এক -
মে মাসের ভ্যাপসা গরমে মিটমিটে হারিকেন জ্বলা, প্রায় অন্ধকার একটা ঘর। মাটির সখ্যে ন্যূজ হয়ে সেখানটায় শুয়ে বসে আছে সাত-আটজন মানুষ। ঘাম-রক্তের সংগে একপাশের নোনা ধরা দেয়ালের গুমোট বোঁটকা গন্ধের মিশেল বাতাসের একটা ঝাপটা গায়ে মেখে একে একে রুমটায় ঢুকলো আরো তিনজন। গায়ের জামা দিয়ে কষে বেঁধে রাখা চোখগুলো তাদের খুলে দেয়া হয়েছে এখানে ঢুকবার আগের রুমটায় পৌঁছাবার পর। চোখ খুলে দিলেও দিলেও হাত জোড়া তিন জনারই তখনো শরীরের পেছন থেকে জোড়া করে বাঁধা।
বেঁধে রাখা চোখের দৃষ্টি-বিঘিœত অন্ধকারে ডুবে পিকআপের পেছনে বসে থেকে অনবরত ঝাঁকুনিতে নিজের অনিচ্ছায় একে অন্যের গায়ের উপর হুমড়ি খাচ্ছিল ওরা। এতে বিরক্তির বদলে পরস্পরের অস্তিত্ব বিদ্যমান থাকবার স্বস্তিটা বরং প্রাণের সঞ্চারে করে যাচ্ছিলো তিনজনার ভিতরই।
এই চানুচরের কৌটায় ভরে ঝাঁকানোর মতোন অবিরাম যাত্রায় কয়েকবার থেমেছে মিলিটারী পিকআপ ভ্যানটি। তাতে দু-একবার অস্পষ্ট কিছু কথার আওয়াজ ছাড়া ওরা শুনতে পেয়েছে কেবলি কয়েক জোড়া বুটের খট্ খট্ আওয়াজ। এটুকু বাদে বাকী সারাক্ষণ তিনটা মানুষের মনের মধ্যে চলছিলো লাগামহীন শংকার ডালপালা মেলা এক বরফ বৃক্ষের ক্রমাগত বিস্তার। তাদের চেহারাগুলোর দিকে তাকিয়ে অবশ্য কারো পক্ষেই ওই শংকার কোনো ছায়া খুঁজে বের করা সম্ভব ছিল না।
নির্বিকার। ভাবলেশহীন। কেমন যেনো এক পাথুরে অবয়বে থমকে আছে ওদের অনুভূতির সমস্ত প্রকাশ। যখন এটুকু মোটামুটি জানা যে, এমনভাবে মিলিটারীরা তুলে নিয়ে আসলে - সম্ভাব্য পরিণতি আর কিছু নয়, একটি বুলেটের সংগে নিশ্চিত অন্তিম প্রণয়। তাহলে আর অতশত ভাবনায় কাজ কি?
