২ জুলাই ২০০৪। ঢাকা বিমানবন্দর ছাড়ার সময়ও আমার সংশয় ছিলো—এ কাজটা হবে কিনা। আয়োজকদের জানিয়েও ছিলাম এমন কথা। বলেছিলাম, মূল নায়িকার যাওয়া এখনও নিশ্চিত হয়নি, আপাতত পিছিয়ে দেন নাটকের কাজ। কিন্তু তারা নাছোড়বান্দা। কোনোভাবেই পিছাবে না। ৩ তারিখ রাতে কানাডা থেকে এলেন মিশুক মুনীর। মিশুক ভাইয়ের সাথে এর আগে কাজ করেছি ‘করিমুন্নেছা’ টেলিফিল্মে। তার কাজ আমার বেশ পছন্দ। তাছাড়া কানাডাতে তিনি মূলধারার টেলিভিশনের সাথে যুক্ত এবং বিভিন্ন ননফিকশন অনুষ্ঠানের জন্য ব্যস্ত ক্যামেরাম্যান হিসেবে কাজ করছেন। সুতরাং ইংল্যান্ডের মতো জায়গায় অনেক কম কারিগরি সহায়তা নিয়ে কাজ করতে তাঁকে আমার প্রয়োজন। ৩ সপ্তাহ সময় নিয়ে এসেছেন তিনি আমাদের জন্য। এসেছে ফারিয়াও। ফারিয়া থাকে তুর্কির ইস্তাম্বুলে। আমার টেলিফিল্মের জন্য একটা অবাঙালি মেয়ে দরকার। যার বাবা ছিলো বাংলাদেশি, মা ব্রিটিশ। ফারিয়ার চেহারার মধ্যে একটা আন্তর্জাতিকতা আছে। তাছাড়া পড়াশোনা করেছে ইংল্যান্ড ও আমেরিকায়। সুতরাং একটা ব্রিটিশ মেয়ের চরিত্রে তার ভালো অভিনয় করার কথা। ফারিয়া ৩ তারিখ দুপুরে চলে আসে লন্ডনে। মাহফুজ পৌঁছেছে ২ দিন আগে। সব ঠিক থাকলে ৫ জুলাই আমরা নিউ ক্যাসল যাবো। নিউ ক্যাসল থেকে আলমগীর লন্ডন এসেছে ৪ তারিখ ভোরে। আমাদের সবকিছু ঠিক থাকে না। আমরা লন্ডন পড়ে থাকি। আমাদের নিউ ক্যাসল যাওয়া হয় না। কারণ আমাদের মূল নায়িকার সংকট কাটেনি।
তিন মাস আগে থেকে ঠিক করা। তারিন হচ্ছে এ টেলিফিল্মের মূল নায়িকা। বাংলাদেশ থেকে বিলেতে পড়তে যাওয়া মন্ত্রীর কন্যা। তার সাথে নানা বিষয়ে বিরোধ হবে একই বিশ্ববিদ্যালয় থেকে বৃত্তি নিয়ে একই বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়তে যাওয়া দরিদ্র পরিবারের মেধাবী ছাত্র মাহফুজের। কিন্তু তারিনকে এখনও পর্যন্ত পাওয়া যায়নি। তার ওয়ার্ক পারমিট ইস্যু হয়নি। আজ হচ্ছে, না হয় কাল হচ্ছে, পরশু পাঠানো হবে, তরশু ভিসা পাবে এবং পরের ফ্লাইটে লন্ডন আসবে। এর মধ্যে দুইবার হোম অফিস থেকে নানা পদের খবরাখবর আসতে থাকলো। আমাদের প্রমোটার জানালেন যে, ব্রিটিশ হোম অফিস কোনোভাবে মানতে রাজি নয় যে, প্রতিদিনের কাজের জন্য একজন অভিনেত্রী ২০০ পাউন্ডের কম পাবে। ৩০ দিনের ওয়ার্ক পারমিট চাওয়া হয়েছিলো। তার জন্য তার সর্বনিু পারিশ্রমিক হবে ৬ হাজার পাউন্ড। বাংলাদেশি টাকায় ৬ লাখ টাকার বেশি! এতো টাকা কীভাবে দেবে? ভুল হয়ে গিয়েছিলো তাদের আবেদনে। তারা নাটকের বিষয়টি ঠিকমতো লিখে বোঝাতে পারেনি। পরে যা বুঝিয়েছে তা তারা বোঝেনি। এমন সংকটের মধ্যে তারা সরাসরি প্রত্যাখ্যানও করছে না। প্রতিদিনই বলছে আমরা এক অফিস থেকে আরেক অফিসে পাঠাচ্ছি। হয়ে গেলে আপনাদের পাঠিয়ে দেবো। কিন্তু হচ্ছেও না।
নিউ ক্যাসল পৌঁছে মাথায় হাত দিয়ে বসে থাকা ছাড়া কাজ ছিলো না। ক্রমাগত নাটকের কাহিনী বদল হচ্ছে। তারিনকে নিয়ে যে চরিত্র ঠিক করে রেখেছিলাম, শ্রাবন্তীর জন্য চরিত্র পরিবর্তন করে নতুন গল্প সাজালাম। এখন শ্রাবন্তীর জন্য প্রতীক্ষা।
কিন্তু শ্রাবন্তী যদি না আসতে পারে?
