মাত্র দুই শতাব্দীর ব্যবধানে চিকিৎসাবিজ্ঞান মানুষের গড় জীবনকাল তিন কুড়ি দশ বছরে ফিরিয়ে এনে অসামান্য দৃষ্টান্ত স্থাপন করেছে। গুটিবসন্ত, টাইফয়েড, প্লেগের বিরুদ্ধে পুরোপুরি প্রতিরোধ গড়ে তোলা সম্ভব হয়েছে। তবে কুষ্ঠর নাম এখনো শোনা যায়। চিকিৎসকরা জন্মের পরপর এ্যাপেনডিক্স এমন সূক্ষ্মভাবে ফেলে দিতে সক্ষম যে ওটা আর মাঝবয়সে ঝামেলা পাকাতে পারে না। যদি করো চেহারা পুড়ে গিয়ে এমনভাবে বিকৃত হয়ে যায় যে তাকে আর চেনার উপায় নেই, তারপরও ছবি দেখে প্লাস্টিক সার্জারির মাধ্যমে তার আগের চেহারা ফিরিয়ে দেয়া সম্ভব হচ্ছে।
লিস্টার নামের এক ইংরেজ শল্যচিকিৎসক সর্বপ্রথম এন্টিসেপটিক প্রয়োগ করেন। তিনি ক্ষত ধুতে কার্বলিক এসিডের ব্যবহার প্রচলন করেন আর তারপর থেকে এটা খুবই কার্যকর ব্যবস্থা হিসেবে বিবেচিত হয়ে আসছে। তার আগে গরম আলকাতরা অথবা উত্তপ্ত লাল লৌহখ- একাজে ব্যবহার করা হতো। কিন্তু অতি সাধারণ ক্ষতগুলোকে সম্ভবত গরম পানি দিয়ে ধোয়া হতো অথবা কোনকিছু ছাড়াই শরীরের নিজস্ব প্রতিরক্ষা ব্যবস্থার ওপর ছেড়ে দেওয়া হতো। লিস্টারকে পেছনে ফেলে আজ আমরা অনেক দূর এগিয়ে এসেছি। পরিষ্কার পরিচ্ছন্নতা হচ্ছে ঈমানের অঙ্গ আর এটাই শল্য চিকিৎসকদের প্রথম নীতি। আপারেশন থিয়েটার পরিষ্কার রাখায় সংক্রমণ নিয়ে খুব একটা চিন্তিত থাকতে হয় না। তবে তারপরও সংক্রমণজনিত ক্ষতের মুখোমুখি হলে সঙ্গে সঙ্গে লড়বার জন্য এক্সরে হতে শুরু করে সালফানিলামাইডসহ অন্যান্য এন্টিবায়টিক ব্যবস্থা তো আছেই। তাই আমাদের দেহের প্রাসাদে রোগের ঝড় তোলার আশায় ভীড় করা ত্বকের ক্ষতের জীবাণুগুলিকে ভালোভাবে নিয়ন্ত্রণে রাখা সম্ভব হচ্ছে।
দুর্ভাগ্যজনকভাবে আমাদের শরীরের বাইরের দিকের মত ভেতরের দিককার ত্বক অতটা পুরু নয়। মুখ, নাক, গলায়, ফুসফুস পাকস্থলী ও অন্ত্রের ভেতরের দেয়ালের সমস্তটাই পাতলা ত্বকে আবৃত। এতসব চিন্তা করে নাওয়া খাওয়া আর নিঃশ্বাস নেওয়া কোনভাবেই বন্ধ করা সম্ভব নয়। তাই বেশিরভাগ জীবাণুই খাবারপানি, বাতাসের সাথে বাহিত হয়ে খুব সহজেই শরীরের ভেতর পৌঁছে, এর ভেতরকার এই পাতলা ত্বককে আক্রমণ করতে সব সময় সক্রিয় থাকে। আর এই আক্রমণ কৌশলটা খুবই কার্যকর। নিউমোনিয়া, স্কারলেট ফিভার, ডিফথেরিয়া, টাইফয়েড জ্বর, অ্যামিবিক ডিসেন্ট্রির জীবাণুসহ অন্যান্য বেশকিছু রোগের জীবাণুরা পোষককে সহজেই আক্রমণ করবার জন্য সুন্দর এই কৌশলটা আয়ত্বে এনেছে।