ওদের বাঁধা চোখের অন্ধকার ক্যানভাসে কল্পলোকের আলোকিত ভাবনা গ্রন্থনায় একে একে ভেসে উঠেছিলো প্রাসংগিক ও অপ্রাসংগিক অতীত। নিজ অস্তিত্ববিহীন স্বজনদের সম্ভাব্য ভবিষ্যৎ ছবি। প্রিয় মানুষগুলোর আনন্দময় অতীত ও বিষাদময় ভবিষ্যতের আশংকা। আবার কখনো সব কিছু ছাপিয়ে সম্ভাব্য কোন এক সোনালী সকালের স্বাধীন প্রিয় মুখটির মাটি ও ফসল ছুঁয়ে যাবার স্বপ্ন বিভা।
লম্বা কয়েক ঘন্টা চলার পর গাড়ী কোথাও এসে থামলে পায়ের দড়ি খুলে তাদের নামানো হলে চলমান সেলুলয়েড অকস্মাৎ থামলো। পিঠে রাইফেলের গুঁতা খেয়ে হোঁচট খেতে খেতে উঠান মতোন খোলা বড় একটা জায়গার মাটি মেখে কতগুলো কদম ফেলার পর, কয়েকটা সিঁড়ি। তা ডিঙ্গিয়ে, বারান্দা, তারপর একটা রুমের ভিতরে এলে পরে তাদের থামতে বলা হলো।
কেউ একজন বাঁধা চোখ উন্মুক্ত করলে আধো আলোকিত রুমের ভেতরও আলো সয়ে নিতে তাদের খানিকটা সময় লাগলো। আসবাবহীন বড় একটা ঘরের প্রায় মাঝামাঝি জায়গার ছাদ থেকে নেমে আসা ইলেকট্রিক তারের মাথায় ঝুলছে উল্টো ফানেলের মতোন একটা শেড। তার নীচে জ্বলছে ষাট পাওয়ারের একটা বাল্ব। সেই অলোর সিংহভাগ দখল করে একখানা টেবিল। ওটার তিন ইঞ্চি চওড়া কাঠের ফ্রেমের মাঝখানের অংশটুকু রেক্সিনে মোড়ানো, টেবিল টপ পাটাতনটার চাইতে এর নীচের অংশটুকুন সামনের দিকে প্রায় দশ-বারো ইঞ্চি ভেতরে ঢোকানো। বিশাল একটা সেক্রেটারিয়েট টেবিল। রঙ চটে মলিন হয়েছে বেশ খানিকটা। রেক্সিনটার এক কোনায় দুই-তিন ইঞ্চি মতোন জায়গা ছিঁড়ে উল্টা দিকে মোচড় খেয়ে আছে, সুতা খুলে যাওয়া পাতার বিড়ির মতোন।
একজন ক্লিনশেভ ক্যাপ্টেন, অন্যজন পাকানো মোচের এক মেজর। টেবিলের প্রস্থ ও দৈর্ঘ্যরে দুই পাশে বসে আছে দুইজন বেশ আমুদে চেহারা নিয়ে। ঢোকার দরজার দুই পাশে আরো দুই জন, ডানদিকের একটা দরজায় একই রকম আরো দুই জন। এই চারজন মিলিটারী জওয়ান। অন্য একপাশের দরোজায় এরকম আরো একজন। টেবিলের পেছনের ডান কোনার দরজাটার পাশে কেউ নেই। ওটা সম্ভবত বাথরুম। একা দাঁড়ানো জওয়ানটার পাশের দরজার ভিতরের রুমটা সম্ভবত মেজর সাহেবের। বোঝা যাচ্ছে, ভেতরে মানুষ আছে। এক নয়, একাধিক। যদিও ভেতর থেকে শুধু এক নারী কন্ঠের কুঁই-কুঁই আওয়াজও পাওয়া যাচ্ছে।
আপলোগ রূপায়া কিউ নেহি দিয়া! ও রূপায়া সরকারকা মাল! হামলোগ সরকারকা সিপাহী। হামারা সাথ জবরদস্ত বেত্তমিজি কার লিয়া তুম! আগার স্ট্রং রুম খুলকার রূপায়া হামকো জরুর দেনে পড়েগা। আব নেহি দেনা তো গোলি চালা দুঙ্গা। সুবাহ তক্ টাইম আপ লোগোকো লিয়ে।
