করোনাকাল
বিচ্ছিন্ন অনুভব
মাহফুজা হিলালী

প্রবন্ধ
অধ্যাপক আনিসুজ্জামান
শামসুজ্জামান খান

গল্প
ডায়মন্ড লেডি ও পাথর মানব
হামিদ কায়সার

গদ্য
নিদ্রা হরণ করেছিল যে বই
মিনার মনসুর

নিবন্ধ
পঞ্চকবির আসর
সায়কা শর্মিন

বিশ্বসাহিত্য
আইজাক আসিমভের সায়েন্স ফিকশন
অনুবাদ: সোহরাব সুমন

বিশেষ রচনা
প্রথম মহাকাব্যনায়ক গিলগামেশ
কামাল রাহমান

শ্রদ্ধাঞ্জলি
মুজিব জন্মশতবর্ষ
মারুফ রায়হান
 
সাক্ষাৎকার
কথাশিল্পী শওকত আলী

জীবনকথা
রাকীব হাসান

ভ্রমণ
ইম্ফলের দিনরাত্রি
হামিদ কায়সার

ইশতিয়াক আলম
শার্লক হোমস মিউজিয়াম

নিউইর্কের দিনলিপি
আহমাদ মাযহার

শিল্পকলা
রঙের সংগীত, মোমোর মাতিস
ইফতেখারুল ইসলাম

বইমেলার কড়চা
কামরুল হাসান

নাজিম হিকমাতের কবিতা
ভাবানুবাদ: খন্দকার ওমর আনোয়ার

উপন্যাস
আলথুসার
মাসরুর আরেফিন

এবং
কবিতা: করেনাদিনের চরণ

১৬ বর্ষ ০৫ সংখ্যা
ডিসেম্বর ২০২৩

লেখক-সংবাদ :





