‘মৃত্যুর আগে’ কবিতাটি সেইসব বিরল কবিতাগুলির একটি, যেখানে অবলীলায় ভেঙে পড়তে দেখি ইন্দ্রিয়বৃত্তির হায়ারার্কি, যেখানে চোখের সামনে খর্ব হতে দেখি চোখেরই আধিপত্য, যেখানে যুক্তি ও বুদ্ধির উপস্থিতিতেই ধীরে ধীরে নিঃসাড় হয়ে পড়তে দেখি যুক্তি ও বুদ্ধির শাসন-- যা আধুনিক (আধুনিকতাবাদী অর্থে) যে-কোনো কর্মে, যে-কোনো যজ্ঞে একপ্রকার দুর্লভই বলা চলে।
পশ্চিমের ‘এনলাইটেনমেন্ট’-এর এক অনিবার্য ফলাফল এই আধুনিকতা। আধুনিকতার রামরাজ্যে ইন্দ্রিয়নিচয়ের মধ্যে চোখ-ই হচ্ছে ব্রাহ্মণ ইন্দ্রিয় এবং বৃত্তিসমূহের মধ্যে বুদ্ধি-ই বৃত্তিশ্রেষ্ঠ-- যেখানে সকল কর্মে, সকল যজ্ঞে চাই চোখেরই পৌরহিত্য, চাই বুদ্ধি ও যুক্তির নিরঙ্কুশ মোড়লগিরি। আবার আমরা এও দেখেছি-- এই আধুনিকতার নামে, র্যাশনালিটির ‘রোশনাই’-এর দোহাই দিয়ে, বুদ্ধি ও যুক্তির চাবুকে প্রতিষ্ঠা করা হয়েছে উপনিবেশবাদের, বর্ণবাদের, উগ্র জাতীয়তাবাদের তাত্ত্বিক ও দার্শনিক ভিত্তি। কায়েম করা হয়েছে প্রকৃতিকে যথেচ্ছভাবে শোষণের মাধ্যমে গঠিতব্য নিরঙ্কুশ ভোগবাদী সমাজের তাত্ত্বিক ও দার্শনিক বুনিয়াদ।
বলা বাহুল্য, এই আধুনিকতার ক্ষেত্র ব্যাপক, বহুমুখী ও বর্ণাঢ্য। প্রভাব ও অভিঘাত দূরপ্রসারী এবং বিচিত্রচারী। এই আধুনিতারই একটি ক্ষেত্রের এক উজ্জ্বল ফসল ও ফলাফল হচ্ছেন কবি জীবনানন্দ, আবার একইসঙ্গে আধুনিকতার এক উজ্জ্বল শিকারও বটেন তিনি। এ এক অপরূপ কূটাভাস।
এখানে উল্লেখ প্রয়োজন, পশ্চিমের এই আধুনিকতা কিন্তু আমরা আমাদের স্বাভাবিক সমাজবিকাশের ধারায় পাইনি। পেয়েছি ঔপনিবেশিক সংস্কৃতির মধ্য দিয়ে। আমাদের সমাজবিকাশের সঙ্গে সঙ্গতিহীন অস্বাভাবিক, বেখাপ্পা এক আধুনিকতা। আমাদের সমাজকাঠামোর পক্ষে সহজ, স্বাভাবিক আধুনিকতা তখনই সম্ভব হবে, যখন পশ্চিমের মতো আমাদের সমাজও বিকাশের সেই বিশেষ বিশেষ কালপর্বের মধ্য দিয়ে পার হতে থাকবে। এ ছাড়া সম্ভব কি? আর উত্তর-আধুনিকতা, সে তো আরো পরের কথা।
উপনিবেশ-- সে তো উঠে গেছে অনেকদিন আগে। তবু সেই ঔপনিবেশিক আধুনিকতার কুহক ও কুয়াশায় আমাদের, বিশেষ করে শিক্ষিত মধ্যবিত্তশ্রেণির দৃষ্টি, মনন, সৌন্দর্য- ও রুচিবোধ আছন্ন হয়ে আছে আজও। কারণ প্রত্যক্ষ উপনিবেশ উঠে গেছে হয়তো, কিন্তু রয়েছে ছদ্ম-উপনিবেশ; সমাজ-উপনিবেশ হয়তো গেছে, কিন্তু থেকে গেছে মনো-উপনিবেশ। আছে নব্য উপনিবেশের নিত্যনতুন জটিল, সফিস্টিকেটেড নকশা ও বাহানা।
