কলকাতা গেলেই শান্তিনিকেতন না যাওয়ার কথা ভাবতেই পারি না ।
শান্তিনিকেতনে এবার নিয়ে পঞ্চম বারের মতো যাত্রা। ২৭ অক্টোবর সকালে বিমানে চড়ে বসলাম। যথা সময়ে বিমান উড়লো। ঢাকার আকাশে দলা দলা কালো মেঘ। ঝড়ের পূর্বাভাস যেন। ওমা, কয়েক মিনিট ওড়ার পর দেখি ঝকঝকে রোদের বন্যা আকাশে। মাত্র ৪০ মিনিটের উড়ালের জন্য কত কি !
দুদিন পর শান্তিনিকেতন এক্সপ্রেসে চড়বো বলে সকাল সকাল হাওড়া স্টেশনে পৌঁছে গেলাম। ঠাঁসা মানুষ! এতো এতো মানুষ সব প্রতিদিনের যাত্রী ভাবতেই অবাক লাগে। শান্তিনিকেতন এক্সপ্রেসের এ সি কামরার নির্ধারিত আসনে বসে তবেই আমাদের শান্তি। আমি আর ইভা। দু’জনের আড্ডার ফাঁকে ফাঁকে চা কফি ঝাল মুড়ি কোনোটাই বাদ যাচ্ছে না।
যারা বারকয়েক শান্তিনিকেতন গেছেন রেলপথে তারা ঠিক জানেন এই ট্রেনে রবিঠাকুরের গান গেয়ে আনন্দ দিয়ে থাকেন কিছু মানুষ। যাদের রয়েছে অপূর্ব কন্ঠ। কখনো মনে হয় বিখ্যাত শিল্পীদের চেয়ে কম নন তারা। ‘আমার এই পথ চাওয়াতেই আনন্দ’ এই গান নিয়ে সেদিনের সেই কন্ঠ আমাদের যাত্রার আনন্দ বহুগুণ বাড়িয়ে দিয়েছিলো।
ট্রেন চলছে, আমরা দুলছি। একে একে স্টেশনগুলো ছাড়িয়ে যাচ্ছি। শক্তি গড়ে এসে যাত্রাবিরতি হলো। কিছু যাত্রী নেমে গেলেন, আবার কেউ কেউ উঠলেন। একবার বন্ধু সঞ্চিতার গাড়িতে করে শান্তিনিকেতন যাওয়ার পথে এই শক্তিগড়েই থেমেছিলাম; খেয়েছিলাম ল্যাংচার দোকানের বিখ্যাত মিষ্টি। তার দারুণ স্বাদ যেন জিভে লেগে আছে।
রেললাইনের দুই ধারে সবুজ ধানের ক্ষেত হাওয়ায় দুলছে ,কোথাও কোথাও ক্ষুধায় কাতর ধবধবে বকেরা অপেক্ষায় তাদের প্রত্যাশিত খাবারের জন্য। ভাবছিলাম মহিষে আর বকে এত ভালো বন্ধুত্ব কেমন করে হয় ! ওরা কী সুন্দর একে অপরের পাশে দিব্যি স্বস্তিতে আছে!
দেখতে দেখতে এসে গেল বর্ধমান স্টেশন। এর পরই বোলপুর, মানে আমাদের গন্তব্য শান্তিনিকেতন। সকল অপেক্ষার শেষ।
বোলপুর স্টেশনে নেমে টমটম (আমাদের সিএনজি অটোরিক্সার মতো) নিয়ে আগেই বুকিং দেয়া রিসোর্ট ‘শকুন্তলা’য় এলাম । খোয়াই এর বন লাল মাটি ঘেঁসে এই রিসোর্ট কী যে অদ্ভুত সাজানো, মন ভরে গেলো। আহা, যদি পূর্ণিমা হতো আজ !
শনিবারের হাট বসবে দুপুর ২ টা থেকে। এরই মধ্যে দুপুরের খাবার খেয়ে নিতে হবে।
শকুন্তলার খাবারের থালা দেখেই অর্ধেক খিদে মিটে গেলো। ভেজ আর ননভেজ থালি। তো আমরা ভেজ থালিই বেছে নিলাম। গরম ভাতে এক চামচ খাঁটি ঘি, শুক্ত, আলু পোস্ত, বেগুন ভাজা, চাটনি , আলুর দম সাথে পাঁপড় । আহ, অমৃত! অনেকদিন জিভে এই স্বাদ রয়ে যাবে।
এবারে হাটে যাবার পালা ।
রিসোর্টের একেবারে কাছেই হাট , রঙ বেরঙের পসরা সাজানো। শাড়ি, চুড়ি, মালা, ঘর-বাড়ির আসবাবপত্র, হাতের কাজের তৈজসপত্র- সব থরে থরে সাজিয়ে বসেছে দোকানীরা। শান্তিনিকেতনে হাট বসবে, আর বাউল গান, সাঁওতাল নাচ থাকবে না, সে কি হতে পারে!
