সামান্য একটা জানালার পর্দা কীভাবে মানুষের মুড বদলে দেয়, অবাক হয়ে ভাবে লায়লা শর্মিন। মনের ক্যানভাসে আকস্মিকভাবেই নতুন রঙের প্রলেপ এসে পড়ে।
অফ হোয়াইট দেয়ালের কনট্রাস্টে সোনালি রঙের এই পর্দাটার দিকে তাকালে প্রথম প্রথম মনটা ফুরফুরে হয়ে যেত তার। নতুন কোন অতিথি এলে, অতিথি মানে সাক্ষাতকার প্রদানকারী ব্যক্তি, হোন তিনি হালের ব্যান্ড গায়ক কিংবা ইউনিভার্সিটির তুখোড় ডিবেটার, কিংবা কোন উঠতি কর্পোরেট বস- পর্দাটার দিকে একবার না একবার তাকাবেনই, তাকিয়ে কয়েক মুহূর্তের জন্য আনমনা হয়ে যাবেন। এই আনমনা ভাব শর্মিনের খুব চোখে পড়ে। সোনালি পর্দাটার ভেতরে সূক্ষ্ম লাইন রয়েছে ফিরোজা কালারের, রেখাগুলো কিছুটা এঁকেবেঁকে চলা। দেখা যায় কি যায় না। সেটি সোনালি রংটাকে যেন আরও স্বর্ণময়ী করেছে।
কথাটা কিসলু ভাইকে একদিন কথায় কথায় বলাতে তিনি শর্মিনের লেগ পুলিং করতে ছাড়েননি। বলেছিলেন, কী বললি- স্বর্ণময়ী! জানালার পর্দা হলো স্বর্ণময়ী। তোরা এত জেন্ডার বায়াসড না! নগণ্য পর্দাকেও স্বগোত্রে ফেলে দিয়েছিস। তবে একদিক থেকে বলেছিস ভাল রে। স্ব স্ব স্বর্ণময়ী... এমন টেনে টেনেই উচ্চারণ করেছিলেন স্টেশনের সিনিয়র ওই আরজে। বেশ নাটকীয় আর মজাদার একটা ভঙ্গিতে। শুনতে মন্দ লাগেনি। মনে মনে টুকে রেখেছিল ওই স্বরভঙ্গি। যদি কখনও সুযোগ আসে, কথাচ্ছলে তাহলে অন এয়ারে সে বাচনেই থ্রোয়িংটা দেবে।
আগে জানালায় ঝুলত হাল্কা ম্যাজেন্টা রঙের পর্দা। যে তিনটে ঘণ্টা এই কক্ষে থাকতে হতো শর্মিনকে সপ্তাহে টানা পাঁচ দিন, সে কয়টি ঘণ্টায় এক অজ্ঞাত কারণে তার মনের ওপর হঠাৎ হঠাৎ ধূসর রঙা মেঘ এসে ভর করত। খুব বেশি সময় সেই মেঘ থাকত না, জমাট বাঁধার আগেই উড়ে উড়ে চলে যেত। কিন্তু তবু থাকত তো, সে ঘণ্টায় দুই মিনিট বা কয়েক সেকেন্ডের জন্য হলেও। এটা তার কাছে অসহ্য হয়ে উঠত। ওই ধূসর গোলাপি রঙের মেঘের দেখা সে প্রথমবারের মতো পেয়েছিল সুইনডনে। লন্ডন থেকে এক-দেড় ঘণ্টার ড্রাইভে যাওয়া যেত সেই শহরতলিতে। শহরতলি কেন, রীতিমতো শহরই বলতে হবে। তবে লন্ডনের মতো সুবিশাল ঝলমলে আর গোটা পৃথিবীতে সুখ্যাত এক মহানগরীর প্রতিবেশী হিসেবে সুইনডনকে শহরতলি বললেই ভাল শোনায়। জেমস তাকে নিয়ে যেত গাড়ি চালিয়ে কোন কোন উইকএন্ডে। আবার ফিরেও আসত রাত বেড়ে ওঠার আগেই। প্রায় আধা ঘণ্টার মতো চলার পর একটা মোড় পাওয়া যেত। রাস্তাটা