সম্ভবত সে-কারণেই, পশ্চিমে বিশেষ বিশেষ কালখণ্ডে, বিশেষ বিশেষ পরিবেশ-পরিস্থিতিতে সমাজ-সম্পর্কের বিশেষ বিশেষ উত্থানপতন ও টানাপড়েনের ফলশ্রুতিতে যে-সব দর্শন ও মূল্যবোধের উদ্ভব হয়েছে অথচ যেগুলির অনুকূল আবহাওয়া ও জমিন আমাদের এখানে নেই বা তৈরি হয়নি, সেসবের প্রতিফলন (নাকি প্রাদুর্ভাব!) যেখানেই আমরা দেখি-না কেন, ঔপনিবেশিকতার আছর-লাগা দৃষ্টিদোষে সেগুলিকেই মনে হয় আন্তর্জাতিক, মনে হয় বিশ্বজনীন, অতএব মহৎ। যেন পশ্চিমজাতিক মানেই আন্তর্জাতিক, পশ্চিমজনীন মানেই বিশ্বজনীন, সর্বজনীন।
একথা অন্যান্য আধুনিকদের মতো জীবনানন্দের কবিতাবিচারের বেলায়ও খাটে। তাঁর যেসব সৃজনকর্মে পশ্চিমা আধুনিকতার সেই নেতি, নির্বেদ, বিচ্ছিন্নতাবোধ, অনিকেতবোধ, অস্তিত্বসংকটবোধ... ইত্যাদির প্রতিফলন দেখতে পাই সেগুলিকেই অধিকতর গুরুত্বপূর্ণ কাজ, বিশ্বমানের কাজ বলে ভ্রম হয়। পক্ষান্তরে তিনি সৃজন করেছেন "রূপসী বাংলা"র মতো কাব্যগ্রন্থের আশ্চর্য কবিতাগুলিসহ আরো অনেক কবিতা যেখানে কবি তার সমস্ত মন প্রাণ আত্মা ইন্দ্রিয় দিয়ে রূপগন্ধময় বর্ণাঢ্য এক নিসর্গকে, অনুভূতির এক অনাবিষ্কৃত মহাদেশকে আবিষ্কার, উদ্ধার ও পুনর্নিমাণ করে রেখে গেছেন আমাদের জন্য।
উঁচুমাপের ওইসব সৃষ্টিকমেূর জন্য আমরা, আধুনিকেরা, ধার্য করে থাকি একধরনের ঊনমূল্য। এবং অনেক অনেক সময়ই ভুল জমিতে দাঁড় করিয়ে, ভুল মাপকাঠিতে, ভুলভাবে বিচার হয় জীবনানন্দের। আধুনিকতাবাদের অ-মহৎ বিচারে এই মর্মে রায় ঘোষিত হয় যে, জীবনানন্দ মহৎ। জীবনানন্দের সৃষ্টিকর্ম নিঃসন্দেহে মহৎ, তবে তা ভিন্ন মানদণ্ডে। বস্তুত আধুনিকতার খণ্ডিত ও টাইপড সব মানদণ্ড জীবনানন্দের কৃতিত্ব ও মহত্ত্বের বহুমাত্রিকতা বিচারের পক্ষে অপ্রতুল।
অনেক সূক্ষ্ম সূক্ষ্ম অনুভূতি, নানা ইন্দ্রিয়-অভিজ্ঞতা যেন ভাষায় মূর্ত হয়ে আছে তাঁর "রূপসী বাংলা"র কবিতাগুলিতে। এবং কে না জানে, অনুভূতির ভাষাই শাশ্বত, সর্বজনীন। বুদ্ধি ও যুক্তির ভাষা যেখানে গিয়ে হয়ে পড়ে অকার্যকর, সেখান থেকে শুরু হয় অনুভূতির ক্রিয়া; শুরু হয় লীলা, অনুভূতি আর অনুভূতিময় ভাষার। আমরা হয়তো এটুকুই দেখি-- এক প্রাদেশিক নিসর্গের রূপ ও ছবি চিত্রিত হয়ে আছে কবিতাগুলিতে। কিন্তু বাংলার ওইসব রূপছবিকে ছাপিয়ে সূক্ষ্ম ও বিচিত্র অনুভূতিমালার যে শাশ্বত বিশ্বজনীন ছবি আঁকা হয়ে আছে কবিতাগুলিতে, তা অনেকসময় নজরে আসে না। প্রাদেশিকতার ভেতর দিয়ে কবিতাগুলি অলক্ষ্যেই উত্তীর্ণ হয়ে যায় আন্তর্জাতিকতায়-- খেয়াল হয় না।
২.
