এই অঞ্চলে আসার পর থেকেই ফতেহ-জঙ্গীপুর জায়গাটি দেখবার আগ্রহ মনের ভেতর আঁকুপাঁকু করতে থাকে। কিন্তু সুযোগ ও সময়ের অভাবে সেই ঐতিহাসিক স্পটটিতে ভ্রমণ সম্ভব হয়নি। হঠাৎ আমার এমএ ক্লাসের ছাত্র হুমায়ূন কবির বললেন, ফতেহ-জঙ্গীপুর আমার বাসার কাছে। কবে যাবেন স্যার বলুন, আমি নিয়ে যাব।
হুমায়ূনও একটি কলেজে শিক্ষকতা করেন। কয়েক মাস আগে মোটরসাইকেল কিনেছেন। অতএব ওর বাইকে সওয়ার হয়ে নিশ্চিন্তে যাওয়া যায়। আমি জিজ্ঞেস করলাম, ‘কতক্ষণের পথ?’
‘খুব বেশি নয়। যেতে ৪০ মিনিট আর আসতে ৪০ মিনিট।’ হুমায়ূন বললেন।
আমি রাজি হয়ে গেলাম। এক শুক্রবার বিকেলে আমার বিশ্ববিদ্যালয় মধুপুর থেকে রওনা দিলাম। বাইক ছুটে চলল দু’পাশের দীর্ঘকায় সবুজ গাছপালা আর অরণ্যের ভেতর দিয়ে। ৪০ মিনিট পর এসে থামল একটি চৌরাস্তার মোড়ে। বাইক রেখে বাঁ দিকের সরু শীর্ণ রাস্তা ধরে আমরা এগিয়ে গেলাম একটা লাল ইটের পুরনো জীর্ণ একতলা বিল্ডিংয়ের দিকে! হুমায়ূন হাঁকডাক দিলে বাড়ির পুরুষ সদস্যরা বেরিয়ে এলো। আমরা তার কাছে জানতে চাইলাম ইতিহাসের হারিয়ে যাওয়া অধ্যায়। লোকটার বয়স পঞ্চাশ ছুঁইছুঁই। সে তেমন কিছু বলতে পারল না। সে পেশায় অটোচালক। সে বলল, আমি যুদ্ধ দেখিনি। আমার নানি দেখেছেন।
তখন নানি ছিলেন না বাসায়। আত্মীয়ের বাসায় গেছেন। আজ ফিরতেও পারেন, আবার নাও ফিরতে পারেন। আমরা নানির সেল নম্বরটা নিয়ে এলাম। পরে কথা বলে জেনে নেব।
ঢাকার বাইরে যে বিশাল বাংলাদেশ সেখানে অনেক ঐতিহাসিক জায়গা, অনেক হেরিটেজ রয়েছে। স্থানীয় প্রশাসন যদি ইউনিসেফকে জানাত তা হলে এই আন্তর্জাতিক সংস্থা থেকে এসব হেরিটেজ সংরক্ষণ করার উদ্যোগ গ্রহণ করা হতো। কিন্তু কারও মাঝে উৎসাহ ও তৎপরতা নেই। আমি হুমায়ূনকে বললাম, তুমি একটি চিঠির খসড়া কর, পরে এটা সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের কাছে পাঠানো যেতে পারে।
রাতে আমার হোস্টেল থেকে নানির সঙ্গে সেলফোনে আলাপ করলাম। তিনি স্বতঃস্ফূর্তভাবে ইতিহাসের হারিয়ে যাওয়া ঘটনাগুলো তুলে ধরলেন। তিনি জানালেন, এখন যেখানটায় তাদের বাড়িঘর, এর পাশের দুটো লাল ইটের অট্টালিকা ছিল ঈশা খাঁর দুর্গ। কালের গর্ভে হারিয়ে গেছে সবকিছু। এখন যেটুকু অবশিষ্ট রয়েছে, সেটা ভগ্নাবশেষ। বিল্ডিং দুটো দাঁত বের করে সময় ও সভ্যতার প্রতি কটাক্ষ করছে।
