[ইংরেজিভাষী কানাডিয় কথাশিল্পী অ্যালিস অ্যান মানরো ২০১৩ সালে সাহিত্যে নোবেল পুরস্কার পান। তিনি ১০ই জুলাই, ১৯৩১ এ কানাডার ওন্টারিও-তে জন্মগ্রহণ করেন। খুব অল্প বয়সে মানরোর লেখার হাতেখড়ি হয়। বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ার সময় তাঁর প্রথম গল্প ‘ডাইমেনশন অব শ্যাডো’ প্রকাশিত হয়। তাঁর প্রথম গল্প সংগ্রহ প্রকাশিত হয় ১৯৬৮ সালে যার জন্য তিনি গভর্নর জেনারেল পুরষ্কার জেতেন। মানরোর লেখার ধরন ছোট গল্পের কাঠামোর ক্ষেত্রে একটা বিপ্লবের মত। তিনি সাহিত্যে তার অবদানের স্বীকৃতিস্বরুপ তিনবার কানাডার গভর্নর জেনারেল পুরস্কার পান। এছাড়া ২০০৯ সালে তিনি ম্যান বুকার পুরষ্কারে ভূষিত হন। এখানে তার ‘ডবহষড়পশ ঊফমব’ গল্পটির বাংলা অনুবাদ ছাপা হল]
আমার মায়ের এক অবিবাহিত কাজিন ছিল। সে ছিল আমার মায়ের চেয়ে বয়সে অনেক ছোট। সাধারণত প্রতি গ্রীষ্মে সে তার মা আন্ট নেল বট্সের সাথে আমাদের খামার বাড়িতে আসত। তার নিজের নাম ছিল এরনি বট্স্। সে ছিল লম্বা, লাল বড় চৌকোনা মুখ ও ভালোমানুষি অভিব্যক্তিসম্পন্ন এক পুরুষ। তার সুন্দর কোঁকড়ানো চুল তার কপালের উপর থেকে ঝুলত। তার হাত এবং হাতের নখ ছিল সাবানের মতই পরিষ্কার। তার নিতম্ব ছিল খানিকটা মোটাসোটা। যখন সে আশেপাশে থাকত না তখন তার জন্য আমার নিজস্ব একটা নাম ছিল- আর্নেস্ট বটম।
আন্ট নেল বট্সের মৃত্যুর পর এরনি আর আসত না, তবে ও সবসময় বড়দিনের কার্ড পাঠাত।
যখন আমি এরনি যে শহরে থাকে সেখানকার কলেজে ভর্তি হলাম, ও আমাকে প্রতি রোববার সন্ধ্যায় ডিনারে নিয়ে যাওয়াটা একটা অভ্যাসে পরিণত করে তুলল। ও এটা করত কারণ আমি ছিলাম ওর আত্মীয়া- আমরা দুজন একত্রে সময় কাটাবার পক্ষে উপযুক্ত কিনা এটা ভাবা ওর পক্ষে অসম্ভব ছিল। এরনি সবসময় আমাকে একই জায়গায় নিয়ে যেত। একটা ভবনের দ্বিতীয় তলায় ওল্ড চেলসি নামের এক রেস্তোরাঁয় । হোটেলটা ছিল বেশ ব্যয়বহুল, সোজা ভাষায় বলতে গেলে তার সাধ্যের বাইরে কিন্তু আমি সেসব নিয়ে ভাবিত ছিলাম না। মফস্বলের মেয়ে হিসাবে আমার বিশ্বাস ছিল যেসব পুরুষেরা শহরে থাকে, প্রতিদিন একটা করে স্যুট পরে এবং এত পরিষ্কার নখ যাদের, তারা সাফল্যের এমন পর্যায়ে পৌছেছে যে তাদের জন্য এসব ব্যাপার খুব সাধারণ। আমি সবসময় খাবার তালিকার বিদেশি খাবারগুলোর জন্য অর্ডার করতাম। আমি পছন্দ করতে প্রচুর সময় নিতাম যেন পাঁচ বছরের এক মেয়ে আইসক্রিমের ফ্লেভার বাছাই করার চেষ্টা করছে এবং এই ভরপেট খাবারের ক্ষতিপূরণ হিসাবে তার পরদিন সোমবার আমাকে সারাদিন উপোস করতে হতো ।
এরনির বয়স আমার বাবা হবার পক্ষে একটু কমই ছিল। আমি চাইতাম না আমার কলেজের কেউ আমাদের একসাথে দেখুক এবং ভাবুক যে সে আমার বয়ফ্রেন্ড।
সে আমার কোর্স সম্পর্কে খোঁজ খবর নিত এবং যখন আমি তাকে বলতাম বা স্মরণ করিয়ে দিতাম যে আমি ইংরেজি ও দর্শনে স্নাতক, তখন সে বিষণœভাবে মাথা নাড়ত। সে আমাকে বলত তার শিক্ষার প্রতি প্রচন্ড শ্রদ্ধা রয়েছে এবং দূঃখ প্রকাশ করত যে মাধ্যমিকের পর লেখাপড়া চালিয়ে যাওয়ার সামর্থ্য তার ছিল না। পরিবর্তে সে কানাডিয়ান রেলওয়েতে টিকিট বিক্রির কাজ নিয়েছিল এবং এখন সে সুপারভাইজার।
পড়ার বিষয় থেকে আলোচনা অন্য দিকে ঘোরাতে আমি তাকে আমার থাকার ঘর সম্পর্কে বলতাম। সেই সময়ে কলেজে কোন ডরমিটরি ছিলো না। আমরা সবাই মিলে ভাড়া বাসায় অথবা সস্তা অ্যাপার্টমেন্টে থাকতাম। আমার রুমটা ছিল একটা পুরনো বাড়ির চিলেকোঠার ঘর। সেখানে প্রশস্ত মেঝে ছিল কিন্তু মেঝে থেকে ছাদের উচ্চতা খুব বেশি ছিলনা। প্রাক্তন মেইডের ঘর হবার কারণে এটার নিজস্ব বাথরুম ছিল। আরও দুইজন স্কলারশিপ প্রাপ্ত ছাত্রী যারা আধুনিক ভাষা বিষয়ে শেষ বর্ষে পড়ছিল তারা দ্বিতীয় তলায় বাস করত। তাদের একজনের নাম ছিলো ‘কে’ আর অন্যজন বেভারলি। নীচ তলায় বাস করত একজন মেডিক্যাল ছাত্র যে কদাচিৎ বাড়িতে থাকত আর তার স্ত্রী বেথ সবসময় বাসায় থাকত কারণ তার দুটি ছোট বাচ্চা ছিল। বেথ ছিল বাড়ির ম্যানেজার এবং ভাড়া সংগ্রহকারী। সে সবসময় দ্বিতীয় তলার মেয়েদের সাথে বাথরুমে কাপড় কাচা এবং সেখানেই শুকানোর জন্য ঝুলিয়ে রাখা নিয়ে নিয়ে ঝগড়া করত। যখন বেথের স্বামী বাসায় থাকত তাকে কিছুসময় ওই বাথরুম ব্যবহার করতে হতো কারণ নীচেরটাতে শিশুদের সমস্ত কিছু থাকত। কে এবং বেভারলি দ্রুত উত্তর দিত যে বাসা ভাড়া নেবার সময় বাথরুমটা তাদের একান্তই নিজেদের মত করে ব্যবহারের প্রতিশ্রুতি দেয়া হয়েছিল।