‘মৃত্যুর আগে’ কথাটির অর্থ কী? মৃত্যুর আগে কী? মৃত্যুর আগে তো জীবন। কবিতাটিতে উছলে পড়ছে জীবনের আনন্দ, জীবনেরই সৌরভ। জীবনের এই যে আনন্দ, যাকে বলি জীবনানন্দ, সে তো চিরকালই মৃত্যুর আগে। জীবনের যা কিছু আনন্দ তা হচ্ছে মৃত্যুর আগে, আগ-পর্যন্ত, এবং মৃত্যুর স্পর্শাতীত। এবং ‘মৃত্যুর আগে’ নামধেয় এই জীবনবাচক কবিতাটিতে আমরা দেখতে পাই প্রকৃতির ওপর জীবনের নানা অভিক্ষেপের চিহ্ন; জীবনেরই বহুবর্ণ আলোছায়ার সম্পাত। যেন প্রকৃতির ওপরে শ্রবণ, দর্শন, স্পর্শ, আঘ্রাণ, আস্বাদ... সবগুলি ইন্দ্রিয় দিয়ে চারদিক থেকে একযোগে আলোছায়াসম্পাত। সে আলোছায়া মৃদু-মৃদু, কিন্তু অব্যর্থ, মর্মভেদী। সে-আলোছায়া সান্ধ্য, সলজ্জ, কিন্তু বর্ণাঢ্য। সে-আলোছায়া গোধূলিমদির, ইমপ্রেশনিস্টিক, কিন্তু বৈচিত্র্যময়। ইন্দ্রিয়সমূহের মিলনের, মিথস্ক্রিয়ার যেন এক জমজমাট মহোৎসব।
প্রত্যেক ইন্দ্রিয়েরই আছে ভিন্ন্ ভিন্ন করণকৌশল, আছে ভিন্ন ভিন্ন মিথ ও রূপকথা। কিন্তু এখানে, অন্তত এই কবিতায়, তাদের সেই করণকৌশলগুলিতে, নিজস্ব মিথগুলিতে সৃষ্টি হয়েছে স্পষ্ট টানাপড়েন। ভেঙে পড়েছে তাদের অনন্যতা। ইন্দ্রিয়গুলি যেন পরস্পর বদলে নিচ্ছে তাদের কৃতি ও কৌশল। যেন বোদলেয়ারের “ঈড়ৎৎবংঢ়ড়হফবহপব” কবিতার সেই নির্যাস-পঙক্তি “সেইমতো বর্ণ গন্ধ পরস্পরে জানায় উত্তর”(অনুবাদ বুদ্ধদেব বসু) এর উদ্ভাস; কিংবা বলা চলে “প্রতিষঙ্গ” অলংকারের বর্ণাঢ্য সমাবেশ।
পুরনো পেঁচা থেকে ভেসে আসে ঘ্রাণ। যেন পেঁচার প্রাগৈতিহাসিক অবয়ব আর আধিভৌতিক ঘুৎকার থেকে ভেসে-আসা এক ধরনের কিম্ভূত-প্রাচীন ঘ্রাণ।
চা’লের গন্ধ। অনুভূত হচ্ছে সেই গন্ধেরও রং। কিংবা রঙের মাধ্যমেই যেন অনুভূত হচ্ছে চা’লের গন্ধ। চা’লের মর্মমূল থেকে উঠে-আসা, তার ধূসর রূপ ছুঁয়ে-ছেনে উঠে-আসা এক ধূসর-রঙা গন্ধ।
তরঙ্গ হচ্ছে জলেরই এক মূর্ত চঞ্চল ভঙ্গি। আর সেই মূর্ত তরঙ্গেরা নাকি বিমূর্ত ‘রূপ’ হয়ে ঝরছে নির্জন মাছের চোখে, চা’লের ওই ধূসর গন্ধের ছোঁয়া লেগে।
সন্ধ্যার অন্ধকারের ভেতর যেন রয়েছে ঘুমের এক রাজ্য। ঘ্রাণ ভেসে আসে সেখান থেকেও। ঘুমের ঘ্রাণ। সেই ঘ্রাণ পুকুরপাড়ের এক হাঁসের নাকে এসে লাগে একসময় আর তার ঘুম পেয়ে যায়।
