কবিতা কি জনপ্রিয়তা হারাচ্ছে! পাঠক কি ক্রমশ কবিতা থেকে মুখ ফিরিয়ে নিচ্ছেন?
এরকম একটা জিজ্ঞাসায় অনেক কবি ও বহু কবিতাপাঠক আন্দোলিত হন। কিন্তু মুখে স্বীকার করতে সংকোচ হয়। কবিতাকে ভালোবেসেই এ ধরনের শঙ্কা মনে উঁকি দিয়ে যায় বটে। গণমানুষ কবিতার বিষয় হলেও তার বড় একটি অংশ কবিতার প্রতি কখনই আকৃষ্ট হন না। বলাবাহুল্য লাখ লাখ স্নাতকের পাঠ্যপুস্তকের বাইরে আর কবিতা পড়া হয়ে ওঠে না সারা জীবনে। সাহিত্যের ধ্র“পদ একটি মাধ্যম কবিতা, ফলে সাহিত্যের পাঠক মানেই কবিতাপাঠক নন। দুই যুগ আগে দেশের প্রথম আধুনিক কবি আবুল হোসেনের সঙ্গে আলাপচারিতায় কিছু অপ্রিয় সত্য কথা উঠে এসেছিল। তিনি বলেছিলেন, ‘কবিতার পাঠকসংখ্যা কমে গেছে বলে দুঃখ করে লাভ নেই। যারা সমসাময়িক কবিতাকে অপাঠ্য দুব্যোধ্য বলে মুখ ফিরিয়ে থাকেন , তারা কবিতা উপভোগের জন্য কিছু করেছেন কি? কবিতা উপভোগ এমনি এমনি হয় না। তা শিখতে হয়। যেমন ধ্র“পদী গানের বেলা, চিত্রকর্মের বেলা। সুতরাং যে কেউ একটা কবিতা নিয়ে বসলেই তিনি কবিতার রসাস্বাদন করতে পারবেন এরকম ভাবা ঠিক নয়। কবিতা সকলের জন্য নয়।’
কবিতার পাঠকপ্রিয়তা কেমন সেটা শতভাগ নিশ্চয়তা দিয়ে হয়তো বলা যাবে না, তবে একুশের বইমেলায় কবিতার বই বিক্রি থেকে কেউ যদি তার একটা মোটামুটি ধারণা পেতে চান তাহলে তাকে কি দোষ দেয়া যাবে? সমকালীন কবিদের কবিতার বইয়ের বিক্রি কিছুটা কমেছে, তার মানে আবার এই নয় যে পাঠক কবিতা থেকে মুখ ফিরিয়ে নিচ্ছেন। রবীন্দ্রনাথের কাব্য, নজরুলের ‘সঞ্চিতা’ জীবনানন্দের সমগ্র কবিতা, সুকান্তের বই প্রতি বছরই যথেষ্ট পরিমানে বিক্রি হয়। এমনকি শামসুর রাহমানের কবিতা তরুণ ও বয়স্ক পাঠকেরা পাঠ করেন। কবিতা তো শুধু একান্তে পড়বার নয়, অন্যকে শোনাবারও। যে ক’জন কবির নাম এইমাত্র উচ্চারণ করলাম তাঁদের বিচিত্র কবিতা আজকের আবৃত্তিকারেরা কণ্ঠে তুলে নিচ্ছেন। শ্রোতার শোনার চাহিদা রয়েছে বলেই তাঁদের কবিতা আবৃত্তি করা হচ্ছে। তাহলে কি আমরা বলতে পারি যে, কবিতার আবেদন এতটুকু ম্লান হয়নি, কিন্তু সমকালে যে কবিতা উৎপাদিত হচ্ছে সেগুলো নিয়ে প্রশ্ন উঠছে। শিক্ষিত মানুষ কেন কবিতা পড়েন? তাঁর শিল্পবোধ ও সৌন্দর্যতৃষ্ণাই তাঁকে কবিতার কাছে নিয়ে যায়। কবিতা এক ধরনের আশ্রয়। মানুষ সেখানে স্বস্তি, সান্ত্বনা, সমর্থন ও আনন্দ সন্ধান করে। মানুষ কবিতায় প্রতিবাদ প্রত্যাশা করে, চায় ধ্বনির যাদু, শব্দের মোহন বাজনা, এবং আরো অনেক কিছু। কবিতায় খোঁজে আবেগের অভিনব প্রকাশ, জীবনের গূঢ় সত্য এবং অপার্থিব শান্তি। জীবনকে গভীরভাবে উপলব্ধি করতে কবিতা সাহায্য করে। কিন্তু কোন কবিতা? অবশ্যই মানসম্পন্ন কবিতা, প্রকৃত কবিতা। সত্যিকারের প্রাজ্ঞ দ্রষ্টা সাধক কবির কবিতা।
এইসব বিষয় নিয়ে আমাদের কবিদের কথাও তো শোনা চাই। তাঁদের কী মত? যাঁদের জন্য লেখা হয় কবিতা সেই পাঠককে আমরা উপেক্ষা করতে পারি না। তাঁদের অভিমতও কান পেতে শোনা চাই। আর আবৃত্তিকারেরা? যাঁরা বহুসংখ্যক মানুষের কাছে কবিতার সুধা পৌঁছে দেন তাঁদের বক্তব্যও কম গুরুত্বপূর্ণ নয়।
প্রবীণ দুই কবি
অবস্থান বিপ্রতীপ