কে এবং বেভারলি আমার কাছে ছিল হতাশার মত। তারা আধুনিক ভাষার ওপর অনেক খাটাখাটুনি করত কিন্তু তাদের কথাবার্তা এবং চিন্তাভাবনা ব্যাংক ও বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানে চাকরি করা মেয়েদের থেকে খুব বেশি আলাদা ছিল না। তারা তাদের চুল পিনকার্ল করত এবং শনিবারে হাতে নেল পলিশ লাগাত।
কারণ ওই রাতে তাদের বিশেষ ছেলেবন্ধুদের সাথে ডেট থাকত। তাদের ছেলেবন্ধুরা তাদের মুখে দাড়ি গোঁফের যে আঁচড় রেখে যেত তার থেকে পরিত্রাণ পেতে রোববারে তাদের মুখে লোশন লাগানো থাকত । আমার কাছে ছেলেবন্ধুর ব্যাপারটা একদম অনাকাক্সিক্ষত ছিল এবং আমি অবাক হয়ে ভাবতাম ওরা কিভাবে পারে।
ওরা বলত যে ওদের মাথায় একসময় জাতিসংঘে দোভাষী হিসেবে কাজ করার মত একটা পাগলামি আইডিয়া এসেছিল কিন্তু এখন ওরা বুঝতে পেরেছে যে ওরা স্কুলে পড়াবে এবং ভাগ্য ভালো হলে বিয়ে করবে। ওরা আমাকে অপ্রীতিকর সব উপদেশ দিত। কলেজ ক্যাফেটেরিয়াতে আমি একটা চাকরি পেয়েছিলাম। আমি একটা হাতে ঠেলা ট্রলিতে করে নোংরা থালা বাটি সংগ্রহ করতাম এবং টেবিল পরিষ্কার করতাম।
ওরা আমাকে সতর্ক করত এই বলে যে এ কাজ কোন ভালো কিছু নয়।
‘কেউ তোমাকে বাইরে বেড়াতে নিয়ে যাবে না যদি তারা তোমাকে এই ধরনের কাজ করতে দেখে।’
আমি এরনিকে এটা বলেছিলাম এবং সে বলেছিল, ‘তুমি কি উত্তর দিয়েছিলে?’
আমি তাকে বলেছিলাম যে আমি এমন কারও সাথে বাইরে যাব না যার বিচারবুদ্ধি এমন, সুতরাং সমস্যাটা কোথায়?
আমি ঠিক জায়গাতেই আঘাত করেছিলাম এবং এরপর এরনি জ্বলে উঠেছিল ঃ
‘একদম ঠিক,’ সে বলেছিল ‘এটাই একমাত্র দৃষ্টিভঙ্গি যা গ্রহণ করা উচিত। সৎ কর্ম। কখনও এমন কারো কথায় পাত্তা দিয়ো না যে তোমাকে তোমার সৎ উপার্জনের জন্য ছোট করে দেখবে। তাদের অগ্রাহ্য করে সামনে এগিয়ে যাও। তোমার আত্মমর্যাদা বজায় রাখ।
সে রাতে আমি যখন বাসায় ফিরলাম দরজার নীচে আমার জন্য বেথের একটা নোট ছিলো যেখানে লেখা ছিল সে আমার সাথে কথা বলতে চায়।
দুর্ভোগ আর বিভ্রান্তিকর দৃশ্যের মধ্যে দরজা খুলে গেল এবং বেথকে দেখে মনে হচ্ছিল তার সমস্ত দিন শেষ হয়ে গেছে। ভেজা কাপড় চোপড়, ডায়াপার এবং বাচ্চাদের উলের কাপড় ছাদের র্যাক থেকে ঝুলছিল। স্টোভের উপর বোতল পানিতে ফুটানো হচ্ছিল জীবাণুমুক্ত করার জন্য। জানালার কাচ বাষ্পে ঢাকা ছিল, চেয়ারগুলো ছিল ভেজা কাপড় আর মাটি মাখানো খেলনাতে ঢাকা। বড় বাচ্চাটা ঘিরে রাখা একটা জায়গা থেকে মুক্ত হবার চেষ্টা করছিল এবং ছোটটি ছিল উঁচু চেয়ারের উপর। তার মুখে ও থুতনিতে মিষ্টি কুমড়োর রঙের মত ঘন ও নরম খাবার লেপ্টে ছিল যেটাকে দেখাচ্ছিল র্যাশের মত।
বেথ এ সব থেকে মুখ তুলল এবং তার ছোট সমান মুখটাতে শ্রেষ্ঠত্বের শক্ত অভিব্যক্তি ফুটিয়ে তুলল যেন সে বলতে চায়, খুব কম লোকই এই দুঃস্বপ্নের সাথে মানিয়ে নিতে পারত যা সে পেরেছে যদিও পৃথিবী তাকে সামান্যতম কৃতিত্ব দেবার মত সদয় ছিল না।
‘তুমি জান, তুমি যখন এসেছিলে’ তারপর সে তার গলাটাকে আরও উপরে তুলল যেন তা বড় বাচ্চাটার কান্না সত্ত্বেও শোনা যায়, ‘তুমি যখন আস তখন আমি বলেছিলাম ঘরটাতে দুজনের থাকার মতো পর্যাপ্ত জায়গা রয়েছে।’
সে আমাকে জানাল আমার সাথে থাকার জন্য আরেকটা মেয়ে আসছে। নতুন মেয়েটি মঙ্গলবার থেকে শুক্রবার পর্যন্ত থাকবে। সে কলেজে কিছু বিষয়ে কোর্স করতে এসেছে।