মেজর সাহেবের কথা থামতেই ক্যাপ্টেনের ইশারায় ডান দিকের দরজার দুই মিলিটারী চাইনিজ রাইফেলের বাঁট দিয়ে গুতিয়ে পথ দেখালো তাদের এই রুমটার দিকে। ক্যাঁচ ক্যাঁচ শব্দে দারোজা খুলে যেতেই দেখা গেলো অন্য রুমগুলোতে বিজলী বাতি থাকলেও এই রুমটায় কেবলি একখানা হারিকেনের মিটে মিটে আলো। বিদ্যুৎ সাশ্রয় নয়, সম্ভবত মানসিক চাপ সৃষ্টির কৌশল হিসেবেই এমন ব্যবস্থা।
দুই
গত সাত দিনে দুইবার গিয়েছিলো মিলিটারী। ম্যানেজার টি হোসেন, চীফ ক্যাশিয়ার নূরুল হোসেন আর তাদের সহকর্মী ইসরাইল। তিনজনই বদ্ধপরিকর পাকিস্তানি আর্মিকে স্ট্রং রুমের একটি টাকাও দেয়া যাবে না। ইনিয়ে বিনিয়ে তারা তাই বার বার ব্যাংক-এর উধর্ক্ষতন কর্তৃপক্ষের অনুমোদনের কাগজ চেয়েছে। ওটা না হলে কিছুতেই দেয়া যাবে না। দিলে সরকারের ও রাষ্ট্রের বিরোধিতা হবে - এমনটা বোঝাবার চেষ্টা করেছে। আর ভাব করেছে পাকিস্তান সরকারের বাধ্য কর্মচারী তারা। তাই দিতে আপত্তি নেই, শুধু প্রমাণ রাখতে চায় টাকা যে মুক্তিদের দেয় নাই। নাইলে যুদ্ধের পরে যে চাকরী থাকবে না।
প্রথম দিন তাদের কথায় বিচলিত হয়ে চলে গেলেও দ্বিতীয় দিন পুরোপুরি দ্বিধান্বিত ছিল পাক আর্মি অফিসারটি। আনুগত্য না কি ধোকা দেবার চেষ্টা এটা যেনো অনেকটাই বুঝে উঠতে যাচ্ছিল...এমন অবস্থায় ফিরে গেলো।
কিন্তু এর তিন দিন পরই আবার ফিরে এলো দ্বিতীয় দিনের অফিসারটি। ক্যাপ্টেন ইমরান। সাথে প্রথম দিনের অফিসারটিও ছিলো লেফটেন্যান্ট জুবেরী। জানালা দিয়ে ব্যাংকের গেটের কাছে থামানো আর্মি জীপের পাশে দুজন শান্তি কমিটির লোক দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে ইতিমধ্যে ব্যাংকের ভেতরের সবাই বুঝে নিয়েছে - এখানে সবাই যে, স্বাধীনতাকামী জনসমষ্টির সমর্থক এবং পাকিস্তান বিরোধী মনোভাবাপন্ন এসব মিলিটারীদের ভালো মতোন জানানো বোঝানো হয়ে গেছে।
দিন পনেরো আগে ক্যাপ্টেন আইনুদ্দীন এসেছিলেন মুক্তিবাহিনীর জন্য অর্থ সংগ্রহ করতে। প্রথম দিন ফিরিয়ে দেয়া হয় মনঃপুত কোন পন্থা বের করতে না পারায়। শেষদিকে চীফ ক্যাশিয়ার প্রস্তাব রাখলো ব্রাক্ষ্মণবাড়ীয়া জোনাল অফিস থেকে রেমিট্যান্সের কাগজ পত্র আনতে হবে। প্রথমত ওই রেমিট্যান্সের টাকা ট্রেনে করে ভৈরব ব্রাঞ্চ থেকে ব্রাক্ষ্মণবাড়িয়া যাবে অস্ত্রধারী গার্ড সমেত। সেখান থেকে কসবা হয়ে পরে আগরতলায় পৌঁছে যাবে ওই টাকা।