ডাক্তাররাও একজন সত্যিকারের জেনারেলের মত এই সমস্ত অজানা সৈনিকদের বিরুদ্ধে শক্তভাবে লড়তে মানচিত্র প্রণয়নসহ একটি সত্যিকারে যুদ্ধক্ষেত্রের মত পরিকল্পনা করে থাকেন। প্রথমে সে শত্রুর যোগাযোগ ব্যবস্থা বিচ্ছিন্ন করে দেন। পানিবাহিত টাইফয়েড জ্বর, তার আক্রমণের ধরনের কারণে এরকম একটি পরিকল্পনা তৈরি করেন। কিছু কিছু লোক ইমিউন ক্যারিয়ারের অধিকারী হওয়ায় তারা এ রোগে কখনই আক্রান্ত হন না। কিন্তু অন্যান্যদের এ রোগ হলে রোগী হয় সেরে উঠবে, না হয় মারা যাবে। যে কোন কারণেই হোক জীবাণু বেশিদিন আমাদের শরীরে বেঁচে থাকে না। এরা একটা অবিচ্ছিন্ন পরিবেশের মধ্যে বসবাস করে। আর তাই সে প্রতিনিয়ত জয় করার জন্য নতুন জায়গা খুঁজতে থাকে। তাই আমাদের মাঝে কেউ সংক্রামক রোগে আক্রান্ত হলে ডাক্তাররা তাকে খুব দ্রুত সংক্রমণনিরোধ কোয়ারেনটাইনের ব্যবস্থা করেন। যাতে করে জীবাণু আর কাউকে আক্রমণ করববার সুযোগ না পায়।
প্রথমদিকে এধরনের যোগাযোগ বিছিন্ন করা ও খাবার সরবরাহের বিঘœ সৃষ্টির মতো কৌশল প্রয়োগ করে ডাক্তাররা খুব সফলভাবে জীবাণুদের আক্রমণ রোধ করে আসছিলেন। কিন্তু তখন পর্যন্ত এ বিষয়ে আরো বড় আবিষ্কারের প্রয়োজন ছিল। প্রশ্নটা শুরু হয় আমাদের নিজস্ব প্রতিরক্ষা ব্যবস্থাকে কীভাবে আরো ভালোভাবে প্রশিক্ষণ দেওয়া সম্ভব তা নিয়ে। এক সময় জীবাণুরা বাতাস, পানি বা খাবারের মধ্য দিয়ে বাহিত হয়ে আমাদের শরীর নামের প্রাসাদের ত্বকের দেয়াল টপকে ভেতরে ঢুকে পড়লে সঙ্গে সঙ্গে শরীর একটা সাধারণ ঘণ্টাধ্বনি শুনতে পায়। আমাদের নিজস্ব সৈন্যবাহিনী তাদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণা করে, এদের মধ্যে প্রধান হলো শ্বেত রক্তকণিকা আর এর সঙ্গে আছে বিভিন্ন এন্টিবডি এবং এন্টিটক্সিন। জয় পরাজয় নিশ্চিত হওয়ার আগ পর্যন্ত এই যুদ্ধটা চলতে থাকে। তারপর সামর্থ বুঝে যে কোন এক পক্ষের জয় হয়। শরীরের জয় হলে সে শত্রুমুক্ত হয় আর পরাজিত হলে মৃত্যু অনিবার্য।
এই রূপরেখা ধরে বিজ্ঞান খুব গভীর অন্তর্দৃষ্টি দিয়ে ব্যাপারটা পর্যবেক্ষণ করেছে। একই মহামারীতে গুটিবসন্তের কথাই ধরা যেতে পারেÑ আক্রান্ত হয়ে কিছু লোক মারা যাচ্ছে আর কিছু লোক বেশ কিছুদিন রোগে ভুগে সেরে উঠছে। কী অবাক ব্যাপার তাই না? কিন্তু কেন? তারপর আরো একটা অবাক করা বিষয় হলো, কেন রোগ-শোকের মোকাবেলায় কিছু কিছু জাতির পুরোপুরি বিলুপ্ত হওয়ার মত ভয় থাকে। আর অন্যরা সেরে ওঠে। হাম এমন একটি অসুখ, যে রোগটাকে আমরা কখনই খুব বেশি গুরুত্বের সাথে নেই না। কিন্তু ১৮৭১ সালে হামের মহামারিতে প্রশান্ত মহাসারীয় দ্বীপরাষ্ট্র ফিজিতে মাত্র এক বছরে সত্তর