‘সব শালা কবি হবে’- এমন বাক্যকে কবিতার চরণ হিসেবে মেনে নিতে চাইবেন না হয়তো কেউ কেউ, অথচ এই কবিতাটিই এরশাদ সরকারকে ক্ষুব্ধ করে তুলেছিল। কবিতাটির জন্য কবিকে ক্যন্টনমেন্টে জিজ্ঞাসাবাদ করা হয়। হ্যাঁ, আমি কবি মোহাম্মদ রফিকের কথা বলছি। সেই গল্প শুনেছি তাঁর মুখে তাঁর সাবেক কর্মস্থল জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ে বসে। কবিতার জনপ্রিয়তা প্রসঙ্গে তিনি যে অভিমত প্রকাশ করেছেন তা গভীর অভিনিবেশের দাবী রাখে। তিনি বলেছেন, ‘প্রথম কথা হলো, আমরা এখানে কবিতা বলতে কি মানের এবং কি ধরনের কবিতা বুঝছি। যদি ধরে নিই যে, আমরা যে কবিতা নিয়ে আলাপ করতে চাইছি তা উন্নত মানের এবং শিল্পসম্মত। তা হলে বলতেই হয়, সে মানের কবিতা কখনই কোন কালে জনপ্রিয় ছিল না। এখন হঠাৎ জনপ্রিয় হয়ে ওঠার প্রশ্নই অবান্তর। দ্বিতীয়ত, আমরা জনপ্রিয় বলতে কি বোঝাতে চাইছি। আমরা কি সেই ধরনের কবিতাকে বুঝতে চাইছি যা মুড়িমুড়কির মতো সর্বজনের প্রিয়? তাহলে স্বীকার করি, সে ধরনের কবিতা সম্পর্কে আমার কোন ধারণা নেই।
তবে দেখা যায়, কখনও কখনও এমন কবিতাও রচিত হয় যা কিনা শিল্পসম্মত হয়েও মানুষের আকাক্সক্ষার সম্পদ হয়ে ওঠে। আমার বন্ধু অনুবাদক জন ফ্রেইস্টনার আমাকে একটা গল্প বলেছিল, আমি তখন আইওয়ায়। ফ্রেইস্টনার বলেছিল, সে পাবলো নেরুদার কবিতা অনুবাদে উদ্যোগী হয়ে চিলি যায়। সান্তিয়াগো শহরে রাস্তায় ঘুরছিল, এমন সময় সে শুনতে পেল এক বালক কবিতা আওড়াতে আওড়াতে তরমুজ বিক্রি করছে। অবাক না হয়ে উপায় ছিল না তাঁর। সে ছেলেটিকে কাছে ডাকল, এক খ- তরমুজ কিনল এবং ছেলেটিকে অনুরোধ করল কবিতার পঙ্ক্তি ক’টি আওড়াতে। সে শুনল এবং পরে পাবলো নেরুদার কবিতা অনুবাদ করার সময় সে আবিষ্কার করল যে, পঙ্ক্তি দুটি পাবলো নেরুদার ‘ওড’ থেকে নেয়া।
ওই বালক হয়ত পাবলো নেরুদা নামে কোন কবির নামই শোনেনি। পঙ্ক্তি ক’টি তরমুজ বিক্রেতাদের কণ্ঠে কণ্ঠে ঘুরছে। তবে এমন ঘটনা মানব ইতিহাসে দুর্লভ এবং দুর্লভ ঘটনাটি ঘটে পাবলো নেরুদার মতো কোন কোন দুর্লভ কবির রচনার ক্ষেত্রে। অবশ্য এই দিয়ে কোন কিছুই প্রমাণিত হয় না।
কিন্তু এমন ঘটনাও ঘটে যে, কালে কালে কোন কোন কবির কোন কোন মানসম্মত কবিতা জনপ্রিয়তার অভিধায় অভিষিক্ত হয়ে পড়ে। এমন উদাহরণ বাংলা সাহিত্যেও রয়েছে। বলা যাক, যতীন্দ্রমোহন বাগ্্চীর ‘কাজলা দিদি’ কবিতাটির কথা। যে কবিতাটি পড়েনি সেও ‘বাঁশ বাগানের মাথার উপর চাঁদ উঠেছে ঐ শুনেই উন্মনা হয়ে যায়। বুকে গেঁথে যায় পঙ্ক্তিটি। এর সঙ্গে মানবিকতা বোধের গভীর সম্পর্ক রয়েছে। জাতীয় সঙ্কটের মুহূর্তে বা যুদ্ধবিধ্বস্ত সভ্যতার মুখোমুখি দাঁড়িয়ে রচিত কবিতা বোধগম্য কারণে সর্বজনপ্রিয় হয়ে ওঠে। এর উদাহরণ পৃথিবীর সর্বত্র ছড়িয়ে রয়েছে, দ্বিতীয় মহাযুদ্ধোত্তর ইউরোপ থেকে ‘৭১ থেকে ‘৭৫-এর বাংলাদেশেও। তদুপরি মানতেই হবে যে, উন্নত মানের রচনা সে কবিতাই হোক আর উপন্যাসই হোক জনপ্রিয় হয়ে ওঠা তো দূরের কথা সর্বজনগ্রাহ্য হতেও সময় লেগে যায়। রুচিরও বোধের বিস্তৃতির ও সংবেদনশীলতার প্রতীক্ষায় থাকতে হয়।
এ কথা সকল শিল্পকর্মের বেলায় প্রযোজ্য। নতুন ধরনের ক্রিয়াকর্ম হলে তো কথাই নেই। নতুনত্বের স্বাদ ও বিস্ময় গ্রহণ এবং উপভোগের জন্য ধৈর্যই একমাত্র নিয়ামক।
কবির দীর্ঘ বয়ানের পরও আমরা জানতে চাই- পাঠক কি কবিতা থেকে মুখ ফিরিয়ে নিচ্ছে?
