কুর্মীটোলা ক্যান্টনমেন্টে নিজের ইউনিটের অস্ত্রাগারে দাঁড়িয়ে চায়নীজ সাব-মেশিনগানের ব্যারেল পরিস্কার করছিল সুবেদার আশরাফ কোতোয়াল। ওর বাড়ি জয়পুর হাটের চালিরকান্দি গ্রামে। ঘামে খাকী ইউনিফর্ম ভিজে জব্জব্। তাও চারদিকে গাছ আছে বলে রক্ষা। নইলে অবস্থা আরো খারাপ হতো। আজ ১৯৭১ এর মার্চ এর ২১ তারিখ। ও মনে করতে পারলো না শেষ বৃষ্টি কবে হয়েছিল। কোয়েটাতে কি আর বর্ষা হয়? আমগাছের পাতার ফাঁক দিয়ে ঝকঝকে নীল আকাশ দেখা যাচ্ছে। মেঘের লেশ মাত্র নেই কোথাও। অস্ত্রটার কাজ শেষ হতে হতে আশরাফ ভাবছিল কবে বৃষ্টি হবে কে জানে। ওর সঙ্গের ত্রিশজন সৈন্যও একই কাজে মগ্ন। কারো কারো কাজ শেষ। কয়েকজনের হবার পথে। ও এবার সবার কাজ একে একে পরীক্ষা করলো। ওর মুখে চোখে সন্তুষ্টির ভাব ফুটে উঠলো। গতকাল বিকেলে অফিস শেষ হবার সময় কম্যান্ডিং অফিসার এর এই আদেশ হঠাৎ এসে হাজির। সমস্ত হাতিয়ার আজ বেলা বারটার মধ্যে পরিস্কার করে রাখতে হবে।
সবার কাজ শেষ। আশরাফ এবার ওর সৈন্যদের হুকুম দিল হাতিয়ারগুলো অস্ত্রাগারে জমা দিতে। অফিস বেলা দুটো পর্যন্ত। আশরাফ ঘড়ি দেখলো। বেরেট্ টা যথা স্থানে রেখে, ঘাম মুছে সি.ও.র রুমের পাশে তাঁর সহকারীর রুমে গেল। সহকারী একজন হাবিলদার। নাম রুস্তম খান তালপুর।বাড়ি সিন্ধুর থাট্টায়। ওকে বলল, স্যারের সঙ্গে দেখা করতে চাই। তালপুর টেলিফোনে কথাটা সি.ও. কে জানালো। সি.ও বাঙালি। তিনি অনুমতি দিলেন। স্যালুট শেষে আশরাফ বলল, স্যার, এক্টু বাড়ি যেতি চেয়েছিলাম।
- এই সময়ে?
- স্যার, কোন অসুবিধা?
- না না। মানে ঢাকায় প্রেসিডেন্টের সঙ্গে আওয়ামী লীগের আলোচনা চলতেছে। যে কোন সময় ক্ষমতা হস্তান্তরের পরিকল্পনার ঘোষণা হইতে পারে। তখন তো উৎসব হইব। ফায়ার ওয়ার্ক হইব। তখন ফৌজ লাগবো না?
- স্যার, ছোট চাকরি করি। এই সব খবর কি আর...
- না, আশরাফ। এখন সারা প্রদেশের মানুষই এই সব কথা জানে। যাই হোক তোমার কি খুব জরুরি দরকার?
