কাহিনীটা সরল। কায়দা করে একে ভূমিকা বলার চেষ্টা করাটা বোকামি হবে। আর সত্যি বলতে কি সে কায়দা-কানুন আমার জানাও নেই। শুরু থেকেই গল্পটা বলি। সালটা ঠিক করে মনে নেই। ২০০৭ বা ২০০৮ হবে। ঢাকার বহুল পরিচিত ধানমন্ডি ২৭ নাম্বার রাস্তায় ইটিসি বলে একটা সুপার শপ ছিল। ওটার দোতলায় নানান রকম বইয়ের ছোটখাটো একটা গ্যালারি ছিল তখন। ওই সময়ই ওটার উঠে যাই-যাই অবস্থা। বেশ কিছু পুরানো বই কম দামে ছাড়ছিল ওরা। আইসক্রিম খেতে গিয়ে একদিন পেয়ে গেলাম গুলজার সাহেবকে। মুখোমুখি নয়; বইয়ের পাতায়। বিকজ হি ইজ। লেখক গুলজার-কন্যা চলচ্চিত্র নির্মাতা মেঘনা গুলজার। তক্ষুনি ব্যাগ হাতড়ে যা পেলাম তাতে কাজ উঠে গেল। বইটা বুকে চেপে বাড়ি ফিরতে ফিরতে আনন্দে মরে যাচ্ছিলাম যেন। আজও জানা হয়ে ওঠে নি কেন অমন হচ্ছিল।
গুলজার সাহেবকে প্রথম শুনি তাঁর গানে। প্রথম পড়ি তাঁর জীবনীর পাতায়। ‘বিকজ হি ইজ’ গ্রন্থের পাতা থেকে পাই তাঁর জীবনদর্শন- সুরভিত আলোর সন্ধান। একজন জীবননিষ্ঠ মানুষ যাকে পড়ছিলাম তাঁর আত্মজার চোখের ভাষায়। কিন্তু ব্যক্তিগত পাঁচালীর বাইরে একজন স্বতন্ত্র সৃজনশীল মানুষের চরিত্র ঠিকঠাক এসে দাঁড়িয়েছে লেখকের মুন্সীয়ানার কল্যাণে। আর দারুণ ব্যাপার লেগেছিল যে, বইটির প্রতি অধ্যায় শেষ হয়েছে গুলজার সাহেবের কবিতা দিয়ে। সে-ই প্রথম। যেটাকে শুরু বলা যায়। গুলজার সাহেবের কবিতার সাথে পরিচয়। ছোটবেলা থেকে হিন্দি গান শুনে ছবি দেখে যে কান তৈরি হয়েছিল সেই হেলাফেলার অভ্যাস এতদিনে কাজে লাগল যেন। ইংরেজি হরফে লেখা হিন্দি ঐ কয়টা কবিতাই ঘুরে ফিরে পড়া, শব্দগুলোর মানে বোঝার চেষ্টা, অনুভবের প্রয়াস। আবিষ্কারের চমকে খাবি খেতে খেতে টের পেলাম ‘অনুভব’ করছি। তাঁর নৈঃসঙ্গ্য শূন্যতা ঔদাসীন্য। অনুভব করছি চেখে নিচ্ছি শিল্পের বিষাদঅমৃত স্বাদ।
পরের বিষয়গুলো ঘটে যাচ্ছিল অলৌকিক পরম্পরায়। আমার প্রাক্তন বস্ শিশু অধিকার বিষয়ক গবেষক রেচেল কবির তখন পারিবারিক কারণে ভারতে যাতায়াত করছিলেন। বেমক্কা তার কাছে আবদার করে বসলাম গুলজার সাহেবের কবিতার একখানা বই এনে দিতে। উনি সানন্দে রাজী হলেন। তারপর এক বিকেলে রেচেল আপার বাসায় গিয়ে হাতে পেলাম গুলজার সাহেবের বই ‘রাত প্যশমীনে কী’। আপা ঐ সময় হিন্দি ভাষা শিখছিলেন। আমার আবেগে থরথর অবস্থা দেখে তাঁর একখানা হিন্দি থেকে ইংরেজি অভিধান আর বর্ণমালার বই দিয়ে দিলেন সাথে। ঠিক মত কৃতজ্ঞতা জানাতেও ভুলে গেছিলাম। গুলজার সাহেবের বইটা হাতড়ে চললাম। একবিন্দু পড়তে পারি না। তবু যেন সুরভিত মন। কী আছে এতে? মনে বাসনা, এই অচেনা হরফে উনি যা লিখেছেন তা আমি চিনব, চিনে নিতে শিখব। এর পরের ব্যাপারটা এমন হওয়ার ছিল যে পরদিন থেকেই আমি কোমড় বেঁধে হিন্দি শিখতে লেগে যাব। কিন্তু এমন কিছুই ঘটে নি। কারণ আমার চিরসাথী আলস্য। রেচেল আপা ঠিকই খোঁজ নিতেন, আমি হিন্দিটা শিখে বইটা পড়তে পারছি কি না। হায়, তখনও আমি অন্ধকারেই ছিলাম। কবি শিল্পী অভী চৌধুরী এর মাঝে একদিন ‘বিকজ হি ইজ’ থেকে গুলজার সাহেবের কিছু কবিতার অনবদ্য অনুবাদ করে ফেলল। তাতেও আমার আগ্রহের ঘরের কড়া নড়ল না। আমার হিন্দি শেখায় কোনো অগ্রগতি সাধন হলো না। অলসতায় আমি নিজের জীবনের ৯০ ভাগ শেষ করেছি। গুলজার সাহেবের প্রতি ভালোবাসাটাও ‘শুকনো কথার’ ভালোবাসায় আটকে থাকত যদি না চিত্রকর গবেষক বন্ধু শাওন আকন্দ আমাকে ধাক্কাটা দিত। গুলজার সাহেবের কবিতার বই প্রাপ্তি এবং বন্ধুর ধাক্কা- এর মাঝে কেটে গেছে সাত সাতটি বছর! বন্ধু শাওন বলল, তুই