করোনাকাল
বিচ্ছিন্ন অনুভব
মাহফুজা হিলালী

প্রবন্ধ
অধ্যাপক আনিসুজ্জামান
শামসুজ্জামান খান

গল্প
ডায়মন্ড লেডি ও পাথর মানব
হামিদ কায়সার

গদ্য
নিদ্রা হরণ করেছিল যে বই
মিনার মনসুর

নিবন্ধ
পঞ্চকবির আসর
সায়কা শর্মিন

বিশ্বসাহিত্য
আইজাক আসিমভের সায়েন্স ফিকশন
অনুবাদ: সোহরাব সুমন

বিশেষ রচনা
প্রথম মহাকাব্যনায়ক গিলগামেশ
কামাল রাহমান

শ্রদ্ধাঞ্জলি
মুজিব জন্মশতবর্ষ
মারুফ রায়হান
 
সাক্ষাৎকার
কথাশিল্পী শওকত আলী

জীবনকথা
রাকীব হাসান

ভ্রমণ
ইম্ফলের দিনরাত্রি
হামিদ কায়সার

ইশতিয়াক আলম
শার্লক হোমস মিউজিয়াম

নিউইর্কের দিনলিপি
আহমাদ মাযহার

শিল্পকলা
রঙের সংগীত, মোমোর মাতিস
ইফতেখারুল ইসলাম

বইমেলার কড়চা
কামরুল হাসান

নাজিম হিকমাতের কবিতা
ভাবানুবাদ: খন্দকার ওমর আনোয়ার

উপন্যাস
আলথুসার
মাসরুর আরেফিন

এবং
কবিতা: করেনাদিনের চরণ

১৭ বর্ষ ০৩ সংখ্যা
অক্টোবর ২০২৪

লেখক-সংবাদ :