এ রকম একটি পুরনো অট্টালিকা দেখেছিলাম ১৯৮৬ সালে ভেলোর ক্রিশ্চিয়ান হাসপাতালের সামনে। স্থানীয় লোকেরা বলে টিপু সুলতানের অট্টালিকা জীর্ণ পুরনো ধসে পড়া অট্টালিকা ইতিহাসের সাক্ষী হয়ে দাঁড়িয়ে আছে।
এখানে, এই ফতেহ-জঙ্গীপুরে এসেও আমার সে রকম অনুভূতি হলো। মোট তিনবার ঈশা খাঁ এবং মানসিংহের মাঝে যুদ্ধ হয়েছিল। তিনবারই মানসিংহ পরাজিত হয়েছিলেন।
আগে এই এলাকার নাম ছিল ফতেহপুর। যুদ্ধের পর নাম হলো ফতেহ-জঙ্গীপুর।
আমরা ঘুরে ঘুরে দেখলাম। গাছপালা আর আগাছায় লাল ইটের দুর্গো দুটো ভরে আছে।
দুটো শিয়াল ত্বরিতগতিতে বনের ভেতর ছুটে পালাল। কোথায় যেন নাম না জানা পাখি ডাকছে। গোধূলির শেষ ভালবাসায় আপ্লুত হয়ে উঠেছে বনভূমি। কী নির্জন, কী শান্ত চারদিক। অথচ এখানে একদিন যুদ্ধ হয়েছিল। মাটি কেঁপে উঠেছিল গোলাবারুদের আঘাতে।
বারুদের গন্ধে ভরে উঠেছিল বনভূমি। এলাকায় নানি ছাড়া আর কোন বয়স্ক লোক পেলাম না যারা এই যুদ্ধ দেখেছেন।
আমি বিস্ময় নিয়ে তাকিয়ে রইলাম দুর্গ দুটোর দিকে। সেখানে শেষ বিকেলের সোনালি ভালবাসা আশীর্বাদের মতো ছড়িয়ে পড়েছে। আর কিছুক্ষণ পর পায়ে পায়ে সন্ধ্যা নামবে।
পাখিদের কিচিরমিচির শুরু হয়ে গেল। ঘরে ফেরার জন্য সব পাখি উদগ্রীব। আমরাও অনেক দূর হেঁটে ফিরে গেলাম বাইকের কাছে।
চোখে পড়ল টিনের তৈরি কিছু বাড়িঘর। এখানকার রাস্তাঘাট মোটেই ভাল নয়। এবড়ো খেবড়ো আর ভীষণ আঁকাবাঁকা। বাইক লাফাতে লাগল। অনেক কষ্টে কোন রকমে পিচের রাস্তায় আমরা এসে পড়লাম। সেই রাস্তা ভাঙ্গাচোড়া, খানাখন্দরে ভরা।
এই ভাঙ্গা আর আঁকাবাঁকা পথ দিয়ে আমাদের ফিরতে হবে।
এই অঞ্চলে মানুষের উৎসব এবং আনন্দ অনুষ্ঠান তেমন একটা নেই। ধর্মীয় উৎসব বাদ দিলে মেলা এবং উরসকে ঘিরে যে আনন্দ উৎসবের আয়োজন হয়, তাতে সব সম্প্রদায় অংশগ্রহণ করে। দূর-দূরান্তে থেকে মানুষ এসে এসব মেলায় অংশগ্রহণ করে আর দিনটা অন্য রকমভাবে কাটায়। দেশের বাইরে থেকেও ধর্মভীরু মানুষরা আসে।
ডিঙ্গামানিক উপজেলায় রাম ঠাকুরের মেলা প্রতি বছর ১৫ মাঘ অনুষ্ঠিত হয়। শরীয়তপুর জেলার একটা অরণ্যময় অঞ্চল এই ডিঙ্গামানিক। এই অঞ্চলকে নিয়ে অনেক কিংবদন্তি আছে। মাঘ মাসে পূর্ণিমা রাতে রাম ঠাকুরের মেলা অনুষ্ঠিত হয়।