কবি মোহাম্মদ রফিক বললেন, ‘আমাদের দেশের প্রকাশকরা কাব্যগ্রন্থ প্রকাশে অনিচ্ছুক। শুধু আমাদের দেশেই নয়, পৃথিবীর প্রায়ই সর্বত্রই এমনটা ঘটছে। অবশ্য ব্যতিক্রমী প্রকাশক যে নেই তা নয়। কারণটা অবশ্যই ব্যবসায়িক। উত্তর একটাই- বিক্রি নেই। তার মানে এই নয় যে, অন্যান্য বইও প্রচুর বিক্রি হচ্ছে। পাঠ্যবইয়ের কথা আমি এখানে তুলছি না। প্রকাশকদের কথা মেনে নিয়েও বলতে হয় যে, পাঠক কবিতা থেকে মুখ ফিরিয়ে নেয়নি। কখনও নেবেও না। কারণ কবিতা তার অস্তিত্বের খোরাক যোগায়। মনে হতে পারে যে, ঠিক ওই মুহূর্তেই বিশেষ ধরনের কবিতা ঠিক পাঠকের আকাক্সক্ষা পূরণে সক্ষম হচ্ছে না। এটা তো আর আজকালকার বিষয় নয়। নগদ দামে বিক্রি হওয়ারও পণ্য নয়। পাঠক তার প্রকৃত কবিতাটি ঠিকই শনাক্ত করে এবং চিত্তেও ধারণ করে। কবিতা জীবন-মরণের বেঁচে ওঠার সঙ্গী। জন্ম থেকে মৃত্যু পর্যন্ত তার দায় ও অঙ্গীকার। পাঠক কবিতার জন্য, তার কবিতাটির জন্য উন্মুখ হয়ে প্রতীক্ষা করছে। বুঝতে হবে কবিকে এবং তখনই সব ভুল বোঝাবুঝির নিরসন হবে।’
বর্ষীয়ান কবি বেলাল চৌধুরী খোলাখুলি যা বললেন সেটাকে কবি মোহাম্মদ রফিকের ভিন্নমত বলতে পারি। কবিতার জনপ্রিয়তা আগের চেয়ে কমেছে এ কথা মেনে নিয়ে জানালেন, ‘ দিনে দিনে কমছে এটাও সত্য। একটা সময় ছিল শিক্ষিত সাধারণ মানুষের মনোজগতের অন্যতম খোরাক ছিল কবিতা। বিনোদনের মাধ্যম হিসেবেও কেউ কেউ নিতেন। এই দুই দশক আগেও কবিতার চর্চা ছিল ব্যাপক। সময়ের অনেক কথাই বিধৃত হতো কবিতায়। এখন কবিতায় পাঠক আগের সেই স্বাদ আর পাচ্ছে না। বিষয়-বৈচিত্র্যের দৈন্য প্রকট হয়ে দেখা দিচ্ছে। সময় বদলাচ্ছে, মানুষের রুচিও পাল্টাচ্ছে। কবিতার মতো উঁচুমার্গের নান্দনিক শিল্প থেকে মানুষ সরে যাচ্ছে। অর্থাৎ চর্চা কমে যাচ্ছে।
অন্যদিকে কবিদের মধ্যেও চর্চার ঘাটতি লক্ষ্য করা যাচ্ছে। অনেকেই আগের মতো সিরিয়াস নন। কবিতা লিখতে গেলে যে প্রচুর পড়াশোনা করতে হয়, করতে হয় সাধনা- সেটা এখন একেবারেই কম। কবিতা যেমন প্রতিভার সঙ্গে জড়িয়ে থাকে, তেমনি চর্চারও বিষয়। আমাদের সময়ের ও অগ্রজ কবিদের দেখেছি সমাজ-সময় ও শিল্পের প্রতি দায়বদ্ধতা থেকে সাহিত্য তথা কাব্যচর্চা করেছেন। এখন কেউ আর চেতনা নিয়ে এগোচ্ছে না আগের মতো। স্বাভাবিক কারণেই তা সৃষ্টির ওপর প্রভাব ফেলছে নেতিবাচকভাবে। আমি মনে করি যে কোন সৃষ্টির নেপথ্যে চেতনা না থাকলে তা ফলপ্রসূ হয় না। ফলে কবিতা আকৃষ্ট করতে পারছে না পাঠককে। এ বাস্তবতায় কবিতার মানও হারাচ্ছে।
কবিতার মান নিয়ে ইতি বা নেতিবাচক কথা বলা কঠিন। সামগ্রিক বিচারে আমরা এগিয়েছি এ কথা বলা যাবে না। মানুষের সুকুমার বৃত্তির জায়গা এখন দখল করে নিচ্ছে আকাশ-সংস্কৃতি ও যান্ত্রিকতা। ইন্টারনেটে একজন মানুষ আনন্দের খোরাক পাচ্ছে বিচিত্র বিষয়ে নানা উপায়ে। কোন পাঠক পছন্দের কবির কবিতা পাচ্ছেন দ্রুত। কবি কবিতাটি সৃষ্টি করে যদি ইন্টারনেটে দিয়ে থাকেন পাঠক হয়ত দ্রুত তা পাবেন, তবে মানের বিষয়ে প্রশ্ন থেকেই যায়। কেননা কবিতা লেখার পর তা দ্রুত প্রকাশ বা প্রচারের বিষয় নয়। সমৃদ্ধ কবিতার অভাবেই কাব্যসাহিত্য পাঠক হারাচ্ছে। পাশাপাশি এই ইন্টারনেটে নিজেকে নিমগ্ন রাখার কারণেই পাঠক বইবিমুখ হচ্ছে। সেটা ঘটছে কবিতার বইয়ের সঙ্গে সৃষ্টিশীল ও সিরিয়াস বিষয়ের বইয়ের ক্ষেত্রেও। একটা বিষয় মনে রাখা দরকার, জনপ্রিয়তা এক বিষয় আর স্ব-স্ব অঙ্গনে টিকে থাকা এক নয়। কবিতা এমন এক বিষয়, যা জনপ্রিয়তার মাধ্যমে টিকে থাকতে হয়। কবিতাশূন্য সময় মোটেও মঙ্গল বয়ে আনে না। কবিতার এ আকালের সময় আমরা অশুভ শক্তির উত্থান দেখছি। কবিতা তথা সুস্থ সংস্কৃতির দাপট থাকলে অশুভ শক্তি দমে থাকত অতীত এমনটাই সাক্ষ্য দেয়। কবিতাকে জনপ্রিয় করতে, পাঠককে ধরে রাখতে মনন ও সৃজনশীল উভয় চর্চা দরকার সচেতনভাবে।
কবিতা সমাজ সংস্কারের হাতিয়ার
