করোনাকাল
বিচ্ছিন্ন অনুভব
মাহফুজা হিলালী

প্রবন্ধ
অধ্যাপক আনিসুজ্জামান
শামসুজ্জামান খান

গল্প
ডায়মন্ড লেডি ও পাথর মানব
হামিদ কায়সার

গদ্য
নিদ্রা হরণ করেছিল যে বই
মিনার মনসুর

নিবন্ধ
পঞ্চকবির আসর
সায়কা শর্মিন

বিশ্বসাহিত্য
আইজাক আসিমভের সায়েন্স ফিকশন
অনুবাদ: সোহরাব সুমন

বিশেষ রচনা
প্রথম মহাকাব্যনায়ক গিলগামেশ
কামাল রাহমান

শ্রদ্ধাঞ্জলি
মুজিব জন্মশতবর্ষ
মারুফ রায়হান
 
সাক্ষাৎকার
কথাশিল্পী শওকত আলী

জীবনকথা
রাকীব হাসান

ভ্রমণ
ইম্ফলের দিনরাত্রি
হামিদ কায়সার

ইশতিয়াক আলম
শার্লক হোমস মিউজিয়াম

নিউইর্কের দিনলিপি
আহমাদ মাযহার

শিল্পকলা
রঙের সংগীত, মোমোর মাতিস
ইফতেখারুল ইসলাম

বইমেলার কড়চা
কামরুল হাসান

নাজিম হিকমাতের কবিতা
ভাবানুবাদ: খন্দকার ওমর আনোয়ার

উপন্যাস
আলথুসার
মাসরুর আরেফিন

এবং
কবিতা: করেনাদিনের চরণ

১৭ বর্ষ ০৩ সংখ্যা
অক্টোবর ২০২৪

লেখক-সংবাদ :





আম্মা
গুলজার হোসেন উজ্জ্বল
অবশেষে আমাদের আম্মা তার জীবনযন্ত্রণা থেকে মুক্তি নিলেন।

আম্মা তার বেঁচে থাকার যুদ্ধে হেরে গেলেন। আম্মাকে চলে যেতে হলো তাঁর প্রিয় সন্তানদের কাছ থেকে। আম্মা একজন চিরসংগ্রামী মানুষ। এই জীবনে একমাত্র মৃত্যুই তাকে হারাতে পেরেছে। আর কিছুনা।

আমাদের আম্মা আসলে কেতাবি ভাষায় 'আলোকিত মানুষ' বলতে যেটা বোঝায় সেটা ছিলেন না। আমাদের আব্বার ঠিক বিপরীত ছিলেন তিনি। আব্বা ছিলেন আমার বিচারে হাইলি ইন্টেলেকচুয়াল মানুষ। যা তিনি অর্জন করেছেন তার শিক্ষা, প্রতিষ্ঠান, কাজ আর নিজস্ব পড়াশুনা ও জানাশোনার আগ্রহ থেকে। বিশ্ববিদ্যালয়ের সর্বোচ্চ ডিগ্রী, প্রগতিশীল রাজনীতি, বন্ধুসংগ সবকিছুরই অবদান আছে এখানে।

আম্মা স্রেফ প্রাইমারি পাশ। তবে নিয়মিত পত্রিকা পড়তেন। এক সময় শরচ্চন্দ্র, নজরুল, রবীন্দ্রনাথও পড়তেন।

আম্মা এককালে সিনেমা পাগল ছিলেন। আম্মার জন্য বাসায় সিনে ম্যাগাজিন, বিচিত্রা এসব কিনে আনতেন আব্বা। এককালে রেডিওতে সিনেমার প্রমো শোনা ছিল তার প্রিয় কাজ। কত কত সিনেমার সংলাপ তিনি প্রমো শুনেই মুখস্ত রাখতেন। প্রমো শুনতে গিয়ে তার কাছে এক প্রিয় নাম হয়ে উঠেছিল Nazmul Husain। আমার চাচাত ভাইয়ের নাম রেখেছিলেন আম্মা নাজমুল হুসাইন। আশির দশকে এতটাই মুভি পাগল ছিলেন আম্মা।