অনুবাদ শুরু কর। গুলজার সাহেবের সাথে একবার সাক্ষাতের চেষ্টা করা যায় কি না দেখি। গুলজার সাহেবের সাথে দেখা! আমি তখন মাটিতে নেই; আসমানেও না। সোজা পড়ার টেবিলে। ২০১৫-এ শুরু করলাম হিন্দি ভাষা শেখা। প্রথম গুরু ইউটিউব। বর্ণমালা চিনেই প্রথম যে কবিতাটা পড়লাম ‘রাত প্যশমীনে কী’ বই থেকে সেটার নাম “পঞ্চম”। সেই অনুভূতিটা বলে বোঝানোর না। ছিল শুধুই অচেনা হরফ। আজ সে প্রিয় শব্দমধুমঞ্জরী। পড়ে যা বুঝলাম আর বুঝলাম না সব মিলিয়ে অনুবাদ হল। পাগলের মত ছুটে গিয়ে শাওনকে শোনালাম। শুনে সিদ্ধান্ত হল রক্তমাংসের গুরু চাই। গুলজার সাহেবকে পড়ব বলে গেলাম দ্বিতীয় গুরু ইন্দিরা গান্ধী কালচারাল সেন্টারের হিন্দি ভাষার শিক্ষক অপর্ণা পা-ের কাছে।
কাহিনীটা এখানে শেষ হতে পারত। কিন্তু সেটা হয় নি। হিন্দি শিখছি। অনুবাদ করার চেষ্টা করছি। ক্লাস শেষে ম্যাডামকে দুরু দুরু বুকে আবার দেখাচ্ছিও। উনি পরামর্শ দিচ্ছেন। আর এভাবে সমস্যাগুলো জানতে পারছি। জানলাম অ আ ক খ শিখে গুলজার সাহেবের কবিতা অনুবাদ করতে যাওয়ার মত বোকামি আর নেই। জানলাম কেবল হিন্দি শিখেও লাভ নেই। গুলজার সাহেব উর্দু ভাষার কবি ও সাহিত্যিক। তাঁর প্রিয়তম ভাষা উর্দুর ভালোবাসা কবিতার পরতে পরতে ছড়িয়ে আছে। যেহেতু ভাষাটা উর্দু,ফার্সী আর আরবী শব্দে ভরপুর। কাজেই উর্দু ভাষার শিক্ষকের দ্বারস্থ হতে হবে। অপর্ণা ম্যাডাম সাধ্যমত চেষ্টা করতে থাকলেন। কিছু বিনিময় হলো ইন্দিরা গান্ধী কালচারাল সেন্টারের কৃতি শিক্ষার্থী সিফাত-ই-এলাহীর সাথে। আমার উর্দুভাষী প্রাক্তন কলিগের সাথেও আলাপ চলল। আপাদের সাথে আলাপ করে জানলাম যেসকল উর্দুভাষীরা বাংলাদেশে রয়ে গেছেন বিশেষ করে আটকে পড়া পাকিস্তানী ক্যাম্পে এবং এর চারপাশের এলাকাগুলোয়, তাদের দৈনন্দিন জীবনের ভাষা আর সাহিত্যে ব্যবহৃত উর্দু ভাষা এক নয়। কাজেই উর্দু ভাষায় যারা সাহিত্য চর্চা করছেন কেবল তারাই আমাকে এক্ষেত্রে সাহায্য করতে পারবেন। বাংলাদেশে উর্দু ভাষায় সাহিত্য চর্চা করছেন এমন একজনের সাথে আমার পরিচয় হয়েছে আমাদের সাহিত্যের আড্ডা ‘কবিতার প্লাটফরম’এর কল্যাণে। তিনি কবি সাদিয়া আরমান। দ্বারস্থ হলাম তার। পেশায় ব্যারিষ্টার। সাদিয়ার বাবা কথা সাহিত্যিক, কবি ও গল্পকার মোহাম্মদ আরমান শামসী উর্দুভাষায় সাহিত্যচর্চা করছেন দীর্ঘদিন ধরে। সাদিয়া আমাকে পাঠালেন তার বাবার বন্ধু উর্দুভাষার কবি শামীম যামানভীর কাছে। বাংলা-উর্দু সাহিত্য ফাউন্ডেশনের ভাইস প্রেসিডেন্ট। শামীম যামানভী তার চর্চা দক্ষতা আর অসীম ধৈর্য্য নিয়ে আমাকে সাহায্য করতে এগিয়ে এলেন। আমি এবার আলোর সন্ধান পেলাম যেন। আর ঠিক এইখানে এসে আমার হুড়োহুড়ি থামল। পাঠক, আর এই বিশদ বর্ণনাটারও তেমন প্রয়োজন নেই বোধহয়। যেটা ঘটে চলল সেটা হল, আমি অবসর পেলাম আস্বাদনের। রাত প্যশমীনে কী- আমার হাতে যেন স্বপ্নলোকের চাবি! গুলজার এবং রাত প্যশমীনে কী- আমার ‘হঠাৎ হাওয়ায় ভেসে আসা ধন’।
গুলজার: বিষণœ আলোর প্রতিকৃতি
......
নতুন করে তাঁকে পরিচয় করিয়ে দেবার প্রশ্ন অবান্তর। তিনি সম্পূরণ সিং কালরা। পৃথিবী তাঁকে চেনে গুলজার নামে । সিনেমার বর্ণাঢ্য জগতে তাঁর পরিচয় কখনো গীতিকার, কখনো চিত্রনাট্য রচয়িতা কখনো চলচ্চিত্র নির্মাতা হিসেবে। তবে সবকিছু ছাপিয়ে তিনি কবি গুলজার। তাঁর লেখা কবিতায় নিজের পরিচয় দিচ্ছেন এভাবে-
লিখেছি কবিতা, ছাপা হল গল্প
রচেছি গান, পড়লাম গিয়ে ছবি নির্দেশনায়
লিখলাম কাহিনী তো খ্যাতি এলো চিত্রনাট্যে
এমনই ঘটে চলেছে আমার সঙ্গে...