- না স্যার, তা না।
- আমার মনে হয় তাইলে,একটু অপেক্ষা কর। তবে একান্ত জরুরি হইলে পরে কইও।
বাঙালি হোক, পাঞ্জাবি হোক, এই পেশায় তর্ক বা যুক্তি প্রদর্শনের কোন সুযোগ নেই। আশরাফ বাঙালি সি.ও.র হুকুম মেনে রুম থেকে বের হয়ে এসেছিল। আশরাফ স্বভাবে সরল। বের হবার সময় সি.ও. ওকে বলেছিলেন, কোতায়াল, চোখ কান খোলা রাইখ মিঞা।
সরল মন সরলই থাকে। আশরাফ শহরের রাজনৈতিক পরি¯ি’তির খবর নেয়া চাকরি বিধির পরিপš’ী বলে বিশ্বাস করে এসেছে। তবু ক্যান্টনমেন্টের থার্ড গেটে মিছিলের শ্লোগান, জয়দেবপুর সেনানিবাসে গুলি বর্ষনের খবর কি ভাবে যেন বাঙালি সৈন্যদের কাছ থেকে না শুনে পারেনি। ওর কানে লেগেছিল, ফায়ারওয়াকস হবে, রেডিওতে মুজিবের সরকার এর কথা শোনা যাবে কথাগুলিতে। আশরাফ দু’দিন ভেবেছিল। সাহেবের ইউনিটে সে আজ চৌদ্দ মাস ধরে আছে।
ও সরল হলেও এটুকু বুঝে এসেছে যে সাহেব কেতাবী মিলিটারী গাম্ভীর্যের আড়ালেও অধস্তন বাঙালিদের সঙ্গে সাধ্যমত ভালো ব্যবহার করেন। তবু আশরাফ ছুটির কথাটা আর তুলতো না। কিন্তু দু’দিন পর ওর গ্রাম থেকে চিঠি এল। ওর বাবা তাতে লেখেছেন, আট মাস হয়ে গেল। নিজের প্রথম ছেলেকে দেখতে আসলি না একবার?
আশরাফ কোতোয়ালের ইউনিট খেমকারান ক্যান্টনমেন্টে পোষ্টেড ছিল। তখুনই শিশুটির জন্ম হয়। ইউনিট পূর্ব পাকিস্তানে বদলী হয়েছে ২৮ শে ফেব্রুয়ারি, ১৯৭১। অথচ আশরাফ এর মধ্যে একবারও বাড়ি যেতে পারেনি। নতুন স্টেশনে এসেই ছুটি চাওয়া যায় না। তারপর ১লা মার্চ থেকে ঢাকার অবস্থা কানে কানে শুনে ও আরো অপেক্ষা করা ঠিক বলে ভেবেছিল। আজ ভাবল এখন কথাটা পারা যায়।
এটি এ বংশে প্রথম নাতি। কোতোয়ালের ছোট তিন ভাই আছে। তারা এখনো কেউ বিয়ে করেনি। শুনে মেজর মুস্তাফিজ ময়মনসিংহের ভাষায় বললেন, আরে মিয়া এইডায় কি আর না করন যায়? খুব ভালো খবর। এই কথাডা তো আগে কও নাই।
ছুটি দেবার ব্যাপারে কোন কড়াকড়ির নিদের্শ নেই উপর অলাদের কাছ থেকে। অতএব দু’মাস চাওয়া মাত্র কোতোয়াল ছুটি পেয়ে গিয়েছিল। সেটা সাত সপ্তাহ আগের ঘটনা।
ছুটির আর দশদিন বাকি আছে। প্রথম সন্তান, তাও আবার ছেলে। ওকে নিয়ে আশরাফের এতগুলো দিন যে কোথা দিয়ে কেটে গেছে টেরই পায়নি। ওর বাবা এবং শশুরবাড়ির আর্থিক অবস্থা ভালো। আকীকা আর ভুরিভোজ এ গ্রামের প্রায় কেউ বাদ পড়েনি। এ বাড়িতে কোন রেডিও না থাকলেও ২৬ শে মার্চ রাতে ঢাকায় যা হয়েছে তার বেশ কিছু খবর কানে কানে এই গ্রামেও এসে পৌঁছেছিল। এই খবরে আশরাফের বাবা বলেছিলেন, তো ভালো কথা। শুনছি মহকুমা আর জেলা শহরগুলিতেও পাঞ্জাবি সৈন্যরা আসতেছে। আসা দরকার তো। যারা জয়বাংলা বলি ফাল পারতাছে হেই ডিসেম্বর মাস থেকি তারা তো ৪৭ এ মা’র পেটেও আসেনি। এই চাঁদ তারা নিশানের দাম হেরা কি বুঝবি? কতটুকু বুঝবি? এইটা বুঝানোর জন্যি এই সৈন্যদের আওনের দরকার আছে।