সেই মতো দু’দিন পরেই রেমিটেন্সের কাগজ এলো। তিনজন বাদে ব্যাংকের আর কেউ জানেও না এটা সত্যিকারের নাকি সাজানো রেমিটেন্স। সুতরাং এই তিনজন মানুষও ট্রেনে ওই ট্রাক ভর্তি টাকা পাহারা দিয়ে ব্রাক্ষ্মণবাড়িয়া পৌঁছে দিয়ে আসে। সেই টাকা দু’দিনের ভেতরই চলে যায় আগরতলায়।
মুক্তিযোদ্ধাদের অস্ত্র, পোশাক, খাবার, শরণার্থী শিবিরের মানুষের বেঁচে থাকা। কতো কিছুর জন্য টাকা দরকার। কাজটা করতে পেরে খুব তৃপ্ত ছিলো মানুষ তিনজন। কথাটা কেউ না হলেও শান্তি কমিটির ছোঁক ছোঁক করা মানুষ ক’জন মনে হয় কিছুটা হলেও আঁচ করতে পারছিলো। কেননা ওরা খুব বুঝতে পারছিল, ব্যাংকের ভেতর ক্রমশ মুক্তিকামী মানুষের আনাগোনা বাড়ছে।
বেশ বোঝা যাচ্ছিল, আজকে আর শেষ রক্ষা হবে না। মেজর সাহেব কথা বলবেন তাদের সাথে এমন কথা বলে বিকেল চারটার দিকে মিলিটারী পিক-আপের পেছনের অংশে তোলা হলো এই তিনজনকে। প্রথমে সেটা এসে থামলো মেঘনা ব্রীজের শুরুর আগে রেললাইনের নীচ দিয়ে এগিয়ে যাওয়া পথে ডান দিকে মোড় নিয়ে খানিক এগিয়েই ... একটা খোলা মাঠের পাশে জায়গাটা শেড টানা এল প্যাটার্নের রেলওয়ে হাই স্কুল।
এখানে আসতেই একটা রুমে নেয়া হলো তাদের। ওয়্যারলেসে কথা বলছিলো কোনো অফিসার। কয়েক লাইন কথা বলবার পর বলা হলো আরো দূরে কোন এক ক্যাম্পে নেয়া হবে তাদেরকে কোন এক পাঞ্জাবী মেজরের কাছে। সে এই এলাকার দায়িত্বে আছে তাই।
তিন
ভ্যাপসা গরমে রুমটায় ভিতর সবাই যেন ধীর লয়ে সিদ্ধ হচ্ছে। সদ্য এসে ঢুকেই বেশ টের পায় তিন জনই। গায়ে তাদের চিট পিটানো ঘাম চুঁইয়ে চুঁইয়ে নামতে থাকে। শরীর-কাপড় ক্রমশঃ নোনতা ভাপে ভিজে যেতে থাকে। আলো কিছুটা ঠাহর হয়ে আসতেই বুঝতে পাওে - যারা আগে থেকেই আছে এখানে তাদের এমন সূক্ষ্ম সুবিধা-অসুবিধার ভাল-মন্দ বোঝার মতোন বোধশক্তি খুব একটা আর অবশিষ্ট নেই। কেমন একটা ঘোরের মধ্যে যেন আছে ওরা, অনুভূতি বিলুপ্ত প্রায়, আধো বোধ আধো অচৈতন্য অবস্থার মাঝামাঝি একটা ব্যাপার। সময়ের সাথে সাথে সেই ঘোর যেনো লাগতে থাতে নতুন আসা তিনজনের মধ্যেও। মানুষগুলো সব পাথরের মূর্তির মতোন স্থির বসে। টিমটিমে আলোয় উজ্জ্বল ক্ষুদে পাখির মতোন স্বাধীন ওড়াউড়ি করছে কতগুলো মশা। থেকে থেকে তীক্ষ্ম চিঁ চিঁ শব্দে টের পাওয়া যায় চিকার উপদ্রব আছে জোর। নিশ্চুপ পড়ে থাকলে মানুষকেও খুবলে দেবে ওরা খাবারের সন্ধানে। মাথার ভিতর বেশ ঝিঁ ঝিঁ ডাকতে শুরু করে দিয়েছে শেষ বিকেলে এখানে আসা তিন ব্যাংক কর্মকর্তারও।
