ড. মহীউদ্দীন খান আলমগীর
বিদ্যাধর সূর্যপ্রসাদ নইপল ২০০১ সালে সাহিত্যে নোবেল পুরস্কার পেয়েছিলেন। গত ১১ আগষ্ট ২০১৮ এ ৮৫ বছর বয়সে তিনি তার চূড়ান্ত পর্যায়ে পছন্দের বাসস্থান লন্ডনে পরলোক গমন করেন। তার জন্ম হয়েছিল ১৯৩২ এর ১৭ আগষ্ট, ট্রিনিদাদ ও টবাগোর চাগুয়ানাসে। নিজকে ভি এস নইপল নামে পরিচিত রেখে প্রায় ৫০ বছর ধরে তিনি ৩০ টিরও বেশী উপন্যাস ও কল্প কাহিনী এবং ভ্রমন ও অভিজ্ঞান ভিত্তিক বই আমাদেরকে ইংরেজী ভাষায় উপহার দিয়ে গেছেন।
১৯৭৬ সালে জাতিসংঘের উন্নয়ন কার্যক্রম সংস্থার পরামর্শক হিসাবে উগান্ডায় ছিলাম আমি কয়েক মাস। উগান্ডার রাজধানী কামপালায় পাহাড় ও বনরাজির পরিমন্ডলে ছবির মত বসানো আফ্রিকার নামকরা ম্যাকরারে বিশ্ববিদ্যালয়ে স্বৈরতান্ত্রিকতায় পরাক্রম প্রতিভূ ইদি আমিনের পতনের পটভূমিকায় প্রথম শুনি নইপলের নাম। তিনি ১৯৬৫-৬৬ সালে এই বিশ্ববিদ্যালয়ে নিবাসী লেখক হিসাবে থাকবার, লেখার এবং উগান্ডা, কেনিয়া ও রুয়ান্ডার প্রত্যন্ত এলাকায় ঘোরার সুযোগ পেয়েছিলেন, আফ্রিকার লোক মানস ও সংস্কৃতির সাথে নিবিড় ভাবে পরিচিত হয়েছিলেন। ম্যাকরারে বিশ্ববিদ্যালয়ের অঙ্গনে তার নাম শুনে আমি প্রথম তার লেখা ‘আঁধারের এক এলাকা’ ( অহ অৎবধ ড়ভ উধৎশহবংং, ১৯৬২) বইটি পড়ি। প্রায় অবিশ্বাস্য সততা ও সাধারন মানুষের প্রতি মমত্ববোধ নিয়ে নইপল এই বই- যা মূলত ভ্রমন বৃত্তান্ত- এ ইংল্যন্ড থেকে আগত ভারতের উত্তর প্রদেশে দারিদ্র জর্জরিত ভিন্নতর ও দুর্বল আর্থ-সামাজিক পরিমন্ডলে তার পিতৃপুরুষের ভিটা খুজতে যেয়ে দেখলেন এক বুড়িকে, যিনি সেখানকার অভাব ও অপ্রাপ্ততায় আত্মসম্মান হারিয়ে তার চকচকে ইংলিশ জুতো আকড়িয়ে ধরে ছিলেন। বুড়ির কাছে সেই চকচকে জুতো পায়ে মানুষটি ভিন্নতর ও উন্নততর এক পরিমন্ডলের অধিকারী হিসাবে রূপ পেয়েছিলেন। দারিদ্রের প্রেক্ষাপটে মহাসাগরের ওপাড়ের বার বার শোনা বিত্তের বৈভব ভারত উপমহাদেশের সাধারন মানুষকে ভিন্নতর ও উন্নততর জগতে মুক্তি পাওয়ার প্রায় অসম্ভব অভিলাষে আচ্ছন্ন এবং সম্ভবতঃ নিজ দেশের প্রতি অনীহা নিয়ে জীবনকে দায় হিসাবে নিয়ে ধুকতে ধুকতে চলতে বাধ্য করে বলে নইপল প্রকারান্তরে বলতে চেয়েছেন। ভারত নইপলের অনুভূতি ও উপলদ্ধিতে এক আহত সভ্যতা বা আবেগের নিলয় যা তিনি সহজ সাধারন কথায় মনকাড়া ভাবে তুলে ধরেছেন। ১৯৭৭ সালে এই অনুভূতিই প্রকাশ পেল আরও একটি ভ্রমন বৃত্তান্ত ‘ ভারত- এক আহত সভ্যতা’য়(ওহফরধ: অ ডড়ঁহফবফ ঈরারষরংধঃরড়হ,১৯৭৭)। তার মতে এই সভ্যতাকে অনধিকার ভিত্তিক পরাক্রম নিয়ে তার মূল সত্ত্বা ও পরিচিতি থেকে দূরে সড়িয়ে দিয়েছে ইসলাম ও খৃষ্ট ধর্ম ভিত্তিক ভিনদের্শী আগ্রাসন। এই অনুভূতি অনেকাংশে সংবেদশীলতায় মুক্তি পায় ১৯৯০ সালে প্রকাশিত ‘ভারতঃ এ সময়ের লক্ষ দ্রোহের নিলয়’ (ওহফরধ: অ গরষষরড়হ গঁঃরহরবং ঘড়,ি১৯৯০)এ।