গোল্ডফিশ
জেসমিন মুন্নী
বৃষ্টিহীন শহরটা তেতে উঠলে রাস্তার গাড়িগুলো দিগি¦দিক্ ছুটতে থাকে। কেউ কোন নিয়মের ধার ধারে না। ধরবেই বা কেন! জায়গার অধিক বস্তুর ঠাসাঠাসি নিয়মকে দাবড়িয়ে নিয়ে গেছে অনিয়মের দিকে। নিয়ম নিজেকে গুটিয়ে পালাবার পথ করে এখন দেশান্তর।
শহরটা তাই অনিয়মের রাস্তা ধরে প্রতিযোগিতায় নেমেছে কার আগে কে পৌছাবে গন্তব্যে; যেখানে নাটোরের বনলতা সেনের চোখের মধ্যে আছে দু’দ- শান্তি। অথবা জমে যাওয়া শীতের রাতে মুুরগির পালকের নিচে ডিম ফুটে বের হওয়া ছানাদের ওম।
তো এসব নিরন্তর ছুটে চলা মানুষদের মধ্যেও রয়েছে দুটি ভাগ। একদল গ্রীষ্ম-বর্ষা-শীত মাড়িয়ে রাস্তায় দলিত মথিত হয় এবং অন্য দলকে এসব কিছ্ইু স্পর্শ করে না। তাদের চলন-বলন-বাসস্থান সবই শীতাতপনিয়ন্ত্রিত খাঁচার মধ্যে বন্ধী। একই মানচিত্রের মধ্যে থেকেও তারা যেন অন্য জগতের মানুষ। অতিরিক্ত আবেগী ও মাত্রারিক্ত সংবেদনশীল। যেন এ্যাকোরিয়ামে রাখা বর্ণিল মাছ বাইরে বের করলেই তড়পাতে তড়পাতে শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করবে। সেই রকম জীবনে অভ্যস্ত গালিবা বাবার সদ্য কেনা প্রিমিওতে বসে তাপদাহ অনুভব করে না বরং ওভারটেক করতে অস্থির লোকাল বাসের ক্রমাগত হর্নে অস্থির। চোয়াল শক্ত করে ড্রাইভারকে সাইড দিতে বলে। বিরক্তি মিশিয়ে ড্রাইভার বামদিকে স্টিয়ারিং ঘোরালে বাসের হেল্পার ড্রাইভারকে গালাগাল দিয়ে সাঁ করে পরিধি বাড়ায়। গালিবার তীক্ষèদৃষ্টি বাস উপেক্ষা করে বাতাসে আঘাত প্রাপ্ত হলে বৃষ্টি নামার পায়তারা। ঘাড় ঘুরিয়ে সবে মাত্র মহাখালি এসেছে দেখে চোখের পাতা বন্ধ করবার চেষ্টা করে। পারছে না। গান শুনতেও বিরক্তি। অগত্যা ফেসবুক নোটিফিকেশনে চোখ।
জন্মনিয়ন্ত্রণ পদ্ধতি উপেক্ষা করে প্রতিদিন কয়েক ডজন গাড়ি ফুটাচ্ছে যে শহর সেখানে জনসংখ্যা বিস্ফোরণের মতো গাড়ি বিস্ফোরণও ক্রমশ ভারি করছিল। গালিবার বাবার কথাই ধরা যাক। সরকারি বিধি অনুযায়ী, কোনো কর্মকর্তাই একটির বেশি গাড়ি ব্যবহার করতে পারবে না জেনেও গত মাসে প্রিমিওটি কিনল। পাজেরো, নিশান সানি ও প্রিমিও নিয়ে তাদের গাড়ির সংখ্যা ৩। রামিসার জন্যও একটা কেনার চিন্তাভাবনা চলছে। গালিবা ভাবল, কিনুক, তাতে আমার কী! সে বাবার চিন্তা দূরে ঠেলে আইফোনের দিকে মনোসংযোগ করে। ওলেভেলে ৮টা এ পাবার সুবাদে মামার কাছ থেকে প্রাপ্ত আইফোনের দিকে তাকিয়ে স্তব্ধ। তার চৌকোনিক শক্ত চোয়াল ঢিলা হয়ে অন্তরাত্মাকে কাঁপিয়ে দেয়। মস্তিষ্কের মধ্যে শুরু হয় দৌড় প্রতিযোগিতা যেটা অনুভব করেনি অনেক বছর। কদমফুল!!  স্ট্যাটাসে দেখামাত্র মস্তিষ্কে সেটার ঘ্রাণ অনুভব করে নিউরনে খুলে দেয় স্মৃতির দরজা, দরজার পর দরজা। গালিবা বুদ্ধিপ্রাপ্ত হবার পর কয়েকটি বর্ষাকালে দেখেছে নানার বাড়ির সামনের বারান্দায় লাইট পোস্টের আড়ালে নতমুখে দাঁড়িয়ে থাকা কদমগাছে ফুল ফুটলে মা বৃষ্টিতে ভিজতো। কখনো কখনো আকাশ ভেঙ্গে জ্যোৎ¯œা নামলে ছাদে বাবা-মা গল্প করতো সঙ্গে ফুলের ঘ্রাণের মাদকতায় বুদ হয়ে সব ভুলে যেত। গালিবা-লাবিবা দুবোন তখন নানা-নানীর সঙ্গে মনোপলি খেলত। দু’বোন ভাবতো, আজ রাতে তাদের মা পরী হবে?
