ঘুমের চেতনাটা ভাঙলেও তন্দ্রাচ্ছন্ন ভাবটা কাটছে না। বিছানাটা যেন মধ্যাকর্ষণ শক্তির মতো চুম্বকীয় আকর্ষণে টানছে। চোখের পাতাটা আরও ভারী হয়ে আসছে। রাজ্যের আলসেমি যেন ভর করেছে। কোনরকমে মোবাইলে আলোটা জ্বেলে দেখে ৪.২০। যাক আর ১০ মি. বিছানায় থাকা যাবে। চোখের পাতাটা বুজে আসে। কিšতু চোখের পাতা দুটো লাগতে না লাগতেই আযানের ধ্বনি ভেসে এলো। আলসেমিটা ঝেড়ে উঠে পড়ে তরু। নাহ্ আর শুয়ে থাকা যাবে না। বিছানা ছাড়ার আগেই একপলক দৃষ্টি বুলিয়ে যায় ঘুমšত স্বামী রফিক আর টুনির দিকে। আরামে ঘুমাচ্ছে ওরা। ঘুমাক আর কিছুক্ষণ। তাড়াতাড়ি উঠে নামায পড়ে কাজে লেগে যায় তরু।
সকালের না¯তা, টুনির ¯কুলের টিফিন, রফিকের লাঞ্চ রেডি করতে করতেই টুনিকে ওঠানোর সময় হয়ে যায়। মেয়েটার ঘুম ভাঙতেই চায় না। একেবারে উঠতেই চায় না। ওর মায়াবী ঘুমšত মুখের দিকে তাকালে আর ঘুম ভাঙ্গাতে ইচ্ছে করে না কি›তু উপায় নাই। স্কুলের দেরী হয়ে যাচ্ছে। টুনিকে ওঠাতে ব্যা¯ত হয়ে পড়ে।
এদিকে রফিকও গভীর ঘুমে অচেতন। তার এক আজব স্বভাব। ঘুমের মাঝেই এ্যালার্ম বন্ধ করে আবার ঘুমিয়ে পড়ে। ডেকে ডেকে হয়রান হতে হয়। মাঝে মাঝে মেজাজটা বিগড়ে যায়। না¯তা টেবিলে রেডি করে মেয়েকে নিয়ে যায় বাথরুমে। মুখ ধুইয়ে, ড্রেস পড়িয়ে, চুল আচড়ে জোড় করে না¯তা খাওয়াতে খাওয়াতেই স্কুলের ব্যগ টিফিন রেডি করতে করতেই রফিক ফ্রেস হয়ে যায়। ফ্রেশ হবার সাথে সাথে ই তার চা চাই। নইলে সারাদিনই মাটি। মেয়েকে রেডি করে রফিকের চা দিয়ে নিজে ছুটে বাথরুমে। কোন রকমে মাথায় দুমগ পানি দিয়েই তৈরী হয়ে নেয়। নিজে চারটা মুখে দেবে সে সময় হাতে নাই মেয়ের ¯কুলের দেরি হয়ে যাবে। কোন রকমে দুটা রুটি ব্যাগে ভরে নেয়। বেরুবার আগে আর একবার দেখে সব ঠিক আছে কিনা? রফিকের লাঞ্চ,পানির বোতল সহ লাঞ্চ বক্সটা রেডি করে বেরুতে যাবে তখনই রফিকের ডাক
- আমার ব্লু শার্টটা তো ই¯িত্র করোনি?
