সাহিত্যের রাজধানী ঢাকা থেকে দূরে সিলেটে নিভৃত জীবনযাপন করলেও কবি দিলওয়ারের (১ জানুয়ারি, ১৯৩৭-১০ অক্টোবর, ২০১৩) বৈশিষ্ট্যময় উপস্থিতি ছিল ঢাকার প্রধান পত্র-পত্রিকায়। অর্জনও করেছেন বাংলা একাডেমী সাহিত্য পুরস্কার (১৯৮০) এবং একুশে পদক (২০০৮)। আমেরিকার দি ন্যাশনাল লাইব্রেরী অব পোয়েট্রি (প্রতিষ্ঠাকাল ১৯৪৯) কর্তৃপক্ষের বিচারে সারা বিশ্ব থেকে আহ্বানকৃত ইংরেজি ভাষায় রচিত কবিতাসমূহ এবং তার কবিদের মধ্যে সেরা বিবেচিত হন তিনি। অনুবাদ নয়, কবি নিজেই লিখেছিলেন ইংরেজি কবিতা, কবিতার নাম এ ক্রিস্টাল গেজিং। এরইমধ্যে সাধারণ মানুষের কথা তাঁর কবিতায় স্বতঃস্ফূর্তভাবে উঠে আসছে, সিলেটে তিনি আখ্যা পেলেন গণমানুষের কবি হিসেবে।
কবি দিলওয়ার তাঁর ৭৬ বছরের দীর্ঘ জীবনে বারবার হয়েছেন অসুস্থতার শিকার। অবস্থা গুরুতরও হতো মাঝেমধ্যে, ফলে থাকতেন শয্যাশয়ী। বেশ ক’দফাই চিকিৎসক তাঁর জীবনের আশা ছেড়ে দিয়ে সম্ভাব্য মৃত্যুর শঙ্কা প্রকাশ করেছেন। এমন অনিশ্চয়তায় ভরা জীবনেও কবির প্রেম এসেছে। পরিণতিলাভও করেছে সেই প্রেম বিয়েতে। আনিসা খাতুন ছিলেন উর্দুভাষী, সিলেট হাসপাতালের সিনিয়র নার্স। নিজের সততা ও স্বচ্ছতা রক্ষায় প্রেয়সীর কাছে কবি নিজেকে তুলে ধরেছেন কোন রাখ-ঢাক না করে, জানতে চেয়েছেন তার মত, ১৭টি নির্দিষ্ট প্রশ্নের মাধ্যমে। দিলদরাজ প্রেমিক কবি দিলওয়ারের সেটিই প্রথম ব্যতিক্রমী প্রেমপত্র। নিজের কঙ্কালসার স্বাস্থ্যের কথা জানিয়ে আনিসাকে জিজ্ঞেস করেছেন, তুমি কি এমন একজনকে বিয়ে করবে?
অন্য প্রশ্নগুলিও ছিল সমজাতীয়। নিজের সংসার বিমুখতা, রক্ষণশীল পরিবারের সদস্যদের বিরুদ্ধতা, নির্দিষ্ট পেশাগত জীবন না থাকা, এমনই সব নেতিবাচক ও নিরাশাজনক সতেরোটি বিষয়ের উল্লেখ করে ছুঁড়ে দিয়েছিলেন সরাসরি প্রশ্ন। কবিকে অবাক করে দিয়ে উত্তর আসে সতেরোটি হ্যাঁ। এরপর আর পিছিয়ে থাকা যায় না। চরম প্রতিকূলতার ভেতর সহপাঠি বন্ধু আব্দুল আজিজ (সিলেট সরকারী এম.সি. কলেজের সাবেক অধ্যক্ষ) পাশে এসে দাঁড়ান, তিনিই বিয়ের ব্যবস্থা করেন। কবির নিজ এলাকা ভার্থখলার মসজিদের মুয়াজ্জেন হাসান দুই পক্ষের অভিভাবকের অজান্তে এবং অনুপস্থিতিতে বিয়েপর্ব সম্পন্ন করেন। শুরু হয় তনবদম্পতির নির্বাসিত ও কষ্টকর যুগল-জীবন।
দিলওয়ারের অসুস্থতার শুরু ১৯৫৪ সাল থেকে। তখন বয়স ১৭, ইন্টারমিডিযেট ফাইনাল পরীক্ষা চলাকালে ইসলামের ইতিহাস পরীক্ষার আগের দিন বিকালে তাঁর পেটে শুরু হয় অসহ্য যন্ত্রণা। সেই যন্ত্রণা থেকেই শুরু হয় দীর্ঘমেয়াদী অসুস্থতা। রোগ বাড়ে-কমে, ডাক্তার বদলান হয় কিন্তু দিলওয়ার কখনো পুরোপুরি সুস্থ হন না। চিকিৎসার জন্য ১৯৮৭ সালে লন্ডনে যান। সেখানে বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকরা পরীক্ষা-নিরীক্ষা করে জানান, শুরু থেকেই ভুল চিকিৎসার জন্য ¯œায়বিক যন্ত্রণা এবং নানাবিধ জটিলতার সৃষ্টি হয়েছে। দুশ্চিন্তামুক্ত অবসর জীবন-যাপনের পরমার্শ নিয়ে দেশে ফিরে আসেন কবি। চিকিৎসার জন্য মাঝে মাঝে ডাক্তার বদলান হতো। একবার এলেন সাহিত্যপ্রেমী ডা. শামসুল ইসলাম। তিনি তাঁকে পরীক্ষা করে বলেন, কবি আমি আপনাকে একটা নতুন জীবন দেব। চলুন হাসপাতালে ।
নতুন করে চিকিৎসা শুরু হয়। তাঁর দেখাশোনার জন্য নিয়োজিত হন আনিসা। সুন্দরী ও দীর্ঘদেহী, কবির দৃষ্টিতে গ্রীকদেবীর মতো সুঠাম দেহবল্লরী যাঁর। প্রথম ভাললাগার ক্ষণটির কথা স্পষ্ট স্মরণ করতে পারেন কবি। একদিন দুপুরে হাসপাতালের বেডে কবি বিশ্রামরত। আনিসা কাছে এসে জিজ্ঞেস করলেন : কেমন আছেন কবি?