থেকে থেকে পাক আর্মির উর্দু বাত-চিতের হালকা আওয়াজ আসছিল। একসময় মনে হলো তার মাত্রা খানিক বাড়লো। রাতের খাবার জুটবার কিছুমাত্র সম্ভাবনা যে নেই তা মোটামুটি ভালোই বোঝা যাচ্ছে। ক্ষিদে সামলাবার উপায় বলতে রুমের এক কোনায় রাখা এক কলসী পানিই সম্বল। তা থেকে একবার খানিকটা করে খেয়ে এলো ওরা। সাধলো শুয়ে থাকা বাকীদের। একজন শুধু চাইলো, বাকিরা নির্বিকার।
কিছু সময় কাটকেই আচমকা গোলাগুলির শব্দ শোনা যেতে লাগলো। ক্রমশঃ সেই আওয়াজ যেনো এগিয়ে আসতে থাকলো খুব কাছাকাছি। শোনা যাচ্ছিল থ্রি নট থ্রির গুলিই বেশি। থেকে থেকে এসএমজির টানা সাত-আট রাউন্ড করে গুলি। প্রায় চল্লিশ মিনিট ধরে এমন চলতে চলতে আকস্মাৎ জোরালো বিস্ফোরণের শব্দ পাওয়া গেল কয়েকটা। সম্ভবত গ্রেনেড চার্জ।
আধো-আঁধারির মধ্যে এক রকম আশা আকাক্সক্ষার আলো যেন জেগে উঠতে চাইছিল। আধশোয়া কেউ একজন বারবার ফিসফিসিয়ে বলছিল- মুক্তি, মুক্তি। হামিদ ভাইরা তো আসবেই আমাদের উদ্ধার করতে। জানি আসবেই।
আশার আলোর গায়ে ছাই চাপা দিয়ে নিয়মিত বিরতিতে গ্রেনেড চার্জ হতে হতে এক সময় থেমে এলো গুলির শব্দ। একটু পরেই পাক সেনাদের কণ্ঠস্বর সংখ্যায় বাড়তে লাগলো পাশের ঘরে। ওদের উত্তেজনা আর খটখট বুটের শব্দ যেনো হিমশীতল একটা বাতাস ছড়াতে শুরু করলো স্যাঁতসেতে রুমটার ভিতর। উত্তেজিত গলায় পাশাপাশি এটুকুও টের পাওয়া গেলো আরো কাউকে ধরে এনেছে ওরা পাশের রুমে।
চার
বল্ ! হামিদ কমান্ডার কৌন হ্যায়! কথা শেষ না হতেই ধরাম ধরাম রাইফেলের বাড়ি, থ্যাতলানো ভোঁতা সেই শব্দ শোনা যায় বদ্ধ রুমের ভেতরেও। উর্দু চিৎকারের বিপরীতে মৃদুকণ্ঠে বাংলা শব্দের আওয়াজ পাওয়া যায় কয়েক জনার।
বেশ কয়েকজনকে ধরে এনেছে পাক সেনারা। মুক্তি বাহিনীর একটা দল অক্রমণ করেছিল এখানকার অগ্রবর্তী পাক ক্যাম্পটায়। কিন্তু আগে ভাগে মনে হয় কিছু একটা খবর ছিল কোনো রাজাকার ইনফর্মার মারফত, তাই বন্দী মুক্তিযোদ্ধাদের উদ্ধার করতে এসে বন্দী হলো ওরা ক’জন। ইনফর্মেশন অনুযায়ী এক প্লাটুন পাক সেনা আগেই সরে ছিল। উল্টো দিক থেকে হামলা করে ঘিরে ফেলে মুক্তিবাহিনীর একটা দলকে। গ্রেনেড চার্জ করায় কয়েকজন আহত হলে পুরো গ্র“পটাই ধরা পড়ে।
