করোনাকাল
বিচ্ছিন্ন অনুভব
মাহফুজা হিলালী

প্রবন্ধ
অধ্যাপক আনিসুজ্জামান
শামসুজ্জামান খান

গল্প
ডায়মন্ড লেডি ও পাথর মানব
হামিদ কায়সার

গদ্য
নিদ্রা হরণ করেছিল যে বই
মিনার মনসুর

নিবন্ধ
পঞ্চকবির আসর
সায়কা শর্মিন

বিশ্বসাহিত্য
আইজাক আসিমভের সায়েন্স ফিকশন
অনুবাদ: সোহরাব সুমন

বিশেষ রচনা
প্রথম মহাকাব্যনায়ক গিলগামেশ
কামাল রাহমান

শ্রদ্ধাঞ্জলি
মুজিব জন্মশতবর্ষ
মারুফ রায়হান
 
সাক্ষাৎকার
কথাশিল্পী শওকত আলী

জীবনকথা
রাকীব হাসান

ভ্রমণ
ইম্ফলের দিনরাত্রি
হামিদ কায়সার

ইশতিয়াক আলম
শার্লক হোমস মিউজিয়াম

নিউইর্কের দিনলিপি
আহমাদ মাযহার

শিল্পকলা
রঙের সংগীত, মোমোর মাতিস
ইফতেখারুল ইসলাম

বইমেলার কড়চা
কামরুল হাসান

নাজিম হিকমাতের কবিতা
ভাবানুবাদ: খন্দকার ওমর আনোয়ার

উপন্যাস
আলথুসার
মাসরুর আরেফিন

এবং
কবিতা: করেনাদিনের চরণ

১৭ বর্ষ ০৩ সংখ্যা
অক্টোবর ২০২৪

লেখক-সংবাদ :