আশরাফ কোতোয়াল পাঞ্জাবীদের সঙ্গে চাকরি করছে ছ’বছর ধরে। ১৯৬৫’র যুদ্ধের পর ও সেনাবাহিনীতে ভর্তি হয়। মুক্তিবাহিনীর কিছু কিছু কথা ও শুনেছে। ও মনে মনে তাতে একমত হয়নি। এদিকে শিশু পুত্র। সীমান্ত, এই গ্রাম থেকে খুব দুরে নয়। গ্রামের তরুণ যুবক দু’একজন ওকে এর মধ্যেই বলেছে ও ওদেরকে ট্রেনিং দিতে পারে কিনা। উদ্দেশ্য শুনে ও চমকে উঠেছে। বলেছে ‘কি বলতিছ। জানতি পারলি জানে মারি ফেলাবে। তাছাড়া ওরা মুসলমান, লোক ভালো।’ কথাটা আর আগায়নি। ও ভাবছিল ছুটির একদিন থাকতেই ঢাকা রওনা হবে।
ওদিকে গ্রামের বয়োজোষ্ঠরা ভাবছিলেন অন্য কথা। পাঞ্জাবী মিলিটারীরা নাকি এখন থানায় থানায়ও ঢুকছে। পাকিস্তান বিরোধী সন্দেহে কাউকে কাউকে ধরে নিয়ে যাচ্ছে। সেদিক থেকে তাহলে তাদের গ্রাম নিরাপদ। ওরা যদি আসেও এদিকে তখন দেখানো যাবে, তোমাদের দলের সৈন্য আছে এই গ্রামের পোলা। আবার তার বাবাও মুসলীম লীগার এবং শান্তি কমিটির সদস্য। অতএব গ্রাম নিরাপদ। চিন্তাটি যুক্তিযুক্ত বটে।
আজ মে মাসের ১৮ তারিখ। বুধবার জৈষ্ঠের ৪ তারিখ। গতকাল ভালো বৃষ্টি হয়েছিল। আজ সকাল থেকে আকাশ পরিস্কার। বেলা দশটা। আম গাছের সবুজ পাতার ঘনছায়া এ বাড়ির চারদিকে। উঠানের এক কোণে ধান শুকাতে দেয়া। আশরাফের ছেলেটি উঠোনো ঘুরে বেড়াচ্ছে। সঙ্গে একটা মেয়ে আছে। ওর বৌ রান্নাঘরে বড় দুটো মাটির রাইং এ ধান সেদ্ধ করছে। বাতাসে সেই ধানের গন্ধ। এই গন্ধ নাকে লাগতে লাগতে জয়নবের মনের একটা স্মৃতির জানালা খুলে গেল।
সেটা একটা চিঠির লেখা। ওর স্বামীটি কথা কম বলে। হাতে শক্তি মারাত্নক। পড়াশোনা করেছিল ক্লাশ টেন পর্যন্ত। তারপরই সৈন্যের খাতায় নাম লেখায়। বিয়ে হয়েছে তারও পাঁচ বছর পর। পাশের ইউনিয়নে বাড়ি। এই লেখার বিষয়টা হলো তার কাব্যপ্রীতি। বিয়ের পরই পশ্চিম পাকিস্তান। করাচী, কোয়েট, নয় শিয়ালাকোট। ওখান থেকে চিঠি লিখতো। এবার গত জানুয়ারি মাসে লেখা চিঠিটায় একটা কবিতা ছিল।
‘কোন এক পূর্ণিমার আলো মাখা রাতে
বকুলের মালা ছিল তব ভীরু হাতে
লাজে নত মুখখানি বুকে অনুরাগ
প্রদীপের শিখা মনে মমতার দাগ।’
এসব বাণী এমন অমোঘ যে অল্প বয়সী এবং সামান্য শিক্ষিত মানুষও এগুলো বুঝতে পারে।
অনেক শান্ত মানুষের ভালবাসা কোন গহীনে যেন লুকানো থাকে ভেবে ক্লাশ এইট পাশ জয়নবের মনের গভীরে খুব ভাল লাগল। আহ কত দিন পর মানুষটাকে একটানা এতদিন কাছে পাচ্ছে। আশরাফ কোতোয়াল বৌকে বলে, বাড়ির বের হবে, লেদু খলিফার দোকানে যাবে। ওখান থেকে কিছু জিনিস আনতে হবে। আজ গঞ্জের হাটবার। গত সপ্তাহের হাট থেকে মেলা জিনিস কেনা হয়েছিল। তাই আজ আর ওখানে যাবার দরকার নেই। আশরাফ এর মা বলে দিয়েছেন তাড়াতাড়ি ফিরতে। ছেলেকে সহজে কাছে পাওয়া যায় না। শীতকাল এমনি এমনি গেছে। পিঠা চিড়া কিছু খাওয়ানো হয়নি। আজ এই অসময়ে তিনি একটা পিঠা করছেন। দুপুরের খাবার এর আগেই এটা খেতে হবে। চিতই পিঠা আর মোরগের মাংস। এই পিঠার অবশ্য ঋতু নেই। বছরের যে কোন সময় তৈরী করা যায়।