শিখ পরিবারে জন্মেছেন ১৯৩৬ মতান্তরে ১৯৩৪ সালের ১৮ অগাস্ট দীনায় (বৃটিশ ভারতের ঝিলম জেলা বর্তমানে যেটা পাকিস্তানে অবস্থিত)। পিতা সরদার মাখন সিং কালরা এবং মা সুজান কউর। শিশু কালেই তিনি মাকে হারিয়েছেন। বেড়ে উঠেছেন বৈমাত্রেয় ভাই-বোনদের সাথে আদরে-অনাদরে। দেশভাগ নামক প্রলয়ের আঘাতে তাঁর পরিবারকে স্থানান্তরিত হয়ে চলে আসতে হয় দিল্লীর রওশন আরা বাগে। সেখানে ইউনাইটেড ক্রিশ্চিয়ান স্কুল থেকে ম্যট্রিকুলেশন শেষ করেন তিনি। বম্বের খালসা কলেজ এবং ন্যাশনাল কলেজ বম্বেতে ইন্টারমিডিয়েট পড়াকালীন সময়ে বিদায় জানিয়েছেন প্রাতিষ্ঠানিক লেখাপড়াকে। সাহিত্যের প্রতি প্রগাঢ় ভালোবাসার পাশপাশি একই সঙ্গে তিনি শাস্ত্রীয় সংগীত ও চিত্রকলারও অনুরাগী। ৪০ বছর বয়সে শিখেছেন সেতার। ৫০ বছরে লন টেনিস। ৮২ বছর বয়সে বান্দ্রা জিমখানার টেনিস টুর্নামেন্টে বিজয়ীর ট্রফি ওঠে তাঁর হাতে। এমন অদম্য ইচ্ছাশক্তি প্রাণশক্তি তাঁর। কবি গুলজারের আগে তিনি পরিচিতি পান গীতিকার, গল্পকার, চিত্রনাট্য রচয়িতা হিসেবে। ১৯৭১ সালে চলচ্চিত্র পরিচালক হবার ইচ্ছে পূরণ হয় তাঁর। নির্দেশনা দিয়েছেন টিভি নাটকেও। বানিয়েছেন তথ্যচিত্র। গুলজার প্রসিদ্ধ একজন শিশু সাহিত্যিক হিসেবেও। এত সমস্ত পরিচয় ছাপিয়ে সাহিত্যমোদীদের কাছে তিনি পরিচিত কবি গুলজার হিসেবে। তাঁর নিজের কাছেও কবিতা প্রাধান্য পায় বার বার। গুলজারের কবিতার জগত জুড়ে আছে ইতিহাস, শিল্প-অভিজ্ঞতা, স্গংীত, সম্পর্কের গল্প, স্মৃতিময়তা, জীবন-জিজ্ঞাসা আর অধ্যাত্মবাদ। কবিতার বুনন ও বিস্তারে পাঠকেরা তাঁকে সহজ করে পায়, পায় একান্তের করে। তাঁর কবিতায় স্মৃতি গন্ধমেদুর, স্মৃতি বিষন্ন আলো। আজলায় ভরে জীবনের অনিমেষ মুহূর্তগুলি তিনি তুলে দিচ্ছেন তাঁর কবিতায়।
শের ও শায়রী প্রতি তাঁর প্রগাঢ় ভালোবাসা স্কুলে থাকতেই। শিশু অবস্থায় মাকে হারিয়েছিলেন কবি। গুলজার সাহেবের মা সুজান কউর পিতা সরদার মাখন সিং কালরার দ্বিতীয় স্ত্রী ছিলেন। প্রথম স্ত্রীর ঘরে তিন সন্তান ছিল সরদারজীর। গুলজার সাহেব ওনার মায়ের একমাত্র সন্তান। গুলজার সাহেবের জন্মের কিছুদিন পরেই সুজান কউর মর্ত্যের মায়া ত্যাগ করেন। পিতা আরো একটি বিবাহ করলেন। গুলজার সাহেব পেলেন আরো পাঁচ ভাইবোন। বেড়ে উঠতে থাকেন বৈমাত্রেয় ভাই-বোনের সাথে। স্বভাবতই মায়ের কোনো স্মৃতি গুলজার সাহেবের নেই। তবে একটি ঘটনা তাঁকে স্মৃতিগ্রস্ত করে রেখেছে আজও। কোনো এক আত্মীয়া তাকে কোলে নিয়ে দীনা বাজারে এক মহিলাকে দেখিয়ে বলেছিলেন, ‘দেখ, তোর মা দেখতে এমন ছিল।’ ঐ মহিলার একটা দাঁত সোনায় বাঁধানো ছিল। তিনি হাসলে সোনার দাঁতটা দেখা যেত। বেশ পরে গুলজার সাহেব তাঁর বড় বোনকে জিগ্যেস করেছিলেন যে তার মায়ের কোনো দাঁত সোনায় বাঁধানো ছিল কিনা। বোন বলেছিলেন, না। কিন্তু এখনো তিনি ভেবে নেন তাঁর মায়ের হাসিমুখ যেখানে একটি সোনায় বাঁধানো দাঁত ঝিকিয়ে উঠছে। এই ভেবে নেয়ায় আবর্তিত তাঁর জীবন। এই ভ্রমের বাসনায় যোগ হয়ে যায় কাক্সিক্ষত বা অনাকাক্সিক্ষত সমূহ অভিঘাত। সবটা মিলিয়ে এই স্মৃতিগ্রস্ত নিমগ্ন জীবনে বন্দি গুলজার হয়ে ওঠেন কবি--
অনেক খাঁচার বন্দি আমি
অনেক খাাঁচার বাসিন্দা
খাঁচায় থাকতে ভালো লাগে
আর নিজের মর্জিমত খাঁচা বেছে নেয়াটাও
সম্পর্কের মেয়াদ নির্ধারণ করি না আমি
বন্দিত্ব খুঁজে ফিরি
বন্দিত্ব ভালো লাগে
