করোনাকাল
বিচ্ছিন্ন অনুভব
মাহফুজা হিলালী

প্রবন্ধ
অধ্যাপক আনিসুজ্জামান
শামসুজ্জামান খান

গল্প
ডায়মন্ড লেডি ও পাথর মানব
হামিদ কায়সার

গদ্য
নিদ্রা হরণ করেছিল যে বই
মিনার মনসুর

নিবন্ধ
পঞ্চকবির আসর
সায়কা শর্মিন

বিশ্বসাহিত্য
আইজাক আসিমভের সায়েন্স ফিকশন
অনুবাদ: সোহরাব সুমন

বিশেষ রচনা
প্রথম মহাকাব্যনায়ক গিলগামেশ
কামাল রাহমান

শ্রদ্ধাঞ্জলি
মুজিব জন্মশতবর্ষ
মারুফ রায়হান
 
সাক্ষাৎকার
কথাশিল্পী শওকত আলী

জীবনকথা
রাকীব হাসান

ভ্রমণ
ইম্ফলের দিনরাত্রি
হামিদ কায়সার

ইশতিয়াক আলম
শার্লক হোমস মিউজিয়াম

নিউইর্কের দিনলিপি
আহমাদ মাযহার

শিল্পকলা
রঙের সংগীত, মোমোর মাতিস
ইফতেখারুল ইসলাম

বইমেলার কড়চা
কামরুল হাসান

নাজিম হিকমাতের কবিতা
ভাবানুবাদ: খন্দকার ওমর আনোয়ার

উপন্যাস
আলথুসার
মাসরুর আরেফিন

এবং
কবিতা: করেনাদিনের চরণ

১৭ বর্ষ ০৩ সংখ্যা
অক্টোবর ২০২৪

লেখক-সংবাদ :





বিচ্ছিন্ন অনুভব
মাহফুজা হিলালী
বাংলাদেশে প্রথম করোনা সনাক্ত হলো ৮ মার্চ। ১৮ মার্চ থেকে শিক্ষা প্রতিষ্ঠান বন্ধ হলো, তখন থেকে মোটামুটি সব বন্ধ। মানুষ ঢুকে গেলো নিজের ঘরে। বহু বছর ধরে মানুষ শুধু দৌড়াচ্ছিলো। দিন নেই, রাত নেই দৌড়... দৌড়... এবং দৌড়...। ভোর, সকাল, দুপুর, বিকেল, সন্ধ্যা, রাত, গভীর রাত, শেষ রাত কখনোই এ দৌড় থামতো না। করোনার কারণে সব থমকে গেলো। বাতাস দূষণমুক্ত হলো অনেকাংশে, শব্দ দূষণও কমে গেলো, গাছেরা সবুজ হলো, আকাশ হলো গাঢ় নীল। প্রকৃতির বুকে নেমে এলো ¯িœগ্ধতা। এই প্রকৃতি দেখে মানুষের মনে এক ধরনের প্রশান্তি অনুভূত হলো। শুধু তাই নয়, বাইরের পৃথিবী থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে ঘরও হয়ে উঠলো মায়াময়। ¯িœগ্ধ প্রকৃতি আর ¯িœগ্ধ ঘর সবারই কাম্য। অতিযান্ত্রিক সভ্যতায় মানুষ তা হারিয়ে ফেলেছিলো। করোনার সময়ে মানুষ সেই ¯িœগ্ধতাটুকুু আস্বাদন করলো আকণ্ঠ। শুধু এটুকুই যদি হতো, তবে আর ভাবনা ছিলো না। কিন্তু বাস্তব পৃথিবী বড়ো কঠিন। এখানে অন্ন, বস্ত্র, বাসস্থান, চিকিৎসা, শিক্ষা-র বিষয় যেমন রয়েছে, তেমনি রয়েছে প্রতিদিনের প্রযোজনীয় সামগ্রীর চাহিদা। বিশেষ করে করোনাসময়ে মাস্ক, সাবান, স্যানিটাইজার ইত্যাদি তো বটেই। আরও প্রয়োজন পরিষ্কার এবং জীবাণুমুক্ত হওয়ার জন্য বিশুদ্ধ পানি। সুতরাং জীবন যতো সহজ এবং ¯িœগ্ধ মনে হলো ঠিক ততোটা কিন্তু নয়। দুশ্চিন্তা তাই পিছু ছাড়ে না মানুষের।

