‘ইট ইজ এজইফ ব্রেথস হিজ পোয়েমস বিফোর পুটিং দেইম অন পেপার। আই ফিল দ্যাট হিজ পোয়েমস এমার্জ ফ্রম হিজ লিপস র্যাদার দেন হিজ পেন।’- জনৈক সমালোচকের মন্তব্য
॥ ১ ॥
তাঁর একটি কাব্যগ্রন্থের ইংরেজি অনুবাদের ভূমিকায় অ্যালেন গিনসবার্গ (১৯২৬-১৯৯৭) লিখেছিলেন কো উন ইজ অ্যা ম্যাগনিফিসেন্ট পোয়েট. কম্বিনেশন অব বুদ্ধিস্ট কগনোসেন্টি পলিটিক্যাল লিবারেশন অ্যান্ড ন্যাচারাল হিস্টোরিয়ান।’ তিনি কবি, কথাসাহিত্যিক, প্রাবন্ধিক, সাহিত্য সমালোচক, রাজনৈতিক কর্মী, মুখর সরকার বিরোধী এবং অবসরপ্রাপ্ত বৌদ্ধ শ্রমণ। কোরিয়ার অন্য কবি লেখকরা তাঁকে ডাকেন “কেওবং” (উতুঙ্গ পর্বশৃঙ্গ) নামে। কিন্তু তিনি পাহাড়চূড়ার নিভৃত প্রাসাদে বসবাস করেন না, তাঁর অবস্থান দেশের সাধারণ মানুষজনের সঙ্গে। তাঁর নাম বিষয়ে একটি জরুরি কথা-“কো” তাঁর পদবি বা অন্তনাম; চিন বা জাপানের প্রথামতন কোরিয়াতেও পদবি দিয়ে নামের শুরু। তাঁর জন্মের সময় প্রদত্ত নাম “উন-তে”। অর্থাৎ পুরো নাম “নে-তে”; কবিতা লেখেন “কো উন” নামে।
পূর্ব এশিয়ার একটি গুরুত্বপূর্ণ দেশ কোরিয়া- চিনের সঙ্গে তার দীর্ঘ সীমান্ত; উত্তরে অল্প দূরত্বে রাশিয়া, দক্ষিণে কোরিয়া প্রণালী বেয়ে নৌকা ভ্রমণের দূরত্বে জাপান। মধ্য সাইবেরিয়ার প্রাগৈতিহাসিক মানুষ উষ্ণতার খোঁজে বেরিয়ে প্রথম বসবাস করতে শুরু করেন কোরিয়া উপদ্বীপে। ভাষা, ধর্ম ও সংস্কৃতিতে দেশটি চিনের কাছে ঋণী; খীষ্ট্রপূর্ব দ্বিতীয় শতাব্দীতে সেখানে প্রচলিত হয় চিনে লিখনলিপি; খ্রীষ্টাব্দ চতুর্থ শতাব্দীতে চিন থেকে আগত বৌদ্ধধর্ম। প্রাচীন ইয়োরোপের শিক্ষিত মানুষ শিখতেন চিনে ভাষা। কোরিয়ার নিজস্ব ‘হাঙ্গুল’ লিখনলিপি চালু হয়েছে অনেক শতাব্দী পরে।
বিংশ শতাব্দীর প্রথমার্ধে দেশটি মূলত জাপানের অধীন-কোরিয়ার রমণীদের প্রতিনিয়ত ধরে নিয়ে যাওয়া হত জাপানী সৈন্যদের যৌন ক্রীতদাসী হিসেবে। সেই অত্যাচারের ক্ষতচিহ্ন এখনো বিদ্যমান। দ্বিতীয় মহাযুদ্ধের পর দেশটি জাপানী অধীনতা থেকে মুক্ত হয়Ñউত্তরাংশ দখল করে সোভিয়েত রাশিয়া এবং দক্ষিণাংশ মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র। ‘শীতল সমর’ (কোল্ড ওয়ার) শুরু হওয়ার ফলে দেশটির আর এক হবার সম্ভাবনা থাকে না। ১৯৪৮ সালে উত্তর ও দক্ষিণ কোরিয়া নামে দুটি স্বাধীন রাষ্ট্রের সৃষ্টি এবং তারপর থেকেই যুদ্ধবিগ্রহ এবং রাজনৈতিক টানাপোড়েন। অদূর ভবিষ্যতে তার সমাধানের কোন সম্ভাবনা নেই।