আশরাফ বাড়ি থেকে বের হয়ে হালটের পথ ধরলো। দু’শ গজ পার হয়েছে। একটা জলপাই রং এর ট্রাক হালটের উপর দাঁড়িয়ে আছে। ছ’বছর সেনাবাহিনীর চাকরি এবং একটি প্রোমোশন পাওয়া সুবেদার আশরাফ কোতোয়ালকে এই বাহন এবং দৃশ্যপট চিনতে পাঁচ সেকেন্ডও ব্যয় করতে হলো না। তাৎক্ষণিক অনুভূতিটি ঠিক ভীতি না বিস্ময় না অনিশ্চিয়তার তা বুঝতে পারলো না ও। তবু সৈন্য তো। মুহূর্তে নিজেকে প্র¯‘ত করলো। চালকের সিটের বাঁ দিকে একজন ফর্সা মানুষ বসে আসে। মানুষটা নেমে আসল। সাত আটজন গ্রামবাসী এর মধ্যে হালটের আশপাশে কৌতুহলী চোখে ট্রাক’টার দিকে তাকাচ্ছে। মানুষটার পেছনে পেছনে ট্রাক থেকে জন পনের সৈন্য নিচে নেমে এসেছে। প্রথম লোকটা একজন ক্যাপ্টেন। বেরেট আর খাকী ইউনিফরম পরনে লোকটার উ”চতা ৬ ফুট হবে। ভীষণ খাড়া নাক। চোখে প্রবল সন্দেহ। তার হাতে কোন অস্ত্র নেই। সৈন্যদের কারো হাতে ষ্টেনগান, কারো ব্রেনগান কিংবা রাইফেল। মাথায় জলপাই রংয়ের নেট লাগানো একই রংয়ের স্টীলের হেলমেট। একজন সৈন্য ট্রাক এর মাথার উপর একটা মেশিন গান পেতে সেটার নল সামনের দিকে তাক্ করে রেখেছে। সে ট্রাক থেকে নামল না। আশরাফ এবার ট্রাকটার নাম্বার দেখতে পেল। ২০ পাঞ্জাব। ওর সাহস এবং আত্নবিশ্বাস আরো বেড়ে গেল। ক্যাপ্টেন এখন আশরাফ এর দিকে এগিয়ে এসেছে। তার বুকে ঝোলানো প্লাস্টিকের প্লেটে নাম দেখা যাচ্ছে। ওয়াসীম নায়েক। আশরাফ এবার ওয়াসীমকে সালাম দিয়ে নিখুঁতভাবে স্যালুট করলো। নায়েক স্যালুটের প্রত্যুত্তর করলো না। আশরাফ এর পরনে লুঙ্গী, উপরে হাওয়াই শাট, পায়ে এক জোড়া রাবারের পাম্প সু। নায়েক কয়েকটি ভয়াবহ কঠিন পরীক্ষায় পাশ করে এই চাকরি এবং দুটি পদোন্নতি পেয়েছে। তারপরও তার কাছে মনে হলো, ‘না, এটা কোন রাজাকার, কোন আল শামস বা কোন মুক্তির কাজ হতে পারে না। আমি কারো গান শুনেই বুঝতে পারি ঐ শিল্পী কি এক বছরের না দশ বছরের পুরোনো। আর এটা তো আমার পেশা। কোন চালবাজি নয়। এ লোক জেনুইন। এমন করে স্যালুট করতে পারা একজন খাঁটি সৈন্যের পক্ষেই সম্ভব’। স্যালুটের প্রত্যুত্তর না পেয়ে আশরাফ একটুও মনোবল হারালো না। ইউনিফরম ক্যান্টনমেন্ট এ রেখে আসলেও ট্রেনিং আর অভিজ্ঞতা সঙ্গেই আছে- নিখুঁত উর্দুতে ও এবার জোরে বলল- স্যার, আমি পাকিস্তান সেনাবাহিনীর সুবেদার আশরাফ কোতোয়াল।
ওর ডান হাত এখনো কপাল থেকে নামায়নি। এবার নায়েক জিজ্ঞেস করলো, তোম লোগ কৌন সে ফৌজ মে হ্যায়?