পণ্য
মনির বেলাল
পশ্চিমপাড়ের কোমর কামড়ে ধরে আছে চুন-সুড়কির সিঁড়িটি। ওদিকে ছুঁয়েছে পুকুরের তলপেট। পুরো সিঁড়িটির এক টুকরোও ওই পাকা সড়ক থেকে দেখা যায় না। তার দুইপাশের বয়োবৃদ্ধ নারিকেল গাছ দুটি শুধু চোখে পড়ে। সিঁড়ির শেষ ধাপের থেকে সামনে সামান্য একটু জায়গা রেখে সিমেন্টের খুঁটি পোতা। আর ওই খুঁটির সঙ্গে বাধা উজ্জ্বল ফর্সা রঙের চাটাই। চাটাইয়ের নিচ মাথাটা পুকুরের জলের এত কাছে যে- সামান্য বাতাসেও দুজন-দজনকে ছুঁয়ে যায়। ফরাজপুরে বিশেষত মেয়েদের গোসল কিংবা তাদের অন্যান্য কাজের জন্য যতগুলো পুকুরঘাট আছে, তার সবগুলোই এ রকম ঘেরা। চাটাইয়ের এ দুর্গ-আক্রমণের আগে সূর্য-চন্দ্রও কয়েকবার রেকি করে নেয়। বর্তমানে জলের স্পর্শে থাকা সিড়ির শেষ ধাপটির ডানপাশ বেশ খানিকটা ক্ষয়ে গেছে। সুড়কির চামড়া ছেলা সেই অঙ্গটি এখনও দগদগ করছে। মেয়েরা, তাদের ফর্সা পায়ের গোঁড়ালিগুলো ঘষে ঘষে আরও ফর্সা করার চেষ্টা করেছে। তাদের পায়ের গোঁড়ালিগুলো হয়ত কালো দাগমুক্ত হয়েছে, কিন্তু বিনিময়ে ক্ষয়ে গেছে এ ধাপটির শরীর। দগদগে অংশটুকু এড়িয়ে গলা পানিতে নেমে গেল সালেহা। ঝকঝকে আয়নার মতো এ পুুকুরের পানি- দিনে হলে নিশ্চিত মুখ দেখা যেত। তবু ক্ষয়ধরা চাঁদের লুকোচুরি খেলায় একটু একটু দেখা যাচ্ছে। গলা-গা-পা ভালভাবে কসলে ডুব দেয়ার জন্য আরও এক পা সামনে এগিয়ে- সে বুঝতে পারল, তার পায়ের তলায় আর কোন সিঁড়ি নেই। তার পায়ের তলায় এখন শুধুই ঝচঝচে বালু। পানি তার কানের লতি ছুয়েছে কিন্তু এখনও খোঁপা ভিজে যায়নি। সে পেছন ফিরে আবারও সিঁড়ির ওপর উঠে দাঁড়ালো এবং হাতের তালুতে পানি ভরে দুবার মুখে ঝাঁপটা মারল। এক, দুই করে সে জলের সীমানা থেকে বেরিয়ে এল। এখন চাঁদটিও তার মতোন মেঘমুক্ত। এ আলো দেখে বিরক্তির বিষে ভরে যাচ্ছে তার ভেতরটা। তার আড়াল দরকার-ঘুটঘুটে অন্ধকার। রাত দেড়টা পার হয়ে গেছে- এটা সে আন্দাজ করতে পারছে। চুলের খোঁপাটি খুলে দু-তিনবার ঝাড়া দিয়ে নিল। যদিও পুরনো গামছায় খোঁপাটি যথানিয়মেই বাঁধা ছিল। তারপরও মসুরের ধুলো বড়ই বেহায়া। আঠার মতোন লেগে থাকে। আবারও মেঘের আড়ালে ঢাকা পড়েছে চাঁদটি। এ সুযোগে ভেজা কাপড়টি বদলে সে একটা মেকছি পরে নিল। এ সময় কাপড় পরতে বেশি সময় লাগবে। এখন পর্যন্ত সবকিছু ঠিকঠাক- কোন অসুবিধা হয়নি। যতধাপ সে নেমেছিল, তার সবকটি ধাপ ভেঙে আবারও উপরে উঠে এল। সিঁড়ি থেকে মাটিতে পা দিতেই তার কানে এল, আল্লাহু আকবার, আল্লাহু...। এটা তো আব্দুল হাকীমের গলা। সালেহা যেই ডাল মেলে কাজ করে- সে মেলের চারজন শেয়ারদারের একজন। সে এই কয়দিন আগে হজ থেকে এসেছে। তার পায়ের শব্দ শুনে- সালেহা তার দূরুত্বটা মেপে- সে মোতাবেক মাথার উপরে ওড়নাটা টেনে গোমটার আকার দিয়ে নিল। বাড়াতে হলো পায়ের গতিও, অবস্থা বুঝে আব্দুল হাকীমও পরহেজগার মেয়ের মতো অন্যদিকে ঘুরে দাঁড়াল। সালেহা তাকে পার হয়ে গেলে- সে সিঁড়ি বেয়ে নিচের দিকে নামতে শুরু করল। তাহাজ্জত নামাজের সময় হয়েছে। এশার নামাজের পরে ঘুমিয়ে ছিল। অজু করা দরকার, গোসলের প্রয়োজনও হতে পারে।

