করোনাকাল
বিচ্ছিন্ন অনুভব
মাহফুজা হিলালী

প্রবন্ধ
অধ্যাপক আনিসুজ্জামান
শামসুজ্জামান খান

গল্প
ডায়মন্ড লেডি ও পাথর মানব
হামিদ কায়সার

গদ্য
নিদ্রা হরণ করেছিল যে বই
মিনার মনসুর

নিবন্ধ
পঞ্চকবির আসর
সায়কা শর্মিন

বিশ্বসাহিত্য
আইজাক আসিমভের সায়েন্স ফিকশন
অনুবাদ: সোহরাব সুমন

বিশেষ রচনা
প্রথম মহাকাব্যনায়ক গিলগামেশ
কামাল রাহমান

শ্রদ্ধাঞ্জলি
মুজিব জন্মশতবর্ষ
মারুফ রায়হান
 
সাক্ষাৎকার
কথাশিল্পী শওকত আলী

জীবনকথা
রাকীব হাসান

ভ্রমণ
ইম্ফলের দিনরাত্রি
হামিদ কায়সার

ইশতিয়াক আলম
শার্লক হোমস মিউজিয়াম

নিউইর্কের দিনলিপি
আহমাদ মাযহার

শিল্পকলা
রঙের সংগীত, মোমোর মাতিস
ইফতেখারুল ইসলাম

বইমেলার কড়চা
কামরুল হাসান

নাজিম হিকমাতের কবিতা
ভাবানুবাদ: খন্দকার ওমর আনোয়ার

উপন্যাস
আলথুসার
মাসরুর আরেফিন

এবং
কবিতা: করেনাদিনের চরণ

১৬ বর্ষ ০৫ সংখ্যা
ডিসেম্বর ২০২৩

লেখক-সংবাদ :





