করোনাকাল
বিচ্ছিন্ন অনুভব
মাহফুজা হিলালী

প্রবন্ধ
অধ্যাপক আনিসুজ্জামান
শামসুজ্জামান খান

গল্প
ডায়মন্ড লেডি ও পাথর মানব
হামিদ কায়সার

গদ্য
নিদ্রা হরণ করেছিল যে বই
মিনার মনসুর

নিবন্ধ
পঞ্চকবির আসর
সায়কা শর্মিন

বিশ্বসাহিত্য
আইজাক আসিমভের সায়েন্স ফিকশন
অনুবাদ: সোহরাব সুমন

বিশেষ রচনা
প্রথম মহাকাব্যনায়ক গিলগামেশ
কামাল রাহমান

শ্রদ্ধাঞ্জলি
মুজিব জন্মশতবর্ষ
মারুফ রায়হান
 
সাক্ষাৎকার
কথাশিল্পী শওকত আলী

জীবনকথা
রাকীব হাসান

ভ্রমণ
ইম্ফলের দিনরাত্রি
হামিদ কায়সার

ইশতিয়াক আলম
শার্লক হোমস মিউজিয়াম

নিউইর্কের দিনলিপি
আহমাদ মাযহার

শিল্পকলা
রঙের সংগীত, মোমোর মাতিস
ইফতেখারুল ইসলাম

বইমেলার কড়চা
কামরুল হাসান

নাজিম হিকমাতের কবিতা
ভাবানুবাদ: খন্দকার ওমর আনোয়ার

উপন্যাস
আলথুসার
মাসরুর আরেফিন

এবং
কবিতা: করেনাদিনের চরণ

১৬ বর্ষ ০৫ সংখ্যা
ডিসেম্বর ২০২৩

লেখক-সংবাদ :





