ট্রিপল জি. স্পেসশিপটি হাইপার স্পেসের শূন্যতা আর স্থান-কালের সমগ্রতার মাঝে নীরবে ঝলকে ওঠে। প্রকা- নক্ষত্রগুচ্ছ হারকিউলিসের আভার দিকে ধেয়ে যায়।
আলতোভাবে এটি মহাশূন্যে ভেসে থাকে, চারদিকে সূর্য আর সূর্য আর সূর্য দিয়ে ঘেরা, এদের প্রতিটির আবার ছোট্ট ধাতব বুদ্বুদের তীব্র টানে আলাদা একটি মাধ্যাকর্ষণ ক্ষেত্রকে কেন্দ্র করে অবস্থান করছে। তবে জাহাজটির কম্পিউটর খুব ভালোভাবেই কাজ করছে এবং এটি একেবারে নিখুঁত অবস্থানেই রয়েছে। লাগরানজ সৌরজগতে- সাধারণ মহাকাশ-চালনায়- তা একদিনের ভ্রমণ।
এই বাস্তবতা মানবচালিত বিভিন্ন জাহাজে হেরফের হতে দেখা যায়। একজন ক্রুর জন্য, এটি অতিরিক্ত একদিনের কাজ এবং অতিরিক্ত একদিনের ফ্লাইট মাইনে আর তারপর ঠেস বিশ্রাম। তারা যে গ্রহটিকে লক্ষ করে এগিয়ে যাচ্ছে তা বসতিশূন্য, তবে কোন গ্রহাণুর মাঝেও ঠেস বিশ্রাম হয়ে উঠতে পারে আনন্দদায়ক একটি মধ্যবর্তী বিরতি। যাত্রীদের সম্ভাব্য মতের অমিল নিয়ে তাদের কোন রকম ঝামেলায় পড়তে হয় না।
বরং বাস্তবে ক্রুরা যাত্রীদের অবজ্ঞাভরে এড়িয়ে চলে।
বুদ্ধিজীবীর দল!
আর তারা এমনই, একজন ছাড়া বাকী সবাই। বিজ্ঞানী, সবচেয়ে বিনয়ী শব্দ-এবং আলাদা একটি অংশ। এদের একটি সাধারণ আবেগের সবচেয়ে কাছাকাছি বহিঃপ্রকাশ এমন যেন নিজেদের যন্ত্রপাতিগুলো নিয়ে চূড়ান্ত অস্বস্তিতে ভুগে, শেষ বারের মতো হালকাভাবে খতিয়ে দেখবার ইচ্ছে।
এবং সম্ভবত সামান্য পরিমাণে মানসিক চাপ আর দুশ্চিন্তা বেড়ে যায়। গ্রহটি ছিল জনমানব শূন্য। সবাই বেশ কয়েকবার করে কঠোরভাবে নিজের এই বিশ^াসের কথা জানান দেয়। তবে, প্রত্যেকের ভাবনাগুলো তাদের নিজস্ব।
মহাকাশ যানটির একজন অদ্ভুত লোক- সে কোন চালক বা বাস্তবে একজন বিজ্ঞানীও নয়- তার সবচেয়ে সঙ্গীন অনুভূতির একটি মারাত্মক ক্লান্তি উপভোগ করছে। খুব মলিনভাবে নিজের পায়ের দিকে চেয়ে থেকে সে মহাকাশ-বমনেচ্ছার সবশেষ পর্যায়ের সাথে লাড়াই করছে। তার নাম মার্ক আননুনচো। আজ টানা চারদিন ধরে সে বিছানায় পড়ে আছে। বলতে গেলে কিছুই খায়নি। এ সময় আলোকবর্ষের স্থান-কাল পেরিয়ে মহাবিশ^ চষে বেড়াবার সময় অসংখ্য বার মহাকাশ যানটি সামনে পেছনে দুলে উঠেছে।
কিন্তু এখন তার মনে হচ্ছে আসন্ন মৃত্যু বুঝি অনেকটাই অনিশ্চিত এবং তাকে ক্যাপটেনের ডাকে সারা দিতে হবে। নিজের আড়ষ্ট আচরণের কারণে, মার্ক সেই ডাকে বিরক্ত বোধ করে। সে নিজের মতো করে চলতে অভ্যস্ত, যা দেখতে ইচ্ছে সে তাই দেখে। ক্যাপটেনের কাছে আবার কে যায়-
এই প্রবণতা তাকে এব্যপারে বলবার জন্য ড. সেফিল্ড এর কাছে ফিরিয়ে নিয়ে যায় এবং তা এ পর্যন্তই সীমাবদ্ধ থাকতে পারত।
কিন্তু মার্ক ছিল খুবই কৌতূহলী, তাই সে জানত তাকে যেতেই হবে।
এটাই ছিল তার সবচেয়ে বড় দোষ। কৌতূহল!
ঘটনাক্রমে এটাই তার পেশা হতে যাচ্ছে এবং জীবনে তার মিশন।
২.