- স্যার, সতের পাঞ্জাব। ঢাকা ক্যান্টনমেন্ট।
- তোমহারা সি.ও. কো নাম বাতাও।
- মেজর মুস্তাফিজুর রহমান, সাব।
- তোমহারা পারসোনাল নাম্বার?
- পি-৫১০০৫
- ডান্ডি কার্র্র্ড হায় তোমহারা পাছ?
- হামারি মোকাম ইছ গাঁও মে হ্যায়। ডান্ডি কার্ড উধার সে হ্যায়। আভি হাম ছোটি সে হ্যায় স্যার।
বিশ্বাস এবং হাসি দুটোই ফুটে উঠলো ক্যাপ্টেনের ফর্সা মুখে। এবার সে নিখুতঁ আনুষ্ঠিনিকতায় স্যালুটের প্রত্যুত্তর করলো। পেছনের সৈন্যদের মধ্যে যে টানটান ভাবটা ছিল তা এখন চলে গেছে। ক্যাপ্টেন এগিয়ে এসে এই অধঃস্তনের সঙ্গে হ্যান্ডশেক করলো। তারপর তাদের মধ্যে ছুটির কারণ, দেশের বর্তমান অবস্থা, গ্রামের এবং পূর্ব পাকিস্তানের সাধারণ মানুষদের মনোভাব নিয়ে আলোচনা হলো। কিছুক্ষণ চুপ থেকে নায়েক যেন আশরাফ এর মনোভাব পড়তে পেরে জানতে চাইল, তোমার বাড়ি কতদূর? আশরাফ একান্ত খুশী মনে বল্ল, স্যার সাহস করিনি এতক্ষণ। ঐ যে বাড়ি দেখা যায়। স্যার, অনুমতি করলে একটা কথা বলি?
- বল।
- চলেন আমার বাড়িতে চলেন। আমার বাবা, মা, বৌ সবাই খুশি হবে। দুপুরের খানা খাবেন ওখানে।
সা¤্রাজ্যবাদী ব্রিটিশ মেকলে ১৩০ বছর আগে বলেছিলেন - বাঙালি উর্ধ্বতনের সঙ্গে তোষামদী করে। এই মুহূর্তে আশরাফ ঠিক সেই অনুভূতিতে আক্রান্ত না হলেও উর্ধ্বতনের কাছ থেকে নিরাপত্তাবোধে আকান্ত্র। মনের এই অবস্থায় মানুষের মনের কথা দ্রুত বের হয়ে আসতে পারে। ও বিনা চিন্তায় ফট করে বলে ফেলল, স্যার, পূর্ব পাকিস্তানের মানুষ গরীব হলেও তারা অতিথিপরায়ণ।
ক্যাপ্টেন নায়েকের মুখভাবের পরিবর্তন হলো না তবে মনোভাবের হলো। তার মানে সৈন্য হয়েও এও অন্যান্য বাঙালীর মতো রাজনীতি করে। তার মনে “পূর্ব পাকিস্তানিরা গরীব” কথাটা গেঁথে গেল। তার মানে পশ্চিম পাকিস্তানিরা ধনী? আরো প্রশ্ন- এদের গরীবানার জন্য দায়ী কে? নিশ্চয়ই একই উত্তর সবার মনে। কোন সৈন্য বা খাঁটি মুসলমান এমনভাবে রাজনীতি করতে পারে না। আর দেশের এ দূর্দিনে এ ছুটি নিয়েছে কেন? হিন্দুদের সঙ্গে হাত মিলিয়ে পূর্ব পাকিস্তানকে কেন্দ্র থেকে বিছিন্ন করার জন্যে? নিশ্চয়ই তাই।
ক্যাপ্টেন হাসি মুখে বলল আলবৎ। তোমার দাওয়াত কবুল। তবে আমরা বিশজন মানুষ। এত রান্না বান্নার তকলিফ...