‘ব্লেক আজ রাতে বিছানা নিয়ে আসবে। মেয়েটি খুব বেশি জায়গা নেবে না। আমার মনে হয় না সে খুব বেশি কাপড় নিয়ে আসবে- সে শহরে থাকে। ছয় সপ্তাহ তুমি সম্পূর্ণ একা থেকেছ এবং ছুটির দিনগুলোতে তেমনটাই থাকবে।’
ভাড়া কমানোর ব্যাপারে কোন কথা হল না।
নিনা সত্যিকার অর্থেই খুব বেশি জায়গা নেয়নি। সে ছিলো ছোটখাটো এবং চলাফেরায় বেশ সাবধানী। সে কখনো কড়িকাঠের সাথে ধাক্কা খায়নি যেমনটা আমি খেতাম। সে অধিকাংশ সময় বিছানায় আড়াআড়ি ভাবে দুই পা রেখে বসে থাকত। তার বাদামি-সোনালী চুল তার মুখের উপর থেকে ঝুলে থাকত। তার জাপানি কিমোনো বাচ্চাদের মত করে তার সাদা অন্তর্বাসের উপর পরা থাকত। তার চমৎকার সব কাপড় ছিল- উটের পশমের কোট, কাশ্মিরী স্যুয়েটার, রুপার পিনওয়ালা স্কার্ট।
কিন্তু যখনই সে তার কলেজ থেকে ফিরত সে তার পোশাক ছেড়ে কিমোনো পরত। আমিও পোশাক পরিবর্তন করতাম কিন্তু আমার ক্ষেত্রে তা ছিলো স্কার্ট এবং ব্লাউজ বা স্যুয়েটার। নিনা তার কাপড় যেখানে সেখানে ছুড়ে দিত। কলেজে আমি আমার উপার্জনের অংশ হিসাবে আমার রাতের খাবার আগেই খেয়ে নিতাম এবং নিনাকে দেখে মনে হতো সেও খেয়ে নিয়েছে যদিও আমি জানতাম না কোথা থেকে।
আমি তাকে জিজ্ঞাসা করতাম তার ওই পাতলা কিমোনোতে শীত লাগে না? ‘উম্হুম্-’ সে জবাব দিত এবং আমার হাত তার গলায় চেপে ধরে বলত ‘আমি সবসময় গরম থাকি’। এবং সত্যিই সে সবসময় গরম থাকত। চামড়ার এই উষ্ণতার সাথে সংযুক্ত ছিলো একটা নির্দিষ্ট গন্ধ যা ছিল অনেকটা বাদাম বা মশলার মত। তার শরীরের গন্ধ অপ্রীতিকর ছিল না কিন্তু নিয়মিত গোসল করা পরিষ্কার শরীরের গন্ধ এটা ছিল না
আমি সাধারণত গভীর রাত পর্যন্ত পড়তাম। আমি ভেবেছিলাম রুমে কেউ থাকলে পড়তে বেশ অসুবিধা হবে কিন্তু নিনার উপস্থিতি ছিল বেশ সহজ। সে কমলা এবং চকোলেটের খোসা ছাড়িয়ে নিয়ে সলিটেয়ার খেলতে বসত। যখন তাকে একটা তাস সরাতে হতো তখন সে সামান্য শব্দ করত যেন সে তার শরীরের এই সামান্য নড়াচড়াতে অভিযোগ জানাচ্ছে কিন্তু সে এটাতে আনন্দ পেত এবং সবসময় এমনটাই করত। অন্যথায় সে ছিল সুখী এবং যখনই তার ঘুম পেত তখনই সে কু-লী পাকিয়ে লাইট জ্বালানো অবস্থাতে ঘুমিয়ে পড়ত। আমাদের কথা বলার বিশেষ কোন প্রয়োজন ছিল না। কিন্তু শীঘ্রই আমরা আমাদের জীবন সম্পর্কে কথা বলতে শুরু করলাম।
প্রথম সে গর্ভবতী হয়েছিল এবং বিয়ে করেছিল যাকে সে তার চেয়ে বয়সে ছোট ছিল। সেটা ছিল শিকাগোর বাইরে কোন একটা শহর। শহরের নাম ছিল লেনিভিল। এবং সেখানে কাজ বলতে ছিল ছেলেদের জন্য কর্ন এলিভেটর বা অন্যান্য যন্ত্রপাতি মেরামত করা এবং মেয়েদের জন্য বিভিন্ন স্টোরে কাজ করা। নিনার ইচ্ছে ছিল একজন হেয়ারড্রেসার হওয়া। কিন্তু এ জন্য তার বাইরে যাওয়া এবং এটা শেখার প্রয়োজন ছিল। নিনা সবসময় লেনিভিলেই থাকেনি। এখানে তার দাদি থাকত । সে তার দাদির সাথে থাকত কারণ তার বাবা মারা গেলে তার মা আবার বিয়ে করেছিল এবং তার সৎবাবা তাকে বাড়ি থেকে বের করে দিয়েছিল।
তার দ্বিতীয় সন্তান হলে তার স্বামী চাকুরির জন্য অন্য শহরে গেল। সে নিনার জন্য খরচ পাঠাতে চেয়েছিল কিন্তু সে কখনও তা পাঠায়নি। তাই নিনা তার দুই বাচ্চাকে তার দাদির কাছে রেখে শিকাগোগামী বাসে চেপেছিল।
বাসে তার মার্সি নামে এক মেয়ের সাথে পরিচয় হয়। সেও তার মতো শিকাগো যাচ্ছিল। মার্সি একজনকে চিনত যার ওখানে একটা হোটেল ছিল এবং মার্সি তাকে বলেছিল লোকটি তাদের কাজ দিতে পারবে। কিন্তু যখন তারা শিকাগো পৌছাল এবং হোটেলটি খুঁজে বের করলো তারা দেখল যে লোকটি ওই হোটেলের মালিক নয় বরং সে হোটেলের একজন কর্মচারী এবং কিছুদিন আগে সে তার চাকরি ছেড়ে দিয়েছে। প্রকৃত মালিক তাদের উপরতলার খালি একটা রুমে থাকতে দিতে রাজি হল এই শর্তে যে তারা প্রতিদিন জায়গাটা পরিষ্কার পরিচ্ছন্ন করবে। হোটেলে তাদের মেয়েদের ঘর ব্যবহার করতে হত কিন্তু দিনের বেলা তারা সেখানে খুব বেশি সময় কাটাতে পারত না।