করোনা-উত্তর পৃথিবী
শামীম আহমেদ
করোনা-উত্তর পৃথিবী কেমন হবে? সবকিছু কি একই থাকবে? পুরোপুরি বদলে যাবে? আমাদের সামাজিকতা, পারিপার্শ্বিকতা, আচরণ, ব্যবহার, সম্পর্কের নাট-বল্টুগুলো কেমন হবে? এই বিষয়ে অনেক তাত্বিক গবেষণা হচ্ছে, তৈরী হচ্ছে বৈজ্ঞানিক তথ্যচিত্র।
তবে আমি আলোচনা করব খুব সাধারণ ভাষায় এমন সব বিষয়, যা আমাদের প্রত্যেকের জন্যই খুব গুরুত্বপূর্ণ বলে মনে করি।
১) হাত মেলানো জরুরী না, কোলাকুলি আবার কেন?
খুব স্বাভাবিকভাবে ভাবুন কয়েক মাস পরের কথা। করোনাভাইরাস যদি নির্মূল হয়, অথবা অনেকাংশেই কমে আসে, তবুও কি আপনি আর খুব স্বাভাবিকভাবে কারও সাথে হাত মেলাতে পারবেন? এই যে সপ্তাহের শেষে বন্ধুর সাথে দেখা হলেই তাকে বুকে জড়িয়ে ধরা, অফিসের মিটিং এ পুরনো কলিগকে দেখলে তার হাত ধরে ঝাঁকুনি দেয়া, মন খারাপ করে থাকা পাড়ার ছোট ভাইটার কাঁধে হাত রেখে আশ্বস্ত করা, কিংবা পরীক্ষায় ভালো করায় কাজিনের মাথায় হাত রেখে দোয়া করে দেয়ার মতো বিষয়গুলো হয়ত আর একই থাকবে না। আমাদের এই যে আন্তরিকতা, অনুভূতির স্বতঃস্ফূর্ত বহিঃপ্রকাশ, সংস্কৃতির চালচিত্র তাতে বড় ধরণের পরিবর্তন খুব সম্ভবত এখন অবশ্যম্ভাবী।
২) অনলাইন, ফোন কল, জুম, স্কাইপ কিংবা চ্যাট হয়ে যাবে নতুন দিনের “চলো দেখা করি”
গত দশ বছর ধরেই সীমিত আকারে অনলাইন কনফারেন্স কল ধীরে ধীরে চালু হচ্ছিল বাংলাদেশে। তাছাড়া বিভিন্ন দেশে যাতায়াতের খরচ, ভিসা প্রাপ্তির সমস্যার কথা চিন্তা করে বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান ক্রমশঃ অনলাইনে কাজ সারবার নানা উপায় খুঁজছিল। বিভিন্ন অফিসের কলিগদের মধ্যে দ্রুত আলোচনা সেরে নেয়ার জন্য হোয়াটসএপ, বন্ধুদের ইদের প্ল্যান ঠিক করার জন্য ভাইবারে আড্ডা, সারা দেশে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা অফিসের কলিগদের সাথে মিটিং করার জন্য স্কাইপ কিংবা জুমের ব্যবহার শুরু হচ্ছিল খুব ধীরে। তারপরও অনেক আলোচনা, মিটিং, ও সিদ্ধান্ত গ্রহণ হচ্ছিল সামনাসামনি দেখা সাক্ষাতের মাধ্যমে।
করোনা ভাইরাসের আক্রমণে এই মাধ্যমগুলোর কার্যকারিতা যে অনেক বেশী সেটি অনুধাবণ করে, সামনের দিনগুলিতে হয়ত সময় বাঁচানোর জন্য মানুষ সামনাসামনি দেখা-সাক্ষাত এড়িয়ে যাওয়ার এই বিকল্পকে বেছে নিবে। তাছাড়া মিটিং-সিটিং এর জন্য ৩-৪ ঘন্টা সময় ব্যয় করে এক জায়গা থেকে আরেক জায়গায় যাওয়া, নাস্তা-পানি-দুপুরে খাবারের ব্যবস্থা করা, ব্যানার-পোস্টার ইত্যাদি বানানো যে অনেকটাই অপ্রয়োজনীয় তোড়জোড়, তা অনুধাবন করে এমন সব আয়োজন কমে আসতে পারে সামনের দিনগুলিতে।
