করোনাকাল
বিচ্ছিন্ন অনুভব
মাহফুজা হিলালী

প্রবন্ধ
অধ্যাপক আনিসুজ্জামান
শামসুজ্জামান খান

গল্প
ডায়মন্ড লেডি ও পাথর মানব
হামিদ কায়সার

গদ্য
নিদ্রা হরণ করেছিল যে বই
মিনার মনসুর

নিবন্ধ
পঞ্চকবির আসর
সায়কা শর্মিন

বিশ্বসাহিত্য
আইজাক আসিমভের সায়েন্স ফিকশন
অনুবাদ: সোহরাব সুমন

বিশেষ রচনা
প্রথম মহাকাব্যনায়ক গিলগামেশ
কামাল রাহমান

শ্রদ্ধাঞ্জলি
মুজিব জন্মশতবর্ষ
মারুফ রায়হান
 
সাক্ষাৎকার
কথাশিল্পী শওকত আলী

জীবনকথা
রাকীব হাসান

ভ্রমণ
ইম্ফলের দিনরাত্রি
হামিদ কায়সার

ইশতিয়াক আলম
শার্লক হোমস মিউজিয়াম

নিউইর্কের দিনলিপি
আহমাদ মাযহার

শিল্পকলা
রঙের সংগীত, মোমোর মাতিস
ইফতেখারুল ইসলাম

বইমেলার কড়চা
কামরুল হাসান

নাজিম হিকমাতের কবিতা
ভাবানুবাদ: খন্দকার ওমর আনোয়ার

উপন্যাস
আলথুসার
মাসরুর আরেফিন

এবং
কবিতা: করেনাদিনের চরণ

১৬ বর্ষ ০৫ সংখ্যা
ডিসেম্বর ২০২৩

লেখক-সংবাদ :





আলথুসার
মাসরুর আরেফিন
(প্রকাশিত উপন্যাসের নির্বাচিত অংশ)