তারা রাস্তার অপর পাশে অবস্থিত বারের একজন লোকের সাথে বন্ধুত্বের সম্পর্ক গড়ে তুলেছিল- লোকটি ছিল বিচিত্র কিন্তু সুন্দর- এবং সে তাদের বিনা পয়সায় জিন্জার এল পান করতে দিত। সেখানেই তাদের একজন লোকের সাথে পরিচয় হয় এবং লোকটি তাদের একটা পার্টিতে যেতে বলে। তার পর থেকে তারা অন্যান্য পার্টিতেও ডাক পেতে থাকে এবং সেই সময়টাতেই মিস্টার পারভিসের সাথে নিনার দেখা হয়। মিস্টার পারভিসই নিনার নাম ‘নিনা’ দিয়েছিল । তার আগে নিনার নাম ছিলো জুন। সে শিকাগোতে মিস্টার পারভিসের বাসায় তার সাথে থাকতে গিয়েছিল।
সে তার ছেলেদের ব্যাপারটা মিস্টার পারভিসের কাছে বলার আগে খানিকটা সময় নিয়েছিল। মিস্টার পারভিসের বাড়িতে অনেক জায়গা ছিল তাই সে ভেবেছিল সেখানে তার ছেলেরা তার সাথে অনায়াসে থাকতে পারবে। কিন্তু মিস্টার পারভিসকে যখন সে এ কথা জানাল সে বলল সে একদম বাচ্চা পছন্দ করে না আর এজন্য সে চায় না কখনও নিনা গর্ভবতী হোক। কিন্তু যেকোনভাবে নিনা গর্ভবতী হয়ে পড়ল এবং মিস্টার পারভিস তাকে নিয়ে জাপানে গেল তার গর্ভপাত ঘটানোর জন্য।
একেবারে শেষমুহূর্ত পর্যন্ত নিনা ভেবেছিল সে গর্ভপাত করাবে। কিন্তু তারপর সে ভাবল, না- সে আরও সামনে এগিয়ে যাবে এবং বাচ্চাটা নেবে।
‘ঠিক আছে’ মিস্টার পারভিস বলেছিল। মিস্টার পারভিস তাকে শিকাগো ফিরে যাবার খরচ দেবে কিন্তু তার পর তাকে নিজের পথ বেছে নিতে হবে।
নিনা ইতিমধ্যে নিজের পথ চিনে নিতে শিখেছে। সে একটা জায়গায় গেল যেখানে তারা ওকে বাচ্চা না হওয়া পর্যন্ত দেখাশোনা করবে এবং বাচ্চাটাকে ওখানে লালন পালনের ব্যবস্থাও হবে। বাচ্চাটা জন্ম নিল। এটা ছিল একটা মেয়ে। নিনা তার নাম দিল জেমা এবং নিনা বাচ্চাটাকে নিজের সাথে রাখবে বলে সিদ্ধান্ত নিল।
সে ওখানকার আরেকটা মেয়েকে চিনত যার বাচ্চা হয়েছিল এবং সেও তার বাচ্চাকে নিজের কাছে রাখার সিদ্ধান্ত নিয়েছিল। নিনা মেয়েটির সাথে একটা চুক্তি করল যে তারা একসাথে থাকবে, শিফট অনুযায়ী কাজ করবে এবং বাচ্চা লালন পালন করবে। তারা তাদের সাধ্যের মধ্যে একটা বাসা নিল। নিনা চাকুরি নিল একটা ককটেল লাউঞ্জে এবং সবকিছু ঠিকঠাক মতো চলছিল। জেমার বয়স যখন আট তখন ক্রিসমাসের আগে নিনা বাড়িতে ফিরে দেখল অন্য মেয়েটি অর্ধেক মাতাল অবস্থায় এক পুরুষের সাথে সময় কাটাচ্ছে। জ্বরে জেমার গা পুড়ে যাচ্ছিল। সে এতটাই অসুস্থ ছিল যে কাঁদতে পর্যন্ত পারছিল না।
নিনা তাকে কাপড়ে মুড়ে নিয়ে ক্যাবে করে হাসপাতালের উদ্দেশ্যে রওনা হল। ক্রিসমাসের কারণে রাস্তায় যানবাহন অনেক বেশি ছিল এবং অবশেষে যখন সে হাসপাতালে পৌছাল তারা তাকে বলল এটা ভুল হাসপাতাল এবং তাকে অন্য একটা হাসপাতালে পাঠাল। পথের মাঝে জেমার কাঁপুনি ওঠে এবং সে মারা যায়।
নিনা জেমাকে সঠিকভাবে সমাহিত করতে চেয়েছিল। সে বাচ্চাটাকে ভিক্ষুকদের কবরস্থানে কিছু ভিক্ষুকের সাথে রেখে আসতে চায়নি। তাই সে পারভিসের কাছে গেল। সে যতটুকু আশা করেছিল মিস্টার পারভিস তার থেকেও সদয় ছিল। সে কফিন এবং জেমার নামাঙ্কিত সমাধিফলকের খরচ দিয়েছিল এবং সব কিছু শেষ হবার পর সে আবার নিনাকে নিজের কাছে ফিরিয়ে নিয়েছিল। সে তাকে উৎফুল্ল করে তোলার জন্য তাকে লন্ডন, প্যারিস এবং আরও অন্যান্য জায়গায় বেড়াতে নিয়ে গিয়েছিল। সেখান থেকে ফিরে তারা শিকাগোর বাড়ি বন্ধ করে এখানে চলে আসে। নিকটেই মিস্টার পারভিসের খানিকটা সম্পত্তি ছিল এবং তার কিছু রেসের ঘোড়া ছিল।
মিস্টার পারভিস তাকে জিজ্ঞাসা করেছিল সে শিক্ষা গ্রহণ করতে ইচ্ছুক কিনা। নিনা জানাল সে ইচ্ছুক। মিস্টার পারভিস তখন তাকে বিভিন্ন কোর্সে বসে পরীক্ষা করতে বলল যে সে আসলে কী পড়তে পছন্দ করবে। নিনা তাকে বলেছিল পড়ার সময়টা সে সাধারণ ছাত্রীরা যেভাবে কাটায় সেভাবে কাটাতে চায়।
নিনার জীবনকাহিনী শুনে আমার নিজেকে অনেক অনভিজ্ঞ লাগছিল।
আমি তাকে জিজ্ঞাসা করলাম মিস্টার পারভিসের প্রথম নাম কী?
‘আর্থার’
‘তুমি তাকে এই নামে ডাকো না কেন?’