একদিকে চলে গেছে অক্সফোর্ডে, আর অন্য রাস্তা সুইনডনের পথে। প্রথমবার ইচ্ছে হয়েছিল ডানে ঘুরে সোজা অক্সফোর্ড চলে যেতে। দেশে ইস্টওয়েস্ট ইউনিভার্সিটিতে পড়ার সময় সহপাঠীদের সঙ্গে আড্ডায় মাঝেমধ্যে অক্সফোর্ডের প্রসঙ্গ উঠত। আহা অক্সফোর্ড। ওখানে কারা পড়েন? কারা পড়ান? তারা কি পৃথিবী নামক এই বিচিত্র গ্রহের সবচাইতে মেধাবী মানুষ! ক্লাসমেট উর্মিলা মিত্র খুব হাপিত্যেশ করত ‘প্রাচ্যের অক্সফোর্ড’ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ার সুযোগ পায়নি বলে। ‘প্রাচ্যের অক্সফোর্ড’ কথাটা উচ্চারণ করত সে একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে। শব্দটি কানে এসে ধাক্কা দিত। যতবার উর্মি দীর্ঘশ্বাস ফেলত, ততবারই বাচাল জুবায়ের হো হো করে হাসত, আর টিটকিরি মেরে বলত, প্রাচ্যের অক্সফোর্ড নাকি বিশ্বসেরা অঘামগাদের স্কুল! মানের জন্য এক সময় সুনাম ছিল। তখন বললে মানাত। এই টিটোয়েন্টির দোরগোড়ায় দাঁড়িয়ে ওসব বলিস না। যত্ত সব ফালতু।
২০২০ সাল আসতে তখনও এক বছর বাকি, তবু বাচাল ছোকরাটা ক্রিকেটের অনুসরণে কথায় কথায় ২০২০ সালের কথা টেনে আনত আর বলত টিটোয়েন্টি। আড্ডায় জাহাঙ্গীর থাকলে কাউন্টার দিত জুবায়েরকে। বলত, আছিস তো খেলা নিয়ে, বড় লোকের ফার্মের মুরগি। ভিশন ২০২১ না বলিস, স্বাধীনতার হাফ সেঞ্চুরিও তো বলতে পারিস। ১৯৭১ থেকে ২০২১-গুনে দেখ ৫০ বছরই হয়। তা না উনি আছেন ২০২০ নিয়ে। দু’জনের বাহাস উপভোগ করত উর্মি। শব্দর খেলা ওর প্রিয় ছিল। বলত, এসব আমি শিখেছি দ্য গ্রেট দাদু সোমেন মিত্তিরের কাছে। শব্দ ভাঙতে ভারি মজা লাগে। তোদের জন্য বানালাম দুটো শব্দ- কুড়ি-কুঁড়ি, কিংবা বিশ বিষ। হি হি হি।
তো সুইনডন যাওয়ার পথে অক্সফোর্ডের মাইলফলক দেখে হৈ হৈ করে উঠেছিল শর্মিন। জেমসকে পটাতে বলেছিল, লিসন ডিয়ার, মাই ড্রিমল্যান্ড ইজ নিয়ারবাই; উড য়্যু প্লিজ ফুলফিল মাই ডিজায়ার? সামনের রাস্তার ওপর থেকে দৃষ্টি না সরিয়ে মিষ্টি করে হেসেছিল জেমস। গাড়ি ঘোরানোর কোন লক্ষণ না দেখে অসহিষ্ণু হয়ে উঠেছিল শর্মিন। জেমসের কনুই ধরে চাপাচাপি করেছিল। জেমস সংক্ষিপ্ত উত্তরে বলেছিল- শোউমি, নেক্সট টাইম। এমন নয় যে জেমস ওর নামটা প্রোপারলি প্রোনাউন্স করতে ব্যর্থ। সে হঠাৎ হঠাৎ ওকে শোউমি বলে ডাকে। অবশ্য পরেরবার সে সত্যি সত্যি শর্মিনকে অক্সফোর্ডে নিয়েছিল। দারুণ মজা হয়েছিল। পুরো শহরটাই প্রসারিত শিক্ষাঙ্গন। অনেক ভবনের চূড়ায়, কিংবা সামনের অঙ্গনে শোভা পাচ্ছে গণিত-বিজ্ঞান-দর্শনের বিশ্বখ্যাত মনীষীদের ভাস্কর্য।