বড় গ্র“পটা পেছনে ছিল আরো। ওরা চেষ্টা চালিয়ে ব্যর্থ হয়ে পিছু হটে গেছে। হয়তো ভারী অস্ত্র নিয়ে আবার হামলা চালাবে কাল রাতে। ততোক্ষণ আহত বন্দীরা বাঁচলে হয়। পাশের রুমের চিৎকার আর আর্তনাদে এখানে টিকে থাকা দায়। আর তাতে ক্ষোভে গুমরে মরছে অন্ধকার রুমের এগারো বন্দী।
বিরামহীন অত্যাচার চালাতে চালাতে এক সময় ক্লান্ত হয়ে পড়লো যেনো পাক সেনারা। ওদিকে ওই রুমে সবাই বলছে আমি হামিদ কমান্ডার। সময় এগুচ্ছে যেন হামাগুড়ি দিয়ে। একটা দুপুর থেকে একের পর এক ধারণাতীত ঘটনার ভিতর দিয়ে তিন ব্যাংকার এসে মিলেছে একদল বন্দী মুক্তিযোদ্ধাদের সাথে। ইসরাইল সাহেব বলে ওঠে ফিসফিসিয়ে, ইসস্ স্যার ভল্টের বাকী টাকাগুলো মুক্তিবাহিনীর হাতে তুলে দিয়ে ধরা পড়তাম পাকিস্তানীদের হাতে তাতে তো তবু শান্তি লাগতো। টি হোসেন সাহেব দীর্ঘশ্বাস ফেলেন, কথা বলেন না। নূরুল হোসেন সাহেব ইসরাইলকে বলেন এসব প্রসঙ্গে আর এখানে কথা না বলতে।
এটুকু ফিসফিস করে বলা কথার উৎসের দিকে হামাগুড়ি দিয়ে এগিয়ে আসে গুটিশুটি মেরে শুয়ে থাকা একজন। মুখভর্তি দাঁড়ি গোঁফ আর এক মাথা ভর্তি চুল লোকটার। বলে আমি হামিদ কমান্ডারের বড় ভাই। আমি শুন্ছি আপনাদের কথা। আপনারাও তো ভাই আমাদের মতোই যুদ্ধ করতেছেন। খালি অস্ত্র নাই হাতে।
পাঁচ
বন্ধ দরজার কাছে এগিয়ে আসে কয়েক জোড়া বুটের শব্দ। এক ঝটকায় দূরে সরে যায় হামিদ কমান্ডরের ভাই। ক্যাঁচ ক্যাঁচ শব্দে দরজা খুলে ভেতরে এসে ঢোকে চারজন পাক সেনা। চুলের মুঠি ধরে প্রথমেই টেনে ধরে হামিদ কমান্ডরের ভাইকে। মোট চারজন বন্দীকে টেনে হিঁচড়ে নিয়ে গেলো চার পাক সেনা। দরজা গলে রুমের ভিতর ছড়ানো আলোয় একটু করে চোখে পড়লো সবার অস্পষ্ট চেহারাগুলো। ওরা বের হতেই দরাম করে দরজা বন্ধ করে দিলে নিভে গেলো আলোর ঔজ্জ্বল্য। ঘরটায় নেমে এলো আবার সেই গুমোট স্থবিরতা। যেনো ঠিক সাথে সাথে তাদের মস্তিষ্কের নিউরনে খেলা করতে শুরু করলো ঝিঁ ঝিঁ পোকারা।
তখন ভোর হবে হবে। পাশের ঘরে ব্যস্ততা বাড়লো যেনো। বন্দীদের বের করে কোথাও নেয়া হচ্ছে যেন। একটু পরে খুলে গেল বদ্ধ রুমের দরজাও। দরজার পাশ থেকে কড়া শব্দে কেউ বলে উঠলো, সাব লোগকো বাহার নিকালো।