বৈশাখে মাঠের পর মাঠ অবারিত সবুজ। সেই ধারাবাহিক সবুজতা ছুঁয়ে ছুঁয়ে বইতে থাকে বাতাস। বয়ে আসতে আসতে সেই বাতাস নিজেই হয়ে যায় সবুজ। বৈশাখের বাতাস তাই সবুজ হয়ে বয়, আর তার স্পর্শও যেন সবুজবর্ণ। আর সে-বাতাসে ঝিঁঝিঁর শব্দ নয়, পাওয়া যাচ্ছে তার গন্ধ, যেন একপ্রকার ঝিঁঝিঁ-ধ্বনিময় গন্ধ।
আবার ‘নরম জলের গন্ধ দিয়ে নদী বারবার তার তীরটিরে মাখে’। এই জল যেন ঠিক তরল নয়, বরং নরম। আর নদী সেই নরম জল দিয়ে নয়, জলের গন্ধ দিয়ে বারবার তার তীরটিকে মাখছে। দুগ্ধনদীর দুধের ঘ্রাণের মতো, ক্ষীরনদীর ক্ষীরের ঘ্রাণের মতো নরম জলের নদী থেকে যেন উত্থিত হয় একপ্রকার ঘ্রাণ, যা হয়তো কেবল কিনার ধরে পা ভিজিয়ে ভিজিয়ে নিঃশব্দে হেঁটে-চলা নিশি-পাওয়া মানুষই টের পায়।
অর্থাৎ আমরা দেখতে পাচ্ছি--
‘চা’লের ধূসর গন্ধ...’। গন্ধ জানাচ্ছে বর্ণের মাধ্যমে উত্তর। কিংবা অন্যভাবে বলা যায়, ঘ্রাণেন্দ্রিয়ের কাজ সাধিত হচ্ছে দর্শনেন্দ্রিয় দিয়ে। চোখ দেখতে পাচ্ছে গন্ধের রং।
‘বাতাসে ঝিঁঝিঁর গন্ধ...’। ধ্বনি সাড়া দিচ্ছে গন্ধের মাধ্যমে। শ্রবণেন্দ্রিয়ের কাজ সম্পন্ন হচ্ছে ঘ্রাণেন্দ্রিয়ের মাধ্যমে। কারণ ঝিঁঝিঁ পোকার উপস্থিতি টের পাই সাধারণত তার ঝিঁ-ঝিঁ ধ্বনি শ্রবণের মাধ্যমে, কিন্তু এখানে শ্রবণ নয়, আমরা তা টের পাচ্ছি সেই ধ্বনি থেকে উঠে-আসা গন্ধ আঘ্রাণ ক’রে। নাসিকা পাচ্ছে ধ্বনির ঘ্রাণ।
‘বৈশাখের প্রান্তরের সবুজ বাতাস...’। এখানে স্পর্শ জানাচ্ছে বর্ণের মাধ্যমে উত্তর। স্পর্শেন্দ্রিয়ের কাজ সম্পাদিত হচ্ছে দর্শনেন্দ্রিয় দিয়ে। বাতাসকে আমরা অনুভব করি ত্বকের সাহায্যে, কিন্তু এখানে তা হচ্ছে চোখের মাধ্যমে। চোখ দেখছে বাতাসের রং।
‘তরঙ্গেরা রূপ হয়ে ঝরেছে দু-বেলা নির্জন মাছের চোখে’। মূর্ত সাড়া দিচ্ছে গন্ধের মাধ্যমে।
‘পুকুরের পাড়ে হাঁস সন্ধ্যার আঁধারে পেয়েছে ঘুমের ঘ্রাণ।’ বিমূর্ত জানাচ্ছে গন্ধের মাধ্যমে উত্তর।
আরও আছে নানা রূপক ও ইন্দ্রিয়ানুভূতির ছবি:
