এক.
‘আজ সকালে দেখি কিছুই চেনা যাচ্ছে না
ঠিকমতো’।—
পৃথিবীর সকালটা এলোমেলো আজ। বেগম সাহেবা ঘুমচোখে রান্নাঘরে যেতে যেতে জানতে চাইলেন, ‘কতো’? বলি, ‘আজ এলোমেলো সকাল। আক্রান্ত ২৪ লাখ ২৪ হাজার, মৃত্যু একলাখ ৬৬ হাজার ছাড়িয়ে গেছে। দেশেরটা আপডেট হয়নি। কার্ভ উর্ধ্বমুখী, কিছুই আর এক-দুই ডিজিটে নেই।’
দেশ ও পৃথিবীর এ অবস্থায় ভাল্লাগে না কিছু। ‘পৃথিবী এলোমেলো সকালবেলায়’ নামের কবিতার বইটা নিয়ে বসি। এ থেকে যদি সামান্য প্রশান্তি পাওয়া যায়! কোনো গ্রন্থ প্রথম থেকে শুরু না করে বই খুলে দৈবচয়নে সামনে পাওয়া পাতায় ধ্যান দেওয়া আমার অভ্যেস। পরে আস্তে ধীরে প্রথম পৃষ্ঠায় যাই। খুলতেই পেয়ে যাই সমকালীনতার রত্নরাজি:
“আলেক্সা বলো, সেইসব প্লেগ বা অন্য মহামারী যদি এইভাবে পৃথিবীকে বেড় দিয়ে ধরে,
যদি শহরে ঢেউখেলা ছাদে চিকিৎসাগৃহের পরে
ফের, পরে, একসার হাসপাতালই চলে আসে,
যা দেখে রিলকে একদিন লিখেছিল
মানুষ এখানে, এইখানে, কোনোদিন কীভাবে বাঁচতে আসে?’”...
আরে ! এই কবি আজকের বিশ্বমহামারীর আভাস কীভাবে পেলেন, বর্ণনায় রাইনার মারিয়া রিলকেকেও টেনে আনলেন! চমকিত চোখে পূর্ব পৃষ্ঠায় গিয়ে দেখি কবিতার নাম ‘আমাজন অ্যালেক্সার প্রতি’। উৎসর্গ ‘অক্ষয় মালবেরি-র মণীন্দ্র গুপ্ত’কে। দ্বন্দ্বে পড়ে যাই। ‘মৌপোকাদের গ্রাম’-এর মণীন্দ্র না হয়ে ‘অক্ষয়’-এর হলো কেন? কবিতার বদলে ‘অক্ষয় মালবেরি’-র আত্মগদ্য কি তবে কবির বেশি প্রিয়? বরিশাল আর গদ্যের মেলবন্ধন যদি হয় তার উদ্দিষ্ট, তবে উৎসর্গ তো ‘বাঙালনামা’র তপন রায়চৌধুরী কিংবা ‘সন্ধ্যানদীর জলে’র শঙ্খ ঘোষের নামেও হতে পারত! ‘অ্যালেক্সা’ নামের পশ্চিমা প্রযুক্তির সঙ্গে সোঁদামাটিগন্ধময় মণীন্দ্রের সম্পর্ক কী—এসব সুরাহা না করেই আপাতত কবিতায় ঢুকে যাই।
‘অ্যালেক্সা’ নামের ওই কথামেশিন কবির জিজ্ঞাসার জবাবে মানুষকে সময়, আবহাওয়া ইত্যাদি মুখস্থবিদ্যার মতো বলে যেতে থাকে। কালপ্রবাহের অস্থিরতা, নৈসর্গিক সৌন্দর্য, ইতিহাসে দাগ কেটে থাকা বর্বরতা বাদে অ্যালেক্সার উত্তর পূর্ণ হতে পারে না বলে তার কাছে কবির নানা প্রশ্ন। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে নাৎসিবাহিনী অধিকৃত পোল্যান্ডের গ্রাম আউশভিৎস-বিরকেনাউ নির্মুল শিবিরের সঙ্গে রায়ের বাজারের তুলনা, জোসেফ স্টালিন আমলে কাতিন ফরেস্টে রাশান রাজনীতিক বেরিয়া-র সিক্রেট পুলিশ ‘এনকেভিডি’ দিয়ে পোলিশ সেনা হত্যাযজ্ঞের মতো ঐতিহাসিক ভায়োলেন্স নিয়েও প্রশ্ন ওঠে অ্যালেক্সার কাছে। কারণ:
"চলমান ভাপ ওঠার মতো
কিছু কিছু বিষয় দৃশ্যমান থাকে—
যেমন অস্থির কালপ্রবাহ
যেমন আবেগসঞ্চারী কিছু বিহ্বলতা
সেসব বাদ দিয়ে কী করে ঝড় বাতাস নিয়ে
তোমার উত্তর পূর্ণাঙ্গ হতে পারে বলো?"