‘এটা ঠিক স্বাভাবিক শোনাবে না।’
নিনা সাধারণত রাতে বাইরে বের হতো না যদি না কলেজে বিশেষ অনুষ্ঠান যেমন কোন নাটক, কনসার্ট অথবা কোন বক্তৃতা থাকত । সে সাধারণত ক্যাফেটেরিয়াতে দুপুর ও রাতের খাবার খেত। নাস্তা ছিল ঘরে বসে নেসক্যাফে এবং একদিনের বাসি ডোনাট যা আমি ক্যাফেটেরিয়া থেকে নিয়ে আসতাম। মিস্টার পারভিস এসব খাওয়া তেমন পছন্দ করত না। কিন্তু সে নিনার কলেজ ছাত্রীদের জীবনাচরণের অনুকরণ হিসাবে এটাকে মেনে নিয়েছিল।
‘তুমি যদি বাইরে যাও সে কীভাবে জানবে?’
নিনা দাঁড়াল। তার সেই অভিযোগ বা আনন্দের মৃদু শব্দ করে সে জানালার কাছে গেল। ‘এখানে এস’ সে বলল ‘এবং পর্দার আড়ালে থাক, দেখতে পাচ্ছ?’
একটা কালো গাড়ি কয়েক ঘর পরে রাস্তায় দাঁড় করানো রয়েছে। রাস্তার আলোয় চালকের চকচকে সাদা চুল দেখা যাচ্ছে।
‘মিসেস উইনার,’ সে বলল ‘সে ওখানে থাকবে মাঝরাত পর্যন্ত, হয়তো তার পরেও, আমি জানিনা। যদি আমি বাইরে যাই তাহলে সে আমাকে অনুসরণ করবে এবং আমি যেখানেই যাই আমার আশেপাশে থাকবে এবং আবার আমাকে অনুসরণ করে ফিরে আসবে।’
‘সে যদি ঘুমিয়ে পড়ে তাহলে?’
‘সে ঘুমাবে না, আর যদি ঘুমিয়েও পড়ে এবং আমি যদি কিছু করার চেষ্টা করি তাহলে সে তড়িৎ জেগে উঠবে।’
মিসেস উইনারের খানিকটা অনুশীলনের জন্য এক সন্ধ্যায় আমরা বাসা থেকে বের হলাম এবং সিটি লাইব্রেরির উদ্দেশ্যে একটা বাসে উঠলাম। বাসের জানালা দিয়ে আমরা দেখছিলাম কালো গাড়িটা প্রতিটা বাস স্টপেজে থেমে খানিকটা অপেক্ষা করছে তারপর আবার স্পিড তুলে কিছুক্ষণ পর আমাদের বাসের পিছনে চলে আসছে। আমাদের লাইব্রেরিতে যেতে খানিকটা হাঁটতে হতো। মিসেস উইনার আমাদের অতিক্রম করে লাইব্রেরির সামনের দরজার দিকে গাড়িটা দাঁড় করালো এবং আমরা বুঝতে পারছিলাম গাড়ির রিয়ারভিউ আয়নায় সে আমাদের উপর লক্ষ্য রাখছে।
আমি দেখতে চাইছিলাম ‘দ্যা স্কারলেট লেটার’ বইটা পাওয়া যায় কিনা। বইটা আমার একটা কোর্সের জন্য খুব প্রয়োজনীয় ছিল। এটা কেনার সামর্থ্য আমার ছিল না এবং কলেজের সমস্ত কপি ধারে গিয়েছিল। আমি নিনার জন্যও একটা বই নিতে চাইছিলাম যাতে ইতিহাসের সরল একটা ধারাক্রম থাকবে।
নিনা যেসব কোর্স অডিট করছিল সেসব কোর্সের বই কিনেছিল। সে নোটবুক এবং কলম কিনেছিল কালার ম্যাচ করে। সে প্রতি লেকচারের সময় একদম পিছনের সারিতে বসত কারণ সে ভাবত ওটাই তার উপযুক্ত জায়গা। সে এমন ভাবে বলত যেন সে কলাভবনের ভিতর দিয়ে অন্যান্য ছাত্রছাত্রীর ভিড়ে হেঁটে যাওয়া, তার আসন খুঁজে পাওয়া, তার পাঠ্যবইয়ের নির্দিষ্ট পাতা এবং কলম বের করা সবকিছু উপভোগ করতো। কিন্তু তার নোটবুক থাকতো শূন্য।
সমস্যা হলো কোন বিষয়ে আলোচনা চালাবার মতো কোন অজুহাতই তার ছিল না। সে জানত না ভিক্টোরিয়ান অথবা রোম্যান্টিক অথবা প্রাক কলম্বিয়ান কী? সে জাপান, বার্বাদোজ এবং য়োরোপের আরও অনেক দেশ ভ্রমণ করেছে কিন্তু সে একটা মানচিত্রে এই দেশগুলো খুঁজে বের করতে পারত না। সে এটাও জানত না যে ফরাসি বিপ্লব প্রথম বিশ্বযুদ্ধের আগে নাকি পরে।
আমি ভেবে অবাক হতাম যে কিভাবে এই কোর্সগুলো ওর জন্য পছন্দ করা হল। মিস্টার পারভিস কি ভেবেছিল যে ও এগুলোতে দক্ষ হবে অথবা ও এগুলো পছন্দ করেছে যাতে করে ও শীঘ্রই ওর ছাত্রী হবার সাধ পূরণ করতে পারে।
যখন আমি আমার বইগুলো খুঁজছিলাম আমি এরনি বট্সকে দেখলাম। আমি ওকে নিনার সাথে পরিচয় করিয়ে দিলাম। আমি এরনিকে নিনার আমার সাথে থাকার ব্যাপারটা বলেছিলাম কিন্তু ওর আগের বা এখনকার জীবন নিয়ে কিছু বলিনি।
এরনি নিনার সাথে করমর্দন করলো আর বলল যে তার সাথে সাক্ষাৎ করে খুশি হয়েছে এবং তৎক্ষনাৎ জিজ্ঞেস করল যে সে আমাদের বাড়ি পর্যন্ত পৌছে দিতে পারে কিনা?
আমি প্রায় বলেই ফেলেছিলাম, না, ধন্যবাদ, আমরা বাসে করে যাব। ঠিক তখনই নিনা তাকে জিজ্ঞাসা করল তার গাড়ি কোথায় রাখা?
‘পেছনে’ সে বলল।
‘পেছন দিকে কি কোন দরজা আছে?’