তাছাড়া এইসব যোগাযোগে সময় ও অর্থ ব্যয় ছাড়াও শারীরিক নৈকট্যের মাধ্যমে রোগ জীবানু ছড়িয়ে পড়া কিংবা হায়ারারকি মানতে গিয়ে খোলা মনে মতামত প্রকাশ করতে না পারার বিষয়গুলো যে প্রতিবন্ধকতা তাও মানুষ বিবেচনা করতে পারে আগের চাইতে অনেক বেশী।
৩) সপ্তাহে ৬ দিন, সকাল ৯টা থেকে রাত ৯টা অফিসের ঘানি টানা দেশ ও জাতির জন্য কতটা জরুরী?
১৯৯৬ সালের যখন বাংলাদেশে সাপ্তাহিক ছুটি ১ দিন থেকে বাড়িয়ে ২ দিন করার আলোচনা শুরু হয়েছিল, তখন চারিদিকে তীব্র প্রতিক্রিয়া হয়েছিল। বাংলাদেশ গরীব দেশ, এখানে মানুষের পারলে প্রতিদিনই কাজ করার দরকার, এমন আলাপ শুনেছি বার বার। এছাড়াও কর্মজীবনে দেখেছি, বা শুনেছি অফিসে নির্ধারিত সময়ের পর যারা যতক্ষণ বেশী থাকেন, তাদের মূল্যায়ন তত বেশী। পরিবারকে সময় দেবার চাইতে পরিবারের সময় অফিসকে দেয়া যেন আমাদের সমাজে “পারফরমেন্স ইন্ডিকেটর”।
রাত ১২টায় মেইল আসলে আপনি যদি রাত ১টায় উত্তর দিয়ে দেন, তবে আপনি বেশী দক্ষ অফিসার। অথচ এই অতিরিক্ত কাজ যে মূলত আপনার পারফর্মেন্সে ক্ষতি করে, আপনার মানসিক স্বাস্থ্যকে ভঙ্গুর করে, অফিসে বেশী সময় ব্যয় করার জন্য আপনি পরিবার বা বন্ধুদের সময় দিতে না পেরে, তাদের কাজ থেকে দূরে সরে যান, মানসিকভাবে বিপর্যস্ত থাকেন এবং আদতে অফিসের কাজও ভালোভাবে করতে পারেন না, এই বিষয়গুলো আমাদের দেশে অন্তত খুব কম প্রতিষ্ঠানই বোঝে।
আমার মনে আছে ১৯৯৬-৯৭ সালে যখন তৎকালীন সরকার সাপ্তাহিক ছুটি দুইদিন করল, আমি আমার আব্বাকে জিজ্ঞেস করলাম তিনি এই বিষয়ে কী ভাবেন? আমার আব্বা অত্যন্ত সৎ ও কর্মঠ কর্মকর্তা ছিলেন। এরশাদের শাসনামলে বিরোধী দলগুলো হরতাল ডাকলে ভোর চারটায় বিছানা বালিশ নিয়ে তিনি অফিসে চলে যেতেন। সেই তিনি আমাকে বললেন এটি একটা খুব ভালো সিদ্ধান্ত। তিনি আরও বললেন বেশীরভাগ মানুষ যদি সপ্তাহে ৯-৫টা নিয়মিত কাজ করে, সেটাই দেশের জন্য অনেক। হাতে গোণা কিছু মানুষের শুধুমাত্র এর বেশী কাজ করতে হয়। তাছাড়া ২ দিন অফিস বন্ধ থাকলে সরকারের তেল কেনার পেছনে অর্থ ব্যয় কম হবে, বিদ্যুৎ খরচ কমবে, জ্বালানী সাশ্রয় হবে ইত্যাদি।