বোঝা যাচ্ছে, কবি ‘আবেগসঞ্চারী বিহ্বলতা’ দিয়ে
অ্যালেক্সাকে নাকাল করে ছাড়তে চান। দেখতে পাই কবি জিজ্ঞাসা করছেন:
"এবং এই এক দেশে কেন তিনখানা ইছামতী নদী?"...
"কুয়োর পাশটাতে যার হাঁস ঘোরে
সেটা কার হাঁস
কার বিড়াল
কাদের গিরগিটি ঘাসের ফাঁকে ফাঁকে?"...
"প্রতি ভোরে পৃথিবী শীত শীত হয়ে এলে
কাঁথার নীচে লুকিয়ে কেন সবচাইতে ভালো বোধ হয়"...
"আমাকে আরেকবার ভোরের নদীর কথা বলো
আরেকবার যে পাখি নির্লিপ্ত ডাকে বলো তার নাম
যে নদী সে কি শান্ত ইছামতি, আর তাতে যে গান তা কি ভাটিয়ালি"—
এসব বলে লাগাতার প্রশ্ন করে যান কবি। ‘আবেগসঞ্চারী বিহ্বলতা’ময় উত্তর কি আর অ্যালেক্সার জানা ?
এ পর্যন্ত ঠিকই ছিল। প্রথম থেকে একটানে পড়তে গিয়েই গোল বাধল। দেখি তেমন কিছু বুঝতে পারছি না। পারম্পর্যহীন শব্দগুচ্ছ কানে ঢুকছে। পৃথিবীর প্রতি একহাত নেয়া নেতিবাচক বাক্যবন্ধ সকালবেলায় প্রশান্তির বদলে উস্কানি দিচ্ছে আমার উচাটন মনে:
"আর শোনো, এ পৃথিবী শেষ হওয়াটাই ভালো—এখানে নিজে থাকতে অন্যকে মেরে উৎসর্গ করা হয়"…
"আর আমার ছোট মেয়েটাকে যে পড়াতে আসে
সে তো গালি দিচ্ছে আমার বাচ্চা ছোট মেয়েটাকে,
বলছে, মন দিয়ে শোন্ বদমাশ মেয়ে,
এ পৃথিবী নিয়ে ভূগোলের বইয়ে
যাই-ই লেখা থাক
এ পৃথিবী টিকবে না"...
"পৃথিবী শেষই যদি হয়ে যায় তো তবে
কতোদূরই বা যাওয়া যেতে পারে, যাওয়া হবে"...
"এ পৃথিবীতে মানবপ্রজাতি নিয়ে শেষ ভাবনাটুকু
মানুষ নয় বরং পাখিদের ভাবা হয়ে গেছে"...
"চিরবসন্ত যাকে বলে সেটা কথার কথা শুধু
কারণ ওভাবেই বলতে হয় তাই
বলা হয়েছে বহু কিছু আমাদের পৃথিবীতে"...
"আর তুমি বোকা মেয়ে তুমি যে আশা করছ
এই পৃথিবী ভালো,
এই পৃথিবীতে ভালোবাসা চিরস্থায়ী ও সত্যি হতে পারে—
ভালোবাসা, তা-ও এই পৃথিবীতে?"...
"পৃথিবী শান্ত তবে জাগছে আরেকটা তছনছ দিনের খাঁজে ঢুকে যাবার দিকে"...
"হায়, কে অন্যায় করছে না কার সাথে?
আর বলো কে আসলে সুখে আছে, তাও এই পৃথিবীতে?"...