সুবেদার জানালো, না কোন অসুবিধা হবে না। সব কিছু ঘরেই আছে।
--
ক্যাপ্টেন নায়েক এবং তার বাহিনীর আহার পর্ব শেষ হয়ে গেছে। লড়াকু সৈন্য। তার মধ্যে আর্য্য বংশ। গরম আর ভেজা বিদেশ বিঁভুই।
তাই খাদ্য পানীয় নিঃশেষ হলো প্রচুর। গ্রামের রান্না বলে রক্ষা। শহরের হলে এই পরিমাণটা পর্যাপ্ত হতো না। গ্রামে রান্না করা হয় বেশী।
খাবারের আগেই আশরাফ তার বাবা ওমর আলী কোতোয়াল এর সঙ্গে ক্যাপ্টেনকে পরিচয় করিয়ে দিলেও আর একটা কাজ করতে ও ভূল করেনি। দেরীও করেনি। তাহলো ওর ইউনিট আইডেনটিটি কার্ডটা নায়েককে দেখানো। ঈমানের দেশ হলে হবে কি চাক্ষুস প্রমাণপত্র বড়ই জরুরি। নায়েক খুব হালকাভাবে কার্ডটায় চোখ বুলালো। কারণ সে প্রথমেই বুঝতে পেরেছে যে কাওয়াল খাঁটী পাকিস্তানি সৈন্য। আর তাছাড়া খাঁটি সৈন্য হলেই বা...?
--
এখন উদাসী এবং রোদেলা দুপুরে গাছের ছায়ারা দীর্ঘ। চেয়ার আর বেি তে সবাই বসে আছে। গ্রামে মেহমান এলে সাধারণত আশেপাশের মানুষরা জড়ো হয়, নিমন্ত্রণ না পেলেও। আজ তেমন একজনও আসেনি। বরং দু’চারজন যারা ছিল তারা কখন যেন নীরবে সরে পড়েছে। পানাহারে তৃপ্ত হলেও উঠোনের চার কোণে বসা এবং দাঁড়ানো পাঁচ ছয়জন সৈন্যের হাতে ভারী আগ্নেয়াস্ত্রগুলোকে এতটুকু শ্লথ দেখা যাচ্ছে না। আশরাফের বাবা, মা, স্ত্রী এবং কাজের মেয়েরা তা খেয়াল না করলেও বিষয়টা আশরাফের চোখ এড়ায়নি। এত মেহমানদারি, এত চর্ব, চোষ্য, লেহ্য, পেয়, এত পরিতৃপ্তির ঢেকুর। তবু ওর মনে কোথায় কি যেন একটা খচ্ খচ্ করে। ক্যাপ্টেন আলাপের ভঙ্গীতে আশরাফ এর বাবাকে জিজ্ঞেস করে কি সুন্দর গ্রাম আপানাদের। কচুরীপানা, পুকুর, হাঁস,মুরগী। এত সবুজ ছায়া। ঘাস ভরা মাঠ, ধান ক্ষেত। অথচ কিছু লোক এই শান্ত সুন্দর দেশটাতে অশান্তির আগুন জ্বালিয়ে দিয়েছে। আশরাফের বাবা, শান্তিকমিটির চেয়ারম্যান বলে, এই দেশের শান্তি কেউ নষ্ট করতে পারবে না। আপনারা আছেন, আমরা আছি। নায়েক এ কথার কোন উত্তর না দিয়ে বলে- অথচ জানেন, আমার বাড়ি রাওয়ালপিন্ডির পাশে ঝং জেলায়। সেখানে কি গরম। নাই গাছ, নাই বৃষ্টি, নাই এরকম পুকুর বা ঘাস। কত কষ্টে আমরা ওখানে জীবন যাপন করি।
এখন পান খাওয়া চলছে। আশরাফ তার শিশু সন্তানকে কোলে করে ক্যাপ্টেন নায়েকের সামনে নিয়ে আসে। বলে স্যার, ইয়ে মেরে আওলাদ হ্যায়।
নায়েক মুখ ভরা হাসি নিয়ে প্রশ্ন করে ইস্কা উমর কিত্না হ্যায়?
