করোনাকাল
বিচ্ছিন্ন অনুভব
মাহফুজা হিলালী

প্রবন্ধ
অধ্যাপক আনিসুজ্জামান
শামসুজ্জামান খান

গল্প
ডায়মন্ড লেডি ও পাথর মানব
হামিদ কায়সার

গদ্য
নিদ্রা হরণ করেছিল যে বই
মিনার মনসুর

নিবন্ধ
পঞ্চকবির আসর
সায়কা শর্মিন

বিশ্বসাহিত্য
আইজাক আসিমভের সায়েন্স ফিকশন
অনুবাদ: সোহরাব সুমন

বিশেষ রচনা
প্রথম মহাকাব্যনায়ক গিলগামেশ
কামাল রাহমান

শ্রদ্ধাঞ্জলি
মুজিব জন্মশতবর্ষ
মারুফ রায়হান
 
সাক্ষাৎকার
কথাশিল্পী শওকত আলী

জীবনকথা
রাকীব হাসান

ভ্রমণ
ইম্ফলের দিনরাত্রি
হামিদ কায়সার

ইশতিয়াক আলম
শার্লক হোমস মিউজিয়াম

নিউইর্কের দিনলিপি
আহমাদ মাযহার

শিল্পকলা
রঙের সংগীত, মোমোর মাতিস
ইফতেখারুল ইসলাম

বইমেলার কড়চা
কামরুল হাসান

নাজিম হিকমাতের কবিতা
ভাবানুবাদ: খন্দকার ওমর আনোয়ার

উপন্যাস
আলথুসার
মাসরুর আরেফিন

এবং
কবিতা: করেনাদিনের চরণ

১৭ বর্ষ ০৩ সংখ্যা
অক্টোবর ২০২৪

লেখক-সংবাদ :





