করোনাকাল
বিচ্ছিন্ন অনুভব
মাহফুজা হিলালী

প্রবন্ধ
অধ্যাপক আনিসুজ্জামান
শামসুজ্জামান খান

গল্প
ডায়মন্ড লেডি ও পাথর মানব
হামিদ কায়সার

গদ্য
নিদ্রা হরণ করেছিল যে বই
মিনার মনসুর

নিবন্ধ
পঞ্চকবির আসর
সায়কা শর্মিন

বিশ্বসাহিত্য
আইজাক আসিমভের সায়েন্স ফিকশন
অনুবাদ: সোহরাব সুমন

বিশেষ রচনা
প্রথম মহাকাব্যনায়ক গিলগামেশ
কামাল রাহমান

শ্রদ্ধাঞ্জলি
মুজিব জন্মশতবর্ষ
মারুফ রায়হান
 
সাক্ষাৎকার
কথাশিল্পী শওকত আলী

জীবনকথা
রাকীব হাসান

ভ্রমণ
ইম্ফলের দিনরাত্রি
হামিদ কায়সার

ইশতিয়াক আলম
শার্লক হোমস মিউজিয়াম

নিউইর্কের দিনলিপি
আহমাদ মাযহার

শিল্পকলা
রঙের সংগীত, মোমোর মাতিস
ইফতেখারুল ইসলাম

বইমেলার কড়চা
কামরুল হাসান

নাজিম হিকমাতের কবিতা
ভাবানুবাদ: খন্দকার ওমর আনোয়ার

উপন্যাস
আলথুসার
মাসরুর আরেফিন

এবং
কবিতা: করেনাদিনের চরণ

১৬ বর্ষ ০৫ সংখ্যা
ডিসেম্বর ২০২৩

লেখক-সংবাদ :