এর পরে একে একে তেমনি চমকতায় মুগ্ধ হয়েছিলাম ‘বিশ্বাস মহোদয়ের বাড়ী’ (অ ঐড়ঁংব ভড়ৎ গৎ. ইরংধিং, ১৯৬১) ‘নদীর এক বাঁক’ (অ ইবহফ রহ ঃযব জরাবৎ, ১৯৭৯) ‘এক মুক্ত রাষ্ট্রে’ (ওহ ধ ঋৎবব ঝঃধঃব, ১৯৭১) ও ‘মিগুয়েল সড়ক’ (গরমঁবষ ঝঃৎববঃ, ১৯৫৩) পড়ে। ‘ বিশ্বাস মহোদয়ের বাড়ী’ তে নইপল ত্রিনিদাদে ভারতীয় বংশো™ু¢ত তিন প্রজন্মের বিবর্তনীয় উন্মেষ তুলে ধরেছেন। এই উপন্যাসের নায়ক তার দারিদ্র থেকে উঠে আসা সংগ্রামী সাংবাদিক পিতার প্রতিচ্ছবি বিশ্বাস মহোদয় তার বিশ্বকে ব্যাপক প্রচেষ্টা সত্ত্বেও অপরিবর্তনীয় বলে দেখে নিজকে অনাকর্ষনীয় কোনকিছুর পর্যায় থেকে তুলে পৃথক সনাক্তীয় সত্ত্বায় উঠিয়ে নিয়েছিলেন। তার লেখায় তিনি বিফল আকাংখা সত্ত্বেও অস্তিত্বের সংকটে হারিয়ে যাননি। ‘নদীর এক বাঁক’ এ নইপল ক্যারিবিয়ান এলাকার গণউত্থানের পটে পৃথিবীকে তুলে ধরেছেন অর্থহীন অবয়বে-এমনকি কোন অর্থ-বহনের সম্ভাবনার বাইরের স্তবক হিসাবে। তার চারদিকের অর্থবিহীন বর্তমানকে পেছনে রেখে অর্থ উদ্দীপনের নিলয় হিসাবে পরিপার্শ্বিকতাকে দেখার এবং দুঃখে লালিত অভিলাষ অনুযায়ী আর্তি ফুটে উঠেছে এই উপন্যাসে। ‘এক মুক্ত রাষ্ট্রে’(১৯৭১) নইপল আফ্রিকার নাম-না-বলা ছোট এক দেশের মাঝ দিয়ে এক ইংরেজ সুশীল সেবকের সাথে তার বন্ধুর স্ত্রীকে সঙ্গী করে গাড়ী চালানো ভ্রমনকে কেন্দ্র করে সেদেশের রাজনৈতিক অস্থিতির অর্থহীনতাকে সাধারনের নিরাপত্তার নির্দিষ্ট অস্তিত্বে ফিরে নিয়ে যাওয়ার অভিলাষ তুলে ধরেছেন। এর বর্ননা ও সংলাপ দিয়ে নইপল তার চারপাশে দাড়ানো অর্থহীন বর্তমানকে, অর্থবহ ভবিষ্যতে নিয়ে যাওয়ার আর্তি তুলে ধরেছেন।‘মিগুয়েল সড়ক’ এ নইপল তার তারুণ্যের ত্রিনিদাদের এক নি¤œবৃত্ত ঘিঞ্জি শহর এলাকার জীবনধারার দৃশ্যমান অর্থহীনতা, ব্যর্থতা কিংবা সামনে এগিয়ে যাওয়ার সন্দিপনের অনুপস্থিতি নিপুনভাবে ফুটিয়ে তুলেছেন। এই ধরনের করুন ও প্রায় নিস্ফল জীবন থেকে মুক্তি নেয়ার মানবিক প্রয়োজনীয়তা তিনি তুলে ধরেছেন সবাইর বিবেককে সাড়া দেয়ার লক্ষ্যে। তার ‘মধ্য পথ’ ( ঞযব গরফফষব চধংংধমব, ১৯৬২) তার জন্ম