“যদিও বিস্ফোরণ যা ঘটবেই যে কোনো মুহূর্তে এই পৃথিবীতে”...
“পৃথিবী এতোটাই ভয়ংকর,
কারও রহম নেই, ছিল না কখনও
অতএব যে পরিচয়ই দাও তাতে কী বা হেরফের,
কারণ পৃথিবী এ রকমই ছিল’”...
“আমিও এই ফাঁকে কবিতা লেখার অবকাশ পেয়ে
বুঝলাম পৃথিবী শূন্য পৃথিবী ফক্কা পৃথিবী ফোঁপরা বটে”...
“আর ধানসিড়ি ধ‘রে পান মুরগি হাঁসগুলো সরালিদের নকল করা ছেড়ে
পানিতেই এইমাত্র বসে গেল হতভম্বভাবে—
কারণ তারা বুঝতে পারছে না আপাতত কিছুদিন
এই সেলাই করা অজ্ঞান পৃথিবীতে তাদের আর কী করার আছে”...
এলোমেলো সকালে প্রশান্তির জন্য যখন ‘পৃথিবী এলোমেলো সকালবেলায়’ নিয়ে বসেছি, তখন দেখি তা আমার কানে উগরে দিচ্ছে নেতিবাচকতা। দেখি, কবি প্রেম-রোমান্টিকতায় ‘কিছু দারুণ সময়’ কাটানোর মধ্যেও পিস্তল টেনে আনছেন; বেকারিতে পাউরুটির বদলে তন্দুরের পাশে দাঁড়ানো ‘সাদাহাত নাজুক মেয়েগুলো’র কাছে ব্রাজিলের ‘প্যাশনফ্রুট’ চেয়ে কেলেঙ্কারি বাধাচ্ছেন; গৃহবন্ধুসহ লংড্রাইভে ‘বনের কিনারে’ গিয়ে স্টেরিওতে ওয়াডালি ব্রাদার্সের ‘ইয়াদ পিয়া কী আয়ে, ইয়ে দুখ সহা না যায়ে’ ঠুমরির বদলে গুন্ডেচা ব্রাদার্সের রাগ শ্যামকল্যাণ বেজে চলার রোমান্টিকতায়ও চিয়াপ্পা-বেরেটা হাতে ষন্ডাবেষ্টিত ভায়োলেন্স ডেকে আনছেন; স্মরণ করছেন অসফিয়েনচিম ক্যাম্পের নাৎসি বর্বরতা; নিজ শহরে সিরামিক প্রদর্শনীতে কাপ পিরিচ দেখে দেখে ক্লান্ত হয়ে মিসাইলের নাকে সিরামিক বসানোর জন্য হা-পিত্যেশ করছেন।
এই কবি বেরসিক বড়। তিনি আঁধারেও
ট্রিগার, তরবারি দ্যাখেন—পিস্তল, চিয়াপ্পা, এম নাইন টুয়েন্টি টু, ক্রুজার, সাবমেরিন, নাইটকোচ ডাকাত, সালফার, ছোরা, আর্মার্ড বক্সার ভেহিকল, ব্যালিস্টিক মিসাইল, এসব তার প্রিয়। আমার মাথা ঝিম মেরে আসে। টেবিলে বই রেখে উঠে যাই।
দুই.