এক সদ্যজাত শিশুর আত্মকাহিনি
মোজাফ্ফর হোসেন
হাড়কাঁপানো শীত যেদিন গ্রামের মধ্যখানে এসে পৌঁছালো ঠিক তার আগের দিনের ¤্রয়িমাণ এক সন্ধ্যায় ঠিক করা হলো পৃথিবী আসার সময়। আমি তখন মর্ত্য,ে স্বর্গশিশুদের ছেড়ে বসে আছি নিজের জন্মক্ষণ সামনে পেতে।
আর পাঁচটা দিনের সঙ্গে আলাদা করার মতো তেমন কিছুই ঘটেনি। ঘরের পেছন দিয়ে- মাছ নেবে গো মাছ, রুই-কাতলা-ময়া মাছ- হেঁকে যায় মাছবিক্রেতা জুমাত। ঘুরে যায় বরফ বিক্রেতা আলা, তার ফাটা মাইকে তখন আরব দেশের সভা। মুহূর্তেই ক্যাসেট বদলে বেজে ওঠে-‘প্রিয়া তু আব তো আজা’। ছিট-কাপড় বিক্রেতা সামাদ সাইকেলের পড়ে যাওয়া চেনটা তুলে জোরে জোরে প্যাডেল ঘুরিয়ে পরখ করে নেয় ঠিক হয়েছে কিনা, শব্দ হয় চাকা ঘুরানোর- ঘ্যাঁচ ঘ্যাঁচ। বহুদিন তেল পড়েনি বিয়ারিংয়ের বলে। হাড়িকুড়িওয়ালা হাঁক দেয় ছন্দ টেনে- নগদ বা ভাঙাচুরা দি’ নি’ যান বাটি-গামলা, হাড়ি-কুড়ি! ভরাট কণ্ঠে কানে আসে- আসিতেছে! আসিতেছে! চন্দ্রিমা সিনেমায় এই শুক্রবারে, এক টিকিটে দুটি ফাটাফাটি সিনেমা! কুংফু অ্যাকশনে ভরপুর জাপানি সিনেমার সাথে কোরিয়ান গরম-মাসাল্লা, এই শীতে গা গরম করতে, আসিতেছে! আসিতেছে!
কুকুরগুলো ডেকে ওঠে, মেতে ওঠে আগের দিনের অসমাপ্ত ঘেউ ঘেউ ঝগড়ায়। একটা হাড়িচাটা কয়েকবার ডেকে কারো কোনো দৃষ্টি আকর্ষণ করতে না পেরে ফিরে যায় অন্যপাড়ায়। মোরগটা এই অসময় ডেকে ওঠে একেবারে দরজার গোঁড়ায়। আমি যেখানে বসা কিংবা দাঁড়িয়ে ঠিক সেখানে। আমার অস্তিত্ব ওর টের পাওয়ার কথা নয় তখনো। বাবা- অল্পক্ষণ বাদেই যিনি আমার বাবা হবেন- স্যান্ডেল ছুড়ে মারেন উঠানের কোণের পেয়ারা গাছে গা ডলতে থাকা ছাগলটাকে তাক করে। ছাগলটা হতভম্ব হয়ে এদিকওদিক তাকায়, লক্ষবস্তু যে সে, সেটা আন্দাজ করতে না পেরে ভ্যা ভ্যা করে ডেকে ওঠে জিজ্ঞাসু দৃষ্টিতে। চালের ওপর একটা প্রতিবেশী পাইরীর লেজে লেজে প্রেম নিবেদনে ব্যস্ত থাকা পায়রাটা ব্যর্থ হয়ে উড়ে যায় অন্য চালে- পতপত শব্দ হয়। এই প্রথম কোনো শব্দ ভালো লাগে আমার। কে যেন ওদিকে চিল্লিয়ে ওঠে রান্নাঘর থেকে- গলায় ভাত বেঁধি গেল, পানি দে...রে...এ! টিউবওয়েল চাপার শব্দ হয় তৎক্ষণাৎ- ঘ্যাঁচঘ্যাঁচ! উঠানে গোলাঘরের নিচে ফিড়ি পেতে বসা এক-বৃদ্ধা বিরতিহীন কেশে যান। মুখে কফ এলে কিছুক্ষণ চিবিয়ে আবার গিলে ফেলেন কি যেন কি মায়ায়! কিছুক্ষণ পরেই এই বিশ্রি স্বভাবের খটমটে বুড়ি আমার দাদি হবেন ভেবে অরুচি আসে পৃথিবীর প্রতি।
বাইরে যখন এত শব্দে উচাটন প্রকৃতি তখন ঘরের ভেতর প্রসব যন্ত্রণায় কাতর কোনো নারীর মৃদুশব্দ কারো কানে আসার কথা নয়। বাড়ির কিছু মানুষ জানে ভেতরে কি ঘটছে, কিছু মানুষ তাও জানে না। এখনো কেউ না আমি এ-বাড়ির, তবুও আমাকে জানতে হয়েছে। কেননা আমার জন্ম হচ্ছে সেটি না জানলে অন্যকেউ ঢুকে পড়বে আমার অস্তিত্বে। স্বর্গে পৃথিবীর কয়েকগুণ শিশু অপেক্ষা করছে। কেউ কেউ তো সিরিয়াল নম্বর না পেয়ে মৃত শিশুদের সঙ্গে মিশে গেছে জন্মস্বাদ না নিয়েই। স্বর্গের মৃতদের কোনো পুনরুত্থান-বিধি নেই।