   ‘কদমফুল! বন্যার প্রিয় ছিল। হুমায়ূন আহমেদ সাহেবের নায়িকাদের মতো, সে অসম্ভব জ্যোৎ¯œা ভালবাসত, বৃষ্টিতে ভিজতে...মা হিসেবে সে পৃথিবীর শ্রেষ্ঠ! আজ তার জন্মদিনে একগুচ্ছ কদমফুলের শুভেচ্ছা।’ সিঙ্গাপুর থেকে বাবা তার স্ট্যাটাটে ছবিসহ পোস্ট করেছে।
   কাঠকাঠ গালিবার ব্যক্তিত্ব হঠাৎ রক্তের উষ্ণতায় গলতে শুরু করেলে বদ্ধ গাড়ির স্বচ্ছ জানালা ঘোলাটে হতে থাকে। দ্বিধাহত কম্পিত পাখির মতো সে বসে থাকে। অনুভব করে পাঁজরের মাঝখান থেকে পাখিটা ফুড়–ৎ করে উড়ে বুকের মাঝখানটাতে টুকটুক করে ঠোকর দিচ্ছে। তখনই আনকন্ট্রোল ইমোশন চোখের কোন ফুটো করে সাদাকালো স্মৃতির দিকে গড়ায়।...
  সেদিন বাবা-মাসহ তারা বাইরে বেরিয়েছে। ভুবনভোলান হাসিমুখ নিয়ে মা বসে আছে বাবার পাশে। বাবা ড্রাইভ করছে, পেছনে তারা দু’বোন বারবি পুতুলদের পরিপাটি করছে। মা সিডির ভলিউম বাড়িয়ে নিজেও ঠোঁট মেলাচ্ছে, বাদল দিনে প্রথম কদম ফুল..  । ভারী বৃষ্টিতে গাড়ি ড্রাইভিং বাবার শখের মধ্যে একটি। মাও সেটা খুব এনজয় করতো। খাড়া নাক, কাজলের টান, মসৃণ গাল বেয়ে নামা নদীর ঢেউয়ের মতো ওয়েভি চুল, গ্লাসে অনবরত বৃষ্টির ফোঁটা, ওয়াইপারের ডানে-বামের দোল, পিছনের সিট থেকে দেখা মার সাইড ফেস যেন অন্য কোনো জগতের মানুষ। মুহূর্তে মার সাইড ফেস প্রচন্ড আলোর ঝলকানিতে মনে হলো সাদা হয়ে মিলিয়ে গেলো। তারপর প্রচন্ড এক ধাক্কা.. সব কিছু অন্ধকার। অনেকপরে জ্ঞান ফিরে নিজেকে হসপিটালে আবিষ্কার করলে মা..মা.. বলে কান্না। গালিবা কি অনুভব করেছিল মা তখন পরী কিংবা অন্য জগতের বাসিন্দা হয়ে গিয়েছে।
   দুর্যোগপূর্ণ আবহাওয়া ও বাবার অসাবধনতায় বিপরীত দিক থেকে আসা মাইক্রোবাসটির ধাক্কায় মার মাথা সামনের ড্যাসবোর্ডে প্রচন্ড আঘাতে ইন্টারনাল হ্যামারেজ। তারপর সব অন্ধকার।.. বহুদিন স্বপ্নে প্রচন্ড আলোতে মার মিলিয়ে যাওয়া দৃশ্যটি দেখে ঘামে জবুথবু হয়ে জেগে কাঁদতে কাঁদতে আবার ঘুমিয়ে পড়তো। এমন সময় হার্ডব্রেক করলে গালিবা চমকে নিজেকে স্বপ্ন অথবা ইলুয়েশনের মাঝখানে আবিষ্কার করে পেছনে ট্যিসু বক্সের ট্যিসুতে ৮ বছর মা ছাড়া থাকার অস্তিত্বকে জমিয়ে রাখে, ট্যিসুগুলোও যেন মার মতো নরম হয়ে মিশে একাকার।
   রাস্তার শেষপ্রান্তে নানার সম্পত্তিপ্রাপ্ত মার নামে নাম ‘বন্যা’ বাড়িটি এখন নতুন মায়ের মতো চটকদার ছয়তলা ফ্লাট। ৫টা ফ্লাটের দু’টাতে খালা ও মামা। অন্য তিনটার দুটোতে বাবার অফিস ও রোমেনা আন্টির, বাকিটা তাদের দুই বোনের। আগে নানা- নানী তাদের সঙ্গে থাকলেও নানার মৃত্যুর পর নানী স্ট্রোকে হাফ প্যারালাইসড হয়ে এখন মামার ঘরে। চার দেয়ালের মধ্যে তাদের দু’বোনের জীবনকাব্য ভালই চলছিল। কাব্যের ছন্দ পতন ঘটে গালিবার বড় বোন লাবিবা নর্থসাউথ থেকে বিবিএ করে ক্লাসমেট সাদমানকে স্বামী বানিয়ে এ্যামেরিকায় এমবিএ পড়তে যাবার পর। বোনের বিয়ের পর পুরোফ্লাটে গালিবা থাকত অ্যালিস, লাভবার্ডস ও বাবার দেয়া একজোড়া গোল্ডফিশ নিয়ে। রাতে অ্যালিস সব সময়ই তার শয্যাসঙ্গী হলেও গোল্ডফিশ থাকতো লাবিবার রুমে। লাবিবার রুম ছাড়া অন্য রুমগুলোর কোনায় কোনায় শূন্যতার বিরাজ। অন্যদিকে হরহামেশা বাবার কান ভারি করে আসছিল রোমেনা আন্টি; রামিসাকে