হাজার লোক প্রাণ হারায়। এক্সিমো, ইন্ডিয়ান, দক্ষিণ মহাসাগরের দ্বীপে বসবাসকারী লোকেদের সাদা মানুষদের এসব রোগের প্রকোপে বিলুপ্ত হয়ে যাওয়ার ভয় ছিল। টাইফয়েড, যক্ষা, ডিফথেরিয়া এমনকি হাম ও মামস পর্যন্ত তাদের জন্য অনেক বড় ঝুঁকি সৃষ্টি করে। সম্ভবত গুটিবসন্ত একাই কলহ, বিদ্রোহ যুদ্ধের চাইতেও অনেক বেশি উত্তর আমেরিকান ইন্ডিয়ান নিপাত করেছে।
শেতাঙ্গ বা সাদা মানুষেরা রোগ শোকের বিরুদ্ধে এমন কিছু একটা অর্জন করেছে যাকে আমরা নির্দিষ্ট রোগের প্রাকৃতিক রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা বলে জানি। বলা যেতে পারে, এটা এসেছে প্রাকৃতিকভাবে অর্জিত প্রাকৃতিক নির্বাচন নামের পুরাতন ধারণা থেকে। হাজার বছরের বেশি সময় ধরে এরা এসব রোগের মোকাবেলা করে এসেছে। অবশ্যই এ ধরনের লোকেরা অন্যদের চাইতে বেশি মাত্রায় প্রতিরোধ ক্ষমতার অধিকারী হয়েছে। আক্রান্ত হলে তাই এরাই টিকে থাকবে, আর অন্যরা মারা যাবে। যারা বেঁচে থাকবে তাদের থেকে এই প্রতিরোধ ক্ষমতা নিকট ভবিষ্যতে তাদের শিশুরা অর্জন করবে, এ কারণেই সাদা মানুষেদের অতি উঁচু ধরনের প্রাকৃতির রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা অর্জিত হয়েছে বর্বর মানুষগুলোর তুলানায়। যক্ষা, স্কারলেট জ্বর এমনকি গুটিবসন্তের মত রোগে আক্রান্ত হবার পরও তাদের সেরে ওঠার সম্ভাবনা অনেক বেশি। কিন্তু এস্কিমো অথবা ইন্ডিয়ানদের এরকম রোগের আক্রমণে মারা যাওয়ার সম্ভাবনাই বেশি থাকবে। এবং একইভাবে ব্যাপারটা বিপরীত দিক দিয়েও সত্য। উত্তর আফ্রিকার আরবরা গত শতাব্দীর পুরোটা জুড়ে আমাশয়ে ভুগেছে, এখন আমাশয় আর তাদের কাছে ভয়ানক কিছু নয়। যদি সাদা মানুষেরা অল্প পরিমাণে তাতে আক্রান্ত হতে পারে, তবে খুব সহজেই তাদের জন্য তা প্রাণঘাতী হয়ে উঠবে। নিগ্রোরা সাদা মানুষের চাইতে অনেক বেশি দিন ম্যালেরিয়া জ্বরের উৎসের কাছাকাছি বসবাস করেছে। যার ফলে এ রোগের বিরুদ্ধে তাদের প্রতিরোধ ক্ষমতাও সাদা মানুষদের চাইতে অনেক বেশি আর তার এই বর্ধিত প্রতিরোধ ক্ষমতা প্রাকৃতিক নির্বাচনের মধ্যে দিয়েই অর্জিত হয়েছে।
কিন্তু চিকিৎসকেরা এর চেয়ে ভিন্ন ধরনের কিছু বিষয় পর্যবেক্ষণ করেছেন। কারো যদি একবার স্কারলেট বা টাইফয়েড জ্বর ও ডিফথেরিয়া হয় তাহলে পরবর্তীকালে সেই রোগে সে আর আক্রান্ত হয় না। যদি কারো আগে কোন এক সময় একবার গুটিবসন্ত হয়ে থাকে তবে মারাত্মকভাবে গুটিবসন্তে আক্রান্তদের সাথে একই বাড়িতে সে খুব নিরাপদেই অবস্থান করতে পারে। তার ত্বকে কামড় বসাবার মত