করোনার সময়ে পৃথিবীর অসংখ্য অফিস আদালত যেহেতু অনলাইনেই বেশ চালিয়ে নেয়া যাচ্ছে, তাই মানুষকে অফিস আদালতে অতিরিক্ত কাজ করিয়ে নেবার প্রবণতা কমে আসবে বলে আমার ধারণা। মানুষও এর প্রতিবাদ করতে শিখবে। অতিরিক্ত কাজ করা যে আসলে ভালো নয়, বরং সামন্তবাদী ধ্যান-ধারণার প্রতিফলন, সেই আত্মপলব্ধি হবে অনেক প্রতিষ্ঠানের। “হোম অফিস” যে আসলে অনেকের কাজের গতি বাড়িয়ে দেয় সেটি বুঝে এর প্রচলনও বাড়বে অনেক। ঘরে বসে কাজ করাকে উৎসাহিত করে জ্যাম, যাতায়াত খাতে সময় ও অর্থ ব্যয় কমানো সম্ভব হবে। ন্যূনতম ৩০ শতাংশ স্টাফকে রোস্টারে কাজ করিয়ে ছোট অফিস ভাড়া নিয়ে সাশ্রয়ও করার প্রচলন শুরু হবে ধীরে ধীরে।
৪) দেশপ্রেমের জন্য সীমান্তে যুদ্ধ করাই একমাত্র উপায় নয়, অস্ত্রের চাইতে স্টেথোস্কোপ ভালো
প্রথম বিশ্বযুদ্ধের পর থেকে সারাবিশ্বে অস্ত্রের যে ঝনঝনানি, সীমান্তে সীমান্তে মানুষ হত্যার ধ্বংসযজ্ঞ – তার বিরুদ্ধে সারা পৃথিবীর মানুষ ক্রমশঃ প্রতিবাদী হয়ে উঠেছে। করোনা-উত্তর পৃথিবীতে এই প্রতিবাদ আরও উত্তাল হবে। মানুষ খাবার, ওষুধ না কিনে সরকারগুলোর অস্ত্র কেনার সিদ্ধান্তের বিরুদ্ধে আরও প্রতিবাদী হবে। জনস্বাস্থ্য, চিকিৎসাবিদ্যায় অর্থ বরাদ্দ না দিয়ে যুদ্ধাস্ত্র, সামরিক যানবাহন কেনার ক্ষেত্রে সরকারগুলো তীব্র প্রতিরোধের সম্মুখীন হবে।
দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ, স্নায়ুযুদ্ধ থেকে শুরু করে উপসাগরীয় যুদ্ধের সময়ও সামরিক বাহিনীকেই যেখানে মূলত দেশপ্রেমের মূল ধারক ভাবা হতো, সেটিতে আমূল পরিবর্তন হবে। চিকিৎসক, জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞ, গবেষক, মাইক্রোবায়োলোজিস্ট, নার্স ইত্যাদি পেশার মানুষরাই হয়ে উঠবেন দেশপ্রেমের মূল প্রতীক। আমাদের সমাজে যেখানে নার্সদের তেমন সম্মান করা হতো না, সামনের দিনে নার্সসহ হাসপাতালকর্মীদের কাজের সঠিক মূল্যায়ন হবে।
সেনাবাহিনী, পুলিশসহ অন্যান্য সশস্ত্রবাহিনীর গুরুত্ব বাড়বে দেশের আভ্যন্তরীণ সেবাকার্যে, সীমান্তে অন্য দেশের সাথে লড়াইয়ের জন্য নয়। করোনা আক্রান্ত পৃথিবীতে এটি পরিষ্কার যে যেসব দেশ সামরিক শক্তিতে সবচেয়ে এগিয়ে যেমন এমেরিকা, ইউকে, ফ্রান্স, চীন ইত্যাদি তারা কেউই তাদের এই বিশাল সেনাযজ্ঞকে কাজে লাগিয়ে কিছু করতে না পেরে আজ অসহায়। অন্যদিকে এই দেশগুলোর চাইতে তুলনামূলক কম সেনা শক্তির দেশ ক্যানাডা, অষ্ট্রেলিয়া, নিউজিল্যান্ড করোনা প্রতিরোধে এখন পর্যন্ত বেশী ভালো করেছে।
৫) পুরুষ নয়, নারীনেতৃত্বই আমাদের আগামী পৃথিবীর ভবিষ্যত