সরু সরু খেজুরগাছের ছায়ার আড়ালে নিজেকে আড়াল করে পথ হাঁটছে সালেহা। চাঁদকে ভরসা করা কঠিন কখনও কখনও সে হঠাৎ করে জ্বলে উঠছে। টানপায়ে হাঁটলে, পুকুরঘাট থেকে মেলে যেতে মিনিট সাতেক সময় লাগবে। হাকীম হাজি ছাড়া পথে এখন পর্যন্ত আর কারও সঙ্গে দেখা হয়নি। জীর্ণ মাটির রাস্তাটিকে মাড়িয়ে সে পাথর বাঁধানো রাস্তায় উঠে এল। জন্মলগ্ন থেকেই এ রাস্তাটি খুব একটা হৃষ্টপুষ্ট নয়- তার ওপর আবার মসুর অথবা মসুরের ডাল ভর্তি ট্রাকগুলোর অব্যাহত অত্যাচারে তার দুপাশটা একেবারে দেবে গেছে। দুপাশের সারি বাঁধা খেঁজুরগাছগুলো না থাকলে হয়ত এ রাস্তা এতদিনে থাকত না। তবু কোন কোন জায়গায় খেঁজুরগাছসহ নেমে গেছে। মাটিগুলোকে অনেক বছর আগে যেখান থেকে তুলে আনা হয়েছিল সেখানে। দুএকটা পাখির ডাক সালেহার কানে এলেও সে বুঝতে পারছে না- এটা কী পাখি। এত রাতে এ রাস্তায় তার জীবনে কোন দিনই সে যায়নি। এটা সড়কপাড়ার রাস্তা তাই তাকে মায়ের বাড়ি অথবা অন্য কোথাও যাওয়ার জন্য এ রাস্তায় যেতে-আসতে হয়েছে। তার দাদি মরার খবর এলে সেদিনও তাকে এ রাস্তায় যেতে হয়েছিল। সেটাই ছিল তার জীবনে সবচেয়ে বেশি রাতে এ রাস্তায় হাঁটা। সে রাতে তার সঙ্গে জলিল ছিল, তার শ্বশুর ছিল। আজ সে এ রাস্তায় হাঁটছে সে রাতের চেয়েও গভীর রাতে- আবার একা। আজ তার ভেতরটা সেদিনের চেয়েও বেশি ভারি। পা দুটো যেন অবস হয়ে যাচ্ছে, তারা আর সামনে যেতে চাচ্ছে না। কিন্তু না তাকে তো যেতেই হবে। তার হাতে ভেজা কাপড়-চোপড় সেগুলো সে চিপে দড়ির মতোন করে ফেলেছে। তার পায়ের গতি বাড়ালো। সন্ধ্যাবেলা মেলে বেরিয়ে আসার সময় তার মেয়েটি বলেছিল, মা সামনের শনিবার থাকি, স্কুল ড্রেস না পরি গেলে, আর ক্লাসে যেতে দেবে না। স্কুলের মাঠে থাকিই, সোনার বাংলা’ গাওয়ার পর বাড়িত চলি আসতে হবে। মা, ওমা মেয়েটি তার হাতের ওপর হাত দিয়ে বলেছিল, জানো মা ক্লাস ওয়ানের খালি আমার আর ফুরকির বাদে, সবার স্কুল ড্রেস আছে। সারে বুলে, এই স্কুল থাকি যে টাকা দেয়া হই, ঐগুলো কি করিস? তার সঙ্গে মেয়েটির মৃদু আবদার, মা একটা স্কুলের ব্যাগ কিনি দেবে- রাসেলের ব্যাগটা খুব সুন্দর জান মা? মা সালেহা মেয়েটিকে বুকের সঙ্গে জড়িয়ে তার সব দাবি পূরণের আশ্বাস দিয়েছে।

জলিল রিক্সা চালাত। পরে আশা থেকে লোন নিয়ে সে রিক্সায় ব্যাটারি লাগিয়েছিল। বিজিবি চেকপোস্টের আগে ওই যে মাটির মসজিদটি যেখানে ছিল। ঠিক ওখানে পেয়ারার ট্রাক এসে ধাক্কা দিল তাকে- উল্টে গেল তাদের জীবনের নকশা। ট্রাকটি ধরা যায়নি। এরপর জলিল-সালেহা দুপক্ষের আত্মীয়-স্বজন, জলিলের পাড়ার আমীন হাজিসহ আরও দুএকজনের সাহায্য-সহযোগিতা সবই মেডিক্যালে ফুরিয়ে গেছে। দশ কাটা জমি কট্ নেয়া ছিল। তাও গেছে। দীর্ঘ চার মাস পরে তারা মেডিক্যাল থেকে ছাড়া পেল- কিন্তু ওতো বড় বড় ডাক্তাররা কেউই নিশ্চিত করে বলতে পারল না কবে থেকে জলিল নিজেই তার নিজের প্রয়োজনীয় কাজগুলো করতে পারবে। দিন গড়ানোর সঙ্গে সঙ্গে আত্মীয়-স্বজন, বন্ধু-বান্ধবদের আবেগও কমতে থাকল। সবাই গুটিয়ে যেতে থাকল- নিজ নিজ আঙ্গিনায়। আরও চার-সাড়ে চার মাস পর তার শরীরের কিছুটা উন্নতি হলো। উন্নতি মানে সালেহার যেই আপ্রাণ প্রার্থনা ছিল- সে তার নিজের পায়ে হাঁটার শক্তিটুকু পাক। সেইটুকু হলো আর কী। এখন জলিলের থেকে লম্বায় হাত খানেক ছোট একটা বাঁশের লাঠির সঙ্গে সে কোন রকমে হাঁটতে পারে। বেলা বাড়লে ওই বাঁশের লাঠিটির সহযোগিতায় সে ধীরে ধীরে বাইরের মোড় পর্যন্ত আসে। সেখানে বয়সের ভারে নুইয়ে পড়া আরও তিনজন মানুষ বসে। কোন কোনদিন সে একাই বসে থাকে। কেউ না আসলে- বাড়ি ফিরে আসে। কোনদিন দুলুদের বাড়িতে যায়- ডিস লাইনে নাটক ও সিনেমা দেখে দেখে সময় কাটায়। তবে কোথাও শান্তি পায় না। কবে সে আবার কাজে ফিরে যেতে পারবে- এ কথা ডাক্তাররাও ঠিক করে বলতে পারে না। ডাক্তারের সেই একই কথা, মাজার ব্যথা সাড়তে সময় লাগবে। ভাঙা রিক্সাটাও বিক্রি করে দিয়েছে।