ধার পরে এর আর থাকবে না। আবার সেই একই প্রশ্ন, কেন? কেন, কীভাবে কেউ এই অর্জিত প্রতিরোধ ক্ষমতার অধিকারী হলেন? পরবর্তীকালে ডাক্তাররা এর জবাব পেয়েছিলেন এবং এর সাহায্যে তথাকথিত সেই জীবাণু বাহিনীকে আরেক দফা জব্দ করা গেল। বলতে গেলে কিন্তু ঠিক জীবাণুরাই সরাসরি আমাদের হত্যা করে না। আসল ঘাতক হচ্ছে জীবাণু নিঃসৃত বিশেষ এক ধরনের বিষ বা টাক্সিন। এ সমস্ত পদার্থ শরীরকে সংকেত দেয়, যার ফলে খুব জলদি শরীর তার নিজস্ব বাহিনী অথাৎ এন্টিবডি ও এন্টিটক্সিনকে যুদ্ধে পাঠায়। জীবাণুদের অবিলম্বে হত্যা ও বিষ নিস্ক্রিয় করার মধ্যদিয়ে এক সময় শরীর ঠিক ঠিক শিখে নেয় কীভাবে এর বিরুদ্ধে লড়ে যেতে হবে। টাইফয়েড জ্বরের কথাই ধরা যাক, এ ক্ষেত্রে একবার শেখা কৌশলটা শরীর কখনই ভুলে যায় না। পরবর্তীকালে টাইফয়েডের জীবাণু শরীরে ঢোকার সঙ্গে সঙ্গেই শরীর তার সেনাবাহিনীকে যুদ্ধে নামিয়ে দেয় আর আগের চেয়ে তড়িৎ গতিতে গলা ধাক্কা দিয়ে জীবাণুদের তার শরীর রাজ্যের বাইরে পাঠিয়ে দেয়। কিন্তু দেহকে আলাদা আলাদা করে প্রতিটি রোগের ক্ষেত্রে কৌশলটা আয়ত্ত করতে হয় আর কিছু রোগের ব্যাপারে শরীর কখনই এই কৌশলটা রপ্ত করতে পারে না। এর চাক্ষুস সাক্ষী হলো সাধারণ সর্দি জ্বর। কিন্তু বেশিরভাগ সত্যিকারের ভয়ানক রোগের ক্ষেত্রে শরীর সেটা চমৎকারভাবে শিখে নেয়।
বিষয়টা জানার পর চিকিৎসকরা ভাবলেন ভুয়া ঘণ্টা বাজিয়ে শরীরকে একটু বোকা বানিয়ে দেখা যাক না কী হয়? কৌশলটা খুব কাজে দিল, তারপর থেকে তারা এটা সম্ভাব্য সকল ক্ষেত্রে কাজে লাগাতে থাকলেন। তা সম্ভব হলো সেই বিষের জন্য যা দেখে শরীর ভয় পায় আর নিজস্ব পরীক্ষাগারে বিজ্ঞানী আর ডাক্তাররা দেহের বাইরে টাইফয়েড জীবাণুদের বংশ বিস্তার করে এদের স্যূপ তেরী করলেনÑ আক্ষরিকভাবে বললেÑ তাপ দিয়ে জীবাণু মেরে ফেলে তারপর তার থেকে টাক্সিন আলাদা করা হলো। হাইপোডার্মিক সিরিঞ্জ এই টক্সিনে পূর্ণ করে সেটা কারো দেহে পুশ করে, অনায়াসে টাইফয়েড জ্বরের সেই জরুরী ঘণ্টাধ্বনি বাজিয়ে দেওয়া যায়।
শরীরে তাৎক্ষণাৎ ঘণ্টা বাজাবে এবং টাইফয়েড জীবাণুদের বিনাশ করবার জন্য যুদ্ধের যাবতীয় প্রস্তুতি সম্পন্ন হবে। ডাক্তার এক সপ্তাহ অপেক্ষা করে বিষের দ্বিতীয় ডোজ আর তারও পরে তৃতীয় ডোজ দেবেন। এর পুরোটা সময় ধরে এন্টিটক্সিন যুদ্ধের ময়দানে নির্দিষ্ট জীবাণুর বিরুদ্ধে তার যুদ্ধের মহড়া প্রদর্শন সম্পন্ন করতে থাকবে। এক সময় শত্রুপক্ষের কেউ আর এই যুদ্ধের ময়দানে টিকে থাকবে না ঠিকই কিন্তু এই জীবাণুর ভয় কখনও