প্রথম প্রথম মানুষের ভালোই লাগছিলো। ঘরে বসে অফিসের কাজ করা, ঘরের কাজকর্ম করা আর পরিবারের সবাই মিলে এক সাথে সময় কাটানো। এ হলো মধ্যবিত্তের কথা। উচ্চবিত্তের মানুষরাও বেশ আয়েশ করে বসেছিলেন। নিম্নবিত্তরাও একেবারে নিঃস্ব ছিলেন না, তাই তারাও কিছুটা আয়েশি মনোভাবে ছিলেন। বিশেষ করে পুরো মাস কাজ না করে বেতন নেওয়ার আনন্দটাও উপভোগ করেছিলেন। তাছাড়া সরকারি-বেসরকারি ত্রাণও ছিলো। তবে গার্মেন্টস শ্রমিকদের বাদর নাচ নাচিয়েছে মালিকরা। তাই তারা বেশ কষ্টের মধ্য দিয়েই চলেছেন। তবু বলা যায় প্রথম মাস মোটামুটি সবাই ছুটির মেজাজে ছিলেন। এরপর বাস্তবতায় ফিরলো মানুষ। ভবিষ্যৎ নিয়ে চিন্তিত হয়ে উঠেছেন সবাই। পরিবারের অর্থনৈতিক অবস্থা, সন্তানের শিক্ষা, বেঁচে থাকবার সরঞ্জাম ইত্যাদি নিয়ে চিন্তাভাবনা মানুষের মনে ঘুরপাক খাচ্ছে। সুতরাং আবার দৌড়...। আংশিকভাবে খুলে গেছে অফিস-দোকান-বাজার। সম্পূর্ণভাবে ঘরে থাকতে পারছে না মানুষ। ফলে করোনায় আক্রান্ত এবং মৃতের সংখ্যা বাড়ছে। সংখ্যা মানে তো শুধু সংখ্যা নয়। এক এক জন মানুষ। মানুষ মানেই তার পরিবার। আর পরিবারের অনেকগুলো মানুষ। সবাই মারা যাচ্ছেন না, কিন্তু আতঙ্কিত। যার পরিবারের একজন মারা গেলেন, তারা আপনজন হারানোর কষ্টে ব্যথিত, আবার নিজেদের স্বাস্থ্য নিয়ে চিন্তিত। শুধু তাই নয় লকডাউনের কারণে বিচ্ছিন্ন। পরিবারের একজনের মৃত্যুর সাথে সাথে শোকের চেয়ে সতর্ক হতে হচ্ছে বেশি। কী দুর্ভাগ্য মৃতের এবং মৃতের পরিবারের। আবার আত্মীয়, বন্ধু কিংবা প্রতিবেশি- কেউই  মৃতকে দেখতে যেতে পারছেন না। যারা দেখতে যেতে পারছেন না, কষ্টটা তাদেরও কম নয়। আমাদের ছেড়ে চলে গেলেন অধ্যাপক আনিসুজ্জামান। নীরবে, নিভৃতে। কিন্তু এমন হবার কথা ছিলো না। লক্ষ মানুষ মিলে তাঁকে শেষ বিদায় জানাতেন। হলো না। জীবন এবং মৃত্যুর চেহারা কেমন বদলে গেলো! বদলে যাচ্ছে সম্পর্কের বন্ধনও। একজনের বিপদে আরেকজন সশরীরে যেতে পারছেন না। অথবা গেলেও তাকে ভাবতে হচ্ছে। এবং নিজেকে নিরাপদ বেষ্টনীতে রেখে যেতে হচ্ছে। এখন কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে কিংবা হাতে হাত রেখে চলতে মানা। মানুষের জীবনাচরণও তাই বদলে যাচ্ছে। তৈরি হচ্ছে মানুষের আচার-ব্যবহারের নতুন সংজ্ঞা। আত্মীয়তার নতুন সংজ্ঞা। হ্যাঁ ভার্চুয়ালি একজন আরেক জনের কাছে এসেছে খুব। বহুদিন যাদের সাথে দেখা-সাক্ষাৎ বা কথা-বার্তা হয় না, তাদের সাথেও সংযোগ স্থাপন হওয়া গেছে। জুম, স্টিম ইয়ার্ড, হোয়াসট অ্যাপ, ম্যাসেঞ্জারে মানুষ কথা বলছে যোগাযোগ করছে অনুষ্ঠান করছে। এতে তৃপ্তি কতোখানি! এখন তুপ্তি পাচ্ছে এই ভেবে যে, কদিন পর আবার এগুলো বাদ দিয়ে স্ব স্ব স্থানে ফিরে যাবে। কিন্তু যদি এভাবেই চলতে হয়, তাহলে তো ভার্চুয়াল জীবন খ-িত জীবন।   