সালেহার গায়ের রং ফর্সা নয়। উজ্জ্বল শ্যামলা। তবে রোগহীন, সতেজ শক্তিতে পরিপূর্ণ একটা শরীর। মুখের কাটিংও শরীরের সঙ্গে মানানসই। কিন্তু ঠিক এ মুহূর্তে তার হাঁটার গতিটা, গতকাল ডেঙ্গু অথবা চিকনগুনিয়ার কব্জামুক্ত কোন একজনের মতো। প্রতি ধাপে আজ সে এগিয়ে যাচ্ছে, অন্য এক জীবনের দিকে । বর্ডারের ওপারের যেই মসুরকে পদ্মার চরের ডালের নামে বৈধ্যতা দিতে- মূলত এখানে এ পরিমাণ ডাল মিলগুলো গড়ে উঠেছিল। বর্ডারের ওপারের সেই মসুরের ঝাকাশেই এক এক করে বন্ধ হয়ে যাচ্ছে সব ডাল মিলগুলো। ডাল মিলের ধুলো পর্যন্ত বিক্রির সেই দিনগুলো এখন অনেকটাই ধুলোময়। যাদের ডালের মিলের সঙ্গে আরও অন্যান্য ব্যবসা-বাণিজ্য আছে তারা টিকে যাচ্ছে। আর যাদের সবকিছু ছিল এই ডাল মিল তাদের ব্যাংকের সিসি লোনের টাকা বুঝিয়ে দিতে হচ্ছে, ধানিজমি অথবা আমবাগান বিক্রি করে। লাগাম ছাড়া যেই লাভ, কিছুদিন আগে দিয়েছিল এই মিলগুলো- এখন সেই সব ভাসিয়ে নিয়ে যাচ্ছে সুদসমেত। গাছ কাটা পড়লে, পাখির বাসা আর কোথায় থাকে। যে কয়টি ডাল মিল টিকে আছে সেগুলোতে- বন্ধ হয়ে যাওয়া মিলের লোকেরা রোজই ভিড় করে। চালনা দিয়ে ছেকে যেমন ডালের গ্রেডিং করা হয়- ঠিক তেমনি লোকদেরকেও চালনা করে নেয়া হচ্ছে। এ অবস্থায় নতুন লোক অর্থাৎ সালেহার মতো একেবারে আনাড়ি লোকের কাজ পাওয়া বড়ই কঠিন। অনেকটাই অসম্ভব। তারপরও সালেহা হাল ছাড়ে না। মাসখানেক থেকে ঘুরে ঘুরে সে মিলনের মা’র কাছে যেত। মিলনের মা’র সঙ্গে মিলের মিস্ত্রির একটা ভাল সম্পর্ক আছে। সে ইচ্ছা করলেই যত কঠিন অবস্থায় হোক, একটা কাজ সে জোগাড় করে দিতে পারবে- মিলনের মায়ের খোঁজখবর রাখে এমন দুইজন মহিলা সালেহাকে এ কথা বলেছে। সে নিজেও এ কথা বিশ্বাস করে। সে প্রতিবার মিলনের মা’র কাছে যায়, আবার পিছিয়ে আসে। কারণ মিলনের মা সালেহাকে সবই খুলে বলেছিল, শোন তুই হইলি আমাদের থাইকা আনেকখানি ভাল ঘরের মেয়ে মানুষ। বিপদে পড়েছিস, কিন্তু ডাল মিল জায়গাডা ভাল না। রাতের আন্ধার গাঢ় হয়ে উঠলেই সাইডে ডাক পড়ে। মিস্ত্রির অত্যাচার, মালিক, তার সাঙ্গপাঙ্গ, বারকার পাটি- সবাই মিলি কাড়াকাড়ি লাগা। এই রকম কাম কি তুই পারবি? কামের লোকের অভাব নেই কিন্তু তুই গেলে মিস্ত্রি তোক ঘুরাবে না এসব শুনে দৌড়ে পালিয়ে আসে বাড়িতে। বাড়িতে জলিল আর মেয়েটির মুখের দিকে তাকিয়ে সে সেখানেও দাঁড়াতে পারে না। বাইরে এসে দাঁড়ায়, পুকুরের জলধোয়া বাতাসের ঝাপটা লাগে তার চোখেমুখে। নিমগাছের ঘনপাতাগুলোও তাকে ছায়া দেয়। চোখ দুটো বুজে, নিঃশ্বাসটুকুকে বুকের ভেতর চেপে রাখে খানিকক্ষণ। শ্বাস ছাড়ে, সঙ্গে মিলনের মা’র কথাগুলো ঢোক গিলে নামিয়ে নেয় বুকের ভেতর। কোন উপায় নেই। কোরবানির ঈদের পর তাদের সমাজ থেকে পাঁচশ’ টাকা দিয়েছিল। সঙ্গে তার বাবাদের সমাজ থেকে তিনশ’ টাকা। সবই ফুরিয়ে গেছে। এবার চামড়ার নাকি এক্কেবারেই দাম নেই। খাশির চামড়া পনেরো টাকাতেও নাকি বিক্রি করেছে। সমাজের লোকের দোষ কী।