- এখন ই¯িত্র করতে গেলে দেরী হয়ে যাবে। আরো শার্ট আছে ই¯িত্র করা সেগুলোর একটা দিয়ে চালাও না প্লিজ।
- গতকাল থেকেই বলছি আজ মিটিংয়ে এটা পড়বো। আমার কিছুতেই তোমার নজর নেই। থাক লাগবেনা। বিরক্ত হয়ে বাথরুমে ঢুকে যায় রফিক।
চাপা একটা দীর্ঘ স্বাাস ছেড়ে টুনিকে একটু বসতে বলে তাড়াতাড়ি ই¯িত্র করতে বসে শার্টটা। গতকাল ই করতে চেয়েছিল কি›তু ইলেক্ট্রিসিটি ছিল না। কে বোঝাবে? আর কথা বাড়িয়েও লাভ নাই। শার্টটা ই¯িত্র করে বাকি সব ঠিক আছে কিনা চোখ বুলিয়ে নিয়ে মেয়ের হাত ধরে বেড়িয়ে পড়ে। ইস্ ৭.৪৫মি বেজে গেছে। ৮.০০ থেকে স্কুল। মেয়েকে স্কুল গেটে ঢুকিয়ে দিয়ে দুাড়িয়ে থাকে কিছুক্ষন, ক্লাসরুমে ঢোকা পর্যšত তাকিয়ে থাকে মেয়ের দিকে, তারপর রওনা হয় নিজের অফিসের উদ্দেশ্যে। আন্যান্য মায়েরা যেখানে গল্পের ঝুড়ি নিয়ে বসে তরু সেখানে পা বাড়ায় বাস কাউন্টারে।
কাউন্টারের লাইনে দুাড়িয়ে থাকতে থাকতে ধৈয্যের শেষ সীমায় পৌছানোর মুহুর্তেই বাসের আগমন। এখন পুরোপুরি যুদ্ধের প্র¯তুতি কারন বাসে ভীড় ঠেলে উঠতেই হবে যেভাবেই হোক না হলে অফিসে পৌছাতে দেরী হয়ে যাবে। অফিসে পৌুছে একগাদা কাজ। কাজের চাপে ভুলেই যায় সেই কোন ভোরে এককাপ চা আর একটা টোস্ট ছাড়া পেটে কিছুই পড়ে নাই। পেটের ভীতর পাকিয়ে ওঠে। একটু অবসর পেতেই এককাপ চা আর দুটা বিস্কিট নিয়ে রফিককে ফোন করে। ঠিকমতেন না¯তা খেয়েছিল কিনা? ঘর ঠিকমতো তালা দিয়েছিল কিনা? ইত্যাদি কথার মাঝেই বসের ডাক পড়ে যায়। কিছু আর্জেন্ট রিপোর্ট দিতে হবে।
কোন রকমে চা টা শেষ করে কাজে ডুবে যায় তরু। কাজের ফাকে বুয়া ঠিকমতো এলো কিনা? মেয়ে ঠিকমতো ফিরলো কিনা? গোসল করলো কিনা? খেল কিনা? সব দিকেই নিয়šত্রন করতে ভুল হয় না। দুপুরে নামায পড়ে লাঞ্চে সেই সকালের আনা রুটি দুটি যেন গলা দিয়ে নামতেই চায় না। মেয়েটা কি করছে? ঠিকমতো খেয়েছে কিনা? ঘুমালো কিনা এই সব চিšতায় ভেতর থেকে ক্ষয়ে যেতে থাকে প্রতিনিয়ত। লাঞ্চের পর থেকেই অস্থিরতা যেন আরো বাড়তে থাকে কখন ৫টা বাজবে। কখন বাসায় যাবে? সেখানে কি হচ্ছে? বাচ্চাটা কি করছে? মেয়েটাও বারবার ফোন করে আব্দারের পর আব্দার করতে থাকে।