‘হ্যাঁ, এটা একটা সেডান।’
‘না, আমি পাঠাগারের কথা বলছি’, নিনা বললো, ‘এই ভবনের পিছন দিকে কোন দরজা আছে কিনা?’
‘হ্যাঁ, হ্যাঁ আছে।’ এরনি জবাব দিল নার্ভাসনেসের সাথে, ‘আমি দুঃখিত, আমি ভেবেছিলাম আপনি কারের কথা বলছেন, হ্যাঁ পাঠাগারের একটা পিছন দরজা আছে। আমি নিজে সেই দরজা দিয়েই ঢুকেছি। আমি দুঃখিত। এরনি লজ্জায় লাল হয়ে যাচ্ছিল। তারপর সে ক্ষমা প্রার্থনা করতেই থাকত যদি না নিনা ওর সহজ হাসিতে ফেটে পড়ত।
এরনি আমাদের বাসায় নিয়ে এল। সে জানতে চাইল আমরা তার বাড়িতে যেতে চাই কিনা এক কাপ কফি খাবার জন্য।
‘দুঃখিত, আমরা আসলে একটু তাড়ার মধ্যে আছি’ নিনা বলল ‘কিন্তু বলার জন্য ধন্যবাদ।’
‘আমার মনে হয় আপনার হোমওয়ার্ক রয়েছে।’
‘হোমওয়ার্ক, হ্যাঁ’, ও বললো, ‘আমরা অবশ্যই হোমওয়ার্ক করি।’
আমি ভাবছিলাম এরনি কখনো আমাকে একবারের জন্যও তার বাসায় যেতে বলেনি। সদাচরণ। একটা মেয়ে, না। দুইটা মেয়ে, ঠিক আছে।
রাস্তার উপরে কোন কালো গাড়ি ছিল না যখন আমরা পরষ্পরকে ধন্যবাদ ও শুভরাত্রি জানালাম। কিছুক্ষণের মধ্যে নিনার ফোন আসল এবং নীচতলার ঘরে আমি ওকে বলতে শুনলাম, ‘আরে না, আমরা শুধুমাত্র লাইব্রেরিতে গিয়েছিলাম একটা বই নিয়ে আসতে এবং সেখান থেকে বাসে সোজা বাসায় ফিরেছি।আমি ভালো আছি, সম্পূর্ণরূপেই ভালো আছি, নাইট, নাইট।’ মৃদু হাসিতে সে দুলতে দুলতে উপর তলায় আসল এবং বলল মিসেস উইনার আজ রাতে বেশ সমস্যায় পড়েছে।
এক সকালে নিনা বিছানা ছেড়ে উঠল না। ও বললো ওর গলা ব্যথা এবং জ্বর। ‘আমাকে ছুঁয়ে দেখ।’
‘আমার কাছে সবসময় তোমাকে গরম মনে হয়।’
‘আজ আমি অন্য দিনের তুলনায় বেশি গরম।’
দিনটা ছিল শুক্রবার। সে আমাকে মিস্টার পারভিসকে কল করতে বলল এবং বলতে বলল সে ছুটির দিনগুলো এখানে কাটাতে চায়।
‘সে আমাকে এখানে থাকতে দেবে। সে অসুস্থ কাউকে তার আশেপাশে সহ্য করতে পারে না- এ ব্যাপারে তার খানিকটা পাগলামি আছে।’
মিস্টার পারভিস ডাক্তার পাঠাতে চাইতে পারেন। এটা ভেবে নিনা আমাকে বলতে বলল তার শুধু বিশ্রামের প্রয়োজন এবং অবস্থা খারাপ হলে সে অথবা আমি তাকে ফোনে জানাব। মিস্টার পারভিস বলল, ‘ভালো কথা, তাহলে ওকে বোলো নিজের যত্ন নিতে।’ মিস্টার পারভিস আমাকে ধন্যবাদ দিল ফোন করার জন্য এবং নিনার একজন ভালো বন্ধু হবার জন্য। এবং তার পরই সে আমাকে জিজ্ঞাসা করলো শনিবার রাতের খাবার তার সাথে খেতে আপত্তি আছে কিনা? নিনা এটাও আগেই ভেবেছিল।
‘যদি সে আগামীকাল রাতে তোমাকে যেতেই বলে তার সাথে খাবার খেতে তাহলে তুমি যাবে না কেন? শনিবার রাতে সবসময় খাবার জন্য ভালো কিছু থাকে- এটা বিশেষ কিছু।’
শনিবার ক্যাফেটেরিয়া বন্ধ থাকে। মিস্টার পারভিসের সাথে দেখা হবার সম্ভাবনা আমাকে একই সাথে বিরক্ত এবং উৎসাহী করে তুললো।
সুতরাং আমি তার সাথে খাবার খেতে যেতে রাজী হলাম। যখন আমি উপরতলায় ফিরে গেলাম আর নিনাকে বললাম আমি কী পরবো? ‘এখনি দুশ্চিন্তা কেন? আগামী রাতের আগ পর্যন্ত এটা হচ্ছে না।’
সত্যিকার অর্থেই আমি কেন দুশ্চিন্তা করছিলাম? আমার একটাই ভালো পোশাক ছিল যেটা আমি কিনেছিলাম আমার স্কলারশিপের টাকা দিয়ে আমার সমাবর্তন অনুষ্ঠানে পরার জন্য।
মিসেস উইনার আমাকে নিতে আসল। তার চুল সাদা ছিল না বরং ছিলো প্লাটিনামের মত। তার চুলের রঙ তার কঠিন হৃদয়ের কথাই আমাকে স্মরণ করিয়ে দিচ্ছিল। ভদ্রতার খাতিরে আমি তার পাশে বসার জন্য গাড়ির সামনের দরজা খুললাম কিন্তু সে তখুনি গাড়ি থেকে নেমে আমার পাশে দাঁড়াল এবং আমার জন্য পিছনের দরজা খুলে দিল।
আমি ভেবেছিলাম মিস্টার পারভিস হয়তো কয়েক একর অনাবাদী জমির উপর লনে ঘেরা শহরের উত্তরে কোন একঘেয়ে বাড়িতে বাস করে। রেসের ঘোড়াগুলো সম্ভবত আমাকে এমনটা ভাবতে বাধ্য করেছিল। কিন্তু তার পরিবর্তে আমরা মোটামুটি প্রশস্ত একটা রাস্তা ধরে শহরের পূব দিকে যাচ্ছিলাম। আমরা অবশেষে উঁচু ঝোপের মধ্যে দিয়ে যাওয়া এক সংকীর্ণ পথে মোড় নিলাম এবং একটা বাড়ির সামনে থামলাম। বাড়িটা দেখে আমি নিশ্চিত হলাম এটা কংক্রিটের তৈরি সমতল ছাদের একটি আধুনিক বাড়ি। ক্রিসমাসের কোন আলো সেখানে ছিল না। কোন প্রকার আলোই ছিল না।