হাজার বছর ধরে চলে আসা পুরুষ নেতৃত্বের জায়গা ছেড়ে দেবার সময় এসেছে এমনটা পরিষ্কার বোঝা যাচ্ছে। গত বেশ কয়েক দশক ধরেই আমরা দেখে এসেছি নারী, নেতা হিসেবে ভালো, ধীরস্থির, অবিচল এবং কঠিন ও প্রয়োজনীয় সিদ্ধান্ত নিতে সক্ষম। বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধে ইন্দিরা গান্ধীর ভূমিকা, সারাবিশ্বের পররাষ্ট্রনীতিতে হিলারি ক্লিনটনের দাপট, অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধিতে জার্মানীর চ্যান্সেলর এঞ্জেলা মার্কেলের দৃঢ়তা, ভারতের স্থানীয় রাজনীতিতে মমতা ব্যানার্জির সাহসিকতা, সন্ত্রাস ও মৌলবাদ দমনে বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা এবং নিউ জিল্যান্ডের প্রধানমন্ত্রী জ্যাসিন্ডা আরডার্নের অবিচল অবস্থান মানুষকে সাহস জুগিয়েছে। এই করোনা আক্রান্ত পৃথিবীতে তারা ছাড়াও সবচেয়ে সফল নেতৃত্বের জন্য ডেনমার্কের মেটে ফ্রেডেরিকসেন, আইসল্যান্ডের ক্যাটরিন, নরওয়ের আর্না সলবার্গ, তাইওয়ানের সাই ইং ওয়েন এবং সর্বকনিষ্ঠ প্রধানমন্ত্রী ফিনল্যান্ডের সানা মার্টিন প্রশংসিত হয়েছেন – যারা সকলেই নারী।
অন্যদিকে পৃথিবীর সবচেয়ে ক্ষমতাধর কিন্তু করোনা মোকাবেলায় সমালোচিত ও ব্যর্থ নেতা হিসেবে বিবেচিত এমেরিকার ডোনাল্ড ট্রাম্প, ইউকের বরিস জনসন, চায়নার শি জিনপিং – সবাই পুরুষ। তবে ব্যতিক্রম হিসেবে নাম নেয়া যায় ক্যানাডার প্রধানমন্ত্রী জাস্টিন ট্রুডোর।
শুধু রাজনীতিতেই নয় সমাজের অন্যান্য ক্ষেত্রে, যেমন চিকিৎসা ও নার্সিং এ নারী কর্মীর ভূমিকা অনস্বীকার্য। উন্নত দেশগুলোর গ্রোসারি স্টোর ও অন্যান্য অত্যাবশ্যকীয় জরুরী সেবাদানে নারীর ভূমিকাই অগ্রগণ্য। এছাড়া করোনা সংক্রমণের তথ্য বিশ্লেষণ করলেও দেখা যায় আক্রান্তের মধ্যে ৩০ শতাংশ মাত্র নারী। তাই সার্বিক বিবেচনায় করোনা-উত্তর পৃথিবীতে নারী নেতৃত্বে সুখ ও সমৃদ্ধি আসবে বলে প্রতীয়মান হয়।
৬) এমেরিকার একক দাপটে আঘাত হানবে বৈশ্বিক সামষ্টিক শক্তি
পৃথিবীতে বড় বড় নানা ঘটনার পর পরাশক্তির যে হিসেব নিকেশ তাতে বড় ধরণের পরিবর্তন হয়। ১৯১৮ সালে প্রথম বিশ্বযুদ্ধ এবং ১৯২০ সালে স্প্যানিশ ফ্লু মহামারীর পর বিশ্বক্ষমতার মানচিত্রে ব্যাপক পরিবর্তন আসে। ১৯১৪ সালের আগের অপরাজেয় ক্ষমতাধর ব্রিটিশ সাম্রাজ্য, ফ্রান্স সাম্রাজ্য তাদের আধিপত্য কিছুটা বজায় রাখতে পারলেও জার্মান সাম্রাজ্য, অষ্ট্রিয়া-হাংগেরি সাম্রাজ্য এবং রাশা সাম্রাজ্য ব্যাপকভাবে তাদের আধিপত্য হারায়।
আবার দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর জার্মানী, জাপান, যুক্তরাজ্য, ইটালি, ফ্রান্স তাদের দীর্ঘদিনের ক্ষমতা হারায় প্রায় একচেটিয়াভাবে যুক্তরাষ্ট্র এবং সোভিয়েট ইউনিয়নের কাছে। স্নায়ুযুদ্ধ পরবর্তীকালে সোভিয়েট ইউনিয়ন তার দাপট হারায় এককভাবে এমেরিকার কাছে। গত প্রায় তিন দশক এমেরিকা তার এই দাপট ধরে রাখলেও ক্রমশ চায়নার প্রতিদ্বন্দ্বিতার মুখোমুখি হচ্ছিল। করোনা উত্তর পৃথিবীতে চায়না ও রাশিয়া এমেরিকার একক দাপটের অবসান ঘটাবে এবং বিশ্ব অন্তত নিকট ভবিষ্যতের জন্য সুপার পাওয়ার কনসেপ্ট থেকে বের হয়ে আসবে বলে মনে হচ্ছে।