কবি জানতেন সেবিকাটি অবাঙালী। স্পষ্ট বাংলা শুনে অবাক কবি জানতে চান,
: আপনি বাংলা কবিতা পছন্দ করেন ?
: হ্যাঁ।
: কার কার কবিতা পড়েছেন?
কবির নাম না বলে সঞ্চিতা ও সঞ্চয়িতা দুটি কবিতা সঙ্কলনের নাম বলেন আনিসা। কবি জানতে চান রবীন্দ্রনাথের কোন কবিতা পছন্দ করেন?
: মুক্তি কবিতাটি।
উত্তর শুনে কবি আরো অবাক হন। জানতে চান কার কাছ থেকে বাংলা শিখেছেন।
জানতে পারেন তার সহকর্মী বান্ধবী শিরীন আখতারের কাছ থেকে এবং এদেশে আসার আগে ভারতের পূর্ণিয়ায় স্কুলে পড়ার সময় শিক্ষিকার কাছ থেকে।
শুরু থেকেই আনিসা তার দায়িত্ব পালনের অংশ হিসেবে কাছে এসে সেবা-শুশ্রুষা করতেন এবং জানাতেন সান্ত¦না, যোগাতেন উৎসাহ। কবি গল্প করতেন খুশি মনে। শোনাতেন নতুন লেখা কবিতা। দু’জনের মধ্যে সম্পর্ক গড়ে ওঠে।
কবি দিলওয়ার কিছুটা সুস্থ হয়ে উঠলে রিলিজ দেয়া হয়। আনিসার সাথে দেখা করতে মাঝে মাঝে কবি যান হাসপাতালে । একদিন এক অপ্রীতিকর ঘটনা ঘটে। আনিসার রুমে দুজনে কথা বলছেন, এমন সময় হাসপাতালের কড়া মেট্রন রহিমা খাতুন গল্পরত দুজনকে দেখে আনিসাকে অভিযুক্ত করে বেশ রাগারাগি করেন।
কবিরা এমনিতেই আবেগপ্রবণ ও অভিমানী হন। তার ওপর তাঁর কাছে মনে হয় তাঁর সততা, আন্তরিকতা ও হৃদ্যতা নিয়ে প্রশ্ন তোলা হচ্ছে। কবি উঠে দাঁড়িয়ে গম্ভীর গলায় বলেন, আনিসা তোমার জন্য আমার দুয়ার খোলা থাকল।
এরপর আনিসা কয়েকবার দিলওয়ারদের বাড়িতে যান। রক্ষণশীল পরিবার এবং উর্দুভাষী হওয়ায় তাকে ভাল চোখে দেখা হয়নি। বাড়ি থেকে প্রতিরোধ করার চেষ্টাও করা হয়। কিস্তু কবি কোন প্রতিজ্ঞা করলে সেখান থেকে পিছিয়ে আসার মানুষ নন। নিজের দুর্বলতা সম্বন্ধে সচেতন ছিলেন বলে নিজের দিক থেকে পরিষ্কার থাকার জন্য প্রশ্নের আকারে সতেরোটি প্রসঙ্গ তুলে আনিসার মতামত জানতে চেয়েছিলেন, যা আগেই উল্লেখিত।
আনিসা ছিলেন মনে-প্রাণে সমর্পিত, তাই বিলম্ব না করে অকপটে সব প্রশ্নের হ্যাঁ উত্তর দিয়ে জানান তাঁর সম্মতি। দু’পরিবারের অজান্তে ও অসম্মতিতে গোপনে বিয়ে হয় দু’জনের। কিন্তু মফস্বলে এমন উল্লেখযোগ্য ঘটনা গোপন থাকে না। জানাজানি হলে তাঁর মা এবং মুরুব্বি দু’একজনের উদ্যোগে কবির বড় ভাই মৌলভী ডেকে সামাজিকভাবে দ্বিতীয়বার বিয়ে দিয়ে নববধূকে উঠিয়ে নেন বাড়িতে ।
কবি দিলওয়ারের জীবনে নারী এসেছে পরিত্রাতা রূপে। বিবাহিত জীবনে স্ত্রী আনিসা তাকে সেবা-যত্ন দিয়ে শুধু আগলে রাখেননি, তাঁকে নতুন জীবনও দেন।