ট্রিপল জি’র ক্যাপটেন ফলেনসবি একজন ভাবাবেগহীন মানুষ। নিজেকে তিনি এমন ভাবতেই অভ্যস্ত। ভ্রমণের আগে তিনি সরকারী-সহায়তা যোগাড় করেছেন। এ কারণে তারা লাভজনক অবস্থানে রয়েছে। রাষ্ট্রসভা এনিয়ে কোন রকম দরকষাকষি করেনি। এর মানে প্রতিবার তার মহাকাশ যান খুঁটিয়ে পরীক্ষা করা, ত্রুটিপূর্ণ কলকব্জা বদলানো, ক্রুর জন্য উদার সব শর্ত। খুব ভালো ব্যবসা। মারাত্মক ভালো ব্যবসা।
তবে এবারের এই ভ্রমণ, অবশ্যই, খানিকটা আলাদা।
এতে তিনি আলাদা দলবদ্ধ খুব বেশী যাত্রী তোলেননি। (তিনি আশা করেছিলেন অস্থির স্বভাবের, রাগি, আর অসম্ভব বোকাটে কিছু লোক জুটবে কিন্তু বোঝা গেল বুদ্ধিজীবীরা অনেকটাই সাধারণ মানুষদের মতো।) এমন নয় যে তার জাহাজের অর্ধেকটা বিধ্বস্ত হয়েছে এবং তথাকথিত “ইউনিভার্সেল সেন্ট্রাল-একসেস ল্যাবরেটরি” এর সঙ্গে চুক্তি করে তা পুনর্নির্মাণ করা হয়েছে। বাস্তবে, এবং তিনি এধরনের চিন্তা-ভাবনাকে ঘৃণা করেন। তাদের সামনে এখন “জুনিয়র” নামের গ্রহটি ভেসে বেড়াচ্ছে।
অবশ্যই, ক্রুরা জানত না, তবে সে, নিজে, ভাবাবেগহীন এবং সবাই, অপ্রিয় বিষয়টি টের পেতে শুরু করে।
তবে তা কেবল শুরু- ঠিক সেই মুহূর্তে, সে নিজেকে বলে, এই সেই মার্ক আননুনচো, যদি এটাই সেই নাম হয়ে থাকে, যে কী-না তাকে বিরক্ত করছে। সে এক হাতের তালুর উল্টা পাশ দিয়ে আরেক হাতের তালুর ওপর চাটি মারে এবং ক্ষুব্ধভাবে বিষয়টি নিয়ে ভাবে। তার বিশাল, গোলাকার মুখখানা ছিল লালচে আর বিরক্ত।
ধৃষ্টতা!
একটি ছেলে বয়স বিশের বেশী নয়, যাত্রীদের মাঝে তার এমন কোন অবস্থান নেই, যে এধরনের একটি অনুরোধ করতে পারে।
এর পেছনে কী আছে? অন্তত তা বের করেতে হবে।
তার মেজাজ খারাপ থাকায়, জ্যাকেটের কলার মুঠো করে ধরে সবকিছু বের করে আনবার ইচ্ছে হয়। দাঁত কড়মড় করে ওঠে। কিন্তু তা ঠিক হবে না- মোটেই ঠিক হবে না-
অন্তত, এটা রাষ্ট্রীয় ব্যয়ে পরিচালিত একটি ফ্লাইট, এবং বিশ বছর বয়সের, অতিকৌতুহলী ছটফটে পর্যটক এই অপ্রচলিত ভ্রমণের অবিচ্ছেদ্য একটি অংশ। সে কেন এই জাহাজে আছে? বলা যেতে পারে, এখানে যে ড. সেফিল্ড আছেন ছেলেটির সেবক হিসেবে কাজ করা ছাড়া তার আর কিছু করবার নেই। কেনই বা তা করতে হবে? কে এই আননুনচো?
সে যাত্রাকালের পুরোটা সময় জুড়ে অসুস্থ, বা এ কি তার কেবিনে পুরে রাখার মতো কেবল একটি ডিভাইস-
দারজায় সিগনাল বেজে উঠলে একটি আলো ঝলকে ওঠে।
এ সেই ছেলেটিই হবে।
স্বাভাবিক থাকি, ক্যাপ্টেন ভাবেন। একটু স্বাভাবিক।
৩
মার্ক আননুনচো ক্যাপ্টেনের কেবিনে ঢুকে নিজের মুখের তেঁতো ভাবটুকু বিদায় করবার বৃথা চেষ্টা করে ঠোঁট জোড়া চাটে। মাথাটা ফাঁকা আর বিমর্ষ মনে হয়।
ঠিক সেই মুহূর্তে, সে পৃথিবীতে ফিরে যাবার কথা মেনে নেয়।
সে দিবাস্বপ্নে তার ছোট্ট ব্যাক্তিগত পরিচিত কামরাটির কথা ভাবে; নিজের মতো করে একা থাকবার একটি জায়গা। সেখানে কেবল একটি বিছানা, ডেস্ক, আর আলমারি, তবে বিনামূল্যে তার সব কেন্দ্রীয় পাঠাগার ব্যবহারের সুযোগ রয়েছে। এখানে সেসবের কিছুই নেই। সে ভাবে মহাকাশ যান নিয়ে তার আরো অনেক কিছু শেখার আছে। এর আগে সে কখনো মাহাকাশ যানে চড়েনি। কিন্তু এভাবে দিনের পর দিন অসুস্থ থাকবে তা মোটেই আশা করেনি।
সে এতটাই ঘরকাতর ছিল যে কাঁদতেও পারছিল না, এবং তার চোখ দুটি লালচে আর ভেজা ছিল এবং ক্যাপটেন তা দেখতে পাচ্ছিলেন বুঝতে পারায় নিজের ওপর তার ভীষণ রাগ হয়। তার শরীরখানা খুব চওড়া আর প্রশস্ত নয়; দেখতে অনেকটা ইঁদুরের মতো বলে নিজের ওপর তার ঘৃণা জন্মায়।
এক কথায় বলতে গেলে, তার চেহারা ছিল এমন। তার চুলগুলো ছিল ইঁদুর-বাদামী তা রেশমি সোজা ছাড়া আর কিছু নয়; সরু, পেছনের দিকে ঢালু একটি থুতনি, ছোট্ট একটি মুখ, আর সুচালো একটি নাক। আহ! এই বিভ্রম পুরা করতে নাকের দুপাশে তার পাঁচ কি ছয়টা করে কমনীয় গোঁফের দরকার ছিল। আর তার উচ্চতা ছিল স্বাভাবিকের চেয়ে কম।
এবং এরপর সে ক্যাপটেনের পর্যবেক্ষণ জানালা দিয়ে আকাশ ভরা তারা দেখতে পায় আর নিঃশ^াস বেরিয়ে আসে।
তারা!