হরি নাম নিয়ে জগত মাতালে আমার একলা নিতাই রে
আমি কোথায় পাবো তারে আমার মনের মানুষ যে রে
খাঁচার ভেতর অচিন পাখি
প্রাণ মন উজাড় করে গেয়ে চলেছেন বাউলেরা। আরেক পাশে চলছে সাঁওতাল নৃত্য ।
সে এক অদ্ভুত সুন্দর উপলব্ধি, যা না দেখলে অনুভব না করলে কতোটুকুই বা বোঝানো সম্ভব!
এর ফাঁকে ফাঁকে আমাদের টুকিটাকি কেনাকাটা শেষ। সন্ধ্যা নেমে আসছে খোয়াইয়ের লাল মাটির রাস্তা বেয়ে বনের ধারে ধারে। আমরা ফিরছি আমাদের অস্থায়ী আবাসে। ঘুমোতে হবে তাড়াতাড়ি, কোপাই নদী আমাদের ডাক পাঠিয়েছে। এই নদী নিয়ে রবীন্দ্রনাথ লিখেছিলেন ‘আমাদের ছোট নদী চলে বাঁকে বাঁকে, বৈশাখ মাসে তার হাঁটু জল থাকে’।
ভোরবেলা আমরা চললাম কোপাইয়ের পাড়ে।
পথ দিয়ে যাচ্ছি টমটমে করে। এর আগে যে কয়বার শান্তিনিকেতনে এসেছি রিক্সা চেপেই ঘুরেছি সব জায়গায়। এবারে এই টমটম। আমার ভালো লাগেনি এই বাহন। প্রাকৃতিক পরিবেশের সাথে যায় না এই যান্ত্রিক যান। খুব বেমানানই বলবো। শান্তিনিকেতন বদলে যাচ্ছে, বদলে গেছে অনেকটাই। মহাত্মা গান্ধী রবিবাবুর সঙ্গে দেখা করতে এসেছিলেন, শান্তিনিকেতনে প্রবেশ করেছিলেন খালি পায়ে। সেই শান্তিনিকেতনে এখন টমটম, গাড়ি, বাইক সব চলে।
কোপাইয়ের পাড়ে এসে আরেকবার ধাক্কা খেলাম। কই কোপাই কই?
এতো সরু এক ফালি জল আর বালু মাটিতে ভরা , আহা রে!
মন খারাপ বাসা বাঁধল মনে মনে...
তুমি কাহার সন্ধানে
সকল সুখে আগুন জ্বেলে বেড়াই কে জানে !
এমন ব্যাকুল ক’রে
কে তোমারে কাঁদায় যারে ভালোবাস।
তবু কোপাইয়ের পাড়ে বেশ কিছুক্ষণ বসে রইলাম, চা পান করলাম। ফের শুরু করলাম হাঁটা।
যেতে যেতে দেখি এক পদ্ম পুকুর । এক ফালি হাসি ফুটলো আমাদের ঠোঁটে। সত্যিই দেখবার মতো বটে !
তরতর করে নেমে গেলাম পদ্ম পুকুরে ,জলপিপি প্রজাপতির মতোন এ-পাতা থেকে ও-পাতায় ডিংগিয়ে ডিংগিয়ে বেড়াচ্ছে ,কী যে হালকা ওদের শরীর !