আম্মা গান শুনতেন প্রচুর৷ রেজওয়ানা বন্যা তাঁর প্রিয় শিল্পী। রবীন্দ্র সংগীতই বেশি পছন্দ করতেন। তবে জানতেন সবাইকেই। বন্যা থেকে শুরু করে খালিদ হোসেন (আম্মার ভাষায় নাক লম্বা ব্যাটা) এমনকি হালের অনিমা রায় পর্যন্ত। সকালের গানের অনুষ্ঠানগুলো ছিলো তার ভীষণ প্রিয়৷ তবে সব কিছুর উপরে তার প্রিয় শিল্পী, প্রিয় কন্ঠ তার সন্তান। সবচেয়ে সুন্দর মেয়ে তার নিজের মেয়ে, সবচেয়ে সুন্দর আর ভাল বউ তার পুত্রবধূ।

এসব শুনে আপনাদের মনে হতে পারে আম্মা বুঝি স্বশিক্ষিত, খুব স্মার্ট মানুষ ছিলেন। না ব্যপারটা তাওনা৷ আম্মা একদম গ্রামের মানুষ ছিলেন। জীবনের এত রকম বাঁক বদলের পরও উনি বদলান নি। খালি পায়ে এপার্টমেন্টের নিচে চলে যেতেন অনেকসময়।

আশি নব্বইয়ের দশকে আমাদের একটা চরম দুঃসময় গেছে। কিন্তু আমরা কেউ আসলে ওভাবে টের পাইনি। হেসে খেলে জীবন কেটেছে আমাদের। এর অনেকখানি কারণ আমাদের সদানন্দ আম্মা।

আমরা এক সময় একটা ডিম চারভাগ করে খেতাম। কিন্তু যখন আমাদের গাড়ি হলো তখনও উনি একইরকম ছিলেন। আমাকে না জানিয়ে লোকাল বাসে বোনের বাড়িতে যেতেন। অভ্যাস পাল্টাতে সময় লেগেছে৷

কিন্তু আমার দ্ৃষ্টিতে আম্মা ছিলেন আধুনিকতম মানুষ। সন্তানদের কোন দিন মারধোর করেন নি। এমনকি বকা পর্যন্ত দেননি। একটা কটু কথাও না। মনে পড়েনা। কোন দিন আমাদের পড়ালেখার জন্য চাপ দেননি।
উল্টো আব্বাকে ফাঁকি দিয়ে আমাদের নিয়ে রবিবার সন্ধ্যায় ডিডি ন্যাশনালে হিন্দি সিনেমা দেখতে বসতেন। আর শনিবার সন্ধ্যায় কলকাতার বাংলা সিনেমা।

আম্মা খোলা গলায় কথা বলতেন। সারাক্ষনই কথা বলতেন। ঘর গমগম করতো। আম্মা বাসায় নাই মানে ঘরটা একদম নীরব।
#
আমি ডাক্তারিতে চান্স পেয়েছিলাম বলে সবাই খুশি হলেও আম্মা খুশি ছিলেন না। উনার বিচারে আমার ইউনিভার্সিটিতে পড়লে ভাল হতো। ভাল গায়ক হবার পথটা সুগম হতো। আম্মা চাইতেন গায়ক পরিচয়টাই আমার মূখ্য হোক। ঐ সময়ে কোন মা এরকম ভাবতে পারতেন ভেবেই আমার অবাক লাগে।

আমার পোস্ট গ্রাজুয়েশনের জার্নি, চিকিৎসক জীবনের হার্ডশিপ সবচেয়ে কষ্ট দিয়েছে আম্মাকে। আমার এমডি পাশের খবরে আম্মা ঝরঝর করে কেঁদেছিলেন। অনেক অনেকদিন পর আমাকে জড়িয়ে ধরে কেঁদেছিলেন।