এ বাড়িতে জন্ম হওয়া মাঝে মধ্যে গঞ্জের হাট থেকে বিলাতি ওল কিংবা কলার মোচা কিনে আনার মতো খুব সাদামাটা একটা ঘটনা। বাড়ির ১৩তম সন্তানের জন্ম হচ্ছে। ১১জন বেঁচে আছে, একজন জন্মের পরপরই পৃথিবী ভালো লাগেনি বলে ফিরে গেছে। তার ফিরে যাওয়া নিয়ে কারো কোনো আক্ষেপ জাগেনি মনে। একমাত্র মা মানুষটি তার ১১জন সন্তানের মুখের ভেতর সেই চলে যাওয়া এক সন্তানের ছবি খোঁজেন। আজও।
ঘরের দরজাটা ভেড়ানো। হাওয়ার শরীর আমার, আমি চাইলেই ফাঁকগলিয়ে ভেতরে ঢুকে যেতে পারি। কিন্তু যাওয়াটা ঠিক হবে কিনা ভেবে পাচ্ছি না। নিজের জন্মদৃশ্য দেখা বাড়াবাড়ি হয়ে যেতে পারে। পৃথিবীতে একমাত্র আমিই নিজের জন্মক্ষণ দেখার জন্য অপেক্ষায় আছি- এমন ভাবার সুযোগ নেই। সব শিশুই এভাবে অপেক্ষা করে। এরপর জন্মক্ষণে স্মৃতিনাশ নদীতে চুবিয়ে স্মৃতিশূন্য করা হয়। আমাকে যখন ডোবানো হয় সেই লিথের রংশূন্য জলে, তখন আমি জীবন-মৃতের মাঝে। বেঁচে আছি, আবার নেই। তাই আমার আর স্মৃতিভ্রষ্ট ঘটেনি। আমি জন্ম নিয়েছি জন্মপূর্ব স্মৃতি এঁটে।
এসব ভাবছি যখন, তখন গরম পানি নিয়ে আমার শরীরের ওপর দিয়ে এগিয়ে গেল মুশির মা। এতক্ষণ এই জিনিসটার কথা মনে ছিল না কারো। দরজাটা আলগা করতেই আবারো শব্দ, ভিড়িয়ে দেওয়ার সময়ও সেই একই শব্দ। শব্দটা হাওয়াই মিলে যাওয়া মাত্র ঘরের ভেতর থেকে চেঁচিয়ে উঠলো দাইমা কথিত বেঢপ শরীরের নারীটি- বিটা হয়চে রে মনুর! ছেলে যে হবে সেটি আমিই কেবল আগে থেকে জানতাম। তাই এই চিৎকারের ভেতর আবিষ্কারের স্মরটা ধরতে পেরে হাসি পেলো আমার। দাদি কষ্ট করে কাশি চেপে উত্তর দেন- ‘কত ছেলি চেইচি মাগির কাছে। একুন ঢঙ করচি! ও ছেলির মুক দেকবু না আমি।’ বাড়ির সকলে খানিকটা আগ্রহ নিয়ে শুনলো তারপর যে যার কাজে লেগে রইল। নিজের জন্মে পৃথিবীর এমন নিরুৎসাহ দেখে মনটা আমার বিষিয়ে উঠল। তবে কি চলে যাবো এবার? এই কারণেই কি ফিরে গিয়েছিল আমার আগেরজন? প্রশ্নটা একবার অবচেতনে অভিমানে ফুসে ওঠে।
‘বিটা বোধ হয় বাঁচে না রে, আওলাদ!’ এই প্রথম বাবাকে, ততক্ষণে আক্ষরিক অর্থেই আমার বাবা হয়ে গেছেন তিনি, উদ্দেশ্য করে কেউ কিছু বলল। বাবা গামছাটা গায়ে দিয়ে প্রতিক্রিয়াহীন দাঁড়িয়ে রইলেন কিছুক্ষণ। একবার ভেবেছিলেন আজান দেবেন। তারপর কি ভেবে যেন আজানটা না দিয়ে পুকুরের পথে পা বাড়ালেন। মা তখন কষ্ট করে কোনোমতে বললেন, ‘কেনে, কি হয়িচে চাচি?’ ছোট্ট জিজ্ঞাসা, পৃথিবীর সমস্ত উদ্বেগ মিশে তার সঙ্গে। আমার মায়া হলো। এই প্রথম খুব মায়া হলো আমার। পৃথিবীর মানুষের প্রতি সেই প্রথম আমার মায়া হওয়া।