এরকম তারা সে আগে কখনও দেখেনি।
মার্ক আগে কখনও পৃথিবী নামের গ্রহ ছেড়ে বাইরে যায়নি। (ড. শেফিল্ড তাকে বলে একারণেই সে স্পেস-সিক। মার্ক তার কথা বিশ^াস করে না। সে আলাদা পঞ্চাশটি বই পড়ে জেনেছে স্পেস-সিকনেস হলো মানসিক। এমনকি ড. শেফিল্ডও কখনও কখনও তাকে বোকা বানাবার চেষ্টা করে।) সে আগে কখনও পৃথিবী ছাড়েনি, আর সে পৃথিবীর আকাশে অভ্যস্ত। সে কেবল প্রথম উজ্জ্বলতা থেকে দশ পর্যন্ত আকাশের অর্ধেক বলয় জুড়ে ছড়িয়ে থাকা দুই হাজার তারা দেখে অভ্যস্ত। কিন্তু এখানে ওদের সাংঘাতিক রকমের ভিড়। শুধু ছোট্ট একটি চারকোনা ক্ষেত্রের ভেতর পৃথিবীর আকাশের চেয়ে দশগুণ। এবং স্পষ্ট!
সে লোভীর মতো মনে মনে তারার নকশা গুছিয়ে নেয়। এসব তাকে আচ্ছন্ন করে। হারকিউলিশ বুরুশের মাঝে ঘুপটি মেরে থাকা আকৃতিগুলো তার অবশ্যই চেনা। এতে দশ লাখ থেকে এক কোটি নক্ষত্র রয়েছে (যদিও এ পর্যন্ত সঠিক শুমারি হয়নি), তবে ছবি এক জিনিস আর তারা অন্য জিনিস।
ওগুলোকে তার গুণতে ইচ্ছে হয়। এটা তাকে অভিভূত করে। সে সংখ্যা সম্পর্কে কৌতুহলী। এদের সবার একটি করে নাম থাকলে সে খুব অবাক হবে; সবগুলো সম্পর্কে যদি কোন জ্যোতিঃশাস্ত্রীয় তথ্য থাকত। দেখা যাক...
ওগুলোকে সে একশটি গুচ্ছে গণনা করে। দুই- তিন- সে শুধু মনে মনে দেখা আকৃতির ব্যবহার করে, তবে অদ্ভুত সুন্দর মনে হলে সেগুলোকে সত্যিকার শরীরের অবয়বে ভাবতেও তার ভালো লাগে- ছয়- সাত-
ক্যাপটেনের আন্তরিক কণ্ঠস্বর তার ওপর ছড়িয়ে পড়ে এবং তাকে জাহাজের ভেতর ফিরিয়ে আনে।
“মিস্টার আননুনসো।”
মার্ক বিস্ময় আর বিরক্তিতে তাকায়। কেন তার গোনায় বাধা দেয়া হলো?
সে বিরক্তির সাথে বলে ওঠে, “ওই যে তারা!” এবং সেদিকে দেখায়।
ক্যাপটেন দেখবার জন্য পেছন ফিরে। “ওগুলোর আবার কী হলো? কোনো সমস্যা?”
মার্ক ক্যাপটেনের চওড়া পিঠ আর স্ফিত পাছার দিকে তাকায়। সে ক্যাপটেনের মাথা ছেয়ে থাকা খাটো ধূসর চুলের দিকে তাকায়, সে তার প্রকা- দুই হাতের মোটা মোটা আঙ্গুলগুলো পেছনের দিকে একত্রে ধরে থেকে জ্যাকেটের চকচকে প্লাসটেক্সের ওপর তালে তালে ঝাপটাচ্ছে।
মার্ক ভাবে, কেন সে তারাগুলো নিয়ে মাথা ঘামাচ্ছে? সে কি ওদের আকার আকৃতি, উজ্জ্বলতা আর বর্ণালি শ্রেণী নিয়ে ভেবে দেখেছে?