কিশোর বয়সে পরিবর্তিত রাজনৈতিক সামাজিক পরিস্থিতিতে পরিবারের অবস্থানগত কারণে দোকানে কাজ নিয়েছিলেন গুলজার অনেকটা বাধ্য হয়েই। দোকানে রাতে থাকতে গিয়েই পাড়ার লাইব্রেরির বইগুলোর সাথে সখ্য গুলজার সাহেবের। সেই সময়ে কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের কবিতার সংকলন ‘দ্য গার্ডেনার’-এর উর্দু সংস্করণ পড়ে পালটে যায় তার জীবনবোধ। প্রথম যে কবিতাটি পড়েছিলেন সেটি হলো ‘মালী’। তার আগে পঠিত রহস্য-রোমাঞ্চ বইগুলোর চমক ফিকে হয়ে গেল এই আলোকিত কবিতার আভায়। পড়তে চাইলেন এই কবির ভাষায় রচিত কবিতা। শিখলেন বাংলা। পরিচিত হলেন শরৎচন্দ্র, মুনশী প্রেমচাঁদের লেখার সাথে। কবিতার প্রতি সাহিত্যের প্রতি এই দুর্বার প্রেম তাঁকে পরিণত করেছিল ঈর্ষণীয় পাঠকে। দিল্লীতে স্কুল শেষ করলেন গুলজার। তাঁর বাবা বড় ভাইয়ের কাছে বম্বেতে তাকে পাঠানোর সিদ্ধান্ত নিয়েছেন আগেই। সম্পূরণ সিং কালরার জীবনের মোড় পালটে দেয় এই সিদ্ধান্ত। বম্বেতে যদিও তিনি বড় ভাইয়ের তত্ত্বাবধানে ছিলেন, কোথাও যেন বুঝে গেলেন তিনি কাক্সিক্ষত নন। বিশাল পরিবারের কোথাও না কোথাও ঠেলেঠুলে মানিয়ে নিতে হয় তাকে। এই সময়ে নানান পেশায় তিনি জীবনের নানান রূপ দেখেছেন। প্রাতিষ্ঠানিক পড়ালেখাকে বিদায় জানিয়ে গড়ে নিতে চাইলেন নিজের স্বাধীন ও একাকী জীবন। বড় ভাইয়ের ডেরার পাট চুকিয়ে থাকতে শুরু করলেন মোটর গ্যারাজে যেখানে তিনি কাজ জুটিয়ে নিয়েছিলেন দূর্ঘটনা কবলিত গাড়ি রঙ করার। রঙের কাজ করতে ভালোবাসতেন গুলজার। নিবিড় মনোযোগে, দক্ষতায় রঙ নিয়ে খেলেছেন বেরঙিন গাড়িগুলোকে রঙিন করে দিতে। কখনো একআনার ভাড়ায় ট্রামে করে ঘুরে বেড়াতেন পুরো শহর। রাতে ফিরে আসতেন তাঁর সাহিত্যের জগতে, শিল্পের জগতে। এই স্বাধীন সময় কবিকে যুক্ত করে ইন্ডিয়ান পিপল’স থিয়েটার এসোসিয়েশন (আইপিটিএ), প্রোগ্রেসিভ রাইটা’র্স এসোসিয়েশন (পিডব্লিউএ) এবং পাঞ্জাবী সাহিত্য সভা-এর সাথে। এ সকল এ্যসোসিয়েশনে সরদার জাফরী, কৃষণ চন্দর, কাঈফী আজমী, সাহির লুধিয়ানভী, ফয়েজ আহমেদ ফয়েজ, গুরওয়েল সিং পান্নু, সুখবীর, রাজিন্দর সিং বেদী এবং বলরাজ সাহানীর মত কবি, লেখক, অভিনেতা ও শিল্পীদের সাথে যোগাযোগ ও বন্ধুত্ব হয় তাঁর। এই সময়ের সম্পর্কগুলোই পরবর্তীতে তাঁর জীবনে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রেখেছে। মাতৃহীন এবং পরিবারের ‘অকর্মণ্য’ তরুণটি ততদিনে সম্পূরণ সিং কালরা থেকে হয়ে গেছেন গুলজার যে নামে তিনি পেতে চেয়েছেন তার কবি পরিচিতি, লেখক পরিচিতি। প্রথমে তিনি হলেন গীতিকার গুলজার। বন্ধু দেবু সেন পরিচয় করিয়ে দিলেন বিখ্যাত চলচ্চিত্র নির্মাতা বিমল রায়ের সঙ্গে। তাঁর সংস্পর্শে এলেন গুলজার এবং তাঁর সহকারী হিসেবে কাজ শুরু করলেন ১৯৬০ সালে। গ্যারাজ জীবনের অবসান ঘটল এবার। চলচ্চিত্রের জন্যে লেখা শুরু করলেন গান। বিমল রায়ের ‘বন্দিনী’ ছবির জন্য লিখলেন প্রথম গান ‘মোরা গোরা অ্যঙ্গ লেই লে’। ঐ সময়ে তিনি চিত্রনাট্য রচয়িতা ও গীতিকার হিসেবে কাজ করেছেন হৃষিকেশ মুখোপাধ্যায়, হেমন্ত কুমার মুখোপাধ্যায় প্রমুখ বিখ্যাত বাঙালীর সাথে। আরো ঘনিষ্ট যোগাযোগ তৈরি হয়েছে বাংলা সাহিত্য ও সংস্কৃতির সঙ্গে। বিমল রায়ের কল্যাণেই শুরু হয় গুলজার সাহেবের জীবনের নতুন অধ্যায়। আর তারপর থেকেই যা যা ঘটে চলল সে সম্বন্ধে চোখ বুঁজে বলা যায়, বাকিটা ইতিহাস। আজও তিনি গভীর কৃতজ্ঞতায় স্মরণ করেন তাঁর গুরু বিখ্যাত চলচ্চিত্র নির্মাতা বিমল রায়কে।
নিজ পরিবারের কাছ থেকে, যদি বলতে হয় তো, গুলজার কেবল নিগ্রহ পেয়েছেন। একটি নমুনা দিচ্ছি এখানে- পিতার মৃত্যুসংবাদ তিনি জেনেছেন প্রতিবেশীর কাছ থেকে তিন দিন পরে। এই সংবাদটি পরিবারের কোনো সদস্যই তাঁকে জানানোর প্রয়োজন অনুভব করেন নি। পরিবারের সেই সময়ের ‘অকর্মণ্য’ ‘অগুরুত্বপূর্ণ’ ছেলেটি আজ গোটা দেশ ও জাতি ছাড়িয়ে ভালোবাসা পেয়ে যাচ্ছেন পৃথিবী জুড়ে আরো অসংখ্য মানুষের। আগেই বলেছি, গুলজার সাহেবের জীবনে খুব গুরুত্বপূর্ণ মানুষদের তালিকায় আছেন তাঁর বন্ধু-বান্ধব, তাঁর গুরু চলচ্চিত্র পরিচালক বিমল রায়, প্রখ্যাত সঙ্গীত নির্দেশক ও শিল্পী শচীন দেব বর্মণ, হেমন্ত মুখোপাধ্যায়, রাহুল দেব বর্মণ, চলচ্চিত্র পরিচালক হৃষিকেশ মুখোপাধ্যায়, অভিনেতা সঞ্জীব কুমার এবং আরো অনেকে। তাঁর জীবনে বিশেষত তাঁর সৃজনশীল সত্ত্বার বিকাশের ক্ষেত্রে এরা ছাড়াও গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রেখেছেন আরো অনেকে। প্রথমত, তাঁর মা সুজান