চৌদ্দে যেদিন পা রাখলাম মনে পড়ছে সেদিনের কথা।
জানালার পাশে বসে স্থির দৃষ্টিতে নীলাকাশের দিকে চেয়ে থেকে ফোনে বান্ধবী কিশ-এর কথা শুনছিলাম, আর তর্জনী দিয়ে মাথার চুল মোচড়াচ্ছিলাম। আগামীতে কি করবে তার ফিরিস্তি দিচ্ছিলো সে, ওকে বড্ড ব্যস্ত মনে হলো। তার মানে আমার জন্য কারু কোনো সময় নেই! ফোন রেখে সটান বিছানায় গিয়ে শুয়ে পড়লাম। অসাড় মন নিয়ে সিলিং ফ্যানের ডানাগুলো গুনতে গুনতে তন্দ্রাচ্ছন্ন হয়ে পড়েছিলাম।
ঢাকার মোহাম্মদপুরে থাকতাম আমরা। না জানিয়েই যখন তখন বাসায় চলে আসতেন পরিচিতজনেরা। ভালো লাগতো আমার।
আমার চতুর্দশতম জন্মদিনে কান পেতে শুনলাম বেলের শব্দ, দরোজার নব ঘুরলো, একটি অভিনন্দন-ধ্বনি প্রতিধ্বনি তুলতে লাগলো সারা ঘরে- ‘হ্যাপি বার্থডে’। আমি কি স্বপ্ন দেখছি! স্বপ্নের মতোই ছিল সেটা। আসলে তো বাস্তব। আমার কাজিন শাহেদ জন্মদিনে সারপ্রাইজ দিতে এসেছে।
দ্রুত খুঁজলাম পরিধেয় এবং বাস্তবে ফেরার চেষ্টা করলাম। বাথরুম থেকে বেডরুম ছুটে ফিরলাম- নাহ মিললো না কিছুই। অনেক মানুষের হাঁটাচলার শব্দ কানে এলো। আমি আসলে আমার জন্মদিনে অনেককেই চাইছিলাম। শেষ পর্যন্ত মা এলেন, হাতে তার একদম নতুন একটা পোশাক। শাদা জমিনে কালো ফুলঅলা ডিজাইন। তিনি সবসময় সেরাটাই আমার জন্য নির্বাচন করতেন।
তার মানে বার্থডে পার্টি হতে যাচ্ছে? সত্যিই...?
কিন্তু আব্বু তো এখনও ফিরলেন না। পরশু তিনি আমাকে বলেছেন যে, আমার বয়েসের যে পর্যায়, তাতে পার্টি হচ্ছে না। কিন্তু মা চাইছিলেন জন্মদিনের উৎসব হোক। শেষ পর্যন্ত জানলাম আমার জন্য সারপ্রাইজ পার্টি দেয়া হচ্ছে। যদিও আমি জানার আগে আমার মামা-চাচা উভয় দিককার প্রায় সবাই জেনেছেন এই পার্টির কথা। এতক্ষণে বুঝলাম কিশ কেন এত তাড়াহুড়ো করছিলো ফোনে। আসলে সে পার্টিতে যোগ দেয়ার জন্য উন্মুখ হয়ে ছিল। অন্যান্য বন্ধু আর দাদা-দাদী, নানা-নানী সকলেই ছিলেন। দারুণ স্পেশাল ছিল সেটা।
শান্তভাবে আমি দরোজার পাশে দাঁড়িয়ে থাকলাম। গোটা লিভিং রুমে ঝটিতে তাকিয়ে দেখে নিলাম। অনুভব করলাম আমার চোখ বেয়ে অশ্রু গড়িয়ে পড়ছে। আমার তৃপ্তি আর কৃতজ্ঞতাবোধেরই গভীর প্রকাশ এই অশ্র“। প্রতিটি মুহূর্তেই দেখছিলাম কেউ না কেউ হেঁটে যাচ্ছে। এরপর আমাকে কে সারপ্রাইজ দেবে!