এই করোনার সময় সামরিক শক্তির বিবেচনা থেকে সরে এসে পৃথিবীর সব দেশ যেভাবে একে অপরের পাশে দাঁড়িয়েছে তা প্রশংসনীয়। পৃথিবী দেখেছে কীভাবে এমেরিকা অন্য দেশের চিকিৎসা পণ্য ছিনতাই করে, পৃথিবীর সেরা বিজ্ঞানী, চিকিৎসক থাকা সত্বেও করোনা নিয়ন্ত্রণে ব্যর্থ হয়; কীভাবে পৃথিবীর সবচেয়ে শক্তিশালী দেশের প্রেসিডেন্ট বিশ্বকে আশ্বস্ত করা তো দূরে থাক, প্রতিবেশী ক্যানাডার সাথে সুসম্পর্ক রাখতে ব্যর্থ হয়; কীভাবে নিজের দেশের মানুষের আস্থা বজায় রাখাও তার জন্য দুরূহ কাজ হয়ে উঠে! এটি মনে রাখা জরুরী যে, মহামারী কোন ভৌগলিক সীমারেখা মানে না, এই সময় সবাই সবার পাশে দাঁড়াতে হয়।
সার্বিক বিবেচনায় আগামীর পৃথিবীতে সব দেশই তাদের প্রতিবেশী রাষ্ট্র ও অন্যান্য দেশের সাথে সম্পর্ক পুনরায় ঝালিয়ে নেবে। আমরা নানা রকমের নতুন নতুন অর্থনৈতিক, সামাজিক বলয় দেখতে পাবো, যেখানে এমেরিকা আর আগের মতো তাদের পরাশক্তির ভূমিকা বজায় রাখতে পারবে না।
৭) রাজনৈতিক নেতা থেকে বিশ্ব নেতৃত্বে আসবেন বিশেষজ্ঞরা
সারা পৃথিবীব্যাপী রাজনীতিবিদদের শুধুমাত্র রাজনীতিতে নয়, বরঞ্চ এর বাইরের বিষয়ে নেতৃত্ব দেবার ফলে নানা সংকটের তৈরী হয়েছে। করোনা সংকট জটিলতা আকার ধারণ করার পেছনেও রাজনৈতিক নেতৃত্বের কিছুটা অকার্যকর ভূমিকা স্পষ্ট। বাংলাদেশে আমরা দেখেছি যে স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের নেতৃত্বে যারা আছেন তাদের চিকিৎসা ও জনস্বাস্থ্য বিষয়ক সিদ্ধান্ত নেবার যোগ্যতার ঘাটতি রয়েছে।
এখানে উল্লেখ্য স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের নেতৃত্ব একজন চিকিৎসক কিংবা জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞের হাতেই থাকতে হবে এমন কোন কথা নেই। কিন্তু মন্ত্রণালয়ের নেতৃত্ব এমন কারও কাছে থাকতে হবে যিনি চিকিৎসক, নার্স, জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞদের একসাথে করে, তাদের মত ও প্রস্তাব বিবেচনা করে সঠিক সিদ্ধান্ত নিতে পারেন।
বলা হয় জার্মানী করোনা চিকিতসায় যতটুকু সাফল্য পেয়েছে, তার মূলে আছে তাদের চ্যান্সেলর, যিনি অতীতে একজন বিজ্ঞানী হিসেবে কাজ করেছেন। সঠিক মানুষটিকে সঠিক জায়গায় না বসানোর অভিজ্ঞতা পৃথিবীর প্রায় সব দেশেই আছে। সামনের দিনগুলিতে বিশেষজ্ঞ, গবেষক, শিক্ষক, বিজ্ঞানীরা তাদের যোগ্য স্থান ফিরে পাবেন এবং তারাই এগিয়ে নেবেন পৃথিবীকে।