দেশের জনপ্রিয় কবি নির্মলেন্দু গুণের সঙ্গে লন্ডনে কবিতা উৎসবে যোগ দিয়ে প্রবাসীদের কবিতাপ্রীতির পরিচয় লাভ করেছিলাম। কবিতার বই ছাড়াও নিজের ভিন্ন ধরনের বইও নিয়ে গিয়েছিলেন কবি। সমস্ত বই কাড়াকাড়ি করে বিক্রি হয়ে গিয়েছিল। এমন একজন কবির কাছে কবিতার জনপ্রিয়তা নিয়ে কোনোরকম সংশয় প্রকাশ ঝুঁকিপূর্ণ বটে। কবি নির্মলেন্দু গুণ এককথায় নাকচ করে দেন; কবিতার পাঠক কমার প্রসঙ্গটিকে অপশক্তির অপপ্রচার বলেও মন্তব্য করেন। তাঁর মুখেই শোনা যাক: কবিতা জনপ্রিয়তা হারাচ্ছে না, পাঠকও কমছে না। যারা বলেন কবিতা জনপ্রিয়তা হারাচ্ছে, পাঠক কমে যাচ্ছে তাদের সঙ্গে শুধু ভিন্নমতই পোষণ করি না, আমি এ ধারণার বিরোধিতা করছি। যারা এমন কথা বলেন তারা কবিতা নিয়ে মিথ্যাচার করছেন। এটা কবিতাবিরোধীদের অপপ্রচার। কবিতার মতো নান্দনিক বিষয় থেকে যদি মুখ ফিরিয়ে নেয়া যায় তা হলে অশুভ শক্তির উত্থান ঘটাতে সহজ হয়। কবিতা জনপ্রিয়তা হারাচ্ছে এমন কথা স্বাধীনতাবিরোধীদের চিৎকার। এসব অপশক্তির অপপ্রচার।
আমি দৃঢ়ভাবে আবারও বলছি, কবিতা সমাজ সংস্কারের হাতিয়ার। বাঙালীর জাতীয়তাবাদ বিকাশে কবিতার ভূমিকা আমরা দেখেছি মুক্তিযুদ্ধপূর্ব সেই ঊনসত্তরের গণআন্দোলনের সময় থেকে। তারও আগে ভাষা আন্দোলনকেও প্রভাবিত করেছে কবিতা। বঙ্গবন্ধু নিজে কবিতার অনুরাগী পাঠক ছিলেন। তাঁর অনুসারীরাও কবিতা পড়তেন। সে সময়ে কবিতা তুমুল জনপ্রিয়তা পায়। জাতীয়তাবাদী আন্দোলন যখন স্বাধীনতা তথা মুক্তিযুদ্ধে রূপান্তরিত হয় তখন আর অন্য সবের সঙ্গেও কবি ও কবিতার ভূমিকা ছিল অপরিসীম। যা আজ ইতিহাস। সে সময়ের আবেগের স্রোতে কবিতা দিয়েছিল শক্তি, প্রেরণা ও বেগ।
মক্তিযুদ্ধের পরে উপন্যাস কিছুটা এগিয়ে গেলেও কবিতার ভাটা কিন্তু পড়েনি। নিজের কথা বলতে পারি ১৯৮৩ সালে আমার ‘নির্বাচিতা’ প্রকাশের পর এই ২০১৬ পর্যন্ত এর আটটি সংস্করণ বেরিয়েছে। তেত্রিশ বছরে একটি কবিতার বইয়ের আটটি সংস্করণই কি প্রমাণ করে না কবিতা জনপ্রিয়তা হারায়নি? আমি এ বাবদ সম্মানী পেয়েছি ২ লাখ ১০ হাজার টাকা।
এ কথা স্বীকার করতেই হবে সময় দ্রুত বদলাচ্ছে। এখন ইন্টারনেটের যুগ। ফেসবুকেও পাঠক কবিতা পড়ছেন। ফেসবুক এখন কবিতাচর্চার অন্যতম ক্ষেত্র। তবে সমগ্র জনসংখ্যার তুলনায় কাব্যচর্চা আশানুরূপ বাড়ছে বলে মনে হয় না। মান বিচারের ভার পাঠকের।
কবিতার জনপ্রিয়তা বাড়া-কমার প্রসঙ্গ তোলাটাই অবান্তর। কেননা বাংলাদেশই পৃথিবীর একমাত্র দেশ যেখানে প্রতিবছর মহান একুশের বইমেলায় হাজার হাজার বই প্রকাশিত হয়। এটা পৃথিবীর অনন্য ঘটনা। এত কবিতা একসঙ্গে প্রকাশ পৃথিবীতে নজিরবিহীন। এটা আমাদের হীরণ¥য় অহঙ্কার। এর মধ্যে হজারেরও বেশি কবিতার বই প্রকাশিত হয়। সেখানে অনুমান করি লক্ষাধিক কবিতা তো থাকেই। বিক্রিও কম হয় না। এটাও মনে রাখতে হবে পৃথিবীর কোন দেশেই এত বিপুল সংখ্যক কবিতার বই প্রকাশিত হয় না। পাশাপাশি কবিদের ‘জাতীয় কবিতা পরিষদ’সহ আরও কিছু সংগঠন রয়েছে। সেখানে কমপক্ষে পাঁচ শ’ কবি জড়িত আছেন। তারা নিয়মিত-অনিয়মিত কবিতার চর্চা করে যাচ্ছেন। তা হলে কবিতার জনপ্রিয়তা কমছে, পাঠক হারাচ্ছে এ কথাটি শুধু ভুল নয় অন্যায়ও। অন্যায় এ কারণে যে, কবিতা বিশ্বের সবচেয়ে নান্দনিক-শিল্পীত মাধ্যম; যেটায় ভর করে অন্যায়-অত্যাচার, অশুভ শক্তির বিরুদ্ধে যুদ্ধ করা যায়। এ এক হীরণ¥য় হাতিয়ার।
বিলেতে বাংলা কবিতা
কবি শামীম আজাদ সুদীর্ঘকাল বিলেতে আছেন, সেখানে মঞ্চে বাংলা কবিতার পাশাপাশি ইংরেজি কবিতাও পারফর্ম করেন তিনি। তাঁর মতে বিলেতে বেড়ে ওঠা বাঙালি তরুণ প্রজন্মের কাছে বাংলা কবিতা ছড়িয়ে দিতে হলে সময়ের দাবী অনুযায়ী আধুনিক যন্ত্রাানুষঙ্গ সহযোগে আকর্ষণীয়ভাবে কবিতা পরিবেশন করা দরকার। এক্ষেত্রে কবি বা আবৃত্তিকারকে বডি ল্যাঙ্গুয়েজও ব্যবহার করতে হবে। শব্দ প্রক্ষেপন, আরোক সংযোজনায়ও আধুনিকতা থাকা চাই। অনেকটা স্টুডিও থিয়েটারের আঙ্গিকে মঞ্চে কবিতার ব্যতিক্রমী পরিবেশনা ভাষা পুরোপুরি না বুঝলেও ইংরেজরাও বাংলা কবিতা উপভোগ করেছেন। এ থেকে কারো কারো মধ্যে আগ্রহ তৈরি হলে বাংলা কবিতার অনুবাদও বাড়বে। ফলে বাংলা না জানা বাঙালি কিশোর-তরুণদের মধ্যে বাংলা কবিতা প্রসার লাভের সুযোগ বাড়বে।
পক্ষে-বিপক্ষে মুক্ত মন্তব্য
‘কবিতার পাঠক কি ক্রমশ কমছে! যদি কমে, তাহলে কেন কমছে?’ সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম ফেসবুকে এরকম একটি জিজ্ঞাসায় স্বতঃসস্ফূর্তভাবে যারা সাড়া দেন তাঁরা অবশ্যই কবিতাকে ভালোবাসেন। অর্ধশতাধিক কবি, আবৃত্তিকার এবং কবিতাপাঠক ফেসবুকের পোস্টটিতে সাড়া দিয়ে আলোচনা ও বিতর্কে অংশ নেন। এটাকে এক ধরনের জরিপ যদি নাও বলি, তবু সমাজের সচেতন একটি অংশের অভিমত বল ধারণা করে নিতে পারি।