মরা তিমির ওই হল রুম থেকে বের হবার জন্য আমি টেবিল ছেড়ে পৌঁছে গেলাম দরজার কাছে, ওই একই দরজা যা দিয়ে ঢুকেছিলাম হল রুমটায়।
আমার একটু আগে এ পথ দিয়েই বেরিয়ে গেছেন স্যামুয়েল, তার পেছন পেছন মেগান। তিমিটাকে কথা বলতে শুনে, তা-ও ও রকম বিধ্বংসী এক কথা, তখনো স্তম্ভিত হয়ে থাকা এই আমার হঠাৎ খেয়াল হলো যে এ বিরাট হল রুমে এ মুহূর্তে আমি ও পৃথিবীর শেষতম ওয়েস্টার্ন নর্থ প্যাসিফিক গ্রে হোয়েলটা ছাড়া আর কেউ নেই। সে আবার কথা বলে উঠতে পারে এ রকম এক ভয়ে, তার দিকে তাকানোর এক পাগলপ্রায় ইচ্ছা সত্ত্বেও পেছনে একদমই না ফিরে, আমি দরজায় ধাক্কা দিলাম। খুলল না সেটা। এবার দরজার হাতল ধরে নিজের দিকে টানলাম এবং বুঝলাম-কীভাবে কোন এক বোধ থেকে যেন বুঝলাম-আমার হাতে সময় একটুও নেই, তিমি নিশ্চিত আবার কথা বলে উঠবে এবং তা এই হল রুমের পরিবেশ-পরিস্থিতির সঙ্গে মিলিয়ে এমন কোনো একটা কথাই হবে যে, আমার তখন সেই কথার সত্যতা প্রমাণের জন্য পায়ের নিচের এই শুকনো শীতল মেঝেয় শুয়ে পড়া ছাড়া অন্য কোনো গতি থাকবে না, যেমন তিমিটা এবার যেন বলবে: ‘ব্লাডি স্কুল স্টেশনে এসেছ তুমি, রক্তাক্ত না হলে কী করে হবে?’ কিংবা অতটা মায়া যদি তার না থাকে (যেহেতু পরিবেশবাদীদের নিয়ে বিদ্রƒপ করা এই আমার জন্য তার বিশেষ কোনো মায়া থাকার এমনিতেও কথা না) তাহলে সে এমনকি এও বলে বসতে পারে যে, ‘এই হল রুমে মৃত্যু ছাড়া তোমার অন্য কোনো বন্ধু নেই, অতএব মেঝেতে হাঁটু গেড়ে বসে পড়ো।’
না, এমন একটা কথা যদি তিমিটা তার মুখ থেকে একবার বলে বসে, একবার যদি সেটা বেরিয়ে যায় এতটা অতিকায় এবং এতখানি একঘেয়ে রকমের বিশঙ্কট, অবয়বে এতটা দুর্জ্ঞেয় এক প্রাণীর মুখ থেকে, তাহলে মানুষের এই পৃথিবীতে-হাহ্, কী রকম ঠুনকো এই পৃথিবী!-আমাকে মৃত্যুর হাত থেকে ফেরাবার মতো আর কোনো শক্তি কারোই থাকবে না, সে বিষয়ে আমি নিশ্চিত হয়ে গেলাম, মনে মনে। যথেষ্ট আতঙ্কিত হয়ে আবার দরজা একবার সামনে ধাক্কা দিলাম, একবার নিজের দিকে টানলাম, অনবরত বলে যাচ্ছি, ‘মেগান, মেগান, স্যামুয়েল, স্যামুয়েল, হোয়ার আর ইউ? হেল্প মি,’ টানছি-ধাক্কা দিচ্ছি-ধাক্কা দিচ্ছি-টানছি, এ রকম চার-পাঁচবার তো হবেই-শেষে পা দিয়ে লাথি দিলাম দরজার ওপরে, নিচের দিকে, মানে যেখানে আমার জুতো থাকার কথা তার থেকে দু ফুট ওপরে এবং ওভাবে পা উঁচুতে রেখেই প্রায় হুমড়ি খেয়ে পড়লাম সামনের ঘরটায়, কারণ দরজা হঠাৎ খুলে গেল নজিরবিহীন এক সারশূন্যতা নিয়ে, আমাকে পরিকল্পনামতো সামনে ঠেলে দিয়ে।