আমার গল্পটি ছিলো বাংলাদেশ থেকে পড়তে যাওয়া ছাত্রছাত্রীদের নিয়ে। লেখাপড়া শেষে মেধাবী ছাত্ররা বিভিন্ন যৌক্তিক কারণেই দেশে ফিরে আসে না। তাদের একজনকে নিয়ে গল্প। গল্পটি সমান্তরালভাবে বয়ে নেবে মাহফুজ তারিন/শ্রাবন্তী, ফারিয়া আর আলমগীর। রহিমা আর রানী প্রতিদিন শ্যুটিং করার জন্য অস্থির করে তুলছে। কিন্তু তখনও পর্যন্ত ঠিক করা হয়নি তারা কী করবে। আগের পাণ্ডুলিপি অনুযায়ী তারা সবাই তারিন বা শ্রাবন্তীর সহপাঠীর চরিত্রে অভিনয় করবে। সেক্ষেত্রে তারিন বা শ্রাবন্তী না এলে ওদের কোনো কাজ নাই। মাহফুজ আর ফারিয়ার অংশগুলো শ্যুট করার জন্য চেষ্টা চালানো হলো। প্রথম দিন শ্যুটিংয়ে যাবার আগে ফারিয়া বললো, সে মেকআপের জিনিসপত্র নিয়ে আসেনি। মেকআপ ছাড়া কেমনে ক্যামেরার সামনে দাঁড়াবে? আলমগীরকে বলা হলো মেকআপের সরঞ্জামের ব্যবস্থা করতে। সে তার স্ত্রীর প্রসাধন সামগ্রী নিয়ে এলো। ফারিয়া বললো, ওগুলোতে হবে না। ঠিক হলো ‘বুটস’ থেকে কেনা হবে। কিন্তু মেকআপ করাবে কে? এ নাটকে যদিও গেটআপের তেমন কোনো আয়োজন রাখা হয়নি, মেকআপ ছাড়া ক্যামেরায় দাঁড়াবেই বা কেমন করে?
খোঁজ নিয়ে জানা গেলো ইংলিশ মেকআপম্যান বা ওমেন পাওয়া যাবে, তারা নাটক-সিনেমার কাজ করে। দিনে দুইশ পাউন্ড পারিশ্রমিকের বিনিময়ে। বিশ হাজার টাকা ডেইলি হিসেবে মেকআপম্যান নিয়ে নাটক বানিয়ে পথে বসতে চান না আমাদের আয়োজক বাহিনী। লন্ডনে যোগাযোগ করা হলো এক বাঙালি বিউটিশিয়ান মহিলার সাথে। তিনিও বলেন ৪ দিন কাজ করবেন, আড়াইশ পাউন্ড তাকে দিতে হবে। পোষালো না এই হিসাবেও। ঠিক করা হলো দোকান থেকে ফারিয়া আর মাহফুজ দুটো পাফ কিনবে, আর ক্যামেরায় দাঁড়ানোর আগে নিজের পাফ নিজের গালে মাখবে।
মেকআপের বিষয় গেলো। আসি ইনডোরে কাজের বিষয়ে। ঢাকা থেকেই বলা ছিলো, অন্তত সানগান টাইপের ৪টা বাতি লাগবেই লাগবে। আলমগীর বললো, সব ব্যবস্থা আছে।
একদিন বাইরে বৃষ্টি, ঠিক হলো ঘরের ভেতর কাজ করবো। আলমগীর বাতি নিয়ে এসেছে, একটা হ্যালোজেন বাল্ব। বিলেতের বাগানবাড়িতে এটার ব্যবহার বেশি। বিল্ডিংগুলো রাতেরবেলা এসব বাতির আলোতে উজ্জ্বল হয়। এই বাতি দেখে হাসবো, না কাঁদবো, বুঝতে পারি না। সেট ঠিক করা হয়েছিলো একটা রেস্টুরেন্টের রান্নাঘর। আমাদের ক্যামেরাম্যান মিশুক ভাই পরম ধৈর্যের সাথে সে-হ্যালোজেন বাতি রান্নাঘরের ছাদে রিফ্লেক্স করে কেমন কেমন একটা শ্যুটিংযোগ্য আলো নিয়ে এলেন। শ্যুট হলো এই আলোতেই।
