এখনো প্রতিদিন খুব সকালে আমার ঘুম ভেঙে যায়। এ আমার গত তিন বছরের অভ্যাসের সুফল। উঠেই জানালার কাছে দাঁড়াই। বাইরের দিকে তাকিয়ে প্রতিদিনের আবহাওয়া বোঝার চেষ্টা করি। রোদ-বৃষ্টি, মেঘলা আকাশ, স্নো, দুরন্ত হিমেল হাওয়া বুঝেই পোশাক চাপাতে হয় শরীরে। এখন সব বন্ধ! ঘরে বন্দি সবাই। স্বেচ্ছাবন্দি-- যাকে বলে হোম কোয়ারেন্টাইন! ভয়াবহ এক মহামারিতে পৃথিবী এখন থমকে আছে এক বেদনার সমুদ্রে। দেশে দেশে মানুষ এখন কেবল সংখ্যা। রবীন্দ্রনাথের রক্তকরবীর সেই সোনার খনির শ্রমিকদের মতো ‘ঊনসত্তরের ঙ’ অথবা ‘সাতচল্লিশের ফ’। সবার চোখ এখন টেলিভিশনের পর্দায় অথবা হাতের মোবাইলের সেটেই আটকে থাকে দিন-রাত্রি। কোন দেশে কতজন নতুন আক্রান্ত হলো, মারা গেল কতজন; এক থেকে দুই, দুই থেকে চারÑ এমনি করে লক্ষ পেরিয়েছে মৃতের সংখ্যা। কবরের জায়গাও যেন ফুরিয়ে আসছে। তাই এইসব মৃত মানুষদের শেষ স্থান এখন গণকবর! মৃত সবার একটিই পরিচয়-- তারা মানুষ! এইরকম একটি নিকষ কালো রাত্রি শেষে আরেকটি দিন শুরু হয়। জানালার কাছে দাঁড়ালে তার ওপাশের ঝলমলে একটি দিন আমাকে সুপ্রভাত জানাল। মেঘমুক্ত নীল আকাশ! এত নীল আগে কখনো দেখিনি যেন! সোনালি রোদে উজ্জ্বল নীল আকাশ! গাছে গাছে ঘাসে ঘাসে প্রকৃতির সারা শরীরে ঝলমল করছে সেই রোদ! রাস্তার ওপারেই এক নিঃসঙ্গ চেরিগাছ দাঁড়িয়ে। গোলাপি ফুলে ফুলে ছেয়ে আছে গাছটা। সদ্য উঁকি দেয়া সবুজ পাতারা ঢাকা পড়ে গেছে গোলাপি সেই ফুলের ভিড়ে! এই সকালেই জমেছে পাখিরা। চড়ুই শালিক ঘুঘু। চঞ্চল সব পাখি। উড়ছে, হাঁটছে, বসছে, খুঁটে খুঁটে খাচ্ছে কিছু। ওদের সঙ্গে ভাব জমাতে জুটেছে দু'একটি কাঠবিড়ালিও। আহা কী চমৎকার দৃশ্য! নির্জন জনমানবহীন রাস্তা। দুপাশে স্থবির হয়ে আছে সার সার গাড়ি। ভাবছি, এ কোন সময়ে আছি আমরা! ছুটে বেড়ানো মানুষগুলো কী অসহায়, বন্দি, নিঃসঙ্গ, একা। সম্পূর্ণ একা! থমকে আছে জীবন! কেবল প্রকৃতি চলছে তার আপন গতিতে। সে আজ মুক্তÑ স্বাধীন! কোনো বাধা নেই, প্রতিবন্ধকতা নেই। আকাশের রং নীল থেকে নীলতর হচ্ছে। স্বচ্ছ থেকে স্বচ্ছতর হচ্ছে সমুদ্রের জল। বালুচরে খেলা করছে ডলফিন। শত বছরের এক প্রাচীন কছিম গা এলিয়ে দিয়েছে রোদে! তীরের বালু ঢাকা পড়েছে বেগুনের আচ্ছাদনে। এমন প্রকৃতির স্বপ্নই তো মানুষ দেখে। দেখে না কি?