‘দিগন্তের নম্র নীল জ্যোৎস্না...’, ‘... নরম নদীর নারী ছড়াতেছে ফুল কুয়াশার’।
বিচিত্র স্পর্শানুভূতির ছবি:
‘আমরা রেখেছি যারা ভালবেসে ধানের গুচ্ছের পরে হাত’
‘ইঁদুর শীতের রাতে রেশমের মতো রোমে মাখিয়াছে খুদ’
‘বেতের লতার নিচে চড়ুইয়ের ডিম যেন শক্ত হয়ে আছে’।
পুরো কবিতাটি যেন ধ্বনি-ঘ্রাণ-বর্ণ-স্পর্শজড়ানো, কুহক-ছড়ানো এক রূপময় ল্যান্ডস্কেপ, যেখানে সুপুরির সারি বেয়ে সন্ধ্যা আসে রোজ, আর প্রতিদিন ভোর আসে ধানের গুচ্ছের মতো সবুজ সহজ হয়ে। যেখানে শস্যহীন মাঠের শিয়রে চাঁদ এসে চুপচাপ দাঁড়িয়ে থাকে, আর সে-চাঁদের সাধ নেই আর ফসলের জন্য। যেখানে শীতের রাত অপরূপ। শিশির আর কুয়াশা দিয়ে নয়, মাঠে মাঠে ডানা ভাসাবার গভীর আহ্লাদ দিয়ে ভরা সেই রাত। সেখানে হিজলের জানালায় আলো আর বুলবুলি একসঙ্গে খেলা করে। সেখানে নীলাভ নোনাফলের বুকে যে ঘন রস জমে তা যেন জমে কোনো এক গাঢ় আকাঙক্ষার আবেশে।
৩.
আরও নানা রকমের চিত্র। এই চিত্র শুধু যে দৃশ্যের তা নয়, এই চিত্র স্পর্শের, ঘ্রাণের, স্বাদের, ধ্বনির এবং অনুভূতির। এই চিত্র শান্ততার, এই চিত্র প্রশান্তির। এবং এই প্রশান্তি, এই শান্ততা যেন সান্ধ্যকালীন। কবিতাটির আবহাওয়া অনেকটা কুয়াশাচ্ছন্ন, পরিবেশটা অনেকটা মেদুর আর সময়টা যেন পূর্বাপর সন্ধ্যাকাল। এবং এখানেই কবিতাটি দাবি করছে অন্য আরেক দিক থেকে আলোকিত হবার।
এই মেদুর সন্ধ্যা কি শেষপর্যন্ত জীবনসন্ধ্যা? ‘মৃত্যুর আগে’ বলতে কি মৃত্যুর ঠিক অব্যবহিত আগে? মৃত্যুর ঠিক আগে, প্রাণবায়ু মোচনের অব্যবহিত আগে ঘটে কি অমনসব ইন্দ্রিয়-অভিজ্ঞতা? ঘটে কি অনির্বচনীয় ইন্দ্রিয়ঘনত্ব, পুলক ও প্রশান্তি? কী জানি? যদিও আমরা জানি, প্রতিটি মৃত্যুর অভিজ্ঞতাই আলাদা, একক ও অনন্য। যদিও আমরা জানি, মৃত্যুর অভিজ্ঞতা যে ঠিক কেমন তা জীবিতের পক্ষে কখনো জানা সম্ভব হয় না, তবু মনে হয় কবির সজ্ঞা হয়তো-বা কখনো-কখনো সক্ষম হয় সেই অজ্ঞেয় অভিজ্ঞতাকে গ্রেফতার করতে।