পরের দিন বাগড়া দিয়ে বসলাম। বাতির ব্যবস্থা করতে না পারলে ইনডোরে কোনো কাজ করা যাবে না।
বাতির ব্যবস্থা করতে গেলেন মিশুক ভাই আর আলমগীর। ৪টা ৮০০ ওয়াটের একটা বাতির প্যাকেট আর ৪টা স্ট্যান্ড। এক সপ্তাহের জন্য ভাড়া করা হলো ৩৫০ পাউন্ড দিয়ে। এই বাতিগুলো আসার পর বিপদ আরো বেড়ে যায়।
বাতি টানবে কে? গাড়িতে উঠাবে, নামাবে, রাখবে এবং খাড়া করাবে, পাত্র-পাত্রীর মুখে কিংবা তার আশপাশে যেখানে যে আলোর দরকার সেখানে এই বাতিগুলো ধরার জন্য ঢাকায় আমাদের ৪/৫ জন লোক থাকে। দিনে তারা শ তিনেক টাকা পারিশ্রমিক পায় এজন্য। ওখানে এ ধরনের লোকের পারিশ্রমিক ঘণ্টায় ১৫ পাউন্ড। দিনে ৮ ঘণ্টা কাজ করলে ১২০ পাউন্ড দিতে হবে দৈনিক সর্বনিম্ন মজুরি। ২ জন লোক নিলে লাইটম্যানের জন্য দৈনিক খরচ বাংলাদেশি টাকায় প্রায় ২৫ হাজার টাকা! সুতরাং বাদ লাইটম্যান।
লন্ডন থেকে জুলহাস ভাই আমাদেরকে পরিচয় করিয়ে দিয়েছেন মুফচ্ছিল আলীকে। আলী বেঁটে-খাটো তাগড়া যুবক। ব্রিকলেনে থাকে। অত্যন্ত সহজ সরল মানুষ। তার একটা চোখে বড় ধরনের সমস্যা। ওখানে একটা নকল লেন্স লাগিয়ে রাখা আছে। প্রাতিষ্ঠানিকভাবে সে প্রতিবন্ধী হিসেবে স্বীকৃত এবং এ কারণে ব্রিটিশ সরকারের কাছ থেকে সপ্তাহে ১৫০ পাউন্ড ভাতা পায়। এই নিঃস্বার্থ অবিবাহিত যুবককে আমাদের সাথে দেয়া হলো। তার কাজ ছিলো প্রোডাকশন বয়ের কাজ। এই এক আলী ছাড়া সমগ্র ইউনিটে আমাদের প্রোডাকশনের কোনো সহকারী ছিলো না।
নিউ ক্যাসলের বাঙালি অধ্যুষিত এক এলাকায় আমাদের জন্য ৪ বেডরুমের একটা বাড়ি ভাড়া করা হয় ২ সপ্তাহের জন্য। আমি, মাহফুজ আর মিশুক ভাই থাকি তিনটি কামরায়। ফারিয়া, রহিমা আর রানী, এই তিন সই থাকেন বড় একটা ঘরে। নিচের তলায় রান্নাঘর আর ড্রইংরুম। মূল অভিনেত্রীর অপেক্ষায় শ্যুটিং যখন প্রায় বন্ধ, তখন মিশুক ভাই রান্নাঘরে তার সৃজনশীলতা দেখাতে ব্যস্ত হয়ে পড়লেন। এবং এ কথা স্বীকার করতেই হবে যে, রান্নায় তার ক্রিয়েটিভিটি ক্যামেরার ক্রিয়েটিভিটি থেকে কোনো অংশে কম ছিলো না। আমি পুরুষশাসিত বাঙালি পরিবারের ছেলে। নিজের চা নিজে ঢেলে খেতে অভ্যস্ত নই। নিজের প্লেট নিজে পরিষ্কার করতে হবে এমন পরিস্থিতিতে যাতে পড়তে না হয় এ কারণে বিদেশমুখিতার কথাও কখনো চিন্তা করিনি। কিন্তু ওখানে আমাকে এই কাজ করতে উৎসাহিত করা হতো। বলা হতো, মনে করা হোক আমরা পিকনিকে এসেছি। পিকনিকের মতো, ভাবাভাবি শুরু হয়ে গেলো অনেকের মধ্যে। রাত একটা বাজলেই বাঙালি ভাইয়েরা রেস্টুরেন্টের কাজ সেরে এসে পড়েন আমাদের পিকনিক হাউজে। তাসের আড্ডা জমে যায়।