লাবিবার রুম শেয়ার করবার জন্য। ফ্লাট বাড়িটাতে একমাত্র দিদির ঘরে মার স্মৃতি হিসাবে বাঁধানো একটি ছবি, কাবার্ডে কয়েকটি শাড়ি ও কিং সাইজ বেডটা অবশিষ্ট ছিল; সেটাও চলে যাবে ভেবে গালিবার সাফ জবাব ছিল ‘না’। ‘না’ কে ‘হ্যাঁ’ করার জন্য মহিলা নানা রকম কথনভঙ্গিমা ব্যবহার করছিল, এমন সব চলচ্চিত্র করছিল যেটা সবার চোখে লাগলে, মুহূর্তে চটকদার কোন গল্প বানিয়ে ফেলত। এমন কি গালিবার গ্রাজুয়েশন দিন ভাবখান এমন যেন অল ক্রেডিট গোজ টু হার! পঞ্চাশ ছুঁই ছুঁই মহিলা তার রুপ ও কথার সম্মোহনে বাবাকে বাক্সবন্দী করে রাখত। বাক্স থেকে মাঝে মধ্যে গালিবার বাবা অর্থাৎ খলিল সাহেব সম্মোহন কেটে বেরিয়ে এলে সন্তানদের ভবিষ্যৎ ভাবনা মাথা চাড়া দিত। তখনই গালিবার ডাক্তারি পড়ার সবকিছু সেটেল হয়ে গেলে বছরান্তে ডলারের এ্যামাউন্ট দেখে ব্যাংকে টাকার পরিনাম তলানিতে গিয়ে ঠেকবে ভেবে পুনরায় বাক্সবন্দী। মাঝেমাঝে কুমিরের কান্নার মতো কাঁদতো। বলতো, মা, মাগো, তুমি চলে গেলে আমাকে কে দেখবে?
   তাহলে আবার বিয়ে করলে কেন? কথাটা গালিবার বুকেই রয়ে যায়। কষ্টভারাক্রান্ত মনে অ্যালিসকে জড়িয়ে ধরে সেন্ট্রাল এসি দেয়া ভ্যাপসা ঘর থেকে বেরিয়ে বোনের রুমে এসে প্রাণ ভরে নিঃশ্বাস নিত। গোল্ডফিশদের মনের কথা বলতো। গোপন কষ্টগুলো শেয়ার করতো। বলতো, বাবা তো এমন ছিল না!  হুট করে মার খালাতবোন ডিভোর্সি রোমেনা আন্টিকে বিয়ে করে বাবা থেকে আঙ্কেলে পরিণত হল। কেউ না থাকলে বাবাকে মাঝেমধ্যে আঙ্কেল বলে সম্মোধন করে নিজেই হাসতো।
   গালিবা নানার কাছ থেকে জেনেছিল, লন্ডনে ল’ নিয়ে পড়ার সময় থেকে বাবা-মার প্রেম তারপর দেশে ফিরে বিয়ে। সরকারি চাকরি সঙ্গে দুজনে চেম্বার নিয়ে প্র্যাকটিস, সোসাইটিতে তাদের বেশ সুনাম ছিল, এরই মাঝে লাবিবা ও গালিবার জন্ম। অন্যদিকে রোমেনা আন্টি কোন এক ধনীকে বিয়ে করে দুবাই পাড়ি জমালেও এ্যাডজাস্ট করতে না পেরে স্বামীকে ডিভোর্স করে রামিসাসহ সোজা দেশে। সেই সময়টাতে মা-ই সহানুভূতি দেখিয়ে তাদের সঙ্গে প্রাকটিস করতে বললে এ বাড়িতে আসা-যাওয়া পথ সহজ হয়েছিল। বাবাকে বোধহয় রবীন্দ্রনাথের শেষের কবিতার লাবণ্যর চেয়ে কেটি মিত্রের চরিত্র বেশী আকর্ষণ করেছিল। তাই তো মিলনাত্মক গল্পের কাহিনী বিয়োগান্তকে মোড় নিয়েছিল রোমেনা আন্টির সঙ্গে সম্পর্কে জড়িয়ে। মার অপমৃত্যুতে বাবা প্রায়শ্চিত্ব করত সারাদিন এলকোহলের মধ্যে ডুবে, ফলে হার্ট লিভার সব শেষ। সব জেনেও অকৃতজ্ঞ রোমেনা আন্টি বুটিকের নামে দেদারসে মার টাকা অপচয় করছিল। রামিসা গায়ে পশ্চিমা সংস্কৃতি জড়িয়ে ফেসবুক জালে হাবুডুবু খাচ্ছিল। একমাত্র গালিবাই ছিল তাদের পথের কাঁটা। নানী-মামা এই ফ্লাটে না থাকলে গালিবাকেও তারা বনবাসে দিত, নয়তো বাড়ির চাকরানী বানিয়ে রাখতো। ভাগ্যিস তারা ছিল!  গালিবা তাই সিন্ডরেলা মন নিয়ে বাড়ির পোষা প্রাণীদের বন্ধু বানিয়ে অপেক্ষায় থাকতো কোন রাজপুত্রের।