গাইডের সঙ্গে গেলাম। রঙিন বাতিতে ঝলমল করছে এলাকাটি। বিশাল এলাকা নিয়ে বসেছে মেলা। প্রবেশপথে এক বিশাল তোরণ তৈরি করা হয়েছে। সেখানে মেলায় আসা নারী-পুরুষরা অটো এবং বাইক থেকে নামছে। এখানকার একমাত্র বাহন অটো এবং বাইক।
গাইডের সঙ্গে ঢুকতেই চোখে পড়ল দু’পাশে অসংখ্য দোকান। মণ্ডা-মিঠাই এবং আরও কত কি বিচিত্র খাবার। চুড়ির দোকানও রয়েছে। সেখানে মেয়েদের ভিড়। ডানে মোড় নিতেই চোখে পড়ল প্রিন্সেস রহিমার নাচের আসর। সেখানে ত্রিপল দিয়ে আলাদা স্টেজ বানানো হয়েছে। এই অর্ধনগ্ন নৃত্য উপভোগ করতে টিকেট কিনতে হয়। পাশেই খোলা একটা জায়গা, সেখানে জুয়ার আড্ডা। সেখানে যুবকদের ভিড়। সেখানে থেকে কিছুক্ষণ পর পর হৈচৈ আওয়াজ উঠছে। প্রিন্সেস রহিমার নৃত্যের ঘোষণা হচ্ছে মাইকে।
গাইডের সঙ্গে এলাম একটি পুকুর পাড়ে। সেখানে বেশকিছু গাছ। সেখানে নগ্ন সন্ন্যাসীরা বসে আছে মাটির ওপর। সমরু এলাকায় নীল ধোঁয়া, আর কী রকম একটা গন্ধ। সেখানেও যুবকদের ভিড়। তারপর এলাম আমরা মূল মঞ্চে। সেখানে কীর্তন গাইছে পুরুষ এবং নারী শিল্পীরা। বয়স্ক নারী-পুরুষরা পাটির ওপর বসে আছেন, তাদের নীর্মিলিত আঁখি। তারা রামের বনবাসের কাহিনী একাগ্রচিত্তে শুনছেন।
তারপর এলাম একটা দোতলা বিল্ডিংয়ের নিচ তলায়। সেখানে ভারত থেকে আসা ‘মহারাজা’ বসে আছেন সিংহাসনের মতো চেয়ারে। ধর্মভীরু নিবেদিত প্রাণ মানুষেরা, নারী-পুরুষরা, তার পদতলে মাথা নত করে আছে, যেন তার কাছে আত্মসমর্পণ করলে ঈশ্বরের কাছে পৌঁছানো যাবে।
গাইডের সঙ্গে আগে থেকে পরিচয় মহারাজার। আমাকে পরিচয় করিয়ে দেয়ার পর, যখন তিনি শুনলেন আমি বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়াই, তিনি তার সিংহাসন ছেড়ে উঠে দাঁড়িয়ে আমাকে বুকে জড়িয়ে ধরলেন। ইংরেজীতে বললেন, ঈশ্বর তোমার মঙ্গল করুন। আমিও অভিভূত হয়ে বললাম : গড ব্লিস য়ু টু।
আমি তাকে নিমন্ত্রণ জানালাম। তিনি কথা দিলেন, তিনি ভারতে ফিরে যাওয়ার আগে বিশ্ববিদ্যালয়ে আসবেন।
তিনি তার কথা রেখেছিলেন। মহারাজ এসেছিলেন। সারাটা দিন কাটল তার সঙ্গে গল্প করে। তার জন্ম এবং বেড়ে ওঠা শরীয়তপুর। তারপর কলকাতার প্রেসিডেন্সি কলেজ। তারপর তিনি হলেন কমিউনিস্ট পার্টির মেম্বার। ঠিক যেন উপন্যাসের চরিত্র। প্রতিটি মানুষের জীবনে গল্প তাকে। কখনও কখনও জীবনকে মনে হয় উপন্যাসের চেয়েও চমকপ্রদ, স্ট্রেঞ্জার দেন ফিকশান, হায় জীবন! হায় মানুষ!
