একেই সম্ভবত বলে ঊষাকাল। অন্ধকার কেটে যাচ্ছে দ্রুত। হাল্কা আলোয় উদ্ভাসিত চারদিক। সামনে ধুধু মরুভূমি। একটি দিন শুরু হলো এখানে। উত্তর আফ্রিকার সাহারা মরুভূমি। যেদিকে চোখ যায় শুধু কর্কশ প্রান্তর। বিস্ময় মুগ্ধতা আর জ্বলজ্বলে বাস্তব হয়ে সামনে শরীর এলিয়ে ইতিহাসের সাহারা। মানব সভ্যতার ঊষাও উদ্ভাসিত হয়েছিল এখানে। খ্রিস্টপূর্ব তিন হাজার পাঁচ শ’ বছর আগে। ইতিহাস বলে, তার বহু আগে আজ থেকে এক লাখ বিশ হাজার বছর আগে হোমোসেপিয়েন্স বা আধুনিক মানবের উৎপত্তি। এই আফ্রিকাতেই। এখান থেকে বিভিন্ন দলে ভাগ হয়ে ইউরোপ, আমেরিকা, অস্ট্রেলিয়া ও এশিয়ার বিভিন্ন অঞ্চলে ছড়িয়ে পড়ে তারা।
সে অর্থে মানুষের ইতিহাস শুরু থেকেই অভিবাসনের ইতিহাস। একেবারে এ সময়ে এসে পুঁজিবাদী সঙ্কট ভিন্নভাবে একে উপস্থাপন করলেও অতীতে নানা কারণে এক জায়গা থেকে অন্য জায়গায় আবাস গেড়েছে মানুষ। মধ্যযুগেও রোমান সা¤্রাজ্যের পতনের পর ইউরোপের অনেক উপজাতি বারবার জায়গা বদল করেছে। সে সময় ফ্রাঙ্ক উপজাতি নানা জায়গায় ঘুরে ফ্রান্সে এসে স্থায়ী হয়ে আজকের ফ্রেঞ্চে পরিনত হয়েছে। এ্যাংলো স্যাক্সনরা স্থায়ী হয়েছে ইংল্যান্ডে। আর এখন অস্ত্র ও যুদ্ধ বাণিজ্যের শিকার হয়ে লাখ লাখ মানুষ পাড়ি জমাচ্ছে ইউরোপীয় ইউনিয়নের বিভিন্ন দেশে। দু’হাজার পনেরো সালে শুধু ইরাক ও সিরিয়ার দশ লাখ মানুষ অস্ত্র ও যুদ্ধ বাণিজ্যের শিকার হয়ে ইউরোপ মুখী হয়েছে। সে সময় এই মিসরের ধনকুবের নাগিব সোয়ারিস ইউরোপগামী শরণার্থীদের থাকার ব্যবস্থা করতে ইতালি অথবা গ্রীসে দ্বীপ কিনতে চেয়েছিলেন। টুইটারে সে দ্বীপের সম্ভাব্য নামও ঘোষণা করেছিলেন। ‘হোপ’। সে এক পুঁজিবাদী তামাশা। গ্রীস তখন ট্রয়কা (ইউরোপীয় কমিশন, ইউরোপের কেন্দ্রীয় ব্যাংক এবং আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিল)-র ঋণ জালে জর্জরিত। সেই দু’হাজার আট সাল থেকে ধুঁকছে। চব্বিশ হাজার কোটি ইউরো ঋণ আর শতকরা ষাট ভাগ বেকারের বোঝা বইছে। দশ লাখ শরণার্থীকে আশ্রয় দিতে সেদেশ আর ইউরোপের দরিদ্রতম দেশ ইতালিকেই চোখে পড়েছিল সোয়ারিসের। অবশ্য তুরস্ক উপকূল থেকে ইজিয়ান সাগর পাড়ি দিয়ে গ্রীস হয়ে ইউরোপের নানা দেশে যাওয়া শরণার্থীদের জন্য সুবিধার। হয়ত সে জন্য গ্রীসে দ্বীপ কেনার কথা ভেবেছিলেন। বেশ আনন্দদায়ক ইচ্ছাই পোষণ করেছিলেন।
নাগিব সোয়ারিসের মতো আবু সিম্বেলও কোন কালে মিসরের ধনকুবের ছিলেন কিনা জানি না। এ নামে সাহারায় গড়ে উঠেছে এক কৃত্রিম গ্রাম। ‘আবু সিম্বেল ভিলেজ’। মরুর বুকে এমন টকটকে উজ্জ্বল ফুল আর সবুজের সমারোহ বিস্ময়কর। প্রাচীরের মতো ঘিরে আছে আবু সিম্বেল গ্রামকে। অনেক যত্ন আর অর্থ ব্যয় রয়েছে এর পেছনে, বোঝা যায়। কোন কোন জায়গায় গড়ে উঠছে বহুতল ভবন। আধুনিক প্রযুক্তি এবং প্রকৌশল বিদ্যার নান্দনিক প্রয়োগ। ধু ধু মরুভূমিতে বহুতল ভবন ম্যানেজমেন্টের জন্য কতটা বিজ্ঞানসম্মত পরিকল্পনা দরকার তা সহজেই অনুমান করা যায়। বিদেশী বিভিন্ন বিশেষজ্ঞের তত্ত্বাবধানে চলছে প্রকল্পের কাজ। আজকের গন্তব্য আবু সিম্বেল। যাওয়ার পথে এসব আরও বিস্তৃত দেখব আমরা। এখন আছি আসোয়ান-এ। এখানেই ভোর হলো যেন ভৈরব রাগে। একটু একটু করে দেখা দিচ্ছে সূর্য। আর আমরা স্নাত হচ্ছি। সাড়ে পাঁচ হাজার বছর আগে হয়ত এভাবেই স্নাত হতেন পৃথিবীর প্রথম সভ্য মানুষেরা।
ভাবতে অবাক লাগে এই সাহারাই এক সময় ছিল লতা-গুল্মে ভরা জলজ ভূমি। এখানে আসার আগে পৃথিবীর প্রাচীন ইতিহাস ও নৃতত্ত্ব সম্পর্কে সামান্য হোম ওয়ার্ক করার সূত্রে জেনেছি, উত্তর ইউরোপে যখন চতুর্থ বরফ যুগ চলছে সাহারা তখন শ্যামল জলাভূমি। প্রচুর নলখাগড়া এবং এ জাতীয় উদ্ভিদ জন্মাত এখানে। এর মধ্যেই বাস করত তখনকার মানুষ। পাথরের অস্ত্র ব্যবহার শিখেছিল তারা। তাই দিয়ে মাছ ও পশু শিকার করত, বন থেকে সংগ্রহ করত ফলমূল। নৃতত্ত্বের বিচারে এরা ‘খাদ্য সংগ্রহ পর্যায়’-এর মানুষ। কৃষির আবিষ্কার তখনও হয়নি। আগুনের ব্যবহারও সম্ভবত শুরু হয়নি।