তরুণ কবি শামীম আহমেদ জিতু বিশ্লেষণী মন্তব্য করেছেন। তাঁর অভিমত: কবিতার পাঠক মোটেও কমছে না। কবিতার পাঠক ছড়িয়ে গেছেন। রুদ্র বাংলা কবিতার মোটামুটি শেষ তারকা কবি। রুদ্র পর্যন্ত বাংলা কবিতায় অনেক তারকা কবি ছিলেন বেশ একটা লম্বা সময় ধরে। একেক দশকে তখন হাতে গোনা ২-৩জন কবি ছিলেন ঈশ্বরের মতো। তাদের ঘিরে থাকত অসংখ্য পাঠক। ধীরে ধীরে এই অবস্থার পরিবর্তন হয়। প্রচুর পত্রিকা, সাহিত্য সংগঠন, প্রকাশক আসতে থাকে - সাথে সাথে বাড়তে থাকে কবিদের এক্সপোজার, পাঠকও হতে থাকেন বিভক্ত। আজ থেকে ২০ বছর আগে পাঠক হাতে গোনা ৫-১০ জন কবির লেখা খুঁজতেন, তাদের বই পড়তেন। এখন রুদ্র'র মতো তারকা কবি নেই কিন্তু অনেক কবি আছেন যাদের পাঠকও নেহায়েত কম নয়। তবে কবিতার ধরন, কবির ধরন এবং পাঠকের মননশীলতাকে কেন্দ্র করে পাঠকও ভাগ হয়ে যাচ্ছে নানা কবিকে ঘিরে। ফলত আগে যেমন ৩-৪ জন কবিকে ঘিরে উন্মাদনা থাকত, তাদের কবিতা, কবিতার বই, আবৃত্তির ক্যাসেট, আলোচনা সভা - সেটা চোখে পড়ত। এখন অনেককে ঘিরে অনেক জায়গায় অনেকে এমনটা করেন বলে আর তা আগের মতো চোখে পড়ছে না।
কবিতাপাঠক শরীফ আহমেদ অন্যরকম ব্যাখ্যা দিয়ে বলেন, পাঠক হ্রাসের ব্যাপারে ভোগবাদী সমাজ ব্যবস্থাকেই আমি বহুলাংশে দায়ী করছি। পুজির আগ্রাসনে শিল্পের আঙিনায়ও যেতে ইচ্ছুক নয় আজকের শিক্ষিত তরুন সম্প্রদায়। আর কর্পোরেট মোড়কের চাকচিক্য এবং প্রযুক্তিগত মেকি বিনোদনে বিভোর হয়ে আছে চারপাশ। শিল্পের মত একটি নান্দনিক জায়গায় চোখ ফেলার জন্য যে সারল্যপূর্ণ যোগসাজশ দরকার তার উপযোগী অনেকেই হতে পারছে না। যারা পারছে তারাই কবিতার পাঠক বা কবিতাটাও স্বয়ং তাঁরাই লিখছে।
কবিতার পাঠক ও লেখক আফসানা কিশোয়ার বলেন, কবিতা বোঝার জন্য যে ধরনের পড়ালেখা থাকা দরকার, সে ধরনের পড়ালেখা অনেকেরই নেই। আমার নিজের যেমন সব জ্ঞান ভাসাভাসা,একটা জিনিস পড়ব সেটা নিয়ে ভাবব বুঝব সেরকম সময় আমার হাতে নেই। তাই সেই ঘুরেফিরে পড়া কবিতাগুলো বারবার পড়ি। তবে নতুন কবিতার চাইতে কেন যেন বারবার জীবনানন্দ, সিলভিয়া প্লাথ, রুদ্র, রবীন্দ্রনাথ পড়তে ভালো লাগে বেশী। আগে পূর্ণেন্দু পত্রী, গুণ, শামসুর রাহমান এগুলো পড়তাম।
কবি লুৎফুল হোসেন মনে করেন সবই ঠিক আছে। শুধু কোথায় যেনো পলি জমছে। যত্রতত্র, প্রায় সর্বত্র গভীরতা কমছে। এর ভেতরও পেয়ে যাই কখনো অলৌকিক ঝর্ণা, গভীর কালো জল দীঘি, উচ্চকিত সমুদ্রতট, কিংবা কয়েকখানা অবারিত আকাশ। তবু পাই তো ! পাই এখনো ...
পাঠক আসমা খাতুনের মতে কবিতা যখন প্রাণ পায় আর পাঠকের হৃদয় ছুঁয়ে দেয় তখন পাঠক তৈরি হয়। সহজবোধ্য শব্দেও গভীরতা থাকে যদি তাতে সঠিক উপমা ব্যবহার করা হয়।
মনজুরুল আজিম পলাশ মনে করেন কবিতার পাঠক বাড়ছে, পড়বার মাধ্যমগুলো বেড়ে চলেছে, হার্ডকপি বই-এর পাঠক হয়তো কমছে।
আবৃত্তিশিল্পী তাহসীন রেজার অভিজ্ঞতালব্ধ মতামত: যারা আগে কবিতা পড়তেন তারা আজকাল লিখতে শুরু করেছেন। কবিতা পড়ার গভীরতম মমত্ববোধ থেকে এমনটা যে হয়, শুধু তা নয়। বরং কবিতা আলোড়িত করে বলেই, সে মানুষজন লিখছেন। তা যেমনি হোক। আরো অবাক করা বিষয় হলো, যাদের সাথে কবিতার কোনো যোগাযোগ থাকবার কথা নয় তারাও খুব আন্তরিকতার সাথে সে গুলো পড়ছেন এবং নিজেদের মতামত লিখে জানাচ্ছেন। এর চাইতে সুখবর আর কি হতে পারে ! তবে এ কথা ঠিক, কবিতার মেজাজ বদলেছে।
পাঠক মাইনুল ইসলাম মিঠুর মতে কবিতার মান কমে যাওয়ায় পাঠকের সংখ্যা কমে যাচ্ছে।
আরেক পাঠক তারেক মাহমুদের মতে এ সংসার-প্রকৃতি ও জীবনবোধের প্রতি পরতে কবিতা আছে, প্রয়োজন শুধু জানাবার। যেমন চলার পথে যখনি কোথাও কেও হোঁচট খাবে-তাতে আশাহত না হয়ে বরং কবিতার চয়ন তাকে এগিয়ে জাবার প্রত্যয় দিবে। কারন সে জানে তার একটা কবিতা আছে। তার কেও আছে।।
কবিতার একনিষ্ঠ পাঠক ফারহানা নীলা বলেন, বই বিক্রি যদি পরমিাপক হয় তাইহলে কোন কথা নেই! কিন্তু যদি কবিতা পাঠক ও বোদ্ধা নিয়ে কথা হয়, তবে দুটো কথা আছে। সহজবোধ্য কবিতা, যা কিনা টেনে নিয়ে যায় সাবলীল ভাবে, যা কিনা পাঠকের মনের সাথে কথা কয়, জীবনের কোন না কোন অংশ অন্তমিল- সে সব কবিতার পাঠক বেড়েছে। গুণ, রুদ্র, হেলাল হাফিজ- এমন আরো কবির কবিতা বহুল পঠিত। আসলে সহজবোধ্য কবিতা আজকাল পছন্দ। মানুষের চলমান জীবন ক্রমশ জটিল!তবে এটা প্রশ্ন থাকে পাঠকের মান কমেছে না বেড়েছে?
