নিহত চিত্রের জন্যে শোকসংগীত
রাকীব হাসান
মনের ভিতরে পাখি আছে। সেই পাখির কত ঢঙ, তার রঙ, তার ভঙ্গি, আছে তার গান আর নৃত্য। আমার জীবনে পাখি দেখা এক চিরদিনের বিস্ময়! দেহ এবং দেহের ভাষা কন্ঠ ছাড়াই প্রকাশ করে দিতে পারে বসন্তের পাখি। যদিও কন্ঠ তার সুরের সর্বগ্রাসী আসন পেতে বাঁশি নিয়ে বসে আছে পৃথিবীতে কোটি কোটি বছর ধরে। এই যে পাখিদের শৈল্পিক জীবন, তাদের সাথে মানুষের শিল্পের নির্মোহ চরিত্রটা কেমন?
পাখির জীবন যতটুকু জানি তারও অধিক জীবন হয়তো তাদের আছে। মানুষ কেন পাখি হতে চায়? শুধুই কি ওড়ার জন্য, নাকি মুক্ত আকাশে উড়ে উড়ে স্বাধীন জগতের কোনো সীমানা নেই, এই মুক্তির স্বপ্নে। কতো সহস্র পাখি মাত্র তিরিশ দিনে পৃথিবীটা ঘুরে বেড়াতে পারে, মানুষ পারে না তাই সে শুধু পাখিজীবনের স্বপ্ন দেখে। সমাজের অনগ্রসর নারীদের চোখে পাখিজীবনের স্বপ্ন দেখেছি আমি। তাদের মুখে শুনেছি পাখি হয়ে না জন্মানোর আক্ষেপ। ছবি আঁকতে আঁকতে কবে যে পাখি আমার নারী দেহের আদলে ক্যানভাস ভরে গেছে টের পাইনি। আমার ছবির সঙ্গে কবিতার আড্ডা হয়, ভাবনার নিজস্ব চৌকাঠ পেরিয়ে, সেই আড্ডায় যে আমাকে মুগ্ধ করে তাকে আমি কম্পোজ করি শব্দে অথবা রঙে। পাখি নিয়ে আমার কয়েকটি কবিতা আছে তবে ছবি এঁকেছি অনেক। এমন একটি ছবি ‘নারীদের পাখিমন’। ২০০৩ সালে এঁকেছিলাম, তেলরঙে, ছয় ফুট উচ্চতায় আর পাঁচ ফুট প্রশস্ত, মন্ট্রিয়ালে ২০০৪-এ গ্যালারি 'গোরা'-তে আমার ত্রয়োদশ একক প্রদর্শনীতে ছবিটি ছিলো।
পাখিমন নামে আমার একটি কবিতা আছে, সম্ভবত ২০১১ তে লিখেছিলাম। ২০১২-র জানুয়ারিতে ফেসবুকে প্রকাশ করেছিলাম, কিন্তু কবিতা আর ছবি খুব অবাক করে বিপরীত অবস্থান নিয়ে প্রকাশিত। 'নারীদের পাখিমন' ছবি এবং পাখিমন কবিতাটি জীবনের দেখা দুই দৃশ্যের অনুভূতি। এই লেখার সঙ্গে সামাঞ্জস্য তাই 'পাখিমন' কবিতাটি এখানে সংযুক্ত করলাম।
পাখিমন
কাকের সঙ্গে একটি মরা গাছ
শাদা বরফের শহরে,
মধ্য জানুয়ারি
কি যে সুন্দর হয়ে উঠলো --
যন্ত্রণার অপ্রিয় উষ্ণতা যদি সুন্দর হয়
মন্ট্রিয়াল তুমিও সুন্দর!
মরা গাছটির মতো কোনো মন
মৃত্যুর পরও অপেক্ষায়,
ক্ষযি়ষ্ণু দেহ থেকে
স্বপ্নের সময় খেয়ে গেল
নিজস্ব গোলাপের দিন --
তুষার ঝরে
একটানা শাদাকালো শামিয়ানা
নিচে বিমর্ষ ঘাস,
সেও কালো!