নৃতাত্ত্বিক ইলিয়ট স্মিথ যাদের বলেছেন ব্রাউন বা বাদামি জাতি সেই ‘মেডিটারেনিয়ান’ জাতি ‘নতুন প্রস্তর যুগ’ বা নিওলেথিক যুগে ব্রিটিশ দ্বীপপুঞ্জ, দক্ষিণ ইউরোপ এবং উত্তর আফ্রিকার ভূমধ্যসাগর তীরের বিভিন্ন দেশের ভিন্ন ভিন্ন অঞ্চলে বাস করত। এই বিস্তীর্ণ এলাকায় বাস করলেও অন্য কোথাও সভ্যতার উন্মেষ না হয়ে মিসরের নীল, মেসোপটেমিয়া বা ইরাকের দজলা ও ফোরাত এবং পাকিস্তানের সিন্ধু- এই চার নদীর উপত্যকায় সভ্যতার উন্মেষ হওয়ার পেছনে জলবায়ুর প্রভাব সম্ভবত অন্যতম কারণ।
চতুর্থ বরফ যুগে গোটা উত্তর ইউরোপ বরফ ঢাকা। সে যুগের প্রাণী ম্যামথ, লম্বা শিঙের হরিণ, বড় লোমের গ-ার ইত্যাদি ছাড়া অন্য প্রাণীর অস্তিত্ব ছিল না সেখানে। পর্বত থেকে নেমে আসা হিমবাহর প্রভাব সেখানকার বায়ুম-লে সৃষ্টি করেছে অতিশীতলতা। সাহারাসহ উত্তর আফ্রিকা আরব পারস্য ও সিন্ধু অঞ্চলের জন্য যা আশীর্বাদ হয়ে এসেছিল। কেননা ওই শীতল বায়ুম-ল আটলান্টিকের বর্ষার মৌসুমী বায়ু প্রবাহকে দক্ষিণের এ অঞ্চলের দিকে ঠেলে দিত। যে জন্য এসব এলাকা হয়ে উঠেছিল সবুজ শ্যামল, মানুষ বাসোপযোগী।
॥ দুই ॥
কায়রো থেকে ঘণ্টা দুয়েক উড়ে ভোরের দিকে পৌঁছেছি আসোয়ানে। এখান থেকে আবু সিম্বেলের দূরত্ব প্রায় তিন শ’ কিলোমিটার। যাওয়ার একমাত্র উপায় সড়ক পথ। সাহারার বুক চিরে পথ গেছে সোজা। কখনও সামান্য আঁকাবাঁকা। তবে পুরোটাই সমতল। গাইড, গাড়ি আগে থেকেই রেডি। তাই ইমিগ্রেশনের ঝামেলা মিটিয়ে সোজা গাড়িতে।
গাইড য়াহমেদ ছ’ ফুটের মতো লম্বা। বয়স পঞ্চাশের ওপর হবে। বাদামী গায়ের রং। পোশাকে পারিপাট্য নেই। চাল চলনেও স্মার্টনেস নেই ততটা। জীবন-জগত সম্পর্কে তেমন আগ্রহ আছে বলেও মনে হয় না। জীবিকা নির্বাহের জন্যই কাজটা করা, বোঝা যায়। তবে কাজে ফাঁকি নেই। তথ্য আছে তার কাছে প্রচুর। ওটা সাপ্লাই করাকেই সে তার কর্তব্য মনে করে। গর গর করে কথা বলে যায়। টকিং মেশিন বা ইনফরমেশন বক্সও বলা যায় ওকে। গাড়িতে উঠে আবু সিম্বেল সম্পর্কে প্রাথমিক ধারণা দিতে প্রায় এক নিশ্বাসে অনেক কথা বলে দিল। ব্যাস, ইনফরমেশন ডেলিভারি শেষ। এবার একেবারে চুপ। কায়রোর গাইড আবির হাম্মাদ স্মার্ট তরুণি। নিজের দেশ সম্পর্কে যেমন বলতো আমাদের দেশ সম্পর্কেও জানতে চাইত। এর এসবের বালাই নেই। বারো সিটের মাইক্রোবাসে য়াহমেদসহ যাত্রী আমরা পাঁচজন। আর সামনের দু’সিটে দু’জন চালক। ইউরোপের মতো এখানেও দূর যাত্রায় দু’জন চালক। একজন চালায় অন্যজন বসে থাকে। দু’ঘণ্টা পর পর ডিউটি বদল।
গাড়িতে আপাতত নৈশব্দ নেমেছে। কায়রো থেকে দু’ঘণ্টার ফ্লাই হলেও সারা রাতই কেটেছে প্রায় নির্ঘুম। সন্ধ্যায় পিরামিডে ‘সাউন্ড এ্যান্ড লাইট’ দেখে হোটেলে ফিরতে প্রায় দশটা। আসার পথে রাতের খাবার খাওয়া হয়েছে। ব্যবস্থা সব ট্যুর অপারেটরের। মিসরের স্থানীয় খাবার খাওয়ালো এক রেস্তরাঁয়। গ্রিল করা বড় পাখি। সবজির সালাদ। সঙ্গে লুচির চেয়ে একটু বড় আকারের তেল ছাড়া রুটি। লুচি না বলে ছোট তন্দুরের মতো বললে বেশি ঠিক হয়। ভেবেছিলাম এ পর্যন্তই। দুপুরের খাবার দেরিতে খেয়েছি। এই আমাদের জন্য যথেষ্টর চেয়ে বেশি। হলে কি হবে কর্তৃপক্ষ তা মনে করে না। সুতরাং একের পর এক আসতে থাকে ভেড়া গরু ও মুরগির তিন রকম। সব্জি, ডাল, মাছ রাইস...। কয়েক রকমের সস তো টেবিলে আছেই। ‘রান্নাঘরে আরও’ কত কি আছে সৈয়দ মুজতবা আলীর আব্দুর রহমান থাকলে হয়তো বলতে পারতো। সামান্য খেয়ে কিছু প্যাক করে নেই। রাত দুটোয় হোটেল থেকে বেরোতে হবে। তখন কারও খিদে পেলে খাবে। বাকি খাবার পড়ে রইল রেস্তরাঁর টেবিলে। কিন্তু হায়! মাঝ রাতে কারোরই আর খিদে পায়নি। প্যাকেটের খাবার প্যাকেটেই রইল। আমরা ছুটি এয়ারপোর্টের উদ্দেশ্যে।