বেলা একটায় বিশ্বভারতীর ভেতরে যাওয়ার অনুমতি মিলবে। সে যাই হোক, আদেশ নির্দেশ লুকোছাপা করে এক ফাঁকে নিঃশব্দে চলেই এলাম ভেতরে। চুপচাপ বসে রইলাম ছাতিম তলায়।
সাইকেল চেপে শাড়ি পরা মেয়েগুলো চলেছে। দেখতে যে কী ভালো লাগে । পাঠভবনের ছাত্র-ছাত্রীরা সব হলুদ পরীর মত কলকল খলখল করে ছুটির আয়োজন করছে, হিমুদের গুচ্ছ গুচ্ছ সভা ইতি উতি চোখে পড়ছিলো। আমিও একদিন এমন ছিলাম; কলকল ছলছল ! আহা সে নানা রঙের দিনগুলো আর কখনো ফিরে পাবো না। ভাবতেই ওদের সাথে একাত্ম হওয়ার লোভ সামলাতে পারলাম না।
পাঠভবন, কলা ভবন, ঘণ্টা, সংগীত ভবন, মৃণালিনীর আশ্রম, প্রার্থনালয় সব ঘুরে ঘুরে আমরা কিছুটা ক্লান্ত তো বটেই।
আরো একটা বিষয় বাকি রয়ে গেছে। মোহন সিং খাংগুরা বিখ্যাত শিল্পী, তাঁর বাড়ির ঠিকানা জোগাড় করা চাই। তারপর যাওয়ার পালা ।
অবাঙ্গালী একজনের সবটুকু বাঙ্গালী হয়ে ওঠা গুণী শিল্পীর গান আমায় মুগ্ধ করে।
তিনি যখন গান- অসীম কাল সাগরে ভুবন ভেসে চলেছে... আমি কেবল শুনি কেবল শুনি।
দুরুদুরু পায়ে তাঁর বাড়ির সামনে হাজির হলাম। কড়া নেড়েও ফেললাম । একটা ফুটফুটে বাচ্চা এসে দরজা খুলে দিয়ে জানতে চাইলে কোথা থেকে কার কাছে এসেছি । জানালাম- মোহন সিং এর সাথে দেখা করবো বলেই এসেছি। বসতে দিয়ে বললে, দাদু দুপুরের খাবার খাচ্ছে, আপনারা বসুন। ঘরময় রোদ্দুরের লুকোচুরি তার ভেতরে বিক্রম সিং এর ছবি দেয়ালে বাঁধানো দেখতেই বুকটা মোচড় দিয়ে উঠলো । কয়েকটা তানপুরা, ইলেক্ট্রিক তানপুরা, নানা বইয়ে ঠাঁসা ।
অবশেষে আমার কাক্সিক্ষত মানুষটি এলেন, যেভাবে এলেন, আমি একদম সেভাবে তাঁকে দেখবো এমন আশাই করিনি। হুইল চেয়ারে বসা শুভ্র সুন্দর একজন মানুষ একজন অবাঙ্গালী হয়েও যিনি আমাদের চেয়েও বেশী বাঙ্গালী । কথা বললাম। কিন্তু মন অস্থির হয়ে উঠছিলো।
বিদায় নিয়ে ফিরছি বিশ্বভারতীর পথ দিয়ে ,ফিরতি পথে ‘প্রতীচী’ বাড়িটির সামনে এসে থমকে দাঁড়ালাম, নোবেল বিজয়ী আরেক বাঙ্গালী অমর্ত্য সেন; রবিবাবুর শান্তিনিকেতনে তাঁরও বাড়ি। বাড়ির নাম প্রতীচী। মা অমিতা সেন এ বাড়িতেই থাকতেন। যেবছর অমর্ত্য সেন নোবেল পেয়েছিলেন, আমি এবাড়িতে এসেছিলাম। তাঁর সাথে দেখাও হয়েছিলো। সে আরেক দিন লিখবো।
সাঁওতাল পাড়া, রতন পল্লী, গুরুপল্লী, সব টো টো করে ঘুরে ঘুরে রিসোর্টে ফিরে আসছিলাম, তখন ভানু যাই যাই করছে, মাথার উপর দিয়ে ঝাঁকে ঝাঁকে পাখি বিচিত্র ধ্বনি তুলে বাড়ি ফিরছে। বিকেল সাড়ে ৫টায় আমাদের ফিরবার ট্রেন।
এসে বসে আছি বোলপুর স্টেশনে। সন্ধ্যা প্রায় রেল কর্তৃপক্ষ ঘোষণা দিল ট্রেন প্রায় দুঘণ্টা দেরিতে আসবে। ভালোই হলো কত মানুষ, কেউ আসে কেউ যায়, ফেরিওয়ালা, ক্লান্ত দেহে স্টেশনে একটু জিরিয়ে নেয়া, এমনকি ঘুম সেরে নেয়ার মানুষও নেহায়েত কম না। মানুষের জীবন-যাপন চলা-ফেরা দেখতে আমার বেশ লাগে। একেকজন মানুষের মুখে একেকরকমের গল্প থাকে,তা পড়তে থাকি টুপটাপ। ক্যামেরার লেন্সে ধরে নিই তাদের অজান্তে ।
শান্তিনিকেতনে আসার টান আমার কখনোই ফুরাবে না,
আমার ফুরাবে না, সেই জানারই সংগে সংগে তোমায় চেনা !
শ্রান্তিমোচনে বারেবার ফিরে আসতে চাই শান্তিনিকেতনে।