দেশের সমাজ ব্যবস্থার অকৃত্রিম প্রতিফলক। সময়ব্যাপ্ত নিস্ফল আর্থ- সামাজিক প্রচেষ্টার প্রেক্ষিতে তিনি নিরাশার সাথে বলেছেন যে ঐ ধরনের প্রচেষ্টা পূর্নাঙ্গ মাত্রায় সফল হবেনা। এ সবগুলো বইয়ে সাধারন্যে দৃশ্যমান, নিরানন্দ ও দারিদ্রে ঘেরা পটে পাঠককে ভাবিয়ে তোলার উপকরনাদি কম কথায় ও সোজা ভাষায় হৃদয় স্পর্শ করে বলতে পেরেছেন নইপল। প্রায় ৫০ বছর ধরে ৩০টির চেয়েও বেশী উপন্যাস, ভ্রমন বৃত্তান্ত ও ব্যক্তিগত প্রবন্ধ লিখে গেছেন তিনি। তার অনুভূতি ও উপলদ্ধি ভারত ও আফ্রিকার সাধারন মানুষের অনুকূলে হলেও তাদের পরিমন্ডল পরিবর্তনের প্রয়োজনীয়তা তিনি অকপটে এবং ভাবনার খোরাক হিসাবে সবাইর সামনে তুলে ধরেছেন। এরূপ বিষন্নতা ভিত্তিক পরিবর্তনের অবচেতন ডাক অবশ্য সবসময় প্রকাশ পেয়েছে ইংরেজীতে। কোন ভারতীয় বা আফ্রিকান ভাষার চর্চা নইপল করেননি। ১৯৭১ সালে তিনি বুকার পুরস্কার পান ‘এক মুক্ত রাষ্ট্রে’এর জন্য। তিনটি ছোট গল্পের সংকলনে তিনি এই বইয়ে ৩টি ভিন্নতর রাষ্ট্রের পরিবেশ ও লোক মানস তুলে ধরেছেন। ২০০১ সালে সাহিত্যে নোবেল পুরুস্কারে ভূষিত হন তিনি। স্বাভাবিক জীবন ধারার বাইরে নিজ আবহ থেকে দূরে সড়ে যাওয়া বা আসা মানুষকে তার লেখায় উপজীব্য হিসাবে ফুটে উঠানোর পটে সাহিত্য আলোচকরা তাকে উদ্বাস্তুদের কবি (চড়বঃ ড়ভ ঃযব উরংঢ়ষধপবফ) হিসাবে আখ্যায়িত করেছেন। নইপল তার লেখা সম্পর্কে নিজেই বলেছেনঃ লেখার ভেতর দিয়ে তার আত্মা, হৃদয় ও স্মৃতির গভীরতম অংশ স্পর্শ করে উথলে উঠে (ঘবি ণড়ৎশ জবারবি ড়ভ ইড়ড়শং, এপ্রিল ২৩, ১৯৮৭)। নোবেল পাওয়া উপলক্ষ্যে তার দেয়া বক্তৃতায় তিনি বলেছেন, তিনিত তার বইয়ের মধ্যেই মিশে আছেন, তার বইগুলোই তিনি। তার মতে সকল সাহিত্যিকের অবয়ব বা কর্ম বস্তুনিষ্টতার বাইরে মৌলিকতা বিবর্জিত বা কৃত্রিম এবং তা বিবর্তমান সংস্কৃতির নতুন সুরে ও মানসের সাথে খাপ খাওয়ানোর প্রক্রিয়ায় নিয়ত পরিবর্তনশীল।
নইপলের জন্ম হয়েছিল ব্রিটিশ শাসিত ট্রিনিদাদ ও টোবাগোর চাগুয়ানাসে। তার পূর্ব পূরুষরা ১৮৮০ এর দশকে চুক্তিবদ্ধ আখচাষী হিসাবে ভারত বা নেপাল হতে দারিদ্র থেকে মুক্তির লক্ষ্যে ট্রিনিদাদ ও টোবাগোতে এসেছিলেন কিংবা দাস হিসাবে তাদেরকে উপনিবেশ স্থাপনকারী শেতাঙ্গ বিত্তবানদের অধিকতর বিত্ত আহরনের জন্য আনা হয়েছিল। তার নইপল গোত্রিক নাম ভারতের উত্তর প্রদেশ নয়, লাগোয়া নেপালের ঐ নামীয় গোত্র উৎসারিত বলে জানা যায়। তার বাবা শ্রীপ্রসাদ নইপল ১৯৩০ এর দশকে