মিলনের মা’র সঙ্গে প্রথম যেই সন্ধ্যায় সালেহা ঘর থেকে বের হচ্ছিল। তখন জলিল তাকে বার বার বলেছিল, এই শোন, যাসনি। সালেহা তাকে ধমক দিয়ে বলেছিল, কি করব তাহালে, মরলে তো মরা যা, মারতে তো আর পারছিনি। এ কথার পর জলিলের দুচোখ বেয়ে কেবলি গরম পানির স্রােত ছুটেছিল। কোন গর্জন হয়নি। মেয়েটির মাথায় হাত বুুুলিয়ে সে বাইরে বেরিয়ে এল।

মিস্ত্রি ডাগা ডাগা চোখে সালেহাকে যেভাবে দেখল, বড় দুলাভাইয়ের সঙ্ড়ে দেখতে গিয়ে জলিলও তাকে এমনভাবে দেখেনি। বেপারী মজুন একদিন তার পোষা খাশিটাকে দেখতে এসে খাশিটার কোমর চেপে-চামড়া টেনে এমন করে দেখেছিল। বেপারটা খারাপ লাগাই সালেহা মজনু বেপারীর মুখের উপরই বলে দিয়েছিল, থাক বেপারী খাশি বেচপো না। মজনু বেপারীর ঝাঁঝালো উত্তর, ভাবি, রাগ করলে হবে নান, এডি বাজার। বাজার বড়ই কঠিন জিনিস। তাদের দুজনের মাঝখানে ঢুকে জলিল সেদিন বলেছিল, এই পাগল তুই ভেতরে যা। আমি দেখছি। মিস্ত্রি বলল, মিলনের মা, আচ্ছা ঠিক আছে। তুমার কথাতে যেই স্যাম্পুল আমি মাথার মধ্যে রাখিছুন। মাল তো তার চ্যাও ভাল। ধুলাবালি কিচ্ছু নেই। গেরস্তের ঘরের মাল। হাতে হাতে কুলিতে ঝাড়া। চরের মালে বালি আর পলিমাটির ঢেলা-ডালের ফলন কম। কথাগুলো শুনে যত বড় ধাক্কা সালেহা খেল, এতটা সে কল্পনা করেনি। তবু পিছু সরল না। আর পেছনে পা দেবে কোথায়?