আত্নপ্রচারের মতো শোনালেও প্রসঙ্গত বলি,মিসর ভ্রমণটা আমাদের অনেক দিনের পরিকল্পনা এবং অর্থ সঞ্চয়ের সমন্বয়। আর দশটা ভ্রমণের মতো নয়। মানবসভ্যতার উন্মেষের দেশ মিসর। সভ্যতার ইতিহাস শুরুর সেই অধ্যায় দেখায় কোন বাধা যাতে না থাকে সেজন্য প্রয়োজনীয় পড়াশোনা ও প্রস্তুতি যেমন ছিল তেমনি আরামদায়ক ভ্রমনের জন্য ‘পাঁচ তারকা’ মানের ব্যবস্থাও ছিল। পাঁচ তারকা হোটেল, ‘নাইল ক্রুসিং’য়ে ‘পাঁচ তারকা’ জাহাজ। সার্বক্ষণিক গাড়ি। আলাদা আলাদা গাইড। সব ব্যবস্থা ঢাকা থেকেই করা হয়েছে। নইলে ওই বিশাল মরুর দেশ, উত্তর থেকে দক্ষিণ- ছুটোছুটি করা বেশ মুশকিলও হতো।
এমত আয়োজনের জন্য কায়রো এয়ারপোর্টে নামার সঙ্গে সঙ্গে ট্রাভেল এজেন্সির প্রতিনিধি মোহাম্মেদের উষ্ণ অভ্যর্থণায় সিক্ত হই। যেন বাংলাদেশ থেকে আমরা চার ভিআইপি পৌছে গেছি তার দেশে। ওর এজেন্সির সুনামেরও ব্যাপার আছে। মিসরের প্রথম সারির তিন এজেন্সির মধ্যে ওরটা এক নম্বর। সুতরাং আচার ব্যবহার আদব কায়দাও তেমনই হতে হবে। তবে নিসন্দেহে মানুষ হিসেবে মোহাম্মেদ যাকে বলে ‘ভালোমানুষ’ তাই। কর্পোরেট জগতের মুখোশ মানুষ নয়। বিনয়ী, বন্ধুবৎসল হাসিখুশি ভদ্রলোক। কিছু মানুষ দেশকাল নির্বিশেষে মানুষের প্রতি সহমর্মিতা নিয়ে জন্মায়। একে দেখে তাই মনে হয়। যেন কতকালের চেনা আপজন। পাসপোর্ট, ভিসাগুলো ওর হাতে দেয়া ছাড়া এয়ারপোর্টের বিরক্তিকর আনুষ্ঠানিকতার কোন কিছুই করতে হয়নি। ঝাড়া হাত পায়ে সোজা গাড়িতে।
তার আগেই অবশ্য দ্বিতীয় মোহাম্মেদ হাজির। গাড়ি নিয়ে এসেছে হোটেলে পৌঁছে দিতে। মোহাম্মেদ ট্রাভেল এজেন্সির মাঝারি গোছের কর্মকর্তা। চটপটে, স্মার্ট। নানা বিষয়ে কথা বলে আমাদের সন্তুষ্ট রাখার চেষ্টা করে। এক ঘণ্টার পথ, যেন বোর না হই। চার সদস্যের জেন্ডার ব্যালান্সড ট্রাভেল টিমের পুরুষ সদস্য দু’জনার কারও নামের আগে মোহাম্মদ নেই। নারী দু’জনার আউটফিটেও বিশেষ ট্রেড মার্ক নেই। মোহাম্মেদ সম্ভবত দ্বিধায় পড়ে। সরাসরি জিজ্ঞেস না করে আলাপ চালিয়ে যায়- ‘মিসরে সাড়ে নয় কোটি জনসংখ্যার নব্বই ভাগ মুসলমান। উই আর সুন্নি মুসলিমস। সুন্নিদের নামের আগে মোহাম্মদ থাকা সুন্নত। তার এ তথ্য প্রদানের উদ্দেশ্য বুঝতে পারলেও ইচ্ছে করেই ওই পয়েন্টে না গিয়ে আমরাও নিজ দেশের আকার আয়তন জনসংখ্যা ইত্যাদি নিয়ে কথা বলি। সেও আর ওদিকে যায় না। শুধু জানায়, সুন্নি মুসলমানের বাইরে তার দেশে খ্রীস্টান এবং অন্য আরও কিছু ধর্মীয় সম্প্রদায়ের মানুষ রয়েছে। তা আমরাও বলি বিভিন্ন ধর্ম এবং ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠীর বৈচিত্র্যময় বাংলাদেশের কথা। কথায় কথায় হোটেলে পৌঁছাই। হোটেলের যাবতীয় আনুষ্ঠানিকতা মোহাম্মেদই সম্পন্ন করে। আমরা লবিতে বসে থাকি।
হোটেল তো নয় বিশাল সমুদ্র। ঢুকতেই ফারাও দ্বিতীয় রামসিসের ছাদ ছোঁয়া বিশাল পাথরের মূর্তি। ছত্রিশ তলা হোটেল। কত যে তার রুম, স্যুট, কত ইউনিট, হলওয়ে তা ভালো করে বুঝতে শুধু ওখানে থাকার জন্যই আরেকবার যেতে হয়। আমরা পড়েছি চব্বিশ তলায়। ওখান থেকে শহরের মধ্যদিয়ে বয়ে যাওয়া নীলনদ দেখা যায়। আকাশের তারা ও রাস্তার মানুষ দেখা যায়। এই নীলনদের পাড়ের মানুষেরাই এক সময় বিশ্বাস করতো নীল ওই আকাশে আছে এ রকম আরেক নদী। এ নদীতে যেমন তারা নৌকায় পারাপার করে মৃত্যুর পর আকাশ নদীর ওপারের জীবনে পৌঁছাতেও লাগে এরকম নৌকা। বিশেষ ধরনের নৌকা বানাতো তারা। ইজিপসিয়ান মিউজিয়ামে আগের সেই নৌকার বেশ কিছু রেপ্লিকা আছে।
নদীর মতোই শান্ত ধীর এ অধিবাসীরা নক্ষত্রের গতি দেখে বছর গোনা শুরু করেছিলেন। তারাই হিসেব কষে বের করেছিলেন সূর্যকে একবার প্রদক্ষিণ করে আসতে পৃথিবীর তিনশ পয়ষট্টি দিন লাগে। প্রাচীন লিখন রীতিও তাদের আবিষ্কার। চিত্র-লেখ বা হায়রো গ্লাইফিক বর্ণমালায় লিখতেন তারা। প্যাপিরাস থেকে কাগজের আবিষ্কারকও তারা।
