করোনাকাল
বিচ্ছিন্ন অনুভব
মাহফুজা হিলালী

প্রবন্ধ
অধ্যাপক আনিসুজ্জামান
শামসুজ্জামান খান

গল্প
ডায়মন্ড লেডি ও পাথর মানব
হামিদ কায়সার

গদ্য
নিদ্রা হরণ করেছিল যে বই
মিনার মনসুর

নিবন্ধ
পঞ্চকবির আসর
সায়কা শর্মিন

বিশ্বসাহিত্য
আইজাক আসিমভের সায়েন্স ফিকশন
অনুবাদ: সোহরাব সুমন

বিশেষ রচনা
প্রথম মহাকাব্যনায়ক গিলগামেশ
কামাল রাহমান

শ্রদ্ধাঞ্জলি
মুজিব জন্মশতবর্ষ
মারুফ রায়হান
 
সাক্ষাৎকার
কথাশিল্পী শওকত আলী

জীবনকথা
রাকীব হাসান

ভ্রমণ
ইম্ফলের দিনরাত্রি
হামিদ কায়সার

ইশতিয়াক আলম
শার্লক হোমস মিউজিয়াম

নিউইর্কের দিনলিপি
আহমাদ মাযহার

শিল্পকলা
রঙের সংগীত, মোমোর মাতিস
ইফতেখারুল ইসলাম

বইমেলার কড়চা
কামরুল হাসান

নাজিম হিকমাতের কবিতা
ভাবানুবাদ: খন্দকার ওমর আনোয়ার

উপন্যাস
আলথুসার
মাসরুর আরেফিন

এবং
কবিতা: করেনাদিনের চরণ

১৭ বর্ষ ০৩ সংখ্যা
অক্টোবর ২০২৪

লেখক-সংবাদ :