৮) ধর্ম ও ধর্মবিশ্বাস ও তার চর্চায় আমূল পরিবর্তন আসতে পারে
যদিও সব ধর্মেই “শান্তির” কথা বলা হয়েছে, তবুও পৃথিবীর গত কয়েক হাজার বছরের ইতিহাস ঘাটলে শান্তির চাইতে যুদ্ধে ধর্মের ব্যবহার বেশী দেখা গেছে। গত কয়েকশ বছরে সবগুলো যুদ্ধের শত্রু-মিত্রও মূলত নির্ণয় হয়েছে ধর্মকে কেন্দ্র করে। গত কয়েক হাজার বছরে একেক শতাব্দী দখলে রেখেছে একেক ধর্মের অনুসারীগণ।
ফলশ্রুতিতে ওইসব সময়ে অন্যান্য ধর্মের মানুষ ভয়াবহ অত্যাচার নির্যাতন সহ্য করেছে। করোনা হচ্ছে একমাত্র সময় যখন সব ধর্মের খুঁটিই বেশ নড়বড়ে হয়ে গেছে। পৃথিবীর ইতিহাসে এর আগে কখনও সকল ধর্মের প্রার্থনার দরজা যেমন মসজিদ, মন্দির, গীর্জা, প্যাগোডা একসাথে বন্ধ হয়নি। আবার একই সময়ে ধর্মের গোঁড়ামির কারণে একই সাথে এত বেশী মানুষও কখনও মৃত্যু ঝুঁকিতেও পড়েনি।
করোনা-উত্তর পৃথিবীতে ধর্মগুলোর আধুনিকীকরণ হবে। ধর্মীয় উপসানয়গুলোতে শারীরিক উপস্থিতির প্রয়োজনীয়তা নিয়ে প্রশ্ন উঠবে, বিকল্প পন্থায় ধর্মের আচার পালনের বিষয়গুলো আলোচিত হবে, এবং অনেক জায়গায় তা বাস্তবায়িতও হবে। ধর্মীয় প্রতিষ্ঠানভিত্তিক যে বিনিয়োগ, তা কমে এসে শিক্ষা ও চিকিতসাখাতে বিনিয়োগে বেশী সংখ্যক মানুষ আগ্রহী হতে পারে বলে আমি মনে করি।
মানুষের ধর্ম বিশ্বাস ও চেতনায়ও পরিবর্তন আসার সম্ভাবনা প্রবল। মোল্লা, পুরোহিতদের কথা অন্ধভাবে বিশ্বাস করা কমে আসতে থাকবে ক্রমাগত। মানুষ নিজের ধর্মগ্রন্থসহ অন্যের ধর্মগ্রন্থ ও গবেষণাপত্র পড়ে নিজের ধর্মের বিশ্বাসগুলোকে ঝালিয়ে নেবে। ধর্মীয় অজ্ঞতা ও গোঁড়ামির মূলে আঘাত আসবে পৃথিবীর নানাপ্রান্তে।
অন্যদিকে কিছু জায়গায় ধর্মীয় গোঁড়ামি আরও শক্তিশালী হবে। সুতরাং একদিকে যখন আগামীর পৃথিবী নানাদিক থেকে প্রগতিশীল ও সহনশীল হবে, সেই পৃথিবী একই সাথে আরও বেশী ধর্মীয় সন্ত্রাস, লড়াই ও ঘৃণাও পর্যবেক্ষন করবে – এমনটা আশংকা করি আমি।
৯) রাত তিনটায় আপনাকে যিনি হাসপাতালে নেবেন, তিনিই আপনার আপনজন
গত কয়েক শত বছর ধরে মানুষ নানাকারণে পারিবারিক কাঠামো থেকে সরে এসে ব্যক্তিকেন্দ্রিক জীবনব্যবস্থায় অভ্যস্ত হয়ে যাচ্ছিল। বাবা মার সাথে সন্তানের, নানী-দাদীর সাথে নাতি নাতনীর, চাচা-মামাদের সাথে ভাগিনা ভাতিজির দূরত্ব বেড়ে গেছে চোখে পড়ার মতো। মানুষ ব্যক্তিগত সুখ দুঃখের কথা বিবেচনা করে বাপ-মাকে বৃদ্ধাশ্রমে রেখে আসছিল। জাগতিক সুখ বিলাসের কারণে মানুষ তাদের আত্মীয়-স্বজনদের থেকে দূরে সরে এসেছিল অনেকটাই। কয়েশ বছর আগে পশ্চিমা বিশ্বে শুরু হওয়া এই সংস্কৃতি আস্তে আস্তে খুঁটি গাড়ছিল আমাদের উপমহাদেশেও।