আমার বিব্রত ও যথেষ্ট কলঙ্কজনক সেই চেহারার দিকে তাকালেন ওই ঘরের সবচেয়ে সিনিয়রমতো দেখতে এক ভদ্রলোক। তিনি আমার সঙ্গে হ্যান্ডশেক করলেন, তবে আমি প্রথমে বুঝতেই পারিনি যে ওটা তার হাত ছিল, কারণ আমার মনে হলো যে হাতটা যেন স্রেফ একা, সার্বভৌমভাবে, কারও শরীরের সঙ্গে সংযুক্ত না থেকেই বেরিয়েছে তার পাশের টেবিলের কাছ থেকে। হতে পারে, ভুল আমি দেখতেই পারি। দুই ঘরের আলো পুরো ভিন্ন দুই স্তরের, আর দুই ঘরের চেহারা, আসবাবের বিন্যাস, স্থাপত্যের কার্যকারিতা সবই আলাদা, এমনকি শব্দও। তিমির ওই ঘরে, দেয়ালে হিজিবিজি গ্রাফিটি করা ওই দীপ্তিহীন, নিষ্প্রদীপ ঘরটায় যেখানে এক বিশাল মরা তিমির তখনো প্রতিধ্বনি তোলা ধিক্কার ও তিরস্কারমাখা শাঁ-শাঁ নিশ্বাসের অতিরিক্ত অন্য কোনো শব্দ নেই, তার বিপরীতে এই ঘরে দেখলাম-অনন্ত তিন-চার ডজন ডেস্কটপ কম্পিউটারের ডিজিটাল হাম্ম্ম্ শব্দ, ডিজিটাল ক্লিক, ক্যাঁচ, টপ, টুক, শু, আবার শু ইত্যাদি এবং সিনিয়র ওই ভদ্রলোকের হাত ছাড়তে ছাড়তেই আমি দেখলাম-আমার হাতের বাঁ দিকে একটানা বসানো পনেরো-বিশটা কম্পিউটারের পর্দায় ঝুলছে আমারই দরজায় লাথি মারা পা-টার মাটি থেকে উঁচুতে স্থির হয়ে থাকবার ছবি, জুতোর নিচে দেখা যাচ্ছে লেখা: এজঊএঙজণ। আমার জুতোর ব্র্যান্ডের নাম গ্রেগরি? কারা বানায় এটা? কবে কোথা থেকে কিনেছিলাম আমি?
ভদ্রলোক আমাকে বললেন, ‘হ্যালো, আর ইউ ওকে?’
আমি ‘ইয়েস, আই অ্যাম’ বলতেই তিনি বললেন, ‘লেট মি ইন্ট্রোডিউস ইউ টু দ্য টিম। তুমি অকারণে ওই ঘরে ও রকম অস্থির হচ্ছিলে। আমরা তিমির সঙ্গে তোমাকে কিছু সময় একা থাকতে দিতে চাচ্ছিলাম, কারণ তোমার মতন আর অন্য সবাই সেটাই চায়।’
আমি তাকে বললাম না যে, তার কথা আমি বিশ্বাস করিনি, কারণ রাস্তা থেকে ওই ঘরে ঢোকার সময়ে আমি ঠিকই দেখেছিলাম কীভাবে মানুষ ওই হল রুম থেকে হয় স্পষ্ট কাঁদতে কাঁদতে না হয় বমি চাপতে চাপতে বের হয়ে আবার রাস্তায় পড়ছিল। তো, আমি সেই দরজা দিয়ে রাস্তায় কেন পড়লাম না? মাঝখানে এই ঘরটা কোথা থেকে এল? কে ঠিক করে রাখে এই সবকিছু? আমি কি ভুল দরজায় ধাক্কা দিচ্ছিলাম? কে ঠিক করে রাখে কারও জন্য ভুল দরজা আবার অন্য কারও জন্য ঠিক দরজাটা? আর মেগান ও প্রফেসর স্যামুয়েল কোথায়?