কবি, কবিতা ও রুচিবোধ
ডাব্লিউ এইচ অডেন, অনুবাদ: কামাল রাহমান
একশ’ ভাগ পৌরুষদীপ্ত মানুষ, খুব পশার জমানো ডাক্তার, নির্দিষ্ট এক শ্রেণির সমাজ-সংস্কারক- এদের কোনো প্রয়োজন নেই কবিতার। প্রথমোক্তরা ভাবে মেয়েলি ব্যাপার এটা, দ্বিতীয় শ্রেণির ওরা মনে করে শিশুসুলভ ও স্নায়বিক দুর্বলতা-সম্পন্ন পলায়নী মনোবৃত্তি এটা, আর তৃতীয়জনেরা বলে, ‘বেহালা বাজায় যখন জ্বলছে রোম’। কবি হিসেবে স্বভাবতই কবিতা কেনার জন্য অন্যদের প্রভাবিত করতে আগ্রহী আমি। তাই চেষ্টা করব এসব অভিযোগের জবাব দিতে।
প্রথম ভদ্রলোকের বিষয়টা সহজ। তাকে শুধু জিজ্ঞেস করব যে ‘গ্লস্টারের ভদ্রমহিলা’ সম্পর্কে কিছু জানে কিনা। তার অভিযোগ মূলত কুশিক্ষার ফলশ্রুতি। বিদ্যালয়ের শিক্ষকেরা, ভয় হচ্ছে আমার, এবং অন্য অনেক মানুষেরা, যাদের আরো ভালো থাকা উচিত, তারা ভাবে ক দিয়ে হয় কবিতা, যেমন কোনো কিছু কেবল উচ্চতর জীবনের সঙ্গে সম্পৃক্ত করে ওগুলোকে, অথবা যে-কোনো চালবাজ, মেধাসম্পন্ন কোনো লোকের জন্য বমন-উদ্রেককারী খেতাব দিয়ে বলে ‘উচ্চমাত্রার জীবন যাপন’। অবশ্যই সম্পূর্ণ অসত্য এটা। কবিতার আছে মানুষের স্বভাবজাত আচরণের মতো একটা অবিরত পরিবর্তনশীল বিষয়বস্তু। বিশ্বজগতের অপার রহস্য নিয়ে ক্রিয়া করে এটা। এমনকি, ইনফ্লুয়েঞ্জা-পরবর্তী সুস্থ হয়ে ওঠার সময়টাতে খুব শক্ত-মাথা কোনো ঝানু ব্যবসায়ী যেমন ভাবে, ’এখানে কেন আমি?’- হতে পারে এটা দুপুরের খাবার সময়ে জমে ওঠা কোনো কৌতুক নিয়ে, অথবা বিপরীত দিকে বসে থাকা মহিলার রূপলাবণ্য নিয়ে।
‘ঢেকে দাও ওর মুখটা; চোখ ধাঁধিয়ে যায় আমার: এত তরুণ সে, অথচ গেল কিনা মরে!’ হচ্ছে কবিতা। এভাবে-
    ‘খুব ভোরে, সাড়ে তিনটেয়
    আলোকিত হয়ে উঠল ওরা সবাই, যেন ক্রিসমাস ট্রি।
    উঠে দাঁড়ালো লিলি, এবং পা বাড়ালো বিছানার দিকে,
    টেনে নিল আরেকটা প্রশ্বাস, এবং পড়ে গেল, মৃত।’
এবং এভাবেই-
    ‘এবং খুঁজে পাওয়া গেল ওকে পুরুষপ্রজাতিতে    
    হাইড্রা, আড্রিয়্যাটিক সাগরে।’
ভাবগম্ভীর কবিতা ও হালকা কবিতা আছে, কৌতুক কবিতা ও চিন্তাশীল কবিতা আছে, খাঁটি কবিতা ও অশলীল কবিতাও আছে। যদি বলেন এর এক ধরনের কবিতা কেবল পছন্দ করেন, তাহলে এটা এমন বলা হবে যে, ‘শুধু পাদ্রী মহাশয়কেই পছন্দ করি আমি।’ অথবা আমার কাছে আসে এমন ধরনের মানুষেরা হচ্ছে শুঁড়িখানার মদ পরিবেশনকারিনীরা। প্রকৃতপক্ষে পাদ্রী মহাশয়দের যথোচিত মূল্য দেয়ার জন্য কিছু সংখ্যক মদ্য পরিবেশনকারিনীদের অবশ্যই বুঝতে হবে আপনার, এবং উল্টোটাও। কবিতার বিষয়েও এটা প্রযোজ্য।
চিকিৎসক ও সমাজ-সংস্কারকেরা হচ্ছে প্রবল প্রতিদ্বন্দ্বী। এদেরকে একসঙ্গে ধরে নিচ্ছি আমি কারণ দুজনের সমালোচনায়ই শৈল্পিক কর্মকা-ের স্বভাবজ প্রশ্নটা উঠে আসে। চিকিৎসকদের ভাষ্য হচ্ছে কিছুটা এমন: ‘তো কী হয়েছে, এমন অনেক শিল্পীরাই আসে আমার চেম্বারে, এবং আমি জানি কি বিষয়ে কথা বলছি আমি। ওদের স্বাস্থ্য সাধারণত যাচ্ছেতাই, মানসিকভাবে সম্পূর্ণ ভারসাম্যহীন ওরা। ওদের ব্যক্তিগত জীবন লজ্জাকর, আর কখনোই আমার ফী দেয় না। দেখুন হোমারকে, বাদুড়ের মতো অন্ধ। ভিলোনকে দেখুন, এক উচ্ছৃঙ্খল জুয়াড়ি। প্রুস্তকে দেখুন, হাঁপানি রোগি, মায়ে-খেদানো প্রকৃষ্ট উদাহরণ সব, ইত্যাদি, ইত্যাদি।