তার নিচের ঠোঁটখানা কেঁপে ওঠে। ক্যাপটেন ননকম্পোস। জাহাজের সবাই-ই একেকজন ননকম্পোস। একারণেই তাদের কাজ থেকে ফিরে যেতে বলা হয়েছে। ননকম্পোস। সবাই। কম্পিউটরের সাহায্য ছাড়া পনর’র পর্যন্ত ঘন করতে পারবে না।
মার্ক খুব নিঃসঙ্গ বোধ করে।
সে প্রশ্নটি এড়িয়ে যায় (বুঝিয়ে বলার কোন মানে হয় না) এবং বলে, “এখানে তারা খুব ঘন। মটরশুঁটির স্যুপের মতো।”
সবই হাজির, মিস্টার আননুনসো।” (ক্যাপটেন মার্কের নাম চ-এর বদলে স দিয়ে উচ্চারণ করে আর তা মার্কের কানে লাগে।) “নিবিড়তম এই বুরুশের তারাগুলোর মাঝে গড় দুরত্ব এক আলোকবর্ষের চেয়েও বেশী। মাঝে অনেক ফাঁকা জায়গা তাই না? তবুও ঘন বলেই মনে হচ্ছে। তা তোমাকে মেনে নিতেই হবে। যদি আলো বেরিয়ে আসতে পারত, তাহলে ওগুলো একটি আন্দালিত শক্তি ক্ষেত্রে লক্ষ কোটি চিজাম রঞ্জকের মতো ঝিলিক মারত।”
তবে সে আলো বের করে আনার প্রস্তাব দেয় না আর মার্কও এ নিয়ে তাকে কোনকিছু জিজ্ঞেস করে না।
ক্যাপটেন বলে, “বসুন, মিস্টার মার্ক আনুনসো। দাঁড়িয়ে থেকে কোন লাভ নেই, তাই না? আপনি সিগারেট খান? আমি খেলে কিছু মনে করবেন? সকালে এসে আপনি এখানে থাকতে পারছেন না বলে খারাপ লাগছে। মহাকাশের বেলা ছয়টার সময় লাগরানজ এক আর দুইকে দেখতে খুব সুন্দর দেখায়। লাল আর সবুজ। ঠিক ট্রাফিক বাতির মতো, তাই না? সারাটা পথ আপনাকে মনে পড়েছে। মহাকাশে পাগুলোকে শাক্তিশালি করা দরকার, হুম? সে এতো জোড়ে “হুম” বলে যে মার্কের কাছে তা ভীষণ বিরক্তিকর বলে মনে হয়।
মার্ক মৃদু স্বরে বলে, “আমি এখন ঠিক আছি।” মনে হয় ক্যাপটেন হতাশাজনক কিছু একটা খুঁজে পেয়েছেন। সে তার সিগারে টান দেয় আর ভ্রু কুঁচকে মার্কের দিকে তাকায়। সে ধীরে ধীরে বলে, “যাই হোক, আপনাকে দেখতে পেয়ে বেশ ভালো লাগছে। একটু পরিচিত হওয়া আরকি। হাত মেলানো। ট্রিপল জি সরকার-অনুমোদিত প্রমোদ তরীগুলোর একটি। কোন সমস্য নেই। কখনও কোন সমস্যা হয়নি। ভবিষ্যতেও কোন সমস্যা হবে না। বুঝতে পারছেন আপনি।”
মার্ক এর কিছুই বুঝে উঠতে পারে না। চেষ্টা করে সে ক্লান্ত। তার চোখ জোড়া ক্ষুধার্তভাবে পেছনের তারাগুলোর দিকে চেয়ে আছে। এরই মধ্যে ওর আকৃতি সামান্য বদলেছে।
মুহূর্তের জন্য ক্যাপটেন তার চোখের দিকে তাকায়। সে ভ্রু কুঁচকায় এবং মনে হচ্ছিল সংশয় নিয়ে কাঁধ উঁচু করতেই ওর কিনারা বরাবর কেঁপে উঠল। সে নিয়ন্ত্রণ প্যানেলের দিকে এগিয়ে যায়, আর সামনের পর্যবেক্ষণ জানালার আড়াআড়ি ধাতব অংশটি প্রকা- একটি চোখের পাতার মতো পিছলে যায়।
মার্ক চিৎকার করে, উত্তেজনায় লাফিয়ে ওঠে, “কী অদ্ভূত আইডিয়া! আমি ওগুলো গুনব, বোকা কোথাকার।”
“গুনবে-” ক্যাপটেন উত্তেজিত হয়ে উঠলেও, বলার ধাঁচে ন¤্রতা বজায় রাখেন। তিনি বলেন, “দুঃখিত!” কারবারটা নিয়ে আমাদের অবশ্যই খানিকটা আলোচনা করা দরকার।”
সে “কারবার” শব্দটিতে আলতো করে জোড় দেয়।
মার্ক জানে তিনি কী বোঝাতে চাইছেন। “এ নিয়ে আলোচনার কিছু নেই। আমি জাহাজের লগ দেখতে চাই। কথাটা বলার জন্য আমি আপনাকে ঘণ্টা খানেক আগে ফোন করেছিলাম। আপনি আমাকে দেরি করিয়ে দিচ্ছেন।”
ক্যাপটেন বলে ওঠে, “ধরুন আমাকে বললেন কেন আপনি এটা দেখতে চাইছেন, হুম? আগে কখনও দেখতে চাওয়া হয়নি। আপনার অধিকার আছে?” মার্ক অবাক হয়। “আমি চাইলে যে কোনকিছু দেখতে পারি। আমি স্মারণিক দায়িত্বে আছি।”
ক্যাপটেন এমএস সিগারে জোরে একটা টান দেয়। (মহাকাশ এবং আবদ্ধ জায়গাতে ব্যবহারের জন্য তা বিশেষভাবে তৈরি। এতে এক ধরনের অক্সিডেন্ট দেয়া আছে যাতে বাতাসের অক্সিজেন অপচয় না হয়।)
সে সতর্কতার সাথে বলে, “তাই? এর কথা কখনও শুনিনি। এটা কী?” মার্ক রাগি স্বরে বলে, “এটা স্মারণিক দায়িত্ব, এটুকুই! আমার কাজ হচ্ছে যা কিছু ইচ্ছে হবে দেখব আর যা দরকার মনে হবে জানতে চাইব। এবং কাজটা করবার অধিকার আমার আছে।”
“আমি না চাইলে লগ দেখতে পারেন না।”
“এ নিয়ে আপনার কিছু বলার নেই, আপনি- আপনি ননকম্পোস।”
ক্যাপটেনের শান্ত ভাবটা একেবারে উবে যায়। তিনি হিং¯্রতায় সিগারটা ছুঁড়ে ফেলেন এবং ওর দিকে ধেয়ে যান, তারপর সেটা তুলে সতর্কতার সহিত ছাইয়ের ঢালায় গুঁজে দেন।
“এ কেমন ছায়াথ চালনা?” তিনি জানতে চান। “যাই হোক, আপনি কে? নিরাপত্তা প্রতিনিধি? কী খবর দেন? সেটা সোজাসাপ্টা বলুন। এখনই।”
“আমার যা বলার আপনাকে আমি বলেছি।”
“কোনকিছু লুকাবার নেই,” ক্যাপটেন বলে, “কিন্তু আমাকেও ক্ষমতা দেয়া হয়েছে।”
“কোনকিছু লুকাবার নেই?” মার্ক খেকিয়ে ওঠে। “তাহলে জাহাজটির নাম কেন ট্রিপল জি রাখা হয়েছে?”