করোনাদিনের গল্প: প্রহর
করোনাদিনের গল্প: প্রহর শওকত চৌধুরী

সকাল থেকে আমতিন সাহেবের গলা ব্যথা হচ্ছে।
সকাল থেকে আমতিন সাহেবের গলা ব্যাথা হচ্ছে- এটা বড় বিষয় নয়। বড় বিষয় করোনাত্তোর বিশ্ব নেতৃত্ব কার হাতে বদল হচ্ছে, সেটা। নেতৃত্বের হাওয়া কোন দিকে যাচ্ছে পেপার-পত্রিকাগুলো ইতোমধ্যে একটু একুট করে ইঙ্গিত দিতে শুরু করেছে। টেলিগ্রাফের ইঙ্গিতটা চায়নার দিকেই।
টেলিগ্রাফের আর্টিকেলটা এই নিয়ে বেশ কয়েকবার পড়েছেন তিনি। প্রতিবারই পড়ার সময় মনে এক প্রকার উত্তেজনা বোধ করেছেন। আচ্ছা এই উত্তেজনার ইংরেজী নাম কি? এক্সাইটমেন্ট?
লেবু তেজপাতা দিয়ে তৈরী রঙ চায়ের একটা কাপ হাতে দাঁড়িয়ে আছেন শিপ্রা। আমতিন সাহেব একবারও তার দিকে তাকাচ্ছেন না। শিপ্রার এখন কী করা উচিত?  
‘কিছু বলবে?’ বললেন আমতিন সাহেব।
 শিপ্রার কন্ঠ নরম- ‘এই চা-টা খেয়ে নাও। গলায় আরাম পাবে।’
আমতিন সাহেব বিরক্ত হলেন- ‘একটু পরপর চা দিচ্ছো কি কারণে? তোমার কি ধারণা আমি কোভিড-১৯ পজেটিভ?’
শিপ্রার কন্ঠ আরও খানিকটা নরম হয়ে গেল- ‘সাবধান থাকাটা ভাল।’
‘সাবধান থাকাটা কেন ভাল জানতে পারি?’
শিপ্রা উত্তর করলেন না।
‘আমার বয়স সত্তর ঠিক, কিন্তু আমার আন্ডার লায়িং কোনো হেল্থ কন্ডিশন নেই।’
‘তোমার একটু জ্বরের মতো হচ্ছিলো, আমি একটা কাজ করেছি, তোমার জন্য একটা ওষুধ তৈরী করেছি। তুমি হয়তো শুনলে একটু রাগ করবে, কারণ এটা এ্যালোপ্যাথিও না আবার কবিরাজিও না। সংমিশ্রণ।’
‘এটার মানে কি?’
‘আদা রসুনের পেস্টের সঙ্গে অ্যাফারভেসেন্ট প্যারাসিটামল দিয়ে তৈরী একটা পেস্ট। আফ্রিকার উকুওলা নামের এক ভদ্রলোক এই ওষুধ তৈরীর একটা ফর্মুলা ফেবু’তে দিয়েছেন।’
‘ফেবুটা কে? আমি কি ওকে চিনি?’
‘তুমি চিনবে কী করে? ফেবু মানে ফেইস-বুক। খাওয়ার তিন দিনের মাথায় তার করোনা টেস্ট নেগেটিভ এসেছে।’
‘এতো সাংঘাতিক ব্যাপার! তো তোমার উকুলালা এমন একটা কান্ড করে ফেলল- হু তাহলে করছে কি?’
‘উকুলালা না, উকুওলা। হু আবার কে?’
‘ডঐঙ, ডব্লিউএইচও এটা কে জানলে তো আর উকুলালা বাজাতে না। শিপ্রা শোন, এটা গুরুত্বপূর্ণ ঘটনা ঘটে গেছে, আড়বায়ু খেলে গেছে বিশ্বে।’
‘আড়বায়ু?’
‘ক্রস উইন্ড! এই ক্রস উইন্ডটা বুঝতে হলে ওয়ার্ল্ড পলিটিক্স বুঝতে হবে। এতদিন ধরে একচ্ছত্র বিশ্ব শাসন করছিল আমেরিকা। এবার বুঝবে চায়না কাকে বলে! সাপ-ব্যাঙ খাওয়া বুদ্ধি! বয়লিং ওয়াটারে কাঁচা সাপ চুবিয়ে এরা লবণ ছিটা দিয়ে খায়। খায় আবার কায়দা করে চ্যাপস্টিক দিয়ে! এই দেখ টেলিগ্রাফ কী লিখেছে! লিখেছে- করোনাত্তোর সময়ে চায়না এগিয়ে আসছে।’
‘এটা একটা সম্ভাবনার কথা। কথার কথা।’
‘ইংরেজরা এভাবেই কথা বলে। সম্ভাবনা দিয়ে কথা বলে। ওরা এই কথার ভদ্রতা দিয়ে বিশ্ব শাসন করেছিল। ওরা কি তোমার আমার মতো- ধরো তক্তা মারো পেরেক- ধরনের কথা বলে? ওদের সব কথায় একটা কার্টিসি থাকে, নরম ভাষায় চরম কথাটা শুধু ইংরেজরাই বলতে পারে! যাও তো, যাও! এখানে ঘ্যানর ঘ্যানর করো না। বিশ্ব কোনদিকে যাচ্ছে খেয়াল নেই খালি লেবু তেজপাতার রঙ চা!’
শিপ্রার পেছনেই দাঁড়িয়ে ছিল টিনা। সে ইশারায় বলল- ‘মা যাওতো!’
টিনা এসেছে তার স্বামী বাজেদকে নিয়ে এ বাড়িতে দুদিন থাকতে। এসেই সরকার ঘোষিত লক ডাউনে আটকে পড়ে গেছে। এই নিয়ে তার সব সময় মেজাজ বিগড়ে থাকে।
‘বাবা কী নিয়ে কথা হচ্ছে?’
‘বিশ্ব একটা নতুন দিকে মোড় নিচ্ছে! বসতো এখানে বস! তোর মা মূর্খকে তো দুনিয়া বোঝানো সম্ভব না, তুই শোন!’
‘বাবা কথায় কথায় মাকে মূর্খ বলবে না তো- শুনতে জঘন্য শোনায়।’
‘মুর্খকে মূর্খ না বলে কী বলব? বিশ্ব কোথায় চলে যাচ্ছে- সে আছে উকুলালার আদা রসুন নিয়ে! গো-মূর্খ!’
‘আচ্ছা বসলাম, কী বলবে বল?’
‘তুই এমন রেগে আছিস কী কারণে?’
‘রেগে আছি বেজু দুপুর থেকে কিছু খাচ্ছে না।’
‘বেজুটা কে?’
‘বাজিদ বাবা!’
‘ও। খাচ্ছে না কেন?’
‘আজকেও আমেরিকায় ২৫শ‘র মতো লোক মারা গিয়েছে। ইংল্যান্ডে প্রায় ৮শ। এসব দেখে ও খেতে পারছে না।’
‘ও খেতে না পারলে খাবে না, তোর রাগ করার কী আছে?’
‘আমি খেতে বলাতে উল্টো আমাকে বলে কিনা দুনিয়াতে আমি শুধু খেতে এসেছি!’
‘বাদ দে ওসব! আয় তোকে একটা আনন্দ সংবাদ দেই, তোর মনটা ভাল হয়ে যাবে। চায়না তো সাপ-ব্যাঙ নিয়ে বিশ্ব শাসনে নেমে পড়ছে! সাপ-ব্যাঙ এদের যে কী যাদুকরী পাওয়ার! কয়েকদিন পর মানুষ আর আমেরিকা যেতে চাইবে না, সবাই যেতে চাইবে চায়নায়। এ যুগের রবীন্দ্রনাথরা নতুন গান লিখবেন- আজ জোছনা রাতে সাবই গেছে চায়নায়..!’
‘আচ্ছা বাবা ধরো চায়না পাওয়ারে চলে এলো...’
আমতিন সাহেব উত্তেজিত হয়ে উঠলেন- ‘ধরো মানে কিরে, বল এসে গেছে!’
‘ধরলাম এসে গেছে। এখন কি তাহলে আমাদেরও সাপ কুচে এসব খেতে হবে? ঘরে ঘরে আমাদের নতুন রেসিপি শিখতে হবে সাপের সুপ, কুচের দো পেয়াজা এসব?’
‘তুই কি আমার সঙ্গে রসিকতা করছিস?’
মেজাজ চড়ে আমতিন সাহেবের দাঁতে দাঁত লেগে গেল। এই জিনিষ তিনি জন্ম দিয়েছেন?