॥ ২ ॥
কো উন-তে’র জন্ম ১৯৩৩ সালে কোরিয়ার উত্তর চুল্পা প্রদেশের কুনসান শহরের কাছাকাছি একটি গ্রামে। দেশটি তখন জাপানী সামরিক বাহিনীর কড়া শাসনে, নাগরিকদের মানবাধিকর সম্পূর্ণ অবদমিত। পিতা ও পিতৃব্যেরা শারীরিক পরিশ্রম করতেন ক্ষেতে-খামারে এবং রাতে বাড়ি ফিরে তেলের বাতি জ্বেলে পড়তেন পুঁথি পুরাণ অথবা চিনে ক্ল্যাসিকের কোরিয় অনুবাদ। শিশুদের শোনানা হত বীরগাঁথা ও কাহিনী। কো ছিলেন রুগ্ন এবং খুব রোগা, কিন্তু লেখাপড়ায় মনোযোগী। বড় হয়ে তিনি দেশের সম্রাট হতে চানÑ স্কুলে এই কথা বলার জন্যে একবার তিনি কঠোর শাস্তি পেয়েছিলেন জাপানী প্রধান শিক্ষকের হাতে। জাপানী পুলিস, মিলিটারি আর সরকারী অফিসারদের হাতে কোরিয়ার সাধারণ মানুষের অত্যাচার ও নির্যাতন খুব কাছ থেকে লক্ষ করেছেন তিনি এবং বিষয়টি তাঁর কবিতর থিম হিসেবে ফিরে এসেছে বারবার। মানবজীবনের উৎকর্ষ এবং মানবজাতির মর্যাদা ও সম্ভ্রম তাঁর কাছে পৃথিবীর যে কোন ধনরতœ ও সম্মানের চেয়েও বেশি কাম্য।
আরেকটি দুঃস্বপ্নের বিষয়ও তাঁকে ভীষণভাবে প্রভাবিত করেছেÑতা হল যুদ্ধ। তাঁর যখন খুব অল্প বয়েস তখন শুরু হয় দ্বিতীয় মহাযুদ্ধ-মানবতার অপমান, মানুষের নিষ্ঠুরতা ও হৃদয়হীনতা, মৃত্যু ও হত্যাÑ আত্মীয়, বন্ধু, শিক্ষক ও প্রতিবেশী-সব নীরবে সহ্য করতে হয় তাঁকে। ১৯৪৫-এর পর অল্প দিনের জন্যে শান্তি আসে এবং স্কুলের নিয়মিত লেখাপড়া চলে; তারপর আবার উত্তর ও দক্ষিণের বিবাদ, যার ফলশ্র“তি ১৯৫০ সালে কোরিয়ার যুদ্ধ। তাঁর পরিবারের অনেক সদস্যকে গভীর রাতে বাড়ির থেকে টেনে বের করে হত্যা করা হয়।
কিশোর কো-এর মনে প্রশ্ন -কেন এত মৃত্যু? কেন এত রক্তপাত? জীবনের অর্থ কী? কপিলাবাস্তুর শাক্যমুনির মতন তিনি ঘর ছেড়ে বেরিয়ে পড়েন পথে-অরণ্যে, উপত্যকায়, তুষার ধবল পর্বতেÑ জীবনের অর্থহীনতা নিয়ে তন্ময় ধ্যান। জীবিকা নির্বাহের জন্য পথের ফেরিওয়ালার কাজ অথবা ভিক্ষে; অল্প স্বল্প অপরাধমূলক কর্মও বাদ যায় না। সন্দেহজনক চরিত্র ভেবে তাঁকে ধরে পুলিস- সেই তাঁর একমাত্র অরাজনৈতিক কারাবাস; পরে অবশ্য বিনা অপরাধে এবং রাজনৈতিক কারণে জেলবাস ঘটবে আবার। এই অন্তহীন