দেখতে দেখতে বন্ধ রুমের এগারো জন মানুষ পাশের ঘর ডিঙ্গিয়ে সেই উঠান পার হয়ে বের হয়ে এলো পুরানো রাজবাড়ীর মতোন পাক বাহিনীর ক্যাম্প থেকে। এর মধ্যে চোখে পড়েছে একপাশে পড়ে আছে তিন নিথর পাক সেনার দেহ। সেই তরুণ লেফটেন্যান্টও আছে ঐ তিনজনের মধ্যে। যাকে দেখা গিয়েছিল ঝুলবাতির নীচে মেজরের হুমকি ধামকির তাঁবেদারি করতে।
সারি দিয়ে হাঁটতে হাঁটতে আধা মাইলের একটু বেশী মতো এগিয়ে একটা বিলের পাশে এসে থামলো সবাই। ততোক্ষণে আলো ফুটেছে শুরু করেছে খানিকটা। মেজরের নির্দেশে বিলের পাড় ঘেঁষে লাইন দিয়ে দাঁড় করানো হলো সেই বদ্ধ রুমের এগারো জনকে। পাশের দঙ্গল থেকে এরপর লাইনে এসে যোগ দিল আরো পাঁচজন। একজনকে পাক সেনারা আটকে রাখলো তাদের নাগালে। সে আসলে দাঁড়িয়ে থাকতেই পারছিল না। বোঝা গেলো লাইনে এসে যোগ দেয়া পাঁচজন এতোক্ষণ তাকে সামলে রেখেছিল। হালকা আলোতে দেখা যাচ্ছিল তার মাথা থেকে নেমে আসা রক্তের ¯্রােত কাদার মতোন জমে আছে শরীরের একপাশ জুড়ে। রাইফেলের বাটের আঘাতে থেঁতলে যাওয়া মাথার আঘাত আর রক্তক্ষরণ - এ দুয়ে মিলে তাকে খুব বেশিক্ষণ আর বেঁচে থাকতে দেবে না, ভালোভাবে বোঝা যাচ্ছে নির্মম সত্যটা।
একটা জলপাই জীপ এসে থামলো দাঁড়িয়ে থাকা মিলিটারীদের পাশে। ওটার হেডলাইট তখনো জ্বলছিল। তার মানে খুব কাছাকাছি কোথাও থেকে আসেনি ওটা। ওখান থেকে কেউ একজন নামতেই মেজর স্যালুট ঠুকলো তাকে। কি সব কথাবার্তা চললো কয়েক মিনিট। আগত অফিসার সম্ভবত কর্ণেল, গাড়ীতে উঠতেই আর একবার স্যালুট ঠুকে ঘরে দাঁড়ালো মেজর। চাপা কিন্তু উচ্চশব্দে সে বলে উঠলো - সাব লোগ কলমা পড় লো।
কোন রকম কথা-বার্তা ছাড়াই কোমরের হোলস্টার থেকে রিভলবার বের করে গুলি চালালো মেজর মৃতপ্রায় আহত মুক্তিযোদ্ধাটিকে লক্ষ্য করে। একেবারে কেউ কিছু বুঝে উঠার আগেই। এতোক্ষণ ভারসাম্য রাখবার কসরতে দুলছিল শরীরটা, এবার থপ করে কাদামাটির উপর থুবড়ে পড়লো।
একজন হাবিলদার এসে টি হোসেন সাহেব আর ইসরাইলকে লাইন থেকে টেনে নিয়ে জীপে তুললো। ইঞ্জিন সচল হলো, তবে জীপটা চলতে শুরু করলো না। তাদের চোখ বেঁধে দেয়া হলো জীপে ওঠানোর সাথে সাথে। হাত দুটোতো পেছনে এনে বাঁধা সেই গতকাল থেকে। ইতিমধ্যে চোখ বাঁধা হয়ে গেছে সারি দিয়ে দাঁড়ানো বাকী চৌদ্দজন মানুষেরই। বাঁধা শেষ করে সিপাইরা সরে যেতেই মনে হলো যেনো মার্চ পাস্ট করে এক কদম সামনে এগিয়ে আসলো স্টেনগান হাতে দুই মিলিটারী। মেজরের কণ্ঠে শোনা গেল চাপা হুঙ্কার - ফায়ার !