শ্যুটিং শুরু হয় নর্দামব্রিয়া বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসে। টেলিফিল্মের প্রায় পুরো গল্প এই বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসকে ঘিরে। নাটকের প্রয়োজনে একজন ইংরেজ রিসেপশনিস্ট দরকার আমাদের। আলমগীরকে বলতেই হাজির করলো টিনাকে। টিনার সাথে তার কথা হয়েছিলো আগে। টিনা দুপুর বারোটা থেকে লাইব্রেরিতে বসা। মেয়েটির সাথে কথা বলে মনে হলো পাকা ইংরেজ সে নয়। হলোও তাই। আলবেনিয়ান টিনার জন্ম গ্রিসের এথেন্সে। ৪ বছর ধরে ইংল্যান্ডে আছে। পড়তে এসেছিলো গ্রিস থেকে। পড়ার ফাঁকে এক বারে ঢুকেছিলো বার টেন্ডারের কাজে। ব্যস, বার টেন্ডারি করে। পড়াশোনা শেষ। আমাদের আলমগীরের সাথে তার যোগাযোগ ছিলো। আমাকে বলা হলো, একঘণ্টার মধ্যে তাকে ছেড়ে দিতে পারলে ভালো হয়। ও পরিষ্কার জানিয়ে দিয়েছে ঘণ্টাপ্রতি সাড়ে চার পাউন্ড তার পারিশ্রমিক দিতে হবে। ব্রিটেনের শ্রম আইনে এটাই সর্বনিু মজুরি।
বিশ্ববিদ্যালয়ের রিসেপশনে গিয়ে দেখি ইভা নামের এক মধ্য বয়স্কা ওখানে কাজ করছেন। তাকে বুঝিয়ে বলা হলো, তার ডেস্কে আমরা একজন অভিনেত্রীকে দিয়ে তার কাজটি করাবো। প্রায় বৃদ্ধা এই মহিলা এই আব্দার শুনে উৎফুল্ল হয়ে গেলেন। বলেন আমার চেহারা যদি আপনার অপছন্দ না হয়, তবে এই চরিত্রে আমি কি অভিনয় করতে পারি? অবশ্য যদি আমার অভিনয় আপনার পছন্দ হয়।
তাকে স্ক্রিপ্ট দেয়া হলো এবং তিনি দুবার পড়েই বলেন, কেউ আমাকে কিছু জিজ্ঞাস করলে আমি তো এই কথাই বলি। ব্যস! হয়ে গেলো। ইভা খুব যতেœর সাথে অভিনয় করে গেলেন। শেষ টেক ওকে হবার পর ইভা বলেন, ‘আমার মনে হয় আমার চেয়ে অধিক সুন্দরী কাউকে দিয়ে শটটা আপনাদের আবার করাতে হবে।’
বলি, না। আপনার অভিনয়ই সাবলীল হয়েছে।
দূরে মুখ ফুলিয়ে বসে আছে টিনা। তাকে তাৎক্ষণিকভাবে বলা হলো, আমাদের সিদ্ধান্তে সামান্য অদলবদল হয়েছে, তুমি অন্য একটা চরিত্র করবে।
অন্য চরিত্র? কেন? আমি কি ঐ বুড়ির চেয়ে সুন্দরী নই? আমাকে বাদ দেয়া হলো কেন?