ত্রিনিদাদে তার পৈতৃক দারিদ্রের বাইরে নিজ ভাষার চর্চা ছেড়ে একজন ইংরেজী ভাষার সাংবাদিক হিসাবে কাজ করেছেন। নইপলের মা দ্রোয়াপাতি কপিলদেও সেখানকার- ভারতীয় সমাজের উৎসারন, স্বামীর তুলনায় বিত্তশালী ছিলেন। সাংবাদিক বাবার জীবন ও বৃত্তি নইপলকে লেখক হিসাবে নিজকে বিকশিত করার স্বপ্ন দেখিয়েছিল। ৬ বছর বয়সে নইপল তার বাবা-মার সাথে চাগুয়ানস থেকে ট্রিনিদাদের রাজধানী পোর্ট অব স্পেনে আসেন এবং সময়ান্তরে সেখানকার নামকরা সরকার পরিচালিত মহারানীর রাজকীয় কলেজে পড়াশোনা করেন। শিক্ষার সংগ্রামে তিনি ছিলেন অকুতোভয় ও সার্বক্ষনিক। ফলতঃ এই কলেজ থেকে সরকারী মেধাবৃত্তি নিয়ে তিনি ইংল্যান্ডে আসেন এবং অক্সফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয় কলেজে সে কালের অভিজাত বিষয় ইংরেজী সাহিত্যের ছাত্র হিসাবে যোগ দেন। অক্সফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয় কলেজে ইংরেজী সাহিত্যের সাথে তার এই পরিচয় ভাষার নিরন্তর ও নিরলস চর্চায় উন্নীত হয়। ইংরেজীকে তিনি তার সকল অনুভূতি প্রকাশের একমাত্র মাধ্যম হিসাবে গ্রহন ও প্রয়োগ করতে থাকেন। সেখানে তিনি সহপাঠী প্যাট্রিসিয়া এনহালের অকৃত্রিম বন্ধুত্ব পান। ১৯৫৩ সালে তারা দুজনই অক্সফোর্ড থেকে ¯œাতক হয়ে বেড়িয়ে আসেন। প্যাট্রিসিয়া তার সেবাযত্ন ও আর্থিক সংগতির ভার নিয়ে তাকে বিত্তস্বল্প জীবন সত্ত্বেও লেখার চর্চায় সারা জীবন সন্দিপীত করে গেছেন। ১৯৫৪ সালে তিনি ও প্যাট্রিসিয়া আক্সফোর্ড থেকে লন্ডনে আসেন এবং ১৯৯৫ সালে তারা বিয়ের বাঁধনে একে অন্যকে আবদ্ধ করেন। নোবেল পুরস্কার পাওয়ার আগ পর্যন্ত নইপল নিদারুন অর্থকষ্টে জীবন কাটিয়েছেন। তিনি লন্ডনে থাকাকালীন নামকরা নিউ স্টেটসম্যান পত্রিকার সাথে সংশ্লিষ্ট হন এবং কিছুদিন বিবিসিতেও খন্ডকালীন সম্পাদক হিসাবে কাজ করেন। এই জীবনের এক সময়ে প্যাট্রিসিয়াকে স্বল্প বেতনের শিক্ষক হিসাবে কাজ করেও ইংরেজী সাহিত্যের এই সাধকের ভরন পোষন চালাতে এবং লেখাকে সকল কাজের উপরে রেখে স্বামীর সৃজনশীলতাকে লালিত করতে হয়।
প্যাট্রিসিয়া নইপলকে লিখতে, বাঁচতে ও উপরে উঠতে একনিষ্ঠ সেবা, সহযোগীতা ও সহমর্মিতা দিয়েছেন। এতদসত্ত্বেও নইপাল , মার্গারেট মারে নামক এক মহিলাকে একই সময়ে ২৫ বছর ধরে রক্ষিতা রুপে সময়ান্তরিক সহচর্য দেন। মারগারেট মারে ও প্যাট্রিসিয়ার সহচর্যে থাকাকালীন সময়েও তিনি তিন সন্তানের জননী মাগারেট গুডিং নামে এক বৃটিশ- আর্জেন্টিাইন মহিলাকে