ও দিক-নির্দেশনাহীন ভ্রমণকালেই তাঁর সঙ্গে পরিচয় ও ঘনিষ্ঠতা হয় এক ভবঘুরে কুষ্ঠরোগী কবির। তাঁর কবিতা পড়েই তিনি কবিতা লেখার কথা ভাবতে শুরু করেন। তখন ১৯৫২ সাল, তার বয়েস ঊনিশ। প্রায় একই সময়ে তাঁর সঙ্গে অলৌকিক ভাবে পরিচয় হয় হিয়েকো নামে এক বৌদ্ধ ভিক্ষুর; হিয়েকো তাঁকে নিয়ে যান পূজ্যপাদ শ্রদ্ধেয় শ্রমণ হিওবং (১৮৮৮-১৯৫৬) কো তাঁর শিষ্যত্ব গ্রহণ করে দীক্ষা নেন ‘সন’ (অথবা জেন) বৌদ্ধ ধর্মে। গুরু তাঁকে উপদেশ দেনÑ তোমার অন্তরে আছে অনন্ত জ্যোতি, তাকে জ্বালিয়ে রেখো চিরকাল; তোমার শরীর ধ্বংস হলেও তা যেন না নেভে। সেই উপদেশ হৃদয়ে রেখে তাঁর কর্মজীবনের শুরু- প্রায় ছ’দশক পরেও তা জ্বলন্ত ও জাগরুক।
হিওবং এর বৌদ্ধ চৈত্যেই তাঁর নতুন জীবনের শুরু-অধ্যয়ন ও ধ্যান, ধর্ম ও তত্ত্বের গভীর আলোচনা, শিল্প ও সাহিত্যের চর্চা। পথের ভবঘুরে কবির বদলে মঠের বিদগ্ধ, শাস্ত্রবিদ, জ্ঞানগর্ভ কবি। তাঁর কবিজীবনের পথ পরিবর্তনের চিহ্নগুলিও স্পষ্ট- একই অঙ্গে বিভিন্ন কবির রূপ এমনই তাঁর কাব্যভাবনার রূপান্তর সময়ের সঙ্গে-প্রায় দশক ভাগ করে বর্ণনা করা যায় তাঁর অন্তর্নিহিত কবিসত্তাকে। ১৯৫২ থেকে ১৯৬২ তিনি শ্রমণ কবি; ১৯৬২ থেকে ১৯৭২ তিনি চরম নাস্তিবাদের (নিহিলিজম) কবি; ১৯৭২ থেকে ১৯৮২ তিনি সরকার বিরোধী রাজনৈতিক প্রতিবাদের কবি; ১৯৮৩ সালে জেল থেকে মুক্তি পাবার পর তিনি প্রধান কবি, শীর্ষস্থানীয় কবি, মানুষের অনুপ্রেরণার কবি। বর্তমান কালে বেসকারীভাবে হলেও তাঁকে বলা যেতে পারে কোরিয়ার জাতীয় কবি। প্রতি দশকে তাঁর নিজেকে পুনরাবিষ্কারের বিষয় নিয়ে প্রথম লিখেছিলেন মার্কিন কবি রবার্ট হাস (১৯৪১-); আর মার্কিন শ্রমণ-কবি গ্যারি স্পাইডার (১৯৩০) তাঁকে শ্রদ্ধা জানিয়েছেন কবিতায়।
॥ ৩ ॥
কো উন এর কাব্যগ্রন্থের সংখ্যাই শতাধিক; সব মিলিয়ে গ্রন্থসংখ্যা দেড়শোর বেশি- তাঁর স্মৃতি ও অভিজ্ঞতার ছবি সেই সব গ্রন্থের পাতায় পাতায়। কোরিয়ার মানুষের জীবনের এক গুরুত্বপূর্ণ মাইলফলক ‘কিলসুন’ (সত্তর বছর পূর্তি) তিনি পেরিয়ে এসেছেন বেশ কয়েক বছর আগে, কিন্তু এতটুকু শ্লথ হয়নি তাঁর কাব্য-রচনার গতি।
