাইফুল বিরক্ত হয়ে বলল, তাইলে তোরাই ক, আমি শুনি।
না আগে তোরটা ক। তারপরে আমারটা। - গগন।
আমারটাও পরে।- রঞ্জু।
মানে কী?
মানে তেমন কিছু না। তুই তোর খোয়াব গুলাইয়া ফালাইছস। খালি খুনের কথাটা তোর মনে আছে, কেমনে করলি ভুইল্যা গেছস।
আমি যে খোয়াবে বরজখরে খুন করছি তোরা জানলি কেমনে?
আমিও তো করছি।- গগন।
আমিও। - রঞ্জু।
খোয়াবে?
খোয়াবে ছাড়া আর কেমনে! আমরা তো খুন-খারাবির কারবার করি না, খুন কেমনে করতে অয় জানিও না। জানার মইদ্যে এক তাস খেলা। বাকি যা যা জানি কুনু কামের না, তোর ডাক্তারিও না।
একটু পরে গগন বলল, তুই তো খালি গত রাইত খোয়াবে খুন করতে দেখছস। আমি পরপর তিন রাইত।
আমি দুই। রঞ্জু বলল।
এখন তোর ঘটনাটা ক, দেখি মিলে কি না।
সাইফুল ভেবে পেল না কী করবে! এরা যে তাকে নিয়ে খেলছে না এ তো পরিষ্কার, যদিও খেলার মতোই লাগছে।
তাকে চুপ করে থাকতে দেখে গগন আরেকটা সিগারেট ধরিয়ে বলল, কাউয়া দেখছিলি, বড় ধুড়া কাউয়া?
সাইফুল মাথা নাড়ল। তার ইচ্ছ হলো দুপুরের কাকটার কথা ওদের বলে, বলল না।
গগন বলল, বরজখের লগে একটা কাউয়া আছিল। তোর ঘটনাটা ক না।
চারপাশে বিকালের আলো মরে আসছে। ভাঙা ব্রিজের নিচে কাদা আর কাদা। একটা কানি বক কাদায় লম্বা পা ফেলে ঘুরঘুর করছে। কাদার মধ্যে ব্যাঙ ছাড়া কী পাবে! সাইফুল আশেপাশে তাকিয়ে যেন নিশ্চিত হলো ব্রিজের যে অংশটা শূন্যে ভাসছে সে সেখানে বসা, সামনে গগন ও রঞ্জু, আর চারপাশে আগুয়ান অন্ধকার। সে বলল স্বপ্নে বরজখকে দেখামাত্র তার মাথায় খুন চেপে বসেছিল, কিন্তু কী দিয়ে খুন করে ভাবতেই টের পেল হাতে রামদা, না না, ওরা যা বলছে সেই কুকরি। বরজখ তার দিকে এগিয়ে আসছে দেখে সে শক্ত হাতে কুকরির হাতল চেপে কয়েক পা সামনে গিয়ে দাঁড়াল, বরজখ কিছু বলল না। এতে তার সাহস বেড়ে গেল, আর তখনই কাজটা সে করে ফেলেছিল। কোপ দিয়ে কল্লাসহ গর্দান ফেলে দিয়েছিল কি না মনে নাই, তবে লাশটা পায়ের কাছে পড়ে থাকতে দেখে মনে আছে একটা লাথি ঝেড়েছিল। জোরে।
রঞ্জু কিছু বলতে যাচ্ছিল, তাকে থামিয়ে গগন বলল, সব মিল্যা গেছে। কাউয়ার কথা বাদ গেছে। লাশটা মাটিত পড়ার সময় কাউয়াটা ফাটা গলায় চিল্লানি দিয়া উইড়া গেছিল। ঠিক না?
সাইফুল মাথা নাড়ল।
তাইলে আর কী, একই জিনিস। তুই যেমন দেখলি, আমিও তেমনই দেখছি। রঞ্জু কিছু কইবি মনে অয়।
কাউয়ার কথা কইতে চাইছিলাম, তুই তো কইলি।
কিছু সময় চুপচাপ। সাইফুল অবস্থাটা বোঝার চেষ্টা করছে, ওরাও যেন তাকে বুঝতে সময় দিচ্ছে।
বরজখরে আমরা কেন খুন করলাম? সাইফুল বলল।
খুন কই করলাম? খোয়াবে দেখলাম। জবাব দিল গগন।
সেইটাই কই, খোয়াবে ক্যান দেখলাম, মানে খুন করলাম?
