করোনাকাল
বিচ্ছিন্ন অনুভব
মাহফুজা হিলালী

প্রবন্ধ
অধ্যাপক আনিসুজ্জামান
শামসুজ্জামান খান

গল্প
ডায়মন্ড লেডি ও পাথর মানব
হামিদ কায়সার

গদ্য
নিদ্রা হরণ করেছিল যে বই
মিনার মনসুর

নিবন্ধ
পঞ্চকবির আসর
সায়কা শর্মিন

বিশ্বসাহিত্য
আইজাক আসিমভের সায়েন্স ফিকশন
অনুবাদ: সোহরাব সুমন

বিশেষ রচনা
প্রথম মহাকাব্যনায়ক গিলগামেশ
কামাল রাহমান

শ্রদ্ধাঞ্জলি
মুজিব জন্মশতবর্ষ
মারুফ রায়হান
 
সাক্ষাৎকার
কথাশিল্পী শওকত আলী

জীবনকথা
রাকীব হাসান

ভ্রমণ
ইম্ফলের দিনরাত্রি
হামিদ কায়সার

ইশতিয়াক আলম
শার্লক হোমস মিউজিয়াম

নিউইর্কের দিনলিপি
আহমাদ মাযহার

শিল্পকলা
রঙের সংগীত, মোমোর মাতিস
ইফতেখারুল ইসলাম

বইমেলার কড়চা
কামরুল হাসান

নাজিম হিকমাতের কবিতা
ভাবানুবাদ: খন্দকার ওমর আনোয়ার

উপন্যাস
আলথুসার
মাসরুর আরেফিন

এবং
কবিতা: করেনাদিনের চরণ

১৬ বর্ষ ০৫ সংখ্যা
ডিসেম্বর ২০২৩

লেখক-সংবাদ :