দূর হবে না। এরই মধ্যে সে শিখে নিয়েছে কীভাবে টাইফয়েডের এন্টিটক্সিন তৈরি করতে হয় এবং এরপর থেকে সবসময় সে বন্দুকের ট্রিগারে হাত দিয়ে অতন্দ্র প্রহরীর মতো নির্দিষ্ট জীবাণুর জন্য অপক্ষা করতে থাকবে। বর্তমানে এভাবে গুটিবসন্ত, ডিফথেরিয়া, প্লেগ, কলেরা স্কারলেট জ্বর, হুপিংকফ এবং অন্যান্য অনেক রোগের বিরুদ্ধে কৃত্রিম ইমিউনিটি অর্জন করা সম্ভব হয়েছে।
সবশেষে চিকিৎসকেরা রোগ জীবাণুদের বিরুদ্ধে প্রতিরোধের জন্য শেষ ছিদ্রটাও খুঁজে বের করলেন। কিছু কিছু জীবাণু ভয়ঙ্কর গতিতে তার ধ্বংসলীলা চালায়। দ্রুত জয়ের জন্য তারা এখানে সেখানে ঝটিকা অভিযান পরিচালনা করে। এর একটি উদাহরণ হলো ডিফথেরিয়া। রোগটা প্রতিরোধের জন্য শরীরের অন্তত ছয় দিন সময় প্রয়োজন হয়। কিন্তু ডিফথেরিয়ার জিবাণু শরীরে এত দ্রুত কাজ করে যে খুব সহজেই যুদ্ধটা ছয় দিনের আগেই সমাপ্ত হয়, আশা ভঙ্গের মধ্যদিয়ে। এর বিরুদ্ধে চিকিৎসা বিজ্ঞান অদ্ভূত এক “ইঁদুরের ফাঁদ” আবিষ্কার করছে।
আগেরকার চিকিৎসকরা কোন বাধা বিঘœ ছাড়াই ডিফথেরিয়কে আক্রমণ করতে দিত। তারা একে থামাবার উপায় জানতেন না। কারণ টাইফয়েডের মতো এর বিরুদ্ধে প্রতিরোধ অর্জন করা তখনও পর্যন্ত সম্ভব হয়ে ওঠেনি। তারপর এক সময় অসুখটা খুব বেশি ছড়িয়ে পড়ল। মানুষজন খুব অসুস্থ হতে শুরু করল, তারপর শুরু হলো প্রতি আক্রমণের পালা। এ ধরনের দ্রুত আক্রমণ শরীর সামলে উঠতে পারতো না বলে তারা ঘোড়ার দেহে এর এন্টিটক্সিন তৈরি করলেন। পরে সেখান থেকে তা সংগ্রহ করার ব্যবস্থা করা হলো, যাতে সঠিকসময়ে দেহের বাইরে থেকে পর্যাপ্ত রসদ সরবরাহ করে শক্তি বৃদ্ধির মাধ্যমে অচিরেই জীবাণুর আক্রমণ থামিয়ে দেয়া যায়। টাইফয়েড অথবা গুটিবসন্তের মত করে ডিফথেরিয়া প্রতিরোধে বিজ্ঞানের অনেক দেরি হয়ে গেলেও এর বিরুদ্ধে প্রয়োগ করা ইঁদুরের ফাঁদের কৌশল বর্তমানে অন্যান্য অনেক রোগের ক্ষেত্রে ব্যবহার হচ্ছে।
চিকিৎসা বিজ্ঞান অণুজীবঘটিত এসব রোগ নিয়ন্ত্রণে খুবই কার্যকরি ভূমিকা রেখেছে। যাদের কয়েকটি এখন পর্যন্ত আমাদের জ্বালাতন করে চলেছে। উদাহরণ হিসেবে যক্ষার কথা বলা যায়। এই নির্দিষ্ট জীবাণুর বিরুদ্ধে কয়েকটি কারণে ভ্যাকসিন এবং এন্টিটক্সিন শতভাগ কার্যকর নয়। অবশ্য বিশ্রাম, পুষ্টিকর খাবার দাবার আর মুক্ত বাতাস অনেকাংশে মৃত্যুঝুঁকি কমাতে সাহায্য করে। শিশুদের পক্ষাঘাতের মত কিছু রোগের ব্যপারে বিজ্ঞান বহুদিন পর্যন্ত অনুমান করে পথ চলছে। সমস্যাটা হচ্ছে এ সমস্ত জীবাণুদের বহুদিন চিহ্নিতই করা যায়নি এবং ভ্যাকসিন