১৯৫২ সালে ‘হেইনসা মন্দির’ নামক বৌদ্ধ মঠে ভিক্ষুর জীবন শুরু করলেন তিনি। পরম আরাধ্য গুরু হিওবং এর বক্তৃতাগুলি নিয়মিত সম্পাদনার ভার পেলেন; কঠোর জেন তপস্যায় অনেকটা কাটলো তাঁর মানসিক বিষাদ ও তমসা। ১৯৫৭ সালে তিনি সূচনা করলেন একটি বৌদ্ধ সংবাদপত্রের- তার সম্পাদনার সঙ্গে সঙ্গে চললো কবিতা রচনা। মাঝে মাঝেই মঠ ছেড়ে বরিয়ে পড়তেন পদব্রজে দীর্ঘ ভ্রমণে, মাসের পর মাস ভিক্ষার মুঠি সম্বল করে। ১৯৬০ সালে প্রকাশিত হল তার প্রথম কাব্যগ্রন্থÑ‘পারমিতার অনুভূতি”। কবিতাগুলি একই সঙ্গে বৌদ্ধ এবং মানবিক-ভগবান বুদ্ধের বাণীর গূঢ় তত্ত্বের কাব্যিক উপস্থাপন, যা মানবিক আবেদনে সমৃদ্ধ। ১৯৯৩ সালে প্রকাশিত আত্মজীবনী “আমি” গ্রন্থে তিনি লিখেছেন তাঁর শ্রমণজীবনের দ্বন্দ্বকীর্ণ অথচ আবেগতাড়িত বিবরণ।
ক্রমশঃ তাঁর রাজনৈতিক ধ্যানধারণা ও মত প্রকাশের সঙ্গে বিবাদ লাগলো নিরাসক্ত শ্রমণজীবনের। ১৯৬৩ সালে “হানকুক-ইবলো” সংবাদপত্রে “হোয়ানসোক” (“ইহজাগতিক জীবনে ফেরা”) নামে একটি দীর্ঘ প্রবন্ধ লিখে তিনি ধর্মীয় জগত ছাড়লেন। কিন্তু গুরুর সঙ্গে নিবিড় আত্মিক সম্পর্ক বজায় রইলো। এই দশকটি তাঁর কাটবে ধর্ম বনাম সাহিত্য ও রাজনীতির দ্বন্দ্বে। তিনি লিখতে লাগলেন কঠোর বাস্তববাদী নাস্তিক কবিতা। একদিন প্রচুর মদ সঙ্গে নিয়ে জাহাজে উঠলেন, নেশাভাঙ করে জলে ঝাঁপ দেবেন বলে; কিন্তু নেশার ঘোরে অজ্ঞান হয়ে যাবার ফলে তা হয়ে উঠলো না। কিছু দিন বাস করলেন এক নির্জন দ্বীপে, তারপর দাতব্য বিদ্যালয় খুললেন দেশের দরিদ্রতম অঞ্চলে, নিজে হলেন তার অবৈতনিক হেডমাস্টার- তিনি ছাত্রদের পড়াতে ভালবাসতেন ভাষা, শিল্প ও সাহিত্য। ১৯৬৭ সালে রাজধানী সোল শহরে ফিরলেন, পর পর দুটি কাব্যগ্রন্থ প্রকাশ করলেন এবং আবার চেষ্টা করলেন আত্মহত্যার- হাসপাতালে তিরিশ ঘণ্টা কোমায় কাটিয়ে প্রাণে বেঁচে ফিরলেন।
১৯৪৮ সালে দেশটির দ্বিখন্ডিত স্বাধীনতার পর থেকে দক্ষিণ কোরিয়া সামরিক একনায়কতন্ত্রী শাসনে। পাশাপাশি চলেছে গণতন্ত্রের ও মানবাধিকার রক্ষার জন্যে আন্দোলন। ১৯৭০ সালে বস্ত্রশিল্পের শ্রমিক চোং তে-ইল এর অগ্নিকুন্ডে আত্মবিসর্জনের খবর সংবাদপত্রে পড়ে বিচলিত কবিও সেই আন্দোলনে সামিল হলেন। ১৯৭৪ থেকে ১৯৮০ সালের মধ্যে জেলে গেলেন পাঁচবার। ১৯৮২ সালে জেল থেকে মুক্তি পেয়ে প্রকাশ করলেন “কবিতা সমগ্র”। পঞ্চাশ বছর বয়েসে এই চিরকুমার, জিতেন্দ্রিয় সন্ন্যাসী বিবাহ করলেন ইংরেজি সাহিত্যের অধ্যাপিকা লি স্যাং-হোয়াকে। দুজনে ঘর বাঁধলেন ‘আনসং’ নামে এক মফস্বল শহরে। একমাত্র কন্যা চা-রিওং এর জন্ম ১৯৮৫ সালে।