পথ ও প্রান্তরে আগ্রাসী সন্ধ্যায়
ঝুলে আছে বিদ্যুতের অসংযোগ;
কালো রঙের সঙ্গে সবাই একাএকা
কালোতেই কাকের পাখিমন ডুবে যায় ।
তখন আমার স্টুডিও ছিলো মন্ট্রিয়ালের ইটালিখ্যাত ‘লিটল ইটালিতে’। নায়রোবি স্টুডিও ছেড়ে এসেছি ২০০০ সালে। প্রায় তিন বছর আমি নিয়মিত ছবি আঁকতে পারিনি, সে এক অন্য গল্প, এ নিয়ে অন্য কোথাও কথা হবে। মন্ট্রিয়ালে যখন আমার প্রথম স্টুডিও হলো, তের বছর পরে শুরু হলো আমার দ্বিতীয় শিল্পী জীবন। ধীরে ধীরে রঙ-তুলি, আমার ছবি আঁকার টেবিল, নিজের চাওয়ার মতো আলো আর স্টুডিওর সাথে মনের সমন্বয় এবং সঙ্গে কিছু বন্ধুর অকৃত্রিম আড্ডায় আমার দ্বিতীয় স্টুডিও একদিন জীবন্ত হয়ে উঠলো।
আমার স্টুডিওর পিছনে যে বাড়িটি ছিলো, সেখানে বাস করতেন এক ইটালিয়ান বয়স্ক দম্পতি। স্টুডিওর পেছনের দেয়াল জোড়া জানালা থেকে তাদের সাথে পরিচয় এবং প্রায় প্রতিদিনই তাদের সাথে কথা হতো। ভদ্রলোকের নাম ছিলো রোনাল্ড ভিনসিলি আর তার স্ত্রীর নাম ছিলো চিয়ারা ভিনসিলি। রোনাল্ড তার বাড়ির পিছনে পুরো জমিটাই টমেটো চাষ করতেন। পুরো গ্রীষ্মকালটা এই দম্পতি ব্যাকইয়ার্ডে কাটিয়ে দিতেন। ভদ্রলোক সারাদিন টমেটো গাছ নিয়ে থাকতেন, দেখেছি কি মুগ্ধতায় প্রতিটি টমেটো তার হাতের স্পর্শে ফল হয়ে উঠতো! আমাকে তিনি কয়েকবার টমেটো দিয়েছেন। তার খেতের সবচেয়ে বড় টমেটো দিয়ে বলেছেন ইটালিয়ান ভার্জিন অলিভ অয়েল, একটু ভিনেগার দিয়ে ফেটা চিজ মিশিয়ে দারুণ সালাদ হবে। বাগেট দিয়ে খেতে অসাধারণ। ভদ্রলোক চার-পাঁচ রকমের টমেটো চাষ করতেন। চেরি, রোমা, বিফস্টেক, বাটার বয় এবং মন্তেরোজা-ই ছিলো তার প্রিয় টমেটো। তার স্ত্রীর ছিলো রূপচর্চার নেশা। একদিন নখের যত্ন তো পরের দিন চুলের, কখনো মুখে মাস্ক মেখে বসে থাকতেন। তাদের ব্যাকইয়ার্ডে চার রকম পাখি দেখতাম। কানাডিয়ান শালিক, চড়ুই, ব্লু জে এবং কমলা রঙের কার্ডিনাল। ব্লু জে অত্যন্ত রূপসী এক পাখি। একদিন তিন জোড়া ব্লু জে গল্প করছে, জীবনের গল্প, অথবা স্বপ্নের গল্প। দেখতে দেখতে চোখ বন্ধ হয়ে গেল। ইচ্ছে হলো এই তীব্র সুন্দরের পরে বহুদিন আর কিছু দেখতে চাই না। এই দৃশ্যের কয়েকদিন আগে চিয়ারা তার কয়েক বান্ধবীকে নিয়ে ব্যাকইয়ার্ডে আড্ডা দিচ্ছিলেন, বয়স্ক এদের দিকে তাঁকিয়ে তাঁকিয়ে ভাবছিলাম, এদের কি এখনো পাখিজীবন আছে? মানুষের পাখিজীবন মনের ভিতরে