ঠিকই বলেছে সে। প্রকৃতপক্ষে, আমি মনে করি, অনুসন্ধান করলে আমরা দেখব যে বুদ্ধিসম্পন্ন সব মানুষেরা, এমনকি বড় ডাক্তার মহাশয়টিও, শৈশবের মনস্তাত্ত্বিক ঘাত-প্রতিঘাতের ফসল। কিছু কিছু আবেগসঞ্জাত বিশেষ লক্ষণাদির প্রতিফলন সাধারণত ঘটায় এসব। বরং সন্দেহ করি আমি যে পৃথিবীটা যদি শুধু মনস্তাত্ত্বিক বিশুদ্ধতার সমষ্টি হত তাহলে জঙ্গলের শেকড়বাকড় খেয়ে কাটাতাম আমরা এখনও। তাই ওটা বাদ দিয়ে শিল্পীর প্রতি একাগ্র হচ্ছি আমি। একটা আবেগাকুল কাঠিন্য অথবা বিপদসঙ্কুল পরিবেশ দ্বারা যখন আক্রান্ত হই, তখন তিনটে কাজ করতে পারি আমরা। ভান করতে পারি যে সেখানে আমরা নেই, অর্থাৎ উদাসীন অথবা অসুস্থ হয়ে উঠতে পারি; ভান করতে পারি যে সেখানে নেই ‘এটা’, অর্থাৎ দিবাস্বপ্নে নিমগ্ন হতে পারি; অথবা যত্ন নিয়ে তাকাতে পারি এটার দিকে, এবং বোঝার চেষ্টা করতে পারি, ফাঁদটার কৌশলগত দিক ধরার উদ্যোগ নিতে পারি। শিল্প হচ্ছে শেষোক্ত দুটোর সমন্বয়। পলায়নের একটা উপাদান আছে এতে, এবং একটা বিজ্ঞাপনের উপাদান। যে নামে ডাকি আমরা ওটাকে তা থেকে কেবল ভিন্ন হয়ে যায় যা। ওটার বিষয় হচ্ছে উপাত্তের এক ভিন্ন রকম বিন্যাস।
শিল্পের প্রথমাংশ, তাহলে উপলব্ধির বিষয়। শিল্পী হচ্ছে সেই ব্যক্তি যে বহিরাঙ্গনে এবং ভেতরে দেখে এবং এমনকি তার স্বকীয়তারও বাইরে দাঁড়ায় ও তাকিয়ে দেখে তারই দিবাস্বপ্নগুলোকে। শিল্পের অপর অর্ধাংশ হচ্ছে বলা। যদি একজন শিল্পীকে জিজ্ঞেস করেন, ‘কেন কাজ করছেন আপনি?’ আমার মনে হয় তিনি বলবেন, ‘অর্থের জন্য এবং আমার বন্ধুদের আনন্দ দেয়ার জন্য।’
একজন গুপ্তচর ও গল্প-বলিয়ের মিশ্রণ তিনি, হোটেলের শোবার ঘরের দরোজার চাবিফুটোয় চোখ রেখে আনন্দ পায় এমন গৃহপরিচারিকা ও মোল্লার স্ত্রীর এক আশ্চর্য শঙ্কর, সে হচ্ছে ঐ ছোট্ট বালক যে ড্রয়িংরুমে এসে বলে, ‘মোল্লা জালালকে হলঘরে দেখেছি আমি’ অথবা ‘ছোট মামিকে স্নানঘরে দেখেছি পরচুলা ছাড়া।’
অতএব চিকিৎসকেরা ভ্রান্ত। যদি কিছু সময়ের জন্য আমাদেরকে পরিত্রাণ দেয় শিল্পীরা, কৃতার্থ হওয়া উচিত আমাদের, অন্তত একটা নির্দিষ্ট সময়ের জন্য সবকিছু ছেড়ে পালানোর প্রয়োজন রয়েছে আমাদের সবারই, যেমন প্রয়োজন রয়েছে ভালো একটা ঘুমের। শিল্পী কিন্তু ঐ সত্যগুলোও তুলে ধরে আমাদের সামনে যা অতিব্যস্ত অথবা যেগুলো দেখতে লজ্জা পাই আমরা।