প্রথম রাত যাওয়ার পর দ্বিতীয় রাতে মিলনের মা তাকে ডেকে বললো, শোন, তোকে আর ড্রাম মারা লাগবে না। তুই এক কাজ কর, আলাদা কাপড়-চোপড় আনতে বুুলিছুন, আনিছিস? কাচারীর ঘাট থাকি গলা অব্দি ধুই, আসেক। মিস্ত্রি ধুলাবালি নিই থাকে কিন্তু অপরিষ্কার ভালবাসে না। যা। শোন মিলনের মা, আমার না, একটু অসুবিধা আছে। মিলনের মা ফস করে উঠল, মানে? তুই তো সব মানিই? না মিলনের মা ও কথা না। আমার অসুখ শুরু হচ আজ থাকি। অসুখের মধ্যে...। মিস্ত্রিক বুলি চার-পাঁচডা দিন সুমা। মিলনের মা- শুধু শুনছে। লম্বা একটা দম ফেলে বলল, আচ্ছা বুঝা বুলি দেহি। না হলে অন্য কাখু দি একয়ডা দিন চলে কিনা? মিলনের মা’র কথা মিস্ত্রি মেনে নিয়েছিল। তবে সালেহার পরিবর্তে এ কয়দিন অন্য কাউকেই তার ঘরে ডাকেনি। এই কয়টা দিন মিস্ত্রি কেবলি নিজেকে পুড়িয়েছে। আর ভেতরে ভেতরে সাজিয়েছে। মেলের মধ্যে ঘুরেছে-ফিরেছে, ডালের সাইজ পরীক্ষার সঙ্গে সঙ্গে চোরাচোখে নজর রেখেছে সালেহার শরীরের ভাঁজে ভাঁজে। কয়দিন থেকে মোবাইলে সে যেই নতুন ভিডিওটা দেখেছে, সালেহাকে অনেকটা তার মতো লাগে। চড়াগলায় মিস্ত্রি মাঝে মধ্যেই হাঁক ছাড়ে, শোন মিলনের মা, লতুন মানুষ শিখাপড়া লেও। আস্তেই সব ঠিক হয় যাবে। আর তুমি কি পান খাওয়া ছেড়ি দিছো নাকি? ট্যাকা লি যাও, পানটান আন, আমার লাগিও একটা আন। আমার ডাতে খয়ের দিও না। মিস্ত্রির এ দরদভরা কথাগুলোর মানে এখানকার সবাই বোঝে।

রাত পোহালেই শুক্রবার। গতকাল এখানে সালেহার ছয় রাত পার হয়ে গেছে। এখানকার মিলগুলোতে সাধারণত মঙ্গলবার ও শনিবার টাকা দেয়া হয়। কারণ এ দুদিন এখানে হাট বসে-সবচেয়ে বড় দুটি সাপ্তাহিক হাট। কোন কোন মিলে রোজ সকালে টাকা দিয়ে দেয়া হয়। তবে সে মিলের সংখ্যা বেশি নয়। একটা রাতও যদি সালেহাদের টাকাগুলো মিল মালিকদের কাছে থাকে। তাতেও তাদের অনেক লাভ। ব্যবসা হয়। সালেহাও গত মঙ্গলবারে প্রথম টাকা পেয়েছে। এ টাকাগুলো তার সংসারে স্যালাইনের মতো কাজ করছে। সামান্য রস জোগাচ্ছে তাদের সংসারে।

মিস্ত্রির কাজ থেকে চেয়ে নেয়া সময়ের মেয়াদ গত রাতে ফুরিয়ে গেছে। এখনও সালেহার শরীর কাঁচা। এ চার-পাঁচ দিনে তার শরীর যতখানি রক্ত ঝরিয়েছে, তার দাগ কাপড়ের তেনাতে হয়ত পাওয়া যাবে। কিন্তু এই কয়মাসে ঝরা তার বুকের সেই ক্ষরণের কোন দাগ বা স্বাক্ষর কোথাও নেই। অনেক স্বাদ করে কেনা আড়াই কেজি চাল একবারে চড়ানোর ওই ডেকছিটা। সেটাও গোপনে বিক্রি করতে হয়েছে।

