বাংলাদেশি বংশোদ্ভূত ব্রিটিশ লেখক জিয়া হায়দার রহমান ২০১৪ সালে তাঁর প্রথম উপন্যাস ইন দ্য লাইট অব হোয়াট উই নো লিখে বিশ্বসাহিত্যে সাড়া ফেলেছেন। এই বইয়ের জন্য ২০১৫ সালে পেয়েছেন ব্রিটেনের জেমস টেইট ব্ল্যাক মেমোরিয়াল পুরস্কার।
জিয়া হায়দার রহমান আমার কাছে এক রীতিমতো বিস্ময়ের নাম। বাংলাদেশি বংশোদ্ভূত কোনো লেখক ইংরেজিতে লিখে অতটা সাড়া ফেলেননি, যতটা জিয়া ফেলেছিলেন ২০১৪ সালে তাঁর ইন দ্য লাইট অব হোয়াট উই নো উপন্যাস দিয়ে। জয়েস ক্যারল ঔটসের মতো প্রথিতযশা লেখক এ উপন্যাসের তুলনা টানলেন কনরাডের হার্ট অব ডার্কনেস-এর সঙ্গে; এমনকি ফিটজেরাল্ড, গ্রাহাম গ্রিন, ডব্লিউ জি সেবাল্ডের সঙ্গেও। জেমস উড এটা নিয়ে এক বড় নিবন্ধ লিখলেন অভিজাত নিউ ইয়র্কার পত্রিকায়, নিউইয়র্ক টাইমস লিখল আধা পৃষ্ঠাজুড়ে। সে বছরের বুকার পুরস্কারের তালিকায় স্থান না হলেও ২০১৫ সালে ভাগ্যে জুটল ‘জেমস টেইট ব্ল্যাক মেমোরিয়াল পুরস্কার’।
তবে বইটি কেন বাণিজ্যিক সাফল্য পায়নি, আমি ভাবি। আমার ধারণা, থিমের দিক থেকে অনেক জরুরি এক উপন্যাস এটি। কিন্তু সাধারণ পাঠককে আকৃষ্ট করবে না- এমন সব বিষয়, যেমন গণিত, দর্শন, জিওপলিটিক্স, যুদ্ধ-ব্যবসার মতো সিরিয়াস বিষয় উপন্যাসটির পাঠকপ্রিয়তাকে ধাক্কা দিয়েছে বড়ভাবে। আমরা দেখতে পাই, যা আমরা জানি বলে ভাবি- তা সত্যিকার জানার ক্ষেত্রে আমরা কত অক্ষম, কারণ বর্তমান জিওপলিটিক্যাল ব্যবস্থা আমাদের অত ‘সত্য’ জানতে দিতে চায় না। এগুলো সবই পাঠকের ভালো লাগে, সন্দেহ নেই। কিন্তু যেই না জিয়া ‘সত্য’ কী, তা নিয়েও প্রশ্ন ও উত্তরের বিশাল রচনা লিখে বসেন, সাধারণ পাঠক তখনই খেই হারিয়ে ফেলেন, বুঝতে পারেন না তাঁরা কী পড়ছেন, উপন্যাস, নাকি প্রবন্ধ?
উপন্যাসটির বাংলা অনুবাদের বেলায় এ সমস্যা প্রকট হয়েছিল। আমি ছিলাম বাংলা অনুবাদ প্রজেক্টের সম্পাদক আর শিবব্রত বর্মন অনুবাদক। যেসব জায়গায় জিয়া গূঢ় দার্শনিক বিষয় নিয়ে কথা বলেছেন কুর্ট গোডেলের গাণিতিক থিওরেমের সঙ্গে মিলিয়ে, সেগুলোয় বাংলা ভাষা কোনো ঠেকনাই দিতে পারেনি এর নিজের প্রাতিষ্ঠানিক শব্দের সীমাবদ্ধতার জন্য।
জিয়া লিখেছেন, যা তিনি লিখতে চেয়েছেন। বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ, ধর্ম ও নাস্তিকতা, পূর্ব ও পশ্চিমের দ্বন্দ্ব- এ বিষয়গুলো আমরা দ্রুত ধরে উঠতে পারি বয়ান ও শাঁসসহ। ‘রেসিজম’ আমাদের চেনা বিষয়, জাতিগত দ্বন্দ্ব আমরা বুঝি। কিন্তু এলিটদের জীবন অভিজ্ঞতাগুলো নিয়ে একটা সাধারণ ঘরের সাধারণ ছেলে কেন তির্যক ও ক্রোধান্বিত হবে এবং হওয়াটা আদৌ যৌক্তিক কি না, তা আমরা ধরে উঠতে পারি না।
সপ্তাহখানেক আগে তাঁকে লিখলাম আমি। জানতে চাইলাম দুটো প্রশ্নের উত্তর: ‘কী লিখছেন এখন? কবে পাচ্ছি দ্বিতীয় উপন্যাস?’ এবং ‘বাংলাদেশ নিয়ে কিছু বলার আছে আপনার?’