যে-কোনো মোক্ষণের, যে-কোনো মোচনের-- হোক না তা দীর্ঘশ্বাসমোচন কিংবা রাগমোচন কিংবা বাকলমোচন কিংবা গর্ভমোচন-- তুঙ্গ মুহূর্তগুলি তো চূড়ান্তভাবে ইন্দ্রিয়ঘন। প্রাণবায়ু মোচনের তুঙ্গ মুহূর্তগুলিও নিশ্চয়ই ইন্দ্রিয়নিবিড়। মৃত্যুর ঠিক আগে, হয়তো লিবিডোর তাড়নায়, হয়তো এক অজ্ঞাত পুলক কিংবা যন্ত্রণার প্রেরণায় ঘনিয়ে আসতে থাকে সমস্ত ইন্দ্রিয়, যেন চতুর্দিক থেকে আয়োজন করে এই ঘনিয়ে আসা। অনুভূতিশক্তি সহসাই হয়ে ওঠে প্রবল, ঝাঁজালো। পরস্পর বদল ঘটতে থাকে ইন্দ্রিয়সমূহের। সমগ্র জীবন-জগৎ-নিসর্গ নিজেদের মেলে ধরে এক ঝটকায়, তাদের রূপ রস বর্ণ গন্ধ স্পর্শ ধ্বনি স্বাদ সবকিছু সূক্ষ্ম ও তুঙ্গ হয়ে আছড়ে পড়ে ইন্দ্রিয়গুলির ওপর, উপর্যুপরি এবং ঝলকে ঝলকে। সম্ভবত এরকমই হয়; কবিরা কি আঁচ করতে পারেন কিছুটা? কি জানি! হয়তো-বা।
৪.
‘মৃত্যুর আগে’ কবিতাটির রয়েছে সেই ধরনের প্রসাদগুণ যার সুবাদে একটি সৃষ্টিকর্ম উত্তীর্ণ হতে চায় এক আদর্শ শিল্পকর্মে। আদর্শ সৃষ্টিকর্মে আসলে কী ঘটে? বুদ্ধি, হৃদয় ও প্রজ্ঞাসহ সমস্ত বৃত্তির ঘটে সাম্য ও সামঞ্জস্য। ঘটে দর্শন, শ্রবণ, ঘ্রাণ, স্পর্শ ইত্যাদি সকল ইন্দ্রিয়ানুভূতির সুষম বিন্যাস। কোনো ইন্দ্রিয়ই আর থাকে না প্রধান কিংবা অপ্রধান। কোনো বৃত্তিই আর থাকে না প্রধান কিংবা অপ্রধান। এবং সমস্ত বৃত্তি ও ইন্দ্রিয়ানুভূতির সাম্য ও সুসঙ্গতি দিয়ে, মিলন আর মিথস্ক্রিয়া দিয়ে যেন এক সমগ্রতার দিকে, এক অখণ্ডতার দিকে ঘটে এক আয়োজিত অভিযাত্রা।
৫.
এতক্ষণ এত যে আলোচনা হলো, আলো ফেলার চেষ্টা হলো, হয়তো অনেক বাহুল্য-বাচনে ফেনিয়ে উঠল পৃষ্ঠা-- কিছু কি তাতে ধরা গেল কবিতার? কিছু কি স্পষ্ট হলো? হয়তো হলো কিছু। কিন্তু অনেকটুকুই থেকে গেল অধরা ও প্রহেলিকাপূর্ণ। আর সম্ভবত সেটুকুই কবিতা। তা ছাড়া আমরা তো জানিই, কবিতায় সৌন্দর্য যখন ঘন ও কেলাসিত হয়ে আসে, একটি কবিতা যখন যথার্থ কবিতা হয়ে উঠতে চায়, তখন তা অলক্ষ্যেই ছেড়ে দেয় সমস্ত ব্যাখ্যার দাবি। সে আর চায় না তাকে ঘিরে জমে উঠুক বেশি কথা ও কোলাহল। আর কোনো কথা নয়, এইবার সবগুলি ইন্দ্রিয় মেলে ধ’রে, পাতাবাহারের সবগুলি পাতা ও পতঙ্গ একসঙ্গে মেলে ধ’রে কবিতার মুখোমুখি ব’সে চুপচাপ অনুভব... শর্তহীন, আকারহীন, প্রশ্ন ও উত্তরহীন, বোবা...