নিজেকে জিজ্ঞাসা করা শেষ প্রশ্নটা আমি ঘরের প্রায় আট-দশজন, কিংবা আরও বেশি হতে পারে, অচেনা মানুষকে করে বসতেই ভদ্রলোকের পেছন দিকে থেকে বের হয়ে এল এক তরুণ-টান টান, স্মার্ট, সুদর্শন, যার হাত, আমি হ্যান্ডশেকের জন্য না ধরেই জানি, কোনো স্টেটসম্যানের হাতের মতো উষ্ণ এবং কোনো করপোরেট এক্সকিউটিভের মতো একদম মাপ মেনে হালকা ভেজা ভেজা ভাবের। সে আমাকে বলল, ‘ওরা এক্ষুনি এখানে আসবে। কোনো দুশ্চিন্তা করবেন না। দিস ইজ নট এ ড্রিল-এখানে এটা কোনো অনুশীলন হচ্ছে না।’
মানে?
আমাকে রবিন বোর্ডম্যান-এই তরুণের নাম রবিন বোর্ডম্যান, আমি জানলাম যে এক্সটিংকশন রেবেলিয়ন-এর হ্যান্ডবুকে তার লেখা একটা রচনাও আছে, নাম ‘বিল্ডিং অ্যান অ্যাকশন’-বোঝাতে লাগল কেন এটা কোনো ড্রিল না।-‘মানে ফায়ার ড্রিলে যেমন হয় যে, আগুন আসলে লাগেনি, আগুন লাগার একটা মহড়া দেওয়া হচ্ছে মাত্র, জানেনই তো? পুরো বিল্ডিং কাঁপিয়ে দেখা যায় বেজে উঠল ফায়ার অ্যালার্ম, কিন্তু আপনি তারপরও ধীরে-সুস্থেই আপনার টেবিল ছেড়ে উঠলেন। এমনকি আপনার ডেস্ক ছাড়ার সময়ে, শেষ মুহূর্তে, আপনার এমনও মনে হলো যে, পানিটা খেয়েই তবে নিচে নামি। তারপর আপনি পানি খেলেন, আপনার গলা তখন নতুন ভেজানো বলে তাতে নতুন জোর, সেই জোরের ওপর ভর করে আপনি এবার বললেন, সবাইকে শুনিয়ে বললেন, “গাইজ, লেটস গো, লেটস গো।” এত শান্ত, ভয়হীন ও পিকনিক-ভাবের কেন আপনার গলা? এতটা আলুনি, এতটা পানসে কেন সবার শারীরিক ভঙ্গিমা? কারণ আপনারা জানেন, ওটা একটা ড্রিল, বিল্ডিংয়ে আগুন আসলে লাগেনি।’
একনিশ্বাসে রবিন এটুকু বলে থামল। আমি ওর কথা শুনতে শুনতে ভালো করে খেয়াল করে নিলাম যে কোথায় আছি। একটা সাধারণ বড় ঘর, এ ঘরের যেখানে আমি দাঁড়িয়ে তার বাঁ ও ডানের পুরোটা জুড়ে টানা টেবিলের ওপরে প্রায় চল্লিশটা কম্পিউটার, কম্পিউটারগুলোর পেছনে দেয়ালজুড়ে পোস্টার আর পোস্টার-অধিকাংশই সাদা-কালো, আবার রঙিনও আছে। ঘরের সব আলো এ মুহূর্তে জ্বলছে না, কিন্তু তাতেও স্পষ্ট যে আমার পেছনেই দাঁড়িয়ে আছেন সেই ভদ্রলোক, এদের সবার বসই হবেন তিনি, তার নাম জেনেছি উইলিয়াম স্কিপিং-হুম, তিনিও এই দলের হ্যান্ডবুকে একটা রচনা লিখেছেন, শিরোনাম: ‘রিইনফোর্সমেন্টস অ্যান্ড মিডনাইট ¯œ্যাকস’। তো এরা সবাই বারবার ওই এক হ্যান্ডবুক হ্যান্ডবুক করছে কেন? আমি কি দয়া করে হ্যান্ডবুকটার একটা কপি পেতে পারি?