কিংবদন্তী জামিলুর রেজা চৌধুরী স্মরণাঞ্জলি
ফারসীম মান্নান মোহাম্মদী

অধ্যাপক জামিলুর রেজা চৌধুরী আমাদের জীবনে একজন সার্বিক শিক্ষকের ভূমিকা পালন করেছেন। জাতীয় জীবনে কয়েকজন এমন শিক্ষক আমরা পেয়েছি, যাঁরা সরাসরি শিক্ষক না হয়েও ‘স্যার’ সম্বোধন পেয়েছেন আপামর মানুষের হৃদয়ের অন্তঃস্থল থেকেই। আমাদের সময়কার মানুষদের মধ্যে দুজন এমন আদ্যোপান্ত শিক্ষক আছেন, যাঁদের আদ্যক্ষর সর্বজনবিদিত। একজন সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী, সংক্ষেপে ইংরেজিতে তাঁর নামের আদ্যক্ষর এস আই সি-এর সমন্বয়ে ‘সিক’ স্যার, অন্যজন প্রয়াত জামিলুর রেজা চৌধুরী, সংক্ষেপে ‘জেআরসি’। ‘জেআরসি’ নামটার মধ্যেও একটা প্রকৌশলগত দার্ঢ্য আছে মনে হবে। কারণ এই নামটি এদেশীয় বহুসংখ্যক প্রকৌশল প্রকল্পের সাথে বহুজড়িত একটি নাম। ‘জেআরসি’ নামোচ্চারণের অর্থই একটি মেগাপ্রকল্প, এবং তজ্জনিত যাবতীয় কৌশলগত এবং কাঠামোগত খুঁটিনাটির এক বিস্তর ভাবগাম্ভীর্য যেন। অনেকটা যেন পেশাগত সাফল্য এবং প্রকৌশল এবং প্রকল্প সত্তার আড়ালে তাঁর শিক্ষকসুলভ মাধুর্য যেন কিছুটা আবৃত মনে হয়।
অধ্যাপক জামিলুর রেজা চৌধুরী আমার সরাসরি শিক্ষক ছিলেন না। তিনি পুরকৌশলের জাঁদরেল অধ্যাপক, আমি তড়িৎ কৌশলের চিরকালীন প্রান্তবর্তী এক ছাত্র। তবে তাঁর আগ্রহের সাথে একটি অভিসারী রেখা আমারও ছিল, আর সেটা হল আমার প্রিয় বিষয় জ্যোতির্বিজ্ঞান। এই জ্যোতির্বিজ্ঞানের সূত্র ধরেই অধ্যাপক জামিলুর রেজার সাথে আমার প্রথম সাক্ষাৎ। সম্ভবত সেটা ১৯৯২/৯৩ সাল হবে। আমি তখন মনে হয় বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হয়েছি, বিস্রস্ত বসে আছি ক্লাস শুরুর অপেক্ষায়। তখন আমরা সহ আরও কয়েকজন শিক্ষার্থী জ্যোতির্বিজ্ঞানে তুমুল আগ্রহী। নিতান্ত করুণা করে প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হয়েছি। ভাবছি, আর কটা দিন সবুর কর, মহাজাগতিক রসুন ফলল বলে। যাহোক, বুয়েটে ভর্তির সুবাদেই আমার উপরে দায়িত্ব পড়ে অধ্যাপক জামিলুর রেজার একটি লেখা সংগ্রহ করার। বিষয় হল আরেক প্রয়াত অধ্যাপক মোহাম্মদ আবদুল জব্বার। তিনিও বুয়েটের শিক্ষক, ছাত্রকল্যাণ পরিচালক এবং গণিতের অধ্যাপক ছিলেন। কিন্তু তাঁর মূল পরিচয়টি ছিল তিনি বাংলায় জ্যোতির্বিজ্ঞান চর্চার পথিকৃৎ। তিনিও তখন প্রয়াত হয়েছেন বেশ কিছুদিন হল। ‘মহাকাশ বার্তা’ পত্রিকার তরফে আমাকে যেতে হল অধ্যাপক জামিলুর রেজার কাছে, তিনি যদি আবদুল জব্বারকে নিয়ে কিছু লিখে দেন। আমি ফোন করে অ্যাপয়েন্টমেন্ট নিয়ে দুরুদুরু বুকে গিয়ে হাজির হলাম বুয়েটের পুরকৌশল ভবনে। ঘন্টাখানেক অপেক্ষা করে দেখা পেলাম অধ্যাপক জামিলুর রেজা স্যারের। তিনি দেখতে ঠিক সেই মিথিক অধ্যাপকের মতই, স্মিত হাস্যের ভারী দুচোখের অধিকারী যেখানে রাজ্যের সকল গাণিতিক জ্ঞান ভিড় করে আছে। অবশ্যই তাঁর নাম আমি আগে থেকেই জানতাম। জানতাম তিনি দেশের তথ্যপ্রযুক্তির এক