“এটাই এর নাম।”
“বলে যান, পৃথিবীর তালিকাতে এধরনের কোন জাহাজ নেই। কথাটা আমি এখানে আসবার আগে থেকেই জানতাম। আপনাকে জিজ্ঞাসার অপেক্ষায় ছিলাম।”
ক্যাপটেন চোখ পিট পিট করে তাকায়। তিনি বলেন, “দাপ্তরিক নাম হলো জর্জ জি-গ্র্যান্ডি। সবাই একে ট্রিপল জি নামে ডাকে।”
মার্ক হেসে ওঠে। “তাহলে, ঠিক আছে। আর লগবুক দেখার পর, আমি ক্রুদের সঙ্গে কথা বলতে চাই। আমার সেই অধিকার রয়েছে। আপনি ড. শেফিল্ডকে জিজ্ঞেস করে দেখতে পারেন।”
“ক্রুদের সাথেও কথা বলতে হবে, এ্যাঁ?” ক্যাপটেন রাগে ফেটে পড়ে। “ড. শেফিল্ডের সঙ্গে কথা বলে আসছি তারপর গ্রহে নামার আগ পর্যন্ত তোমাকে কামরায় রাখা হবে। আগাছা কোথাকার!”
তিনি এক ঝটকায় ইন্টারকম বক্সের দিকে এগিয়ে যান।
৪
আলাদাভাবে একজন তরুণ হিসেবে আর তাদের সবার যে ধরনের কাজ-কারবার করতে হয় সে অনুসারে ট্রিপল জি’র বৈজ্ঞানিক যন্ত্রপাতির সংখ্যা ছিল খুবই অপ্রতুল। ঠিক মার্ক আননুনচো’র মতো তরুণ নয়, সম্ভবত, সে নিজে একাই আলাদা দলের, তবে তাদের মাঝে সবচেয়ে বয়ষ্ক, ইমানুয়েল জর্জ সিমন (জ্যোতির্পদার্থবিদ), পুরোপুরি ঊনচল্লিশও নয়। এবং তার কালো, হালকা চুল আর বড় বড়, দীপ্তিময় চোখে, এখনও তাকে তরুণ বলেই মনে হয়। তার চোখের এই দীপ্তিময়তার আংশীক কারণ অবশ্য কন্টাক্ট লেন্স।
সিমন, তার বয়স অনুসারে সম্ভবত তুলনামূলকভাবে অতি সচেতন, আর সত্যি করে বলতে গেলে তার মাথাটা নামমাত্র অভিযানপ্রিয় (এই সত্যটা বাকী সবাই এড়িয়ে যেতে ইচ্ছুক) সাধারণত তা মিশনের কোন অনাটকীয় দৃষ্টিকোন দ্বারা প্রভাবিত। সে তার আঙুলগুলো দিয়ে ফুটকি ওয়ালা টেপ চালায়, তারপর সাপের মতো নীরবে তা ওর টাকুতে পুরে রাখে।
“মিল চালানো,” ছোট্ট প্যাসেনজার লাউনজের সবচেয়ে তুলতুলে চেয়ারটিতে বসে, সে দীর্ঘশ^াস ফেলে। “বৃথা।”
সে লাগরানজ বাইনারির সবশেষ আলোকচিত্র আর ওসবের অভেদ্য সৌন্দর্য দেখে। লাগরানজ এক, সবচেয়ে ছোট আর পৃথিবীর নিজস্ব সূর্য থেকেও উতপ্ত। একটি প্রখর সবুজাভ নীল নক্ষত্র। একে ঘিরে থাকা মুক্তো সদৃশ সবুজ-হলদে জ্যোতির্বলয়টি দেখতে স্বর্ণে বসানো পান্নার মতো। একটি স্বল্প দূরত্ব থেকে একে মসুর দানা বা ল্যান্সার র্যাচেট থেকে বেরিয়ে আসা বলের মতো দেখায়! (যে দূরত্ব থেকে ছবি তোলা যায়) তা লাগরানজ দুই। মহাশূন্যে এর অবস্থান অনুসারে এটি লাগরানজ এক থেকে আয়তনে দ্বিগুণ। (বাস্তবে, এটি পরিধিতে লারানজ এককের পাঁচ ভাগের চার, আয়তনে অর্ধেক, আর ভরের দিক দিয়ে তিনভাগের দুই ভাগ।) এটি কমলা লাল, মানুষের রেটিনার চেয়ে, তুলনামূলকভাবে, ফিল্ম এর প্রতি কম স্পর্শকাতর, সঙ্গী সূর্যের চেয়ে এর আভা একেবারেই ম্লান বলে মনে হয়।
দুটিই কাছের অনিমজ্জিত সূর্য সমূহ দিয়ে ঘেরা। তাছাড়া হারকিউলিস ক্লস্টার ঘন বিন্যস্ত হলদে, সাদা, নীল, আর লাল গৈরিক ধূলায় ছাওয়া বলে অবিশ^াস্য রকমের উজ্জ্বল। ফলে বিশেষ করে এই কাজে আলাদাভাবে পোলারাইজড লেন্স ব্যবহার করা হয়ে থাকে।