তৈরির জন্য দেহের বাইরে এদের কর্ষণ করাও সম্ভব হয়নি। কেমন করে তাদের ধরতে হবে এটাও আমাদের জানা ছিল না। তবে এর জন্য খানিকটা সময়ের প্রয়োজন হয় মাত্র। কেননা আধুনিক বিজ্ঞানের কাছে শার্লক হোমস পর্যন্ত নস্যি। বিজ্ঞান সবসময়ই নিত্যনতুন সব রোগের মোকাবেলা করে এসেছে। ১৯১৬ সালে সর্বপ্রথম স্লিপিং সিকনেস-এর প্রাদুর্ভাব ঘটে। যা পঞ্চাশের দশক পর্যন্ত পরিচিত রোগগুলোর মধ্যে চিকিৎসা বিজ্ঞানকে সবচেয়ে বেশি ভুগিয়েছে। এটাকে আবার আফ্রিকান স্লিপিং সিকনেসের সাথে গুলিয়ে ফেললে চলবে না। এটা পুরোপুরি আলাদা একটি অসুখ। তখন বোস্টনের কাছাকাছি এলাকায় ঘোড়ার এনকেফালাইটিস বা স্লিপিং সিক্নেস মারাত্মকভাবে মানুষকে আক্রান্ত করতে শুরু করে। সময়টা এমন মনে হচ্ছিল যে নতুন এক প্লেগ রোগ সত্যিকার অর্থেই হয়ত আবার আসন গেড়ে বসল, আর সমস্ত মেডিক্যাল স্কুলের আশপাশ জুড়ে আক্রমণ হতে থাকলো। তাই ভালোভাবে ছড়িয়ে পড়ার আগেই তাকে লাাথি মেরে বিদায় দেয়া হলো। গত বিশ্বযুদ্ধের সময়কার স্প্যানিশ ইনফ্লুয়েঞ্জা সম্ভবত নতুন কোন অসুখ ছিল না, শুধুমাত্র পেট ব্যথার অসুখের চেয়ে কিছুটা মারাত্মক বলা হয়ে থাকে আর এতেই যুদ্ধের মত প্রাণহানী ঘটে যায়। এর পরের অনেক অসুখের জীবাণুদের নিয়েও চিকিৎসা বিজ্ঞান যথেষ্ট সমস্যার মোকাবেলা করেছে।
মা এবং শিশুদের স্বাস্থ্য নিয়ে এখন পর্যন্ত চিকিৎসা বিজ্ঞান হিমশিম খাচ্ছে। আগের দিনে অর্ধেক মায়েদেরই মৃত্যু ঝুঁকির মধ্যে থাকতে হতো। ম্যাটারনিটি ওয়ার্ডে ভাল করে হাত ধোয়া ও পরিষ্কার টাওয়েল ব্যবহারের প্রচলন করে পাস্তুর চিকিৎসা বিজ্ঞানকে অনেকখানি সামনে এগিয়ে দিলেন।
আমাদের মাঝে আনেক লোক আছেন যারা শিশুদের কলেরা আর ডায়রিয়া নামের রোগটিকে নীতিকথা আউড়ে আবার টেনে আনতে চাইছেন। পাপ হবে বলে কারো কখনো একটি মাছিও মারা উচিত নয়। ছোটবেলায় শোনা এরকম কথা এখনও অনেকেরই মনে আছে। বছর বছর ছোট্ট এই মাছি কলেরা বা ডায়রিয়ার মত রোগ ছড়িয়ে ঠিক কত শিশুকে হত্যা করেছে, তার প্রকৃত সংখ্যা হয়ত কারোরই জানা নেই। বিশে^র বেশিরভাগ দেশে এই চিত্রটা হয়ত এখন শুধুই অতীত এক ইতিহাস। অবশ্য আধুনিক চিকিৎসা বিজ্ঞানই শুধু এই ধন্যবাদ পাবার যোগ্য।