আবার এক কথা কয়! খোয়াবে খুন করতে দেখলাম আর খুন করলাম এক অইল!
এক না?
না।
তাইলে?
কী তাইলে?
আমরা ক্যান খুন করতে দেখলাম? কুকরি আমরা কই পাইলাম- যে জিনিসের নামই শুনছি, দেখি নাই?
খোয়াবে হাতে কুকরি আসছে, দরকার অইলে মিশিনগান আসত, তুই কি মিশিনগান চালাইছস, না দেখছস?
আমরা একই খোয়াব দেখতেছি ক্যান?
প্রশ্নটা রঞ্জুর পছন্দ হলো। সে বলল, এইটা আমারও কথা।
তোর একলার না। গগন বলল।
বরজখ কী ক্ষতি করছে? সাইফুল যেন ধরে নিয়েছে জবাবটা গগন জানে।
কিন্তু গগন কথা বলল না।
সাইফুল আবার বলল, কী ক্ষতি করছে যে আমরা তারে খোয়াবে খুন করতেছি, মানে খুন করতে দেখতেছি! তুই যত প্যাঁচগোছই লাগা, কথা এক, খুনই করতেছি।
গগন বুঝল প্রশ্নটা তাকেই করা। সে এদিক ওদিক তাকিয়ে দেখার মতো কিছু না পেয়ে মাথা কাত করে বসে থাকল। একটু পর মাথাটা সোজা করলেও মুখে যা বলল তার মাথামু-ু নাই- সাইফুলের তাই মনে হলো।
গগন বলল, সব ক্ষতি তো বুঝা যায় না। ক্ষতিটা কে করল তাও না। আমরা খালি জানি বরজখ জানের দুশমন। তারপরও তার কথায় চলি ফিরি, সামনে পাইলে আদাব-সালাম দেই। আসলে তো ওরে আমরা মান্যগন্য করি, করি না? হের খেমতারে ডরাই, আবার ভাবি যুদি খেমতার ছিটাফুটাও পাইতাম! আবার কী কারবার, আমরা তিনজনই ওরে খুন করতে দেখতেছি। রাইত তো আরও আছে, নয়া আরও কিছু দেখুম না কে কইতে পারে!
আগড়ম-বাগড়ম শুনে সাইফুল বিরক্ত হলো। অনেকটা রাগের মাথায় বলল, রাখ্ তোর বাখোয়াজি। ওরে ক্যান মার্ডার করতে চাই এইটা ক। খোয়াবে ওরে দেইখা ক্যান খুনের নেশায় পাইল? জীবনে কাউরে খুন করার চিন্তা করি নাই।
মুসিবতে ফালাইলি। জানলে কী কইতাম না? খালি জানি ও জানের দুশমন, আবার এইটাও জানি ওরে ছাড়া চলে না।
কী চলে না?
গগন কয়েক সেকেন্ড কী ভেবে টেনে টেনে বলল, মনে কর ভাত না খাইলে যেমন চলে না ...
তোর মাথা গেছে।
খালি আমার না। বরজখরে নিয়া সাফ-সিদা কিছু কওয়া মুশকিল। ভাতের কথা কওয়া মনে অয় ঠিক অয় নাই, আবার এক্কেরে বেঠিক কেমনে কই! ভাত ছাড়া মাইনষ্যের চলে? বরজখ ছাড়া আমরার চলে না এইটা কইতে অসুবিদা কুনখানে। আমরা আছি বইলা বরজখ আছে, আর বরজখ আছে বইলা ...