অবশেষে আব্বুর গাড়ির হর্ন শুনলাম। হ্যাঁ তিনি এসেছেন। দৌড়ে তিন তলা থেকে নামতে লাগলাম। যেমনটা সব সময়েই করে থাকি। আর জলদি আব্বুর কাছে পৌঁছুনোর জন্য সিঁড়ির দু’এক ধাপ বাদ দিয়ে দিয়ে লাফিয়ে নামি। আমি আব্বুকে আজকের ঘটনা বলতে যাচ্ছিলাম, তার আগেই আব্বু বলে উঠলেন, ‘হ্যাপি বার্থডে ওয়ালী-২ (আব্বু সব সময় আমাকে এই নামেই ডাকতেন)।’ ত্রিশ ইঞ্চি লম্বা একটা বক্স আব্বুর হাতে। কী এটা? আমার জন্যেই।
আসলে ওটা একটা কেক ছিল, দেখতে ঠিক বিরাট খোলা বইয়ের মতো। নিজের সঙ্গেই বাজি ধরলাম- ‘এটা নিশ্চয়ই ব্ল্যাক ফরেস্ট।’ আমার চমক ভাংছিলো না। আব্বু কেন আমার জন্য একটা পুস্তকাকৃতির কেক এনেছেন?
এখন, কমপক্ষে কুড়ি বছর পরে আমি আমার ফেসবুক বন্ধুদের বলি, জন্মদিন নিয়ে দু’কলম লিখতে। আসলে আমার ভালো লাগে জানতে যে আমার বন্ধুরা জন্মদিন নিয়ে কী ভাবে। কাছাকাছি ধরনের অভিজ্ঞতা এবং অনুভূতির কথা জানতে পারি। আমার এক বন্ধু লিখেছেন, তিনি জন্মদিনে বিশ্বাস করেন না। প্রতিটি জন্মদিনই তাকে মৃত্যুর কথা মনে পড়ায়। আমার ধারণা, কোনো যাজক তার মনে এমন বোধ রোপণ করেছেন। ইন্টারেস্টিং, আমি ভাবি। কী লজ্জা! মানবযাত্রার (হিউম্যান জার্নি) কী নিদারুণ অপচয়!
আমরা কোনো ধর্মীয় ছুটির দিন পালন করি না। সুতরাং জন্মদিন ছিল আমাদের বাড়ির সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ইভেন্ট। বহু দিন ধরে আমরা জন্মদিনের অনুষ্ঠানের জন্য কথা বলতাম, পরিকল্পনা আঁটতাম। আমার স্বামী ইয়া বড় একটা লিস্টি ধরিয়ে দিতেন, সেগুলো তার চাই। আমার কন্যারা জানতো জন্মদিন এমন একটা দিবস যেটা আমি বিনষ্ট করে ফেলতে পারি। মা এবং আব্বুর জন্মদিনে তাঁদের সঙ্গে থাকার চেষ্টা করতাম। প্রত্যেকবারই তা হয়ে উঠতো দারুণ স্পেশাল।
কেন? আমার মনে পড়ে সেই চতুর্দশতম জন্মদিনের কথা। জন্মমাসের শুরুতেই আব্বু আমাকে উইশ করেছিলেন। জন্মদিনের কত গানই না তিনি শোনাতেন। একদিন সকালে আমার রুমের দিকে আসছিলেন বাবা আমাকে জাগাতে, উইশ করতে। মা বলেছিলেন, ‘এত আগে আগে কেন? আর প্রতিদিনই কেন?’ আব্বু প্রত্যুত্তরে বলেছিলেন, ‘যাতে ওর এই মানবজন্মের সকল বছর কভার হয়ে যায়!’