আজ থেকে পাঁচশ বছর আগে আমাদের পূর্বপুরুষেরা খুব সাধারণ জীবন যাপন করতো। আজকের হাসপাতাল নামটা তাদের কাছে ছিল অজানা। লন্ডনের বিখ্যাত বেরলেম হাসপাতাল প্রথম দিককার একটি হাসপাতালের উদাহরণ। সেখানে উন্মাদ রোগীদের আলাদা আলাদা কুঠুরির নোংরা জঞ্জালের মাঝে এমনভাবে বেঁধে রাখা হতো যাতে কেউ সেখানে গিয়ে তার প্রতি মানবতার দায়িত্ব পালন করতে না পারে। উচ্ছৃঙ্খল লোকদের জন্যই বোধহয় জায়গাটা উপযুক্ত ছিল। ক্ষেপাটে হয়ে গেলে কাঠের গুড়ি দিয়ে পিটিয়ে নতুবা সূঁই ফুটিয়ে ঠা-া করা হতো রোগীদের। সেই সব রোগীদের দেখতে হলেও হাঙ্গামার মুখোমুখি হতে হতো। প্রতিটি ছুটির দিনই দর্শনার্থীদের ভীড়ে জেডলেমের হাসপাতালের আশপাশ গিজগিজ করতো। ১৮০০ সালের আগ পর্যন্ত অবস্থাটা এমনই ছিল।
তাই পরের শতকের চিকিৎসার ধরন ছিল খুবই অস্বাভাবিক। এমনকি আজকের দিনের মত ল্যাবরেটরিতে মানুষের শরীর ব্যাবচ্ছেদ ছিল নিষিদ্ধ। দেহ হচ্ছে পবিত্র। তার বদলে একটা কুকুরের শরীর এ কাজে ব্যবহার হত। কাজটা করানো হত একজন নাপিতকে দিয়ে তবে এ কাজে তাকে একজন ডাক্তার নির্দেশ দিত কিন্তু শরীর সম্পর্কে কিছু জানা নিষেধ ছিল। ভ্যাসালিউস প্রথম পরীক্ষার জন্য মৃত মানুষ ব্যবচ্ছেদ করেন। এই অপরাধের শাস্তি হিসেবে তাকে আগুন পুড়িয়ে মারার জন্য খুঁটির সাথে পর্যন্ত বাঁধা হয়েছিল। শেষমেশ মহান রোমান সম্রাটের আদেশে তিনি প্রাণে বেঁচে যান। তার সময় ইথার এবং অন্যান্য অ্যানেস্থেটিক ছিল পুরোপুরি অজানা।
বংশগতির সাহায্যে প্রাকৃতিক নির্বাচনের মধ্যে দিয়ে মানব জাতির একটা বিশাল অংশ প্লেগের মতো ভয়াবহ রোগের বিরুদ্ধে প্রাকৃতিক ইমিউনিটি অর্জন করেছে। সাদা মানুষেরা খুব ভালভাবেই হাম, স্কারলেট জ্বর, যক্ষা, এমনকি টাইফয়েডের বিরুদ্ধে বহুদিন পর্যন্ত প্রতিরোধ অর্জন করছিল। ডিফথেরিয়া, গুটিবসন্ত, বুরনিক প্লেগ এবং কলেরার মতো কিছু কিছু রোগ অনেক দিন পর্যন্ত ভয়ঙ্কর ধ্বংসযজ্ঞ চালালেও ধীরে ধীরে তারা এগুলোতেও প্রতিরোধী হয়ে উঠছে।
যে কোন অসভ্য জাতিও দীর্ঘ সময় ধরে এগুলোর যে কোন একটি রোগে আক্রান্ত হতে হতে এক সময় পরিপূর্ণ ইমিউনিটি অর্জন করতে পারবে। কিন্তু কোন অসভ্য জাতিই ডিফথেরিয়া টাইফয়েড যক্ষা গুটি বসন্ত হামে একই সঙ্গে আক্রান্ত হয়ে বেঁচে থাকতে পারবে না। বেশিরভাগ রোগের ক্ষেত্রেই প্রাকৃতিক প্রতিরোধ বংশগতির ব্যাপার। এমনকি উচ্চ রক্তচাপও যে পরিবার থেকেই আসে তাও নিশ্চিত হওয়া গেছে। এরকম অনেক বিষয় পর্যালোচনার পর খুবই গুরুত্বপূর্ণ এবং ধ্বংসাত্মক একটি ব্যপার চোখে পড়েবে, তা হল সভ্য জগতের মানুষ তার সেই প্রাকৃতিক প্রতিরোধ ক্ষমতা ক্রমেই হারিয়ে ফেলছে। এ ব্যাপারে টাইফয়েড একটি উদাহরণ হতে পারে। এক্ষেত্রে প্রাকৃতিক নির্বাচন পদ্ধতি অচল হয়ে পড়েছে। তাই আমরা সবাই এই রোগের আওতায় বাস করছি। এসব বিষয়ে ভুরি ভুরি উদাহরণ টানা সম্ভব। বাস্তবে আমাদের কেউই সঠিকভাবে জানেন না প্রাকৃতিকভাবে অর্জিত এই ইমিউনিটি হারানোর ফলে সম্পূর্ণ মানব জাতিকে ঠিক কতটা লোকসানের মুখমুখি হতে হবে। ব্যপারটা বর্তমানে আলোচিত অন্যান্য বিষয়ের চাইতে ভিন্নতর। সিরাম আর ভ্যাকসিন দিয়ে রোগ সারানো প্রকৃতির কাজ নয়। সম্ভবত এ কারণেই প্রকৃতি নতুন কোন রাস্তা ধরে এগোবে।