খুশি না লুকিয়ে জেমসকে বলেছিল শর্মিন, জানো এখানে স্টিফেন হকিং লেখাপড়া করেছেন।
জেমস হেসে বলেছিল, জানি। ওই বিজ্ঞানী কী বলেছেন, সেটা কি জানো? ১০০০ বছরের মধ্যে এই সাধের পৃথিবী ধ্বংস হয়ে যাবে। আরেকটা কথা। এই অক্সফোর্ডে শুধু ইংল্যান্ডেরই নয়, গোটা দুনিয়ার ডজন ডজন প্রেসিডেন্ট ও প্রাইম মিনিস্টার লেখাপড়া করেছেন।
শর্মিন ভাবে, সে যদি এখানে পড়তে পারত। ইশ চিরকালের জন্য যদি থেকে যেতে পারত অক্সফোর্ডে। ওই একবারই। আর যাওয়া হয়নি সেখানে। পরে যতবারই জেমসের সঙ্গে সুইনডন গেছে শর্মিন, প্রত্যেকবারই ওই মোড়টা থেকে সুইনডনের সোজা দীর্ঘ পথে জেমসের মেরুন-রঙা আলফা রোমিও গাড়িখানা বাঁক নিলেই তার মনে ভেতরে গুনগুনিয়ে উঠত গান। চোখ বন্ধ করলে দেখতে পেত ধলেশ্বরী নদীর মাঝ বরাবর উড়াল দিয়েছে একঝাঁক পাখি। গোটা পথ সে মৌনই থাকত, আর তার বুকের ভেতর বেজে চলত কথা ও সুরের সম্মিলিত বাদন। বুঝদার জেমসও আর মুখ খুলত না। সুইনডন শহরে ঢুকে শুধু সুর করে বলত- ডন ডন সুইনডন। শর্মিন খিলখিল হেসে উঠে ঘোর ভেঙ্গে বাস্তবে নেমে আসত।
ক্লাসমেট নয়, জেমস ছিল ব্যাচমেট। দেখতে মোটেও সুদর্শন ব্রিটিশ সাহেব বলা যাবে না তাকে। বরং কিছুটা আনইমপ্রেসিভই বলা চলে। শীর্ণ মুখের পরে পুরু লেন্সের চশমা, আর বিশেষ গাত্রবর্ণের জন্য তার একটা সূক্ষ্ম বিকর্ষণক্তি ছিল। অথচ শর্মিন আকৃষ্ট হয়েছিল জেমসের প্রতিই। না, নারী-পরুষসুলভ আকর্ষণের রসায়ন সেখানে কাজ করেনি। দূর সম্পর্কের এক আত্মীয় ভাই হিসেবেই যেন একটা মমত্ববোধ তৈরি হয়েছিল। জেমসের বাবা-মা সুইনডনেই থাকতেন। জেমস এক সপ্তাহ বাদ দিয়ে পরের সপ্তাহে নিয়ম করে ওই শহরতলিতে যেত। তবে জেমস বাবা-মায়ের সঙ্গে দেখা করতে যেত শুধু দুপুরের খাবার খেতে যাওয়ার সময়টায়। চারজনে মিলে খেতো। কিছুক্ষণ অল্পস্বল্প গল্প হতো। বিশ্রাম নিয়ে আবার তারা বেরিয়ে পড়ত। কাছেই ঝিল-ঘেঁষা একটা বাহারি উদ্যান রয়েছে। তার একটা মলিন বেঞ্চে গিয়ে বসে থাকত দু’জনে। জেমস স্বল্পভাষীই ছিল, আর শর্মিনেরও স্বভাবে নেই কোন বিষয়েই বেশি কৌতূহল দেখানোর। একদিন জেমসকে ভারি বিষণœ দেখাচ্ছিল। শর্মিন বুঝেছিল ওর মনটা ভাল করে দেয়া দরকার। একটু মমতা তার চাই এ সময়টায়। মুখে কিছু বলতে হয়নি শর্মিনকে, তার উৎসুক দৃষ্টি দেখেই জেমস বুঝে নিয়েছিল। কিংবা এমনও হতে পারে সে একটা সুযোগ খুঁজছিল নিজের সংগোপন লকার থেকে একটা পুরনো জীর্ণ ছবি বের করে বন্ধুকে দেখানোর।