ঐ সমাজ-সংস্কারকেরাও ভুল বিবেচিত। একজন শিল্পী যখন বস্তি নিয়ে লেখে, অথবা রোগবালাই, কিংবা নরক বিষয়ে, অবশ্যই  এটা সত্য যে ওগুলোকে তুলে ধরতে চায় সে, কারণ ওর বিষয় হচ্ছে ওগুলো। ঠিক যেমন দাঁতের ডাক্তারেরা চায় মানুষদের পোকায় কাটা দাঁত। সঠিকভাবে বললে, একজন ভালো রাজনীতিবিদ হিসেবে ওকে গ্রহণ করতে পারেন আপনি। সত্যি যা বলেন তিনি আপনার ইচ্ছাশক্তি বাড়াতে, এবং আপনার অবসরের সময়টাকে আনন্দঘন করে তুলতে। ছোট মামি না হয় মোটের উপর কিছু চুল বাড়ানোর বনৌষধি কিনে নিতে পারেন।
আরো দুটো দিক আছে যা স্পর্শ করতে চাই আমি, এর একটা অতি তুচ্ছ, অন্যটা তুলনামূলকভাবে গুরুত্বপূর্ণ। প্রথমত, কবিতা কি যা অন্য শিল্প হতে পৃথক করে তাকে, এবং দ্বিতীয়ত, খারাপ কবিতা হতে ভালোগুলো বেছে নেবেন কীভাবে? এখানে আমি মনে করি, গদ্য ও কবিতার মধ্যে চুলচেরা কোনো বিভাজন নেই। ‘আমার ধারণা খাঁটি কবিতা শুধু আবেগাশ্রিত ও তাৎপর্যপূর্ণ শব্দ-বিন্যাস এবং সব রকমের দার্শনিক গুরুত্ববিহীন, আর গদ্য হচ্ছে তার বিপরীত। প্রকৃতপক্ষে খাঁটি কবিতা ও গদ্যের অস্তিত্ব নেই, যেমন পৃথিবীতে একেবারে মৌলিক পদার্থের অস্তিত্ব নেই। যদি তা পাওয়াই যায় তাহলে ওটা আর পাঠযোগ্য থাকে না, যেমন রাসায়নিক যৌগ ক্রিয়াশীল হয় না। সাকুল্যে যা বলতে পারেন আপনি-
‘পাঁচকড়ি মুদ্রার গান গাই
পকেট ভর্তি ভাজা বাদাম।’
হচ্ছে খাঁটি কবিতার প্রান্তসীমার কাছাকাছি এবং খাঁটি গদ্যেরও প্রান্তসীমার কাছাকাছি, এবং সকল ছায়া পড়েছে ওখানে।
রুচির ক্ষেত্রে অবশ্য পাঠকের ব্যক্তিগত সীমায় পৌঁছে যায় এটা। প্রত্যেক পাঠক এবং সব বয়সের পাঠক স্বভাবতই ভাবে যে তাদের হাতে তুল্যমূল্যের চাবিকাঠি, কিন্তু ইতিহাসের উচিত আমাদের বিনীত করা। একটাই মাত্র সাধারণ রীতি আছে এখানে এবং এটা হচ্ছে সরলতা, যা বলা সহজ, কিন্তু সঠিকভাবে মেনে চলা অসম্ভব। নিজের মধ্যে আপনি গ্রহণ করেন এটা যে একেবারে ভিন্ন ধরনের কবিতা পছন্দ করেন আপনি, ভিন্ন রকম মেজাজে, এবং যদি বুঝতে পারেন যে প্রকৃতপক্ষে শেক্সপীয়ারের চেয়ে এলা হুইলার উইলকক্সকে বেশি পছন্দ করেন আপনি, স্বর্গের দোহাই, মেনে নিন ওটা। কিছু লোক কখনোই কবি হতে পারে না, কারণ তাদের মধ্যে শব্দের প্রতি মনোযোগী হওয়ার বিষয়টি হয়ে উঠে না, শিল্পের উচ্চারিত অংশটুকু; অর্থাৎ তারা আসলে কবিতার প্রতি আগ্রহীই না, উপলব্ধিগত দিকটিতে। কিন্তু যে কোনো শিল্পের মন্দ বিষয়ক সর্বাধিক সাধারণ কারণটি হচ্ছে একটি বিষয়ের প্রতি মনোযোগী হয়ে অন্য আরেকটি বিষয়ের প্রতি মনোযোগ প্রদানের ভান করা। ভালো শিল্পের গোপন বিদ্যাটি ভালো জীবন যাপনের গোপন বিদ্যার অনুরূপ, সঠিকভাবে খুঁজে বের করা যে কীসে আগ্রহী আপনি, হোক না সেটা অদ্ভুত, অথবা অকিি তকর, অথবা উচ্চাকাঙ্খী, অথবা হৃদয়বিদারক, অথবা উন্নয়নমূলক এবং ঐ বিষয়ের সঙ্গে সম্পৃক্ত যা নিয়ে ভালোভাবে কাজ করতে পারেন আপনি। ‘প্রত্যেকের প্রতি তাদের সামর্থ্য অনুসারে; প্রত্যেকের জন্য তাদের ক্ষমতা অনুযায়ী’ হচ্ছে প্রকৃতাবস্থা। ব্যক্তিগতভাবে আমি এমন কবিতা লেখা পছন্দ করি কিন্তু পারি না, তা হচ্ছে, ‘সাধারণ মানুষের কথনে জ্ঞানী মানুষের চিন্তার প্রতিফলন।’