কাঠগড়ায় ‘কবি’
কবিতার পাঠক কি ভাগ হয়ে যাচ্ছে? পাঠক বেছে নিচ্ছেন তাঁর পছন্দের কবিকে, তারপর শুধু সেই পছন্দের এক বা একাধিক কবির কবিতা পড়ছেন। অন্যদের কবিতা তাঁকে আকৃষ্ট করতে পারছে না। তাহলে অধুনা কবিদের মধ্যেই কি সমস্যা রয়েছে? কবি টোকন ঠাকুর কবিতার মতো করেই কিছু প্রসঙ্গ আনলেন। তাঁর বক্তব্য: এও কি হতে পারে যে, পুঁজি নিয়ন্ত্রিত সমাজ ব্যবস্থায় মানুষ যেভাবে নানান কোম্পানির প্রডাক্ট হয়ে যাচ্ছে, মানুষ যেভাবে সাবান হয়ে যাচ্ছে, বুদবুদ হয়ে ফুটছে, মানুষ যেভাবে চকলেট হয়ে যাচ্ছে, মানুষ যেভাবে মানুষ হতে চাচ্ছে, তাতে, তার মধ্যে তো কেউ কেউ কবি, কিছু মানুষ তার পাঠক; সেই কিছু মানুষ, সেই কবি, সেই কবিতা--সবই প্রডাক্ট। কাজেই প্রডাক্টের বাইরে সত্যিকারের কবিতাও কি লিখিত হচ্ছে আজ?--যে, পাঠক তার সন্ধানে হেঁটে যাবে, খুঁটে খাবে? আজ যত কেরানি, তারাই কবিতা লিখে নাম কবিযশোপ্রার্থীর তালিকা বাড়াচ্ছে। তাই কবির মুক্তি দরকার কেরানির জীবন থেকে, কবিতা মুক্তি পাবে। সেই মুক্ত কবিতা সুস্বাদু হবে। বেঁচে থাকার প্রয়োজনেই পিঁপড়ে মধুর খোঁজ পেয়ে যাবে।
কবি শান্তা মারিয়ার সাফ কথা- কবিতার পাঠক সত্যিই কমছে। কেন কমছে? কিছু আগাছা কবিতার জন্য এটা হচ্ছে। যে পাঠক একবার আগাছা কবিতা পড়ে বিরক্ত হয়েছেন তিনি আর অন্য কবিতাও পড়তে চান না। মানসম্পন্ন নয় এমন কবিতার লাগামছাড়া প্রকাশ মানসম্পন্ন কবিতার পাঠককে কবিতাবিমুখ করে তুলছে। পাঠক ভয়ে নতুন কবিতা পড়তে চায় না। তবে পুরনো কবিতা যেমন জীবনানন্দ বা সুধীন দত্ত তো মানুষ এখনও পড়ে।
সিনিয়র আবৃত্তিশিল্পী লায়লা আফরোজেরও অনুরূপ মন্তব্য-অধিকাংশই কবিতা হয় না তাই পাঠক কমছে। শব্দের পাশে শব্দ জুড়ে দিয়ে শব্দের সেতু নির্মাণই কবিতা? না তা নয়। কবিতা অন্য কিছু। যারা কবিতা লেখেন তাদের অধিকাংশই এই ব্যাপারটা বুঝেন না। তাই কবিতা লেখার নামে আবর্জনা সৃষ্টিতে ক্ষান্ত হন না। লিখেই যান, বিরামহীন-অন্তহীন শব্দের জাগ্লারী!
তরুণ লেখক বিধান মিত্রের মতে আজকালকার বেশির ভাগ কবি কাব্যজগতে প্রবেশের পূর্বে প্রথমে বিসর্জন দেন পিতৃপ্রদত্ত নাম, এরপর বিসর্জন দেন চিন্তার-স্বাভাবিকতা, এরপরে উপস্থাপনের সহজ রীতি। ওই তিনটা জিনিস বিসর্জন দিয়ে, যে তিনটা জিনিস গ্রহণ করেন--এর সবগুলোই তো কৃত্রিম। কৃত্রিম নাম-ভাব-ভাষা প্রয়োগ করে মানুষকে চমকে দেয়া যায়, হৃদয়-মননে আসন পাওয়া যায় না। পাঠক-সাধারণ কবিতার ভেতরে আনন্দ-রোমান্স- খোঁজে, জ্ঞানের কণা খোঁজে না। বর্তমানকালের অধিকাংশ কবিতায় ‘জ্ঞান’ কতোটুকু আছে--জানি না, তবে ‘আনন্দ-রোমান্স’ যে নেই তা হলফ করে বলতে পারি, কারণ ওইসব কবিতার আংশিক মর্মোদ্ধার করাও শোচনীয় রকমের কঠিন। একটা নির্দিষ্ট সময়ে সাপ তার খোলস ত্যাগ করে। আমাদের নবীন কবিরা কবি হিসেবে নাম লেখাবার আগেই---ত্যাগ করেন নিজের ঐতিহ্য--মাইকেল-রবীন্দ্রনাথ-নজরুলকে। জীবনান্দের আংশিক আলো সাথে করে তারা খোঁজ করেন দেরিদা-নেরুদা-র্যাবোর। শেকড়-বিচ্যুত কবিকুল, ভুলে যান--মধুসূদন শেকড়ে ফিরে আসার পরই কবি হয়েছেন।
কবিতাপাঠক পূর্ণা রায় বললেন, মানুষের প্রতি মানুষের মমত্ববোধ যত কমছে, কবিতার পাঠক ততই কমছে, আর ভালবাসার শক্ত গাঁথুনিহীন কবিতা নামের লাইনগুলোও কবিতার প্রতি অবহেলার একটা কারণ হতে পারে।
সমালোচনার তীর পাঠকের দিকে!
