জাভেদ জলিল বর্তমান সময়ের একজন মেধাবী চিত্রশিল্পী। শিল্পকলা নিয়ে তিনি প্রবন্ধও লিখে থাকেন। ইতোমধ্যে একজন সমালোচক হিসেবে তিনি সতীর্থ শিল্পীদের মধ্যে সমীহপূর্ণ আলাদা স্থান করে নিয়েছেন। তার সাম্প্রতিক কাজকে এক কথায় সময় ও সমাজের বাস্তবতায় সূক্ষ্ম অভিব্যক্তি বা প্রতিক্রিয়া বলা যায়। লস এ্যাঞ্জেলেসে বসবাসের সময় তিনি তার শিল্পীসত্তার সঙ্গে বাইরের দৃশ্যমান জগতের যোগসূত্র স্থাপনের তাগিদ বোধ করেন। তখন সদ্য তরুণ তিনি। ১৯৮৭ সাল থেকে ১৯৯৬ পুরো এক দশক মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের বিভিন্ন আর্ট কলেজে অধ্যয়ন করেছেন তিনি। বিভিন্ন শিল্প কর্মশালায় যোগ দিয়ে তিনি সমৃদ্ধ হন। একইসঙ্গে শিল্পতত্ত্ব বিষয়েও জ্ঞানার্জন করেন। লন্ডনে আয়োজিত সমকালীন ফিগার ড্রইং ও সৃষ্টিশীল মন বিষয়ক একটি কর্মশালা থেকেও তিনি ভিন্নতর অভিজ্ঞতা অর্জন করেন। ফলে তার নিজের শিল্পকর্মে একদিকে তার শিল্পীসত্তার সৃজনানন্দ কাজ করেছে, অপরদিকে সূক্ষ্ম সমালোচক সত্তা তাকে শুদ্ধতার দিকে অগ্রসর হতে প্রেরণা যুগিয়েছে। ১৯৯৩ সালে তিনি একক চিত্র প্রদর্শনী করেন আমেরিকাতেই। এর দু’বছর পরের প্রদর্শনীটিও ছিল সেখানে। এরপর ঢাকায় পাঁচ বছরের মধ্যে তিনটি চিত্র প্রদর্শনী করেন। নিয়মিত শিল্পচর্চা তাকে একজন পেশাদার শিল্পী হিসেবেই প্রতিষ্ঠা দিয়েছে।
১৯৬৯ সালে ঢাকায় জš§গ্রহণ করেন জাভেদ জলিল। তিনি প্রকৃত অর্থে যুক্তরাষ্ট্রের লস এ্যাঞ্জেলসে থাকার সময়ই নিজেকে শিল্পী হিসেবে আবিষ্কার করেন, যেখানে সে তার পারিপাশ্বিক বাস্তবতা থেকে পালিয়ে পার্থিব জগতকে প্রত্যক্ষ করতে সচেষ্ট হন এবং এর সাথে তাঁর নিজেস্ব অনুভূতি ও পর্যবেক্ষণ, পার্থিব জগতের দৃশ্যগত প্রক্রিয়ার বিন্যাস অন্বেষণে তাকে ধাবিত করে। তার চিত্রকর্মগুলো এরই সংমিশ্রণে দৃঢ় যোগসূত্র স্থাপনের চেষ্টা করে যা প্রকৃতিকে অনুধাবন, মানব দৃষ্টিভঙ্গির নৃশংসতা ও অনিয়মের সেই সব দৃশ্যে থেকে উদ্ভূত মানব সক্ষমতা বলেই মনে করি। শিল্পী নিজেকে একটি অনুসন্ধানের কেন্দ্রবিন্দুতে কল্পনা করেন, যেখানে ইন্দ্রিয়বোধ, পার্থিব ও অপার্থিব বাস্তবতা একসঙ্গে পরিবেষ্টিত করেন তার একান্ত দৃষ্টিভঙ্গিতে, আর এ-প্রক্রিয়াকেই তিনি ‘ক্রিপাটক মনোলগ’ নামে অভিহিত করেছেন। একান্ত নিজস্ব পদ্ধতিতেই শিল্পী খুঁজে পান তার শৃঙ্খলা, কাব্য ও স্থায়িত্ব। প্রদর্শিত চিত্রকর্মগুলো শিল্পীর ’অন্বেষণ’-এর একটি দীর্ঘ সময়ের প্রতিফলন, যা এখনও অব্যাহত আছে। তিনি তার আঁকা প্রতিটি চিত্রকর্মকে সময়ের ‘তাৎক্ষণিক মুহূর্তের’ প্রতিচ্ছবি মনে করেন, যা মুহূর্তের সেই যাত্রাকে প্রতিফলন ঘটিয়ে বিবিধ ভাবনায় প্রদক্ষিণ করে। তার রেখার অনন্য শৈলীতে প্রকাশিত হয়ে দেখা দেয় এক অতিসূক্ষ্ম রঙের ব্যবহারে উদীয়মান প্যাটার্ন যা প্রকৃত অর্থেই অসংযম দৃশ্যের অবতারণা করে। প্রদর্শনীতে ক্যানভাস ও কাগজে করা মোট ২০টি তৈলচিত্র প্রদশির্ত হচ্ছে।