গার্হস্থ্য জীবনে সবচেয়ে বড় সাফল্য এলো কবিতায়- রচনার পরিমাণ, ঘনত্ব ও গভীরতা- সবই বাড়লো। ১৯৮৪ সালে লিখতে শুরু করলেন “মানিম্বো”, যার বাংলা করলে দাঁড়াবে ‘জনজীবন” অথবা “দশ হাজার মানুষের পারিবারিক গাঁথা”Ñ তাঁর জীবনের কথাবার্তা অথবা কবিতায় স্মৃতিচারণা। ১৯৮৬ সালে প্রকাশিত হল প্রথম খণ্ড, তারপর একে একে আরো পঁচিশটি- এইভাবেই জন্ম হয় প্রচলিত কাহিনীরÑ তাঁর প্রতিটি শ্বাস-প্রশ্বাসই এক একটি কবিতার পঙ্ক্তি।
॥ ৪ ॥
কখনও ভাবি
যে তিনি অতিথি
কখনও ভাবি
যে তিনি গৃহকর্তা
বহু বছর ধরে
স্বপ্নে দেখেছি গেরস্থের
চিমনি থেকে বেরোয় ধোঁয়া
কিন্তু এখনও উপলব্ধি করিনি
কবিতা কাকে বলে।”
“আগামীকালের গান” নামের তাঁর একটি নির্বাচিত কবিতা সংকলনের ভূমিকা লিখতে শুরু করেছিলেন তিনি এই কবিতাটি দিয়ে। কবিতাই তাঁর জীবন, কবিতা নিয়েই তাঁর দিন কাটে। পঞ্চাশ হাজার পঙ্ক্তির এক মহাকাব্য লিখেছেন “পেকটু পর্বত” নামেÑতাতে জাপানের বিরুদ্ধে কোরিয়ার স্বাধীনতা সংগ্রামে সাধারণ মানুষের ত্যাগ ও বীরত্বের মহান কাহিনী।
১৯৯২ সালে দেশে গণতন্ত্রের সূচনা হলে তাঁর সময় এলো স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলার। অনুমতি পেলেন বিদেশ যাত্রার; তারপর থেকে তাঁর যাতায়াত পৃথিবীর বিভিন্ন প্রান্তে; কিন্তু নিজের জন্মস্থান উত্তর কোরিয়ায় যাওয়া নিষেধ। তিনি কবিতায় কল্পনা করেন উত্তর ও দক্ষিণ এক হওয়ার কথা। ১৯৯৭ সালে রাষ্ট্রপতি নির্বাচিত হলেন তাঁর কারাগারের বান্ধব কিম জে দং(১৯২৫-২০০৯)। দুই কোরিয়ার বন্ধুত্বমূলক শীর্ষ সম্মেলনে অংশ নিতে তিনি সঙ্গ দিলেন দেশনেতাকে। ফিরে আসার পর ২০০০ সালে প্রকাশিত হল নতুন কাব্যগ্রন্থ “উত্তর ও দক্ষিণ”।
কবিতাই তাঁর জীবন, জীবনই কবিতা। সাম্প্রতিকতম কাব্যগ্রন্থ “সমুদ্র হীরক পর্বতে”র মুখবন্ধে তিনি লেখেন, ‘কেউ যদি আমার মৃত্যুর কয়েক বছর পর আমার সমাধি উন্মুক্ত করে তো দেখবে সেখানে আমার অস্থি নয়, কবিতায় কবিতায় পূর্ণ হয়ে আছে, যেগুলো রচিত হয়েছে কবরের অন্ধকারে।’ ৮৩ বছর বয়েসেও তিনি অচঞ্চল, সক্রিয়, সৃষ্টিশীল। তাঁর দীর্ঘ জীবন কামনা করি।
শীতের আকাশ /কো উন (১৯৩৩-)
কী ব্যথাতুর নীল রঙ!