করোনাকরুণ দিনযাপন
আহমাদ মাযহার
আজ বাইরে ঝকঝকে রোদেলা দিন। এই সপ্তাহের পুরোটাই  ছিল মোটামুটি এই রকমের রৌদ্রকরোজ্জ্বল। দিনের এই প্রোজ্জ্বলতা মনটাকেও চঞ্চল করে তোলে। তাতে কী, করোনাবন্দিত্বের কারণে নিস্ক্রীয়-নিশ্চেষ্টই থকেতে হচ্ছে। অথচ স্বাভাবিক দিন থাকলে এখন পুরো উত্তর আমেরিকা জুড়ে দেখা যেত মানুষের দুর্বার রৌদ্র উদযাপন। এখনো ঠান্ডা থাকলেও গা উদলা করার তীব্র আগ্রহ দেখা যেত উত্তর আমেরিকাবাসীদের মধ্যে। কিন্তু করোনাবন্দিত্বের কারণে তা তো হবার উপায় নেই! সকালে ঘুম ভাঙতেই দেখলাম রৌদ্রের উজ্জ্বলতা! বাইরে তার উদ্ভাস আমার মনে জাগিয়ে দিল কী যেন একটা নির্ঝরপ্রাণনার উচ্ছলতা। করোনাবন্দির কাল পার করতে বিচিত্র টুকরো টাকরা পড়ায় মনোনিবেশ করতে পারলাম না। বরং দু-চার কথা লিখতে মন চাইল। রৌদ্রালোকের তীক্ষ্ণ তাড়নাতেই বুঝি বা ল্যাপটপের কী বোর্ডে আমার আঙুল পড়তে লাগল। তা ছাড়া অনেক সময় লক্ষ করেছি, কিছু একটা লিখতে গেলে ন্যূনতম যেটুকু মনঃসংযোগ লাগে তা সর্বব্যাপী বিষণ্ণতা থেকে মুক্তির পক্ষে উপকারী হয়ে উঠতে পারে! মনে হলো হয়তো বা লেখার সময়টুকুতে অন্তত করোনাসংবাদে ব্যথিয়ে ওঠা থেকে মুক্ত থাকতে পারব।  করোনার প্রকোপ শুরু হওয়ার পর থেকে খাদ্যব্যবস্থা সরল করে ফেলেছি। ভক্ষ্যবস্তুকে নিয়ে এসেছি ন্যূনতম মাত্রায়। কয়েকটা দিন পার হতেই বুঝতে পারি স্থবির জীবনে খাদ্যবাহুল্য দেহের যে আয়তন গড়ে তুলবে তাতে সুস্থাস্থ্যের পরিচয় মিলবে না। খাদ্যগ্রহণ একবেলায় নামিয়ে এনেছি।
নিয়মিত বাজার করলেও সাধারণত রান্নার কাজে নাক গলাই না আমি। এমনকি আমেরিকায় বকুলের পেশাগত ব্যস্ততার কারণে সময়াভাবের কারণেও না। তা ছাড়া শ্যালকপত্নী সুইটির রন্ধনানন্দিত শৈলীশৌকর্যের কল্যাণে উদরসাৎও ভালোই চলছিল এতকাল। করোনাক্রান্তির দিনে বুঝলাম এখন তো আর তা চলবে না! খাদকতায় সংযম আনতেই হবে। ঠিক হলো মেদবাহুল্য কমাতে শর্করাবর্জিত আহার-সংস্কৃতি অনুসরণ করব। করোনাসূত্রে বকুলও গৃহবাসী বলে রান্নায় ওর পক্ষে সময় দেয়া সম্ভব হয়ে উঠল। কিন্তু শর্করা বর্জন করলেও খাদবস্তুতে কিছুটা বৈচিত্র্য আনতে গিয়ে আমিও বকুলের সহযোগী হতে লাগলাম। দু-একবার নিজেই স্বল্পমাত্রায় সকালের নাশতা পরিবেশনে সামর্থ্য দেখাতে পেরে শুরু করলাম খানিকটা বিনোদিতও হতে। আমাদের পুত্রটি খানিকটা আকস্মিকভাবে স্বাস্থ্য সচেতন হয়ে একবেলার আহারী হয়ে উঠেছিল করোনাকাল আসবার কিছুটা আগেই। সুতরাং পুত্রের জন্যেও ঘনঘন রান্নাঘরে যেতে হচ্ছে না বকুলের। বরং আমরা তিনজনই একবেলার আহারী বলে অলিখিত করোনাকালীন খাদ্যব্যবস্থা গড়ে তুললাম। 
খাদ্যগ্রহণ একবেলায় নেমে আসায় রান্না ও খাওয়ার সময়টাকে আমরা খানিকটা বুঝি উদযাপনই করতে শুরু করেছি। করোনাবন্দিত্বের কালে আমাদের দাম্পত্য জীবনে এ এক নতুন বৈচিত্র্য বটে! খাদ্যপ্রস্তুতের জন্য বকুল যখন কিচেনে যায় আমিও তার সঙ্গী হই! সে সময়টাতেই কিচেনের জানালা দিয়ে দেখতে পাওয়া যাওয়া ব্যাকইয়ার্ডে চোখ পড়ে। তখনই ভালোভাবে অনুভব করি দিনের প্রকৃতি। লক্ষ করেছি শীতকালেও মাঝে মধ্যেই রৌদ্রোজ্জ্বলতা থাকলেও পোশাক-আশাকের বাহুল্যে ও শীতের কামড়ে তা একেবারেই উপভোগ করা যায় না। আমার জীবনের টানা ৫৪টি বছর কেটেছে বাংলাদেশে। বিদেশভ্রমণ বলতে ঘোরাফেরাও ছিল দক্ষিণ এশিয়ায়। ফলে আবহাওয়াগত বৈচিত্র্যের প্রত্যক্ষ পরিচয় আমার কম। পশ্চিমের দেশগুলোর সামার আর উইন্টার সম্পর্কে পরিচয় সাহিত্য পাঠের