   ৪৫ মিনিটের পথ ৩ ঘন্টায় পাড়ি দিয়ে বাড়ি ফিরে গালিবা গোল্ডি ও সিলভানার কাছে গিয়ে বসল। প্রাণীদের প্রতি তার এই অপত্য ¯েœহ নাকি স্বর্গীয়-বাবার ভাষ্য ছিল।  ৮বছরের জার্মান সেফার্ডটি অন্য দিনের মতো দু’পায়ের উপর দাঁড়িয়ে জড়িয়ে ধরলো কিন্তু মেঝেতে ফেলে জ্বিভ দিয়ে গাল চেটে দিল না, শুধুমাত্র মাথাটা বুকের সঙ্গে ঘঁেষ রুমের দিকে চলে গেল। অ্যালিসের ব্যাবহারে কিছুটা বিস্মিত হলো, হঠাৎ শ্যানেলের ঘ্রাণ নাকে গেলে বোনের ঘরের দিকে আগায়। শ্যানেল মার প্রিয় ব্রান্ড ছিল বলে ওদেরও প্রিয়। দরজা খুলে দৃশ্যত সব কিছু মাথায় রক্ত চড়ার জন্য যথেষ্ট হলেও নিস্তব্ধ হয়ে গেল এ্যকোরিয়ামের দিকে তাকিয়ে। বিধ্বস্ত রুমে বিছানার উপর স্তুপাকারে মা ও লাবিবার পরিধানের কাপড়, অলংকার ও পারফিউমের বোতল পড়ে আছে। গালিবা পাথরের চোখ দিয়ে দেখল, স্বচ্ছ পানিতে গোল্ডফিশ দু‘টোর স্থির হয়ে আসা দৃষ্টি।
   বছর কয়েক আগে মায়ের হাতে সাজানো ডাইনিং-লাউঞ্জ- বেড রুম-রিডিং রুম-বারান্দা- পোর্চ সব ডেভেলপারদের হাতুড়ির আঘাতে একের পর এক আস্তর খুলে কঙ্কাল বেরিয়ে এলে ছোট গালিবা প্রতিবাদ জানিয়েছিল দু’দিন না খেয়ে থেকে। অধ্যাপক নানা-নানী কষ্টকে সহজ করার জন্য কত প্রলোভন দেখিয়েছি। বলেছিল, চারিদিকে দেখ, সবার বাড়ি কত ঝকঝক করছে! তোমরটাও ওদেরটা চেয়ে বেশী সাইনি হবে। রিয়েলি উই মিন ইট!
  ইটের পর ইটের গাঁথুনি, পলেস্তারা, ঝকঝকে ইটালিয়ান টাইলসের নিচে চাপা পড়ে গেল বনানীতে শুয়ে থাকা মার কবরের মতো বাড়িটি। সেদিন প্রতিবাদের ভাষা না খেয়ে থাকা হলেও এই মুহূর্তে তার কি করা উচিত? গালিবা ধীর পায়ে এ্যাকোরিয়ামের সামনে এসে সাইড টুলে বসে গ্লাসে টোকা দিলে ঁেঠাট এগিয়ে কিস করবে ভেবে অপেক্ষা করল। না দু’জনের কেউই এলো না, শুধু একটু লেজ নেড়ে উপরে ওঠার চেষ্টা করে ডাস মেরে রইল। অজানা ভয়ে অস্থির গালিবার চিৎকারে সমস্ত বাড়ির ভিত কেঁপে উঠলো। আতঙ্কিত রামিসা ড্রেসিংরুম থেকে তীব্র পারফিউমের ঘ্রাণে বাতাস ভারী করে, হাই হিলের টকটক শব্দে গালিবার হৃদয় গুড়িয়ে দৌড়। ছয়ে পা রাখার পর থেকে রামিসা এই বাড়ির স্থায়ী বাসিন্দা। ১৪বছর বয়সে প্রত্যাশার অধিক প্রাপ্তি তাকে বিগড়ে দিয়েছিল। রোমেনা আন্টির প্রশ্রয়ে  বাড়ির সবকিছুর উপর তার অনধিকার চর্চা বাবা দেখেও না দেখার ভান করতো। শুধু বলতো, সম্পর্কে এখন সে তোমার ছোটবোন। একটু এ্যাডজাস্ট ক্ষমতা বাড়াও দেখবে সব ঠিক।’
  আর কতো এ্যাডজাস্ট ক্ষমতা বাড়ালে গোল্ডফিশরা রক্ষা পেত! শূন্যের কাছে অভিযোগগুলো কান্না হয়ে আকাশ ভেঙ্গে অঝোরে ঝড়তে থাকে। মাছেরা অসুস্থ হলে কী করা উচিত! এমন সময় ল্যান্ড ফোন বেজে উঠলে অবচেতন মনে তার মুখ থেকে বেরিয়ে আসে, ওয়াট ডু উই ডু হোয়েন দ্যা ফিশ ইজ ইল!
-    হোয়াট! মিসেস রোমেনা কৌতূহল নিয়ে বলে, হোয়াট আর ইউ টকিং এ্যাবাউট! আর ইউ ওকে!
-     প্লিজ হেল্প মি, সেভ মাই গোল্ডফিশ!
-   ডোন্ট ওয়ারি! ইট জাস্ট এ্যা ফিশ! এভরি থিং উইল বি ওকে। নাউ যাস্ট প্রে ফর ইউর ফাদার। ডাক্তার বলেছে আজ রাতেই ওপেন হার্ট হবে। সবাইকে দোয়া করতে বলো। টেক কেয়ার।