মনে হলো আমার কথা কেউ শুনল না, কারণ আমার গলায় জোর নেই, আমার খিদে পেয়েছে অনেক, যতটা না না-খাওয়া থেকে, তার চেয়ে বেশি দুশ্চিন্তা এবং ওই তিমিকে দেখার অতীন্দ্রিয়তা ও অযৌক্তিকতা থেকে, আর এ রকম কম আলোয় আমার চোখকে অভ্যস্ত হতে হচ্ছে বলে নিজের ভেতরকার বিরক্তি থেকে আমার শরীরের এনার্জির দ্রুত পোড়ায়। এতখানি কম আলো! কেন এ রকম কম আলো? তার মধ্যেই আমি স্পষ্ট দেখলাম আমার পেছনে দাঁড়ানো উইলিয়াম স্কিপিং, আমার সামনে দাঁড়ানো ঝকঝকে বাচ্চা ছেলে রবিন বোর্ডম্যান, আর রবিনের পেছনে দল বেঁধে দাঁড়িয়ে থাকা আরও সাত-আটজন যারা একটানা তাদের নামগুলো বলে গেল-হাই আমি জেমস, হাই আমি রুবি, আমি অ্যাডাম, হ্যালো আমি ডুগাল্ড, হাই আমি ভুবন, ভুবন চাঁদ জোশি, এ রকম এ রকম। এরা সবাই কম্পিউটারগুলোর স্ক্রিন থেকে আসা অনৈসর্গিক আলো, প্রায়-সবুজ প্রায়-ধাতব প্রায়-মভ রং আলো চেহারায় মেখে দাঁড়িয়ে থাকা প্রচ- উদ্যমী ও অক্লান্ত কিছু মানুষ, যারা স্পষ্ট ব্রত নিয়েছে যে এ পৃথিবীকে তারা বাঁচাবেই। সে অর্থে এদের চেহারার মূল ভাব: জেদ। আর সেই মূল ভাবের বৃত্তের বাইরে যা আছে তা অঙ্গীকার এবং অস্থিরতা ও পরহিতব্রত থেকে জš§ নেওয়া এক ঔদ্ধত্যের মিশেল।
ঠিক এ সময়ে, ততক্ষণে রবিনের জায়গা নিয়ে নিয়েছে যে ডুগাল্ড-সে-ই প্রথম আমাকে হ্যান্ডবুক নিয়ে কোনো কিছু বলেনি-সে বলা শুরু করল সেখান থেকে যেখানে রবিন থেমেছিল। রবিন যতটা ঝকঝকে একটা ছেলে, ডুগাল্ড ততটাই পাগল-পাগল, হিপ্পি চেহারার, যাকে আমার নিশ্চিত মনে হচ্ছে নিউইয়র্কের ইস্ট ভিলেজে সারা দিন গিটার হাতে ঘুরে বেড়ানো কোনো উš§না তরুণ যে নাকি ইরাক যুদ্ধ শুরু হওয়ার কারণের থেকে তার গানের প্রতি একাগ্রতা সাময়িক হারিয়ে ফেলেছে। যে-ই ডুগাল্ড বলা শুরু করেছে, তখন আমি দেখলাম এদেরই দলের শ্যামলা রং সুশ্রী মেয়ে রুবির পাশে এসে দাঁড়াল মেগান, দেখি সে আমার দিকে তাকিয়ে হাসছে, কিন্তু আমি তার উত্তরে তাকে হাসি ফিরিয়ে দিতে পারছি না এই আজগুবি ভয়ের থেকে যে, আমার মনে হচ্ছে আমার মুখে যেই না হাসি ফুটবে, অমনি মেগান কোথায়ও হারিয়ে যাবে আর পাশের হল ঘরের তিমিটা অমনি নড়েচড়ে বসে মেগানের জন্য আমার মায়া প্রসঙ্গে স্রেফ এক দুর্বোধ্য কিন্তু ক্রোধোš§ত্ত তীক্ষè চিৎকার দিয়ে লন্ডনের এই ব্লাডি স্কুল নামের আধিভৌতিক এলাকাটায় একটা সিভিল-মিলিটারি ইমারজেন্সি ঘটিয়ে বসবে।