ডায়মন্ড লেডি ও পাথর মানব
হামিদ কায়সার
কে নাকি এককোটি টাকা মূল্যের ডায়মন্ড পরে এসেছে। কথাটা কীভাবে হারুন-বিলকিস জুটির ত্রিশতম বিবাহবার্ষিকীর কেক কাটার সময়ই চাউর হয়ে গেল। এবং, ডায়মন্ড পরিহিতাকে দেখার জন্য সবার ভেতরেই চাঞ্চল্যকর ঔৎসুক্য খেলা করতে লাগল।
শাহ জামালের অবশ্য এ-নিয়ে মাথাব্যথা নেই। ও যে দেখে দেখে অভ্যস্ত তা-ও নয়, বরং উলটো, গুলশানের লা রিজা-র মতো পশ রেস্তোরাঁয় ওর এ-জীবনে কখনো পদচারণা ঘটেনি। এ-রকম বড়লোকের মজমাতে আসাও হয়নি আগে। সামান্য একটা সাবেকি আমলের প্রেসের ম্যানেজার ও। যা বেতন পায়, কোনমতো দিন চলে। এমন বর্ণিল জায়গায় আসার মনই বা কোথায়। আজ এসেছে শিল্পপতি এ.ইউ খানের পাল্লায় পড়ে। সন্ধ্যায় খানের ইস্কাটনের বাসায় গিয়েছিল ইলেকশনের পোস্টারের কাজ পাওয়ার ধান্দায়। খানসাব এই প্রথম এমপি ইলেকশন করবেন- নির্বাচনী পোস্টারের কাজটা যদি মিলে মন্দ কি। প্রেস থেকে কিছু কমিশনও জুটত। নেক্সট ইয়ারে পলিকে বিয়ে দিতে হবে। টাকা-পয়সা দরকার। কিন্তু দেড় দু-ঘণ্টাকাল এতিমের মতো খানের ড্রয়িংরুমে বসে থেকেও কথাটা বলার চান্স পেল না। সেক্রেটারির এক কথা, খান সাব আসতাছে। বসেন!
দেড়ঘণ্টা পর ভাবী এমপি মহোদয় যাওবা এলেন, বসলেন না। মোবাইলে কথা বলতে বলতে বাইরের দরজার দিকে যেতে যেতে ওকেও সঙ্গে যাওয়ার ইঙ্গিত করলেন। দামি পাজেরোর সামনে দাঁড়িয়ে পড়েছিল শাহ জামাল। এ.ইউ খান ওকে প্রায় ধাক্কা মেরে পাঠিয়ে দিয়েছে সামনের সিটে। সেক্রেটারিকে পাশে নিয়ে নিজে বসেছে মাঝখানের সিটে। তা গাড়িতে বসেছে সত্য, তার মনোযোগ সব সেই মোবাইলেই, কী যে বকবক, অন্য কোনোদিকে তাকানোর ফুরসৎই পেলেন না। গাড়ি থেকে নেমেও মোবাইলে কথা বলতে বলতে রেস্তোরাঁর গেট যখন পেরুবে, ওর কাঁধে হাত রেখে শুধু জানালেন, ‘বাগবাড়ির কানসু মাতবরের বড়পোলা হারুনরে চিনস? অর আইজকা তিরিশতম বিবাহবার্ষিকী। ভাগাইয়া নিয়া বিয়া করছিল বইলা অনুষ্ঠান করতে পারে নাই তখন। এখন বয়সকালে শখ মিটাইতাছে। বুঝছ না গার্র্মেন্টস-এর কাচা পয়সা! খাওয়া-দাওয়া কর। দেশের মানুষ! যাওয়ার সময় শুনুমনে তর কথা। আহসই তো না! কতদিন পর আইলি ক-ছে!’
কী আর করা! খানসাব যা বলেন, তাই-ই সই। হেয়তো আর হালচাষ করতে বলে নাই। খাওয়া-দাওয়াই তো করতে হবে! তারপর না হয় সুযোগ বুঝে কথাটা তোলা যাবে! সেই থেকে কেবল এ.ইউ খানের লেজে লেজে ঘুরছে। তাছাড়া আর করবেই বা কি! যাবেই বা কোথায়? কোট-টাই পরা সব মানুষজন। মাইয়ামানুষগোর দিকে তো তাকানোই যায় না। যা গর্জিয়াস একেকজনের সাজগোজ! সেই ডায়মন্ডের বেটি না জানি দেখতে কেমন! খানসাবের পিছে ঘুরতে ঘুরতে চোখটাকে একটু লাবণ্যে ভিজিয়ে নিচ্ছিল শাহ জামাল। কতক্ষণ আর বিনা বাক্য ব্যয়ে শুধু দাঁত কেলিয়ে কেলিয়ে থাকা যায়? মাঝে মধ্যেই বিব্রত, নিজেকে গরুর জাবর কাটার মতো লাগছিল। তবে ধাক্কাটা লাগল তখন- যখন এ.ইউ খান এক ভদ্রমহিলার দিকে তাকিয়ে আরেক ভদ্রলোকের উদ্দেশে বলে উঠলেন, ‘এই সেই ডায়মন্ড লেডি। ইন্ডাস্ট্রিয়ালিস্ট টনি হকের মিসেস। চিনিস তো টনিভাইকে? আরে অরিয়ন টেক্সটাইলের মালিক। বিগ শট!’