অনেকক্ষণ পৃথিবী ও অ্যাপোক্যালিপসভিত্তিক মুভি দেখি। প্রশান্তি নিয়ে বইটিতে ফিরতে উন্মুখ হই। আকস্মিক দেখি, আরে, পড়ছি তো কবি-লেখক মাসরুর আরেফিনের কবিতার বই! পূর্ণ ‘মাসরুরপাঠ’ রিলেট করে কবিতা না পড়লে ‘আবেগসঞ্চারী বিহ্বলতা’ ছাড়া যেমন অ্যালেক্সার উত্তর পূর্ণাঙ্গ হয় না, তেমনি ‘পৃথিবী এলোমেলো…’ এলোমেলোই থেকে যাবে, বুঝে আসবে না।
রচনা, সাক্ষাৎকার, সামাজিক মাধ্যম মিলে সম্পূর্ণ মাসরুরপাঠে বোঝা যায়, তার পোয়েটিক ডিকশনটা আলাদা। বিশ্বসাহিত্যের কনটেমপোরারি হকিকত মাসরুরের অধীত। যৌক্তিক জগতের প্রেম, প্রকৃতি, সঙ্গীতবাদ্যে তার মতি। নেপথ্যে মেটাফিজিক্সায়ন—বস্তু ও সত্তার স্বরূপ সন্ধানে তার আগ্রহ। অনাদিকাল থেকে প্রবহমান বৈশ্বিক দ্বন্দ্ব, ক্ষমতাকেন্দ্রিক ধ্বংস, হানাহানির ঐতিহাসিকতার প্রতি তার প্রবল টান। উপরন্তু আইডিওলজি আরোপ ব্যতিরেকে রিপোর্টারের মতো চিন্তন-সৃজন বিবৃত করে যাওয়ার নাম মাসরুর। এর দরুন তার চরিত্রমুখে বিশ্বসাহিত্যের খই ফোটে। ঘটনা-অনুঘটনায় প্রকৃতি, বিজ্ঞান, বাস্তবতার মধ্যে ঢুকে পড়ে অধিবিদ্যা—যা সাদাচোখে বিয়ন্ড-দ্য-লজিক। এ জন্য প্রেম-রোমান্স-সঙ্গীতের মধ্যে এসে যায় ভায়োলেন্স। এই পোয়েটিক ডিকশন মাথায় নিয়ে নিলে তার কবিতা মেটাফরসহ সব বুঝে নিতে কষ্ট হয় না।
আমি তার কবিতা বার বার পড়তে থাকি, আর মনে হয় এই কবি বেড়ে ওঠার বয়স থেকে দেখে আসা প্রকৃতির ফুল-পাখি, নদী, বৃক্ষকে একাকার করেন, সত:শ্চল কাব্যভাষার মধ্যে তার প্রিয় সঙ্গীত, প্রিয় শিল্পী, অধীত বিশ্ববিদ্যা অভিজ্ঞতা চালান করে দেন।—
‘“মনে হচ্ছে স্মৃতি থেকে মেয়েটাকে লেখা শৈশবের চিঠি পড়াটাই ভালো
কারণ চারপাশে দূর্বাঘাসের গায়ে
মেক্সিকান অরেঞ্জ গাছ আছড়ে পড়েছে কেন,
তার কোনো খোঁজ আছে কারো?”
‘দূর্বাঘাসের গায়ে মেক্সিকান অরেঞ্জ’-এর আছড়ে পড়ার স্টাইল মাসরুরের প্রাতিস্বিক। নষ্টালজিক প্রকৃতির সঙ্গে মিশতে থাকে তার বিশ্ববীক্ষা। সেখানে ‘চাখারে বেতবনের পারে’ হেঁটে যায় ‘বলাকা মোহনচূড় বা ঝোটনের দল’; মুহুর্মুহু কবিতায় গান গায় ‘ঘন বন শালবন বনতুলসী অলীক কুচফল / পারুল জারুল ইত্যাদি আর অর্জুন’; সঙ্গে পাওয়া যায় দেবদারু, মেঘশিরীষ, গগণশিরীষ, গামারি, পানপাতা, কাঠমল্লিকা, রাধাচূড়া, দারুচিনি। তার কবিতায় উঠে আসে বরিশালের শেফালি থেকে নিয়ে বিদেশি উইচহ্যাজেল, হর্নবিম, বাংলার জাম-জারুল থেকে নিয়ে দক্ষিণ আমেরিকার জ্যাকারান্ডা, নাটাফল থেকে বিদেশি স্লিপারি এলম্-এর এলেম।