  টেলিফোন রাখার শব্দটা তাকে পৃথিবীতে ফেরত আনলে একটু আগে শোনা কথাগুলো ধাতস্ত করতে কষ্ট হলেও দৃষ্টি পুনরায় এ্যাকোরিয়ামে। মাছের ব্যপারে কে তথ্য দিতে পারবে ভাবতে গিয়ে প্রথমেই বাবার মুখটা ভেসে ওঠে। ‘গোল্ডফিশ সৌভাগ্যের প্রতীক’ বিশ্বাস করে বাবা মেয়েদের গিফট করেছিল। বলেছিল, শুধু সৌভাগ্য না তোমাদের উপর কারো নজর লাগার আগে যেন এই মাছেদের উপর দিয়ে যায়।’ সেদিন গালিবার অসহায় গোল্ডফিশ দুটোকে বলির পাঠা মনে হলেও লাবিবা তাদের দুটো সুন্দর নাম দিয়েছিল। জনপ্রিয় ফেন্সি জাতের সাদা ও কমলা কম্বিনেশনের মধ্যে আংশিক সাদার পরিমান বেশিটা সিলভানা। অন্যটার মধ্যে সোনালী রঙের প্রভাব বেশি বলে গোল্ডি।  মাছ দুটি সুন্দর নাম দিয়ে বেশ গর্বিত হয়ে বাবার কাছে নিয়ে গেলে সে বলল, আমার কাছে তো এ দুটোকে মনে হচ্ছে লাবিবা ও গালিবা। সিলভানাকে দেখিয়ে বলল, দেখ লাবিবার মতো শান্ত। গোল্ডিকে দেখিয়ে বলল, একদম গালিবার মতো গাল ফোলান।’
 গালিবা মুখ গম্ভির করে বলেছিল, এই দু’টো হচ্ছে, তুমি আর মা।’ বাবার মন তাতে ক্ষনিকের জন্য নষ্টালজিক হলেও বাবা- মেয়েদের আহ্ল্াদে আড়ালে কোথাও হৃদয় পোড়া গন্ধ গালিবার নাক ঠিকই স্পর্শ করেছিল।
  লাবিবা চলে যাবার পর প্রতিদিন গালিবা গুগলে দেখত, হাউ টু লুক আফটার এ্যা গোল্ডফিশ। সেভাবে গোল্ডফিশ দু’টোকে বেশি অক্সিজেন পাবার জন্য রাউন্ড বোল থেকে ফ্লাট এ্যাকোরিয়ামে আনার আগে ২ থেকে ৩ দিন ধরে পানিতে মেডিসিন মিশিয়ে প্রস্তুত করে তারপর বাইরের টেম্পারেচারের সঙ্গে এ্যাডজাস্ট করে রুম অন্ধকার করে ছেড়ে দিয়েছিল। প্রতিদিন দু’বেলা দুটো করে ফিশফুড দিত সঙ্গে মাছদের স্বাস্থ্য পর্যবেক্ষণ, সপ্তাহান্তে একবার পানি চেঞ্জ ও এ্যাকোরিয়াম ক্লিন করতো। ফেন্সি জাতের মধ্যে মুরস, অরানডাস, ফানটেইলস, র‌্যানছুস, বাবল-আইস, সেলিসটেইলস ও লায়নহেডস নানা প্রজাতির গোল্ডফিশের ছবি দেখে বের করেছিল তাদেরটা ফানটেইল প্রজাতির। ডিম্বাকৃতি দেহ, ফাঁপানো চোখ, পৃষ্টদেশে উঁচু একটা ডানা, ঘারে কুঁজ ছাড়া  সিলভানা ও গোল্ডি ছিল লম্বা ঝুলে পড়া লেজের অধিকারী। পানির রসায়ন প্রিয় পানির মধ্যে গোল্ডফিশদের নিরাপদে বিচরণ করার সৌন্দর্য ছিল অবর্ণনীয়। মনে হত স্বর্গীয় দূতেরা মাছের রুপ নিয়ে তাদের আগলে রাখছে; সৌভাগ্য বিতরণ করছিল বলে গালিবা ওলেভেল-এলেভেলে অল এ পেয়েছিল। রোমেনা আন্টির কুনজর ডিঙ্গিয়ে গালিবার পড়ার সব খরচ বাবা তার এ্যাকাউন্টে ট্রান্সফার করেছিল। অন্যদিকে গোল্ডি ও সিলভানাকে দেখভালের উছিলায় গালিবার ক্ষত হৃদয়ে মলমের প্রলেপ দিত।
   বাবাতো চিকিৎসার জন্য সিঙ্গাপুর মাউন্ট এ্যালিজাবেথ হসপিটালে মনে হতে গালিবার গোল্ডফিশদের বাাঁচাতে মামার কাছে দৌড়ায়.. বুয়ার মামা হসপিটালে খবরটা দিলে  হাতে সময় কম ভেবে দ্রুত সিঁড়ি দিয়ে নামতে গিয়ে শোনে ভেতর থেকে নানী বলছে, বাবার জন্য দোয়া কর..।’ গালিবার নানীর কথা শোনার সময় কই! সে কম্পিউটারে ফেসবুক স্ট্যাটাটে কমেন্টস লেখে, প্লিজ হেল্প মি সেভ মাই গোল্ডফিশ!
   নিঃশ্বাস ফেলার চাইতেও দ্রুত পৌছে যায় গালিবার বন্ধু মহলে। অপেক্ষার প্রহরে সেকেন্ড ঘন্টায় পরিণত হলে পুনরায় মাছদের কাছে বসে। বন্ধুপ্রিয় গোল্ডফিশদের স্মৃতি কয়েক সেকেন্ড স্থায়ী হলেও তাদের তীক্ষè দৃষ্টিশক্তি আলাদাভাবে গালিবাকে চিহ্নিত করতে পারতো বারবার দেখে। গলার স্বর ও শব্দতরঙ্গের মাধ্যমে তারা তাকে বন্ধুর মতো আপন করেছিল।