“বৃথা,” সিমন বলে।
“আমার কাছে তো ভাল বলেই মনে হচ্ছে,” লাউনজের অপর এক লোক বলে। তিনি হলেন রুট ক্যানোভানাগে (চিকিৎসক; খাটো, হৃষ্টপুষ্ট, এবং নোভি ছাড়া আর কোন নামে কেউ তাকে চেনে না)।
সে জিজ্ঞেস করে, “জুনিয়র কোথায়?” তারপর সিমনের কাঁধের ওপর ঝুঁকে, খানিকটা ক্ষীণদর্শন চোখে উঁকি দিয়ে দেখে।
সিমন ওপরের দিকে তাকায় এবং ঠক ঠক করে কেঁপে ওঠে। “এর নাম জুনিয়র নয়। এতো অত্যধিক ধু ধু তারার ভিড়ে, আপনি ট্রোয়াস গ্রহটি দেখতে পাবেন না, যদি ওর কথা বলে থাকেন। এই ছবিটি পৃথিবীর অধিবাসীদের বৈজ্ঞানিক সামগ্রী, এর আলাদা কোন ব্যবহার নেই।”
“ওহ, মহাশূন্যে আসা আর ফিরে যাওয়া!” নোভি হতাশ হন।
“যাই হোক, এর কোন পার্থক্য দেখতে পাচ্ছেন আপনি?” সিমন জানতে চায়। “ধরুন আমি বলছি এর একটি ফুটকিই হলো ট্রোয়াস। ওর যে কোন একটি। পার্থক্য জানা না থাকলে এটি আপনার কী কাজে লাগতে পারে?”
“এবার একটু অপেক্ষা করুন, সিমন। এভাবে সেরা বলে দাবি করবেন না। এটি যুক্তিসঙ্গত মতামত। কিছু দিনের জন্য আমরা জুনিয়রে থাকব। তাই আমরা সবাই জানি, আমরা ওখানে মারা যাব।”
“ওখানে কোন দর্শক নেই, নোভি, কোন অর্কেস্ট্রা নেই, নেই কোন তুর্যধ্বনি, তাহলে এতো নাটকীয়তা কেন? আমরা ওখানে মরব না। যদি মরিই, তা হবে আমাদের নিজ দোষে, এবং সম্ভবত অতিরিক্ত খাবার খাওয়ার কারণে।” অদ্ভুত জোর দিয়ে তিনি কথাটা বলেন যেমন কম ক্ষুধার লোকেরা বেশী ক্ষুধার লোকেদের সঙ্গে কথা বলবার সময় বলে থাকে, যেন দুর্বল হজমক্ষমতা এমন কিছু যা কেবল অনমনীয় সদ্গুণ আর সেরা বুদ্ধিমত্তা থেকেই আসতে পারে।
“হাজার লোক মরেছে,” মৃদু স্বরে নোভি বলেন।
“নিঃসন্দেহে, ছায়াপথ জুড়ে দিনে অন্তত দশ লাখ লোক মারা যায়।”
“এভাবে তো নয়।”
“এভাবে নয়?”
চেষ্টা করে, নোভি তার স্বাভাবিক টেনে টেনে কথা বলবার ধাঁচটা বজায় রাখে। “দাপ্তরিক সভা ছাড়া অন্য কোন কথা হবে না। এমন সিদ্ধান্তই নেয়া হয়েছিল।”
“আমার কিছু বলার নেই, “অস্পষ্টভাবে সিমন বলে। “ওরা কেবল দুটি সাধারণ নক্ষত্র। ধুর যদি শুধু জানতাম কেন আমি সে¦চ্ছাসেবক হলাম। আমি মনে করি এতে কেবল খুব কাছ থেকে অস্বাভাবিক বড় একটি ট্রোজান সিস্টেম দেখার সুযোগ হলো। এ তো কেবল দুই সূর্যের সাথে বাসযোগ্য একটি গ্রহ নিয়ে ভাবা। আমার জানা নেই কেন আমাকে এর সম্পর্কে বিস্ময়কর কিছু চিন্তা করতে হবে।”
“কারণ আপনি এক হাজার মৃত নারী-পুরুষের কথা ভাবছেন,” কথাটা শেষ করেই নোভি দ্রুত বলতে থাকে, “শুনুন, আমাকে কিছু একটা বলুন, কি বলবেন না? যাই হোক, একটি ট্রোজেন গ্রহ আসলে কি বলতে পারেন?”
ডাক্তার পাশের জনের অবজ্ঞার চাহনি দেখে মুহূর্তের জন্য বিরক্ত বোধ করে, তারপর বলেন, “ঠিক আছে। ঠিক আছে। এব্যপারে আমার কিছু জানা নেই। আপনিও সবকিছু জানেন না নিশ্চয়। শ্রবণাতীত ছেদন নিয়ে আপনি কী জানেন?”