পুরোধা মানুষ। তখনকার বিখ্যাত ‘কমপিউটার জগত’ পত্রিকাটির অন্যতম উপদেষ্টা তিনি। সেখানে তাঁর নাম ছাপা হতে আমি দেখেছিলাম। ইতিমধ্যে বুয়েট কমপিউটার কেন্দ্রের পরিচালকের পদে ছিলেন অনেকদিন। সেটাও তখন অতীত। আমরা লোকমুখে শুনেছি ‘যমুনা মাল্টিপারপাজ ব্রিজ’ অথরিটির হয়ে কাজ করে তিনি দেশের দুইশত কোটি টাকা বাঁচিয়ে দিয়েছেন, ডিজাইনের ছোট একটা ত্রুটি সারিয়ে। মুখে মুখে আরও কত গল্প আছে তাঁর! বলা যায় স্যার তখন তাঁর ক্যারিয়ারের মধ্যগগনে। এবং তিনি দেখতে সেইসব প্রফেসরদের মতো, এঞ্জিনিয়ারিঙের পৌরাণিক প্রফেসররা যেমন হলে ঠিক মানাতেন। তখনই আমরা জানি, অধ্যাপক জামিলুর রেজা একজন চলমান ক্যালকুলেটর। তাঁর গণনার ক্ষমতা এবং স্মৃতিশক্তি বিখ্যত।     
প্রথম সাক্ষাতে স্যার বললেন, তুমি কাল-পরশু আস। আমিও সেইমত গেলাম। আমাকে দেখে স্যার মুখ নিচু করে লজ্জিত হাসি দিলেন, আমি বুঝতে পারলাম, তিনি লেখাটা লিখতে পারেননি। তিনি বললেন, তুমি কি কিছুক্ষণ বসবে? আমি তো সানন্দে রাজি, বুয়েটের পুরকৌশল ভবনে বসতে পার। ‘না’ বলি কোন সাহসে! তিনি আমাকে পুরকৌশল বিভাগের বিখ্যাত লাইব্রেরিখানায় বসালেন। এবং পাশের কম্পিউটার রুমে ঢুকে গেলেন। আমি বসে বসে গম্ভীর মুখে সিভিল এঞ্জিনিয়ারিঙের ঢাউস ঢাউস ইংরেজি বই দেখছি আর হা করে সব দৃশ্য গলাধকরণ করছি। অধ্যাপকেরা নিচু স্বরে কথা বলছেন, কেউ ব্যস্ত হয়ে বেরিয়ে যাচ্ছেন, কেউ বকতে বকতে ঢুকছেন, কেউ বিশাল শিটে জটিল এঞ্জিনিয়ারিং ড্রইং করছেন। আ পার্ফেক্ট স্কুল অফ এঞ্জিনিয়ারিং!  ঘন্টা দেড়েক পর আমাকে ডাকলেন, স্যার ভেতরে বসা, একটা কমপিউটার প্রিন্ট-আউট দিলেন। দু পৃষ্ঠার। অধ্যাপক আবদুল জব্বারের উপর একটি মনোজ্ঞ প্রবন্ধ, প্রকৌশল শিক্ষায় তাঁর অবদান ইত্যাদি। আমাকে পড়ে দেখতে বললেন, জিজ্ঞেস করলেন, চলবে কিনা? আমি খুশী হয়ে চলে এলাম, এবং বাসায় বসে গপ্প দিলাম কীভাবে আমি সেই বিরাট মহীরুহ অধ্যাপকের সাথে একটি বেলা কাটিয়ে এসেছি।         
এরপর স্যারের সাথে ওভাবে আর কোনো মিথস্ক্রিয়া হয়নি। আমি তড়িৎ কৌশলেই থেকে গেলাম। সেখানেই যাবতীয় পড়াশোনা, শিক্ষকতা ইত্যাদি। কিন্তু অধ্যাপক জামিলুর রেজা এগিয়েছেন আরও অনেকগুলো পথে। তিনি ব্র্যাক বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য ছিলেন অনেকদিন, বঙ্গবন্ধু সেতু, ঢাকা মেট্রোরেল প্রকল্প, পদ্মা সেতু আরো কত কী প্রকল্পে তিনি কাজ করেছেন। বাংলাদেশের পুরকৌশল খাত তাঁকে ছাড়া চিন্তাও করা যায় না। এতটাই মহীরুহ তিনি।