প্রায় ২৪ বছর ধরে ১৯৯৫ পর্যন্ত জীবন ও ভ্রমনসাথী হিসাবে সময় দেন। মারে এরুপ ত্রিমাত্রিক জীবন যাপনের স্মৃতি চারন করে নইপলের বিরুদ্ধে সময়ান্তরিক নির্যাতনের কথা উল্লেখ করেছেন, কিন্তু অভিযোগ করেননি। প্যাট্রিসিয়া ও এই বিষয়ে কখনও সরব হননি। ১৯৯৫ এ স্ত্রী প্যাট্রিসিয়া ক্যান্সারে মারা যান আর সাথে সাথে নইপাল গুডিং এর সাথে সম্পর্কের ইতি টেনে অভাবনীয় দ্রুততার সাথে নাদিরা আলভি নামের এক পাকিস্তানী বিধবা সাংবাদিককে বিয়ে করেন। নাদিয়ার সাথে তার পরিচয় হয়েছিল পাকিস্তানের লাহোরে এক মার্কিন কুটনৈতিকের বাসস্থানে। নাদিয়া তার যুবতী জীবনের একাংশ স্বাধীনতা পূর্বের বাংলাদেশে কাটিয়েছিলেন। ২০০৩ সালে তিনি নাদিয়ার আগের ঘরের সন্তান মালিহাকে কন্যা হিসাবে গ্রহন করেন। তার ব্যক্তিগত এই জীবনের উড়নচন্ডীর ধারা অúূর্ন সন্তোষ নিয়ে বেঁচে থাকার পথে কল্পিত সুখ ও তৃপ্তি পাওয়ার সার্বক্ষনিক বাসনার প্রতিফলন বলে ধরা যায়। এই জীবন কথা তিনি বস্তুনিষ্টতার প্রতি অকাট্য বিশ্বস্ততার আলোকে কখনও গোপন করতে চেষ্টা করেননি। সাহিত্য চর্চার পথে সম্ভবত ভিন্নতর কোন কিছুই তিনি ব্যত্যয় হিসাবে গ্রহন করেননি।
২০০১ সালে সাহিত্যে নোবেল পুরস্কার দেয়ার সময় , সুইডিস একাডেমী উল্লেখ করেন যে নইপল তার লেখায় কল্পীয় বিবরনীর সাথে দূর্নীতি- মুক্ত সমীক্ষন মিলিয়ে দিয়েছিলেন এবং তাদের মতে এভাবে মিলিয়ে দেয়া সাধারনতঃ চেপে রাখা ইতিহাসকে আমাদের সামনে উপস্থিত করতে সহায়তা করে। এই প্রেক্ষিতে তাদের সযত্ন বিচারে নইপল এক আধুনিক দার্শনিক। তাদের বীক্ষনে নইপল প্রহরী-প্রখর শৈলীতে ক্রোধকে সঠিকতায় রুপান্তর এবং ঘটনার পরস্পরাকে তার অন্তনিহিত সহজাত পরিহাসে ফুটিয়ে সমাজকে কষাঘাত করেছেন। ভাষার উপর তার নিয়ন্ত্রন এবং সহজ সরল বচন শৈলী পাঠককে তার সনাক্তকৃত সত্য আংশিক সঠিক হলেও পূর্ন বিশ্বাস ও সমর্থনের বলয়ে নিয়ে এসেছে। তার স্মৃতিতে সমকালীন অন্য লেখকদের বিবেচনা বা স্মৃতিতে স্থান না পাওয়া বঞ্চিতদের ইতিহাস দৃঢ়তার সাথে স্পন্দিত হয়েছে। আমার সযত্ন বিবেচনায় সমসাময়িক ইংরেজী ভাষার অন্যান্য লেখকদের তুলনায় অন্যকে সজাগ করার এরূপ নিরানন্দ সক্ষমতা তাকে বিশিষ্টতা দিয়েছে। ইংরেজ না হয়েও এভাবেই তিনি ইংরেজী ভাষাকে ব্যবহারিক দিক-দর্শন দিয়েছেন। তার এই সক্ষমতা আমার প্রতীতি দৃঢ়তর করেছে যে সভ্যতার উৎকর্ষ সাধনে ইংরেজদের সবচেয়ে বড় অবদান ইংরেজী ভাষা এবং স্থিতিশীল ও রাজনৈতিক প্রশাসন, যে ভাষার ভিনদেশী ভিনজাতি চর্চা ও প্রয়োগকে তারা সবসময় স্বাগত জানিয়েছেন এবং যে সমাজ ব্যবস্থার অনুসরন ও পরিমার্জন তারা সবদেশে উৎসাহিত করেছেন।