শাহ জামালের চোখ প্রথমে সে ডায়মন্ডেই গেল। সঙ্গে সঙ্গে চোখ ঝলসেও উঠল। সোনালী শরীরের খোলা বুকের ওপর ঝলমল করছে যেন একখ- সূর্র্য! পুরো আয়োজনটিই যেন হঠাৎ ময়ুরের পেখম মেলে দেয়! শাহ জামাল কখনো এমন ঝা-চকচকে ডায়মন্ডের ঝিলিক দেখেনি। সত্যি বিশেষত্ব আছে বটে জিনিসটার। অভিভূত হওয়ারই মতো। কিন্তু ডায়মন্ডের মালকিনের দিকে তাকিয়েই ওর চোখ ঝলসে যাওয়ার অবস্থা। মাহজাবীন! কী করে সম্ভব! এক সময়ের ডাকসাইটে বামপন্থী ছাত্রনেত্রী এখন পরে আছে শহরের সবচেয়ে দামী ডায়মন্ড! সেটা হলেও না হয় কথা ছিল- জাবীন যে ছিল ওর জীবনেরই খ-াংশ! ভাবা যায়? খান এগিয়ে যাচ্ছেন মিসেস টনি হকের দিকে। ‘স্লামুআলাইকুম ভাবী। দারুণ লাগছে! একেবারে আকাশের তারা নামিয়ে দিয়েছেন কিন্তু।’
শাহ জামাল এগোতে পারে না। পা যেন আটকে আছে মেঝেতে। তুমি আমাকে জীবনে কত স্বপ্ন দেখিয়েছিলে মেয়ে! দুজনে সারাজীবন শোষিত মানুষের জন্য কাজ করে যাব। সমাজ থেকে শ্রেণি-বৈষম্য ঝেটিয়ে বিদেয় করবো... তারপর আরো কতো স্বপ্নচারিতা- বিয়ের, ভালোবাসার! সেই তুমি আমাকে আচমকাই ঝড়ে একা ফেলে, চুপিসারে ছেড়ে গিয়েছ! উফ কী যে দুঃসহ সেসব দিন। ক্রেন দিয়ে ইউরোপ থেকে প্রতিদিন নামিয়ে ফেলা হচ্ছে লেনিনের মূর্তি। বিচারের কাঠগড়ায় দাঁড় করানো হচ্ছে চসেস্কুদের! ভাঙনের সেই দিনে মধুর ক্যান্টিনে একদিন মাহজাবীনের জন্য অপেক্ষায় থাকতে থাকতে দিনের আলো নিভে এলো ওর, সন্ধ্যার অন্ধকার এলো ঘনিয়ে। জমাট সেই কালো প্রতীক্ষাময় অন্ধকারের অবসান আর হলো না। জাবীন এলো না ক্যাম্পাসেই। শেষে আর থাকতে না পেরে ওদের উত্তরার বাসায় ফোন, কেউ ধরলো না। এরপর আরো কত দিন রাত! এমনকি একদিন বাসায় গিয়েও সাড়া মিললো না। গেট থেকেই একজন জানিয়ে দিল, জাবীন নেই। দেশের বাইরে। অনেক অনেকদিন পর, একদিন শুধু শুনল, বিশাল এক শিল্পপতির ছেলের সঙ্গে বিয়ে হয়েছে জাবীনের। উচ্চপদস্থ সরকারি কর্মকর্তার মেয়ে নিছক রোমান্টিকতাবশত বিপ্লবী দলে নাম লিখিয়েছিল, এ-কথাটা তখনো বিশ্বাস করতে মন চায়নি। শাহ জামাল ভেবেছিল, জাবীন হয়ত অবস্থার শিকার। কিন্তু আজ সব সংশয় দূর হলো ওর। আসলে মেয়েটা রক্তের ধারায় বয়ে বেড়াচ্ছে আভিজাত্য, ক্ষমতা আর দম্ভ। শরীর ফুলেফেপে স্বাস্থ্যের কি ছিরি! মনে হচ্ছে যেন হাতির বাচ্চা। জাবীন যে আসলেই অভিজাত শ্রেণির কৃত্রিম মানুষ, সে সত্য আরো বেঢপভাবে প্রকাশ পেল এ.ইউ খানের কথা থেকেই; তিনি আরেক বন্ধুকে বলছিলেন, ‘জানিস মাহজাবীন ভাবী একবার কী করেছিল। জয়পুর গেছে বেড়াতে। এক দোকানে একশো শাড়ি পছন্দ হলো। ভাবী ১০০ শাড়িই কিনে ফেলল।’