  এই মুহূর্তে গোল্ডফিশ দু’টো বন্ধুর ডাকে সাড়া দিতে পারছে না বলে নিজেদের অপরাধি মনে করে। তারা ঈশ্বরের কাছে মানুষের ভাষায় কথা বলার জন্য প্রার্থনা করলো। গালিবাকে বলতে চাইল, পরজন্মে তুমি মাছ হয়ে জন্ম নিও। তোমার দুঃখ ভোলাব।’
   গ্লাসে আঙ্গুল দিয়ে গালিবা অনবরত টোকা দেয়। নাহ! নড়ছে খুব আস্তে। পানির মধ্যে মেলে ধরা তাদের লেজ, ডানা ধীরে ধীরে নেতিয়ে পড়ছে। সিলভানার দেহ হাফ সার্কেল হয়ে নিচে গিয়ে কুচিকুচি পাথরে আঘাত প্রাপ্ত হলে কিছুটা নড়ল কিন্তু উপরে ওঠার চেষ্টা করলো না।
  গালিবা ভালো করে তাদের পর্যবেক্ষণ করলো; কোন সাদা চিহ্ন কিংবা ফিন রট (ডানা বিকৃতি বা ক্ষত) আছে কিনা। এর আগেও অসুস্থতা দেখা দিলে একটি মগে অল্প পানিতে মেডিসিন মিলিয়ে পুরো এ্যাকোরিয়ামে আস্তে আস্তে ঢেলে দিলে কিছুক্ষণ পর ভাল হয়ে যেত। আজও তেমন করলে কিছুই হলো না। হঠাৎ খেয়াল হল ঘরে এসির টেম্পারেচার কম ছিল বলে রুম ঠান্ডা হয়ে পানিকে ঠান্ডা করেছে ভাবতেই এসি বন্ধ করে দরজা-জানালা খুলে দিল। একমাত্র গোল্ডফিশদের জন্য লাবিবার রুমের টেম্পারেচার সব সময় ২২-২৪ ডিগ্রি সেলসিয়াসের মধ্যে রাখতো। রামিসা সেটা ১৭তে নামিয়েছিল।
  এরই মাঝে ফেসবুকে লাইকিং এসেছে দুইটা। আশ্চর্য! ‘মাছকে বাঁচাতে এগিয়ে আসুন’-এতে লাইকিং দেবার কি আছে? অস্ট্রেলিয়া থেকে মামাতো ভাই ফাহাদ মন্তব্য করেছে, এদের রাখতে হয় রেকট্যাঙ্গেল কাঁেচর জারে।’ কানাডা থেকে অরাত্রিকা -‘রাপিড চেঞ্জেস ইন টেম্পারেচার ক্যান কিল দেম।’ সাকিব লিখেছে, মোস্ট গোল্ডফিশ ইলনেসেস ক্যান বি ট্রিটেড উইথ মেডিকেশন।’
 গালিবার জানা তথ্যগুলো বন্ধুরা জানাচ্ছিল তাতে নতুন কিছুই ছিল না। অগত্যা ফেসবুক থেকে মুখ ফিরিয়ে মামাকে ফোন করল, হ্যালো মামা, মাছদের বাঁচাতে কি করা উচিত? তুমি তো ডাক্তার, প্লিজ হেল্প মি!
-  মি. দত্তকে ফোন করছ?
-করেছিলাম, উনি যেভাবে বলেছে সেভাবে করলাম, কিন্তু কাজ হচ্ছে না।
- কাঁটাবনে যার কাছ থেকে খাবার আন তাকে ফোন কর, নয়ত লাইব্রেরি রুমে মাছেদের বিষয়ে বইগুলো পড়। আশ্চর্য ! তুমি একদম বন্যা আপার মতো করছ!..অনেক বছর আগের কথা, তোমার বাবা এক কান্ড করলো। আগে ইউরোপে এক সনাতন নিয়ম ছিল বিয়ের প্রথম এ্যানিভারসারিতে ভালবেসে স্বামী স্ত্রীকে একজোড়া গোল্ডফিশ উপহার দিলে পরবর্তি বছরগুলো শুভান্বিত ও সমৃদ্ধশালী হয়। এই ভেবে প্রচন্ড ইউরোপভক্ত তোমার বাবা তাদের প্রথম বিয়ে বার্ষিকীতে আপাকে একজোড়া গোল্ডফিশ দিল। আপাও  তাদের নিয়ে সারাদিন ব্যস্ত থাকতো। তোমার মনে আছে কিনা জানি না, গোল্ডফিশ বেশি দিন বাঁচে না, কিন্তু সেগুলো অনেকদিন বেঁচেছিল।
   মামার কথায় বিব্রত গালিবার স্মৃতিতে মায়ের এ্যাকোরিয়াম ক্লিন করার দৃশ্যটা কিছুটা স্পষ্ট হয়। শুনেছিল আমাদের দু’বোনকে আয়ার কাছে বসিয়ে প্রতিটা পাথর কুচি, প্লাস্টিকের লতা-গুল্মগুলো, অক্সিজেনের নল পর্যন্ত মমতার মাখিয়ে পরিষ্কার করতো। হঠাৎ করে সেই মাছদুটোর ভাবনাও তাকে বিচলিত করে। ফ্লাটে ওঠবার পর তাদের আর দেখা যায় নি।
- মন খারাপ করো না, সব ঠিক হয়ে যাবে। দুলাভাইয়ের বাইপাস লাগবে। কেয়ারটেকার মজিদ মসজিদে বাদ মাগরিব মিলাদে আপার জন্মদিনের সঙ্গে দুলাভাইয়ের জন্যও দোয়া করতে বলবে। অপারেশন সাকসেসফুল হলে একটা কেক নিয়ে আসবো।’
 