কউর, যিনি শিশু গুলজারকে জন্মদানের কিছুদিন পর মর্ত্যরে মায়া ত্যাগ করেন। যার চেহারা গুলজার মনে করতে পারেন না। কেবল শৈশবে দেখা একজন নারীর সোনায় বাঁধানো ঝিকিয়ে ওঠা একটি দাঁতের ভ্রম বহন করে নিয়ে চলেন বাকি জীবন। তাই যেন মহান শিল্পী মিকেল্যাঞ্জেলোর ‘দ্য পিয়েতা’ চিরকালের মনোসঙ্গী গুলজারের। মায়ের মুখ মনে না পড়ার বেদনা গুলজারকে আরো শূন্যতর বোধের পথে নিয়ে যায় কখনো কখনো। ‘দ্য পিয়েতা’য় মা মেরীর কোলে শিশুর মত শুয়ে থাকা ওই পূর্ণবয়স্ক যীশু যেন গুলজারের মনের প্রতিচ্ছবি। শিশুকাল থেকে মাতৃমমতা বঞ্চিত গুলজার যে শূন্যতার সাথে পরিচিত হন তা যেন শিল্পীজীবনের চন্দ্রগ্রস্ত জীবনের অবধারিত সঙ্গী।
উল্লেখ করতে পারি হিন্দি সিনেমা জগতের ট্র্যাজেডি কুইনখ্যাত অভিনয়শিল্পী মীনা কুমারীর কথা। গুলজার সাহেবের প্রথম বই যেটি ছিল গল্পের, ‘চৌরাস রাত’, উৎসর্গ করেন বন্ধু মীনা কুমারীকে। অনেকের কাছে এটা অজানা তথ্য যে, মীনা কুমারী কবিতার অত্যন্ত অনুরাগী ছিলেন এবং তিনি নিজেও ছিলেন একজন কবি। তাদের বন্ধুত্বের সূত্র মূলত কবিতা। মীনা কুমারী মৃত্যুর আগে তাঁর কবিতার খাতা উইল করে যান বন্ধু গুলজারের নামে। গুলজার সাহেব পরিচালিত প্রথম ছবি ‘মেরে আপনে’ তে মীনা কুমারী অভিনয় করেছেন কেন্দ্রীয় চরিত্রে। গুলজারের জীবনীকার মেঘনা গুলজার লিখেছেন যে, মীনা কুমারী যখন অসুস্থ হয়ে পড়েন এবং রোযা রাখতে অপারগ, তখন গুলজার সাহেব বলেছিলেন তাঁকে দুঃশ্চিন্তা না করতে কারণ গুলজার বন্ধু মীনা কুমারীর হয়ে রোযা রাখবেন বলে প্রতিশ্রুতি দেন। মেঘনা স্মৃতিচারণ করছেন যে, যতদিন না গুলজার সাহেবকে নিয়মিত ঔষধ সেবনের অবস্থায় যেতে হয়েছিল, ততদিন রোযার মাসে গুলজার সাহেব ৩০টি রোযা রাখতেন এবং সন্ধ্যায় ইফতার করতেন খেজুর দিয়ে। এমন অসামান্য বন্ধুত্ব দৃষ্টান্ত হয়ে আছে জগতের কাছে।
রাখী গুলজার অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ একজন ব্যক্তি গুলজার সাহেবের জীবনে, সেটা নিঃসন্দেহে বলা যায়। গুলজার সাহেব তাঁর ‘রাভি পার এন্ড আদার স্টোরিজ’ গল্পগ্রন্থটি রাখী জীকে উৎসর্গ করেন। উৎসর্গপত্রে লেখেন- ফর রাখী, দ্য লংগেস্ট শর্ট স্টোরি অফ মাই লাইফ! মেঘনা জীবনীতে বলছেন, তারা (গুলজার ও রাখী) কখনোই বুঝতে দেন নি তারা আলাদা থাকেন। মেঘনা জানতেন তার দুটো বাড়ি। একসঙ্গে না থাকলেও তাদের মধ্যে যে পারস্পরিক শ্রদ্ধাবোধ এবং সর্ম্পকের সহজতা রয়েছে তার উল্লেখ করে মেঘনা গুলজার পিতার জীবনীতে লেখেন, দে স্টিল লাফ টুগেদার।
গুলজার সাহেবের জীবনে তাঁর একমাত্র কন্যা মেঘনা গুলজার, আদরের বোস্কি ভালোবাসার কেন্দ্র অধিকার করে আছে। নানান সাক্ষাৎকারে গুলজার বলছেন, “শি ইজ কোর অফ মাই লাইফ”। বোস্কি বড় হয়েছেন গুলজার সাহেবের কাছে। শিশুদের লালন-পালনের ক্ষেত্রে গুলজার সাহেবের নিজস্ব ব্যাখ্যা এরকম- মা-বাবারা প্রায়শই এটা ভেবে ভুল করেন যে, তারা বড়। তারা শিশুদের চেয়ে সব বিষয়ে অভিজ্ঞ বেশি। তারা এটা ভেবে দেখে না যে, একজন মানুষ হিসেবে তারা বড় হলেও বাবা-মা হিসেবে তারা ওই শিশুটির বয়সই। একজন শিশুর জন্ম নেয়ার মধ্য দিয়েই মা-বাবারও জন্ম হয়। কাজেই দুজনেই সমান বয়সী। একে অপরের কাছ থেকে শিখে শিখে নিজেদের লালন-পালন করতে পারাটাই প্রকৃত বিকাশ। মেঘনা বলছেন যে, বোস্কির ১৩ বছর বয়স পর্যন্ত প্রতিটি জন্মদিনে গুলজার সাহেব একটি করে বই প্রকাশ করতেন। প্রকাশিত সেই বইগুলো বোস্কির বন্ধু, সহপাঠীদেরকে উপহার দেয়া হতো। এমন অভূতপূর্ব ভাবনার মানুষ বলেই পিতা-কন্যার অনন্য সম্পর্ক দুজনকেই করেছে একে অপরের পরম বন্ধু পরম আশ্রয়। পিতার পদাঙ্ক অনুসরণ করে কন্যা মেঘনা গুলজার হয়েছেন চলচ্চিত্র পরিচালক এবং লেখক।