চিৎকার করে জানান দেয়,
কিন্তু শোনা যায় না কিছু।
কী ব্যথাতুর নীল রঙ!
পাখিদের ওড়াওড়ি দিনের পর দিন।
ঝিঁঝিঁর গুঞ্জন
আমি ঝিঁঝিঁর গুঞ্জন বন্ধ হতে শুনি
এখন হেমন্তের শেষ,
আমি শুনি
পৃথিবীতে জন্ম নেবার আগে
ঝিঁঝিঁর জীবনবৃত্তান্ত।
না,
এই জন্মের না, পরজন্মের।
আমার এখন এই ঊনষাট বছর বয়েসে।
ক্যাঙারু
ব্রিটিশরা অস্ট্রেলিয়ার মাটিতে নেমে
একজন ভূমিজ মানুষকে শুধোয়,
“ওই যে জন্তুটা লাফ দিয়ে পালালো,
তার নাম কী?”
মানুষটি বিনীতভাবে বলে,
“আমি জানি না, ক্যাঙারু,
তোমার কথা বুঝলাম না আমি।”
ব্যস, থেকে গেল নামটি।
আহা, জ্ঞান লাভের চেয়ে
অজ্ঞানতার কদর বেশি।
টীকাঃ অস্ট্রেলিয়ার একটি প্রচলিত কাহিনী (যার সত্যতা বিষয়ে অনেকেই সন্দিহান) Ñ সেখানে জাহাজ নোঙর করে মাটিতে নেমে ক্যাপটেন কুক (১৭২৮-১৭৭৯) এবং জোসেফ ব্যাংকস (১৭৪৩-১৮২০) প্রথম এই প্রাণীটিকে দ্যাখেন এবং একজন স্থানীয় অধিবাসীকে জিজ্ঞেস করেন তার কথা। লোকটি উত্তর দেয় “ক্যাঙারু” অর্থাৎ “তোমার কথা বুঝলাম না আমি”। সেই ভুল বোঝাবুঝিতেই প্রাণীটির নামকরণ।
ঠাকুর্দার উপদেশ
পাহাড়কে দেখে শেখো,
নদীর থেকে শেখো,
ডেস্কের বই থেকে নয়।
ছিঃ ছিঃ।
বাইরে যাও, খেলো।
যখন মা ডাকবে
সন্ধেবেলা
চেঁচিয়ে জবাব দাও আর ঘরে ফেরো।
ছিঃ ছিঃ।
বনের মধ্যে
গোধূলিতে বনের পথে
আমরা দুজন, শিশুটির
শক্ত হাতে ধরা, আমার হাত।
দুজনে এক হয়ে,
শক্তহীন হেঁটে হেঁটে,
বনের গভীরে ঢুকি।
সেখানে দাঁড়িয়ে আমার শৈশব,
ঠিক যেমনটি ফেলে এসেছিলাম তাকে,
লাফিয়ে পালায় একাকী হরিণ।
ভুলে যাওয়া
সবাই ভোলে কিছু না কিছু।
পুরানো দিনের ভুলে যাওয়া সামগ্রী
জমে জমে,
ভরে ওঠে হৃদয়
পাহাড় থেকে উড়ে আসা অর্থহীন ধুলোর মতন।
প্রথম
ডিম ফুটে বেরিয়ে মুরগিছানা
যাকে প্রথম দ্যাখে তাকেই মা বলে ডাকে।
সে কাক অথবা সারস
অথবা যাই হোক।
নিজের মা না হলেও চলবে।
মা, আমাদের প্রথম চিত্তবিভ্রম কী
তোমার আমার মধ্যে?