জবাবে সিমন বলে, “কিছুই না, আর আমার ধারণা এই ভালো। আমার মতে একজন পেশাদার লোকের বাইরের তথ্য জানার বিশেষত্ব অর্থহীন এবং মানসিক-সম্ভাবনার অপচয় মাত্র। শেফিল্ডের দৃষ্টিভঙ্গি আমাকে দমিয়ে দিয়েছে।”
“তারপরও আমি জানতে চাই। যদি আপনি তা বুঝিয়ে বলতে পারেন।”
“আমি তা বলতে পারব। সত্যি বলতে কি, আসল বিবৃতিতে এর কথা উল্লেখ ছিল। বেশীরভাগ গুচ্ছ নক্ষত্র, আর এর মানে প্রতি তিনটি নক্ষত্রের একটির, নামেমাত্র কিছু গ্রহ রয়েছে। সমস্যা, হলো এসব গ্রহ কখনই বাসযোগ্য নয়। পুরোপুরি বৃত্তাকার একটি কক্ষপথের জন্য এরা যদির নক্ষত্রগুচ্ছটির মাধ্যাকর্ষণ কেন্দ্র থেকে যথেষ্ট দূরে অবস্থান করে, তাহলে হিলিয়াম সমুদ্রের কারণে তা যথেষ্ট শীতল থাকে। তাপ পাবার জন্য যথেষ্ট কাছাকাছি অবস্থান করলে, তাদের কক্ষপথ এতটাই অনিশ্চিত হয়ে ওঠে যে প্রতি আবর্তনে, তারা কোন একটি নক্ষত্রের এত কাছাকাছি চলে যায় সেই তাপে লোহাও গলে যাবে।
“এই লাগরানজ সিস্টেমে, অবশ্য, আমরা একটি অদ্ভুত ঘটনা দেখতে পেলাম। দুটি তারা, লাগরানজ এক আর লাগরানজ দুই, এবং গ্রহ, ট্রোয়াস (এর উপগ্রহ ইলিয়ামসহ), কল্পিত একটি সমান পাশের ত্রিভুজের একেবারে শেষ প্রান্ত সমূহে অবস্থিত। বুঝলেন? এধরনের বিন্যাস কেবল সুস্থিত কোন একটিতেই পাওয়া সম্ভব, আর আপনি যেমন চাইছেন তার দোহাই দিয়ে বলছি, কেন এমন হলো তা আমাকে বলতে বলবেন না। একে কেবল আমার পেশাদার মতামত হিসেবেই গ্রহণ করবেন।”
নিঃশ^সের আড়ালে নোভি বিড়বিড় করে বলে, “স্বপ্নেও আমি এতে সন্দেহ করছি না।”
সিমনকে বিরক্ত বলে মনে হলেও সে বলতে থাকে, “এই সিস্টেমটি একটি গুচ্ছ আকারে পরিভ্রমণ করে। ট্রোয়াস সব সময়ই প্রতিটি সূর্য থেকে কোটি মাইল দূরে, আর ওর সূর্য দুটিও সব সময় একে ওপরের থেকে কোটি মাইল দূরে অবস্থান করছে।”
নোভি তার কান পরিষ্কার করে অতৃপ্তি নিয়ে তাকিয়ে থাকে। “আমি এসবের সবই জানি। বিবৃতির সময় আমি শুনেছি। কিন্তু কেন এটি একটি ট্রোজান গ্রহ? কেন ট্রোজান?”
সিমনের সরু ঠোঁট মুহূর্তের জন্য চুপসে যায়, যেন জোর করে কোন নোংরা শব্দ আটকালো। সে বলে। “সৌর জগতেও আমরা এধরনের একটি ঐক্য দেখতে পাই। সূর্য, বৃহস্পতি, আর ছোট্ট একদল গ্রহাণু এধরনের একটি সমভুজ গঠন করে অবস্থান করছে। ঘটনাক্রমে গ্রহাণুগুলোর নাম দেয়া হয়েছে হেক্টর, একিলিস, এজাক্স, এবং ট্রোজান যুদ্ধের অন্যান্য বীরদের নামে, তাহলে এখানেই কি আমি শেষ করতে পারি?”
“এটাই কি সব?” নোভি বলে।
“হ্যাঁ। তারপরও কি আপনি আমাকে আরো জ¦ালাতন করবেন?”
“আচ্ছা আপনার মাথা গরম হয়ে গেছে।”
নোভি রুষ্ট জ্যোতির্বস্তুবিদকে বিদায় করতে উঠে দরজার স্লাইড সক্রিয়ক স্পর্শ করবার আগ মুহূর্তে তা খুলে যায় এবং বরিস ভেরনাৎস্কি (মৃৎরসায়ণবিদ; কালো ভ্রু, চওড়া মুখ, প্রশস্ত চেহারা, পলকা ডট-শার্ট আর লাল প্লাস্টিকের ম্যাগনেটিক ক্লিপ-অন টাইয়ের প্রতি গভীর ঝোঁক) ভেতরে পা রাখে।
সে নোভির রক্তিম মুখ আর সিমনের বিরাগ শীতল চাহনি খেয়াল করে না।
সে মৃদু স্বরে বলে, “সহকর্মী বিজ্ঞানীরা, আপনারা মনোযোগ সহকারে খেয়াল করলে শুনতে পাবেন, সম্ভবত উপরে ক্যাপটেনের কক্ষের ওখান থেকে ছায়াপথে বিস্ফোরণের শব্দ ভেসে আসছে।”
“কী হয়েছে?” নোভি জানতে চায়।
“ক্যাপটেন শেফিল্ডের পোষা পুঁচকে টিটিকিটিকে আটকে রেখেছে, আর শেফিল্ডও তাকে আক্রমণ করতে উপরের ডেকের দিকে ছুটে গেছে, তার চোখ দুটি ভীষণ লাল হয়ে ছিল।”
সিমনও যতটুকু পারা যায় শুনে, ঘুরে ফোঁস ফোঁস করে ওঠে।
নোভি বলে, “শেফিল্ড! লোকটি তো রাগতেই পারে না। এমনকি আমি তাকে কখনও উঁচু স্বরে কথাও বলতে শুনিনি।”
“এবার সে এই কাজটিই করেছে। খোকাটিকে খুঁজে পেয়েই সে তাকে না বলেই কেবিন ছেড়ে বেরিয়ে আসে আর তখনই ক্যাপটেন তাকে গালাগাল শুরু করে- দারুণ! আপনি কি ঠিক জানেন ছেলেটি বিছানায় নেই, নোভি?”