আমতিন সাহেব ইউটিউব থেকে রবীন্দ্রনাথের গান খুঁজে বের করলেন। আজ তার বড় গান শুনতে ইচ্ছে করছে। আজ কতদিন তিনি গান শুনেন না! আজ তার সত্তর বছর বয়সের একটা বিশেষ দিন। খুব কম মানুষের ভাগ্যে এটা ঘটে- একটা পরাশক্তিকে ডিঙিয়ে আর একটা পরাশক্তির নেতৃত্বে আসার সময়টা নিজের চোখে দেখে যেতে পারে!

সারা বিকেল আমতিন সাহেব গান শুনলেন। মাঝরাতের দিকে তার শরীরের জেঁকে জ্বর এল। ১১১ এ ফোন দিয়ে পরামর্শ নিয়েছে বাজিদ। পরামর্শের অংশ হিসেবে আমতিন সাহেবকে সেলফ আইসোলেশনে থাকতে হবে দু’সপ্তাহ। প্রয়োজনে হাসপাতাল নিয়ে যেতে হবে। আমতিন সাহেব অবশ্য হাসপাতালের ব্যাপারে খুব আগ্রহী নন। তার ধারণা হাসপাতালগুলো বুড়ো মানুষদের ইচ্ছে করেই মেরে ফেলে। সরকারের খরচ বাঁচানোর জন্য। ইতালি তো বলেই দিয়েছে- বুড়োদের কোনো ট্রিটমেন্ট দেবে না।
আমতিন সাহেব ১১১ এর কোনো পরামর্শকে খুব একটা গ্রাহ্য করলেন না। তিনি যথারীতি অন্য সবার সঙ্গে বাথরুম শেয়ার করছেন, যদি কোনো কিছুর প্রয়োজন হয় শিপ্রাকে ডাকতে ডাকতে রান্নাঘরে চলে যাচ্ছেন। শিপ্রাকে হাসতে হাসতে বলছেন- ‘জীবনকে মানুষ যত জটিল ভাবছে জীবন আসলে এতো জটিল নয়। জ্বর ব্যাধি সামান্য বিষয়!’
সকালে নামাজের পর থেকে শিপ্রা সুর করে কোরান তেলাওয়াত করছেন। অনেকদিন পর কোরান পড়ার কারণেই কিনা তিনি আয়াতের মাঝখানে আটকে যাচ্ছেন। তেলাওয়াতে সুর কেটে যাচ্ছে। সুরহীন কোরান কানে লাগছে।
আমতিন সাহেব গায়ে চাদর জড়িয়ে নিতে নিতে শিপ্রার কোরান তেলাওয়াতের ঘরে ঢুকলেন।
‘তুমি এমন সুর করে কোরান পড়ছো মনে হচ্ছে আমি মারা গেছি! আমি কি মারা গেছি?’
শিপ্রা মাথা তুলে তাকালেন, কিছু বললেন না।
‘আমাকে এক কাপ চা দিতে পারবে?’
শিপ্রা কোরান বন্ধ করলেন। কোনো এক কারণে তার মনে হল- আহা এই লোকটি আর কিছুদিন পর থাকবে না, তার কাছে চা-ও চাইবে না! তার চোখে পানি এসে গেল!
‘এমন বোকার মতো আমার দিকে তাকিয়ে আছো কেন?’
‘তুমি যাও। আমি চা নিয়ে আসছি।’
‘তোমার কি ধারণা আমি সত্যি মরে যাচ্ছি? আই’ম নট ডায়িং শিপ্রা! চোদ্দ দিন পর আমি আবার ফ্রি হয়ে যাচ্ছি। ফ্রি লাইক এ্যা বার্ড!’
শিপ্রার চোখ থেকে টপ করে এক ফোঁটা পানি গড়িয়ে পড়ল। এই অব্দি করোনায় দুই লাখের মতো লোক মারা গিয়েছে। এই লোকটাকে কে বোঝাবে সেটা?
‘শিপ্রা আমি যখন একটা কথা বলি তার পেছনে নিশ্চয় কোনো যুক্তি আছে। আমার ইম্যিউন পাওয়ার খুব ভাল। ভাল বলেই এই বয়সেও আমি চশমা পরি না। দাঁতের কোনো সমস্যা নেই। ডায়াবেটিস নেই, বুঝতে পারছো?’
শিপ্রা আঁচলে চোখ মুছলেন।
‘শোন, পশ্চিমে সাংঘাতিক তোলপাড় হয়ে যাচ্ছে। আমেরিকা চায়না কোল্ড ওয়ার শুরু হয়ে গেছে। কোভিড-১৯ কে আমেরিকার প্রেসিডেন্ট চায়নিস ভাইরাস বলে দাবী করেছে, বুঝতে পারছো কিছু? গেম হ্যাস অলরেডি স্টার্টটেড! কিন্তু চায়না কী জিনিস বিশ্ব এখনো সেটা চিনতে পারেনি। দেখেছো কী তড়িৎ গতিতে এই কয়দিনেই করোনার মৃত্যুর হার কমিয়ে ফেলেছে! যেখান থেকে করোনা শুরু হয়েছিল, সেই উহান এখন তারা খুলে দিয়েছে! বিশ্ব এইবার বুঝবে চায়না কী জিনিষ!’
শিপ্রা আঁচলে আবারো চোখ মুছলেন।