পরজন্ম
পরের জন্মে
কিছুতেই আর মানুষ হয়ে ফিরতে চাই না।
পরের জন্মে
যে কোনো প্রাণীর রূপ পেলেই চলবে।
বিশালবপু চাই না;
খুদে একটা কিছু।
এমন কী এত ছোট
যে চোখেই দেখা যায় না।
অ্যামিবা হলেও ক্ষতি নেই।
কিছুদিন আগেও অন্য রকম ভাবতাম।
তখন আপত্তি ছিল না মনুষ্যজন্মে
তবে পুরুষ নয়
গ্রামের এক অশিক্ষিত নারী, যার
এগারোটি সন্তানের কয়েকটি মরেছে আঁতুড়ে।
সেই নারী হয়ে ফিরে এলেই চলত।
কিন্তু আর ফিরতে চাই না মনুষ্যরূপে কোনোদিন।
তেমাথা ঈগল
তেমাথা ঈগল
এক মাথা সামনে তাকায়,
এক মাথা পেছনে,
তৃতীয় মাথা বেঁকেচুরে দ্যাখে
ওপরে আর নীচে।
উড়ে যান আকাশে মেঘের ওপারে
তিনিই উপযুক্ত ব্যক্তি
তিনিই উপযুক্ত ব্যক্তি
চোসান আমলাদের অসাধু কীর্তিকলাপে
নজর রাখার জন্যে,
আগুনভরা চোখে তিনি শূন্য থেকে নেমে আসেন
বজ্র ওষ্ঠে ছিন্ন ভিন্ন করেন তাদের নাড়িভুঁড়ি।
চারশো বছরের চোসান সাম্রাজ্যে,
দুশো বচরের সৎ রাজ্যশসনের পর,
তিনি বেছে নেন দুর্নীতিপরায়ণ অফিসারদের
কোতল করেন জনগণের নামে।
মাথা উঁচু রাখো গর্বে।
মানুষের ন্যায্য আশা-আকাক্সক্ষা
তিক্ত মেঘের গর্জনে ঢাকা পড়লে
তেমাথা ঈগল ফিরে আসবেনই।
টীকাÑ চোসান সাম্রাজ্যÑ কোরিয়ার শেষ রাজবংশ (১৩৯২-১৯১০)। তার পরে দেশটি জাপানের অধীন হয়।
জেন কবিতা
প্যাঁচা
দুপুরবেলায় প্যাঁচা
গোল গোল চোখ খুলেও
দ্যাখে না কিছু।
সবুর কর, বাছা
সন্ধে আসছে।
শিশু
তোর জন্মের অনেক আগে
তোর বাবার জন্মের আগে
তোর মায়েরও জন্মের আগে
তখনই কেঁদে উঠলি তুই।
মাতাল
কখনোই একা মানুষ নয় আমি,
সঙ্গে আছে ছ’হাজার কোটি জীবকোষ!
কিন্তু তাদের খবরদারি করতে হয় আমাকে
ছ’হাজার কোটি জীবকোষ,
মাতাল সবাই!
মশা
মশা, তুমি কামড়ালে।
ধন্যবাদ!
আহা বেঁচে থাকার সুখ।
খশ খশ, চুলকোই।
বন্ধু
তোর হাতে খোঁড়া গর্তের মাটি দিয়ে
বুদ্ধের মূর্তি বানাই।
আবার বৃষ্টি শুরু হলে
বুদ্ধ বনে যান কাঁদা।
নির্মেঘ আকাশের কী প্রয়োজন?
আদিবাসী
আফ্রিকার আদিবাসীদের মুখে
সারা জীবনে
বড় জোর এক ডজন শব্দ
পিতা, পুত্র আর পুণ্য আত্মা মিলে আদিবাসী।
টীকা
সংস্কৃত “ধ্যান” শব্দ থেকে জাপানি “জেন” শব্দ। কোরিয় ভাষায় তাকে বলে “সন”। বাংলায় বোধগম্যতার সুবিধের জন্যে “সন কবিতা” এর বদলে “জেন কবিতা” ব্যবহার করেছি।
সব কবিতাগুলির কোরিয় ভাষা থেকে ইংরেজি অনুবাদ করেছেন ক্লেয়ার উ এবং রিচার্ড সিলবার্গ।