সালেহা মিলের পেছনদিক দিয়ে মিস্ত্রির ঘরে গিয়ে উঠল। দরজাতে হাত দিতেই খুলে গেল। মাথা নিচু করে পা এগিয়ে দিল দরজার ভেতরে। এনার্জি বাল্বের ফলনের তুলনায় এ ঘরের আকার-আয়তন ছোট হয়ে গেছে। সব কিছু দেখা যাচ্ছে। ঘরে আসবাবপত্র বলতে তেমন কিছু নেই। ঘরে ঢুকতেই বাম হাতের কাছে একটা টেবিল। সম্ভবত আম কাঠের। তবে তার সঙ্গে জোড়া মেলানো চেয়ার চোখে পড়ছে না। টেবিলের ওপরে রাখা ভিন্ন ভিন্ন সাইজের মসুর ও মুগডালের স্যাম্পুল। প্লাস্টিকের একটা জগ আর একটা কাঁচের গ্লাস। বড় ও ছোট দুই সাইজেরই দুটি বুমা। দেয়ালে সিমেন্ট-বালুর পলেস্টারের পরিবর্তে লাগানো রয়েছে খবরের কাগজ। খবরের কাগজগুলো দেখলে মনে হচ্ছে, খুঁজে খুঁজে বিনোদন পাতাগুলোই এখানে ব্যবহার করা হয়েছে। এ বিশেষ পলেস্টারের ব্যবস্থা শুধুমাত্র চৌকিটির তিনপাশ জুড়ে। চার দেয়ালের অন্যান্য অংশ এ বিশেষ ব্যবস্থা থেকে বঞ্চিত। মেঝেতেও কেবলি ইট বিছানো সিমেন্ট-বালুর ঘোলাও সেখানে দেয়া হয়নি। গরুর গোয়ালে যেমনটি দেয়া হয়, তেমনটিও না। মেঝের মাঝ বরাবর দুটি ইট নড়বড়ে হয়ে গেছে। সেই ইট দুটির একটির ওপর পায়ের কিছু অংশ রেখে দাঁড়াল সালেহা। যদিও সে মিস্ত্রির কাছাকাছি হয়ে দাঁড়াতে সংকোচ বোধ করছে। কিন্তু এ ঘরের যে গঠন তাতে সে যেখানেই দাঁড়াক। মিস্ত্রির থেকে খুব দূরে দাঁড়াতে পারছে না। ঘরের দরজার দিকে দুজনের কারই খেয়াল ছিল না। সালেহা ভেতরে আসার পর থেকে দরজাটি হা-খোলা। মিস্ত্রি দরজাটি লাগাতে যাচ্ছিল, এমন সময় মিলনের মা এসে হাজির। ভাইজান আপনের এনার্জি বিস্কুট আর আগরবাতি। মিস্ত্রি মুখে কোন কথা না বলে, শুধু তার হাত দুটি বাড়িয়ে দিল। তারপর ভিড়িয়ে দিল দরজা। দরজার পাল্লা দুটি একত্রিত হওয়ার শব্দটি সালেহার বুকে শেলের আঘাত।