বলতে গেলে, এর পরবর্তী সংযোগ ২০১৬/১৭ সাল থেকে পুনরায়। অধ্যাপক জামিলুর রেজা সবসময়েই প্রথাবিরোধী কাজে সময় দিয়েছেন। তিনি গণিত অলিম্পিয়াড আন্দোলনের অন্যতম প্রাণপুরুষ, অধ্যাপক জাফর ইকবাল এবং অধ্যাপক কায়কোবাদ ও মুনির হাসানের সাথে তিনি এই বিশাল দক্ষযজ্ঞের সাথে জড়িত। ফলে কোনো না কোনো অলিম্পিয়াডে তাঁর সাথে দেখা হতোই। পরে বাংলাদেশ বিজ্ঞান জনপ্রিয়করণ সমিতির পক্ষ থেকে আমরা যখন কিশোরদের জন্য আন্তর্জাতিক জুনিয়ার সায়েন্স অলিম্পিয়াডে যাওয়া শুরু করি, তখন থেকেই তিনি খুব মন দিয়ে এই যাত্রাপথকে অনুসরণ করেছেন, সকল অনুষ্ঠানে সশরীরে থেকেছেন, আমার কাছ থেকে প্রায়শই খুঁটিয়ে বিভিন্ন দেশের শিক্ষার্থীদের প্রস্তুতি নিয়ে জানতে চেয়েছেন। তিনি জ্যোতির্বিজ্ঞান আন্দোলনের সাথেও জড়িত ছিলেন। কিন্তু একটি ভিন্নভাবে। অলিম্পিয়াড একটি বিরাট আয়োজন। এই আয়োজনের যখনই জরুরি কোনো অবকাঠামোগত সাহায্য দরকার হয়েছে, আমরা জানতাম আমাদের একজন অভিভাবক আছেন, আমরা তাঁকে ফোন দিতাম। মুশকিল আহসান, তৎক্ষণাৎ।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের পদার্থবিদ্যার অধ্যাপক প্রফেসর আহমদ শফীর কাছে আমি জেনেছি, অধ্যাপক জামিলুর রেজা ছিলেন সেন্ট গ্রেগরি স্কুলের প্রাক্তনী। তিনি স্কুলে গণিতে রেকর্ড মার্কসের (৯৯ অথবা ৯৮, ১০০তে) অধিকারী ছিলেন। তাঁর রেকর্ডের সবচেয়ে কাছাকাছি (৯৭) গিয়েছিলেন কয়েক বছর পর প্রফেসর শফী। সংখ্যাটা ভুল হতে পারে, কিন্তু অধ্যাপক জামিলুর রেজার সেই বাল্যকাল থেকেই গণিতে তুরন্ত মেধার পরিচয় পাওয়া যায়। শুধু গণিতে নয়, অ্যাপ্লায়েড সায়েন্স অ্যান্ড এঞ্জিনিয়ারিঙের বিবিধ বিষয়েরও তিনি চোস্ত সমঝদার। এঞ্জিনিয়ারিং ম্যাথমেটিক্স তাঁর ছিল দারুণ হস্তগত ব্যাপার। প্রকৌশল শিক্ষায় গণিতের গুরুত্ব নিয়ে নানাভাবে ভেবেছেনও তিনি। কদিন আগেও ভাবতেন। বছর চারেক আগে যুক্তরাষ্ট্রের ম্যাথ অলিম্পিয়াড টিমের প্রাক্তন কোচ অধ্যাপক পো-শেন লোহ ঢাকায় এলে অধ্যাপক জামিলুর রেজা আমাদের মতো কয়েকজনকে তাঁর আফিসে এক ঘরোয়া ডিনারে আপ্যায়ন করেন। তিনি ড. মাহবুব মজুমদার (ব্র্যাক বিশ্ববিদ্যালয়) এবং ড. লোহের সাথে খুঁটিয়ে আলাপ করেন গণিত শিক্ষার বিভিন্ন বিষয়ে।
অধ্যাপক জামিলুর রেজা আমাদের দেশের জন্য এক অমূল্য সম্পদ। তাঁর প্রয়াণ আমাদের প্রকৌশল প্রকল্পগুলির ভবিষ্যৎ পন্থার জন্য একটা বড় ধাক্কা। দেশের সিভিল এঞ্জিনিয়ারিং পেশা এবং খাতে তাঁর অভাব বহুদিন অনুভূত হবে। তিনি সমাজের একজন অভিভাবকতুল্য মানুষও বটে। আমাদের দৈনন্দিন কাজগুলোর জন্য আমাদের এখন অনেক বেশি ভাবতে হবে আর দৌড়ঝাপ করতে হবে। কিংবা গণিত শিক্ষা নিয়ে কেই বা আর একান্তে ভাববেন? জীবনানন্দ বলে গেছেন ‘এ পৃথিবী একবার পায় তারে, পায়নাকো আর’। আমাদের জন্য জামিলুর রেজা চৌধুরীও ঠিক তাই। শুধু পুরকৌশল খাতে নয়, এমন বহুধা বিস্তৃত মেধার মানুষ যথার্থ বিরল।
অধ্যাপক জামিলুর রেজাকে আমি তাই দেখেছি দূর থেকে, পর্বতশীর্ষ যেভাবে মানুষ দেখে। কিছুটা বিস্ময়, কিছুটা ভয়, অনেকটা শ্রদ্ধা আর ভালবাসায়। খুব কাছ থেকে কাজ করার বা দেখার সুযোগ না থাকলেও দূরের বরফাচ্ছাদিত পর্বতশীর্ষ যেমন এক অভূতপূর্ব আলো বিচ্ছুরণ করে, অধ্যাপক জামিলুর রেজা আমার কাছে ঠিক তাই। দূরের পাহাড় তিনি, তাঁকে সেলাম।

* লেখক: বুয়েট-এর শিক্ষক এবং দেশের জনপ্রিয় বিজ্ঞান-লেখক