এ কবিতার মাধুর্য পেতে মেটাফিজিক্সের জটিলজগতের ধারণা নিলেই হয় না, থাকতে হয় বহুমাত্রিক জ্ঞান ও অভিজ্ঞতার মিশেল—ঝালকাঠির রাজাপুর কাউখালি থেকে ছায়াপথ বা মবিডিকের সমুদ্র অভিযান; ‘তিনখানা ইছামতি’, গাবখান, কালিজিরা, ধানসিড়ি, বিষখালী, সুগন্ধা, বালুনদী থেকে হাডসন, দানিয়ুব; রোমান-গ্রিকপুরাণ, নাৎসি বর্বরতা থেকে আজকের সিরিয়াযুদ্ধ; ভারতীয় ধ্রুপদী শিল্পী গুন্ডেচা ব্রাদার্স থেকে মার্কিন জেরি
বী-স, ফার্মগেট থেকে যু্দ্ধস্মৃতিময় ফ্রান্সের লিবার্টি রোড, ঢাকাই সিনেমার রোজিনা থেকে হলিউডি বেটি ডেভিস পর্যন্ত নিয়ে যেতে হয় আপনার জানাশোনার পরিধি।
আপনার জানা বা সুলুকসন্ধান থাকলে ইছামতির গান ভাটিয়ালি গান কি-না বলে অ্যালেক্সাকে প্রশ্ন করে মাসরুর যখন চলে যাবেন আইসল্যান্ডের শিল্পী আসগেইর এইনারসনের বিখ্যাত ‘গোয়িং হোম’ গানে মেতে উঠতে, নিউইয়র্কের ইয়াসগার্স পার্কের উডস্টক সঙ্গীত উৎসব মিস করার কথা তুলবেন, তখন আর বুঝতে অসুবিধা হবে না তাকে। ছায়াপথ থেকে সমুদ্র পর্যন্ত জ্ঞান প্রয়োজন এজন্য যে:
"কীভাবে হিসাব মেলে সন্ধ্যা যে কত দূরে ছিল কত আগে!
কেমন সন্ধ্যা ছিল আজ এটা?
আকাশে এ্যানড্রমিডা অরিয়ন কিছুই দেখিনি তো"— বলে এই কবি ক্রিমসন রঙের বর্ণনায় চলে গেলে ছায়াপথ থেকে সন্ধ্যার দূরত্বের হিসাব আপনার মিলে যাবে অনায়াসে।
‘গড়িয়াহাটগামী লালবাসের সিটে’ বসে ‘ডাউন বালিগঞ্জ ট্রাম’-এর নিচে ধানসিড়ি তীরের কবি জীবনানন্দকে ছাতু হওয়া দেখবেন কবি, আর ট্রামের হেলপার ‘হরিচাঁদ’-এর সঙ্গে যখন ক্যাপ্টেন আহাব এর তুলনা টেনে আনবেন, তার সঙ্গে মবিডিকের তিমি শিকার অভিযানের কথা জুড়ে নিলে আকস্মিক মঞ্চে ক্যাপ্টেন আহাব এর এই প্রবেশ কেন, তা বোঝা জলবৎ তরলং হয়ে যাবে তখন।
মাসরুরে মজা এখানেই। হোমিওর মাদারটিংচারের মতো সত:শ্চল কাব্যকথার মধ্যে তিনি অবলীলায় মেশান মিথ, বিশ্ববীক্ষার আরক। ‘সংবাদ’-এর নেপথ্যকাহিনীর মতো তার ব্যাখ্যায় গিয়ে মাধুর্য বের করে আনতে হয়।—
“পৃথিবী ঘৃণার কারখানা,
জুডাস-ব্রুটাসে কে এই ঘর যথেষ্ট ভরে দিল?”...
“আর তখনই, যখন ঘাসে ঘাসে জেগে উঠছে ময়াল সাপগুলো
ছোট সৈন্য লাইকাওন ভোরের আলোর নিচে
দু টুকরো হয়, হতে বাধ্য বীর একিলিসের কিরিচে—চিরকাল?”