ডুগাল্ড দেখি বলতে বলতে প্রায় আমার গায়ের ওপর পড়ে যাচ্ছে। ইস্ট ভিলেজে গিটার বাজানো এই তরুণ কি নেশাগ্রস্ত? এরা কি কেউ বুঝতে পারছে না যে আমার খিদে পেয়েছে? প্রফেসর স্যামুয়েল কোথায়? মেগান একা কেন? প্রফেসর কি আমার ওপরে রাগ থেকে আমাকে তিমি দেখিয়ে পরিবেশবাদী আন্দোলন বিষয়ে আমার ধারণাকে মিথ্যা প্রমাণ করার আনন্দে বাইরে বাগানে বসে গাঁজা টানছেন? আমি দেখেছি যে এই ঘরের শেষে একটু  উঠানমতো এবং সেখানে গাছের ফাঁকে ফাঁকে কিছু বেঞ্চি পাতা, কিংবা আমি হয়তো ভুল দেখেছি, হয়তো ওই গাছগুলো সরু সরু তেলের ড্রাম আর বেঞ্চিগুলো খেলার মাঠে টাইমকিপারের বসার টুল, আবার এ-ও হতে পারে যে ছোট একটা টুলকে অনেকগুলো টুল আর সবটা যোগ দিয়ে জিনিসটাকে একটা বেঞ্চি বলে মনে হয়েছে আমার-তো সেই বাগান, সেই তেল কোম্পানির কারখানার পেছন দিকটায় ব্যাডমিন্টন খেলার একটুখানি মাঠ, সেখানেই প্রফেসর কি আমাকে হারাতে পারার আনন্দে সাবস্ট্যানস ইউজ করে করে ঘুমিয়ে পড়েছেন?
ডুগাল্ড বলে চলেছে: ‘অবশ্যই আমাদের এটা কোনো ড্রিল না। এটা রিয়াল। ড্রিলে কী হয়? কী হয়? রবিন যা বলল সেখান থেকেই যদি বলি-ততক্ষণে আপনার ফ্লোরের ফায়ার ওয়ার্ডেন, প্রতি ছ মাসে একবার ড্রিল করে করে তিনি ক্লান্ত, ততক্ষণে তিনি নিশ্চিত বাঁশি বাজাচ্ছেন আর সবাইকে বলছেন যে, সবাই সিঁড়ি ধরে নামবে এবং সিঁড়িতে ভিড়ের মধ্যে তোমরা কোনো ছেলেমেয়ে কোনো রকম বেলেল্লাপনা করলে তাকে ধরে সত্যিকারের আগুন জ্বালিয়ে তাতে ছুড়ে দিয়ে ভস্ম করে ফেলা হবে।’
ডুগাল্ড এমন একটা কথা বলে বসবে, তা কেউ কল্পনা করেনি, আমিও না। ডুগাল্ডকে এবার একপাশে ঠেলে সরিয়ে দিল ভুবন, ভুবন চাঁদ জোশি, যার লেখা একটা রচনা আছে সেই হ্যান্ডবুকে, শিরোনাম: ‘দ্য হিট ইজ মেল্টিং দ্য মাউন্টেনস,’ সেটা সে লিখেছে কমলা জোশির সঙ্গে মিলে। আমার মনে হলো, চোখের ইঙ্গিত দিয়ে ডুগাল্ডকে ঠেলে সরিয়ে দেবার কথাটা ভুবনকে বলেছেন আমার পেছনে দাঁড়িয়ে থাকা নেতা উইলিয়াম স্কিপিং, আবার মনে হলো এরা যদি আমাকে ওই হ্যান্ডবুকের (শুনলাম ওটা বেরিয়েছে এই ২০১৯ সালেই পেঙ্গুইন র‌্যান্ডম হাউস ইউকে থেকে, আর এখন নেলি নামের এক মেয়ে, মেগান এ মুহূর্তে নিজে যার কাঁধে ভর দিয়ে দাঁড়ানো, শুনলাম রুমের ওই ওখান থেকে চিৎকার দিয়ে বলছে, ‘বইটার আইএসবিএন নম্বর ৯৭৮-০-১৪১-৯৯১৪৪৪-৩;’ কিন্তু আইএসবিএন নম্বর দিয়ে আমি করবটা কী?) ওই হ্যান্ডবুকের কোনো কপি আমার হাতে না দিয়ে আর একবারও ওটার কথা আমাকে বলে তো, আমি চিৎকার করে এবার তার প্রতিবাদ জানাব, বলব যে ‘নো-ও-ও-ও-ও’।