#
কলেজে থাকতে প্রেমে জড়িয়ে পড়ি। আম্মা জেনে গেলেন। আমার কাছে চিঠি পার্শেল আসতো বন্ধুদের ঠিকানায়। আমি সেখান থেকে সংগ্রহ করতাম। আম্মা বুঝে গিয়েছিলেন। একদিন বললেন বাসার ঠিকানাই দিয়ে দে। আমি রিসিভ করব।

আম্মাকে আমার আব্বার কিশোর বয়সের ভেংগে যাওয়া প্রেম নিয়েও হাহাকার করতে দেখেছি। আব্বার প্রাক্তন প্রেমিকার ছবিকে যত্ন করে রেখে দিয়েছিলেন অনেকদিন। আমাদের সেই গল্প শোনাতেন খুব আগ্রহ, ভালবাসা আর রসবোধ নিয়ে। আর বলতেন এত সুন্দর মেয়ে! হরিণের মত চোখ! একে ভুলে আমার মত মানুষের সাথে ক্যামনে সংসার করছে কে জানে?

অনেক অনেক বছর পর আব্বার সেই মানুষটির সাথে দেখা করার ঘটনাটিও ছিল আম্মার উদ্যোগেই। আব্বা ততদিনে দৃষ্টিহীন। আম্মা আব্বাকে বুঝিয়ে দিলেন তাঁর প্রাক্তন এখন দেখতে কেমন হয়েছে৷

আপনারা ভুলেও ভাববেন না আম্মা খুব প্রজ্ঞাবান, স্মার্ট মানুষ ছিলেন। আম্মা ছিলেন সহজ মানুষ। খুব সরল বলতে যা বুঝায় তাই৷ সরল মানুষেরা ভেতর থেকে সত্য অনুধাবন করতে পারে। আম্মা হয়ত সেটা পারতেন।

আম্মার সহজাত রসবোধ ছিল। পনের দিন আগেও হাসপাতালের আইসিইউতে বড়ভাই দেখতে গিয়েছিল পরে আম্মা বললেন "আমার একটা ছবি উঠা। "
অসংখ্য নল লাগানো। নাকে অক্সিজেন ক্যানুলা, সিভি লাইন ইত্যাদি। আম্মা হাপানো গলায় বললেন "এতগুলো গহনা পরাইছে ছবি রাখা দরকার। "

আম্মা দৃঢ় বিশ্বাসী ছিলেন তিনি বাঁচবেন। ছেলের কাছে ক্যান্সার জয়ী মানুষের গল্প শুনতেন। ক্যান্সার রোগীরা ভাল হয়ে গিয়ে তার ছেলেকে টাটকা সব্জি, রান্না করা হাঁসের মাংস পাঠাতো। এসব দেখে আম্মা বিশ্বাস করতেন ক্যান্সার ভাল হয়। প্রথমবার কেমোথেরাপি দেবার পর মেয়েকে ভিডিও কলে বলেছেন "একুশ দিন পর পর কেমো দিব। এইভাবে ছয়টা দিতে পারলে ভাল হইয়া যামুগা। "

কেমোথেরাপি পরবর্তী জটিলতা থেকে আর বের হতে পারলেন না। কেউ কেউ পারেনা। আম্মা তাদেরই একজন। কেমো নেবার সময় কোন সমস্যা হয়নি। একবার বমি হয়েছিল মাত্র। আমাকে বলেছিলেন " ডরাইস না, মরুম না। আমার বিড়ালের জান। "