গ্রিক-রোমান পুরাণ জানা না থাকলে জুডাস-ব্রুটাস-একিলিস দুর্বোধ্য হয়ে ধরা দেবে।
পাঠকের মনে থাকার কথা, রবীন্দ্রনাথের ‘একরাত্রি’ গল্পের নায়ক বাল্যসখি সুরবালার প্রেম তুচ্ছ করে নাজির সেরেস্তাদার হওয়ার লক্ষ্যে কলকাতায় চলে যান, স্বাধীনতা আন্দোলন-সংগ্রামে যোগ দেন। তার উক্তি: "নাজির সেরেস্তাদার হইতে আসিয়াছিলাম, কিন্তু মাট্সীনি গারিবাল্ডি হইবার আয়োজন করিতে লাগিলাম"। রবীন্দ্রনাথের এই ‘মাটসীনি গারিবাল্ডি’র পরিচয় উদ্ঘাটনে সেকালে এন্তার বই ঘাঁটতে হতো, ঘেঁটে জানা যেতো, মাটসিনি, গারিবাল্ডি যথাক্রমে ইতালির রাজনীতিক ও দেশপ্রেমিক, দেশের অন্যতম দুই জনক। ‘পৃথিবী এলেমেলো সকালবেলায়’ বইয়ে নাটশেল আকারে এরকম উল্লেখ বহু।
মাসরুরের কবিতা দর্শন অধিবিদ্যার নানা নিরীক্ষার দরুন সাদাচোখে জটিল লাগে। কবির প্রথম কাব্যগ্রন্থ ‘ঈশ্বরদী মেয়র ও মিউলের গল্প-’তে যারা ‘ঈশ্বরদী‘ নামের বাস্তব জনপদ খোঁজেন, তাদের হতাশ হতে হয়। জনপদের নামটি ব্যবহার করে মাসরুর আদতে গড়ে তোলেন সম্পূর্ণ নতুন জগৎজনপদ—ঈশ্বরদী।
তিন.
হাহ্, যেন বই আলোচনা করতে বসেছি। আসলে না, করোনা গৃহবাসের অবসরে সাদামাটা পাঠপ্রতিক্রিয়া দিচ্ছি মাত্র। প্রথানুগ আলোচনা না বলে ইনভারটেড কমার বাক্যে সোর্সকবিতার নাম ব্রাকেটবন্দী করিনি। বইয়ের উৎসাহ জাগানিয়া দিক, আমার কাছে, এর কিছু অনবদ্য লাইন। মনে করি, তার কবিতার দুয়েক চরণই ছাপার অক্ষর থেকে মুখে উঠে যায় মানুষের, কালোত্তরের পথে হাঁটে। এমন মোহময় বহু লাইনের হকদার ‘পৃথিবী এলোমেলো সকালবেলায়’-এর কবি, যেমন:
"মানুষের পিপাসার পাশে কোনো পাতাঝরা-মতো
আনুমানিক পবিত্রতা নেই, ছিল না কখনও"।
"তুমি তার চেয়ে আমাকে তোমার বাসায় নিয়ে চলো
সেখানে অন্তত নীরবতা ভাগ করে বসে থাকা যাবে"।
"তাই আপাতত মিশে থাকা যাক দেবদারুদের পাতার বিন্যাসের মাঝে"।
"এরকমই হাওয়ায় উড়ছে ধুলো চিরকাল মাত্রা না মেনে।"
"মানুষ এমন কেন শোল মাছের মতো, অকারণে ছটফটে অকারণে দ্রুত"?
"আর হাসপাতালগুলো ভরে যাচ্ছে এমন সব লোকে
যারা জীবনের এতো খরচাপাতি দেখে অসুস্থ হয়ে গেছে"।
বৈশ্বিক ক্ষমতা-দ্বন্দ্ব ডিল করতে করতে পৃথিবী ও প্রেম টিকে থাকার প্রশ্নে যতো নৈরাশ্যবাদীই হোন মাসরুর, চেতন-অবচেতনে তিনি কার্যত বুনে যান আশার বীজমন্ত্র—
"এ পৃথিবী যা-ই বলো, শেষ হবার নয়
আকাশের থেকে চাঁদ বা সূর্য হাত তুলে খুলে নেবে,
স্তব্ধ করে দেবে সব গভীর তমসায়—
ব্যাপারটা এত সোজা নয়"।
চার.
এলোমেলো সকালে বইয়ে বুঁদ হয়ে থেকে সন্ধ্যা গড়ায়। জলি এক ফাঁকে টেবিলে চা দিয়ে বলে গেল যে, ‘আজ পৃথিবী সত্যিই এলেমেলো। আজ মিলে মোট মৃত্যু একশ ছাড়ালো, নতুন রোগী একলাফে চারশ বিরানব্বই। মোট আক্রান্ত তিন হাজারের ঘরে'। চোখ কপালে তুলে বললাম, বলো কী!
ঢাকা ।। ২০ এপ্রিল ২০২০
* বইটা পাওয়া যাচ্ছে শাহবাগে পাঠক সমাবেশ ও অন্যান্য দোকান এবং অনলাইনে রকমারি ডট কমে।