মানুষের চলমান জীবন কত দিন আর স্বাভাবিক থাকবে! ঘরে বসে বসে অর্ডার করে খাদ্যদ্রব্যসহ নিত্য প্রয়োজনীয় জিনিসগুলো মানুষ আনছে। সবাই যদি ঘরে বসে থাকে, তাহলে এগুলো আর উৎপাদন হবে না। এক সময় সবই শেষ হয়ে যাবে। টাকা দিয়েও কিছু কেনতে পাওয়া যাবে না। তখন আবার প্রয়োজনীয় জিনিসের অভাবে মানুষ মারা যাবে। কী উভয়-সংকটেই না পরেছে মানুষ! উৎপাদনের জন্যই অন্তত কয়েকজন করে মানুষের একত্রিত হতে হবে। আবার একত্রিত হলেই করোনায় আক্রান্ত হওয়ার সম্ভাবনা। তাহলে কী ঘটতে চলেছে মানব জাতির ইতিহাসে? কেমন হতে চলেছে ভবিষ্যৎ পৃথিবী? এখনই এর উত্তর পাওয়া কঠিন। মহাকাল নির্ধারণ করবে এর উত্তর। বর্তমানে শারীরিকভাবে যে করোনাকে মোকাবেলা করতে পারছে, সে বেঁচে যাচ্ছে। কিন্তু একবার আক্রান্ত হলে আবার যে আক্রান্ত হবে না, তা-ও তো নয়। তাই ভয় দূর হচ্ছে না। এমনই আতঙ্ক নিয়ে বেঁচে থাকছে মানুষ। করে চলেছে প্রতিদিনের কাজ।

যদি কোনো ওষুধ বা প্রতিষেধক আবিষ্কৃত হয়, তবে তো সুখের কথা। প্লেগ, কলেরা, টাইফয়েড, ম্যালেরিয়া সব কিছু থেকেই বাঁচার উপায় বের হয়েছে। আশা করি করোনা থেকেও হবে। এর জন্য ঠিক কত দিন অপেক্ষা করতে হবে, কিংবা কত প্রাণ চলে যাবে তা বলা যাচ্ছে না। কিন্তু এই করোনাকালেও মানুষকে কাজে বের হতে হবে। অন্তত উৎপাদন করার জন্য। নইলে জীবন চলবে না। জীবন চলবে না দু পক্ষেরই; যাঁরা উৎপাদন করবেন আর যাঁরা ব্যবহার বা ভোগ করবেন। তাই দূরত্ব বজায় রেখে কতটা কাজ করা সম্ভব তা ভেবে বের করা খুব জরুরি। সীমাবদ্ধ পরিস্থিতিতে বিকল্প বিষয় চিন্তা করতে হবে। মানুষকে তো মানিয়ে নিয়েই চলতে হয়। এই পরিস্থিতিতেও সেই মানিয়ে নেওয়াকে চিন্তা করতে হবে। বৈরী পরিবেশে কিভাবে মানিয়ে চলা যায়, জীবন বাঁচিয়ে কাজ করা যায়, তাই এবার খোঁজার পালা। দূরত্বে থেকে, মাস্ক লাগিয়ে, গ্লাভস পরে কিংবা সমস্ত শরীর ঢেকে স্পর্শ বাঁচিয়ে কাজ করলেও যে আক্রান্ত হচ্ছে মানুষ, তা-ও দেখা যাচ্ছে। এ কারণে সংবাদকর্মী ডাক্তার-নার্স এবং আইন-শৃঙ্খলারক্ষাকারী বাহিনী আক্রান্ত হচ্ছেন বেশি।। তাই বোঝা যাচ্ছে এটা হয়তো সঠিক নিয়ম নয়। এর সাথে আরও কিছু যুক্ত করতে হবে। মানুষের জীবন বাঁচানোর উপায় ভেবে তবেই কর্মক্ষেত্র খোলা প্রয়োজন। এবং তা দ্রুতই ভাবা প্রয়োজন। ভাবনার মধ্যে বৈজ্ঞানিক ব্যাখ্যা থাকাটাও খুব জরুরি।

এ কথা ঠিক, করোনা নতুন করে শেখালো ‘নিরাপদ দূরত্ব’ বিষয়টি। মানুষের উচিত হবে এই শিক্ষাকে সঙ্গে নিয়ে চলা। আমাদের ছোটোবেলায় পরিবার থেকে শেখানো হতো সবার সাথে দূরত্ব রেখে চলবার কথা। সেই কথা বার বার কানে বাজছে। মনে হচ্ছে, মানুষের বেপরোয়া মনোভাবকে বর্জন করে এবার চলতে হবে। সতর্কতার সাথে নিজের চারপাশটা গড়তে হবে। সীমাবদ্ধতার মধ্যেই নিয়মতান্ত্রিকভাবে নিজেকে স্থাপন করতে হবে। এভাবেই নিজের চারপাশটা গড়তে হবে। করোনার কারণে মানবজীবনে যে চর্চাগুলো হচ্ছে, তা খুব ভালো চর্চা। তাই করোনা চলে গেলে বা ওষুধ-প্রতিষেধক আবিষ্কার হলেও এই চর্চাগুলো করা প্রয়োজন। তাতে জীবনযাত্রা সুন্দরই হবে। করোনাকে জয় করে মানব সভ্যতা এগিয়ে চলুক - এটাই এখন একমাত্র চাওয়া।

লেখক: সহকারী অধ্যাপক, ব্র্যাক বিশ্ববিদ্যালয়।