ভুবন তার রাজকীয় ব্রিটিশ অ্যাকসেন্টে, যার মধ্যে উত্তর ভারতের কী যেন কী একটা মেশানো, যেভাবে আইশ্যাডো ও মাসকারা মিলেমিশে থাকে কাজলের সঙ্গে, বলে যেতে লাগল: ‘তখন আপনারা সবাই জলদি সোজা অফিসের সামনের মাঠে এসে দাঁড়ালেন। দমকল বাহিনীর চিফ ফায়ার অফিসার নিজে আজ কথা বলবেন জমায়েতের উদ্দেশে। মেগাফোনে তিনি এরই মধ্যে বলতে শুরু করেছেন, “মার্শাল, মার্শাল, চেক দ্য ফ্লোরস।” কেন এটা বললেন তিনি? কারণ এ বিষয়ে অভিজ্ঞ এক লোক হিসেবে তিনি জানেন যে, ফায়ার ড্রিলের সময়ে সব লোক আসলে বিল্ডিং থেকে বের হয় না, কারণ তারা জানে এটা মিথ্যা, এটা স্রেফ একটা ড্রিল, তাই তারা তাদের ক্ষমতা খাটিয়ে কিংবা আড়চালাকির চূড়ান্ত প্রমাণ দিয়ে বসে থাকে কোনো একটা বাথরুমে এবং বিনা কারণে বাথরুমে বসেছে বলেই এরা প্যান্ট-আন্ডারওয়্যার সব খুলে কমোডেই বসে যায়, সেই বিনা কারণেই, আর শোনে বাইরে কীভাবে লোকেরা হুলুস্থুল করে নামছে সিঁড়ি বেয়ে, আর তারা তাদের পাছার ওপরের দিকটা এবার একটু চুলকায়, যে পাছা কিনা এতক্ষণে সত্যি পুড়ে ছাই হয়ে যেত এটা যদি ড্রিল না হয়ে সত্যিকারের আগুন লাগার ঘটনা হতো কোনো।’
কিছু একটা বাড়তি কিছু ছিল ভুবনের কথার মধ্যে, কোনো একটা প্রায় স্ফারিত ও প্রায় অগুপ্ত অশ্লীলতা যে, তাকেও যেতে হলো, আমার সামনে থেকে সরে যেতে হলো। এবার স্বয়ং উইলিয়াম স্কিপিং আমার মুখের ওপরে। তিনি আমাকে সোজা নিয়ে গেলেন এতগুলো বক্তব্যের উপসংহারের দিকে, কারণ তিনি বস-কোনো লম্বা আলোচনা শেষ করে দেওয়া তার জীবনের প্রধান দু-তিনটে কাজের একটা।
উইলিয়াম বললেন, তিনি বলছেন আর আমি তার মুখে বাংলাদেশের পানের কড়া গন্ধ পাচ্ছি-সেটা কী করে সম্ভব? কীভাবে সম্ভব? তিনি যত বলছেন তত পান পার হয়ে সুপারিতে যাচ্ছি আমরা, সুপারি পার হয়ে জর্দায় যাচ্ছি, আর যতক্ষণে তিনি তার শেষ বাক্যে, ততক্ষণে আমরা (মানে আমি ও তিনি) খয়েরে, চুনে: ‘সে রকম কোনো মিথ্যা ফায়ার ড্রিল চলছে না এই পৃথিবীতে। এখানে আসলেই আগুন লেগে গেছে, সত্যিকারের দাবানল। তোমাকে বুঝতে হবে যে ড্রিলের দিন শেষ, ওই দাগ কবেই পার হয়ে এসেছে পৃথিবী। মোদ্দাকথা, এভাবে চলতে থাকলে হাতে থাকবে,’ এটুকু বলে থামলেন উইলিয়াম, এ রুমের সবাই ঘন হয়ে এল উইলিয়াম ও আমার চারপাশে এবং উইলিয়াম আরেকবার কথাটা বলতেই-যে, ‘এভাবে চলতে থাকলে হাতে থাকবে’-তারা সবাই যার যার ডান হাত একসঙ্গে উঁচুতে তুলে একযোগে বলল: ‘আর মাত্র বারো বছর।’