মনে পড়ে, আমার এক উপন্যাসে আমার অজান্তে মহারাজের চরিত্রটি অবচেতনের অন্দর মহলে ঢুকে পড়েছিল। তিনি উপন্যাসে বিশাল জায়গা জুড়ে আছেন। সেই উপন্যাসের নাম : অন্য কোনদিন।
সুযোগ পেলে মেলা, উরস ইত্যাদি অনুষ্ঠানে যেতে চেষ্টা করি। মেলার মানুষদের সঙ্গে, বিশেষ করে গৃহহীন, সংসারহীন, ভবঘুরে সেই সব মানুষের সঙ্গে কথা বলতে চেষ্টা করি। প্রত্যেকে আমাকে গল্প দেয়। আমি ঋদ্ধ হই। এই জগত সংসারে কত বিচিত্র সব মানুষ, কত বিচিত্র তাদের জীবন, সবটুকু কি লিখতে পেরেছি? পারিনি। তবে এ কথা ধ্র“ব সত্য, কষ্ট করে গল্প বানাইনি। যা দেখেছি, তা-ই একটু এদিক ওদিক করে উল্টেপাল্টে পাঠকের পাতে তুলে দিয়েছি। বাকিটা আর জানি না। জানতে চাই না। আমার কাজ শুধু অচেনা মানুষের আখ্যান তুলে ধরা। চেনা মানুষরাও সেই আখ্যানে ঢুকে পড়ে সঙ্গোপনে।
সমরেশ বসু প্রথমে আমাকে উস্কে দেন সেই ত্রিশ-চল্লিশ বছর আগে। তার একটা ধারাবাহিক লেখা পড়েছিলাম কলকাতার এক সাপ্তাহিকীতে ‘কুম্ভমেলার সন্ধানে।’ কী তাৎপর্যময় পর্যবেক্ষণ, কী ভাষা, কী জীবনদর্শন। মেলার ওপর অনেক লেখা পড়েছি। কিন্তু সে রকম আর লেখা পেলাম কোথায়?
একটা ভিন্ন ধরনের উপন্যাস পড়ে সমরেশের লেখার স্বাদ পেলাম অনেকটা। সেটাও ত্রিশ বছর আগের পড়া। জ্যাক কেরুয়াকের লেখা ‘অন দ্য রোড’ বিট জেনারেশনের অন্যতম কবি খোলামেলা সব কথা বলেছেন। জীবনের সব পাপপুণ্য, জীবনের জলছবি। আমরা সব কথা এ রকম খোলামেলা লিখতে পারি না কেন?
প্রসঙ্গত ‘অন দ্য রোডের’ কথা মনে পড়ল। সম্পূর্ণ ভিন্ন দুটি বিষয়। কিন্তু পর্যবেক্ষণে কোথায় যেন মিল আছে। সময় পেলেই বার বার বইটি পড়ি। ভাল লাগে। অভিভূত হই। বেদনার্ত হই। মনের ভেতর কবিতার শব্দ, কবিতার অনুষঙ্গ ডানা ঝাঁপটায়। ফিরে যাই কবিতার কাছে :
এখন আমার বিশ্রাম নেয়ার সময়
শরীর এখন আরাধনা চায়
শরীর এখন আরো কিছু চায়।
পুরনো বইয়ের গন্ধ
আমার ব্যক্তিগত লাইব্রেরির কিছু বইপত্র ঢাকার বিভিন্ন পুরনো বইয়ের দোকান থেকে কেনা। এই বইগুলো দুর্লভ এবং এখন আর পাওয়া যায় না। মাঝেমধ্যে নির্দিষ্ট র্যাক থেকে এই বইগুলো বের করে পাতা ওল্টাতে ভাল লাগে। পুরনো বইয়ের গন্ধে মন আকুল করে তোলে কখনও কখনও।
ঢাকার পুরনো পল্টনের পানির ট্যাঙ্কের উল্টো দিকের গলিতে বেশ ক’টি পুরনো বই ও ম্যাগাজিনের দোকান ছিল। রথখোলা মোড়ে পতিতাপল্লীর উল্টো দিকে সাধনা ঔষধালয়ের সিডির ওপর একটি অবাঙালী লোক পুরনো বইপত্র বিক্রি করতেন। এখন পতিতাপল্লীও নেই, সেই দোকানটিও নেই। বাংলাবাজারেও দু-একটি পুরনো বইপত্রের দোকান ছিল। অনেক দিন এসব দোকানে যাওয়া হয় না। সে সব দোকান এখন আছে কিনা জানি না।