নিউইয়র্কে এখন বসন্ত। শীতের জড়তা থেকে বের হবার এ-ই তো সময়। হলুদ ওয়াইল্ড ড্যাফোডিল ফুটে আছে আমাদের ব্যাক ইয়ার্ডের ছোট্ট বাগানে। এবারের বসন্তে রুজভেল্ট আইল্যান্ডের ‘চেরিব্লসম’ দেখতে যাওয়া হলো না আমাদের। ফুল তো ফুটবেই প্রকৃতির নিয়মে। ‘স্টে হোম, সেইফ নিউইয়র্ক’-- নিউইয়র্ক সিটি কর্তৃপক্ষের আহ্বানে সাড়া দিয়ে আমরা আজ গৃহবন্দি! তাই এখন স্মৃতির চোখ দিয়ে দেখি সবকিছু। আকাশ, নদী, মাঠ, সমুদ্র, অরণ্য; আর দেখি ঝাঁক বেঁধে উড়ে যাওয়া হলুদ প্রজাপতির দলকে! এসব কথা যখন মনে ভীড় করে স্মৃতিজট সৃষ্টি করছেÑ অনেকটা যেন এ-সময়ের ডাব্লিউডাব্লিউডাব্লিউডটএনওয়াইডট্জিওভি’র হটলাইনের মতো! সবাই দিনরাত লাইন পাওয়ার জন্য ফোন রিডায়াল করে চলেছে। লকডাউনের কারণে কারো কাজ নেই। সবাই এখন বেকার! সরকারি অনুদান পাওয়ার জন্য এই হটলাইনে ফোন করাটা খুব জরুরি! হঠাৎ জানালার শার্শিতে শব্দ হলো ঠক ঠক ঠক। চোখ পড়তেই দেখি এক নীলকণ্ঠ পাখি আমাকে দেখে বলল, কিরে কেমন আছিস! চিনতে পারছিস না! আমি নীল, নীলকণ্ঠ।
একটু ভেবে কপাল কুঁচকে নিয়ে বললাম, ‘ও তুই? চিনব কী করে বল, আমার স্মৃতির ঘরগুলো দখল করে নিয়েছে এক অজানা অদেখা ক্ষুদ্রাতিক্ষুদ্র জীবাণু কোভিড নাইন্টিন! এখন আর অতীতের কোনো কিছুই যেন মনে করতে পারছি না।’
নীল পাখা ঝাপটিয়ে বলল, ‘জানি, সব জানি। পৃথিবীর অসুখের কথা সবার আগে প্রকৃতিই জানতে পারে। জানিস তো সে কথা! আর সেজন্যই ঘুরে ঘুরে উড়ে উড়ে বেড়াচ্ছি তোকে খুঁজে পেতে। একটু কথা বলে যদি তোর বিষণ্ন মনটাকে ভালো করে দিতে পারি।’
‘তাই নাকি! খুব ভালো লাগল তোকে দেখে। এবার বল, খবর কী!’ এই বলে নীলকণ্ঠের কথা শোনার জন্য উদগ্রীব হলাম আমি।
‘সবই ভালো ভালো খবর, কেবল তাদের খবর ছাড়া। এই যেমন ধর, বনে বনে ফুল ফুটেছে পাখি ডাকছে, প্রজাপতি আর ঘাসফড়িঙের মেলা বসেছে-- সবই তো ভালো খবর, ইস্ট রিভার আর হাডসন নদীতে লক্ষ লক্ষ নতুন সোনালি মাছের দল দিনরাত সাঁতার কেটে বেড়াচ্ছে-- এসবই ভালো খবর নয়?’
শুনে আমি বললাম, ‘ভালো। খুব ভালো খবর! কারো সাথে দেখা হলো?’