  মামা ফোন রাখলে দরজা ঠেলে অ্যালিস এসে গা ঘেষেঁ দাড়ায়। গালিবা কি মনে করে বারান্দায় গিয়ে লাভ-বার্ডদের মুক্ত করে দিল। অনেকদিন বন্দী থেকে উড়তে ভুলে যাওয়া পাখিগুলো কোথাও না গিয়ে বারান্দায় আনমনে বসে থাকে। ঘরে ঢুকে পুনরায় এ্যাকোরিয়ামের পাশে বসে মোবাইল থেকে কাঁটাবনের ফোন নাম্বার খোঁজে। কল লিস্টে বন্ধুদের নাম দেখে খুব মিস করছিল সঙ্গে বাবাকেও। বাবার কথা মনে হতে ফিলিং এসে নিয়মমাফিক তার শক্ত চোয়ালকে ধাক্কা মেরে, অহংকার ভেঙ্গে দাঁড় করিয়ে দেয় প্রচন্ড আবেগের সামনাসামনি। আবেগী কষ্টগুলো মনের হ্রদে অসহায় মাছ হয়ে সাঁতার কাটে যেন দুটি গোল্ডফিশের একটি মরে যাবার পর আরেকটি মরার অপেক্ষায়। চোখের সামনে গোল্ডি নিস্তেজ হয়ে এক সময় দৃষ্টি মেলে দৃষ্টির আড়ালে চলে গেল। সঙ্গী চলে যাবার পর সিলভানা কিছুটা শক্তি সঞ্চার করে নড়লো, ডানা দুটো দিয়ে সাঁতরে আগাল, লেজ লেড়ে ঠোঁট ফাক করে গ্লাসে মুখ লাগিয়ে গালিবাকে স্পর্শ করলো। কষ্টের হ্রদে সাঁতার কাটা গোল্ডফিশটা হয়তো শেষবারের মতো একটি প্রবাহিত নদীর সন্ধান পেয়ে গেছে।