নীল নদের নিম্নাংশ বা অববাহিকা অঞ্চলের অধিবাসীদের আবিষ্কার বা নিদর্শনের বেশিরভাগই পলি মাটির নিচে চাপা পড়লেও ইতিহাস ও নৃতত্ত্ববিদরা ধারণা করেন নীল নদের এ অঞ্চলের সভ্যতাই অধিকতর প্রাচীন ও প্রগতিশীল। কিন্তু এ যাবত পাওয়া আদি নিদর্শনগুলোর বেশির ভাগই উদ্ধার হয়েছে দক্ষিণ মিসর থেকে। তাই মিসর কাহিনীর শুরু দক্ষিণাংশ থেকে ধরা হয়।
নীল নদ নিয়ে ছোট বেলায় শোনা টুকরো টুকরো কাহিনী নীল আকাশের ওই তারাদের মতো মনে ভিড় করে। ফেরাউনের অত্যাচারে জর্জরিত মুসা নবী মানুষের কল্যাণ চেয়ে সব অত্যাচার নীরবে সয়েছেন। শেষ লড়াইয়ে জিতে যাওয়ার বিস্ময়কর দৃশ্য এখনও মনে গেঁথে আছে- ফেরাউন তার বাহিনী নিয়ে তেড়ে আসছে, লাঠি হাতে মুসা নবী একা এগিয়ে যাচ্ছেন সামনে। নীল নদের পাড়ে এসে এক মুহূর্ত হতবিহ্বল। কি করে পার হবেন এ বিশাল নদী! ওদিকে শত্রু প্রায় ঘাড়ের কাছে। লাঠি হাতে নামেন নদীর কিনারে। কি আশ্চর্য! লাঠির স্পর্শে নদীর পানি দু’ভাগ হয়ে মাঝখানে তৈরি হয় রাস্তা। নবী তরতর করে হেঁটে ওপারে পৌঁছে যান। তাকে অনুসরণ করে ফেরাউনও সে পথে নামে। মাঝ পথে আসতেই নদী আবার আগের রূপে ফেরে। অত্যাচারী ফেরাউন সদল বল ডুবে মরে নীল নদের পানিতে। জয় হয় মুসা নবীর। সেই নীল নদের দেশ, ফেরাউনের দেশ, মিথ আর ইতিহাসের মিসরে এসে পড়েছি! অতীত আর বর্তমান অথবা কল্পনা এবং বাস্তবের মিশেল অভিভূত করে।
ওল্ডটেস্টামেন্টের কাহিনীও এই নীল নদ, মুসা নবী আর ফেরাউন অর্থাৎ ফারাওকে নিয়ে। শুরু অনেকটা আমাদের ভারতীয় সনাতন ধর্মের ‘তোমারে বধিবে যে গোকুলে বাড়িছে সে’র মতো। কেনান প্রদেশ থেকে প্রচুর হিব্রু ধরে এনে দাস বানিয়েছিল ফারাওরা। তাদের ওপর অত্যাচার নির্যাতন চলত। একদিন দৈববানী হয় ফারাওদের অত্যাচার রুখবে যে আজ তার জন্ম হবে হিব্রুদের ঘরে। সেখানে সেদিন যে শিশুটির জন্ম হয় ফারাও এর অভিযানের ভয়ে তার মা বড় পাত্র করে তাকে নীল নদে ভাসিয়ে দেয়। ভাসতে ভাসতে শিশু যে ঘাটে ভেড়ে সেখানে সখীদের নিয়ে জলকেলি করছিলেন ফারাওয়ের নিঃসন্তান বোন। শিশুকে দেখে মমতায় বুকে তুলে নেন। রাজপ্রাসাদে সবার চোখের মণি হয়ে বাড়তে থাকে সে ফারাওয়ের বোনের ছেলে বা ভাগ্নে হিসেবে। এই শিশুই মোজেস বা মুসা। যৌবনে পৌঁছলে তার অনেকরকম গুণ প্রকাশ পেতে থাকে। সেসঙ্গে রূপও। এক সময় তিনি নিজের আসল পরিচয় জেনে যান। শুরু হয় ফারাওয়ের সঙ্গে বিরোধ। বিদ্রোহীদের নিয়ে তিনি ফিরে যান কেনান প্রদেশে। সেখানে তুর পাহাড়ের চূড়ায় সদা প্রভু তাকে দশটি নির্দেশ দেন। যা ‘টেন কমান্ডমেন্ট’ নামে পরিচিত। এ কাহিনী নিয়ে হলিউডে অস্কার জয়ী একাধিক চলচ্চিত্র নির্মিত হয়েছে। ধারণা করা হয়, যে ফারাওয়ের সঙ্গে মুসার বিরোধ ছিল সেই ফারাওই দ্বিতীয় রামসিস যার টেম্পেল আমরা দেখতে যাচ্ছি। রাতের নীল নদের দিকে তাকিয়ে এসব কত কি মনে হয়! ধীর-শান্ত বয়ে চলেছে নীল।
ইতিহাস বলে, সেই আদিকাল থেকেই নীল নদের প্রকৃতি শান্ত। ইরাকের দজলা ও ফোরাতের মতো উদ্দাম অস্থির নয়। দক্ষিণের আবিসিনিয়া অঞ্চলের পাহাড়ে নীল নদের উৎপত্তি। এরপর উত্তরে প্রায় দু’হাজার কিলোমিটার বয়ে গিয়ে মিশেছে ভূমধ্যসাগরে। নীল নদের প্রবাহ অনুুযায়ী মিসর উর্ধাংশ এবং নিম্নাংশ বা দক্ষিণ ও উত্তরে বিভক্ত।
কায়রো এবং আলেক্সান্দ্রিয়া ছাড়া সম্ভবত বাকি প্রায় পুরো অংশ উর্ধাংশ বা দক্ষিণ মিসর। দক্ষিণের পাহাড়ে উৎপত্তি বলে এ অংশ মিসরের উর্ধাংশ হিসেবে পরিচিত। দক্ষিণ মিসর আফ্রিকার মরু অঞ্চলের সঙ্গে যুক্ত। ভ্রমণের শুরুতে ইজিপশিয়ান মিউজিয়ামে ম্যাপ সামনে নিয়ে গাইড আবির আমাদের মিসরের ভূগোলের সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দিয়েছিল প্রথমে।