‘কার সাথে- ও মানুষ! মানুষের কথা বলছিস? না, তাদের কারো সাথেই দেখা হল না রে! তুইই বল মানুষ ছাড়া প্রকৃতি কি ভালো লাগে? এই যেমন তোর এখানে আসার পথে ব্রুকলীনের বোটানিক্যাল গার্ডেন আর রুজভেল্ট আইল্যান্ড ঘুরে এলাম! এই বসন্তে যেন আগের চেয়ে অনেক বেশি ফুল ফুটেছে সেখানে। ফুলে ফুলে ছেয়ে আছে রুজভেল্ট আইল্যান্ড। গোলাপি চেরি, সাদা চেরি! কিন্তু ফুলেদের মুখে হাসি নেই যেন। আমাকে দেখে ওরা বলল, মানুষদের কী হল বল দেখি! দলবেঁধে আসছে না ওরা! জানিস তো, ওরা না বলে, ‘‘পুষ্প আপনার জন্য ফোটে না।’’ মানুষই যদি না দেখতে পেল তবে আমাদের এই সৌন্দর্য কার জন্য! পার্কের কালো লোহার চেয়ারগুলো কেমন কঙ্কালের মতো হাঁ করে তাকিয়ে আছে। ছেলেমেয়েরা হাত ধরাধরি করে এখন আর বসে থাকে না। ঠোঁটে ঠোঁট রেখে ভালোবাসাও প্রকাশ করে না কেউ! তাই মনে হচ্ছে কী যেন নেই!’ সব শুনে বললাম আমি,
‘ঠিকই বলেছিস নীল!’ নীল আবার বলতে শুরু করল, ‘গতকাল ব্রংক্সে গিয়েছিলাম বেড়াতে। চিড়িয়াখানায় বাঘ নাদিয়া ভীষণ রেগে আছে! যে ন্যানি তার দেখাশোনা করে তার কাছ থেকেই ও কোভিড নাইন্টিন পজিটিভ হয়ে গেছে। এখন বাইরে ঘুরে বেড়াচ্ছে। বলছে এবার উচিত শিক্ষা হলো মানুষের। এতদিন আমাদের খাঁচায় রেখে ঘুরে বেড়িয়েছ তোমরা, এখন দিন এলো উল্টো। তোমরা খাঁচায় বন্দি আর আমরা মুক্ত। একবার বের হলেই হালুম!’
‘হালুম মানে?’
‘একজনকে পেলেই ঘাড় মটকে দেবে নাদিয়া। আচ্ছা নীল, ও কি এখন রাস্তায়?’
‘না না, চিড়িয়াখানাতেই আছে। তবে খাঁচায় না, বাগানে ঘুরে বেড়াচ্ছে। মুক্ত-স্বাধীন! আর ঐ যে লুলু!’ ‘লুলুটা আবার কে?’
‘তুই চিনবি কী করে! লুলুটা হলো আমার এক হুলো-বেড়াল বন্ধু! মা-বাবা সহ ওর একশো বোন আর দুশো ভাই সবাইকে ধরে নিয়ে গেছে এক পশুপাখির হাটে। লুলুটাই কোনো রকমে পালিয়ে আসতে পেরেছে। তারপর থেকে ভীষণ ক্ষেপে আছে তোদের ওপর! একজনকে পেলেই নাকি খামচে দেবে! আচ্ছা পৃথিবীর সবকিছুই কি খেতে হবে? আমার মতো শুধু শস্যদানা খেয়ে থাকতে পারিস না?’
আমি হেসে বললাম, ‘আমি পারি। সবাই তা পারে না হয়তো! একটা কথা বলব তোকে? রাগ করবি না তো আবার?’
মাথা নেড়ে সম্মতি জানালাম আমি, অর্থাৎ রাগ করবো না। এবার আশ্বস্ত হয়ে বলতে শুরু করল নীল, ‘তোরা শুধু নিজেদের জন্য ভাবিস, তাই না? আমাদের কথা ভাবিস না। সেজন্যই তো পৃথিবীটাকে খণ্ড খণ্ড করে এত ছোট করে ফেলেছিস; অথচ দেখ আমরা এক অখ- আকাশেই আছি, ভাগ করিনি তো? তোদের মধ্যে এত ভেদ কেন, এত হানাহানি, এত রক্তক্ষয়, এত যুদ্ধ! জাত-ধর্ম-বর্ণ-- ধর্মযুদ্ধ জাতের সঙ্গে জাতের লড়াই কর। সম্পদের পাহাড় গড়ে সমাজে তৈরি করেছিস কত পার্থক্য। প্রকৃতির সৃষ্টি মানুষ। সবাই এক। অথচ মানুষই মানুষকে আলাদা করে দিয়েছে। ঠেলে দিয়েছে দূরে। ভালবাসাহীন এক পৃথিবী গড়ে নিজেকেই করেছিস একটা ঘরের চার দেয়ালের মধ্যে বন্দি। পাশে কেউ নেই, ঘরে একা। হাসপাতালে একা। কবরেও। মৃত্যুতে চোখের জল ফেলার কেউ নেই! ফুলের স্তবক নেই। শবদেহের পাশে আগরবাতির গন্ধ নেই! মোমবাতি জ্বালাবার জন্যও কেউ নেই। কোরআন বাইবেল গীতা পাঠ করবার জন্যও কেউ নেই চারপাশে। এ কেমন পৃথিবী। কেমন মানবজীবন! এই জীবনের জন্যই তোদের এত লড়াই, এত সংগ্রাম, এত ছুটে চলা! যেন সময় কোথায় সময় নষ্ট করবার, তাই না!