সব শুনে খানিকটা অবাক আর আহত হয়েছিল শর্মিন। নিজের জীবনের সঙ্গে সাযুজ্য খুঁজে পেয়েছিল। জেমসের মা বলে যাকে জেনেছে তিনি ওর বাবার দ্বিতীয় স্ত্রী। জেমসের মা মারা গিয়েছিলেন একটা দুর্ঘটনায় বেশ ক’বছর আগে। জেমস শুনেছে অনেকে নাকি ওই দুর্ঘটনার পেছনে বাবার হাত রয়েছে বলে সন্দেহ করেন। এটা এক ভয়ঙ্কর অনুমান। সন্তানের মন চিরতরে বিষিয়ে দেয়ার মতো। একদিকে মাতৃবিয়োগের শোক, অন্যদিকে অমন কদর্য সন্দেহ। জেমসের ভেতর একটা সূক্ষ্ম গভীর বিষণœতার প্রবহমানতা রয়েছে এটা এতদিন টের না পেলেও জেমসের কাছ থেকে সব কথা শোনার পর শর্মিনের মনে হয় জেমস আর সে তারা দুজনেই সমগোত্রের। সে যেন তার সহোদর।
অফ হোয়াইট দেয়ালের কনট্রাস্টে সোনালি রঙের পর্দার শব্দনিয়ন্ত্রিত ছিমছাম ঘরটাতে বসলে লায়লা শর্মিনের মন কখনও কখনও অতীতে বিচরণ করতে চায়। সেটাকে বাগ মানাতে মাঝেমধ্যে জোরাজুরি করা লাগে। এখন যেমন করতে হবে। লাস্ট আওয়ার চলছে তার শো ‘ফিউচার ফিউশন’-এর। ধনীর এক দুলাল আসবেন এই পর্বে, দশ মিনিটের আলাপচারিতায়। আলাপের ছলে কোম্পানির গুণগান আর নিজের ঢোল পেটানো। স্ট্রোকের পর বাবার বড় ধরনের শারীরিক সীমাবদ্ধতা দেখা দিলে দুলালটি বাবার চেয়ারে বসেছেন। শর্মিনকে স্টেশন ম্যানেজার আগেভাগে সতর্ক করে দিয়েছেন আকারে ইঙ্গিতেও কোন ঠাট্টা-মস্করা করা চলবে না। নো মজা। এটা স্রেফ সিরিয়াস টক। কিছুক্ষণের মধ্যে তাকে শর্মিন থেকে আরজে রাজহংসী হয়ে উঠতে হবে। রেডিও স্টেশনে সে হলো আরজে রাজহংসী। নাম রেখেছিলেন এই ‘সুর অবসর’ রেডিও স্টেশনের সিনিয়র আরজে কিসলু ভাই। থুড়ি, কিসলু বলা ভুল হলো। কিসলু তার মায়ের দেয়া আদরের ডাক নাম। এই নামে শ্রোতারা তাকে চেনে না, তারা চেনে খ্যাতিমান আরজে ক্রেজ কিংশুক উসমানকে। না, নিজের নাম তিনি নিজে রাখেননি। পরিবার থেকেই পাওয়া। শর্মিন কোয়ালিফাইড হয়ে প্রথম যেদিন মাইক্রোফোনের সামনে বসবে, ঠিক তার আগের দিন স্টেশনে গেছে এ্যাপয়েন্টমেন্ট লেটার আনতে, আসলে কাজ আরেকটু বুঝে নিতে, সে সময় একটু গায়ে পড়ার মতো করেই কিসলু তাকে জিজ্ঞেস করেছিল- আপনি কি শর্মিন নামেই শো করবেন? অনেক পরে সে বুঝেছিল, যেটাকে