‘মাই গড! তাই নাকি?’ আসফ খানের বিস্ময়।
জাবীনও স্বতস্ফূর্ত, ‘কোনটা রেখে কোনটা নেব ভাই! কি যে ডিজাইন একেকটার! বাধ্য হয়ে সব কটাই নিলাম! জীবনে সাধ-আহলাদের উপর কি আছে বলেন!’
অথচ কত সিম্পল থাকত ক্যাম্পাসে! রঙহীন বিবর্ণ সালোয়ার-কামিজ। পায়ে সাধারণ স্যান্ডেল। মাঝে মধ্যে যে সাজত না তা নয়, বসন্ত-পহেলা বৈশাখের মতো দিনগুলোতে শাড়ি পরত। খোপায় গুঁজে রাখত ফুল। কখনো শাহ জামালের নজরে না পড়লে কী যে অভিমান! জাবীন আজ তুমি ঠিকই নজরে পড়েছ! শুধু আমার নয়। এই উৎসবে যারা এসেছে- সবাই তোমাকে মনে মনে খুঁজছে, একনজর দেখতে চাইছে!
জানো, কেমন লাগছে তোমাকে? তোমার ডায়মন্ডের মতো তো নয়ই। ওটার কাছে তুমি বড় ম্রিয়মান। অনেক স্থূল তুমি! বড়ো বেশি মাংসময়। মাংস থকথক করছে তোমার গালে-গলায়-বুকে-পেটে-নিতম্বের দোলায়। তোমার সেই ছিপছিপে বেতের মত শরীরটা গেল কোথায়? তুমি যখন ক্যাম্পাসে আমার পাশে হাঁটতে, যুবকরা আমার দিকে জেলাসি চোখে তাকাত। যখন আমরা লাইব্রেরির পেছনে, টিএসসির ভেতরের মাঠে বসে থাকতাম- আমি তোমার দিকে অপলকে চেয়ে থাকতাম। তুমি লজ্জায় চোখ নামিয়ে নিতে। কোথায় তোমার সেই অনুরাগ ভরা দৃষ্টি! লাবণ্যের সেই ছাঁচ, দীপ্তি সকল! জাবীন তোমাকে দেখে মনে হচ্ছে বসন্তের দিনে হঠাৎ ঝড় এসে বেসামাল করে গিয়েছে আমগাছের বউল। শিলার তান্ডবে তছনছ হয়ে গেছে ধানী-জমি। জাবীন যদি রাগ করতে পারতাম, এই মুহূর্তে তোমার গালে সপাং একটা থাপড় বসাতাম! কেন আমাকে সেদিন ভালোবাসার ফাঁদে ফেলেছিলে। বেশতো ছিলাম মিছিল নিয়ে, পড়াশোনা নিয়ে, নিজের জগত নিযে। পায়ে ছিল গ্রামের মাটি। সে মাটি নিয়ে গর্বে দাপিয়ে বেড়াতাম পুরো ক্যাম্পাস। অগ্নিঝরা বক্তৃতায় গরম করে ফেলতাম তারুণ্যের রক্ত।
সে-বক্তৃতা শুনেই তো তুমি এসেছিলে কাছে! সেদিন তোমার চোখই বলেছিল সব কথা। আমার আর পিছু ফিরে দেখার কিছু ছিল না। বেতের ফলার মতো চোখ যে মেয়ের- তাকে কে না মনে মনে কামনা করে? কে না নিজের জীবনে আপন করে পেতে চায়? আর তখন আসলে আমাদের স্বপ্ন বা ভাবনাগুলো ঠিক নিজেদের ঘিরে ছিল না। দেশ-মানুষ-সমাজতন্ত্র! সেই বৃত্ত থেকে বের করে তুমিই তো আমার মনে জাগিয়েছিলে ভালোবাসার ঢেউ! তবে কি সবই ছিল মিথ্যে, সাজানো? নাকি সবই শুধু বয়সের খেয়াল। বড়লোকের মেয়ের যথেচ্ছারিতা অথবা খেলো রোমান্টিকতা? যেমন করে কমিউনিস্ট পার্টি করতে, মিছিলে যেতে, একই দৃষ্টিকোণ থেকে মফস্বলের এক যুবককে ভালোবাসা! তাই বুঝি বাস্তবের অলিন্দে পৌঁছে সবকিছু অলীক মনে হতে একটুকুও সময় লাগেনি।