এক মাস যুদ্ধ করলেন। অবশেষে গতকাল তেইশ মে বিকেল ৩.৪৫ মিনিটে তিনি রণে ভংগ দিলেন। সকাল থেকেই আমাকে খুব কাছে চাচ্ছিলেন। আমার হাতটা ধরেছিলেন জ্ঞান থাকা অব্দি। এই কটা দিন মায়ের সাথে বেশিরভাগ সময় থাকতে পেরেছিলাম শুধুমাত্র আমি চিকিৎসক বলে। আমার চিকিৎসক জীবন সার্থক। এই জীবন ও পেশা নিয়ে আমার আর কোন খেদ নেই। আম্মাকে গতকালই মাগরিবের ঠিক আগে আগে রায়ের বাজার শহীদ বুদ্ধিজীবি কবরস্থানে সমাহিত করি। মহামারীর কালে সোশ্যাল ডিস্টেন্সিং এবং হাইজিন নিশ্চিত করতে গ্রামের বাড়িতে নেইনি। তাতে ব্যপক লোক সমাগম হয়ে একটা ঝুঁকিপূর্ণ পরিস্থিতির সৃষ্টি হতে পারতো। আমি আমার আত্মীয়দের কাছে ক্ষমাপ্রার্থী।

আমার মাটির পুতুল, সরল-সহজ, বোকা মা'টা সন্তান আর নিজের ভাইবোনদের ছাড়া কিছু বুঝতেন না।
আম্মা খুব ধার্মিক ছিলেন। পাঁচ অক্ত নামাজ পড়তেন। নিয়মিত কোরান তেলওয়াত করতেন। রোজার মাস এলে কোরান খতম দিতেন। কিন্তু কোনদিন দোজখের আগুন নিয়ে ভয় পেতে শুনিনি। বেহেস্তও চাইতে শুনিনি। শুধু পোলামাইয়া নিয়ে আরো কিছুদিন বাঁচতে চাইতেন।

তবু তীব্র রোগ যন্ত্রণা থেকে মৃত্যু উত্তম। দীর্ঘ বারোদিন লাইফ সাপোর্টে থাকার যন্ত্রণা থেকে আপাত মুক্তি হিসেবে মৃত্যুকে তাই শীতল আশ্রয় বলেই মেনে নিচ্ছি। এটুকুই সান্তনা।

কিন্তু যে গভীর শূন্যতা, যে স্মৃতির ভার বয়ে বেড়াবো সারাজীবন তার তুলনা হবেনা। এই বেদনা থেকে মুক্তি লাভ হোক তা চাইনা। আমরা আসলে সবাই বাবা মায়ের জন্য এই বেদনাবোধটা পুষে রাখতেই চাই।

করোনা কালীন এই দুঃসময়ে আম্মার রোগ নির্ণয় ও চিকিৎসা করা অনেক কঠিন ছিল৷ কঠিন কাজগুলোও সম্ভব হয়েছে আমি চিকিৎসক বলেই। আমার যে সহকর্মী বন্ধু ও সিনিয়র ভাইয়েরা আমাকে সাহায্য করে তাদের প্রতি কৃতজ্ঞতা জানানোর ভাষা আমার নাই। আমার মন জানে আমি তাদের হৃদয়ে ঠাঁই দিয়েছি।

আপনারা যারা আমার ফেসবুক বন্ধু তাঁরা নানাভাবে আমার সাথে ছিলেন। আমার কঠিন সময়ের ভার হালকা করেছেন নানাভাবে। আপনারা আমার একান্ত স্বজন। দিনের বড় অংশ আপনাদের সাথেই তো কাটাই। আপনাদের প্রতিও আমার কৃতজ্ঞতা।

আম্মা মৃত্যুকে ভয় পেতেন শুধু ছেলে মেয়েদের থেকে, তার প্রিয় সংসার থেকে বিচ্ছিন্ন হতে হবে বলে। তাঁর
মৃত্যু পরবর্তী জীবন কেমন হবে জানিনা। আমার নিষ্পাপ আম্মার বেহেস্ত বলতে তার সংসার, তার ছেলে মেয়ে। আমাদের যেন মৃত্যুর পরের জীবনে আবার দেখা হয়। আর যদি পূনর্জন্ম বলে কিছু থাকে সেখানেও যেন আমার বাবা মায়ের সন্তান হিসেবে জন্মাতে পারি। আমাদের সেই সোনার সংসারটা আরো একবার ফিরে পেতে চাই। এই জীবনে তো সবই ফুরালো। আর তো আশা নাই।