উৎস থেকে উত্তরে বয়ে যেতে যেতে ভিন্ন ভিন্ন ছয় জায়গায় ছ’টি প্রপাত সৃষ্টি করেছে নীল। প্রথম প্রপাত সৃষ্টি হয়েছে এ্যালিফেন্টাইন নামে এক জায়গায়। এর উত্তরে সাহারা মরুভূমি। সাহারার পূব দিকের উপত্যকার নাম মিসর। মিসর শব্দের অর্থ জিজ্ঞেস করলে আবির বলেছিল ‘রক্ষাকর্তা’। প্রফেটস সান। যে রক্ষা করে। আর প্রাচীন মিসরের ‘আসিরিস মিথ’-এ মিসরকে ‘ভূমি’ কল্পনা করা হয়েছে। সূর্যদেব ‘রে’ কন্যা মিসরকে বিয়ে দিয়েছিলেন পুত্র ফারাওয়ের সঙ্গে। মিসর বা ভূমিকে সব ধরনের সঙ্কট ও ঝঞ্ঝা থেকে রক্ষার দায়িত্ব ফারাওয়ের।
একই দেশের দুই অংশ হলেও উত্তর ও দক্ষিণের মানুষের মধ্যে চারিত্রিক এবং সাংস্কৃতিক পার্থক্য তৈরি হয়েছিল। মূলত দুই অংশেই বিদেশী অনুপ্রবেশের জন্য। আফ্রিকার মরু অঞ্চলের সঙ্গে দক্ষিণ অংশের সংযোগ থাকায় সুদানের ব্যবসায়ীরা নদী পথে মিসরীয় ব্যবসায়ীদের সঙ্গে লেনদেন করত। দক্ষিণ মিসরের এ এলাকা সুদানের সঙ্গে বাণিজ্যের জলপথ হয়ে উঠেছিল। উত্তর মিসরে সেমেটিক অনুপ্রবেশ ঘটেছিল প্রাগৈতিহাসিক যুগে। ভূমধ্যসাগর ও এশিয়ার সঙ্গে যুক্ত উত্তরে অনুপ্রবেশকারীরা এসেছে বদ্বীপের দু’দিক থেকে। পূব দিক থেকে সেমেটিক, পশ্চিম দিক থেকে লিবিয়ানরা। প্রাচীন মিসরের ভাষায়ও সেমেটিক প্রভাব ছিল। এই বিদেশী অনুপ্রবেশের জন্য সম্ভবত উত্তর ও দক্ষিণ মিসর পরস্পরের সঙ্গে যতটা ঘনিষ্ঠ ছিল তার চেয়ে বেশি ঘনিষ্ঠ ছিল বাইরের অধিবাসীদের সঙ্গে। নিজেদের মধ্যে বৈষম্য ও রেষারেষিই প্রকট ছিল।
মিসরের সবচেয়ে প্রাচীন লিখিত বিবরণ পাওয়া গেছে খ্রিস্ট জন্মের তিন হাজার চারশ’ বছর আগের। ইতিহাসের শুরু ধরা হয় সেখান থেকে। ইতিহাসের কালপর্ব মোটা দাগে তিন ভাগে ভাগ হয়েছে- প্রাচীন রাজ্য, সামন্ত যুগ এবং সাম্রাজ্য বিস্তারের যুগ।
‘কেমব্রিজ এনসিয়েন্ট হিস্ট্রি’ (ঈধসনৎরফমব অহপরবহঃ ঐরংঃড়ৎু) কে ভিত্তি করে জেমস হেনরি ব্রেস্টেড, হলো প্রমুখ ইতিহাসবিদ এ কালবিভাজন করেছেন। প্রখ্যাত প্রত্নতাত্ত্বিক ফ্লিল্ডার্স পেট্রি অবশ্য মিসরীয়দের গ্রহ নক্ষত্রের আবর্তনের হিসেবে বর্ষ গণনার উল্লেখ করে খ্রিস্ট জন্মের পাঁচহাজার পাঁচশ’ ছেচল্লিশ বছর আগে থেকে শুরু করে মিসরের ইতিহাসের কালপঞ্জী রচনা করেছেন। কিন্তু বেশিরভাগ ঐতিহাসিক ব্রেস্টেড এবং হলোর কেমব্রিজ এনসিয়েন্ট হিস্ট্রিভিত্তিক কাল গণনাকে সমর্থন করেন এবং অধিকতর নির্ভরযোগ্য ও বস্তুনিষ্ঠ মনে করেন। এখানকার ইতিহাসের অন্যতম বৈশিষ্ট্য হলো সব যুগের শাসকরা নিজেদের কীর্তি অমর করার জন্য বিভিন্ন স্থাপত্য নিদর্শন রেখে গেছেন। প্রাচীন রাজ্যের নিদর্শন পিরামিড। তার পরের সামন্ত যুগের নিদর্শন পাহাড় কাটা সমাধি-মন্দির। আর সাম্রাজ্য যুগের নিদর্শন বিশাল মন্দির ও পাথরের মূর্তি।
প্রাচীন মিসর নিয়ে গবেষণা করার জন্য ‘মিসর তত্ত্ব’ বা ইজিপ্টোলজি নামে পড়ালেখার একটি আলাদা বিষয় (ঝঁনলবপঃ) ই চালু আছে। এসব ভাবতে ভাবতে আর আহরিত বিদ্যা ঝালিয়ে নিতে নিতে ঘুমে জাগরণে কেটে যায় রহস্যময় মমীর দেশের প্রথম রাত।
পরদিন ব্রেকফাস্ট শেষে বেরিয়ে দেখি গাইড আবির হাম্মাদ গাড়ি নিয়ে অপেক্ষা করছে। ড্রাইভার গত রাতের সেই য়াহমেদ। মিসরে মোহাম্মেদ আর য়াহমেদ নাম দুটো খুব কমন। কায়রো এয়ারপোর্টে প্রথমে যে আমাদের অভ্যর্থনা জানিয়েছিল তার নাম মোহাম্মেদ। হোটেলে নিয়ে যেতে এসেছিলো যে তার নামও মোহাম্মেদ। তার ড্রাইভারের নাম ছিল য়াহমেদ। এখনকার গাইড য়াহমেদ, ড্রাইভারদের একজনের নামও য়াহমেদ। য়াহমেদ আর মোহাম্মেদের চক্কর! হোটেল লবি রাস্তা মার্কেট সবখানে এ নাম দুটোই বেশি কানে বেজেছে। শব্দ দুটো আমাদের বেশি পরিচিত, সে জন্যও হতে পারে। আমাদের দেশেও বেশিভারগ মানুষের নামের আগে পরে মোহাম্মদ, আহমেদ থাকে। ওরা হয়তো নামের প্রথম অংশ অথবা শেষাংশ ধরে ডাকে। তাই য়াহমেদ মোহাম্মেদের এতো ছড়াছড়ি। আবিরের সঙ্গে মিউজিয়াম পিরামিড প্যাপিরাস হোসেনিয়া মসজিদ ইত্যাদি দেখে রাতে রওনা আসোয়ানের উদ্দেশ্যে। এখন আছি এই নতুন গাইড য়াহমেদের তত্ত্বাবধানে। রিলে রেসের মতো।