শাহ জামাল প্ল্যান করল সামনে যাবে না জাবীনের। রাগ-অভিমান ও কার সঙ্গে দেখাবে? সেই মন কি আর জাবীনের আছে! তাছাড়া দৈন্য দেখাতেও ইচ্ছে করছে না। নিজের পোশাকের দিকে একবার আড়চোখে তাকাল। সাধারণ থেকেও সাধারণতরো। ও কি আর জানত এভাবে গুলশানের এক পার্টিতে আসতে হবে? আর জানা থাকলেই বা কি! বাসায় বুঝি বস্তায় বস্তায় শার্ট-প্যান্ট রাখা রয়েছে? জীবন থেকে জাবীন সরে যাওয়ার পর কেমন এক নিরাসক্তি এলো। দলীয় কর্মকান্ডেও ছিল বেশ কদিন নিস্ক্রিয়। তারপর আবার বিষাদ ঝেটিয়ে সক্রিয় হয়েছে। বলা যায়, যৌবনের প্রায় পুরোটাই কেটেছে শ্রেণি-বৈষম্য ঘোচানোর স্বপ্নে-স্বপ্নে। তারপর যখন যৌবনের ধার এলো কমে, বিয়ে করতে হলো বাবা-মায়ের চাপে, ক্রমে ক্রমে সংসারের ভার বহন করাটাও হয়ে পড়ল অসম্ভব কঠিন- পার্টির সঙ্গেও ঘুচে গেল সম্পর্ক- ঘুচবে না? পার্টিও তখন হয়ে উঠেছে এক ধরনের লোক দেখানো ব্যাপার। কেউ ব্যাংকের বড় পোস্টে চাকরি করছে, কেউ খুলে বসেছে এনজিও, কেউ আবার ঢাকায় চার-পাঁচটা বাড়ির মালিক। খেয়ে-পরে বাঁচার জন্য ও-ও ছুটলো জীবিকার পেছনে! কিন্তু ততক্ষণে শরীরে বয়স বসিয়ে দিয়েছে মরণকামড়। হার্টে ব্লক, রক্তে ডায়াবেটিস। আত্মবিশ্বাস হারাতে হারাতে শূন্যের কোঠায়। মানসিকভাবেও আজকাল বড় বিপন্ন লাগে। নিজের হাতের আঙুলের দিকে তাকিয়ে ও আরো বেশি আড়ষ্ট হয়ে যায়, আঙুলে আঙুলে গোমেদ, নীলা, পান্না, পোখরাজ। জ্যোতিষি মনোমোহন ভাগ্যরত্ন যখন যেটা পরতে বলেছে, অকাতরে তা গ্রহণ করেছে। এইসব পাথর এবং ভাগ্যে কেমন একটা অদ্ভুত বিশ্বাসও জন্মেছে! কিন্তু আজ এখানে পাথরসমেত হাতে জাবীনের সামনে যেতে কেমন বাঁধো বাঁধো ঠেকছে। ওর যে সাহসী এবং শানানো ব্যক্তিত্বকে ভালোবেসেছিল জাবীন- সে পরিচয়টাকে মুছে দিতে মন একেবারেই সায় দিচ্ছিল না।
শাহ জামাল চুপিচুপি সরে এল আনোয়ারউদ্দিন খানের পাশ থেকে। দাঁড়িয়ে রইল একলা একা কোণার ধবল অন্ধকারে, যেন জাবীনের চোখে কোনোমতেই না পড়ে। একটু পরই হয়ত আশা করা যায়, খানকে জুতমতো পাবে। কেননা, সবাই খাওয়ার টেবিলে বসে যাচ্ছে। এই রে! খান যদি জাবীনের সঙ্গেই এক টেবিলে জুটে যায়! আহা বসুক না! আমি খুঁজে নেব অন্য টেবিল। কিন্তু খাওয়ার হট্টরোলে যদি খান হারিয়ে যায়? না না, খানসাবকে হারানো যাবে না! শাহ জামাল এ.ইউ খানকে নজরে ধরে ঠায় দাঁড়িয়ে থাকে। খুব বেশিক্ষণ অপেক্ষা করতে হয় না ওকে। কী এক কথায় খান হাসতে হাসতে গড়িয়ে, নিজেকে পড়া থেকে ঠেকিয়ে খাবার টেবিলের দিকে ধীর পায় এগিয়ে যাচ্ছেন। জাবীনরা নেই। অন্যদিকে ঝুঁকেছে। শাহ জামাল তীরের ফলার মতো ছুটে এ.ইউ খানের পাশেই লাগোয়া চেয়ারটিতে বসে যায়।
খেতে বসেও শান্তি নেই। শাহ জামাল আনোয়ারউদ্দিন খানকে যে খুলে বলবে কথাটা, সে মেজাজেই ওকে পাওয়া গেল না। একবার সামনের জনের শরীরের খোঁজ তো আরেকবার পাশেরজনের ব্যবসার কী অবস্থা! একের পর এক লাগাতার। ধ্বস্তবিধ্বস্ত শাহ জামাল অগত্যা খাওয়ায় মনোযোগী হতে চেষ্টা করলো। খাবে আর কি? টেবিলে পোলাও-মাংস, কুর্মা-কালিয়া, কাবাব-রুটি আরো কী-সব! প্রায় সবই তো নিষিদ্ধ। ডাক্তার কড়া গলায় জানিয়েছে, ঘৃত-তেলের খাবার খাওয়া যাবে না। পারলে তেলছাড়া