দিনরাত সিগারেটের উপরেই থাকে মিস্ত্রি। কিন্তু এ মুহূর্তে তার ঘরের মধ্যে একটা সিগারেটের গোড়াও পড়ে নেই। হয়ত মিলনের মা একটু আগেই সব ঝাট দিয়ে নিয়ে গেছে। বিছানার চাদরটিই তার এ ধারণার পক্ষে সাক্ষী দিচ্ছে। মিলনের মাও প্রথম প্রথম মিস্ত্রির বিছানাতেই থাকত। এখন এগুলো করে। তার সঙ্গের কেউ আর এই মেলে নেই। মিস্ত্রিকে আগরবাতি জ্বালানোর চেষ্টা করতে দেখে সালেহা বলে উঠল, আগরবাতি জ্বালাবেন না। ওটা আমার ভাল লাগে না। মিস্ত্রি থেমে গেল। সে বুঝতে পারছে না- সালেহার মতোন মেয়ের আগরবাতি ভাল লাগে না। হয়ত মিস্ত্রি এটা কোন দিনই বুঝতেই পারবে না। মিস্ত্রির সমস্ত শরীরে আগুন খেলে যাচ্ছে। ঘণ্টাখানেক আগে সে মেলের পাশের ফার্মেসি থেকে একটা ওষুধ নিয়ে খেয়েছে। সঙ্গে সঙ্গে ফার্মেসির ওই ছেলেটিকে খানিকটা শাসিয়েও দিয়েছে- এবার যদি কাজ না হই। ফার্মেসির ছেলেটি বলেছে, আরে না মিস্ত্রি যাও, ওষুধ খা এক গ্লাস গরম দুধ খাও। কাজ হবেই। আর একটা কথা শুনো, তুমাক যে কিচমিচ আর বাদাম খাওয়ার কথা বুলিছুন। খাছো তো নাকি? জমিতে খালি ইউরিয়া সার দিলেই আবাদ হ’না। জমির লিজের বুকের জমানো শক্তিও থাকা লাগে, বুঝতো। আর তুমার তো বয়স চল্লিশ পার। না জমতেনিই বোধহ শুরু করিছো। আর কতদিন চলবে? বয়সের প্রশ্নে ক্ষেপে গিয়েছিল মিস্ত্রি, ধোত শালা। মাঝেমধ্যে ওষুধ বদলে দিয়ে- মিস্ত্রিকে ফার্মেসির এ ছেলেটিই সচল রাখে। মিস্ত্রির মনে বিশ্বাস জন্মাছে আজকের ওষুধটি ভালই দিয়েছে।

সালেহার একশ’ সত্তর টাকা রোজ। কিন্তু ফজরের আযানের পর পর মিস্ত্রি তার হাতে একশ’ টাকার দুটি নোট গুঁজে দিল। নোট দুটো একেবার পুরনো ও নরম হয়ে গেছে। তবু বাজারে তার দাম এক পয়সাও কম না। নিষ্পেষিত সালেহার সবকিছু যখন তার সহ্যের বাইরে চলে যাচ্ছিল। সে সময় মিস্ত্রি তার চুলের মধ্যে হাত বুলিয়ে একবার বলেছিল, চিন্তা করিস না। সিসি ক্যামেরা দেখার জন্য একটা লোক লাগবে। আমি হাজিক জলিলের কথা বুলবোন। কুনু কাম নেই, খালি রাত জাগি থাকাটাই যা খাটুনি। কিছু হলে খালি বাঁশি বাজাবে। আর বাইরে তো সিগিরিটির লোক আছেই। তার কথায় বিশ্বাস করেনি। কারণ সে জানে- পুরুষ মানুষ এমন সময়ে অনেক কথায় বলে। কিন্তু ভুলে যায়। তবু এখন তার যেই অবস্থা তাই খানিক আশা করছে। আবারও সে মিলের পেছনের সেই পথে বেরিয়ে যাচ্ছে। খানিকটা এগিয়ে পথের ধারে চেনা-অচেনা আগাছায় ঘেরা একটা গর্ত তার চোখে পড়ল। যেখানে সে ছুড়ে মারল খবরের কাগজে মোড়ানো কনডমগুলো। এখন দুই উরুর ব্যথায় তাকে বেশি ভোগাচ্ছে। কিন্তু তার চেয়ে বেশি ভারি লাগছে তাকে তার নিজের কাছে। কাচারীর পুকুরে বেলা উঠাভর ডুবে থেকেও আজ আর হয়ত সে হালকা হতে পারবে না।

ডাল মিল থেকে ফেরার পথে রোজ তারা সবাই গোসল করেই বাড়ি ফেরে। এদিক থেকে কোন অসুবিধা হয়নি। ঘরে ফিরে মেয়েটিকে বুকে জড়িয়ে বললো, থাম রুটি কডা বানায় লিই। তারপর কাচু খলিফার দোকানে যাবোন। সকাল সকাল গেলে আজই তোর স্কুল ড্রেস বানা দেবেন।