বিকেল ছ’টায় টিনা আমাদের থেকে বিদায় নিয়ে চলে গেলো। বলি, তুমি ছয় ঘণ্টা আমাদের সময় দিয়েছো, তোমার ওয়েজেস নিয়ে যাও।
সে বলে, নিতাম ঠিকই, কিন্তু আমি তো কাজ করিনি। আবার আমার কাজ হলে ডাকবেন। আমি কিন্তু সাড়ে চার পাউন্ড এন আওয়ার রেটের কমে কাজ করবো না।
পরদিন একটা দৃশ্যে অভিনয়ের জন্যে একজন ব্রিটিশ মহিলার দরকার হলো। কিন্তু সে সময় টিনাকে পাওয়া গেলো না।
কিন্তু উটকো ঝামেলা বাঁধিয়ে দিলো অ্যান্ড্রু আর পিটার। তারা দুই বন্ধু। ক্লাস থ্রিতে একই সাথে পড়ে। দুটো একই বয়সি। অ্যান্ড্রু বেশ মোটাসোটা, পিটার চিকনা চাকনা। দুজন অনেকক্ষণ ধরে শ্যুটিং দেখছিলো সিটি সেন্টারের সামনের জায়গাটায়। অ্যান্ড্রু এসে আমাকে বলে, তুমি কি এটার পরিচালক?
বলি, হ্যাঁ।
অ্যান্ড্রু বলে, আমি কিন্তু স্কুলে ড্রামা করেছি। আমাকে অভিনয় করতে দিতে হবে। আমি অভিনয় করবো।
বলি, তোমার মতো কোনো চরিত্র নাই।
সে বলে, তুমি ডিরেক্টর, তুমি চাইলেই আমাকে ঢুকিয়ে দিতে পারো, তবে ডায়ালগ থাকতে হবে।
তাদেরকে অপেক্ষা করতে বলি। এর মধ্যে শুরু হয়েছে মাহফুজ আর ফারিয়ার দৃশ্য। মাহফুজকে একটা কলম উপহার দিয়ে দেয় ফারিয়া। ফারিয়া তাকিয়ে দেখে। মন খারাপ। এ দৃশ্য দেখবে ঐ বাচ্চা ছেলেটা। কাছে এসে বলবে, ‘ইজ হি ইয়োর বয়ফ্রেন্ড?’
ফারিয়া বলবে, ‘আই এম নট শিওর ইয়েট।’
ছেলেটি বলবে, ‘ডোন্ট ওরি, হি উইল কামব্যাক।’
এটুকু বলেই ছেলেটা চলে যাবে।
এ দৃশ্যের কাজ শেষ। পিটারকে ধন্যবাদ দিলাম। এখন শুরু করবো আরেক দৃশ্য। কিন্তু অ্যান্ড্রু সরে না। পিটারের সংলাপ আছে, অ্যান্ড্রুর সংলাপওয়ালা আরেকটা দৃশ্য লাগবেই। সে আমার পাশে ঘুরঘুর করছে। বারবার তার স্ক্রিপ্ট চাইছে, তার কাপড় কী হবে, জ্যাকেট থাকবে না গেঞ্জি, হাতে ঘড়ি রাখবে কিনা, লাল রঙের জ্যাকেট থাকবে নাকি অন্য কোনো কালারের কাপড় পরবে, এসব।
দৃশ্যটা সাজানো হলো এরকম। মাহফুজ একটা পারফিউমের প্যাকেট নিয়ে মাঠে বসে বই পড়ছে। অ্যান্ড্রু পাশ দিয়ে হেঁটে যাচ্ছিলো, তাকে দেখে একটু থামে।
অ্যান্ড্রু : ক্যান আই সিট হেয়ার?
মাহফুজ : শিওর!
অ্যান্ড্রু : হোয়ার ইউ ফ্রম? ইন্ডিয়া?
মাহফুজ : নো।
অ্যান্ড্রু : শ্রীলঙ্কা?
মাহফুজ : নো।
অ্যান্ড্রু : বাংলাদেশ?
মাহফুজ : ইয়া।
অ্যান্ড্রু : হোয়াট ইউ ডুয়িং হেয়ার?