খুব বেশি যেতাম রথখোলা মোড়ের অবাঙালী লোকটার দোকানে। সেখানে পূজা সংখ্যা দেশ, উল্টোরথ এবং আরও অনেক ম্যাগাজিন ও বই পাওয়া যেত।
এখনও অবাঙালী লোকটার কথা খুব মনে পড়ে। তিনি বাংলা-উর্দু মিলিয়ে একটি জগাখিচুড়ি ভাষায় আমার সঙ্গে কথা বলতেন। সেটা ছিল ১৯৬৮-৬৯ সালের কথা। দেশ তখনও স্বাধীন হয়নি। একটা পুঞ্জীভূত ক্ষোভ দিন দিন এই অঞ্চলের মানুষের মাঝে জমা হচ্ছে। দেশ শাসন করছেন ফিল্ড মার্শাল আইয়ুব খান। তিনি ১৯৫৮ সালে ক্ষমতায় এসে কলকাতার বাংলা পত্রপত্রিকা এ দেশে প্রবেশ নিষিদ্ধ করে দেন। কিন্তু বিস্ময়কর ব্যাপার এই যে, রথখোলার মোড়ের এই পুরনো বইয়ের দোকানে কলকাতার পত্রিকা এবং বই পাওয়া যেত। কে বা কারা এনে সেই অবাঙালী লোকটির কাছে এসব বিক্রি করে যেত, সে বিষয়ে তাকে আমি কখনও কোনদিন কিছু জিজ্ঞেস করিনি।
লোকটি সারাক্ষণ উর্দু ম্যাগাজিন পড়তেন। চোখে কালো চশমা, মুখে সাদা খোঁচা খোঁচা দাড়ি, পান খাওয়া লাল দাঁত। তার মুখের মতো মলিন ফতুয়া আর লুঙ্গি।
পঞ্চাশের বেশি বছর পার হয়ে গেছে। অথচ এখনও তার চেহারা মনে পড়ে। আমার ব্যক্তিগত লাইব্রেরির পুরনো বইয়ের পাতায় হাত রাখলেই তার কথা মনে পড়ে।
বাংলা সাহিত্যের প্রধানতম লেখকদের কালজয়ী সব গল্প-উপন্যাস আমি তার কাছ থেকে পেয়েছি।
দাম খুব একটা বেশি দাবি করেননি, আবার খুব যে কম নিয়েছেন, তাও নয়। অনেকদিন তার দোকানে না গেলে তিনি না আসার কারণ জানতে চাইতেন। বেশকিছু দুর্লভ বইপত্র, যা তিনি আমার জন্য আলাদা করে রেখেছিলেন, তা এগিয়ে দিতেন। আমাদের উভয়ের মাঝে একটা চমৎকার সম্পর্কের সেতু গড়ে দিয়েছিল এসব পুরনো বইপত্র।
এখনও চোখ বুঝলে, কখনও কোন অলস মুহূর্তে লোকটির মুখ আমি দেখতে পাই। অনেকের কাছ থেকে পুরনো বইপত্র কিনেছি, কিন্তু সবার কথা, সবার স্মৃতি মনে দাগ তেমনভাবে কাটেনি। যেমনটি রথখোলার বই বিক্রেতার স্মৃতি আজও অমলিন হয়ে আছে।
তখন আমি স্কুলের ছাত্র। নতুন বই কেনার মতো সমর্থ, সুযোগ ও পয়সা হাতে ছিল না। অগ্যতা পুরনো বইয়ের দোকানই ছিল একমাত্র ভরসা।
সময়ের সঙ্গে সঙ্গে আমাদের রুচি বদলাতে থাকে। পুরনো বইয়ের দোকান আমাদের চাহিদা পূরণ করতে তেমন একটা পেরে ওঠে না। আমাদের হাতে তখন টাকা পয়সা আসতে শুরু করেছে। আমরা চাকরি পেয়ে যাই। কিন্তু বইয়ের নেশা কমে না।
পাঠাভ্যাস আগের মতো থেকে যায়। বরং আরও বহুগামী হয়ে ওঠে। আমার পাঠাভিজ্ঞতা বৃদ্ধি পেতে থাকে। পাঠক থেকে একদিন লেখকে রূপান্তরিত হই। বই পড়ার কোন বিকল্প কিছু পাই না। প্রযুক্তি আসে, অনলাইনে বই পাওয়া যায়, কিন্তু বই কেনার অভ্যাস কমে না।
একদিন দেশ স্বাধীন হয়। রথখোলার সেই লোকটিকে আর দেখি না। চারদিকে পতাকা দেখি, স্বাধীনতা দেখি, কিন্তু সেই লোকটিকে আর কোথাও দেখি না।