মাধ্যমে। কিন্তু পাশ্চাত্যের লেখকদের বর্ণনায় তো সেই অঞ্চলের অধিবাসীদেরই মনোভঙ্গি ফুটে ওঠে, ফলে আমরা যারা উষ্ণ মণ্ডলীয় অঞ্চলের বাসিন্দা তাদের অনুভবে এই বৈশিষ্ট্য কীরকম ভাবে ধরা দেয় তার পরিচয় পাই না। তা পেতে হলে দরকার সেই সাংস্কৃতিক পটভূমির মানুষদের মনোভঙ্গি থেকে ব্যাপারগুলোকে দেখা। এরকম একটা দৃষ্টিভঙ্গির পরিচয় পেলাম রোদেলা দিনের উজ্জ্বলতা দেখে বকুলের উক্তি থেকে। ও বলছিল, ‘আহা রে একেকটা সুন্দর দিন পার হয়ে যাচ্ছে, কিন্তু কেউ বাইরে যেতে পারছে না!’ কথাটা আমারও মনে হয়েছে। 
আমি যখন প্রথম নিউইয়র্কে এসেছি তখন ছিল মে মাস। খোলা জায়গায়, পার্কে মানুষের আনন্দময় বিচরণ চোখে পড়েছিল। মেয়েরা যেন বসন গায়ে রাখতেই চায় না এমন ফ্যাশন তাদের। ছেলেরা হাফহাতার টিশার্ট  আর হাফপ্যান্ট পরতে পারলেই যেন বেঁচে যায়। স্যান্ডো গেঞ্জি পরে চলাফেরা করতে কতজনকে দেখলাম রাস্তায়! কিন্তু শীতকালের সঙ্গে বৈপরীত্য দেখার অভিজ্ঞতা না থাকায় এর তাৎপর্যটা সেবার তেমনভাবে অনুভব করিনি। এক বছরের শীতগ্রীষ্ম পরিক্রমায় ভালো ভাবে অনুভব করলাম শীতের ছয়মাস বদ্ধতার মধ্যে থেকে যেন মুক্তি পেয়ে উল্লাস করছে তাদের শরীর! আজ সকালের রৌদ্রকরোজ্জ্বলতা দেখে বকুলের আর্তি সে কথাই মনে করিয়ে দিল। বাংলাদেশে যাওয়ার কয়েকমাস আগে থেকেই আমি ‘জবলেস’। ফলে করোনাকালের মতোই ঘরে থাকার সুযোগ ছিল। কিন্তু আমি তো আড্ডাবাজ আর উড়নচণ্ডী! নানা ছুতোয় এখানে সেখানে ঢুঁ মারার তালে থাকি! ফলে ‘জবে’র খোঁজে গিয়ে ‘জব’ পাওয়ার চেয়ে ফাউ হিসেবে উপভোগ করতে থাকি ঘোরাঘুরির আনন্দকে। সেই আনন্দ ধরে রাখবার জন্য মনে মনে ধন্যবাদ দিতে থাকি বেকারত্বের দীর্ঘতাকেও। বাংলাদেশে যাব বলে এখনই ‘জব’ না হোক সেটাও বুঝি চাইছিলাম মনে মনে। সেই চাওয়া যে এমনভাবে পাওয়া হয়ে আসবে তা এমনকি দেশ থেকে নিউইয়র্কে ফিরে আসার সময়ও মনে হয়নি। আজকের রৌদ্রালোক দেখে বকুলের উক্তি আমাকে সে কথা মনে করিয়ে দিল! যেন মনে করিয়ে দিল, যারা আকস্মিকভাবে করোনায় আক্রান্ত হয়ে ইহলোক ছেড়ে যাচ্ছেন তাঁদের মতো পরিণতি আমারও তো হতে পারে! সুতরাং সময় নষ্ট না করে এমন কিছু সাধারণ কাজ আমার এখনই শেষ করে ফেলা উচিত যা করব বলে মনে মনে অনেক আগেই ভেবে রেখেছিলাম। কিন্তু জীবন আমাদের এমন ভাবে ধাওয়া করে চলছিল যে ছোট ছোট সেই কাজগুলো করা হয়ে ওঠেনি। এই যে সাতান্ন বছরের জীবন পেয়েছি সেটাও বা কম কিসে। সাহিত্য-শিল্প-সংস্কৃতির আনন্দমেলায় এই যে ঘোরাফেরা করেছি এতগুলো বছর ধরে তার পেছেনে সারা জীবনে কত মানুষেরইতো অবদান রয়েছে। সে-সব অবদানের ঋণ তো স্বীকার করা হয়ে ওঠেনি! ঠিকমতো জানানো তো হয়ে ওঠেনি আমার কৃতজ্ঞতা! কেউ আমাকে জিজ্ঞাসা করতে পারেন জীবনে কী এমন সাফল্য পেয়েছি? হাঁ, সাফল্য না পেতে পারি, জীবন তো এক রকম সার্থকই হয়েছে সাহিত্য-সংস্কৃতি চর্চার সূত্রে আনন্দ-উপভোগের মধ্য দিয়ে। আর এই উপভোগ সম্পন্ন হয়েছে যাঁদের আশ্রয়-প্রশ্রয়ে, যাঁদের দেখানো পথে চলে আমি খুঁজে পেয়েছি সেই আনন্দ নিকেতনের ঠিকানা তাদের প্রতি কৃতজ্ঞতা তো আমার জানানোই উচিত! তাই ঠিক করেছি করোনাক্রান্তির কালের অস্থির পীড়নে নিশ্চেষ্ট না থেকে অন্তত এই কাজটুকু করতে চেষ্টা করব। করোনাবন্দিত্বের জীবনে সার্থকতার দিক থেকে এটুকই বা কম কী! নিশ্চেষ্ট বিষণ্ণ না থেকে সুখের স্মৃতিচারণে কাটুক। কৃতজ্ঞতা জানানোর সূত্রে ফিরে ফিরে আসুক স্মৃতিসুখকর দিনের আনন্দ!
১৭ এপ্রিল ২০২০