মাহফুজ : আই এম এ পিএইচডি স্টুডেন্ট, নর্থামব্র্রিয়া ইউনিভার্সিটি
অ্যান্ড্রু : হোয়াটস ইয়োর সাবজেক্ট?
মাহফুজ : আরবান প্ল্যানিং। আই উইলবি এ ট্রান্সপোর্টেশন প্ল্যানার।
অ্যান্ড্রু : হোয়াটস ইয়োর রিসার্চ?
মাহফুজ : আই এম ট্রাইং টু সলভ ঢাকা’জ ট্রান্সপোর্টেশন প্রবলেম।
অ্যান্ড্রু : উইল ইউ স্টে হেয়ার অর গো ব্যাক হোম?
মাহফুজ : ইফ আই গেট এ বেটার চান্স, আই উইল স্টে।
অ্যান্ড্রু : ইয়োর রিসার্চ ইজ টু ডেভেলভ দ্যা ট্রাফিক প্রবলেম ইন ঢাকা, হোয়াই ডু ইয়ো স্টে হেয়ার?
মাহফুজ : উই হ্যাভ টু ডু মেনি থিংস ফর আওয়ার সারভাইভ্যাল।
এর মধ্যে ফারিয়া এসে পড়ে। অ্যান্ড্রু বিদায় নিয়ে চলে যাবে।
মাত্র কয়েকটা টেক-এ এ দৃশ্যটির শ্যুটিং ওকে হয়ে যায়। অ্যান্ড্রু আমাদের সবাইকে অভিভূত করে হ্যান্ডশেক করে চলে যায়। যেতে না যেতে মাহফুজ বলে, ভাই, অ্যান্ড্রু আমার ঘাম বের করে দিয়েছে। ইউনিটের লোকজন থ’ হয়ে গেলো অ্যান্ড্রুর অভিনয় দেখে। মাহফুজ বলে, ওকে পঞ্চাশ পাউন্ড রিম্যুনারেশন দেয়া উচিত। ভাবলাম তাকে চকোলেট খাওয়ার জন্য ক’টা পাউন্ড দেয়ার ব্যবস্থা করি। কিন্তু ততক্ষণে অ্যান্ড্রু আর পিটার হাওয়া হয়ে গেলো। কোথায় গেলো তাদের আর দেখা গেলো না।
বিদেশি শিল্পী নিয়ে চরম বিপদে পড়েছিলাম এক রাতে। আমার চিত্রনাট্যে ক’জন সাদা বর্ণবাদীর প্রয়োজন ছিলো, যারা মাহফুজকে আক্রমণ করবে এবং নানারকম গালি দেবে। যে কোনো সাদাকে দিয়েই তা অভিনয় করানো যেতো। কিন্তু এক রাতে আলমগীর ৪ জন যুবা-কিশোর নিয়ে এলো। এদের বয়স ১২-২০ হবে। বললো, এরা হচ্ছে অরিজিনাল ‘কাছরা’। এদের কাজ হচ্ছে গলির চিপায় দাঁড়িয়ে মদ খাওয়া আর কাউকে পেলে তাদের কাছ থেকে টাকাপয়সা নেয়া। এরা সব জেল খেটেছে। ক্রিমিনাল হিসেবে পুলিশের খাতায় তাদের নামও লেখা। পিচ্চি ছেলেটাকে দেখে বলি, ওকে দিয়ে হবে না, ও আবার মাহফুজকে কী এটাক করবে? আমাকে বলা হলো, ক্রিমিনালরা দলে একটা আন্ডার এজড ছেলে রাখে এবং ওকে দিয়ে আসল ক্রাইমটা করায়। ধরা পড়লে বিচারে ওর সাজা হবে সবচে কম। ওর জেলও হবে না, ওকে দেয়া হবে কিশোর সংশোধনী কেন্দ্রে।
আলমগীর আমাকে তাড়া দিচ্ছে। ওদেরকে নিয়ে আসার ৩০ মিনিট হয়ে গেছে, আর ৩০ মিনিটের মধ্যে ওদের বিদায় করতে পারলে ৪ জন ২০ পাউন্ডের বিনিময়ে রফা হবে, না হলে ঘণ্টা প্রতি আরো ২০ পাউন্ড দিতে হবে ৪ জনকে। যা হোক, ওদের নিয়ে শ্যুটিং করাটা ছিলো আমাদের সবচে বিপজ্জনক অধ্যায়।