॥ তিন ॥
একঘেয়ে মরু পথে চলতে চলতে গাড়ি হঠাৎ থামে। য়াহমেদ জানায় ‘ড্রাইভাররা চা-কফি খাবে, প্রাকৃতিক কর্ম সারবে, চাইলে তোমরাও এসব করতে পারো’। চা-কফির কথা শুনে মনে আনচান করে ওঠে। গত রাতের সেই ভোজন পর্বের পর প্লেনের খাবার আর সঙ্গে থাকা কিছু শুকনো খাবার খাওয়া হয়েছে। চা-কফির সঙ্গে দেখা হয়নি। ড্রাইভারদের মতো আমরাও এসব চাই- য়াহমেদকে জানিয়ে দ্রুত গাড়ি থেকে নামি। কিন্তু হায়! এ তো আর বাংলাদেশের ঢাকা শহর নয় যে রাস্তার মোড়ে মোড়ে কেতলিতে ধোঁয়া উড়বে। এ হচ্ছে সাহারা মরুভূমি। পানি এখানে সাত রাজার ধন এক মানিক। এ বিরান ভূমিতে এ দোকানপাট নেই। রেস্টুরেন্ট জাতীয় আয়োজন তো অকল্পনীয়। য়াহমেদকে অনুসরণ করে ভেতরে গিয়ে শুকনো গলা আরও শুকোয়। কিছু চিপসের প্যাকেট আর ছোট কেক জাতীয় জিনিস সাজিয়ে যে দুজন বসে আছে নির্বিকার মুখে তারা জানায় খাবার পানি চা কফি কিছু হবে না। তাহলে য়াহমেদ যে বলল? ড্রাইভার দুজনই বা গেল কোথায়? আগেই বুঝেছিলাম জীবন জগত সম্পর্কে য়াহমেদ মাত্রারিক্ত উদাসীন। হয়ত এখানে ব্যবস্থা শুধু ড্রাইভারদের জন্য অথবা চা-কফি থাকা না থাকা নিয়তি নির্ধারিত- তা হয়ত সে জানেই না।
যা হোক, গ্রহণ যখন হলো না ভাবলাম বর্জন অন্তত করি। অবকাঠামো খারাপ না কিন্তু সমস্যা ওই পানি। কমোডে পানির ব্যবস্থা ইউরোপেও নেই। কিন্তু হাত মুখ ধোয়া, পরিচ্ছন্নতার পানির অভাব নেই। এখানে সে অভাব প্রকট। নির্ধারিত সময় শেষে গাড়িতে উঠতে উঠতে মরুভূমিতে দু’কদম হাঁটার অভিজ্ঞতা সঙ্গে করে নেই। তাই বা কম কি। ইতিহাসের সাহারা। ভূগোল বইয়ে পড়া সাহারা। বিবিসির প্রামাণ্য চিত্রে দেখা সাহারা। সেখানে হাঁটছি ভেবেই বার বার শিহরিত হই।
গাড়ি ছুটছে দু’ধারে মরু প্রান্তরের মাঝে সোজা রাস্তা দিয়ে। ডানে-বাঁয়ে মোড় নেই। যদ্দুর মনে পড়ে। শুরুর দিকে দয়েকটি লরি ছাড়া কোন ক্রস বা ওভারটেকিং হয়নি। আবু সিম্বেল ভিলেজ এখনও অনেক দূর। এখনকার দৃশ্য প্রায় একই। দু’ধারে ছাইরঙা খরখরে ভূমি, মাঝে মাঝে উঁচু ঢিবি বা স্তূপের মতো। কোনোটা দাঁড়িয়ে আছে। কোনোটা ক্ষয়ে যাচ্ছে। সাহারার এ অংশে গাছপালা দূরের কথা একটা ঘাসের অঙ্কুর কোথাও নেই। লতাগুল্মে ভরা সেই জলজ সাহারা এখন কল্পনা করাও কঠিন। বরফ যুগের অবসানের সময় থেকে সবুজ সাহারা হারাতে থাকে তার সমস্ত লাবণ্য।
প্রকৃতির কি বিচিত্র খেয়াল। যে মৌসুমী বায়ুর প্রভাবে দক্ষিণের অঞ্চল জলসিক্ত হয়ে মানুষ বাসের উপযোগী হয়েছিল বরফ যুগের অবসানে তা হয়ে পড়ে খটখটে রুক্ষ। কারণ বায়ুপ্রবাহ তখন উত্তরে মুখ ঘুরিয়েছে।
উত্তর ইউরোপের বরফ সরে যাচ্ছে আর্কটিকের দিকে। আটলান্টিকের বায়ু প্রবাহ ও গতিমুখ বদলিয়ে উল্টো দিকে বইতে শুরু করেছে। একটু একটু করে বেরিয়ে আসছে ইউরোপ। ক্রমশ মানুষের বাসোপযোগী হচ্ছে। মৌসুমী বায়ুর উল্টো প্রবাহে সাহারা হয়ে পড়ছে বৃষ্টিহীন। প্রচ- গরমে জলাভূমি গেল শুকিয়ে। পুড়ে গেল জলজ উদ্ভিদ। শুধু সাহারা নয় আফ্রিকা এবং এশিয়ার অনেক জায়গার অবস্থাই ক্রমশ এমন হয়ে ওঠে।
তবে প্রকৃতি এতটা নির্মম হয়েছিল বলেই হয়ত এখানকার মানুষের পক্ষে সভ্যতার উন্মেষ ঘটানো সম্ভব হয়েছিল। ওই বৈরি পরিবেশে অনেকগুলো মানবগোষ্ঠী নিজ এলাকা ছাড়তে বাধ্য হয়েছিল। যারা থেকে গিয়েছিল তাদের মধ্যে যারা জীবন ধারণের প্রচলিত অভ্যাস বদলাতে পারেনি তারা ধীরে ধীরে বিলুপ্ত হয়ে যায়। অভ্যাস বদলে টিকে গেল অন্যরা। পশু পালনকে বেছে নিল জীবন ধারণের নতুন উপায় হিসেবে। তৃণভূমির খোঁজে ঘুরতে লাগল এখান থেকে সেখানে। ইতিহাসে এরাই যাযাবর হিসেবে চিহ্নিত।