নইপাল তার লেখায় ধণতান্ত্রিক ও বিত্তশালী প্রথম বিশ্বের আপেক্ষিকতায় তৃতীয় বিশ্বের জাগতিক অপূর্নাঙ্গতাকে তুলে ধরেছেন এবং তৃতীয় বিশ্বের অনুকূলে সকল সহানুভূতি ও সমর্থন দিয়েও প্রথম বিশ্বের স্থিতিশীল আর্থ-সামাজিক বলিষ্টতাকে পছন্দনীয় আশ্রয় হিসাবে বেছে নিয়েছেন। যৌবনের পরিচ্ছন্ন মুখাবয়বের পরিবর্তে শেষ জীবনে তিনি ফরাসী আদলের দাড়ি রেখে হয়ত ইংল্যান্ডের আপেক্ষিক রক্ষণশীলতার বিরুদ্ধে প্রতিবাদ অববায়িত করতে চেয়েছিলেন, কিন্তু তথাপিও সেখানকার সমাজব্যবস্থা ও জীবন শৈলী আফ্রিকা বা এশিয়ার অন্যকোন এলাকার তুলনায় বড় বা গ্রহনীয় বলেই প্রতিভাত করেছেন। তার লেখা ও জীবনধারায় তিনি বর্ন-মানুষের প্রতি সহানুতূতিশীল ও সহমর্মী হয়েও ইংল্যান্ডের অধিবাসী ও ইংরেজী ভাষার শৈলী-সাধক রয়ে গেছেন। ভাষা হিসাবে ইংরেজীকে গ্রহন করে ও এর ব্যবহার শৈলীতে দৃশ্যমান সরল বৈচিত্র এনে তিনি তার উৎকর্ষ সন্ধানী মানসকেও ফুটিয়ে তুলেছেন। ইংরেজ না হয়েও ইংরেজীর এমন তীক্ষè সংবেদনশীল ব্যবহার তার সকল লেখাকে বিশেষত্ব দিয়েছে, ইংরেজ ও ইংরেজী ভাষীদের কাছেও প্রশংসার্হ হয়েছে। তার শেষ জীবনের লেখা ‘অর্ধজীবন (ঐধষভ ধ খরভব, ২০০১) এবং যাদু বীজ’ (গধমরপ ঝববফং,২০০৪) এ উইলী চন্দ্রারে ভারত থেকে লন্ডন, লন্ডন থেকে আফ্রিকা, আফ্রিকা থেকে ভারত হয়ে লন্ডনে এসে থিতু হয়ে বসার কল্পকাহিনী সে সময়কার জীবনের অর্থবিহীন উদ্দেশ্য বিমুখতার উপরে প্রতীতিতে স্থান পাওয়া ধণতান্ত্রিক প্রথম বিশ্বে আশ্রয়- নিলয়ের অনুকূলে উপসংহার যেন তারই জীবন কথা হিসাবে প্রতিভাত। ত্রিনিদাদের আকর্ষন, ইউরোপ-আফ্রিকা ভ্রমনের বৈচিত্র লব্দ সন্তোষ সত্ত্বেও ইংল্যান্ডের সালেসবারীর উইল্টশায়ার এভনকে তিনি তার শান্তির শেষ নিলয় হিসাবে ব্যবহার করে গেছেন। ২০১৬ এর নভেম্বরে তিনি একবার ঢাকা এসেছিলেন। সে সময় আমি ও আমার স্ত্রী, এদেশে অন্যান্যদের মধ্যে তার ২ গুনগ্রাহী, তার তারুন্যের আকর্ষন ক্যারিবিয়ান ছাড়িয়ে আরও দূরে পোটওরিকতে ছিলাম বলে দেখা হয়নি। সেখান থেকে ফিরে এসে তার আহত সভ্যতার নিলয় ভারতের উত্তর প্রদেশ ছাড়িয়ে এই ঢাকায় তার লেখা বইগুলো জীবনবোধের টুকিটাকি হিসাবে আমাদের দুজনের চিত্ত ও চিন্তার বৃত্তে তারপরেও ছড়িয়ে আছে বলে বোধ করছি। জয়তু বিদ্যাধর সূর্যপ্রসাদ নইপল।