এমনকি মিস্টার পারভিসেরও কোন চিহ্ন ছিল না। গাড়িটা গ্যারেজে ঢুকে গেল। আমরা এলিভেটরে করে একতলা উপরে উঠলাম এবং একটা হলঘরে উপস্থিত হলাম। ঘরটা হালকা আলোয় ভরা ছিল আর আসবাবপত্রগুলো যেমন : কিছু চেয়ার, ছোট্ট একটা মসৃণ টেবিল, আয়না এবং ছোট গালিচা দিয়ে ঘরটাকে ড্রইংরুমের মত করে সাজানো ছিল।
মিসেস উইনার আমাকে পথ দেখিয়ে হলঘরের একদিককার দরজা খুলে অন্য একটা ঘরে নিয়ে গেল। ঘরটিতে কোন জানালা ছিল না। পরিবর্তে ঘরটিতে ছিল একটা বেঞ্চ, এবং কাপড় ঝুলানোর জন্য দেয়ালময় অনেক হুক। কাঠের মসৃণতা আর মেঝের কার্পেট বাদ দিলে ঘরটি ছিল অনেকটা স্কুলের পোশাক এবং ব্যাগ জমা রাখা ঘরের মত। মিসেস উইনার বলল, ‘এখানে তুমি তোমার কাপড় ছাড়’।
আমি আমার দস্তানাটা খুলে আমার কোটের পকেটে ঢুকালাম। আমি আমার কোটটা হুকে ঝুলিয়ে দিলাম। মিসেস উইনার আমার সাথেই ছিল। আমার পকেটে একটা চিরুনি ছিল এবং আমি আমার চুলগুলো ঠিকঠাক করতে চাইছিলাম কিন্তু মিসেস উইনারের সামনে নয়। আর ওখানে কোন আয়নাও ছিল না।
‘এখন বাকি কাপড়,’ সে বলল।
আমি তার আদেশ মানার কোন চেষ্টাই করলাম না। সে তখন নিস্পৃহ গলায় বললো ‘আশা করি তুমি বাচ্চা নও।’
কিন্তু আমি ওখানে নিশ্চল হয়ে দাড়িয়ে রইলাম। মিসেস উইনার তখন আমাকে বললো, ‘তাহলে তুমি শুধু বইয়ের পোকা, এর বেশি কিছু তুমি নও’।
আমি বসে আমার জুতা খুলে ফেললাম। তারপর মোজা এবং তারপর আমার পোশাক খুলে ফেললাম। কিন্তু আমি তখনো পাতলা জামাতে ঢাকা ছিলাম। জামার মধ্যে হাত গলিয়ে আমি আমার ব্রার পিছন দিককার হুক খুলে দিলাম এবং তার পর কসরৎ করে এটা জামার ভিতর থেকে বের করে আনলাম। তারপর আমার প্যান্টি ও গার্টার বেল্ট সবকিছু খোলা হলে আমি ওগুলো মুড়ে একটি বল বানিয়ে আমার ব্রার নিচে লুকিয়ে রাখলাম। এরপর আমি আবার জুতো পরলাম।
‘খালি পা’ দীর্ঘশ্বাস ফেলে মিসেস উইনার বললো। আমি যখন জুতো খুললাম তখন সে বলল ‘সম্পূর্ণ নগ্ন, তুমি কি শব্দটার অর্থ জানো?’
আমি তখন পাতলা জামাটা আমার মাথা গলিয়ে বাইরে বের করে নিলাম। এরপর সে আমাকে এক বোতল লোশন দিয়ে বলল, ‘এটা সারা শরীরে মেখে নাও’।
লোশনটার গন্ধ ছিল নিনার শরীরের গন্ধের মতো। আমি এর কিছুটা আমার হাতে ও কাঁধে মেখে নিলাম। আমার লোশন মাখা শেষ হলে আমরা ওই রুম থেকে বের হয়ে হলরুমে ঢুকলাম। আমি আয়না থেকে নিজের চোখ সরিয়ে রাখছিলাম। মিসেস উইনার আরেকটি দরজা খুলল এবং এই রুমটাতে আমি একাই ঢুকলাম।
আমি এটা ভাবিনি যে মিস্টার পারভিস আমার জন্য একইভাবে ন্যাংটো হয়ে আমার জন্য অপেক্ষা করবে এবং সে তেমনটি ছিলও না। সে পরেছিল গাঢ় নীল রঙের ব্লেজার, একটা সাদা শার্ট এবং এসকট স্কার্ফ। মিস্টার পারভিস আমার চেয়ে লম্বা ছিল না। সে ছিল চিকন এবং বুড়ো। তার মাথার অধিকাংশ স্থানে টাক পড়ে গিয়েছিল এবং হাসার সময় তার কপালে ভাজ পড়ছিল।
পোশাক খোলাটা ধর্ষণ বা অন্য কোন ঘটনার শুরু হতে পারতো কিন্তু আমার ক্ষেত্রে তেমনটা ঘটেনি বরং এটা ছিল রাতের খাবারের প্রস্তাবনা। আমার নগ্ন হওয়াকে আমি আমার অন্যসব পাপকর্মের শুরুর ঘটনা হিসাবে না দেখে এটাকে আমার সাহসের বহিপ্রকাশ হিসাবে দেখতে চাইছিলাম। এবং সেই শব্দটা যেটা আমাকে এটা করতে উত্তেজিত করে তুলেছে -‘বইয়ের পোকা’।
আমার বলতে ইচ্ছা করছিল আমার খোলা দাঁতের জন্য যেমন লজ্জিত নই তেমনি আমার নগ্নতার জন্যও লজ্জিত নই। অবশ্য এটা সত্য ছিল না। সত্য ঘটনা এই যে আমি খুব ঘামছিলাম কিন্তু সতীত্বহানির ভয়ে নয়।
মিস্টার পারভিস আমার সাথে করমর্দন করল এবং আমার নগ্নতার ব্যাপারে ও কোন সচেতনতা দেখাল না। সে বলল নিনার বন্ধুর সাথে মিলিত হতে পারাটা তার জন্য বেশ আনন্দের। ও এমনভাবে বলছিল যেন নিনা কাউকে স্কুল থেকে বাড়ি ধরে এনেছে যেটা একদিক থেকে সত্যি ছিল। সে বলেছিল নিনার জন্য আমি ছিলাম অনুপ্রেরণা।
‘সে তোমার খুব প্রশংসা করে। নিশ্চয় তোমার খুব ক্ষিদে পেয়েছে? আমরা কি দেখব আমাদের জন্য কী খাবার সরবরাহ করা হয়েছে?’