এলাকা ছেড়েছিল যারা তাদের মধ্যে এক দল যায় সাহারা থেকে দক্ষিণে। সেখানে খাবার সংগ্রহ করতে পারলেও অনভ্যস্ত উষ্ণ আবহাওয়ায় অলস জীবনযাপন করে কোন মতে টিকে থাকল। আরেক দল গেল ইউরোপে। সেখানেও আবহাওয়া অন্যরকম বৈরি। তীব্র শীতের সঙ্গে লড়াই করে বেঁচে থাকা। তবু টিকে গেল তারা। মাছ ধরা পশু শিকারের অভ্যস্ত কাজ করতে পেরে। এ দু’ দলেরই যাবতীয় শক্তি খরচ হয় বৈরি প্রকৃতির সঙ্গে লড়াইয়ে। শেষ দলটি ছড়িয়ে পড়ে আফ্রিকা ও এশিয়ার বিভিন্ন নদী উপত্যকায়। সাহারার জলাভূমিতে যারা মাছ আর পশু শিকার, ফলমূল সংগ্রহ করে জীবন ধারণ করত নদী উপত্যকায় এসে তারা ধীরে ধীরে নিজেদের জীবন ধারণের অভ্যাস পাল্টে ফেলে। উর্বর আবহাওয়ায় ক্রমশ রপ্ত করে কৃষি কাজ, চাষের কৌশল। শস্য রোপণ। নদী তীরের এই অভিবাসীরাই সভ্যতার পথের অগ্রপথিক। কৃষির আবিষ্কারক। পৃথিবীর ইতিহাসে কৃষির আবিষ্কারই প্রথম সমাজ বিপ্লব। এশিয়া ও আফ্রিকার চার নদী উপত্যকার মানুষেরা এর সূচনা করেছিলেন। এসব ঐতিহাসিক তথ্য এখন এ বিষয়ে আগ্রহীদের মোটামুটি জানা।
নীল নদের তীরে যখন ব্রোঞ্জ যুগ চলছে ওদিকে ভোল্্গার তীরে তার এক হাজার বছর পরও চলছে ‘শিকার যুগ।’ তখন অবশ্য আগুনের ব্যবহার শিখে গেছে তারা। রাহুল সাংকৃত্যায়নের ‘ভোল্গা থেকে গঙ্গার’ সে সময়ের একটি চিত্র বেশ আলোড়িত করেছিল। ‘সবার আগে রয়েছে একজন স্ত্রীলোক, বলিষ্ঠ তার দেহ। বয়স চল্লিশ পঞ্চাশের মধ্যে। তার নগ্ন বাহুর দিকে তাকালেই বোঝা যায় সে খুব বলবতী। বাঁ হাতে একটি ছুঁচলো তিন হাত লম্বা ভুর্জ গাছের মোটা কাঠ। ডান হাতে কাঠের হাতলে দড়ি দিয়ে বাঁধা পাথরের কুঠার, শিকারের জন্য ঘষে ঘষে শান দেয়া হয়েছে, তার পেছনে রয়েছে চারজন পুরুষ ও দু’জন স্ত্রীলোক। হাতে কাঠ, হাড় ও পাথরের অস্ত্রাদি এবং তাদের অভিযান দেখে মনে হয়, তারা যেন যুদ্ধে যাচ্ছে। ...পাহাড় থেকে নামার পথে প্রথম স্ত্রী লোকটি হচ্ছে মা। সে বাঁ দিকে ঘুরল, আর সকলে তাকে নীরবে অনুসরণ করল। শিকারিরা এবার তাদের গতি একেবারে কমিয়ে দিল। তারা সতর্কতার সঙ্গে চারদিকে ছড়িয়ে পড়ল। তারপর অতি ধীরে সন্তর্পণে দূরে দূরে পায়ের পাতা ফেলে টিলার দিকে এগোতে লাগল। মা সকলের আগে গুহামুখে গিয়ে পৌঁছাল। গুহার বাইরের সাদা বরফের দিকে ভাল করে তাকাল- সেখানে কোন কিছুর পায়ের চিহ্ন পড়েছে কি না? দেখল কোন চিহ্ন নেই। সে একলাই গুহার মধ্যে প্রবেশ করল, কয়েক পা এগিয়ে গুহার একটি বাঁক দেখা গেল, আলো খুবই কম।...বাকি সবাই দম বন্ধ করে সেখানে অপেক্ষা করতে লাগল। গুহার মধ্যে গিয়ে মা দাঁড়াল মরদ ভাল্লুকটির কাছে, আর দু’জন পুরুষের একজন মাদী ভাল্লুকটির কাছে, অপরজন বাচ্চাটির কাছে গিয়ে দাঁড়াল। তিনজনে একই সঙ্গে ভাল্লুকের উদরে সুতীক্ষè কাঠের বর্শা দিয়ে বিদ্ধ করে হৃৎপি- পর্যন্ত জখম করল।’ ওখানকার সমাজ তখনও মাতৃতান্ত্রিক। সমাজ গঠনের সেই আদি পর্বে গোষ্ঠীবদ্ধ জীবনে মা ছিলেন পরিবার বা দলপ্রধান। মায়ের পরিচয়ে সন্তান পরিচিত হতো। স্বাভাবিক প্রাকৃতিক নিয়মে। মা এবং সন্তানের সম্পর্কই পৃথিবীতে একমাত্র মৌলিক সম্পর্ক। অন্যসব সম্পর্কের সঙ্গে জড়িয়ে আছে স্বার্থ, সমাজ, অর্থনীতি, রাজনীতি। কৃষি আবিষ্কারের পর থেকে মায়ের ক্ষমতা কমতে থাকে। ধীরে ধীরে তার স্থান চলে যায় গৃহাভ্যন্তরে। সভ্যতা এখানে পেছনমুখি। রাষ্ট্র, রাজনীতি, ধর্ম, ব্যক্তিগত সম্পত্তির কারসাজিতে।
অনেকটা পথ পেরিয়ে এলাম। আবু সিম্বেল গ্রাম শুরু হয়েছে কিছুক্ষণ আগে। অদ্ভুত ধরনের গ্রাম। রাস্তার ডান দিকে শুরু হয়েছে, ভেতরে বিস্তৃতি কতদূর জানি না। রাস্তার ধার ঘেঁষে টানা এগিয়ে যাচ্ছে। মাঝখানে কিছু দূর বিরতি। তারপর আবার সাইন বোর্ড- ‘আবু সিম্বেল ভিলেজ’ এ রকম একটু পর পর সাইন বোর্ড টাঙানো। গ্রাম যেমন লম্বালম্বি সামনে এগোচ্ছে তাকে প্রাচীরের মতো ঘিরে এগোচ্ছে সবুজ গাছ আর বর্ণিল ফুল। কিছু নির্দিষ্ট জাতের গাছ আর ফুলের চাষই মনে হয় এখানে সম্ভব। কারণ গাছ-ফুল দুইই তরতাজা হলেও বৈচিত্র তেমন নেই। দু’তিন রকমের গাছ এবং ফুলই সবখানে। এগুলোকেই সম্ভবত বাঁচিয়ে রাখতে পেরেছেন এখানকার মালি বা পরিচর্যাকারীরা।