আশরাফ উত্তর দেয়। ক্যাপ্টেন এবার শিশুটির চিবুকে হাত ছুঁয়ে বলে, বেটে তোমহারা নাম কিয়া হ্যায়?
আশরাফ উত্তর দেয়। বলে, আকবর, স্যার।
বহুৎ আ”ছা নাম। মোঘল বাদশাহর নাম।
গরমের মধ্যে স্বাস্থ্যবান শিশুটি একটি সুতীর নিমা পরে রয়েছে। ক্যাপ্টেনের সামনে দাঁড়ানো একজন সৈন্য হাতে ধরা আগ্নেয়াস্ত্রের নল সে তার নখ দিয়ে পরীক্ষা করছে। এসব ব¯‘ চেনার বয়স তার হয়নি। বাঘ বা সাপ এর অর্থ তার কাছে একই। সৈন্যটিও হাসিমুখে শিশুটির এই কাজটি দেখতে থাকে। বাধা দেয় না। উর্দু বলতে না পারায় ওমর আলী কোতোয়া ছেলের মাধ্যমে কথা বার্তা বলছিল। এবার সে বাড়ির ভেতরে যায়। ছেলের সঙ্গে সে আগেই একটা বিষয়ে পরামর্শ করেছে। ‘বাব্বা, খাস পাঞ্জাবি সাহেব। ছেলের উপরওয়ালা। অতএব, বিশেষ একটা কিছু করতে হবে।’ উঠোনের কথাবার্ত এখন প্রায় থেমে গেছে। বড় শোবার ঘর আর রান্না ঘর থেকে নারীরা এই মেহমানদের আহার গ্রহণ এবং আলাপচারিতা লক্ষ্য করছিল। তারা এগুলো রান্না এবং সরবরাহও করেছে এতক্ষণ ধরে। যদিও সামনে আসেনি। এখন ক্যাপ্টেন আস্তে করে ওর পাশে বসা নায়েব সুবেদার লছমন খান আশ্রাবিয়াকে কি যেন বলে। কথাগুলো গুরুমুখী ভাষায় বলায় ভাল উর্দু জানা সত্ত্বেও আশরাফ বুঝতে পারে না। আশ্রাবিয়া মাথা নাড়ে এবং সৈন্যদের দিকে তাকায়। আশরাফ এবার ক্যাপ্টেনকে বলে, ওর বাবা ওদের দলকে বিশেষভাবে সম্মান প্রদর্শন করতে চান। এতে কোন আপত্তি আছে কিনা? ক্যাপ্টেন বলে, আপত্তি নাই। আশরাফ বাবাকে জোরে ডেকে উঠানে আসতে বলে। ওমর আলী পেছনে তার তিন পুত্র এবং হাতে একটি পাকিস্তানি পতাকা নিয়ে উঠানে নামে।
অনেকটা গার্ড অব অনারের ভঙ্গীতে ক্যাপ্টেনের সামনে দাঁড়ায় এবং চারজনে শ্রোগান দেয় -
‘পাকিস্তান জিন্দাবাদ
মুসলীম লীগ জিন্দাবাদ।’
এসময় এক সঙ্গে তিনজন সৈন্যর হাতের আগ্নেয়াস্ত্রের গুলি ঝিমধরা বিকেলের নীরবতাকে ভেঙ্গে দেয়। সেই সঙ্গে ওর স্বপ্নভরা দেশ পাকিস্তানের স্বপ্নও ভেঙ্গে যেতে থাকে। মুহূর্ত আগে আশরাফ এর কাছে কাছাকাছি এমন একটা কিছু কেন যেন মনে হয়েছিল। । কিন্তু পাশের সৈন্যটির সাব-মেশিনগানটি কেড়ে নেবার কথা ভাবার আগের সেকেন্ডেই প্রথম গুলিটি ওর শিশুপুত্র এবং ওকে একসঙ্গে বিদ্ধ করলো। একই সঙ্গে ব্রাশ ফায়ারে, জাতীয় পতাকাকে