১৯৬১ সালে, বিয়ের বছরেই কবি দিলওয়ার গুরুতর অসুস্থ হয়ে পড়েন, হাসপাতালে ভর্তি করা হয়। মুখ দিয়ে রক্ত উঠতে থাকে। আনিসা তখন সন্তানসম্ভবা, এসময় হাসপাতাল থেকে জানানো হলো কবির অবস্থা খুব খারাপ। আয়ু খুব বেশী হলে ছয়মাস। তাকে বাড়িতে নিয়ে আসা হলো। দেশভাগে উচ্ছেদ হওয়া ও পরিবারের সাথে খুলনায় অভিবাসী জীবনে আনিসা নিজের পায়ে দাঁড়াবার ইচ্ছে নিয়ে বেছে নিয়েছিলেন সেবিকার জীবন। পেশাগত জীবনের অভিজ্ঞতা নিয়ে ডাক্তারের জবাব দেওয়া স্বামীর চিকিৎসার ভার নিজের হাতে তুলে নিলেন। স্বামীকে বললেন, আমি আপনাকে সুস্থ করে তুলব। একটা ইনজেকশন দেব, কষ্ট হবে কিন্তু আল্লাহ চাহেন তো আপনি সেরে উঠবেন। অনুমতি পেয়ে আনিসা কবিকে ইনজেকশন দিলেন। বিস্ময়কর ব্যাপার রক্ত পড়া বন্ধ হলো, দিলওয়ার ধীরে ধীরে সুস্থ হয়ে উঠলেন।
কিন্তু তাঁদের গভীর ভালবাসার বিবাহিত জীবন দীর্ঘ হয়নি। দাম্পত্যের পনেরো বছরের মাথায় আনিসা দিলওয়ার ২২ মার্চ ১৯৭৫ টিটেনাসে আক্রান্ত হয়ে মারা যান। রেখে যান তিন পুত্র ও দুই কন্যা। এরপর দুই পরিবারের সম্মতিতে দিলওয়ারের সঙ্গে বিয়ে হয় আনিসারই বোন ওয়ারিসা খাতুনের সঙ্গে। এই বিবাহিত জীবনও খুব বেশী দীর্ঘ হয়নি, ক্যান্সারে আক্রান্ত হয়ে তিনি মারা যান ২০০৩ সালে।
অসুস্থতার কারণে দিলওয়ারের লেখাপড়া থেমে যায় ইন্টারমিডিয়েটের পরেই। পেশাগত জীবনও সংক্ষিপ্ত। সহকারী শিক্ষক হিসাবে মাত্র দুই মাস এলাকার দক্ষিণ সুরমা হাইস্কুলে চাকরি করার পর চলে যান ঢাকায়। সহকারী সম্পাদক হিসেবে ১৯৬৭ সালে দৈনিক সংবাদে যুক্ত হন। দু’বছর চাকরি করে ফিরে আসেন সিলেটে। সমন্বয় লেখক ও শিল্পী সংস্থা গঠন করেন। স্বাধীনতার পরে আবারো যান ঢাকায়, দুবছর দৈনিক গণকন্ঠে সাংবাদিকতা করেন।
ছাত্রাবস্থায় তাঁর প্রথম কাব্যগ্রন্থ ‘জিজ্ঞাসা’ প্রকাশিত হয় ১৯৫৩ সালে। কবি দিলওয়ারের উল্লেখযোগ্য গ্রন্থগুলো হলো- ঐকতান, পূবাল হাওয়া, উদ্ভিন্ন উল্লাস, বাংলা তোমার আমার, রক্তে আমার অনাদি অস্থি, বাংলাদেশ জন্ম না নিলে, স্বনিষ্ঠ সনেট ইত্যাদি। প্রবন্ধ, গান, ছড়া ও ভ্রমণকাহিনীও লিখেছেন তিনি। ১৯৬৯ সিলেট রেডিও স্টেশনের উদ্বোধন হয় তাঁর লেখা গান ‘তুমি রহমতের নদীয়া/দোওয়া কর মোরে হযরত শাহজালাল আউলিয়া’ পরিবেশনার মাধ্যমে।
অতীতে দীর্ঘ সময় যাবত সিলেট শহরে প্রবেশ করতে হতো ক্বীন ব্রিজ দিয়ে। কবির জন্মের আগের বছর সুরমা নদীর ওপরে নির্মিত হয় সাঁকোটি। এটি নিয়ে সনেটও লিখেছেন কবি। তারই কয়েকটি পঙ্ক্তি দিয়ে লেখার ইতি টানছি।
নিচে জল কলকল বেগবতী নদী সুরমার, / কান পেতে শুনি সেই অপরূপ তটিনীর ভাষা / গতিবন্ত প্রাণ যার জীবনের সেই শ্রেয় আশা, / সৃষ্টির পলিতে সে-ই বীজ বোনে অক্ষয় প্রজ্ঞার।