এসবের ভেতর দিয়েই সমগ্র জীবনে গুলজার হয়ে উঠেছেন একজন সৃজনশীল সংবেদনশীল মানুষ। একজন কবি- সাহিত্যিক। লেখার জন্যে তিনি শেষমেশ ছবি পরিচালনাকেও বিদায় জানিয়েছেন। কবিজীবনের দীর্ঘ সাধনায় গুলজার সাহিত্যে রেখেছেন অনন্য অবদান যার স্বীকৃতিস্বরূপ ২০০২এ পেয়েছেন সাহিত্য একাডেমি পুরস্কার। ২০০৪এ সম্মানিত হয়েছেন পদ্মভূষণ পুরস্কারে। ২০০৮এ মৌলিক গানের জন্য জিতেছেন একাডেমি এ্যওয়ার্ড । ২০১৩এ সম্মানিত হয়েছেন দাদা সাহেব ফালকে পুরস্কারে। ২০১৩এর এপ্রিলে আসাম ইউনিভার্সিটির চ্যান্সেলর নিযুক্ত হন তিনি। গুলজার’র জীবনে রবীন্দ্রনাথের প্রভাব নিঃসন্দেহে গভীর। রবীন্দ্রনাথের যে বইটি পড়ে পালটে গিয়েছিল গুলজার’র দৃষ্টিভঙ্গী সেই গার্ডেনারের হিন্দী অনুবাদ সম্পন্ন করেছেন তিনি ২০১৬-তে। বাগবান বলে এই সংকলনটির প্রথম কপি ভারতের তৎকালীন রাষ্ট্রপতি প্রণব মুখার্জীর হাতে তুলে দিয়ে গুলজার বলেছিলেন যে, তাঁর ইচ্ছে, সকল স্কুলে যেন রবীন্দ্রনাথের রচনা পাঠ্য করা হয়। কেননা রবীন্দ্রনাথের রচনায় নিজস্ব সভ্যতা ও সংস্কৃতি রয়েছে। তিনি চান শিশুরা এর সংস্পর্শে বেড়ে উঠুক। গুলজারের ভাষায় গুরু একজনই, টেগোর। দীর্ঘদিন ধরে তিনি ডুবে আছেন রবীন্দ্রনাথের শিল্পভুবনে। ভালোবেসে চলেছেন অনুবাদ করে চলেছেন। তবে কেবল রবীন্দ্রনাথের কবিতার অনুবাদ করছেন গুলজার, তা নয়। গত ১০ বছরের বেশি সময় ধরে তিনি ভারতের ৩২টি ভাষার ৩০০ জন সমসাময়িক কবির ৫০০ কবিতা অনুবাদ করেছেন। তিনি বলছেন, “নো মাস্টারস, জাস্ট কন্টেম্পরারি পোয়েটস। আই ওয়ান্ট টু মেক আওয়ার পোয়েট্রি ইয়াং এগেইন” । ২০১৬-তে গুলজার স্বল্প সময়ের জন্য বাংলাদেশে ঘুরে যান। তিনি বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের ওপর নাটক লেখার এবং বাংলাদেশের জাতীয় কবি নজরুল ইসলামের কাজের অনুবাদ করার ইচ্ছা পোষণ করেন। এই চিরযুবা কবি ও মহান শিল্পীকে আমাদের ভালোবাসা ও প্রণতি জানাই।
রাত প্যশমীনে কী
........
একই সাথে উর্দু এবং হিন্দী ভাষায় গুলজার রচনা করে চলেছেন কবিতা ও ছোটগল্প। ‘রাত প্যশমীনে কী’ কবিতার বইটি তেমনই একটি বই যেটি একই সাথে প্রকাশিত হয়েছে দুই ভাষাতেই। তিনটি পর্বে গুলজার সাহেবকে পাই এই বইটিতে। প্রথমটি ন্যজম- কবিতা; দ্বিতীয়টি গ্যজল আর তৃতীয়টি ত্রিবেণী। ন্যজম মুক্ত ছন্দেও হতে পারে, ছন্দবদ্ধও হতে পারে। গুলজার সাহেবের ন্যজমগুলোকে মুক্ত ছন্দে পেয়েছি এই বইটিতে। ন্যজমের বৈশিষ্ট্য হল, একটি বিষয়ে কবিতাটি লেখা হবে এবং যার একটি শিরোনাম থাকবে । উর্দু সাহিত্যের ইতিহাসে ন্যজম তুলনামূলক ভাবে নতুন একটি ফর্ম। ঔপনিবেশিক শাসনামলে উর্দুকবি নাজির আকবরাবাদীর হাত ধরে ন্যজম’র জন্ম হয়। সেটার আনুমানিক সময় ১৭৫০ /১৭৬০ সাল। ন্যজমের ধরনটি বোঝাতে গেলে উর্দু কবিতার খানিকটা বৈশিষ্ট্য আগে জানা দরকার। উর্দু কবিতার নানা ফর্মের ভেতর যেমন ক্বসীদা, হামদ, না’ত, মসনভী, মার্সিয়া, রুবাই, তাজকীরা, ন্যজম এবং অন্যান্য- গ্যজল একটি জনপ্রিয় ফর্ম। গ্যজলকে বলা হয় উর্দু কবিতার প্রাচীন এবং কঠিন ফর্মগুলোর একটি। একজন উর্দু কবি স্বীকৃতি তখনই পাবেন যখন তিনি গ্যজল লেখায় সিদ্ধহস্ত হবেন। উর্দু কবিতা মূলত শ্রুতি ও বাক নির্ভর। গ্যজলেও এর ব্যতয় ঘটে না। একে যতটা লিখিত ততটাই শ্রুতি বা পাঠযোগ্য হয়ে উঠতে হয়। গ্যজলের ক্ষেত্রে দুটি পঙক্তিতে একটি বিষয় সম্পন্ন হয়। বলা যায় অনেকগুলো ‘শের’ এর সমন্বয় গ্যজল। একটি গ্যজলের ভেতর নানা বিষয় লিপিবদ্ধ হতে পারে। তবে বিষয়বস্তুর ক্ষেত্রে এটি মূলত প্রেমের কবিতা। প্রেম- যা মানবের সাথে মানবের, মানবের সাথে পরমের কিংবা জীব-প্রেম। চরিত্রের ক্ষেত্রে প্রেমাষ্পদ উচ্চাসনে আসীন, প্রেক্ষাপট শহুরে। ন্যজমের ধরন ও বিষয়বস্তু গ্যজল বা প্রশস্তি বন্দনার উর্দু কাব্যের ভেতর নতুন বাঁক এনে দিল। ন্যজমে বিষয় হিসেবে উঠে আসল গ্রামীণ জীবন, সাধারণ মানুষ এবং তাদের দৈনন্দিন কর্মকা- ও অনুভূতির সুচিত্রিত ছবি। সময়ের সাথে ধীরে ধীরে আরো বিস্তৃত হলো ন্যজমের বিষয়বস্তু ও ধরন। বলা যায় উর্দু কবিতায় গ্যজল এবং অন্যান্য ফর্মের ভেতর ন্যজম এখন জনপ্রিয় একটি ধরন। এবার আসি ত্রিবেণীর কথায়। ত্রিবেণীরও নির্দিষ্ট ফর্ম আছে। ত্রিবেণী গুলজারের আবিষ্কার। যেমনটি হয়ে থাকে ত্রিবেণী- প্রথম ও দ্বিতীয় পংক্তি দুটো যে কোন একটি ভাবকে সম্পন্ন করে। আর তৃতীয় পংক্তিটি ভাবের সাথে যোগ করে বাড়তি মাত্রা। বলা বাহুল্য যে অনুবাদ শুরু করবার সময় এসকল তথ্য আমার জানা ছিল না। উল্লেখ করা আবশ্যক যে, কাজটায় বেশ কিছুদূর এগোনোর পরে উর্দু কবিতার ধরন নিয়ে এসকল বিষয়ে তথ্য দিয়ে আমাকে সাহায্য করলেন উর্দু ভাষা ও সাহিত্যের গবেষক ও অনুবাদক জাভেদ হুসেন।