কবি ফরিদ কবিরের অভিমত: কবিতার পাঠক অনেক কমেছে। আশির দশকেও একটি কবিতার বই ছাপা হতো ১২৫০ কপি। এখনকার বইগুলো ৩০০ কপি করে! গত চল্লিশ বছরে দেশে লোকসংখ্যা বেড়ে প্রায় দ্বিগুণ হয়েছে। কিন্তু বইয়ের বিক্রি কমে গেছে! আগামীতে কারো কারোর বই হয়তো ১০০ কপি ছাপানো হবে। দু-দুজন প্রকাশক আমাকে বলেছেন, কোনো কোনো কবির বই পুরো মেলায় ২০ কপিও চলেনি! আমি নিজে বইমেলায় লক্ষ করে দেখেছি, যারা কবিতা লেখেন তাদের বেশির ভাগই বইমেলায় প্রতিদিন গেছেন কিন্তু ফেরার সময় তাদের অনেকের হাতেই আমি বইয়ের কোনো প্যাকেট দেখিনি! অনেকে ফেসবুকেই কবিতা পড়ে ফেলেন, তাদের হয়তো মনে হয়, বই কেনার আর দরকার কী? অনলাইনে কবিতার পাঠক দিয়ে কেউ যদি ভাবে পাঠক বেড়েছে, তবে সেটা আমার পক্ষে মেনে নেয়া মুশকিল! নিবিষ্ট মনে একটা আস্ত কবিতার বই পড়া আর, অনলাইনে দুটো-চারটা কবিতা পড়ে একজন কবিকে বুঝতে পারার মধ্যে তফাৎ আকাশ আর পাতালের। অনলাইনে একজন কবির ৫-২০টা কবিতা পড়েই অনেকে ভাবছেন, তার কবিতা পড়া হয়ে গেছে! আর কিছু পড়ার দরকার নাই! যারা এমন স্বভাবের, তাদেরকে তো আমি পাঠক বলতে পারবো না।
কবি পিয়াস মজিদও বললেন, কবিতার বইয়ের বিক্রি বইমেলায় খুবই কম। কিন্তু আমরা যখন দেখি রাজনীতিবিদ, অবসরপ্রাপ্ত আমলা, বিচারকরা পর্যন্ত যখন তাঁদের মূল্যবান সামাজিক পরিচিতির বাইরে অল্প একটু কবিখ্যাতির জন্য প্রাণান্ত চেষ্টা করেন তখন প্রশ্ন জাগে সমাজে ‘কবি’র অবস্থানটা ঠিক কোথায়? কেন কবি হওয়ার জন্য বিপুল মানুষের জোর প্রচেষ্টা আর কেনই বা বিশিষ্ট বহু কবিরও কাব্যগ্রন্থের প্রথম সংস্করণ কয়েক বছরেও শেষ হয় না? এর সোজা-সাপ্টা উত্তর খুঁজে পাওয়া ভার। তবু একটা কারণ হয়তো অনেকেই বলবেন যে আধুনিক কবিতার দুর্বোধ্যতাই পাঠককে দূরে ঠেলে দিচ্ছে। এবং ভাবতে অবাক লাগে যে শিল্পসাহিত্যের অন্যান্য মাধ্যমে কাজ করা ব্যক্তিরাও যখন একই কথা বলেন। প্রশ্ন আমাদের- কবি কি সর্বজনবোধ্য পদ্য লিখবেন? নাকি বাংলা ও বিশ্বকবিতা বর্তমানে যে পর্যায়ে এসে পৌঁছেছে তার সঙ্গে নিজেকে সম্পৃক্ত করবেন? যদি বিজ্ঞান ও প্রযুক্তির কথা ধরি তাহলে দেখব প্রাথমিক জ্ঞান নিয়েই তো একজন বিজ্ঞানী বা প্রযুক্তিবিদ বসে থাকেন না। তিনি তো ক্রমশ নিজেকে ছাড়িয়ে যেতে চান- নতুন নতুন উদ্ভাবনায়। তাঁর এই উদ্ভাবনার স্বাদ ও সুফল পেতে হলে ভোক্তা সাধারণকেও কিন্তু শ্রম ও মনোযোগ দিতে হবে। কবির কবিতা উপলব্ধি করতে হলেও পাঠকের শিল্পশিক্ষা থাকা জরুরি। শুধু কবিতা না যে কোনো সাহিত্য ও শিল্পকর্ম অনুধাবনেই এই শিক্ষা শর্তবিশেষ। পাঠক যতই সহজ পদ্য পেতে চান এখনকার কোনো কাণ্ডজ্ঞানসম্পন্ন কবিই তো আর পেছন পথে হাঁটবেন না। তাই আধুনিক কবিতার বইয়ের নিদারুণ স্বল্প বিক্রয়ের জন্য একতরফাভাবে কবিকে দায়ী না করে পাঠকের মানের উন্নয়ন-অবনয়নের দিকেও ফিরে তাকানো দরকার।
লেখক, কবিতাপাঠক ফয়জুল ইসলাম বলেন, কবিতার বই পড়ার পাঠকের সংখ্যার সাথে যোগ হবে কবিতার অনলাইন পাঠকের সংখ্যা। তাহলে কবিতার পাঠকের সংখ্যা বেড়ে যাবে অংকের নিয়মে। পরিসংখ্যান নেই আমার কাছে বটে। প্রবাসী অনেকেই হাতে বই পায় না। তারা অনলাইন উৎস থেকে কবিতা পড়ে বলে জানি। দুই-চারটা কবিতা পড়ে কোনো কবিকে বোঝা যাব না। আর পাঠক অর্থ হ'ল যে কোনো লেখা যান্ত্রিকভাবে না পড়ে হৃদয়ঙ্গম করতে পারা বলে মনে করি। আমার এই পর্যবেক্ষণ অনুযায়ী কবিতার পাঠকের সংখ্যা কমে যেতে বাধ্য।