নীলের কথা শুনতে শুনতে আমার ঝাপসা হয়ে যাওয়া চোখ দুটো আড়াল করলাম ঘরের দিকে তাকিয়ে। সত্যিই তো! আজ আমি একা একটি ঘরে বন্দি। একদিন দুইদিন তিনদিনÑ তারপর কতদিন বন্ধুহীন বন্ধ্যা এক জীবনের ভার বহন করে করে আমি কী ভীষণ ক্লান্ত আজ!
কী রে! কী এত ভাবছিস! এবার আমি যাই! শুধু তোর সঙ্গে কথা বললেই হবে! আরো অনেক বন্ধু আছে আমার তা তো জানিস! নীলের কথায় সম্বিত ফিরে এল। অস্ফুটস্বরে বললাম, যেন নিজের কাছেই খুব অচেনা মনে হলো সেই স্বর, আমার উপহার?
উপহার? ও নীলকণ্ঠ পালক? দেব দেব, সময় হলে নিশ্চয়ই পাবি!
কবে সময় হবে রে নীল? সেই কবে প্রার্থনা করেছিলাম তোর কাছে মনে আছে? আমার তখন কিশোর সময় এক জন্মদিন বন্ধুর কাছ থেকে পেয়েছিলাম রক্তকরবী। তারপর থেকে মনে মনে চেয়েছি, নন্দিনীর মতো কোনো এক সকালে আমার ঘরের পুবের জানালা দিয়ে উড়ে এসে পড়বে আমার স্বপ্নের পালক, আমার ভালোবাসার বার্তা। আর কতদিন অপেক্ষা করব বল তো! এবার যে যাবার সময় হল রে! এ জীবনে পাওয়া বুঝি আর হলো না। আর আমাকে খুঁজে না পেলেৃ.!
আমার কথাগুলো শুনে নীলের নীল চোখদুটো কেমন ঘোলাটে দেখাল। বলল, আমি ঠিকই খুঁজে নেব তোকে, যেমন আজ নিলাম। বাংলাদেশ থেকে এই আধুনিক নিউইয়র্ক শহরের মাঝখানে এসে তোকে খুঁজে নিলাম।
কিন্তু যদি আর না থাকি এই শহরেও? যদি চলে যাই কোন নির্জন পাহাড়ের পাদদেশের কোনো এক গণকবরে, তখন? কী করবি তুই!
তবুও তোকে খুঁজে নেবো তোকে। প্রতিদিন রেখে যাবো আমার একটি পালক। সে তো শুধু আমার একার হবে না সে তো সবার জন্য! হোক সবার, তবুও তা হবে একান্ত আমার।
নীল, তুই একটা পাগল পাখি! সবার জন্য রোজ রোজ একটি করে পালক রেখে যেতে যেতে একদিন সব শেষ হয়ে যাবে। তখন কী করবি বলতো!
আমার কথা শুনে নীল হেসে বলল, ‘তুই বড় বোকা একটি মেয়ে। ভালোবাসার পালক কোনদিন শেষ হয় না। ভালোবাসা যে শেষ হবার না, সে তো অশেষÑ বলেই নীলকণ্ঠ পাখি উড়ে গেল আমার জানালার ওপাশ থেকে। উড়ে গিয়ে প্রথমে বসলো সামনের গোলাপি চেরি ফুলে। লেজ দুলিয়ে ডানা ঝাপটিয়ে নিল কয়েকবার। তারপর উড়ে গেল তার অখ- নীলাকাশে! যেখানে কোনো বিভাজন সেই প্রাচীর নেই বাধা নেই সীমানা নেই! মুক্ত আকাশে উড়ে উড়ে যেতে যেতে নীলকণ্ঠ পাখি একটি নীল বিন্দুতে পরিণত হয়ে নীল আকাশেই হারিয়ে গেল। আর আমি জানালার ওপাশে চোখ রেখেই দাঁড়িয়ে আছি এখনো। এখানে এখন মধুর বসন্ত। স্বচ্ছ নীল আকাশ সোনালি রোদ গোলাপি চেরি ফুল চড়ুইয়ের দল নীল আর বেগুনি ঘাসফুল তাকিয়ে আছে আমার দিকে! সেই আছে, থাকবে, হয়তো আমিই...। আমি যদি আর না থাকি, যদি অন্য জীবন পাই তবে যেন তোর জীবন পাই নীল! তোর সঙ্গে যেন উড়ে বেড়াতে পারি ওই অখণ্ড নীল আকাশের বুকে...।’
নিউইয়র্ক/ ১৩ এপ্রিল ২০২০