সাইফুলের ইচ্ছা হলো না গগনকে আর ঘাঁটায়। ভাবগতিকে মনে হচ্ছে মারফতি ফলাচ্ছে। ক্লাস সেভেন-ফেল মারফতি।
কিছু সময় তিনজন চুপ করে থাকে। যেন বরজখের বিষয়ে ফয়সালায় না আসতে পারায় কথা বলার দরকার ফুরিয়ে গেছে। অন্ধকার ঘন হতে শুরু করেছে, কাছে-দূরে ঝোপঝাড় থেকে কয়েকটা জোনাকি ডানার আড়মোড় ভাঙতে ভাঙতে এলোমেলো উড়ছে। আকাশে মেঘ নাই, চাঁদ উঠতে হয়তো দেরি করবে। একটা বাতাস আছে, তাতে মশাদের অসুবিধা হচ্ছে না। তিনজনই একটু পরপর হাতে পায়ে চাপড় দিয়ে মশা মরছে বা খেদাচ্ছে।
সাইফুলই আবার মুখ খুলল। এবার নতুন কথা বলল, র্ধ, বরজখরে আমরা কেউ সত্যই খুন করলাম, খোয়াবে না, তাইলে কী অইব? র্ধ, গগন তুই করলি।
আমি? গগন চমকে উঠল।
রঞ্জু যেন সাইফুলের কথায় চটে গেল। সে বলে উঠল, গগইন্যা যুদি করেও, আমি বইসা থাকুম! লেংড়া বইল্যা কিছু করুম না! গ্যারেজ থাইক্যা বড় হেকসো বেলেডে রঙ মাখাইয়া ব্যাকতেরে কমু আমি করছি।
তেজের সঙ্গে কথাটা বললেও গগনের কথায় সে চুপসে গেল। গগন বলল, তুই কইবি, আর দুইন্যার মাইনষ্যে কান পাইতা শুনব! গাধার গাধা। যে শুনব সে-ই কইব কামটা তার। এমনও হইতে পারে যে কুনুদিন বরজখরে দেখে নাই, নামটা খালি জানে, সেও কইব জীবনে পয়লা খুন অইলেও কামটা পাক্কা হাতে করছে। ধারে-কাছে জুইতমতো কিছু না পাইলে এক মুঠ পাটকাঠি দেখাইয়া কইব এইগুলান পাছায় হান্দাইয়া কাম সারছে। এমন ক্যাচাল লাগব চিন্তাও করতে পারবি না। পুলিশ কী মুসিবতে পড়ব ক।
গগন কথা শেষ করেছে কেবল, রঞ্জু ফিসফিসিয়ে খানিকটা দূরে একটা ঝোপের দিকে কী একটা দেখাতে সাইফুল, গগন তড়াক করে লাফিয়ে উঠল, খোঁড়া পা নিয়ে রঞ্জুও উঠল। তারা যা দেখল তাতে নিজেদের চোখকেও বিশ্বাস করতে মন চাইল না। কিন্তু চোখকে কী করে অবিশ্বাস করে! তারা দেখল হাত পঁচিশ-তিরিশেক দূরে একটা ঝোপের পাশ ঘেঁষে যে আনমনে হেঁটে যাচ্ছে সে আর কেউ না, বরজখ।
পরে যা ঘটল খুবই দ্রুত। তিনজনের হাতে স্বপ্নে দেখা সেই পিঠ বাঁকানো কুকরি। তারা কীভাবে ঝড়ের বেগে তিন দিক থেকে বরজখকে ঘিরে কুকরি বাগিয়ে ঝাঁপিয়ে পড়ল বলতে পারবে না। বলতে এটুকুই পারবে, স্বপ্নে যখন তারা বরজখকে আক্রমণ করেছিল তাদের মাথায় এমন অস্থির খুনের নেশা চাপেনি। হুঁশজ্ঞান হারিয়ে কুপিয়ে, খুঁচিয়ে ফালা ফালা করে বরজখকে ঝোপের পাশে ঘাসের ওপর ফেলে দেয়ার পরও তাদের কুকরি চালানো থামল না। ঘ্যাঁচ্ ঘ্যাঁচ্ করে তিনজনের তিন-তিনটা কুকরি। সাইফুলের মনে হলো ফালা ফালা করার পর এবার সে কুচি কুচি করে কাটছে। কী কাটছে ভাবতেই তার মনে পড়ল দুপুরে মীনাকে দেখেছিল ছোট ধারালো চাকু দিয়ে কুচি কুচি করে আদা কাটছে। ভাবামাত্র তার সন্দেহ জাগল, তার হাত থেমে গেল। দেখাদেখি গগন, রঞ্জুর হাতও। তারা দেখল, নিজেদের চোখকে বিশ্বাস করতে না চাইলেও দেখল একটা বড় থোড়ওয়ালা কলা গাছকে কুপিয়ে, খুঁচিয়ে, চিরে, ফেড়ে খ-বিখ- করে তারা শ্বাস টানার কাহিল কসরতে মাথা ঝুঁকিয়ে বসে হাঁফাচ্ছে। কয়েকটা টিমটিমে জোনাকি তাদের পাহারায়, আর চাঁদ-নেই-আকাশে একটা চাঁদ মনে হচ্ছে উঠব-উঠব করছে।