চা খেতে খেতে আমতিন সাহেব যেটা খেয়াল করলেন- জানালার বাইরে কেউ একজন দাঁড়িয়ে আছে। লোকটিকে দেখতে খানিকটা বাজিদের মতো লাগছে। ও কি আসলেই বাজিদ? বাজিদই তো! আচ্ছা তিনি বাজিদের চেহারা চিনতে পারছেন না কেন? তার কি চোখের কোনো সমস্যা হচ্ছে? নাকি প্রচন্ড জ্বরের কারণে তার এমনটা হচ্ছে?
‘কে বাজিদ? বাজিদ না ওটা?’
‘জি বাবা?’
‘তুমি জানালার পাশে অন্ধকারে দাঁড়িয়ে আছো কেন?’
‘সোস্যাল ডিস্টেন্স বজায় রাখছি বাবা। টু মিটারস!’
আমতিন সাহেবের আবারো দাঁতে দাঁত লেগে গেল। তিনি নিজেকে সংযত করে হাসি মুখে বললেন- ‘হাত ধুয়েছো বাবা?’
‘আমি এক ঘন্টা পরপরই সাবান দিয়ে হাত ধুই বাবা! লিক্যুইড সোপ। হাত ধোয়ার সময় হ্যাপি বার্থডে গানটা দু’বার গাই। ওটা দু’বার গাইলেই কুড়ি সেকেন্ড হয়ে যায়। নিয়ম হচ্ছে সাবান দিয়ে কুড়ি সেকেন্ড হাত ধুতে হবে।’
‘মারাত্মক বুদ্ধি বাবা তোমার!’
‘আমি আধঘন্টা পরপর হ্যান্ড স্যানিটাইজার দিয়ে হাতও পরিষ্কার করি। মাস্ক পড়তাম- কিন্তু বাজারে পাইনি। টিনা বলেছে কাপড় কেটে তৈরী করে দেবে। হোম মেইড!’
‘ আদর্শ বউ তোমার বাবা। সেলাই দিদিমনি!’
‘একটা পিপিই এর ব্যবস্থা হয়েছে। দুপুরের দিকে চলে আসবে।’
‘পিপিই দিয়ে তুমি কী করবে? তুমি নার্স নাকি ডাক্তার?’
‘বাবা যে কী বলেন!’
থেমে বাজিদ আবার বলল- ‘চায়না নাকি আমেরিকাকে কাট কিক মারছে?’
আমতিন সাহেবের দাঁতে আবারো দাঁত লেগে যাচ্ছিলো, কিন্তু শেষ কথাটার জন্য তার মেজাজ আবার তরল হয়ে এলো। ছেলেটা বোকা হলেও ভাল, বিশ্বের খবর রাখে।
‘কাট-কিক মার্শাল আর্টের একটা বড় অস্ত্র! এই খবরটা তুমি রাখ দেখে খুশি হলাম বাবা। বিশ্ব শক্তি সব একহাতে চলে গিয়েছে। ভারসাম্য নষ্ট হয়ে গেছে। চায়ান কী জিনিষ এবার বিশ্ব জানবে। ওরা যেখানে দশদিনে হাসপাতাল বানিয়ে ফেলে, আমেরিকার সেখানে গড়ে দেড় থেকে দু’হাজার করে মানুষ মরে! ওরা উহান খুলে দিয়েছে! সারা বিশ্বের বিজ্ঞানীরা যখন ল্যাবে মাথা গুঁজে ঘাম ঝরাচ্ছে- ওরা তখন ভ্যাক্সিন মানব দেহে ঢুকিয়ে টেস্ট শুরু করে দিয়েছে। এটা গ্রেট ওয়ালের দেশ বাবা! যে ওয়ালটা চাঁদ থেকেও দেখা যায়। সহজ জিনিষ না।’
‘বাবা আপনি ১১১ এর পরামর্শ পুরো মেনে চলবেন!’
‘ওসব আমার লাগবে না। আমরা পুরনো মানুষ, খাঁিট ঘি খাওয়া লোক! কই মাছের প্রাণ!’
‘আপনার জ্বরতো কমছে না।’
‘এই রোগের ওষুধ কি তুমি জানো? পুরনো দিনের মানুষেরা বলত- ওষুধ খেলে সাত দিন, না খেলে এক সপ্তাহ! হা হা হা।’
আমতিন সাহেব এমন শব্দ করে হাসতে থাকলেন। হাসতে হাসতে তার চোখে পানি এসে গেল। কিন্তু তিনি কিছুতে হাসি থামাতে পারছেন না।