যাই হোক, আমার হোঁচট খাওয়া হিন্দী নিয়ে দ্বারস্থ হলাম গুলজারের ন্যজম-এর। তখনো বুঝি নি কী বিপদে পড়তে যাচ্ছি। যতই দিন এগিয়েছে ততই ভুল বুঝতে পারছিলাম। মাঝে এমন হতাশ হয়েছি, কুঁকড়ে গেছি তা বলবার নয়। কী যে আমাকে টেনে আনলো আবার কবিতার কাছে, জানি না। হোঁচট খেতে খেতে এগুনোর দিন কোনোমতে পার করে গুনে দেখলাম ৮০টি ন্যজমের আশেপাশে ঘুরঘুর করছে আমার এই অল্পশিক্ষা। এই কবিতাগুলোয় আমি কবির জগৎ ঘুরেছি। যা তথ্য হিসেবে জীবনী থেকে জেনেছি তার সাথে কিছুই মেলাতে হয় নি। ছায়াছবির মতন দৃশ্যগুলো একে একে ভেসে উঠছিল মানসপটে। যে সুরভিত আলোর খোঁজে তিনি চলেছেন তার সুঘ্রাণ পেলাম যেন। যে নৈঃসঙ্গের শব্দ উচ্চারণ করেছেন তার ঝিঁঝিডাক শুনতে পেলাম আমার শ্রবণে। যা বলছি, অনুভব করছি তারও সহ¯্রগুণ বেশি।
বিষয় বৈচিত্র্যে “রাত প্যশমীনে কী”র ন্যজম অংশটি ভরপুর একথা বলা যায়। বইটিতে ১২১টি ন্যজম, ১১টি গ্যজল এবং ঊনসত্তরটি ত্রিবেণী গ্রন্থিত আছে। আমি বেছে নিয়েছি ন্যজম অংশ থেকে আমার পছন্দের কিছু কবিতা। বিশ্বব্রহ্মা-, সৃষ্টিরহস্য আর সৃষ্টিকর্তার স্বরূপ নিয়ে আধ্যাত্মিক জিজ্ঞাসা, তর্ক; ১৯৪৭ এর দেশভাগ, দাঙ্গার ইতিহাস, ব্যথাতুর স্মৃতি; প্রকৃতির সাথে মানুষের সম্পর্ক, অনুভবের কথকতা; মানব-মানবীর প্রেম, পারস্পরিক সম্পর্ক, বিচ্ছেদ বেদনা; একজন কবির জীবন দর্শন, তার সৃষ্টিশীল সত্তার দ্বন্দ্ব-দ্বৈততা, বন্ধুদের উৎসর্গগাথা-- এসব কিছু নিয়ে সাজানো “রাত প্যশমীনে কী”র ন্যজম অংশটি। কবিতা পাঠের নাম করে কবির পায়ে পায়ে ঘুরেছি যেন কোন ‘সুরভিত আলো’র সন্ধানে। গুলজারের কবিতায় যে ঔদাসীন্য, একাকীত্ব আর ভাষা ব্যবহারে সংযমের ছান্দসিক বয়ান, তা যেন স্থবিরতা, নিঃশেষ হবার কথা বলে না, বরং তা নিয়তই সঞ্চরণশীল, কোন এক অরূপের সন্ধানে পরিব্যপ্ত যার অস্তিত্ব সুরভিত, আলোময়।
কবিতার গুলজার
....
নিজের মধ্যে যখন প্রবেশ করলাম তখন খুদার কাছে পৌঁছলাম
তখন টের পেলাম আমিও কত দূরে ছিলাম।।
মীর তকী মীর
কবিতার ভূত চেপেছিল সেই শৈশবেই। স্কুলে যখন বেইতবাজি হতো (শের কিংবা কবিতা মুখস্ত রাখার প্রতিযোগিতা), সেখান থেকেই কবিতাকে আত্মস্থ করবার বিষয়টি মজ্জাগত হয় গুলজারের। তাঁর জীবনীকার মেঘনা গুলজার বলছেন যে, কখনো কখনো গুলজার চিট করতেন খেলায়। প্রয়োজনে বর্ণ অনুযায়ী শব্দ বানিয়ে জুড়ে দিতেন মূল কবিতার সাথে। যেমন ধরা যাক মূল কবিতাটি শুরু ‘জিন্দেগী’ শব্দটি দিয়ে। উনি খেলায় প্রয়োজন অনুসারে ‘ইয়ে জিন্দেগী’ বলে শুরু করলেন। মেঘনা বলছেন, সম্ভবত এটাই তাঁর ভেতরের কবিসত্তার শুরুর দিক ছিল।
গুলজারের ন্যজমের বৈশিষ্ট্য প্রথমত তাঁর পঙক্তি নির্মাণের সারল্যে, দ্বিতীয়ত কবিতার বিষয়বৈচিত্র্যে এবং তৃতীয়ত বিষয় নির্বাচনে । তাঁর কবিতাকে বলা যায় নিরলংকার এবং ঊনরঞ্জন রূপরেখায় চিত্রিত। বাহুল্যের কোনো চিহ্নমাত্র পাই না আমরা। কবিতার বিষয় তার নিহিত ভাবের সাথে মিলে সরল-সৌন্দর্যে স্বরূপে হাজির হয় পাঠকের সামনে। গুলজারের কবিতায় বিষাদ যেন সেই আবরণ যা মহিমান্বিত করে আপাত দৃষ্টে মনে হওয়া সামান্য অনুভূতিকে। ঠিক তেমনি শেষাংশে প্রশ্ন উত্থাপন কিংবা অনুভূতিজাত একটি সাধারণ কথা কবিতাটিকে দেয় অসাধারণের ব্যঞ্জনা। তাঁর কবিতায় দ্বিধা-দ্বন্দ্বের জটিল সমীকরণ নেই, আছে সংশয়োত্তীর্ণ বেদনার প্রলেপ, কোমল জিজ্ঞাসা। যেন বিষাদগ্রস্ত আলোচারী পাখি- ফেলে যায় তার অনিবার্য ছায়া, আশ্বাস। কবি গুলজারের এ অনুসন্ধান যেন কেবল অসীমের দিকে নয়, অস্তিত্বের দিকে- সে নিজ বা অপর বা নিজের মাঝে অচেনা হয়ে থাকা আর কেউ।