দৃশ্যটা এরকমÑ মাহফুজ কাজ শেষে হেঁটে হেঁটে ঘরে ফিরছে। এমন সময় চারজনের দল তাকে আক্রমণ করবে। প্রথমে সিগারেট চাইবে, পরে টাকা এবং না পেয়ে তার গায়ে মদ ঢেলে দেবে এবং কিল-ঘুষি দেবে।
৪ মাস্তান ভাইকে আমার বোঝাতে খুব কষ্ট হয়েছে। কারণ, ওদের ইংরেজির অর্ধেকও বুঝি না। ওরা সিগারেটকে বলে ‘টাব’, মানিকে ‘মনি’, বাসকে ‘বুস।’ আরো অনেক আঞ্চলিক শব্দও উচ্চারণ করে।
পুরো দৃশ্য এক টেকেই নিতে হবে। কারণ মারামারি দৃশ্যটি যদি কোনো পুলিশের নজরে পড়ে যায়, তা হলে আমরা নির্ঘাত ফেঁসে যাবো। এটা যে কেবল অভিনয়, এটা বোঝাতে অনেক বেগ পেতে হবে।
মিশুক ভাই এ রাস্তার আলোর সাথে একটি মাত্র গাড়ির হেড লাইটের আলোয় এ দৃশ্য চিত্রায়ণের ব্যবস্থা করলেন। প্রথম অংশে ছিলো ছোট মাস্তান সিগারেট চাইবে, পাশ থেকে বড় মাস্তান এসে মাহফুজের গায়ে ঘুষি লাগাবে। তাতে তার চশমা পড়ে যাবে। বড় মাস্তান বেশ ভারি একটা ঘুষি দিয়ে বসলো মাহফুজের চোয়ালে। মাহফুজ ঘুরে ঘুরে পড়ে গেলো। এমন ঘুষির প্রত্যাশা ছিলো না মিশুক ভাইয়ের। দৃশ্যটি ধরা গেলো না। দ্বিতীয়বার হালকা ঘুষি দেয়ার রিস্ক নিলাম না। বললাম বিয়ারের বোতল থেকে বিয়ার ছুড়ে ওর জামা ভিজিয়ে দিতে হবে। বিয়ারের বোতলে পানি ঢুকানো হলো। ওদের বড় মাস্তানটা প্রথমেই বিয়ারের বোতল ছুড়ে মারলো মাহফুজের মাথা বরাবর। হায় হায়! একী! কথা তো ছিলো বিয়ার ছুড়বে, বোতল তো বলা হয়নি? মাহফুজ যদি সাথে সাথে মাথাটি না সরাতো, তবে সেদিন অন্য ঘটনা ঘটে যেতো। মাস্তান ভাইদের একঘণ্টার মজুরি ২০ পাউন্ড এবং টিপস হিসেবে এক বোতল মদ কিনে দিয়ে তাড়াতাড়ি বিদায় করা হলো।
মাহফুজের সহ-অভিনেতা অভিনেত্রী হিসেবে বাকি যারা কাজ করেছে তাদের মধ্যে ফারিয়া ছাড়া আর কেউ আগে অভিনয় করেনি। লন্ডন থেকে রহিমা আর রানীকে নেয়া হয়েছিলো ছোট চরিত্রে অভিনয় করার জন্য, সেখান থেকে তাদের চরিত্র বেড়ে অনেক বড় হয়ে যায়। শ্রাবন্তীর চরিত্র থাকে না, তার বদলে অন্য একটা চরিত্র আসে, সেটাতে অভিনয় করে রহিমা। এক সময় নিউ ক্যাসলে বেশ অসহায় হয়ে পড়ে। এরকম একটা বিরূপ পরিস্থিতিতে আমার দু-একজন বন্ধুকে ঢাকায় এসএমএস-এ টেক্সট পাঠাইÑ ‘নো সান, নো লাইট, নো হিরোইন, নো এসিস্ট্যান্ট, নো মেকআপম্যান, নো লাইটম্যান, নো প্রডাকশন বয়, নো বুম ম্যান, নো স্ক্রিপ্ট। অনলি মিশুক মুনীর অ্যান্ড মাহফুজ উইথ লোনলি শাকুর মজিদ।
শ্যুটিং চলে ঢিমেতালে। আমরা ফাঁকে ফাঁকে শহর দেখার জন্য বেরিয়ে পড়ি।