ভোর রাতের দিকে আমতিন সাহেবের জ্বর বেড়ে গেল। নিঃশ্বাস আটকে আটকে এলো। তিনি এক প্রকার গোঙানোর মতো শব্দ করতে থাকলেন। অ্যাম্বুলেন্স খরব দেয়া হয়েছে। অ্যাম্বুলেন্স এখনো এসে পৌঁছাচ্ছে না কেন কে জানে!
জীবাণু সংক্রমণের ভয়ে আমতিন সাহেবের পরিবারের কোনো সদস্যই তার রুমের দিকে যাচ্ছেন না। শিপ্রা চেঁচিয়ে চেঁচিয়ে আলাদা একটা রুম থেকে কোরান পড়ছেন। টিনা একটু পরপর বলছে- এখনো অ্যাম্বুলেন্সটা আসছে না কেন? বোকার মতো জানালার ওপাশে দাঁড়িয়ে আছে বাজিদ। তার চোখে পানি।
‘বাবা আপনি একটু ধৈর্য ধরুন, এখনি অ্যাম্বুলেন্স চলে আসবে।’
অ্যাম্বুলেন্স নিয়ে আমতিন সাহেবের কোনো মাথাব্যথা নেই। তার মাথাব্যথা বিশ্ব নেতৃত্ব নিয়ে। তিনি এখন জ্বরের ঘোরে বিড়বিড় করছেন- ‘ইরাক আফগানিস্তানের মতো ওরা কতো কতো দেশ শেষ করে ফেলেছে বাবা! পাকিস্তান আমাদের এতগুলো মারতে পারে যদি ওরা ব্যাক-আপ না করে?’
আমতিন সাহেবের কথা জড়িয়ে যাচ্ছে। তিনি জড়ানো স্বরে বললেন- ‘হারামজাদারা সাপ ব্যাঙ খেয়ে ওরা কীভাবে এতোদূর এগিয়ে গেল? আমরা স্বাধীনতার পঞ্চাশ বছর কী করেছি বাজিদ?’

অ্যাম্বুলেন্স বোধহয় এসে গেছে। সাইরেন বাজছে খুব তীব্রভাবে। চারপাশের মানুষ খুব উৎসুক হয়ে জানালা দিয়ে অ্যাম্বুলেন্স দেখছে। যেন অ্যাম্বুলেন্স আসা একটা বড় ধরনের আনন্দের ব্যাপার।

* লন্ডন / ০৫ মে ২০২০
[email protected]