পাঠক মিনি শামসুন নাহার বলেন, সব লেখা কবিতা নয়। কবিতা পড়তে হ'লে ও হৃদয়াংগম করতে হ'লে, যে সহৃদয় বোধ ও বিশ্বাস থাকতে হয়, যে প্রস্তুতির প্রয়োজন তা এখনকার পাঠকদের মধ্যে অনুপস্থিত। এবং সহৃদয় হৃদয়সংবেদী হতে হয়। কারণ কবিতা কোনো ফিরিস্তি নয়, নয় দূর্বোধ্য শব্দের সমাহার আর নয় শুধু খন্ডিত কাঁচা প্রেমের সমাহার। তাই কবিতার পাঠক কমে গেছে।
আবৃত্তিকার মোস্তফা শিবলি মনে করেন অজস্র কিছুর মধ্যে কবিতা একটু চাপা পড়ে আছে কিন্তু জনপ্রিয়তা মোটেও কমে নি।
কবিতার বই নিয়মিত কেনেন সায়কা শারমিন। তিনি বলেন, প্রকৃত পাঠক কমছে কিন্তু না পড়ে লাইক দেয়া ভার্চুয়াল পাঠক বাড়ছে। অতিরিক্ত বস্তুবাদী জীবনধারায় মানুষ এখন সস্তা আর হালকা বিনোদন খোঁজে। মগজ খাটিয়ে অনুধাবন করতে হবে এমন কিছুতে সময় ব্যয় করতে চায় না। আর ভালো পাঠক না থাকলে ভালো কবি তৈরী হয় না আবার ভালো কবি না আসলে ভা্লাে পাঠকও পাওয়া যায় না...এই চক্রে ঘুরপাক খাচ্ছি আমরা।
প্রবীর বিকাশ সরকারের এক কথা- মনকে আন্দোলিত করার মতো কবিতা লেখা হচ্ছে না এটাই আমার মতে পাঠক কমার প্রধান কারণ।
কবিতা যখন ফেসবুক স্ট্যাটাস
শুধু বইমেলা থেকে নয়, সারা বছর কবিতার বই কিনে পড়েন সংস্কৃতিকর্মী হুমায়ূন আজম রেওয়াজ। তাঁর অভিমতটি তাৎপর্যপূর্ণ। তিনি বলেন, সংখ্যা বিবেচনায় পাঠক কমেনি তবে নিবিষ্ট পাঠক কমেছে। অনলাইন দুনিয়াতো কবি(!) আর কবিতায়(!) সয়লাব। এ বিপুল জোয়ারে ভালো কিংবা প্রকৃত কবিতার ঝাণ্ডা উঁচিয়ে রাখা দুস্কর। সাম্প্রতিক কালের স্বঘোষিত বা বন্ধুমহল ঘোষিত কবিদের সার্কেল মূলত অনলাইন নির্ভর। সোশ্যাল মিডিয়ায় মেকি লাইক আর তোষামোদের আড়ালে পাঠের পরিবেশ নষ্ট হয়ে যাচ্ছে। লিটল ম্যাগের এখন দুর্দিন ফলত কবির প্রস্তুতির জায়গাটা একেবারেই অপরীক্ষিত থেকে যাচ্ছে। একই সাথে প্রতিষ্ঠিত দৈনিকগুলোর সাহিত্য পাতার মান বিজ্ঞাপন আর চটকদারিতায় আচ্ছন্ন হয়ে ক্রমশ নিম্নগামী। এর উপর আছে হাজারো চটুল বিষয়ের ফিচার পাতা। পাঠক কিন্তু প্রতি সপ্তাহে এসব ফিচার পাতায় সস্তা কৌতুক, রেসিপি, ফ্যাশন, বিনোদন সংবাদ গিলছে আর ভোগবাদী সমাজের গ্রাহক হয়ে পড়ছে অজান্তে। এমন অস্থির আর সহজলভ্যতার যুগে কবিতায় নিবিষ্ট হবার অবকাশ কই?
আর বই প্রকাশ বা কবিতা প্রকাশ এতই সহজ যে, আজকাল যে কেউ যেন চাইলেই কবি বনে যেতে পারেন। এখনও কবিতার জন্য উন্মুখ থাকি, সপ্তাহান্তে সাহিত্য পাতা উলটে দেখি, মাসান্তে সাহিত্য পত্রিকাও কিন্তু কবির সাথে যোগাযোগটা যেন হয়ে উঠছে না। সবাই যেন বিচ্ছিন্ন দ্বীপের রবিনসন ক্রুসো। তাই পাঠ কালে ফিরে যাই সত্তর, আশির দশক বা তারো পূর্বে। এই আকালের দিনেও অবশ্য কভু পেয়ে যাই নতুন মুশায়েরা । কবিতার দিন ফিরুক, কবিতার আড্ডা ফিরুক। আর কিছু অবসরপ্রাপ্ত কবি কাম নেতা অবশ্য পরিবেশ ঘোলা করার দায়িত্ব নিয়েছেন। এঁদের কাজ অগ্রজদের নিন্দামন্দ করে বাতিল করে দেয়া। এই গোত্রের কবিকুলের শিষ্যরা হাততালি দিবে আর নিজেরাও সামিল হবে। এই গালাগালির স্রোতে পড়ে তাদের আর পাঠ হয়ে ওঠে না। এই ঊঠতি বয়সের ‘হঠাৎ কবি সম্প্রদায়’ দু একটি বই বের করেই এমন কুচকাওয়াজ শুরু করেন যে সাধারণ পাঠকের পাঠের স্বস্তিটা উবে যায়। কবিতায় চিৎকার থাকতে পারে কিন্তু তা মূল অবলম্বন হয়ে ঊঠলে বিপদ বলেই মনে করি। গত বইমেলায় গোটা কয় নতুন কবির বই কিনেছি, প্রায় সবার কবিতা (উল্লেখযোগ্য সংখ্যক পড়তে পারেন) ফেসবুক স্ট্যাটাস আক্রান্ত। তো ফেসবুক স্ট্যাটাস আমি কবিতার বই থেকে পড়ব কেন?
......... মারুফ রায়হান