ঠা ঠা ঠা ঠা করে যুগল অস্ত্রের আর্তনাদের সাথে লুটিয়ে পড়লো সার বাঁধা মানুষগুলো। পাশের জনের গুলি খাওয়া শরীরের আচম্কা ধাক্কায় পড়ে যেতেই নূরু বুঝতে পারছিল সে পড়ে গেছে বটে, কিন্তু গুলি আসলে তার গায়ে লাগেনি। লহমায় আঁচ করতে পারে অনির্বনীয় সৌভাগ্যটুকু। তবু ভয় টুঁটি চেপে থাকে শরীরের ও সমস্ত অনুভূতির। হয়তো এক্ষুণি কাছে এসে আবার গুলি করে নিশ্চিত হবে মৃত্যু, তারপর থামবে। শরীরের অর্ধেক চাপা পড়ে আছে অচেনা কোনো মুক্তিযোদ্ধার শরীরের নীচে। তার উষ্ণ রক্তের ¯্রােতে ভিজে যাচ্ছে নূরুর শরীর।
গুলির শব্দ থেমে গেলে টের পায় নিজেদের মধ্যে কথা বলতে বলতে ফিরে যাবার জন্য পা ফেলতে শুরু করেছে খান সেনারা। অফিসার আর দুই ব্যাংক কর্মকর্তাকে নিয়ে গাড়ীটাও চলতে শুরু করে। নূরু পাথরের মতো শুয়ে থাকে অনেকক্ষণ, দু’একজন তখনো গোঙ্গাচ্ছে কাতর শব্দে। বেশিক্ষণ স্থায়ী হয় না গোঙ্গানোর শব্দ। তারপরও নিস্তব্ধ বিল পাড়ে মৃতের মতো নিথর পড়ে থাকে নূরু। এতক্ষণে পরপারে পৌঁছে যাবার নিশ্চিত ঘটনার ভেতর থেকে কিভাবে বেঁচে আছে ভাবতে ভাবতে সম্বিত ফেরে হালকা আলোর রেখা চোখে লাগতে। আঁধার কেটে আলো সবল হতে শুরু করেছে। ত্রিসীমানায় কোনে জনমানবের সাড়া শব্দ নেই। গড়িয়ে গড়িয়ে আস্তে আস্তে পেছনের দিকে সরে যেতে থাকে নূর। পায়ে পানির স্পর্শে টের পায় বিলের গায়ে সামান্য ঢালের মতোন একটা জায়গায় আছে সে। সৌভাগ্যের পিঠে সমস্ত শক্তি জমা করে সন্তর্পণে চেষ্টা চালাতে শুরু করে নূরু দ’ হয়ে শরীরটাকে দুহাতের ভেতর দিয়ে গলিয়ে দিয়ে শক্ত করে বাঁধা পেছনের হাত দুটো সামনে আনতে। মাথার ভিতর করণীয়গুলোকে সাজাতে সাজাতে নিজ মনোবল বাড়াবার জোর চেষ্টা চালিয়ে যেতে থাকে নূরু। আগে চোখের বাঁধন আলগা করতে হবে। তারপর হাত দুটো মুক্ত করতে পারলেই কচুরিপানার আড়ালে আড়ালে বিলে সাঁতার কেটে কেটে তাকে সরে যেতে হবে নিরাপদ সীমানায়। ততোক্ষণে বন্ধ দু’চোখে তার সেলুলয়েডের মতোন ভাসতে থাকে স্ত্রী, সন্তান, বাবা-মা সবার মুখচ্ছবি। ওরা কোথায় আছে? যেখানে রেখে এসেছিল অচেনা এক গ্রামে, সেখানে আছে কি এখনো ! আছে নিরাপদে !