আমি বুঝলাম এটা কোনো ড্রিল না। আমি বুঝলাম পৃথিবী ধ্বংস হয়ে যাবার এই সতর্কবাণী সত্য, যে অ্যালার্ম বেল এই এক্সটিংকশন রেবেলিয়নের এরা বাজাচ্ছে তা কোনো ড্রিলের বেল না, তা সত্য দুর্ঘটনায় বাজানো এক সত্য ঘণ্টা-ঢং ঢং ঢং করে বাজছে সে এবং জানান দিচ্ছে যে এভাবে চলতে থাকলে পৃথিবী টিকবে আর মাত্র বারো বছর। বোঝা গেল। কিন্তু এতক্ষণ ধরে এতগুলো আলাদা আলাদা মানুষ আমাকে এই সামান্য সত্যটুকু এত আয়োজন করে বলবার আদৌ কি দরকার ছিল কোনো? আমি তো ওই পাশের হল ঘরে পৃথিবীর শেষতম ওয়েস্টার্ন নর্থ প্যাসিফিক গ্রে হোয়েলকে দেখে যা বোঝার তা আগেই বুঝে গিয়েছিলাম। এত কিছু না করে, আহা, এরা স্রেফ যদি আমাকে একটা কিছু খেতে দিত এবং সোজাসাপ্টা জিজ্ঞেস করত যে, তিমি দেখার পরে আমি কি কনভিনসড যে তাদের আন্দোলন সত্য কথা বলছে ইত্যাদি, তাহলেই তো হয়ে যেত। আমি আর না পেরে উইলিয়ামকে বলে বসলাম: ‘আই ফিল এক্সট্রিমলি হাংরি।’ আমার কথার পরে একটুখানি চাঞ্চল্যের ঢেউ উঠল যেন চারপাশে; কে যেন কাকে বলল ‘প্রফেসর কোথায়?’ কে যেন এই কথা বলে ফিসফিস এক ডাকও দিল: ‘মেগান, মেগান, ইওর ফাদার ইজ হাংরি।’ সম্ভবত ‘ইওর ফাদার’ কথাটা বলা হয়নি, সম্ভবত তা আমার কল্পনা, তা আমার এই আশঙ্কা থেকে জš§ নেওয়া এক কল্পনা যে ফাদারদের কাছ থেকে মেয়েরা তো পালায় এবং তারা বরং কাছে আসে কেবল তাদের এখনকার প্রেমিক ও প্রাক্তন প্রেমিকদেরই।
আমাকে এবার প্রথম পোস্টারটা হাতে তুলে দিলেন উইলিয়াম। নেলি তাকে এনে দিল সেটা, গোল করে রোল করা, আর তিনি তা ঝটপট খুললেন আমার চোখের সামনে। আমি নেলির হাবভাব দেখে আশ্চর্য হয়ে গেলাম। টাইট জিনস পরা এই মেয়ে এদের সবার বস উইলিয়াম স্কিপিংকে পোস্টারটা হাতে দেবার সময় দেখি যে, সে তার টি-শার্ট ফুঁড়ে বের হয়ে আসতে চাওয়া দুই বুক দিয়ে ঘষা দিল উইলিয়ামের বাহুতে, তারপর উল্টো ঘুরে যাবার সময় তার পাছা বিশ্রীভাবে নাচাল একটু। উইলিয়াম যেন তা দেখেও দেখলেন না, তিনি কেবল মেয়েটার ওই বিদায় নিতে থাকা পাছায় ছোট থাপড় মারলেন দুটো-কোনো অশ্লীল থাপড় না, স্বাভাবিক ‘যাও, যাও তো’, এমন ধরনের দুটো থাপড়।

(চলবে)