সে গায়ে পড়া ভেবেছিল সেটা মোটেই তেমন নয়। কিসলু ভাইয়ের স্বভাবই হচ্ছে কোথাও কোনো উটকো কিছুর গন্ধ পেলে তার একটা সুরাহা করে দেয়া। শর্মিনের বিরক্ত হওয়ার কথা ছিল, কিন্তু তা না হয়ে সে হয়েছিল বিস্মিত। আপনা থেকেই চোখ বিস্ফারিত হয়েছিল, আর দুই ঠোঁটের ভেতর দুই ইঞ্চি মাপের একটা গর্ত দেখা গিয়েছিল। মানে সে হা হয়ে গিয়েছিল। বর্ণনাটি কিসলু ভাইয়েরই। শর্মিনের বেশি মুড অফ থাকলে তাকে স্বাভাবিক করার জন্য নাটক করে দেখাত সে। চোখ বড় বড় করে, কয়েক সেকেন্ড হা মুখ করে অপলক তাকিয়ে থেকে বলতে শুরু“ করে- অবাক করলেন কিসলু ভাই, আমি কি এই যুগের কবি যে নিজের নাম বদলে দেব? তাছাড়া আমার নামটা কি যথেষ্ট স্মার্ট নয়! শ্রোতারা এটা নেবেন না?
বিব্রত বা বিরক্ত না হয়ে কিসলু যুক্তি সামনে এনে বলেছিল- অন্য একটা রেডিও স্টেশনের একজন সিনিয়র এবং শ্রোতাপ্রিয় আরজের নাম শারমিন। তাই নাম বদলালেই ভাল। শর্মিন প্রত্যুত্তরে বলতে পারত- উনি শারমিন, আমি শর্মিন, দুটো দুই নাম। তাছাড়া একজন লিসেনার কণ্ঠ শুনেই বুঝবে দু’জন আলাদা মানুষ। কিন্তু বলেনি। ওষ্ঠের মুখে এসে পড়া কথাগুলো সে গিলে ফেলে বলে, কী করা যায় কিসলু ভাই, বলুন তো? একদিনের মধ্যে নতুন নাম পাই কোথায়?
কিসলু বলেছিল, ‘দুশ্চিন্তা কোরও না রাজহংসী’। এবার সত্যি সত্যি বিরক্ত হলো শর্মিন। প্রথমত, এমন কাব্য করে সম্বোধন, দ্বিতীয়ত তুমি করে বলা। মুখে কিছু না বললেও চেহারায় তা ফুটে উঠেছিল। একটুও না দমে কিসলু হেসে বলেছিল- ফান করে বলেছি, কিন্তু মন্দ হয় না যদি নামটা রাখ।
শর্মিন বলে, কোন নাম? আপনি নাম বললেন কখন।
কিসলু মধুর একটা হাসি দিয়ে বলল, ওই যে, আরজে রাজহংসী। বেশ একটা রিদম আছে।
শর্মিন বলতে বাধ্য হয়, কোথায় রিদম দেখলেন। এটাকে বলো সমধর্মী উচ্চারণ। ব্যাকরণের পরিভাষায় বলতে পারি অনুপ্রাস। আরজে এবং রাজ। সে যাক, হাঁসের নামে নাম নিতে হবে নাকি। সেক্ষেত্রে বনহংসী মন্দ কী! ফিক করে পরিহাসের একটা হাসি বেরিয়ে এলো শর্মিনের মুখ থেকে।
কিসলুর চোখে এমন একটা দৃষ্টি যার ভেতর শ্রদ্ধাবোধ মিশে থাকা বিচিত্র নয়। সে ভাবে, এত অল্প বয়সী একটা মেয়ে বেশ জানে তো! মুহূর্ত মাত্র, তারপরই স্বরূপে ফেরে। কণ্ঠে বলিষ্ঠতা নিয়ে কিসলু বলে, বনহংসী কমোন জীবনানন্দের কল্যাণে। তাছাড়া এই নামে শো শুরু করলে বুঝবেন, শ্রোতারা আপনার আদার পার্ট খোঁজা শুরু করে দেবে। বনহংসী একা কেন! আমাদের একজন বনহংস চাই-ই চাই। বলেই দম ফাটানো হাসি দেয় কিসলু।