ঘড়িতে সাড়ে পুাচটা বাজতেই ছুটে বেড়িয়ে আসতে চায় তরু। আবার সেই বাসের জন্য অপেক্ষা। একটার পর একটা বাস চলে যায় উঠতেও পারেনা। সময়ের সাথে সাথে বাড়তে থাকে অস্থিরতা। ধ¯তধ¯িত করেই ঝুলে পড়ে বাসে। রা¯তার জানজট, ট্রাফিক জ্যাম আর বিড়ম্বনায় মাঝেই ছটা সাড়ে ছটা বেজে যায়। বাস থেকে নেমে রি´ার জন্য অপেক্ষা করার মতো সময় বা ধৈয্য কোনটাই থাকে না। হেুটেই রওনা হয়ে যায়। যাবার পথে দরকারী বাজার বা কোন সদাই কিনতেও ভুল করেনা।
বাসায় ফিরতে ফিরতে সেই সাতটা সাড়ে সাতটা বেজেই যায়। সেই সকাল সাতটায় ঘর থেকে বেড়িয়ে আবার সাতটায় বাড়ী ফেরা। ঘরে ঢুকতেই গলা জরিয়ে ধরে মেয়ের কতনা অভিযোগ অভিমান আব্দার। মেয়েকে কিছুটা সময় দিয়ে আদর আব্দার মিটিয়ে পড়তে বসিয়ে আবার সেই রান্না ঘর। রাতের খাবার তৈরী করতে হবে। একচুলায় চায়ের পানি আর একচুলায় ভাতের চাল চড়িয়ে হাতমুখ ধুয়ে ফ্রেশ হয়ে নেয়। চায়ের কাপে চুমুক দিতে দিতেই মেয়ের পড়াটা দেখিয়ে দেয়। এর ফাকে ফাকেই চলে রাতের রান্নার ব্যাবস্থা। রান্নার ফাকে মেয়ের পড়া, ঘর গুছানো, রফিকের আগামী দিনের অফিসের পোষাক রেডি করতে করতেই রাত বেজে যায় ১০টা।
মেয়েকে খাইয়ে ঘুম পাড়িয়ে একটু টিভির সামনে বসতে না বসতেই চোখের পাতা দুটো ভারী হয়ে আসে। তাড়াতাড়ি রাতের খাবার রেডি করে। রফিকের সাথে প্রয়োজনীয় বা অপ্রয়োজনীয় আলাপগুলো রাতের এই খাবার টেবিলেই হয়ে থাকে। সারা দিনের ব্য¯ততায় আর সময় কোথায় গল্প করার? টেবিল গুছিয়ে সব কাজ সেরে ঘড়ির দিকে তাকালেই শরীর যেন আর চলতে চায় না। সাড়ে এগার টা থেকে বারোটার মধ্যেই বিছানায় গিয়ে গভীর ঘুমে তলিয়ে যায়। একেবারে ঘড়ির কাটার সাথে সাথে চলা যেন মানুষ না রোবট। মাঝে মাঝে খুব ইচ্ছে করে একজন মানুষের জীবন যাপন করতে। বড় ইচ্ছে করে গভীর রাতে চায়ের কাপে চুমুক দিতে দিতে পুরোনো দিনের গান শুনতে। কি›তু ইচ্ছে গুলোকে গলা টিপে জোর করেই চলতে হয় এই গৎবাধা একঘেয়ে জীবনে।
সব শখ গুলোকে বাক্স বন্দি করে বিছানায় যেতে হয়। নাহলে যে আবার ভোর পুাচটায় উঠা যাবেনা। সাতটার মধ্যে না¯তা, টিফিন, রফিকের সব কিছু রেডি করে সাড়ে সাতটায় ঘর থেকে বেড়–নো যাবেনা। আটটায় মেয়ের স্কুলে পৌুছানো যাবে না। সাড়ে নয়টায় নিজের অফিসেও পৌুছানো যাবেনা। একটু নিয়মের হেরফের হলেই পুরো দিনের, পুরো সংসারের রুটিন চেঞ্জ হয়ে যাবে। যার ধকলটা সামলাতে হবে তরুকেই। তাইতো ইচ্ছার বিরুদ্ধেও মানুষ নামী রোবটের জীবনটাকেই মেনে নিতে হয় তরু কে। তরুর মতো সবাইকে।