সে খাবারের ঢাকনা খুলল আর আমাকে তুলে দিতে গেল। কর্নিশ হেন, কিশমিশ দিয়ে রাধা হলুদ ভাত, সবুজ মেটে রঙের আচার এবং গাঢ় লাল রঙের জ্যাম।
মিস্টার পারভিস আচার ও জ্যাম দেখিয়ে আমাকে বলল, ‘এগুলো খুব বেশি নিওনা’। সে আমাকে টেবিলে নিয়ে বসাল তারপর সে নিজের জন্য খাবার নিয়ে টেবিলে আসল।
টেবিলের উপর পানির জগ এবং মদের বোতল রাখা ছিল। আমি পানি খেলাম। সে আমাকে তার ঘরে মদ পরিবেশন করে বলল এটা পান করা বড় ধরনের পাপ বলে গণ্য হবে। আমি খানিকটা অখুশি হলাম। আমার আগে মদ খাওয়ার কোন সুযোগ আসেনি। যখন আমি ও এরনি ওল্ড চেলসিতে যেতাম সে সবসময় রোববারে মদ পরিবেশন না করা নিয়ে সন্তুষ্টি প্রকাশ করত।
‘নিনা আমাকে বলেছে’ মিস্টার পারভিস বলল, ‘তুমি ইংরেজি দর্শন পড়ছ, কিন্তু আমার মনে হয় এটা হবে ইংরেজি ও দর্শন, আমি কি ঠিক? সারা ইতিহাসে নিশ্চিতভাবেই খুব বেশি মহৎ ইংরেজ দার্শনিক নেই।’
তার সতর্কবার্তা সত্ত্বেও আমি একদলা সবুজ আচার মুখে নিয়েছিলাম। তাই তার প্রশ্নের উত্তর আমি দিতে পারলাম না। সে ধৈর্য্য সহকারে অপেক্ষা করছিল।
অবশেষে আমি বললাম, ‘আমরা গ্রিকদের দিয়ে শুরু করি’।
‘ও হ্যাঁ। গ্রিস। ভালো কথা। তো এখন পর্যন্ত তোমার প্রিয় গ্রিক দার্শনিক কে?’
তারপর কর্নিশ হেনের মাংস কিভাবে হাড় থেকে আলাদা করতে হয় এ বিষয়ে একটা বক্তব্য দিয়ে মিস্টার পারভিস আবার বলল, ‘তোমার প্রিয় দার্শনিক?’
‘আমি কলেজে এখনও আমার প্রিয় দার্শনিক অব্দি পৌছতে পারিনি- আমরা এখনও প্রাক সক্রেটিস দর্শন পড়ছি। আমার প্রিয় প্লেটো।’
‘প্লেটো তোমার প্রিয়। তাহলে বোঝা যাচ্ছে তুমি সিলেবাসে আটকে না থেকে নিজে নিজে সামনে এগিয়ে যাচ্ছ। প্লেটো। তুমি প্লেটোর ‘দ্যা কেইভ পছন্দ কর?’’
‘হ্যাঁ’
‘অবশ্যই ‘দ্যা কেইভ’ অনেক সুন্দর, তাই না?’
যখন আমি বসে ছিলাম আমার সবচেয়ে প্রকাশিত অংশ ছিল দৃষ্টির বাইরে। যদি আমার স্তনগুলো নিনার মতো ছোট ও সুন্দর হতো তবে আমি বেশ স্বচ্ছন্দ বোধ করতাম কিন্তু এগুলো ছিল বেশ বড়। এগুলোকে উজ্জ্বল আলোয় হতচকিত নিশাচর প্রাণীদের মতো লাগছিল। সে যখন কথা বলছিল আমি তার দিকে তাকাতে চাইছিলাম কিন্তু প্রতিবারই আমি নিজের অজান্তেই লজ্জ্বায় আক্রান্ত হচ্ছিলাম। যখন এমন হচ্ছিল আমি মিস্টার পারভিসের কণ্ঠস্বরে পরিবর্তন লক্ষ্য করছিলাম। আরও অধিক শান্ত এবং সন্তুষ্ট যেন সে এইমাত্র খেলায় জেতা চালটা দিয়েছে। কিন্তু সে তারপরও সহজভাবে তার গ্রিস ভ্রমনের কথা আমাকে বলছিল। ডেলফি, দূর্গ, বিখ্যাত আলো, পেলোপনিসাস-এর হাড় এ সব বিষয়ে সে বলেছিল।
‘এরপর আসছে ক্রীট এর কথা। তুমি কি মিনোয়ান সভ্যতা সম্পর্কে জান?’
‘হ্যাঁ।’
‘অবশ্যই তুমি জান। এবং তুমি নিশ্চয় জান মিনোয়ান মেয়েরা কি ভাবে পোশাক পরত?’
‘হ্যাঁ।’
আমি এবার তার মুখের দিকে তাকালাম এবং তার চোখে চোখ রাখলাম। আমি তার চোখ থেকে চোখ না সরিয়ে নেবার ব্যাপারে দৃঢ়প্রতিজ্ঞ ছিলাম।
‘মিনোয়ান মেয়েদের ওই স্টাইলটা বেশ সুন্দর ছিল’ মিস্টার পারভিস বেশ দুঃখের সাথেই বলল, ‘এটা বেশ অদ্ভুত, বিভিন্ন যুগে ঢেকে রাখা এবং দেখানোর বিষয় ভিন্ন ভিন্ন ছিল’।
ডিজার্ট ছিল ভ্যানিলা কাস্টার্ড এবং ক্রিম। মিস্টার পারভিস সামান্যই মুখে দিল। আমার অস্বস্তির জন্য আমি প্রথমের খাবারগুলো তেমন উপভোগ করতে পারিনি তাই এগুলো আমি মিস করতে চাইছিলাম না।
মিস্টার পারভিস ছোট কাপে কফি ঢাললো এবং তার লাইব্রেরিতে বসে কফি পান করার আমন্ত্রণ জানালো।
আমি যখন চেয়ার ছেড়ে উঠতে গেলাম আ