রান্না খান। কথাটা মেনেও এসেছে শাহ জামাল। কিন্তু আজ আর পারল না। না খেতে পারা মানে তুমি দুর্বল অসুস্থ, তুমি বাতিল হয়ে গেছ সমাজে, তুমি একটা রদ্দি মাল। না না, আমি অতো সহজে হারতে রাজি নই, আমাকে কে বাতিল করবে করুক তো! রোস্ট একটার জায়গায় দুটো খেল। প্লেটের পর প্লেট পোলাও নিল। যেন আবারো সেই যৌবনের দিন ফিরে পাওয়া। যেখান থেকে শুরু করা যাবে সব নতুন করে!
অনেকদিন পর বেশ পেটপুরেই খেল শাহ জামাল। খাওয়া শেষ করে ওয়াশরুমে গেল হাত ধুতে। হাত ধুয়ে কেবল ঘুরে দাঁড়িয়েছে কী দাঁড়ায়নি, তখনই বড় আকস্মিকভাবে জাবীনের একেবারে মুখোমুখি। জাবীন আচমকাই ভূতদেখা চমকে শাড়ি দিয়ে ঢেকে ফেলল ওর খোলা বুকের ডায়মন্ড। এমনকি কান পর্যন্ত যেন চাইছে আড়াল করতে। হাত দুটোও রাখতে চাইছে শাড়ির আঁচলের নিচে। কিন্তু লাভ কি! জাবীনের দুকানে স্বর্ণের বিশাল দুটো দুল। গলার হারটাও বেশ ভারী। হাতের কবজি থেকে প্রায় বাহু পর্র্যন্ত নানা অলংকার। চুড়ি ব্রেসলেট এটা সেটা। কোনটা রেখে কোনটা আড়াল করবে? ভালো লাগল এতো বছর পরও দামী এবং ভারী সাজসজ্জায় থাকার জন্য জাবীন যে ওকে দেখে বিব্রত- সেটা চাক্ষুস করে। শাহ জামালের এ-মুহূর্তে বাজি ধরে বলতে ইচ্ছে করছে, জাবীন যদি ভুলেও কখনো কল্পনা করতে পারত, শাহ জামাল দেশের একজন চোরাকারবারি শিল্পপতির বাসায় বিবাহবার্ষিকীর দাওয়াত খেতে আসতে পারে, কখনো এবং কোনো অবস্থাতেই এমন দামী এবং বিলাসবহুল সাজসজ্জায় উপস্থিত থাকতে পারত না। ও যেমন এখানে এই পরিবেশে শাহ জামালকে নিতে পারছে না, শাহ জামালও যে তেমনি এ-রকম দামী বিলাসবহুল সাজে ওকে দেখবে, এটাও বুঝি ওর পক্ষে একটা অচিন্তনীয় ব্যাপার। কারণ, ওরা যে একজন আরেকজনকে চিনেছিল-মিছিলে মিছিলে, টিয়ার গ্যাসে, অপরাজেয় বাংলার চাঁদের জোছনাজলে। মন হু হু করে উঠল শাহ জামালের। তুমি হাতে একটা কাঁচের চুড়ি পর্যন্ত পরতে না জাবীন। একটা চুড়ি পর্যন্ত না।
মাহজাবীন ঝটপট সামলে নিল নিজেকে। তারপর সপ্রতিভ হওয়ার চেষ্টা। ‘জহুর, ও জামাল! ভার্সিটিতে আমার ব্যাচমেট ছিল। আর জামাল, হি ইজ মাই লাইফ পার্টনার। জহুর।’ দশাসই চেহারার মানুষটা শাহ জামালের দিকে স্বতস্ফূর্ত ভঙ্গিতে হাত বাড়িয়ে দেয় হ্যান্ডশেকের জন্য। শাহ জামাল হাতটা, ওর ডান হাতটা ত্বরিৎ এবং ক্ষিপ্র বেগে প্যান্টের পকেটে ঢুকিয়ে দেয়। দেয় তো দেই-ই। বের করে না। ভদ্রলোকের হাতটা ওর বুকের কাছে সামনে স্থির হয়ে আছে। শাহ জামাল ঘামছে। কী করে মেলাবে হাত! ওর চারটা আঙুলে যে চারটা পাথর। গোমেদ, নীলা, পান্না, পোখরাজ। জাবীন যে পাথরগুলো দেখে ফেলবে! দেখে ফেলবে একজন প্রচন্ড আত্মবিশ্বাসী আর সাহসী মানুষের হাড়গোড় কংকাল। ভদ্রলোক হাতটা নামাচ্ছে না কেন? শাহ জামাল টের পায় পকেটের ভেতর ওর আঙুলের পাথরগুলো একটা আরেকটার সাথে ঠোকাঠুকি করছে!

ব্যবহৃত শিল্পকর্ম: রেবেকা সুলতানা মলি