জন্ম নেয় এবং মনেই তার বাস। তার কোন বয়স নেই। এরকম একটা ভাবনার ঘোরে, ব্লু জে আর কয়েকজন নারীর আড্ডা মিলে হয়ে গেলো আমার পেইন্টিং 'নারীদের পাখিমন'। সিম্বলিক ঘরানার ছবি, আনক্যানি ফিগারে। আকাশ আর জীবনের রঙ্গিন মেলামেশা। আমাদের জীবনে প্রকৃতির সংসর্গ দেখতে পাওয়ার চেষ্টা, যেখনে চিন্তার কোনো সীমান্ত নেই।
চিন্তার রসায়ন থেকে প্রতিটি সৃষ্টিশীল কাজ জন্ম নেয়। কোনো এক অদৃশ্য ভাবনাকে দৃশ্যমান করে তোলার এই যে প্রয়াস, তার সবটুকুর একক দাবিদার মনের রসায়ন, কোথা থেকে সে আসে, আবার মন চাইলেও সে আসে না! কি অদ্ভুত এই মনের এক খেলা। কোথা থেকে গলে এসে শাদা ক্যানভাসে রঙের এই বিবর্তন মানুষ কেবল দেখতে পায়। একটি ছবি আঁকা শেষ হলে, আমি বুঝতে চেষ্টা করি ছবির ভাষা বোধগম্য কিনা, তার সঙ্গে আমার ভাবনা কতটা কানেক্টেড। টেকনিকের সাথে রঙের গভীর মেলামেশা ছাড়া, টের পাই ভাষাটা সৃষ্টি হচ্ছে না। রেখার সঙ্গে অন্য রেখার, বিন্দুর সাথে বিন্দুর রঙের জীবন্ত তাপমাত্রা চাই, যারা প্রকৃতির মতো মানুষের মনের সংসর্গে আসে, আর আমাদের মনের ভিতরের পাখি সে ভাষাটা বুঝতে পারে।
আমি একটা বেশ বড় টেবিলে ছবি আঁকি, যেখনে ৭২''x ৬০'' একটি ক্যানভাস শুইয়ে রাখার পরেও দুই পাশে দুই-তিন ফুট করে জায়গা থাকে। তেল রঙে আমার টেকনিকের কারণে ইজেলের চেয়ে টেবিল বেশি পছন্দের। ‘নারীদের পাখিমন’ ছবিটি আঁকা শেষ করে শুকানোর জন্য টেবিলের ওপরেই ছিলো। তুলি ধোয়ার জন্য পেইন্ট থিনার রাখা ছোট্ট খোলা বালতিটা আমার কনুইয়ের ধাক্কায় উল্টে গেলো টেবিলের ওপরে। দুই লিটার পেইন্ট থিনার মুহূর্তে পুরো টেবিলে ছড়িয়ে গেল, তেলরঙের বিনাশী বিষ ছবিটিকে খেয়ে ফেলছে আমারই সম্মুখে। দ্রুত টয়লেট পেপার আর টাওয়েল বিছিয়ে ছবিটিকে বাঁচানোর চেষ্টা করলাম। ছবিটা প্রায় শুকিয়ে গিয়েছিলো, মনে হয়েছিলো বেঁচে গেছে। কিন্তু বছর দেড়েক পরে আবিষ্কার করি তার শরীরে অসংখ্য ভাঙন। রঙ খসে পড়া শুরু হলো। বিভিন্ন স্প্রে দিয়েও বাঁচানো গেল না। মাত্র দুই বছর জীবন ছিলো ছবিটার।
পরিচিতি: রাকীব হাসান চিত্রশিল্পী এবং কবি। এক দশক আফ্রিকায় পড়াশুনা এবং অসংখ্য একক এবং যৌথ প্রদর্শনীর পরে মন্ট্রিয়ালে আছেন গত বিশ বছর ধরে। এখানে অবস্থিত শিল্পীর স্টুডিও এবং উঠান আর্ট গ্যালারি উত্তর আমেরিকার কবি, লেখক এবং শিল্পীদের মন মাতানো আড্ডার অন্যতম আকর্ষণ।