শীতে সাংস্কৃতিক কর্মকাণ্ড বেড়ে যায়, সরগরম হয়ে ওঠে ঢাকার মঞ্চ, গ্যালারি আর মিলনায়তনগুলো। দলীয় বা সাংগঠনিক পরিবেশনা এ সময়ে যেন প্রাণ পায়। কিন্তু যারা নিভৃতে সাধনা করেন, নিজের শিল্প এলাকায় নিবেদিত থাকেন তারা কি শীতে বেশি সক্রিয় থাকেন, নাকি অন্যরকম কিছু? সেদিন দেশের একজন বিশিষ্ট শিল্পীর স্টুডিওতে গিয়েছিলাম। তার ব্যস্ততা দেখে মনে হলো কী শীত কী গ্রীষ্ম তিনি সদা কর্মশীল। দেশে ছবি বিক্রির বাজার নিহায়ত ছোট নয়। আগে যেখানে বিদেশী বায়ার আর স্বদেশী শিল্পপতিরা ছবি কিনতেন, এখন সেখানে মধ্যবিত্তও ছবি কিনছেন। শিল্প-শিক্ষার্থীরাও ছবি বিক্রি করে থাকেন। স্বল্প আয়ের চাকুরেরা তাদের ছবির বড় ক্রেতা। যাহোক, শিল্পী জামাল আহমেদের প্রসঙ্গে ফিরে আসি। চারুকলা ইনিস্টিটিউটের এই শিক্ষকের ছবির চাহিদা রয়েছে। বিদেশের তকমা লাগানো, মানে দীর্ঘকাল বিদেশে বসে শিল্পচর্চা করা শিল্পীদের কারও কারও ঈর্ষণীয় পরিমাণে ছবি বিক্রি হয়। অন্যদিকে শতভাগ দেশে অবস্থানকারী সার্বক্ষণিকভাবে শিল্পে নিবেদিত চিত্রকরদের মধ্যে যাদের ছবি সবচেয়ে বেশি বিক্রি হয় তাদের ভেতর আছেন এই জামাল আহমেদ। তিনি কোন রাখঢাক করেন না, সরাসরিই বলেন, আমি ছবি বিক্রি করেই চলি। তাই ক্রেতাদের পছন্দকে আমার মূল্য দিতে হয়।
ডিমান্ড অ্যান্ড সাপ্লাই, অর্থাৎ চাহিদা ও সরবরাহের নীতি অনুযায়ী পণ্য উৎপাদিত হয়ে থাকে। আর্টও একটি পণ্য বটে! অসাধারণ পণ্য। কিন্তু আর্টিস্ট ‘পণ্য’ তৈরি করতে গিয়ে কি স্বকীয়তা/ স্বাধীনতা বিসর্জন দেন? এমন একটি প্রশ্ন শিল্প-সমঝদারেরা করে থাকেন। আসলে শিল্পে কম্প্রোমাইজ বলে একটা টার্ম রয়েছে। অনেক শিল্পীই অনেক সময় এই সমঝোতা করেন। শিল্পী জামাল আহমেদ বললেন, অনেক বাণিজ্যিক প্রতিষ্ঠান তাদের পন্যের প্রসারের বা প্রদর্শনের প্রবণতা থেকে থিম নির্দিষ্ট করে দিয়ে ছবি নিতে চান। সেসব কাজেও আমি নিজের স্টাইল আর বৈশিষ্ট্য বজায় রাখার চেষ্টা করি।
প্রত্যেক শিল্পীরই স্বপ্ন ও কল্পনার একটি স্থান থাকে। সেখানে তিনি বিচরণ করেন। সমাজ-সংসার-বাজারের প্রয়োজন ভুলে সম্পূর্ণ নিজের শিল্পীসত্তার আকাক্সক্ষা অনুযায়ী ছবি আঁকেন। এমন একটি সিরিজের ছবি তিনি আঁকছেন বেশ ক’বছর ধরে। দুটো ছবি সম্পূর্ণ করেছেন, আর দুটো প্রায় সম্পূর্ণ। মোট চারখানা ছবি। চারটিই বিশেষ ধরনের ছবি। খানিকটা সঙ্গোপনেই রাখা আছে স্টুডিওর অভ্যন্তরে। নিয়ে এলেন দেখানোর জন্যে। ভূচিত্র, নিসর্গ, প্রকৃতির ছবি তিনি অনেক এঁকেছেন। নারীসৌন্দর্যের চিত্রকর্মও কম করেননি। ন্যুড ছবিও রয়েছে যথেষ্ট পরিমাণে। এই চারটি ছবির প্রত্যেকটিতে নারীর নগ্নতা তীব্র ও প্রকাশ্য নয়, সেখানে আড়াল আছে। এইসব ছবিতে ঘোড়ার সঙ্গে নারী দৃশ্যমান। একটি ছবিতে সেই ঘোড়া বেশ রাজকীয় মাথা উর্ধমুখী করে রেখেছে, পেছনের দুটো পায়ের কম্পোজিশন দেখবার মতো। নারীও যেন ঘোড়াকেই অনুসরণ করেছে তার দেহভঙ্গিমায়। এইসব ছবিতে চোখ আটকে থাকে, মন বহুদূর চলে যায়।
- মারুফ রায়হান