‘বিটা কাঁদে না রে, মনু। কেমুন পাখির মতো ধড়। প্যাঙটা, ভিতরের সব দেকা যায় তো!’ বাইরে তখন গোলাঘরের টিনের চালে একটা নারিকেল খসে পড়ার বিকট শব্দ। বিশ্রি বিস্বাদ শব্দ। শব্দ শুরু হয়েছে ঘর অতঃপর বাড়ি জুড়েও। শিশুটি মৃত শুনে জেগে উঠেছে পুরো মহল্লাটাই। শব্দের ভেতর নীরব কেবল সদ্য জন্মানো আমি। তখনো ঠিক করে উঠতে পারিনি, চলে যাবো না থাকবো। আমি শব্দ করলেই আগ্রহ সবার ঘুচে যায়- খুশি হয় কেউ কেউ, কেউ মুখ যেমন গোমরা করে এসেছিল, তেমন গোমরা করেই ফিরে যায় সংসারে রোজকার ভূমিকাতে।
‘তিকার ভাইকে ডাকবু?’ একজন বলে। তিকার মাস্টার এ বাড়ির জামাই। পেশা পড়ানো, উপরি আয়ের জন্য করেন ডাক্তারি। আমি ফিরে না গেলে তাকে একদিন দুলাভাই বলে ডাকবো। তিনি হয়ত আজকে আমাকে বাঁচিয়ে তোলার গল্পটা সুযোগ পেলেই আমাকে শুনিয়ে সুবিধা বা কৃতজ্ঞতা আদায় করতে চাইবেন।   
‘এইজন্যি আগ-থেকি বুলিলাম ঝাড়-ফুঁক করাতি। আমার সন্দেহ হচ্ছিল! না হলি রোজ রোজ মগরেবের ওয়াক্তে বাড়ির পাশ দি’ কালো বিড়াল যাবে ক্যানে?’ অন্য একজন বলে। তাকে আমার চিনে রাখতে ইচ্ছে করে, কিন্তু ভিড়ের ভেতর আলাদা করা যায় না।
দাদি বাইরে থেকে কাশতে কাশতে বলেন, ‘ছেলিটাকে মেরি ফেললু মাগি! কি ফুটফুটে-চান্দের মতোন দেকনা হয়লো! এক্কেবারে আমার আওলাদ!’ আওলাদ আমার বাবার নাম, বাবা দূরে দাঁড়িয়ে ছিলেন, তার সঙ্গে নিজের চেহারাটা মিলিয়ে দেখার খুব ইচ্ছে হচ্ছিলো। বাবার গায়ের কালো রঙ, বেটে-শুকনো শরীর দেখে মনটা ফের ভেঙে পড়ল আমার। যদি সত্যি সত্যি বাবার মতো দেখতে হই তাহলে কি চলে যাওয়াটাই ভালো হয় না? জেনেশুনে এমন মাঝারি মানের শরীরে বাসা বাঁধা কি বুদ্ধিমানের পরিচয় হবে?  
বাড়িতে ততক্ষণে কান্নার রোল পড়েছে। আমার জন্ম-মৃত্যুতে যাদের কিছুই যায় আসে না, তারাও কাঁদছে ইনিয়ে বিনিয়ে। দরদ মিশিয়ে কাঁদছে আমার মেজোবোন- নিজের মৃতপ্রসূত সন্তানের কথা মনে পড়ে গেছে। ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে কাঁদছে একটা শিশু- ভিড়ের ভেতর মাকে হারিয়ে ফেলেছে। শিশুটিকে দেখে মায়া হলো আমার। ওর মাকে খুঁজে দিতে ইচ্ছে হলো। কিন্তু ওর মাকে আমি চিনি না। চিনে নিতে পারলেও ডেকে দেওয়া আমার তখন সম্ভব না। আমি সবার মাঝে থাকলেও শরীরটা আমার নিথর পড়ে দাইমার কোলে- একটা ছোট্ট কু-ুলির মতো জড়সড় হয়ে। অমন বেঢপ হাতে ওইটুকুন আমি, খুব মন খারাপ হওয়ার মতো দৃশ্য বটে! পাশে শুয়ে অসহায় শরীর নিয়ে কাতরাচ্ছেন মা। আমার মা। একমাত্র তিনিই জানেন আমি এখনো আছি এইখানে, আশেপাশে কোথাও- থাকা না-থাকা দ্বন্দ্বের মাঝে আটকে।
‘মুখে ফুঁ দে।’ কেউ একজন বলে।
‘বুকে আস্তে আস্তে চাপ দে।’ দাদির বয়সী অন্য একজন বলে।
‘হাসপাতাল নিলি হয় না?’ কেউ একজন জনতার মাঝে উদ্দেশ্যহীন প্রশ্নটা ছুড়ে মারে- কারো গায়ে লাগলে ভালো, না লাগলেও ক্ষতি নেই বিশেষ।
‘চিৎ করে ফেলে পিঠে থাবা দেন।’ কলেজপড়ুয়া অল্পবয়সী এক মেয়ে বলে।
‘মুখ হা করে ফু দিলে হয় না?’ কেউ একজন নিজেকেই নিজে জিজ্ঞেস করে।
‘ফিরে আয়, খোকা। যাসনে।’ মনে মনে নৈশব্দে কথাগুলো বলেন একজন। আমার মা। এই ক’টি অনুচ্চারিত শব্দে সব দ্বিধা কেটে যায় নিমিষেই।
আটচালা টিনের ঘর কেঁপে ওঠে আমার প্রথম কান্নায়।