জাভেদ জলিলের রহস্যপূর্ণ স্বগতোক্তি শীর্ষক প্রদর্শনীতে একটি সাধারণ সুর প্রত্যক্ষ করা যায়। সেখানে প্রতিটি চিত্রকর্মে রয়েছে একাধিক কুশীলব। যদিও কেন্দ্রস্থিত কুশীলবটি মানুষ। তবে কোন মানুষ? প্রধানত বিপর্যস্ত, আক্রান্ত, বিহ্বল মানুষ। অপরদিকে রয়েছে একেবারে ভিন্ন চিত্র : দ্বান্দ্বিক মানুষ। সে সব মানুষের প্ররোচনা বা ভঙ্গি নাটকীয়। মানুষের এই বিপরীতধর্মী অবস্থান তার ‘স্যাভেজ কিস’ বা ‘অশ্লীল চুম্বন’ ছবিটিতে লক্ষণীয়ভাবে দৃশ্যমান। ইট ইস অনলি ইউ, পিসফুল কন্ট্রাডিকশন ও ফরগিভেন টাইম শীর্ষক ছবিগুলো একই অভিব্যক্তি উপস্থিত করে। ছবিগুলোয় আমরা দেখব মানুষের চোখেমুখে এক অজ্ঞাত অনিশ্চয়তা ও জিজ্ঞাসা। তাদের মনোজগতের প্রতিবিম্ব পড়েছে মুখাবয়বে। সেখানে আগ্রাসী কিংবা ত্রাতার ভূমিকা নিয়ে ডান হাতের কয়েকটি আঙ্গুল প্রাধান্য বিস্তার করেছে।
তবে প্রদর্শনীর সবচেয়ে বড় আকর্ষণ বোধ করি ওয়ার্ল্ড আন্ডার দ্য অক্টোপাস এবং পাপেট্রি অব দ্য স্মোকিং উইমেন। ওয়ার্ল্ড আন্ডার দ্য অক্টোপাস বা অক্টোপাসের নিচে পৃথিবী অত্যন্ত বলিষ্ঠ প্রতীকী ছবি। ক্যানভাসে কুশীলবের ছড়াছড়ি তবে সেখানে গর্ভবতী নারী, ফড়িং, পিঁপড়া ও অক্টোপাসই প্রধান। বলাবাহুল্য নীল অক্টোপাসই কেন্দ্রীয় চরিত্র। এই আটপেয়ে ভয়াল আগ্রাসী প্রাণীটি কুসংস্কার ও রহস্যময় ষড়যন্ত্রের প্রতীক। নারী একই সঙ্গে শিল্পকলা ও আগামী দিনের সম্ভাবনার প্রতীকটিকে ধারণ করেছেন স্বীয় গর্ভে। মানুষ নামের জীবগুলোর কিম্ভুতকিমাকার দশা। স্পেসজুড়ে খেলা চলছে, নীল অক্টোপাসের থাবার নিচে সৌন্দর্য, জীবন ও সম্ভাবনা হতবিহ্বল। উজ্জ্বল রঙের সমাহারে এক অদ্ভুত রহস্যময় জগৎ নির্মাণে মুন্সিয়ানা দেখিয়েছেন শিল্পী। যা দর্শকের বোধ ও মননকে নিশ্চিতরূপেই নাড়া দিয়ে যাবে।
পাপেট্রি অব দ্য স্মোকিং উইমেন বা ধূমপানরত নারীর পুতুলবাজি ছবিটিও সমধর্মী রঙের অবলোপন ও প্রতীকী ব্যঞ্জনায় বিশিষ্ট হয়ে উঠেছে। এখানে ধোঁয়ার কুণ্ডুলীর ভেতর বিকট দর্শন সারমেয়র উপস্থিতি পুরো ছবিটিতে এক ভিন্ন মাত্রা এনে দিয়েছে। মানুষের বিকট বিকৃত অবস্থানের বিপরীতে মানুষরূপী দানবের হুঙ্কার ও অশ্লীলতাও দেখবার মতো।
সমকালীন চিত্রকলায় জাভেদ জলিল তার স্বতন্ত্র শক্তিশালী অবস্থান বজায় রেখেছেন এই চিত্রপ্রদর্শনীর মাধ্যমেও। বোদ্ধা দর্শকরা তার আগামী চিত্রচর্চার দিকে কৌতূহল নিয়ে তাকিয়ে থাকবেন, এ কথা নিঃসন্দেহে বলা চলে।