রাত প্যশমীনে কী বইটিতে যে ন্যজমগুলো গ্রন্থিত আছে সেগুলো বিষয় বৈচিত্র্য অনুসারে কিছু কথা আমার ভাবনায় এসেছে। সেখান থেকে খানিকটা বলবার দুঃসাহস সম্ভবত দেখানো যায়। বিশ্বব্রহ্মা-ের অস্তিত্ব রহস্য নিয়ে বিস্তর জিজ্ঞাসা রয়েছে গুলজার সাহেবের রচনায়। তাঁর কবিতায় ঘুরে ঘুরে আসা নৈঃসঙ্গ্যের নিভৃতবাস এসকল মোলায়েম জিজ্ঞাসাকে নিয়ে যায় দার্শনিক অভিজ্ঞতার দিকে। আবার, ধর্মের প্রচলিত রীতি-রেওয়াজ নিয়ে নানা প্রশ্ন আমরা পাই গুলজারের বেশ কিছু কবিতায়। তাঁর জিজ্ঞাসার ধরন কখনো তীব্র প্রতিক্রিয়াশীলতাকে উপস্থাপন করে না। ব্যক্তিজীবনে তিনি যেমন নমনীয় এবং একই সঙ্গে দৃঢ়, কবিতায় তাঁর প্রকাশভঙ্গীটিও তেমনি। কখনো বন্ধুর মত, নিকট প্রতিবেশীর মত আলাপচারিতায় বিষয়টিকে উন্মুক্ত করেন। কখনো জনমানুষের পক্ষ নিয়ে কিংবা ভুক্তভোগীর অভিজ্ঞতা থেকে অনুযোগ করেন। এই অনুযোগ যার কাছে তিনি কখনো পরম সত্তা, কখনো জীবন, কখনো তিনি নিজে।
আমরা জেনেছি, দেশভাগ নামক প্রলয়ের আঘাতে তাঁর পরিবারকে স্থানান্তরিত হয়ে চলে আসতে হয় দিল্লীর রওশন আরা বাগে। জীবনীকার মেঘনা গুলজার বলছেন যে, দাঙ্গার ভয়াবহতা যখন সকল ভ্রাতৃত্ববোধ সৌহার্দ্যকে টলিয়ে দিয়েছিল, যখন মানুষের ধর্মান্ধতা তাকে রক্ত-পিপাসু করে তুলেছিল তখন গুলজার সাহেবের পরিবারের সকল সদস্য ছিলেন প্রবল ভাবে স্থির এবং মানবিক। এর একটাই কারণ ছিল, গুলজার সাহেবের পিতা সরদার মাখন সিং কালরার বিচক্ষণতা, মানবিকতা। ওই সময়ে তাদের অনেক মুসলিম বন্ধু, প্রতিবেশী একে অপরকে সামলেছেন, আশ্রয় দিয়েছেন। মেঘনা জীবনীতে উল্লেখ করছেন, ওই সময়ে গুলজার সাহেবের পিতা ছেলেমেয়েদের বলতেন, “প্রলয় আ গ্যয়ি হ্যায় ... নিক্যল যায়েগি”। বলছেন, ওই সময়ের নৃশংসতা ভয়াবহতা গুলজার সাহেবের মনে এমন প্রভাব ফেলেছিল যে এর অনেক বছর পরও রাতে দুঃস্বপ্ন দেখে জেগে উঠতেন তিনি। ওই সকল দুঃসহ স্মৃতিকে কবিতায় তুলে এনেছেন তিনি আরো পরে। দেশভাগের বেদনা, নিজের জন্মভূমি থেকে উচ্ছেদ হওয়ার হাহাকার তাড়িত করেছে কবি গুলজারকে। তবে কখনো ফিরে যেতে চান নি, দেখতে যেতে চান নি তাঁর জন্মভূমিকে। একবার একজন দীনায় তাদের বাড়ির ছবি তুলে পাঠিয়ে লিখেছিলেন, তাদের বাড়ির দরজা এখনো তেমনি দাঁড়িয়ে আছে। গুলজার তাঁর কন্যাকে বলেছিলেন, তাদের বাড়ির দরজা মোটেও এত ছোট ছিল না। তাঁর শৈশবের দেখায় ওটার বিশালতাকে ধারণ করে আছেন স্মৃতিতে। মেঘনা বলছেন, সেটাই তিনি চান। ডুবে থাকতে চান শৈশবের বিস্ময়ে বিশালতায় দেখা তার বাড়ির দরজার স্মৃতিময় খাঁচায়। এই স্মৃতিগ্রস্ত জীবনে কাক্সিক্ষত বা অনাকাক্সিক্ষত সমূহ অভিঘাতে তিনি হয়ে ওঠেন কবিতার গুলজার।
সমসাময়িক অরাজকতা, বৈষম্য, অনাচার, ব্যক্তি মানুষের অনুদারতা কবি গুলজারের মানবিক, সামাজিক সত্তাকে আলোড়িত করে প্রবল ভাবে। তিনি তাঁর প্রকাশ ঘটান তাঁর স্বভাবসিদ্ধ কোমলতায়, স্থৈর্য্যে। জীবনের আপাত দৃষ্টে সামান্য মনে হওয়া ঘটনা বা অনুষঙ্গের ভেতর দিয়ে তিনি জীবনের মৌলিক দার্শনিক প্রশ্নের মুখোমুখি করান পাঠককে। কখনো হয়তো নিজেকেও।
কবি ও কবিতাকে দিন শেষে ফিরতে হয় নীরবতায়, নৈঃসঙ্গ্যে, ধ্যানে। কবি গুলজারের সৃজনশীল সত্তার সাথে তার জিজ্ঞাসা আর মধুর দ্বন্দ্বের খুনসুটিগুলো কিছু কবিতায় পেয়ে যাই। পেয়ে যাই প্রেম-বিচ্ছেদের চিরায়ত সঙ্গীত ভিন্ন বাণীতে-সুরে। বলা হয় গুলজার ঠিক শব্দটি খুঁজে পেতে তাঁর অনুসন্ধান জারি রাখেন।
মৃত্যু বিষয়ে গুলজার তাঁর কবিতায় থাকতে চেয়েছেন নির্বিকার অথচ সহিষ্ণু বৃক্ষের মত মহান। জীবনে এত রকমের মৃত্যু, এত বিচ্ছেদ দেখেছেন, পরম বন্ধুদের কিংবা পরম আদরের দিনটিকে কাফনে জড়িয়েছেন, কবরে শুইয়েছেন যে সে বেদনাকে অস্তমিত সূর্যের কোমলতায় অপূর্ব চিত্রালঙ্কারে প্রকাশ করেছে