কিন্তু যদি আমরা প্রকৃতি প্রদত্ত সেই রক্ষাকবচ হারিয়ে ফেলি, তবে সামনের দিনগুলি আমাদের সবার জন্য খুবই ভয়ানক হয়ে দাঁড়াবে। কোন কারণে যদি সভ্যতা বিধ্বস্ত হয় তখন প্রকৃতি তার প্রাকৃতিক ইমিউনিটি হারানো সেই মানব জাতিকে কখনই আশ্রয় দেবে না। এবং যদি হাতে যথেষ্ট সময় থাকতে এখনই কার্যকর কোন পদক্ষেপ নেওয়া না হয় তবে সামনে এরকম সম্ভাব্য কিছু একটা ঘটতে বাধ্য। এমন একদিন হয়তো আসবে যখন আমাদের আশপাশে ভ্যাকসিন, সিরাপ, এন্টিবডি আর এন্টিটক্সিন তৈরির জন্য বড় বড় ল্যাব আর উঁচু দরের প্রশিক্ষিত লোকবল থাকবে না। তখন কি সেই ধ্বংসযজ্ঞ নেমে আসবে না? তখন কি লুকিয়ে থাকা ডিফথেরিয়া, গুটিবসন্তসহ অন্যান্য রোগের জীবাণুরা বেরিয়ে এসে কৃত্রিম ইমিউনিটি ছাড়া ঘুরে বেড়ানো লোকগুলোকে আবারও আক্রমণ করতে শুরু করবে না?
এস্কিমোদের মত কোনদিন আমাদেরও কিন্তু এমন একটা অবস্থার মুখোমুখি দাঁড়াতে হতে পারে। তখন দুর্যোগের সেই লেলিহান শিখা আমাদের চারপাশ থেকে ঘিরে ফেলে চূড়ান্ত কোন মহামারি কি নিয়ে আসবে না? সম্ভবত, অনেকেই একে ‘বাজে কথা’ বলে ভাবছেন। কিন্তু এসব ক্ষুদে জীবাণুদের করুণা করা কি ঠিক হবে? আমরা যদি এদের প্রতিশোধ নেবার পথটা খোলা রেখে দিই, তবে সে হয়তো বিখ্যাত ধোঁকাবাজ হানিবলের মতো এক সময় তার এই কাজটা ঠিকই সারবে। রোমানদের বিরুদ্ধে যুদ্ধের সময় প্রথমে পিছু হটার মধ্যেদিয়ে আগে থেকে তৈরি করে রাখা ফাঁদের দিকে টেনে নিয়ে বাকি দিনটা শত্রুদের উল্লাসভরে কচুকাটা করেছিল হানিবল বাহিনী।
তাই সামগ্রিকভাবে আমাদের এই মানব জাতির যাতে হঠাৎ স্থায়ী কোন ক্ষতি না হয়, সেদিকটায় নজর দিয়েই প্রত্যেক ডাক্তারকে তার রোগীর প্রতি মহৎ দায়িত্ব পালন করা উচিত। এসব ক্ষতিকর অণুজীবেরা আমাদের গলার ওপর ডেমক্লিসের তরবারির মত সবসময় ঝুলে আছে। আমাদের এই সভ্যতা কখন না পিছলে যায়। আকষ্মিক কোন প্রাকৃতিক বিপর্যয়ে আমাদের ল্যাবরেটরিগুলো কখন না ধ্বংস হয়ে যায়, সঙ্গে বিদায় নেন বাঘা বাঘ সব বিজ্ঞানীরা! আর সেই সুযোগে অতি ক্ষুদ্র সব ক্ষতিকর অণুজীবেরা অসহায় মানুষদের না পৃথিবী থেকে ঝেটিয়ে বিদায় করে ছাড়ে।
× ম্যান দ্য ম্যাকানিকেল মিসফিট অবলম্বনে