জিয়া প্রথম প্রশ্নের উত্তরে জানালেন কীভাবে তাঁর পক্ষে সম্ভব হবে না পাঠকপ্রিয় কোনো লেখা লিখতে বসা, কীভাবে প্রথম উপন্যাস লেখার সময় তিনি বুঝে উঠতে পারেননি যে পশ্চিমে উপন্যাস লিখে জীবিকা নির্বাহ কঠিন। জিয়ার নিজের জবানে: ‘আমি যদি বিষয়টা আগে জানতাম, তাহলে সম্ভবত লেখা প্রকাশ করার জন্য লিখতাম না, স্রেফ লিখতাম নিজের জন্যই, যার মানে হচ্ছে এমন একধরনের লেখা, যা কেবল ছোট এক পাঠকগোষ্ঠীই বুঝবে।’
আর বাংলাদেশ? ‘২০১৪ সালের পর আমি বাংলাদেশে যাইনি, শিগগিরই আবার যেতে পারলে ভালোই লাগত। আমার মধ্যে কোনো ধরনের জাতিচেতনা আসলে নেই, নিজের দেশের অন্য মানুষের কোনো অর্জন আমাকে গর্বিত বা আলোড়িত করে না। শিকড়ের বোধটাই নেই আমার। নিজেকে যতটুকু ইংরেজ মনে হয়, তার চেয়ে বেশি বাংলাদেশি বলে মনে হয় না কখনো। আমার কাছে আমার আত্মপরিচয় আমার কাজ দিয়ে, জন্মস্থান দিয়ে নয়। কিন্তু তারপরও, জীবনের বৃহত্তম অংশ পশ্চিমে কাটানোর পরও, চিন্তা ও স্বপ্ন- দুটোই আমার ইংরেজিতে করা বা ঘটা সত্ত্বেও বাংলাদেশ আমার চিন্তায় পৌরাণিক এক জায়গা নিয়ে আছে। শৈশবের এক বিশেষ গ্রামীণ বাংলাদেশকে আমার মনে পড়ে অনেক আকুতি নিয়েই।’
এই শেষের উত্তরের মধ্যে জিয়া টান দিয়েছেন জাতিসত্তার বোধের ও ‘দেশের মাটি’-সংশ্লিষ্ট চেতনার প্রথাগত বিশ্বাসটা নিয়ে। তাঁর উত্তরের মধ্যেই প্রশ্ন আছে যে শিকড় নিয়ে মানুষের এত মাতামাতি কি স্মৃতি ভালো লাগা থেকে, নাকি অন্যকে অপছন্দ করার এক দারুণ বাহানা তা?
আমি জিয়াকে করা দুটো প্রশ্নের উত্তর নিয়েই ভাবছি আর শুভ কামনা জানাচ্ছি তাঁর পরবর্তী বইয়ের উদ্দেশ্যে। জিয়া জানাচ্ছেন, ‘কোনো উপন্যাস নয়, এটা একটা নন-ফিকশন বই, একটা স্মৃতিকথা। সমাজে শ্রেণি-পার্থক্যের বিষয়টা পশ্চিমের দেশগুলোতে কীভাবে ডানপন্থার জাগরণ ঘটাচ্ছে, তা এই বইয়ে বুঝতে চাইছি আমার নিজের ইংল্যান্ডে শ্রমিকশ্রেণির এক পরিবারে বেড়ে ওঠার অভিজ্ঞতা দিয়ে।’
বাংলাদেশ তাহলে সামনেই আবার তার সবচেয়ে খ্যাতিমান প্রবাসী লেখককে নিয়ে গর্ব করার সুযোগটা পেতে যাচ্ছে শিগগিরই?
পরিচিতি
জন্ম : সিলেটে, অল্প বয়সে মা-বাবার সঙ্গে লন্ডন গমন
পড়াশোনা : অক্সফোর্ড, কেমব্রিজ, মিউনিখ ও ইয়েল বিশ্ববিদ্যালয়
২০১৪: ইন দ্য লাইট অব হোয়াট উই নো নামে প্রথম উপন্যাস প্রকাশ
২০১৫ : ব্রিটেনের জেমস টেইট ব্ল্যাক মেমোরিয়াল পুরস্কার
২০১৭ : হার্ভার্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের র্যাডক্লিফ ইনস্টিটিউট ফর অ্যাডভান্সড স্টাডির ওয়াল্টার জ্যাকসন বেইট ফেলো
লেখা প্রকাশ: নিউইয়র্ক টাইমস ও দ্য গার্ডিয়ান