“না, তবে আমি অবাক হইনি। স্পেস-সিকনেস এরকমই একটি বিষয়। এটি হলে, আপনার মনে হবে আপনি মরে যাচ্ছেন। মনে হবে মরার জন্য অপেক্ষারও বুঝি সময় নেই হাতে। তারপর, দু মিনিট পর তা চলে যাবে আর মনে হবে সব ঠিক হয়ে গেছে। একটু দুর্বল লাগলেও, মনে হবে সেরে উঠেছেন। সকালে আমি মার্ককে বলেছিলাম পরদিন আমরা ল্যান্ড করছি আর মনে হচ্ছে কথাটি তাকে টেনে তুলেছে। গ্রহের উপরিতলের নজরকারা অবারিত প্রান্তরের কথা ভেবে স্পেস-সিকনেসে বিস্ময় ঘটানো সম্ভব। আমরা শীঘ্রই ল্যান্ড করছি, তাই না, সিমন?”
জ্যোতির্পদার্থবিদ অদ্ভুত একটি শব্দ করে যা সম্মতি বলে ধরে নেয়া যেতে পারে। অন্তত, নোভি একেই এর মানে বলে ধরে নেয়। “যাই হোক,” নোভি বলে, “কী হয়েছে?”
ভেরনাৎস্কি বলে, “শুনুন, ছেলেটি যখন স্পেস-সিকনেসসহ বুড়ো আঙুলে ভর করে পেছনে গিয়ে তার ডেস্কে চার্ট নিয়ে বসে মুঠো-কম্পিউটরের দিকে বড় বড় চোখ করে তাকিয়ে ছিল, তখনই রুম ফোনের সিগনাল বেজে ওঠে আর কলটি ছিল ক্যাপটেনের। একারণেই সে ছেলেটিকে পেয়ে যায় আর তখনই সে তার কাছে সরকারের হয়ে গোয়েন্দাগিরির গোপন ভাষা ও যাবতীয় ডট ড্যাসের মানে জানতে চায়। তাই শেফিল্ড তাকে লক্ষ্য করে চিৎকার করে বলে ওঠে যে বাচ্চাটিকে এভাবে বোকা বানালে একটি ক্যালামোর ম্যাক্রো-লেভেলিং-টিউব দিয়ে সে তার কুঁচকিতে আঘাত করবে। ফোনটা সজাগ রেখেই ছেলেটি বেরিয়ে যায় এবং ক্যাপটেন গেঁজাতেই থাকে।”
“এর সবকিছুই আপনি বানিয়ে বলছেন,” নোভি বলে। “শেফিল্ড এধরনের কোনকিছু বলবে না।”
“কথাগুলোর কারণেই তো এই পরিণতি।”
নোভি সিমনের দিকে তাকায়। “আপনি আমাদের দলের নেতৃত্ব দিচ্ছেন। এব্যপারে আপনি কিছু করছেন না কেন?
সিমন গর্জে ওঠে, “এধরনের পরিস্থিতিতে, আমি দলের নেতৃত্ব দিয়ে থাকি। সব সময় আচমকা আমার ওপর এধরনের দায়িত্বগুলো এসে চাপে। এ নিয়ে ওদের লড়তে দিন। শেফিল্ড খুব ভালো একটি কথার লড়াই লড়েছে আর ক্যাপটেনও, তার পলকা পিঠ থেকে হাত বের করে আনতে হয়নি। ভেরনাৎস্কির বর্ণনার মানে এই নয় যে ওখানে শারীরিক লাঞ্ছনার মতো ঘটনা ঘটেছে।”
“ঠিক আছে, তবে আমাদের এই অভিযানের মতো কোনকিছুতে কলহে জড়াবার কোন যুক্তি নেই।”
“আপনি আমাদের মিশনের কথা বলছেন!” ভেরনাৎস্কি উপহাস আতঙ্কে দুই হাত উঁচু করে উপরের দিকে চোখ পাকায়। “কীভাবে আমি সময়টুকু উপভোগ করব যখন প্রথম অভিযানেই নিজেদের এরকম একপাল টোকাইয়ের মাঝে আবিষ্কারে কথা মনে পড়বে।”
এবং মনে যে ছবিটা রয়ে যাবে অন্তত তা কোন আনন্দ বয়ে আনবে না, হঠাৎ-ই যেন কিছুই বলার রইল না। এমনকি ইজি চেয়ারের পেছনের যে দৃশ্য সিমনের মাথায় জমা আছে তা ভাবতেও খানিকটা কষ্ট হচ্ছে।
(চলবে)