সম্মান প্রদর্শন রত ওর বাবা এবং তিন ভাই নায়েকের সামনে লুটিয়ে পড়েছে প্রবল আর্তনাদে। আর একজন হাবিলদার রান্নাঘরের ভেতরে একটা স্টেনগান এর ম্যাগাজিন নিঃশেষ করেছে। ওখান থেকে তিনজন অন্তঃপুরবাসিনীর আর্তনাদটুকুও শোনা গেল না। উপরে আমগাছের শাখা থেকে এক ঝাঁক কাক আর শালিকের দল ডানা ঝটপট করতে করতে উড়ে চলে গেল। গুলি চলছে। আশরাফ উঠোনে পড়ে গেলেও এখনো জ্ঞান হারায়নি। যদিও ইউরিপাইডিস এর দার্শনিক উক্তি, ‘একজন খারাপ মানুষের কাছে উপহারের কোন মূল্য নেই’ একজন সাধারন সৈন্যের জানার কথা নয় তবুও মনের চোখ ওর খুলে গেছে। আধো বোজা চোখে ও ওর ঠিক সামনে একজন সৈন্যর বুট সমেত পা দেখতে পাচ্ছে। পুত্রর লাশ ও দেখতে পাচ্ছে না । আরো দেখতে পাচ্ছে দুটো গুরুত্বপূর্ণ জিনিস। রাখালরা উঠোনের খড় বা ধানের ভেতর অনেক সময় এই জিনিসগুলো রেখে দেয়। দুটো কাস্তের বাট দেখা যাচ্ছে ওর চোখের ঠিক সামনে। আশরাফ একটা কাস্তে তুলে নিল। প্রদীপ নিভে যাবার আগে দপ্ করে জ্বলে উঠে। এই দেশী অস্ত্রটা দিয়ে ও সামনের বুট সমেত দু’পা এর পেছনের মাংসে এক সঙ্গে পোঁচ দিল। গত পাঁচ বছর বাঙালি কোতায়াল বিশ জন পাঞ্জাবি সৈন্যকে কঠোরভাবে নিয়ন্ত্রণ করে এসেছে। ওর হাতে এখন সেই অধিনায়কের শক্তি। প্রচন্ড চিৎকারে সিপাই লস্কর ওয়ালিয়া আশরাফের উপর পড়ে গেল। শরীরের শেষ শক্তিটুকু ডান হাতে স য় করে ও সিপাইটার গলায় কাস্তেটা চালিয়ে দিল। একই সঙ্গে সামনে থেকে একটা স্টেনগানের একরাশ গুলি আশরাফকে ঝাঁঝরা করে দিল।
--
এখন এখানে কোন শব্দ নেই। উঠোনময় সুনসান নিরবতা। উদরভরা মোরগের মাংস, চিতই পিঠা, কাতল মাছ, ভাত, নারিকেল আর রসগোল্লা নিয়ে ক্যাপ্টেন ওয়াসীম নায়েক এর দলটি বাড়ির বাইরে নেমে আসতে থাকলো। ওয়াসীম, লছমনকে বলল, আ”ছা, বাঙালি আবার মুছলমানই কি মুসলীম লীগই কি? বল তো।
লছমন বলল, হাঁ সাব, আপনে ঠিক বোলা।
ওরা বের হয়ে ট্রাকে উঠলো। পেছনের উঠোনে পড়ে রইল।
- একটি প্রত্যাখ্যাত পতাকা।
- চারটি বিশ্বাসী পুরুষের লাশ।
- আজ প্রত্যুষ থেকে অভূক্ত তিনজন অন্নপূর্ণার নিষ্প্রাণ দেহ।
- জন্ম মৃত্যু বুঝতে পারেনি এমন একটি নিষ্পাপ শিশুর বিচূর্ণ মাথা।
- একজন মৃত মুক্তিযোদ্ধা।
- বিশটি ডাবের খোসা এবং অসংখ্য কৃতঘœ বুটের চিহ্ন।