আমার মনে হতো একমাত্র সন্তান হওয়ার সুবাদে আমি আদরে আদরে নষ্ট হয়ে যাচ্ছি। আমার মাকে আমি ধন্যবাদ দিই প্রতিটি জন্মদিনেই। তিনি একজন চমৎকার বন্ধু। যদি মায়েরা হোন ফুলের বাগানে ফুল, তাহলে আমার মা সেই ফুল যেটাকে আমি তুলে নেবো। আমার আব্বুর প্রতিও আমার অশেষ কৃতজ্ঞতা। জীবনভর তিনি আমার জীবনের বিভিন্ন পর্যায়ে সিদ্ধান্ত গ্রহণে সাপোর্ট দিয়েছেন। তাঁর ইতিবাচক প্রভাব আমাকে আজকের এই উন্নততর মানুষ হিসেবে গড়ে ওঠোয় ভূমিকা রেখেছে।
আমার ওই স্পেশাল ১৪-এর কেকটির কথা ভুলিনি। আব্বু চাইতেন আমি যেন খোলা বইয়ের মতো হয়ে উঠি- স্বচ্ছ, স্পষ্ট, অগোপন। মানুষের চোখের দিকে সোজাসুজি তাকিয়ে কথা বলতে শিখিয়েছিলেন তিনি। এটা ঠিক এশীয় সংস্কৃতির আদবকায়দা নয়। তাঁর কঠিন সময়ে এমন অনেক লোককেই বিশ্বাস করেছিলেন তিনি, যারা চোখে চোখ রেখে কথা বলতো না। কিন্তু আমি দৃঢ়ভাবে চোখে চোখ রেখে মানবসম্মন্ধ বজায় রাখতাম। তারপর আব্বু শেখালেন নিজের অনুভূতি না লুকোতে, যাতে মানুষ জানতে পারে আমার সত্যিকারের আমিকে। এদের কেউ আমাকে পছন্দ করবেন, কেউ করবেন না। কিন্তু একই সময়ে একই সাথে আমি সবাইকে সুখি করতে পারবো না। তিনি বলতেন যে, খোলা বইয়ের মতো জীবন যাপন করা সহজতর, যেখানে কোনো কিছু লুকনোর কষ্ট করতে হয় না। চূড়ান্তভাবে তাঁর কথা হয়ে উঠলো হাতিয়ার। যা ব্যবহার করা যাবে ইচ্ছেমতো। বলতেন, ‘পাঠ উপভোগ করবে, কিন্তু নিজেকে প্রকাশ করার জন্য তার বর্ণমালাগুলোকে ব্যবহার করবে’। আজ, এতগুলো বছর পর, আমি সেই উপদেশ গ্রহণ করছি জীবনের বাকি পথ চলবার আগে।
ওই জন্মদিনে এমন পাঁচজন ছিলেন যাঁরা আজ আর আমার সঙ্গে এই পৃথিবীতে নেই। আমার সঙ্গে আছে বর্তমান- এই সত্য আমাকে আজকের দিনটিকে উপভোগের কথা বলে। ‘স্বর্গের কান্না...’ গানটির সুর ও বাণী আজ শুনছি আর ভাবছি... http://www.youtube.com/watch?v=b6t4Zs5Yq_k&feature=related
ওইসব বন্ধুদের চেয়ে অমূল্য আর কিছুই নেই, যারা সেদিন ছিল আমার জন্মদিনকে ভরিয়ে তোলার জন্য আমার পাশে; সেই সঙ্গে আমার পরিবার যারা প্রতিটি দিন আমাকে ভালোবাসছে। প্রতিটি জন্মদিন আমার কাছে নতুন করে জন্মগ্রহণের মতো। আমাদের শারীরিক পরিবর্তনগুলো আমাদের নিয়ন্ত্রণের মধ্যে নেই; কিন্তু মন আর আত্মা নিষ্কলুষ ও সতেজ থেকে যেতে পারে- থাকতে পারে বিশুদ্ধ এবং তরুণ; অজটিল এবং স্বর্গীয়, প্রবল আবেগপূর্ণ এবং ঐশ্বর্যময়। না, আমাদের দায়িত্ববোধের ওজন আমরা নিয়ন্ত্রণ করতে পারি না, কিন্তু সকল সময়ে তা আমরা বহন করতে পারি হাসিমুখে। আমি তো বলি জন্মদিন কখনো বা আমাদের মনে করিয়ে দেয়- ‘জীবন নিজের মধ্যেই’। আমি বলি, জন্মদিন উদযাপন করতে হবে আনন্দউপভোগের মাধ্যমে- কারণ এটা একবারে নিজস্ব একটি দিবস!
আমার আপনজন ও প্রিয়জনদের নিয়ে জন্মদিন পালনের কথা আমি আজ ভাবছি। নিজেকেই বলছি ওই মুহূর্তগুলোকে নম্রতা দিয়ে আলিঙ্গন করার জন্যে। প্রজ্বলিত মোমশিখাগুলো বলবে সামনে এগিয়ে যাওয়ার কথা। আমি বারবার আবৃত্তি করতে থাকবো : হে পরম করুণাময়, আমার চৌদ্দতম জন্মদিনে যারা আমার পাশে ছিল, এখন নেই, তাদের তুমি শান্তিতে রেখো। হে আল্লাহ, অনুগ্রহ করে তাদের দিকে খেয়াল রেখো যারা আমার বন্ধু ও পরিবারের সদস্য, যারা সব সময় আমাকে ভালোবাসছে, আমার পাশে থাকছে।
শেষে চির অশেষ একটি প্রার্থনা : ‘চিরকালের জন্য আমার পরিবারকে শান্তিতে ভরিয়ে রেখো’।
নিজেকে নিজেই বলি : শুভ জন্মদিন। উপভোগ করো, এটা তোমারই...।