কৃত্রিম হলেও বেশ আকর্ষণীয় গ্রাম। সাজানো-গোছানো। তবে আবু সিম্বেলের মূল আকর্ষণ প্রাচীন মিসরের সাম্রাজ্য যুগের কীর্তি যমজ মন্দির বা টেম্পেল। এটি দেখতেই পর্যটকরা এখানে আসেন। ইউনেস্কোর ওয়ার্ল্ড হেরিটেজ সাইটে অন্তর্ভুক্ত হওয়ার পর নাম হয়েছে ‘নিউবিয়ান মনুমেন্টস’। প্রাচীন মিসরের সাম্রাজ্য যুগের প্রভাবশালী ও প্রখ্যাত ফারাওদের অন্যতম দ্বিতীয় রামসিস এ মন্দির নির্মাণ করিয়েছিলেন। তার সাম্রাজ্য বিস্তারের বীরত্বগাথা ইতিহাস খ্যাত।
আজকের মিসরেও ফারাও দ্বিতীয় রামসিসের প্রতাপ কম নয়। আমরা যে হোটেলে উঠেছি সেই ইন্টারন্যাশনাল চেইন পাঁচতারকা হোটেলের নাম তার নামে। হোটেল লবির ছাদ ছোঁয়া রামসিস মূর্তি প্রথমেই ধারণা দেয় তার শিখরস্পর্শী বিশালতা সম্পর্কে। মিউজিয়াম মার্কেট পিরামিড চত্বর বা পর্যটক প্রধান এলাকা- সব খানে আছেন তিনি। কখনও আবক্ষ মূর্তিতে, কখনো প্যাপিরাসে, কখনও আবার পোস্টার বা ফেরিওয়ালার হাতে কাঠ কিংবা সিমেন্টের মূর্তিতে। হাতবদল হয়ে এখন আছেন আমার ড্রইংরুমেও।
॥ চার ॥
হোমারের ইলিয়াডে সুন্দরী হেলেনের জন্য প্রবল পরাক্রান্ত ট্রয় নগরী ধ্বংস হয়েছিল। ট্রয় উপাখ্যানের মূলে রয়েছে একটি সোনার আপেল আর আইরিশ নামে এক কুটিল দেবী। ঝগড়া বাধানোই যার কাজ। কুটিল স্বভাবের জন্য অন্য দেব-দেবীরা তাকে এড়িয়ে চলতেন। কোন উৎসবে নিমন্ত্রণ পেতেন না তিনি। ভোজসভায় ছিলেন অনাহূত। এ নিয়ে ক্ষোভের আগুন জমছিল তার মনে। রাজা পেলিউস ও বিদূষী থেটিসের বিয়েতেও যখন আমন্ত্রণ পেলেন না তখন রাগে আগুন হয়ে প্রলয়ঙ্করী এক ফন্দি আঁটেন তিনি। এমন ঝগড়া বাধাতে হবে যা ধ্বংস করবে সব কিছু। বিয়ের অনুষ্ঠানে খাওয়ার আসরে সবার অলক্ষ্যে একটি সোনার আপেল গড়িয়ে দিলেন। যাতে লেখা ‘শ্রেষ্ঠ সুন্দরীর জন্য’। সুন্দরীদের মধ্যে আলোড়ন ওঠে। দেবী কুলে কে হবেন শ্রেষ্ঠ সুন্দরী?
খেতাব পেতে মরিয়া দেবীদের মধ্যে চূড়ান্ত বিচারে টিকে গেলেন তিনজন। আফ্রোদিতি, হেরা এবং এথিনা। এবার প্রতিদ্বন্দ্বিতা তিনজনের মধ্যে সেরা নিয়ে। দেবরাজ জিউসকে তারা অনুরোধ করলেন বিচারকের দায়িত্ব নিতে। জিউস এ কঠিন দায়িত্ব কৌশলে এড়িয়ে গিয়ে আইডা পাহাড়ে পাঠালেন তিন সুন্দরীকে। যেখানে যুবরাজ প্যারিস নিজ বংশ ও দেশ ধ্বংসের কারণ হওয়ার দৈববাণী মাথায় নিয়ে প্রায় নির্বাসিত জীবন কাটাচ্ছেন। তিন দেবী প্যারিসকে শ্রেষ্ঠ সুন্দরী নির্বাচনের অনুরোধ জানান এবং তিনজনই নিজেকে নির্বাচন করার জন্য আড়ালে প্যারিসকে লোভনীয় উপহারের প্রস্তাব দেন। হেরা জানান, তাকে নির্বাচন করলে পুরো ইউরোপ ও এশিয়া খ-ের প্রধান করবেন প্যারিসকে। অপরাজেয় সেনাপতি হয়ে গ্রীকদের পরাজিত বিধ্বস্ত করার ক্ষমতা দেয়ার প্রতিশ্রুতি দিলেন এথিনা। আর আফ্রোদিতি রাখঢাক না করে জানিয়ে দিলেন তাকে শ্রেষ্ঠ সুন্দরী দেবীর স্বীকৃতি দিলে প্যারিসকে তিনি পাইয়ে দেবেন পৃথিবীর শ্রেষ্ঠ সুন্দরীকে। যুবরাজ প্যারিস আফ্রেদিতির প্রস্তাবে সাড়া দিয়ে সোনার আপেলটি তাকে দিয়ে শ্রেষ্ঠ সুন্দরী নির্বাচন করেন। তারপর পৃথিবীর শ্রেষ্ঠ সুন্দরী হেলেনকে পাওয়া এবং অপহরণের সূত্র ধরে দশ বছরের যুদ্ধ শেষ হয় ট্রয় নগরী ধ্বংসের মধ্য দিয়ে।
না রাজা রামসিস প্রেমের জন্য কোনো রাষ্ট্র বা নগর ধংস করেননি। তবে সুন্দরী শ্রেষ্ঠদের প্রতি আসক্তি ছিল তীব্র। তার প্রণয় কাহিনী ছাপিয়ে গিয়েছিল মিসরের সব যুগের সব ফারাওয়ের প্রণয়োপাখ্যানকে। কয়েকশ’ রানী ছিল তার। কৃতী সন্তানে বংশ বৃদ্ধির জন্য নিজের মেয়েদের মধ্য থেকেও কয়েকজনকে বিয়ে করেছিলেন। মৃত্যুর সময় তার সন্তান সংখ্যা ছিল দেড়শ’। একশ’ ছেলে পঞ্চাশ জন মেয়ে। বংশধরের সংখ্যা এত বেড়ে গিয়েছিল যে তারা নিজেরাই একটি সম্প্রদায় গঠন করেছিল। এবং প্রভাব প্রতিপত্তির কারণে ওই সম্প্রদায় বা গোষ্ঠী থেকেই মিসরের শাসক নির্বাচিত হতো। তার সময়ে মিসরে কোনো হোমারের জন্ম হলে হয়তো তার �