কান্নার মতো হাসিও কি সংক্রামক? হাসিতে যোগ দেয় শর্মিন এবং এই হাসাহাসির মধ্য দিয়েই আরজে রাজহংসী নামটা চূড়ান্ত হয়ে যায়। ভেতরে ভেতরে শর্মিন কৃতজ্ঞ বোধ করে। ছদ্মনাম গ্রহণ এখন চলছে খুব। বিশেষ করে ফেসবুকে আর ব্লগগুলোতে। সিনেমার নায়ক-নায়িকাদের বেশিরভাগেরই নতুন নাম নেয়া। লেখক নাম বা কলম-নাম, পর্দা নামের সঙ্গে কণ্ঠ-নাম হিসেবে তার নামটা যুক্ত হলে মন্দ কি। সত্যিকারের নাম গোপন করা যাবে নিশ্চয়ই। পেশাদার আরজে জীবনটাকে সম্পূর্ণ আলাদা রাখা গেলে তো ভালই। সেক্ষেত্রে এই নাম গ্রহণ একটা ফ্যাক্টর হতে পারে। চোখ বুজে এক মুহূর্ত ভেবে নেয় সে। মানবীরূপী রাজহংসীকে সে দেখতে পায় সাত সমুদ্দুর তের নদীর পাড়ে সেই সুইনডনের আশ্চর্য ঝিলের পাড়ে। আশপাশে তাকিয়ে দেখে কেউ নেই, এমনকি বন্ধু জেমসও কোথাও নেই। তার ভাবতে ভাল লাগে ডানাওয়ালা এক ঘোড়া ছুটিয়ে সেখানে এসে নামবে কোন এক রাজকুমার। তারপর রাজহংসী আর রাজকুমার- হা হা হা, কল্পনার লাগাম টানা যাক। চোখ খুলে মিষ্টি হাসি সারামুখে ছড়িয়ে তাকায় কিসলু ভাইয়ের দিকে; ডান হাতখানি বাড়িয়ে দিয়ে বলে- মেনি মেনি থ্যাঙ্কস। সত্যি সুন্দর একটা নাম দিলেন এই প্রজাকন্যা শর্মিনের।
কিসলু অবাক হওয়ার ভান করে বলে, ওয়েলকাম। ভাল বলেছেন তো, রাজকন্যা নয় প্রজাকন্যা। তারপর নাটকীয় ভঙ্গিতে বলতে শুরু করে: স্মার্ট কিসলু পিছলা খাইল ড্যাম স্মার্ট শর্মিনের কাছে; সহস্র শোয়ের এ্যাঙ্কর ধাক্কা খাইল শোহীন একখান শোপিস শো শো শৌমিন, আই মিন শর্মিনের কাছে। হুররেরেরেরে...
সেই থেকে শর্মিন হলো শহরের নবাগত অথচ সেনসেশন তৈরি করা এফএম রেডিও ‘সুর অবসর’-এর আরজে রাজহংসী। সত্যিকারের রাজহংসী কতটা উড়তে পারে জানা নেই শর্মিনের। তবে গ্রামে নানু বাড়িতে রাজহাঁস দেখেছে। বিলের ধার দিয়ে রাজকীয় ভঙ্গিতে ঘুরে বেড়াতে, ডানা ঝাপটাতে, কখনও কখনও সামান্য উড়ুক্কু ভাব ধরতেও। বাস্তবের রাজকীয় পাখিটি ডানা মেলতে পারুক না পারুক, অন এয়ারের রাজহংসী তার পাখনা মেলে দিয়েছিল নতুন নতুন মেঘের রাজ্যে। সেই মেঘে জীবনের রোদ্দুর লেগে চিকিচিক করত; কখনও বা পূর্ণিমার রুপালি আলোয় সাঁতরে সাঁতরে পৌঁছতে চাইত স্বর্গরাজ্যে। মাত্র তিন মাসের ভেতর আরজে রাজহংসী দস্তুরমতো সুপারস্টার হয়ে উঠল এফএম ফিল্ডে।
(চলবে)