মিরপুরের পশ্চিম মনিপুরের একটি শিল্পম-িত বাড়ির নাম বনলতা। বাড়িতে বসবাস করেন লেখক জুটি ফারসীম-ফারহানা। তাদের আয়োজনে বাড়িটিতে ক’বছর হলো শুরু হয়েছে ‘বনলতা রিডিংস’ শিরোনামে পাঠ-আয়োজন। আসলে এটি লেখক-আড্ডাই। কিছুদিন আগে হয়ে গেল বনলতা রিডিংসের পঞ্চম আসর। এবার ষাটের দশক থেকে শুরু করে পাঁচ প্রজন্মের পাঁচজন কবিকে আমন্ত্রণ জানানো হয়। এই পঞ্চকবি হলেন রুবী রহমান, আসাদ মান্নান, কামরুল হাসান, মাহবুব কবির ও আফরোজা সোমা। অনুষ্ঠানে সস্ত্রীক এসেছিলেন কথাসাহিত্যিক ফারুক মঈনউদ্দিন। এই আসরে আরও ছিলেন মনোরোগ বিশেষজ্ঞ ড, মেখলা সরকার, চিত্রশিল্পী নাজিব তারেক, কবি সোহরাব সুমন, কবি লুৎফুল হোসেন এবং উপস্থাপক আবদুল্লাহ জাফর দম্পতি।
আমন্ত্রিত কবিরা তাদের কবিতা পাঠ করেন, সঙ্গে ছিল কবিতা নিয়ে তাদের সঙ্গে প্রশ্নোত্তর পর্ব। শুরুতেই ডাক পড়ে কবি কামরুল হাসানের। তিনি তার ‘বাছাই ১০০ কবিতা’ গ্রন্থ থেকে পাঁচটি কবিতা পড়েন। এরপর আসেন সত্তর দশকের কবি আসাদ মান্নান। তিনি বেশ কয়েকটি কবিতা পড়ে শোনান যার মধ্যে ছিল তার জনপ্রিয় কবিতা, ‘পা দু’খানি দেখতে দেখতে’ আর আলোচিত কাব্য ‘সৈয়দ বংশের ফুল’ থেকে একটি কবিতা। তার বক্তব্য হলো ‘দুঃখ ছাড়া কবিতা হয় না’। একটি প্রশ্নের উত্তরে কবি আসাদ মান্নান কবিতাকে গাড়ির সঙ্গে তুলনা করে বলেন ছন্দ হচ্ছে কবিতার চাকা যা ছাড়া গাড়ি চলবে না। কবি আফরোজা সোমা তার নিজস্ব ভঙ্গিমার আবৃত্তি দিয়ে সবাইকে মুগ্ধ করেন। কবি মোহাম্মদ সাদিকের শুভেচ্ছা বক্তব্য ছিল কবিতার মতন। কান পেতে শুনবার মতোই। বনলতার আয়োজনকে তিনি সাধুবাদ জানান। তার মতে, কবিতা লেখা হচ্ছে নিজের কবর খোঁড়ার মতো, নিজেকে সমাহিত করেই কবিতার সৃষ্টি হয়। কবি মাহবুব কবির ছিলেন এই আসরে নব্বই দশকের কবিদের প্রতিনিধি। আসরের সবচেয়ে কম কথা বলা এই কবি ছোট ছোট বেশ কয়েকটি কবিতা পড়ে শোনান। সবশেষে মঞ্চে আসেন এ আসরের বিশেষ আকর্ষণ কবি রুবী রহমান। এবারের একুশের বইমেলায় প্রকাশিত তার ‘তমোহর’ বই থেকে পড়ে শোনান কয়েকটি কবিতা। তার স্বামী গণতন্ত্রী পার্টির সভাপতি ও শ্রমিক নেতা নুরুল ইসলাম ও তার ছেলে ইসলাম তমোহর পুচির হত্যাকা-ের বিচার নিয়ে লেখা একটি কবিতার শেষ কটি লাইন সবার মন ছুঁয়ে যায়...
‘পিলপিল করে মানুষেরা উঠতে থাকে
পাঁচতলায় সাততলায় এজলাসের দিকে
ধূসর উষরতর বিচারের আহ্বানে...
একদিন হয়তো বলে বসবে আমিও আমি নই
তখন কি কিছু করার থাকবে মেনে নেয়া ছাড়া!’
শুধু কবিদের কথাই না, কবিতা নিয়ে কথাসাহিত্যকদের দৃষ্টিভঙ্গি জানতেও ছিল বিশেষ পর্ব। উপস্থিত কথাসাহিত্যিকদের সঙ্গে সঞ্চালকের আলাপচারিতায় জানা যায় কিছু মজার তথ্য। পাপড়ি রহমানের মতে, কবিতা লেখা খুব কঠিন কাজ। কবিতা লিখতে ব্যর্থ হয়ে তিনি কথাসাহিত্যে এসেছেন। তিনি নিজেও কবিতা পড়েন আর অন্যদেরও ধর্মগ্রন্থের মতো কবিতাগ্রন্থ পড়ার আহ্বান জানান। কথাসাহিত্যিক ফারুক মঈনউদ্দিনের সঙ্গেও কবিতা নিয়ে জমে ওঠে আলাপচারিতা। ক্লিনটন বি সিলির লেখা জীবনানন্দ দাশের সাহিত্যিক জীবনী অনুবাদ করার জন্য সুবিখ্যাত ফারুক মঈনুদ্দীন। সেই অনুবাদের পটভূমি বললেন তিনি। অবাক করা বিষয় ছিল তার নিজের লেখা দুটি কবিতার পাঠ। এরই মাঝে আসরে কিছুটা বৈচিত্র্য আনতে সঞ্চালক ফাঁকে ফাঁকে মঞ্চে ডেকে নেন ফারহানা মান্নান, সায়কা শর্মিন, লাবণ্যসুধা আর সুলতানা শাহরিয়া পিউকে। ফারহানা মান্নান স্কুলের পাঠ্যক্রমে কবিতার গুরুত্ব নিয়ে কথা বলেন। তার মতে, কবিতা পড়লে শিশু-কিশোরদের মনে ভাষা, ছন্দ, সৌন্দর্য নিয়ে আগ্রহ জাগে, তারা ভাষা ভালভাবে রপ্ত করতে পারে, জীবন সম্পর্কে দৃষ্টিভঙ্গি উন্নত হয়।
সায়কা শর্মিন পড়ে শোনান রবীন্দ্রনাথের ‘কিন্তুওয়ালা’। লাবণ্যসুধা আর শাহরিয়া পিউর কথা ও গানের যুগলবন্দী ছিলো মনে রাখার মতো। আসরের কিছু অংশ ফেসবুকে লাইভ প্রচার করা হয়- একবার শুরুতে, আরেকবার কবি রুবী রহমানের কবিতা পাঠের সময়।
পুরো অনুষ্ঠানটি শেষ পর্যন্ত ধরে রাখার কৃতিত্বের দাবী করতে পারেন সঞ্চালক কবি মারুফ রায়হান। তার প্রাঞ্জল সঞ্চালনা ছিলো এ আসরের কবিতা বা গানের মতই আকর্ষণীয়। এ আয়োজন প্রসঙ্গে আব্দুল্লাহ জাফর বলেন 'ডাকলে আবার আসবো...না ডাকলেও আসবো'।