করোনার সময়ে আমরা দেখেছি কিছু মর্মান্তিক চিত্র। বৃদ্ধ বাবা মাকে বনে জঙ্গলে ফেলে এসেছে পাষাণ সন্তানেরা। অসুস্থ রোগীকে হাসপাতালে নিতে চায়নি কেউ। করোনায় মারা যাওয়া ব্যক্তির জানাজায় উপস্থিত হবার জন্য অনুরোধ করেও পাওয়া যায়নি কোন আত্মীয়স্বজনকে। অন্যদিকে অসুস্থ সন্তানকে কেউ এম্বুলেন্সে তুলতে রাজি হয়নি বলে বাবা তাকে কাঁধে নিয়ে গেছেন। অজানা অচেনা মৃত্ ব্যক্তির জানাজায় উপস্থিত থেকেছে দয়ার্দ্র পুলিশ। কোথাকার কোন মানুষকে পরম মমতায় চিকিৎসা সেবা দিয়েছেন ডাক্তার ও নার্স।
নতুন পৃথিবীতে মানুষের সম্পর্কে ভিত্তি হবে ভালোবাসা। পারিবারিক দূরত্ব আবার আস্তে আস্তে কমে আসবে। চাকচিক্যের এই পৃথিবীতে কে কাকে গাড়িতে ঘোরাতে নিয়ে যায়, কে কাকে খাওয়াতে নিয়ে যায় ফাইভ স্টার হোটেলে, এবং তার পেছনে কাজ করা ভোগবাদী আগ্রহগুলো পরিষ্কার ধরা পড়বে সবার চোখে। নতুন পৃথিবীতে বাবা-মা, সন্তান আত্মীয়েরা আবার কাছাকাছি হবে।
মানুষ অনুধাবন করবে রাত তিনটায় যে তাকে হাসপাতালে নিয়ে যেতে দ্বিধা করে না, সেই আসল স্বজন, প্রকৃত পরিবার।
এই লেখাটির জন্য আমি গত ৭ দিন ধরে অনেক ভেবেছি। নানা পত্রিকা, গবেষণাপত্র পড়েছি। খুবই আগ্রহ নিয়ে পড়েছি পলিটিকো, কোয়ার্টজ, ল্যান্সেট, ফোর্বস, বিবিসি, হার্ভার্ড বিজনেস রিভিউ, জার্নাল অফ রিলিজিওন এন্ড পপুলার কালচার, দ্যা ইকোনোমিস্ট ইত্যাদি। প্রয়োগ করেছি নিজের ভাবনা ও বিশ্লেষণ। খতিয়ে দেখেছি অতীত ইতিহাস। তাই আমার এই কল্পচিত্র বাস্তব নাও হতে পারে। হতে পারে পৃথিবী আগের মতোই আত্মঘাতী চরিত্রে ফিরে যাবে, কে জানে! একজন সাধারণ মানুষ হিসেবে আমি তো কেবল অভিজ্ঞতালব্ধ জ্ঞান, ও নিজের বিচার বুদ্ধি খাটানো বিশ্লেষণই আপনাদের সামনে তুলে ধরতে পারি।
মনে রাখা দরকার, করোনা একদিন শেষ হবে। কিন্তু যারা বেঁচে থাকবেন, তাদের মনে থাকবে জ্বলজ্বলে সব স্মৃতি। ওই সময়টায় আমরা অন্যদের প্রতি কতটা মানবিক ছিলাম, সেটি শুধু অন্যরাই মনে রাখবেন তা নয়, মনে রাখবে আমাদের সন্তান, আমাদের পরিবার, প্রতিবেশী এবং আমাদের একান্ত সত্তা।
ভালো থাকুন। সুস্থ থাকুন। সহানুভূতিশীল হোন। পজিটিভ থাকুন। নেগেটিভিটি থেকে থাকুন অনেক দূরে।
অনেক ভালোবাসা।

শামীম আহমেদ:
সোশাল এন্ড বিহেভিয়েরাল হেলথ সায়েন্টিস্ট
ইউনিভার্সিটি অফ টরোন্টো
২২ এপ্রিল ২০২০